রোববার, ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

উপেক্ষার পরও দফায় দফায় চেষ্টা

আপডেট : ১৩ জুন ২০২৫, ১২:১৪ এএম

ইসরায়েলের একটানা আগ্রাসনের মুখে যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের গাজা একদিকে যেমন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, অন্যদিকে ত্রাণ প্রবেশে অবরোধ আরোপ করে মানবিক সংকট চরমে নিয়ে গেছে। ফলে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের জীবন বাঁচানোর প্রচেষ্টায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গাজায় অবিলম্বে, বিনা শর্তে ও স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতির খসড়া প্রস্তাবের ওপর ভোটের আয়োজন করে। কিন্তু এরই মধ্যে এই প্রস্তাবে ভেটো দেওয়ার কথা জানিয়েছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে গত সপ্তাহে নিরাপত্তা পরিষদেও একই ধরনের প্রস্তাব এসেছিল। তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোয় বাতিল হয়ে যায়। প্রায় দুই বছর আগে গাজায় নতুন করে সংঘাত শুরুর পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের জীবন বাঁচানোর প্রচেষ্টায় এগিয়ে এসেছে বৈশ্বিক এই সংস্থাটি। কিন্তু ১৯৩ দেশের এ সংস্থার সব প্রচেষ্টাই এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। তা সত্ত্বেও হাল ছাড়েননি মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও তার সংস্থা। তবে কেন গাজায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয় সে বিষয়ে আলোকপাত করা যাক।

সাধারণ পরিষদের পূর্ববর্তী উদ্যোগ : এর আগেও সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করেছে। তবে সব প্রচেষ্টা উপেক্ষিত থেকেছে। সাধারণ পরিষদে নিরাপত্তা পরিষদের মতো ভেটো প্রক্রিয়া যেমন নেই, তেমন নেই এর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা। ২০২৩ সালের অক্টোবরে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ১২০টি দেশ অবিলম্বে গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতি চালুর প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। সে বছরের ডিসেম্বরে একই ধরনের আরেক প্রস্তাবে সায় দেয় ১৫৩ দেশ। এরপর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে অবিলম্বে, বিনা শর্তে ও স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের পক্ষে ১৫৮ ভোট পড়ে।

প্রস্তাব পাস হলেও বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা নেই : কূটনীতিকরা বলছেন, এবারের প্রস্তাবটি ১৯৩ সদস্যের সাধারণ পরিষদে বড় আকারে সমর্থন পেয়ে পাস হতে যাচ্ছে। সাধারণ পরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাব বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা নেই। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন কূটনীতিকরা। এই ভোটের সিদ্ধান্তে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের বিষয়ে বৈশ্বিক জনমতের প্রতিফলন পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন তারা।

ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা : তবে যথারীতি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। সপ্তাহ জুড়ে দেশটি এই প্রস্তাবের বিপরীতে অন্যান্য দেশের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে কূটনীতিক তৎপরতা চালিয়েছে। তেল আবিবের ভাষ্য, এই প্রস্তাব ‘রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ও প্রহসনমূলক’। প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি হামাসের হাতে জিম্মিদের মুক্তি, ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তি ও গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা শতভাগ প্রত্যাহারের বিষয়গুলোও আছে। প্রস্তাবে অবাধ ত্রাণের প্রবাহ নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে এবং বেসামরিক মানুষকে অনাহারে রাখাকে যুদ্ধ জয়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহার, অবৈধভাবে মানবিক ত্রাণের প্রবাহ বন্ধ করা ও বেসামরিক মানুষকে জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যক উপকরণ থেকে বঞ্চিত করার প্রতি তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। তবে এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে ইসরায়েল। বিশ্ব সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সতর্কতা সত্ত্বেও এ অভিযোগকে ‘একই সঙ্গে মিথ্যা ও অবমাননাকর’ বলে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছে পাঠানো এক চিঠিতে দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন। একই সঙ্গে জাতিসংঘের খসড়া প্রস্তাবকে ‘অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ ও ক্ষতিকারক’ বলে অভিহিত করে সদস্য দেশগুলোকে এই ‘প্রহসনমূলক’ উদ্যোগে অংশ না নেওয়ার আহ্বান জানান ড্যানন। তার ভাষায়, এই প্রস্তাব জিম্মি-বন্দি মুক্তির দরকষাকষিকে অবমাননা করছে এবং এটি হামাসকে নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।

নিরাপত্তা পরিষদের যত উদ্যোগ : সাধারণ পরিষদের পাশাপাশি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও গাজায় শান্তি প্রচেষ্টা বারংবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অন্তত নয়বার গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত প্রস্তাব আনা হয়। পাঁচবার ভেটো দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাঁচটি প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। ২০২৩ সালের ১৮ অক্টোবর ও ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ও ২০ নভেম্বর এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালের ৪ জুন ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা পরিষদে মানবিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ওঠে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো না দিলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক (নয়টি) ভোটের অভাবে প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। রাশিয়ার ওই প্রস্তাবের পক্ষে পাঁচ ও বিপক্ষে চারটি ভোট পড়ে। ভোটদানে বিরত থাকে ছয় দেশ। এরপর ১৮ অক্টোবর ব্রাজিলের আনা প্রস্তাবে ১২ দেশ সায় দিলেও যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেয়।

১৫ নভেম্বরের প্রস্তাবে যুদ্ধবিরতির বদলে ‘সাময়িক বিরতির’ কথা বলা হয়। এই প্রস্তাবে ভেটো পড়েনি। তবে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নও হয়নি। এতে ১২ দেশ ভোট দেয় ও তিন দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ৮ ডিসেম্বর আরব আমিরাতের আনা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবেও ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আলজেরিয়ার প্রস্তাবেও ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ওই ভোটে ১৩ দেশ যুদ্ধবিরতির পক্ষে রায় দেয়। যুক্তরাজ্য ভোটদানে বিরত থাকে। একই বছরের ২৪ মার্চ রমজান মাসে ‘সাময়িক যুদ্ধবিরতির’ প্রস্তাবের পক্ষে ১৪ দেশ ভোট দেয়। ভোট দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। তবে ওই যুদ্ধবিরতিও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন হয়নি।

একই বছরের ১০ জুন যুক্তরাষ্ট্রের ‘তিন ধাপে’ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের পক্ষে ১৪ দেশ সায় দেয়। রাশিয়া ভোট দেয়নি সেবার। ওই প্রস্তাবে কাতারের মধ্যস্থতায় হামাস-ইসরায়েলের মধ্যে দরকষাকষির পক্ষে মত দেওয়া হয়। তবে দুই পক্ষ এক মত না হওয়ায় সেই উদ্যোগও আলোর মুখ দেখেনি। ২০২৪ সালের ২০ নভেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের ১০ নির্বাচিত সদস্য রাষ্ট্রের আনা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ১৪ দেশ রাজি থাকলেও ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ এ বছরের ৪ জুন আবারও ‘ই-১০’ নামে পরিচিত ওই ১০ দেশের আনা প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো-খড়গে বলি হয়। ফলে এটি বলাই যায় যে, জাতিসংঘ ও তার সদস্য রাষ্ট্রদের সব ধরনের যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টাই যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে এটি স্পষ্ট যে, ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলের স্বার্থরক্ষা করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র; সেটি জাতিসংঘের শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে ভেটো দিয়ে বা অন্যান্য প্রক্রিয়ায় বানচালের মাধ্যমে।

আবারও ত্রাণকেন্দ্রে ইসরায়েলি হামলা : ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলি ভূখণ্ডে অতর্কিত হামলা চালিয়ে এক হাজার ২০০ ব্যক্তিকে হত্যা করে হামাস। তাদের হাতে জিম্মি হয় প্রায় ২৫০ জন। সেদিনই গাজায় প্রতিশোধমূলক ও নির্বিচার সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। মাঝে দুই দফায় অল্প দিনের যুদ্ধবিরতি বাদে পুরো সময়টা ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত আছে। এসব হামলায় ৫৫ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ইসরায়েলের আকাশ, নৌ ও স্থলপথে পরিচালিত হামলায় গাজার বেশিরভাগ অংশই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

ফিলিস্তিনের গাজায় দুটি ত্রাণকেন্দ্রের কাছে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ৪০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ২০০ জন। দুটি ত্রাণকেন্দ্রই পরিচালনা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলসমর্থিত বিতর্কিত ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ)। এ নিয়ে বিতর্কিত সংস্থাটির ত্রাণ নিতে গিয়ে দেড় শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার জরুরি পরিষেবা বিভাগ সিভিল ডিফেন্সের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, বুধবার মধ্য গাজার ‘নেৎজারিম করিডর’ এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রসমর্থিত একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালায়। এতে ৩১ জন নিহত হন। এ ছাড়া গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফা এলাকায় ত্রাণকেন্দ্রের কাছে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে আলজাজিরা জানিয়েছে। নাসের হাসপাতালের বরাত দিয়ে এ কথা জানানো হয়। গুলিবর্ষণের কথা স্বীকার করে বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ টেলিগ্রামে একটি বিবৃতি দিয়েছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। এতে বলা হয়, নেতজারিম করিডর এলাকায় রাতে সেনারা ‘সতর্কতামূলক গুলি’ চালিয়েছে।

বেঁচে গেলেন নেতানিয়াহু : ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জোট সরকার ভেঙে দিতে পার্লামেন্ট যুদ্ধ। বিরোধীদের আনা একটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটের ১২০ সদস্যের মধ্যে ৬১ জন বিলের বিপক্ষে ভোট দেন এবং ৫৩ জন পক্ষে ভোট দেন। বিলটি পাস হলে ইসরায়েলে আগাম নির্বাচনের পথ খুলে যেত এবং নেতানিয়াহুকে সড়ে দাঁড়াতে হতো। এই ভোটে ব্যর্থ হওয়ার ফলে বিরোধীদের এখন আবার একই ধরনের বিল আনতে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত