রোববার, ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

পারটেক্স-মেঘনা ফের বাড়াল বোতলজাত পানির দাম

আপডেট : ১৭ জুন ২০২৫, ০৩:২৫ এএম

আবারও বেড়েছে বোতলজাত পানির দাম। পারটেক্স বেভারেজ লিমিটেডের মাম এবং মেঘনা গ্রুপের সুপার ফ্রেশ ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানির দাম বাড়ানো হয়েছে। কোম্পানি দুটি এমন এক সময়ে পানির দাম বাড়াল যখন অতি মুনাফা এবং যোগসাজশের মাধ্যমে আধা লিটার পানির দাম বৃদ্ধির অভিযোগে দেশি-বিদেশি ৭ কোম্পানির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনে মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ওই ৭টি কোম্পানির তালিকায় মাম ও ফ্রেশও রয়েছে। 

জানা যায়, প্রতিযোগিতা কমিশন গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই মামলা দায়ের কারলেও এখন পর্যন্ত কোনো শুনানি করতে পারেনি। মামলা দায়েরের পরপরই গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন নির্ধারণ করলেও পরে তা বাতিল করে কমিশন। ৭ কোম্পানির বিরুদ্ধে আগামী ২ জুলাই শুনানির দিন নির্ধারণ করেছে কমিশন। অর্থাৎ একটি মামলার শুনানি শুরু করতেই পেরিয়েছে প্রায় ১০ মাস।

এই অবস্থার মধ্যেই পারটেক্স বেভারেজ লিমিটেডের মাম ব্র্যান্ডের দুই লিটারের বোতলজাত পানির দাম ৫ টাকা বাড়িয়ে ৪৫ টাকা এবং ৫ লিটারের পানির বোতল ৯০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে মেঘনার সুপার ফ্রেশ ব্র্যান্ডের দুই লিটারের বোতলজাত পানির দামও বেড়েছে ৫ টাকা। ফ্রেশের দুই লিটারের পানিও এখন ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

২০২৩ সালে ডলার ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে নামমাত্র খরচ বাড়লেও এই অজুহাতে আধা লিটার পানির বোতলের দাম ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা নির্ধারণ করে। এক অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা কমিশন তদন্ত করে দেখতে পায় বোতলে নামমাত্র খরচ বাড়লেও যোগসাজশের মাধ্যমে আধা লিটার পানির দাম উৎপাদনকারী কিছু কোম্পানি একসঙ্গে ৫ টাকা বাড়িয়ে দেয়। এই অভিযোগে কমিশন স্ব-প্রণোদিত হয়ে কোকাকোলা বাংলাদেশ বেভারেজ লিমিটেড, ট্রান্সকম বেভারেজ লিমিটেড, মেঘনা বেভারেজ লিমিটেড, পারটেক্স বেভারেজ লিমিটেড, রূপসী ফুডস লিমিটেড (সিটি গ্রুপ), আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড এবং প্রাণ বেভারেজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে মামলা করে। উৎপাদিত পানির বিক্রয়মূল্য পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে নির্ধারণ করা, সরবরাহের প্রতিটি পর্যায়ের যেমন ডিস্ট্রিবিউটর, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে অতিরিক্ত মুনাফা প্রদান করে প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে বলে কমিশনের অনুসন্ধানে উঠে আসে।

এই মামলার পর কোম্পানিগুলোর মধ্যে মেঘনা, প্রাণ, আকিজ ও পারটেক্স তাদের পানির দাম ৫ টাকা কমিয়ে পুনরায় ১৫ টাকায় এনেছিল। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যখন প্রতিযোগিতা কমিশনে অস্থিরতা শুরু হয় এবং শুনানি বাতিল করার ঘোষণা আসে, তখনই আবার কোম্পানিগুলো পানির দাম ২০ টাকা করে ফেলে। কমিশনের মামলার এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে কোম্পানিগুলো আধা লিটার পানি এখনো ২০ টাকা করেই বিক্রি করছে।

প্রতিযোগিতা কমিশনের তদন্তে কোম্পানিগুলোর উৎপাদন খরচ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নামমাত্র উৎপাদন খরচ বাড়লেও সে সময় ৫ টাকা দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে কোম্পানিভেদে মুনাফা বাড়ানো হয়েছে সর্বনি¤œ ৭১ দশমিক ২৩ শতাংশ থেকে ৪২০ শতাংশ পর্যন্ত। প্রফিট মার্জিন বেড়েছে ডিস্ট্রিবিউটর ও খুচরা বিক্রেতার। কোনো কোনো কোম্পানি আধা লিটার পানি বিক্রিতে খুচরা বিক্রেতাকে ৯ টাকা পর্যন্ত লাভ দিচ্ছে।

কমিশনের ‘বোতলজাত পানির অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি বিষয়ক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে’ উঠে এসেছে, বোতলজাত পানির উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রথম সারির (মার্কেট শেয়ারের ভিত্তিতে) কোম্পানিগুলো ২০২৩ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে হঠাৎ করে আধা লিটার পানির বোতলের দাম ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা নির্ধারণ করে। এই দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার ও কাঁচামালের কারণে বেড়ে যাওয়া আমদানি খরচকে দায়ী করে।

ঢাকা ওয়াসাসহ মোট ৮ কোম্পানির উৎপাদন খরচ বিশ্লেষণ করা হয় কমিশনের অনুসন্ধান পর্যায়ে। যার একটি আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। কমিশন বলছে, ৫ টাকা পানির দাম বাড়ানোর মাধ্যমে কোম্পানির জন্য সবচেয়ে বেশি লাভ বাড়িয়েছে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। প্রতিষ্ঠানটি ১৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ উৎপাদন খরচ ও ভ্যাট ট্যাক্স-এর কারণে ৩১ দশমিক ৭৮ শতাংশ খরচ বৃদ্ধির বিপরীতে নতুন দাম নির্ধারণ করে কোম্পানির মুনাফা বাড়ানো হয়েছে ৪২০ শতাংশ। যেখানে খুচরা বিক্রেতা দাম বৃদ্ধির আগে আধা লিটার পানি বিক্রি করে ৫ টাকা ৬২ পয়সা মুনাফা করত সেটা দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে ৯ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ ২০ টাকার পানিতে ৯ টাকায় যায় খুচরা বিক্রেতার পকেটে। 

কোম্পানিগুলো তাদের পানি বিক্রির জন্য নিজেদের লাভ বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যাপকভাবে খুচরা বিক্রেতাদের কমিশন বাড়িয়েছে। ফলে পানি কিনতে ভোক্তার খরচ বেড়েছে।

একইভাবে কোকাকোলার কিনলের আধা লিটার বোতলজাত পানির উৎপাদন খরচ বেড়েছে দেড় টাকার মতো বেড়েছিল ডলার ও ট্যাক্স ভ্যাটের কারণে, যা শতাংশের হিসেবে ২৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ৫ টাকা মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে কোম্পানিটি তাদের মুনাফা বাড়িয়েছে ২১১ দশমিক ৬২ শতাংশ, পরিবেশক পর্যায়ে মুনাফা বেড়েছে ৩০ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ২৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ মুনাফা বাড়ানো হয়েছে।

কিনলের আধা লিটারের একটি পানির বোতল ১৫ টাকা বিক্রি করে খুচরা বিক্রেতা আগে ৬ দশমিক ৬৭ টাকা মুনাফা করত, সেটা ৫ টাকা দাম বাড়ানোর পর ৮ দশমিক ৪৭ টাকা করা হয়েছে। একইভাবে ট্রান্সকম বেভারেজের মুনাফা ৭১ দশমিক ২৩ শতাংশ, মেঘনা বেভারেজ লিমিটেডের মুনাফা ১৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়িয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।

কমিশনের পর্যবেক্ষণ বলছে, সিটি গ্রুপ অপর্যাপ্ত তথ্য দেওয়ায় ও প্রাণ কোনো প্রকার তথ্য সরবরাহ না করায় তাদের মুনাফার পরিমাণ বিশ্লেষণ করা যায়নি। সে সময় শুধু পারটেক্স বেভারেজ দাম বাড়িয়ে ডিস্ট্রিবিউটর ও খুচরা বিক্রেতাদের কমিশন বাড়ালেও কোম্পানির মুনাফা বাড়ায়নি। প্রতিযোগিতামূলকভাবে দাম নির্ধারণ না করে পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘন করেছে কোম্পানিগুলো।

নতুন করে পানির দাম বৃদ্ধির কারণ জানতে মেঘনা ও পারটেক্স গ্রুপের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি।

মামলা পরিচালনায় দীর্ঘসূত্রতার কারণ জানতে প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন এ এইচ এম আহসানের সঙ্গে মোবাইল, হোয়াটসঅ্যাপে কল এবং খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

কমিশনের পর্যালোচনা অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের হিসেবে দেশে বোতলজাত পানি বিক্রি হয়েছে ৫৫ কোটি ২৪ লাখ ৫৯ হাজার লিটারের বেশি। যেটা ২০২২-২৩ (৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত) পানি বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি লিটার।

যেখানে সবচেয়ে বেশি পানি বিক্রি হয়েছে ফ্রেশ ব্র্যান্ডের। প্রতিষ্ঠানটির মার্কেট শেয়ার ছিল ২৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল প্রাণ, ১৬.৮৮ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে ছিল অ্যাকুয়াফিনা। এ ছাড়া ১৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ নিয়ে চতুর্থ অবস্থানে মাম, ১৩ দশমিক ৮১ শতাংশ নিয়ে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে স্পা। কিনলের ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ,  জীবন ব্র্যান্ডের ৪ শতাংশ এবং মুক্তা, সেনা, মুসকান ও শান্তি পানির প্রতিটি ব্র্যান্ডের মার্কেট শেয়ার ১ শতাংশের কম।

বিএসটিআই বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসেবে দেশে বোতলজাত খাবার পানি উৎপাদন ও বাজারজাতকারী নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৩২টি। এর মধ্যে উল্লিখিত ১১টি ব্র্যান্ডের দখলেই মূলত বোতলজাত পানির বাজার।  

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত