প্রত্যেক মানুষের জীবনে তার সঙ্গী ও বন্ধু এক গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। বন্ধুর সংস্পর্শে মানুষের চারিত্রিক গুণাবলির ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে। এজন্য মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রায়ই বিচার করা হয় তার বন্ধুদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির ওপর ভিত্তি করে।
ভালো মানুষের সঙ্গ একজন মানুষের চারিত্রিক গুণাবলিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। অন্যদিকে খারাপ মানুষের সঙ্গ একজন ভালো মানুষকেও খারাপ মানুষে পরিণত করে। এজন্য একজন মুসলিমের বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইসলাম কিছু বিষয়কে মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে এবং তা মেনে একজন মুসলিমকে বন্ধু নির্বাচনের নির্দেশ প্রদান করেছে।
একজন মুসলিমের জীবনে বন্ধু বা সঙ্গীর অবদান অনস্বীকার্য। খারাপ বন্ধু একজন ব্যক্তির জীবন ধ্বংসের অন্যতম কারণ। এমতাবস্থায় বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইসলাম এমন কিছু নির্দেশনাবলি দিয়েছে, যা একজন মুসলিমের মেনে চলা অবশ্য কর্তব্য। কোরআন ও হাদিসের আলোকে সেসব মানদণ্ডের বর্ণনা উল্লেখ করা হলো।
কোনো মুসলিমের জন্য মুসলিম বন্ধুই প্রয়োজনীয়। কেননা সে তাকে নামাজের সময় নামজের জন্য ডাকবে, দৈনিক ইবাদতের বিষয়ে খোঁজখবর নেবে, সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে, তার অবস্থার খোঁজখবর রাখবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তার কল্যাণ কামনা করবে এবং তার সংস্পর্শে সে সহজে তার দ্বীন ও ইমান রক্ষা করতে পারবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদাররা! তোমরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ কোরো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, সে তাদের মধ্যে গণ্য হবে। নিশ্চয় আল্লাহ জালেমদের সৎপথ প্রদর্শন করেন না।’ (সুরা মায়েদা ৫১)
এ বিষয়ে তাফসিরে মাআরিফুল কোরআনে বলা হয়েছে, মুসলমানরা অমুসলিমদের সঙ্গে উদারতা, সহানুভূতি, শুভেচ্ছা, ন্যায়বিচার, অনুগ্রহ ও সদ্ব্যবহার করতে পারে এবং করাও উচিত। কারণ ইসলামের শিক্ষা তাই, কিন্তু তাদের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ও মেলামেশা করার অনুমতি নেই, যার ফলে ইসলামের স্বাতন্ত্র্যের লক্ষণসমূহ মিশ্রিত হয়ে যায়।
মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘ইমানদাররা যেন ইমানদার ছাড়া কাফেরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যে ব্যক্তি তা করবে, আল্লাহর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।’ (সুরা আলে ইমরান ২৮)
মুমিনদের একমাত্র বন্ধু হবেন আল্লাহ, তার রাসুল ও ইমানদাররা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের একমাত্র বন্ধু হলেন আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) এবং ইমানদাররা, যারা নামাজ আদায় করে, জাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহর কাছে অবনত হয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসুলকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, (সে অবশ্যই দেখতে পাবে যে) আল্লাহর দলই বিজয়ী।’ (সুরা মায়েদা ৫৫-৫৬)
মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘ইমানদার পুরুষ ও ইমানদার নারী একে অপরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ দেবে, অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে, নামাজ আদায় করবে, জাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করবে। এরাই সেসব মানুষ, যাদের ওপর আল্লাহ শিগগিরই দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা তওবা ৭১)
মুসলিমদের উচিত সত্যবাদীদের বন্ধু হওয়া ও তাদের সাহচর্য লাভের চেষ্টা করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদাররা! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।’ (সুরা তওবা ১১৯)
বন্ধুত্বের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। কেননা সত্যবাদিতা ইমানদারদের চরিত্রের ভূষণ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসে, আল্লাহর জন্য কাউকে ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্য কাউকে দান করে, আল্লাহর জন্য কাউকে দান করা থেকে বিরত থাকে, সে পূর্ণাঙ্গ ইমানের অধিকারী।’ (আবু দাউদ)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের স্বাদ পেতে পছন্দ করে, সে ব্যক্তি কেবল আল্লাহর উদ্দেশেই অপরকে ভালোবাসুক।’ (মুসনাদে আহমাদ)
তাই মুসলিমদের উচিত বন্ধু নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন করা। কেননা বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক না হলে তা দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে ওঠে। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকের বিবেচনা করা উচিত যে, সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।’ (জামে তিরমিজি)
হাশরের ময়দানে এ বন্ধুত্বই স্থায়ী হবে, যখন অন্য সব ধরনের বন্ধুত্ব বিনষ্ট হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন পরহেজগার ছাড়া সব বন্ধুই পরস্পরের শত্রু হয়ে পড়বে।’ (সুরা জুখরুফ ৬৭)
বন্ধু নির্বাচন শুধুমাত্র সামাজিক বা আবেগঘন কোনো বিষয় নয়; বরং একজন মুসলিমের দ্বীন, চারিত্রিক গঠন এবং পারলৌকিক পরিণতির সঙ্গে তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ কারণেই ইসলাম বন্ধুত্বকে কেবল পার্থিব স্বার্থে নয়, বরং আখেরাতকে সামনে রেখে নির্ধারণ করার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রকৃত বন্ধু সেই, যে আল্লাহর ভয় রাখে, ইমানদার, সত্যবাদী, ন্যায়ের পথে অটল এবং মানুষকে সৎপথে আহ্বান করে।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বহু হাদিসে বন্ধুর প্রভাব ও সাহচর্যের গুরুত্ব স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন, মানুষ তার বন্ধুদের চরিত্রের ওপর গড়ে ওঠে। আবার হাশরের দিনে সব বন্ধুত্ব ভেঙে যাবে, শুধুমাত্র আল্লাহভীতি ও তাকওয়ার ভিত্তিতে গঠিত বন্ধুত্বই টিকে থাকবে। এ কথা স্পষ্ট করে দেয়, ইসলাম কেবল আবেগ নয়, চেতনাপূর্ণ জীবনযাপনের ভিত্তিতেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক অনুমোদন করে।
বন্ধুত্বের প্রকৃত সৌন্দর্য তখনই প্রকাশ পায়, যখন তা আল্লাহর সন্তুষ্টিকে উদ্দেশ্য করে গড়ে ওঠে। ইসলাম এই বন্ধুত্বকে পবিত্র ও চিরস্থায়ী রূপ দিয়েছে, যা হাশরের ময়দানেও উপকারে আসবে। তাই আমাদের সবার উচিত, ইসলাম নির্ধারিত মানদণ্ড অনুসারে বন্ধু নির্বাচন করা এবং এমন বন্ধু বেছে নেওয়া, যে দুনিয়ায় পাশে থাকবে এবং পরকালেও উপকারে আসবে।