সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

গানের সুরে মনে পড়ে স্মৃতি

আপডেট : ১৬ জুন ২০২৫, ০৩:৫৫ এএম

আপনার কি কখনো এমন হয়েছে হঠাৎ পুরনো কোনো গান শুনে মনটা উদাস হয়ে গেল? মনে হলো, যেন সেই পুরনো দিনটা আবার ফিরে এসেছে? স্মৃতিকাতরতা এবং মানুষের জীবন নিয়ে এই লেখা। লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব

কেন এমন হয়? কেন সংগীত আমাদের স্মৃতিগুলোকে খুলে বসিয়ে দেয়? কেন গান শুনলে কখনো আনন্দে মনটা নেচে ওঠে, আবার কখনো অদ্ভুত বিষন্নতা গ্রাস করে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা পৌঁছে যাই আরও গভীর এক প্রশ্নে ‘আমি কে?’

আপনি আসলে কে?

আমরা নিজের শরীরটাকেই ‘আমি’ বলে মনে করি, তাই তো? কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, শরীর বলে যেটাকে আমরা চিনি, সেটাও আসলে প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে। আপনি জানেন কি? প্রতিদিনই আপনার শরীর থেকে পরমাণু হারিয়ে যায়, আবার নতুন পরমাণু এসে যোগ হয়। গড়ে প্রায় পাঁচ বছরে আপনার শরীরের সব পরমাণু একেবারে পাল্টে যায়। মানে দাঁড়াল যেই আপনি এখন আছেন, সেই ‘আপনি’র শরীর পাঁচ বছর আগে অন্যরকম ছিল। এই তথ্যটা ভাবলে একটু অবাক লাগতে পারে, কিন্তু সত্যি। তাহলে কীভাবে আপনি ‘আপনি’ হয়ে থাকলেন? এর উত্তর লুকিয়ে আছে স্মৃতি আর পরিচয়ের ভেতরে।

আপনি প্রতিদিন বদলে যাচ্ছেন চেহারা, অভ্যাস, স্বপ্ন, বন্ধুবান্ধব সবই বদলায়। কিন্তু আপনার স্মৃতিগুলোই আপনাকে ধরে রাখে। আপনার গল্পগুলো, আপনার অভিজ্ঞতা এসব নিয়েই তো ‘আপনি’। আর যখন পুরনো কোনো গান শোনেন, তখন সেই সুর বা কথা আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই স্মৃতির ভেতর। কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্ত, বিশেষ করে জীবন গঠন করার সময়কার স্মৃতিগুলো আবার জেগে ওঠে।

গান, স্মৃতি আর নস্টালজিয়া

কখনো কখনো আমরা হঠাৎই হারিয়ে যাই পুরনো কোনো মুহূর্তে। পুরনো কোনো গান বাজতে শুরু করল, আর আপনি যেন সেই স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। হয়তো কেউ খুঁজতে গেলে সেই মুহূর্তটা আপনার মনে ছিল না, কিন্তু গানটা খুলে দিল স্মৃতির সেই বন্ধ জানালা। এই অনুভূতির নাম নস্টালজিয়া। কিন্তু জানেন কি, একসময় এটাকে একটি রোগ বলে মনে করা হতো?

১৬৮৮ সালে সুইস চিকিৎসক জোহানেস হোফার প্রথম ‘নস্টালজিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তার মতে, এটি ছিল সৈনিকদের জন্য একধরনের মানসিক অসুস্থতা যারা বাড়ির কথা মনে করে এতটাই ভেঙে পড়তেন যে যুদ্ধের মাঠে লড়াই করতে পারতেন না। তখন নস্টালজিয়ার একমাত্র চিকিৎসা ছিল তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া।

সেই সময় অনেকেই ভাবত, এটা বুঝি শুধুই সুইসদের রোগ। কেউ কেউ তো বলেই বসেছিলেন, আল্পসের গরুর ঘণ্টাধ্বনি নাকি তাদের মস্তিষ্কে ক্ষত তৈরি করে। এমনকি সেনাপতিরা সুইস গান গাওয়াও নিষিদ্ধ করে দেন ভেবে দেখুন, এক টুকরো গান যে এতটা আবেগের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে! কিন্তু সময়ের সঙ্গে ধারণা বদলাতে থাকে। বিশ্ব যখন আরও ছোট হতে শুরু করল, মানুষ যখন দেশ ছেড়ে দূরদূরান্তে কাজের খোঁজে বের হলো, তখন দেখা গেল নস্টালজিয়া আসলে কারও জন্যই বিশেষ কিছু নয়। যে কেউ দীর্ঘদিন নিজের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে তার মনে সেই পুরনো পৃথিবীর জন্য কষ্ট আসতে পারে। ধীরে ধীরে চিকিৎসাবিজ্ঞান বলল, এটা আসলে কোনো রোগ নয়। বরং মানুষের মনে শৈশবের গন্ধ লুকিয়ে থাকে বলেই কখনো কখনো সে হারিয়ে যেতে চায় পুরনো দিনগুলোর দিকে। অনেক মনোবিজ্ঞানী তো একধাপ এগিয়ে বললেন আমরা বুঝি গর্ভাবস্থার নিরাপদ অবস্থায় ফিরে যেতে চাই! কিন্তু গবেষণা এগোতে থাকল, নতুন নতুন তথ্য সামনে আসতে থাকল। এরপর নস্টালজিয়া শব্দটার মানেও পাল্টে গেল। শুধু বাড়ির জন্য নয়, বরং অতীতের সবকিছুর জন্য একধরনের মিষ্টি-কষ্টের অনুভূতি এই হয়ে উঠল নস্টালজিয়া। আর এই পরিবর্তনের সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ রেখে গেছেন ফরাসি সাহিত্যিক মার্সেল প্রুস্ত। একদিন হঠাৎ করেই ছোটবেলার পছন্দের ‘ম্যাডলেন কেক’-এর স্বাদ মুখে আসতেই তার মনে ঝড় তুলে দিয়েছিল পুরনো দিনের উষ্ণ স্মৃতি। গবেষণায় দেখা গেছে, ‘স্মৃতি-বিন্দু’ (Reminiscence Bump) বলে একটি বিষয় রয়েছে। ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সের সময়টা আমাদের স্মৃতির ভাণ্ডারে সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করে রাখে। এই সময়েই মানুষের পরিচয়ের কাঠামো তৈরি হয়। স্কুল জীবন, প্রেম, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মজীবনের শুরু সবকিছু গড়ে ওঠে এই বয়সে। তাই তখনকার গানগুলো, সিনেমা, গল্প কিংবা গন্ধ সবকিছুই বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকে। আর মানুষের স্বভাব হলো, ভালো স্মৃতিগুলোই বেশি মনে রাখা। কারণ আমরা নিজেদের জীবনের গল্পটা সুন্দরভাবে সাজাতে চাই। তাই ছোটবেলার অনেক কঠিন স্মৃতিও এখন মনে হলে মিষ্টি লাগে।

পুরনো স্মৃতি কেন এত ভালো লাগে

আমরা প্রায়ই অতীতকে বাস্তবের তুলনায় আরও সুন্দর করে মনে করি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন নিজের শৈশবের স্মৃতি নিয়ে একবার লিখেছিলেন ‘আবার দেখি শৈশবের ঘর, মন বিষন্নতায় ভার, স্মৃতি ভিড় করে মনে, তার মাঝেও আনন্দ যে অনিবার।’ 

(মূল কবিতা : 

My childhoods home I see again/and saddened with the view

 And still as memory crowds my brain/theres pleasure in it too.)

এমনকি ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের সংযোগের কথা ভাবলে চমকে যাবেন ১৯৫৬ সালে স্যামুয়েল জে. সেমোর নামের এক বৃদ্ধ একটি টিভি শোতে এসেছিলেন, যিনি ছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কনের হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী! ভাবুন তো, ইতিহাস আসলে কতটা কাছাকাছি থাকে।

গান শুনলে শরীর নেচে ওঠে

আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, কোনো গান শুনলে আপনার পা চঞ্চল হয়ে ওঠে, মাথা নড়ে, বা আপনি গুনগুন করে ওঠেন। কেন এমন হয়? আমরা এই আচরণটা সে অর্থে কখনো শিখি না; এটা যেন আমাদের ভেতরের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। গবেষকরা বলছেন, এর কারণ হতে পারে সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলিয়ে চলার প্রবণতা। যখন আমরা একসঙ্গে গান শুনি বা নাচি, তখন আমাদের আবেগগুলো কাছাকাছি চলে আসে। এমনকি অপরিচিত দুই ব্যক্তি একসঙ্গে কোনো গান শুনলে, তারা মানসিকভাবে কিছুটা হলেও কাছাকাছি চলে আসে। এই একসঙ্গে ‘তাল মিলিয়ে চলা’ সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের বড় শক্তি।

আরও মজার ব্যাপার ভালো নৃত্যশিল্পীদের শরীরের নড়াচড়া সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, যা দেখে অন্যদের কাছে তারা আরও আকর্ষণীয় মনে হয়।

গান ‘মাথায় আটকে’ যায়

অনেক সময় মাথার ভেতর একটাই গান বারবার বাজতে থাকে। যতই ভাবি ‘না, আর শুনব না’, ততই সেটা মনে বাজতে থাকে। একে বলে ‘কানের কীট’ (Earworm)। গবেষণায় দেখা গেছে, অপরিকল্পিত বা অসম্পূর্ণ সুর বা কথা আমাদের মস্তিষ্ককে বারবার ‘সম্পূর্ণ’ করার চেষ্টা করতে বাধ্য করে। কিন্তু গানের ওই অংশটুকু ঠিকঠাক না হওয়ার কারণে তা বারবার ফিরে আসে। জেমস কেলারিস নামের গবেষক বলছেন, পুরুষ-নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই এই সমস্যা দেখা যায়, তবে নারীদের ক্ষেত্রে এটি একটু বেশি বিরক্তিকর হতে পারে! আপনি চাইলে সুডোকু বা ধাঁধার মতো মস্তিষ্কের কাজ করে মাথা থেকে বের করতে পারেন এই ইয়ারওয়ার্ম। অথবা এক গান দিয়ে আরেকটা গান ঢুকিয়ে দিতে পারেন! এ জন্য রয়েছে ‘আনহিয়ারইট ডটকম’-এর মতো মজার ওয়েবসাইটও! এটি মূলত এমন একটি মজার প্ল্যাটফর্ম যা আপনার মস্তিষ্কে আটকে থাকা বিরক্তিকর গান বা ‘কানের কীট’ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে। যখন কোনো নির্দিষ্ট সুর বা গানের অংশ বারবার আপনার মাথায় বাজতে থাকে এবং আপনি তা থেকে মুক্তি পেতে চান, তখন এই ওয়েবসাইটটি কাজে আসতে পারে। এর কার্যপ্রণালি বেশ সহজ : এটি একটি সম্পূর্ণ এলোমেলো এবং প্রায়শই কিছুটা অনাকাক্সিক্ষত বা ভিন্ন ধরনের গান বাজিয়ে আপনার মস্তিষ্কের মনোযোগ বর্তমান ইয়ারওয়ার্ম থেকে সরিয়ে দেয়। হঠাৎ করে অন্য একটি সুর কানে আসায় মস্তিষ্কের সেই পুনরাবৃত্তিমূলক প্যাটার্নটি ভেঙে যায় এবং আপনি বিরক্তিকর গানটি থেকে সাময়িক বা স্থায়ী মুক্তি পেতে পারেন। এটি এমন একটি সমাধান, যা ‘কানের কীট’ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এক গান দিয়ে আরেক গান ঢুকিয়ে দেওয়ার ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। ২০০৯-২০১০ সালের দিকে এর জনপ্রিয়তা বাড়ে এবং এটি এখনো একটি মজার উপায় হিসেবে পরিচিত।

আপনি যদি কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়েন যে একটি গান আপনার মাথা থেকে বের হচ্ছে না, তাহলে এই ধরনের ওয়েবসাইটগুলো একটি দ্রুত এবং কার্যকরী সমাধান হতে পারে।

গান, স্মৃতি আর পরিচয়

স্মৃতি ছাড়া কি আপনি থাকতে পারবেন? হয়তো ভাবছেন, স্মৃতি দিয়েই তো ‘আমি’ তৈরি। কিন্তু ভয়ংকর সত্য হলো ভুল স্মৃতি তৈরি হওয়াও সম্ভব। বিজ্ঞানীরা অনেক পরীক্ষায় দেখিয়েছেন শৈশবের ছবি ফটোশপ করে কারও সামনে রাখলে, মানুষ সেই ঘটনার ভুয়া গল্প বলে ফেলেন! তাহলে? আপনি কি শুধু স্মৃতির প্যাকেট? নাকি এর বাইরেও কিছু? কিছুদিন আগে রয়্যাল অবজারভেটরি, গ্রিনউইচ-এ গিয়ে ‘লংপ্লেয়ার’ নামে এক আজব সংগীত শুনেছিলেন ইউটিউবের জনপ্রিয় বিজ্ঞানভিত্তিক চ্যানেল ভিসস (Vsauce)-এর মাইকেল স্টিভেন্স। এই গানটি বাজতে থাকবে এক হাজার বছর! শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালে আর শেষ হবে ২৯৯৯ সালে। মাইকেল বলেছিলেন আমরা যেমন একটা চলন্ত তরঙ্গ, প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছি, তেমনি এই গানটাও সারা পৃথিবী ঘুরে বাজতে থাকবে। আমরা চলে যাব, নতুন মানুষ আসবে, কিন্তু শব্দের তরঙ্গ চলতেই থাকবে। তাহলে কী? আপনি কি চাইবেন আপনার স্মৃতি বা প্রভাবও কারও মনে ‘কানের কীট’-এর মতো থেকে যাক? হয়তো সেটাই হবে আমাদের সবচেয়ে সুন্দর তরঙ্গ একটা ভালো গান, একটা প্রিয় স্মৃতি, একটা হাসিমাখা মুহূর্ত। বিজ্ঞানীদের বদৌলতে আরও বোঝা গেল নস্টালজিয়া মানেই শুধু কান্না নয়। বরং এটি মানুষকে নিজের জীবনের অর্থপূর্ণ মুহূর্তগুলো মনে করিয়ে দেয়, আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করে। গবেষণায় পর্যন্ত দেখা গেছে নস্টালজিয়ায় ডুবে থাকা মানুষ বেশি উদার, বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। কঠিন সময়ে মানুষ নিজের অজান্তেই পুরনো ভালো দিনগুলোর স্মৃতিতে আশ্রয় নেয়, একটু শান্তি খুঁজে নেয়। আজকের দিনে এই নস্টালজিয়া আরও বড় হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞাপনদাতারা ঠিক বুঝে ফেলেছেন পুরনো দিনের স্মৃতি দেখিয়ে মানুষকে হাসানো, কাঁদানো, কিংবা কিছু কিনতে প্ররোচিত করা যায়! তবে এটাকে দেখে ভুল করে ভাবার দরকার নেই যে আমরা কেবলই পেছনে হাঁটছি। বরং এই স্মৃতিগুলোই আমাদের সামনে এগোনোর শক্তি দেয়। অতীতের গল্পগুলো মনে করিয়ে দেয় আমরা পারি, আগেও পেরেছি।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত