নানা কারণেই সম্পর্কের টানাপড়েন ও বিয়েবিচ্ছেদ হয়। এরপর আইনি বিধানমতে আসে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে দেনমোহর, স্ত্রী ও নাবালক সন্তানের ভরণপোষণ প্রসঙ্গ। সমাধান না হলে সবচেয়ে বড় ভরসা পারিবারিক আদালত। কিন্তু সেখানেও দুর্গতির শেষ নেই। মামলার অসহনীয় দীর্ঘসূত্রতা, জট, একটার পর একটা আইনি ধাপ, অযাচিত খরচ, আদালতের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে হরহামেশাই। বছরের পর বছর এক মামলা থেকে আরেক মামলা, সংশ্লিষ্ট পারিবারিক আদালত থেকে পারিবারিক আপিল আদালত। সেখান থেকে উচ্চ আদালত। উচ্চ আদালত থেকে আবার অধস্তন আদালত। ‘ভাগ্যক্রমে’ কোনো বাদীপক্ষ দেনমোহর ও ভরণপোষণের রায় পেলেও তা কার্যকরে আবারও মামলা। এই মামলাও চলে বছরের পর বছর। ভুক্তভোগীদের জন্য মামলার যন্ত্রণা কতটুকু চূড়ান্ত পর্যায়ে যেতে পারে তার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
বাগেরহাট সদরের এক তরুণীর সঙ্গে একই জেলার এক যুবকের (সামাজিক- পারিবারিক কারণে নাম ও পরিচয় প্রকাশ করা হচ্ছে না) বিয়ে হয় ২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। দেনমোহর নির্ধারণ হয় ১ লাখ টাকা (১৫ হাজার টাকা উসুল)। ২০১৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর তাদের এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। এক পর্যায়ে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়। এরপর দেনমোহরের ৮৫ হাজার টাকা ও ভরণপোষণের দাবিতে বাগেরহাটের পারিবারিক আদালতে মামলা করেন ২০১৬ সালের ২৪ জানুয়ারি। ২০১৭ সালের ৭ নভেম্বর আদালত এক রায়ে ৮৫ হাজার টাকা ও ভরণপোষণে মাসিক ১১ হাজার টাকা দিতে বিবাদীকে নির্দেশ দেয় আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে বিবাদী ২০১৮ সালের শুরুতে জেলার পারিবারিক আপিল আদালতে আপিল করলে সেটি নামঞ্জুর হয়। ২০১৯ সালে বিবাদী হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন আবেদন করেন। ২০২১ সালের ১৪ নভেম্বর হাইকোর্ট পারিবারিক আপিল আদালতের রায়টি বহাল রাখে। এরপর পারিবারিক আপিল আদালতের রায় কার্যকর করতে ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট অর্থপ্রাপ্তির মোকদ্দমা (এক্সিকিউশন সুইট) করেন বাদী। এ মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে পারিবারিক আদালতে বিবাদীর করা আবেদন একই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর নাকচ হয়। এ আদেশের বিরুদ্ধে জেলা আদালতে (দেওয়ানি) আপিল করেন বিবাদী। ওই আবেদনও বিবাদীর বিপক্ষে যায়। এরপর জেলা আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে বিবাদীর ২০২৩ সালে হাইকোর্টের রিভিশন আবেদন এখনো বিচারাধীন। পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সালে যে মামলার শুরু তা শেষ হয়নি সাড়ে ৯ বছরেও। দেনমোহর ও ভরণপোষণের জন্য একটি মামলার জেরে বাদী ও বিবাদী উভয়পক্ষে ৭টি মামলা হলেও ফলাফল এখনো শূন্য।
ভুক্তভোগী ওই নারীর সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেছে দেশ রূপান্তর। অসচ্ছল হওয়ায় তাকে আইনি সহায়তা দিয়ে আসছে সুপ্রিম কোর্ট ও জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি। তিনি বলেন, মেয়েটির বয়স এখন প্রায় ১০ বছর। সে বাগেরহাটে স্থানীয় একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। মেয়েকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাবার বাড়িতে আছি। স্থানীয় একটি এনজিওতে মাঠ পর্যায়ে কিছু কাজ করে মাসে কয়েক হাজার টাকা পাই। লিগ্যাল এইড আইনি সহায়তা দিলেও মামলার নথিপত্র জোগাড়সহ বিভিন্ন কাজে বছরের পর বছর আদালতে টাকা খরচ করতে হচ্ছে। ঢাকায় যাওয়া ও অন্য খরচ চালিয়েছি হাঁস, মুরগি, ডিম, ছাগল বিক্রি করে।
মামলার ভবিষ্যৎ ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘৯ বছর ধরে কোর্টে ঘুরছি। অনেক ক্ষতি হয়েছে আমার। কিন্তু সমাধান হয়নি। আরও কত ঘুরতে হবে কে জানে।’ দেনমোহর ও ভরণপোষণের মামলা নিয়ে উচ্চ ও অধস্তন আদালতের ৭ জন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছে দেশ রূপান্তর। তারা পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, মামলাকে অনেকে শেষ ভরসা মনে করলেও বাস্তবতা একেবারেই জটিল।
মামলায় যন্ত্রণা কমে না, বাড়ে : সারা দেশে পারিবারিক আদালত রয়েছে ৭০টি। এর মধ্যে ঢাকায় তিনটি। সুপিম কোর্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত পারিবারিক আদালতগুলোতে এখন বিচারাধীন মামলা ৭৩ হাজার ৫০৯টি। এর মধ্যে পাঁচ বছর বা এর বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলা ৪ হাজার ৫৮টি। তবে, বিচারাধীন মামলার মধ্যে দেনমোহর ও ভরণপোষণের মামলা কতগুলো সেই পরিসংখ্যান আইন ও বিচার সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরে সুনির্দিষ্ট করা হয় না। তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার তিনটি পারিবারিক আদালতে বিচারাধীন মামলা ১০ হাজার ৬৩। অর্থাৎ তিনটি আদালতে গড়ে বিচারাধীন মামলা ৩ হাজারের বেশি। আইনজীবীরা বলেন, মামলার বড় একটা অংশ জুড়ে আছে দেনমোহর ও ভরণপোষণ সংক্রান্ত। আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা বলেন, একেকটি আদালতে প্রতি কর্মদিবসে গড়ে ১০০ বা এর কমবেশি মামলার শুনানি হয়। তবে, দীর্ঘদিন ধরে ছোট পরিসরের এজলাস ও এর পরিবেশ নিয়ে আপত্তি রয়েছে বিচারপ্রত্যাশী ও আইনজীবীদের। রয়েছে বিচারক ও এজলাস সংকট। এছাড়া কর্মদিবসে অসংখ্য মানুষের সমাগম, প্রচ- গরম, প্রতিকূল পরিবেশে নারী ও শিশুদের ভয়ংকর বাজে অভিজ্ঞতা হয়। সুপ্রিম কোর্ট ও ঢাকার পারিবারিক আদালতে নিয়মিত শুনানি করেন এমন একজন আইনজীবী নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘মামলা নিয়ে প্রথম এক বছর দুই পক্ষই থাকে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে। কিন্তু বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, আর্থিক খরচ ও ভোগান্তিতে পরের বছর থেকে উৎসাহ কমতে থাকে। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, একবার মামলা হয়ে গেলে কেউ আর হারতে চান না। এক ধরনের ‘ইগো’ বা জেদ কাজ করে পক্ষদের মধ্যে। কিন্তু এ মানসিকতা ক্ষতি করে প্রকৃতপক্ষে যারা ভুক্তভোগী তাদের।’
সময়ের আবেদনে বাড়ে বিলম্ব : আইনজীবী ও ঢাকার তিনটি পারিবারিক আদালতে শুনানিকারী আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা বলেন, বিচারের বিলম্বতা বা দীর্ঘসূত্রতা দুটিই বাড়ে সময়ের আবেদনে। বিশেষ করে বিবাদীপক্ষের আবেদনে। তবে, বিবাদীপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী একাধিক আইনজীবী বলেন, বিবাদীপক্ষকে সুরক্ষা দেওয়াই তাদের মূল লক্ষ্য। তরুণ একজন আইনজীবী নিজের পরিচয়, পারিবারিক ও সামাজিক কারণে পক্ষদের নাম, পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে একটি মামলার উদাহরণ তুলে ধরেন। ২০১৯ সালে মতিঝিলের এক তরুণীর সঙ্গে উত্তরার এক যুবকের বিয়ে হয়। যুবকটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায় ২০২০ এর সেপ্টেম্বরে। এরপর দেনমোহর পেতে ওই নারী মামলা করেন ঢাকার তৃতীয় সহকারী জজ পারিবারিক আদালতে। কিন্তু ২০২০ সালের জানুয়ারিতে হওয়া এ মামলার বিবাদীপক্ষে জবাব দেওয়া হয় পাঁচ বছরের বেশি সময় পর গত ৫ ফেব্রুয়ারি। এই দীর্ঘ সময়ে অন্তত ৩০ বার সময় নেওয়া হয়েছে। ওই আইনজীবী বলেন, ‘আমি তো বিবাদীর আইনজীবী। তাকে আইনি সুরক্ষা দেওয়াই আমার কাজ। আর পারিবারিক আদালত আইন ও মামলাগুলোর এমন অবস্থা যে চাইলে এই মামলা ১০/১৫ কিংবা ২০ বছর পর্যন্ত চালিয়ে নেওয়া যাবে।’
প্রতিবেদনের শুরুতে উল্লিখিত ভুক্তভোগী নারীকে আইনি সহায়তা দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটা পর্যায়ে দেখা যায় সন্তান বড় হয়ে গেছে। কিন্তু দেনমোহর ও ভরণপোষণের মামলা রয়েই গেছে। শিশুরা বাবা ও মায়ের বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক দেখে নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে বড় হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘মামলা করতে গিয়ে কেন এমন পরিস্থিতি তা নিয়ে আলোচনা, গবেষণা হয় না। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এর কারণ ও প্রতিকার খুঁজে বের করার দায়িত্ব যাদের তাদের উদ্যোগও চোখে পড়ার মতো নয়।’
মেডিয়েশনে মনোযোগ কম : বিশেষজ্ঞরা সবসময়ই বলেন, মধ্যস্থতায় (মেডিয়েশন) বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআর’র (অলটারনেটিভ ডিসপুট রেজুলেশন) মাধ্যমে মামলা-পূর্ব ও মামলা-পরবর্তী বিরোধ নিষ্পত্তি একটি সহজতম, আলোচিত ও যুগোপযোগী পদ্ধতি। মামলার জট হ্রাস, পক্ষদের অর্থ সাশ্রয় ও ভোগান্তি কমাতে এ পদ্ধতি এখন সর্বজনবিদিত। তবে, সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশের পারিবারিক আদালতগুলোতে সাড়ে ৭৩ হাজার মামলার বিপরীতে এডিআরের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৯৯৩টি মামলায়। মামলার সংখ্যার আধিক্য ও ভোগান্তির বিপরীতে এ চিত্র একেবারে সাদামাটা বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান মনে করেন, এজলাস ও বিচারক বাড়ানো, আদালতের অবকাঠামো সংকট দূর করাসহ পরিবেশ উন্নত করতে হবে। পাশাপাশি মেডিয়েশনের ওপর জোর দিতে হবে। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘বিচারক সংকটসহ অবকাঠামো এত দুর্বল যে মামলা পরিচালনা করার মতো পরিবেশ থাকে না। বিচারকরা চাইলেও সময়ের ঘাটতিতে মেডিয়েশনের প্রয়োগটা তেমনভাবে করতে পারেন না। পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হলে অবশ্যই এ বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে।’