শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

অগ্নিশিখার উত্তাপে মধ্যপ্রাচ্যে প্রলয়

আপডেট : ১৮ জুন ২০২৫, ১২:২৭ এএম

নিশীথের নিস্তব্ধতা ভেঙে কখনো কখনো ইতিহাসের রক্তাক্ত পদধ্বনি শোনা যায়। মরুর অতল বিস্তারে আজও গুঞ্জরিত হয় সহস্র বছরের শোকগাথা। ধ্বংস আর জন্মের এই অনন্ত চক্রে, মধ্যপ্রাচ্য যেন এক পুঞ্জীভূত রক্তাক্ত পান্ডুলিপি। যে পান্ডুলিপির প্রতিটি অধ্যায় লিখিত হয়েছে মানবরক্তে। রক্তের রেখায় রাজনীতি, ধর্ম, প্রতিরোধ আর প্রতিশোধের বিবরণ। তেলের গন্ধ মিশে আছে বালুকণায়। আগুন জ্বলে উঠছে, দুরাগত বন্দরের নাবিকের চোখে। ঈগলের ছায়া ছুঁয়ে যাচ্ছে, মিনারের চূড়া। নীরবতা কখনো কখনো হয়ে উঠছে আগ্নেয়গিরির পূর্বাভাস। মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি শ্বাসে লুকিয়ে আছে বিপ্লব। প্রতিটি নীরবতার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে যুদ্ধের মুখোশধারী সন্ন্যাসী। সময় দাঁড়িয়ে নেই, হেঁটে যাচ্ছে সংকটের আলিঙ্গনে।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান ইতোমধ্যে ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ করেছে। একটি পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে ২৫ শতাংশ ইউরেনিয়াম যেখানে যথেষ্ট, সেখানে ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম মজুদ ইসরায়েলের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তুলেছে শতগুণ। ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে, ইরানের পরমাণু হুমকি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত। জেরুজালেম ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আইএনএসএসের তথ্যমতে, ২০২০ সাল থেকে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে কমপক্ষে ১২টি সুনির্দিষ্ট হামলা চালানো হয়েছে। এসব হামলার বেশিরভাগই ফার্সদো পরমাণু স্থাপনাকে লক্ষ্য করে। এই স্থাপনা ইরানের প্রধান সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান তামির পারদো স্বীকার করেছেন, পরমাণু বিজ্ঞানীদের টার্গেট করা তাদের কৌশলের অংশ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এই সংকটে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন স্পষ্ট করেছিল, ইরান যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শর্ত মানতে না পারে, তবে নতুন নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে।

অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সংঘাত বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার আইইএর তথ্যানুযায়ী, হরমুজ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন ২১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়। এই সংখ্যা বিশ্বের মোট তেল সরবরাহের ২০ শতাংশ। ২০১৯ সালে ইরান ব্রিটিশ তেল ট্যাঙ্কার জব্দ করলে, তেলের দাম ১০ শতাংশ বেড়ে যায়। বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এই প্রণালি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৫০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। ফলে বৈশি^ক মুদ্রাস্ফীতি ৩ শতাংশ বাড়তে বাধ্য। আঞ্চলিক শক্তিগুলোর অবস্থানও এই সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০২০ সালের আব্রাহাম চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণকে আমূল বদলে দিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের পর এখন সৌদি আরবও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে।

ইরানের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রগুলোকে ‘হুমকির উৎস’ হিসেবে চিহ্নিত করে ইসরায়েল একাধিকবার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। অন্যদিকে ইরানও আর আগের ইরান নেই। যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি, প্রতিরোধ কৌশল ও সামরিক সক্ষমতায় তারা এখন বহুগুণ সমৃদ্ধ। হামলার জবাবে ইরান শুধু প্রতিরোধ নয়, পাল্টা প্রতিশোধেও বিশ্বাস করে। তেহরান বারবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে এই বলে ইসরায়েলের একটি হামলা মানেই মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে জ¦লন্ত অগ্নিস্নান। হরমুজ প্রণালি হবে অগ্নিপ্রলয়ের প্রথম শিকার। যার পরিণতিতে বিশ্ব তেলের বাজারে নেমে আসবে অন্ধকারের ছায়া। এ যেন পরমাণু বিস্ফোরণের পূর্বাভাস যেখানে তেল নয়, রক্ত হবে সবচেয়ে দামি তরল। এই সংঘাতের ছায়ায় এক নতুন যুদ্ধাভিনয়ের জন্ম হয়েছে ড্রোনের কৌশলী নৃত্য, স্যাটেলাইটের শীতল নজরদারি এবং সাইবার আক্রমণের নিঃশব্দ তাণ্ডব। হিজবুল্লাহর একাধিক সামরিক শাখা ইতোমধ্যে ইসরায়েলের সীমান্তে সক্রিয়। প্রতিদিন শত শত রকেট ক্ষেপণের ক্ষমতা এখন বাস্তবতা, কল্পনা নয়। অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্থিতি সবকিছুকে বিপর্যস্ত করতে প্রস্তুত রয়েছে ইরানের ‘অক্ষশক্তি’। পরমাণু অস্ত্রের হুমকি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যান্ড গ্লোবাল সিকিউরিটি প্রোগ্রামের গবেষণায় উঠে এসেছে, ইরান পরমাণু অস্ত্র বানালে মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে। ইসরায়েলের পরমাণু কর্মসূচির বিরোধিতা সত্ত্বেও সৌদি আরব, তুরস্ক ও মিসর নিজস্ব পরমাণু কর্মসূচি শুরু করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসির ধারণা অতি শিগগিরই এ অঞ্চলটি পরমাণু অস্ত্রের দৌড়ে জড়িয়ে পড়তে পারে। রাশিয়া ও চীনের ভূমিকা এই সংকটে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মস্কো ইতিমধ্যেই ইরানকে এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহের চুক্তি করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধে ইরান রাশিয়াকে প্রায় ২,০০০ শাহেদ ড্রোন সরবরাহ করছে বলে পেন্টাগন সূত্রে জানা গেছে। চীন ইরানের সঙ্গে ২৫ বছর মেয়াদি ৪০০ বিলিয়ন ডলারের কৌশলগত চুক্তি করেছে। চুক্তিটি তেল বাণিজ্যকে ইউয়ানে নিষ্পত্তির পথ তৈরি করেছে। তবে এই দুই শক্তি সরাসরি সংঘাতে জড়াতে অনিচ্ছুক। কারণ এ রকম সংঘাত তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার ঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছে। তেল আবিবভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের গবেষকরা সতর্ক করেছেন, ইসরায়েল ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে আবার ব্যাপক বিমান হামলা চালাতে পারে। এর জবাবে ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে, যা বিশ্বের তেল সরবরাহে ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে। হিজবুল্লাহ উত্তরে প্রতিদিন ৫০০+ রকেট নিক্ষেপ করতে পারে, যা ইসরায়েলের অর্থনীতিকে স্থবির করে দেবে। কঠিন এ সংকটের সমাধান খুঁজতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, কূটনৈতিক আলোচনা ছাড়া উত্তেজনা কমানোর অন্য কোনো পথ নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত। তবে ইরানের রয়েছে অনমনীয় অবস্থান। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্নালেনা বারবক বলেছেন, ‘ইরানকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শর্ত মেনে নিতে হবে’। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জটিল কাজ। ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব থেকে শুরু করে গালফ যুদ্ধ, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ-প্রতিটি সংঘাত এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রাহাম অ্যালিসনের গবেষণা অনুযায়ী, এই সংঘাত যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায় তবে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, জ্বালানি সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সংঘাত ইতিমধ্যেই বিশ্ববাজারে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। লন্ডনের লয়েডস ইন্স্যুরেন্স মার্কেটে মধ্যপ্রাচ্যে বীমা প্রিমিয়াম ৩০ শতাংশ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এই সংঘাত যদি বাড়তে থাকে তবে ২০২৪ সালে বৈশি^ক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১.৫ শতাংশ কমে যেতে পারে। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো গ্যাস সরবরাহ সংকটে পড়তে পারে। কেননা ইরান কাতারের সঙ্গে গ্যাস বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করতে পারে।

মানবিক প্রভাবও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্যমতে, এই সংঘাত যদি বিস্তৃত হয় তবে ৫ মিলিয়নের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। ইরাক, সিরিয়া ও লেবাননে ইতিমধ্যেই মানবিক সংকট চলছে, নতুন করে সংঘাত এই পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলবে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই সংঘাতে সাইবার যুদ্ধ নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ইসরায়েলের জাতীয় সাইবার ডিরেক্টরেটের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ইরান সমর্থিত হ্যাকার গ্রুপগুলো ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে ২,০০০+সাইবার হামলা চালিয়েছে। অন্যদিকে ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোতে স্টাক্সনেট ভাইরাসের নতুন সংস্করণ পাওয়া গেছে, যা ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের কাজ বলে মনে করা হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কোনো সহজ সমাধান নেই। ইরান ও ইসরায়েল উভয়কে আত্মসংযম দেখাতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। ইরানের ইতিহাসে, শাসকের চেয়ে প্রতিরোধকারীর রক্ত ঝরেছে বেশি। একদিকে রয়েছে পারমাণবিক তৎপরতার বাস্তবতা, অন্যদিকে সম্মানের প্রতিরক্ষা। রয়েছে সার্বভৌমত্ব রক্ষার অবিচল প্রতিজ্ঞা। ইরানের প্রতিটি পদক্ষেপ অঘোষিত আত্মপক্ষ সমর্থন। সমাধান সম্ভব। তবে তা হতে হবে সমতার রঙে, সম্মানের তুলিতে। যে আলোচনায় থাকবে না পক্ষপাত, থাকবে না আধিপত্যের কষাঘাত। ইরানের ইতিহাসে বারবার আগ্রাসন এসেছে। সেসব আগ্রাসন প্রতিহত হয়েছে প্রজ্ঞা, ঐক্য আর আত্মত্যাগের এক বিরল সমন্বয়ে। বিশ্ব যদি সত্যিই শান্তি চায়, তবে তাকে ইরানের কণ্ঠ শুনতে হবে। শুধু তেল নয়, শুধু ইউরেনিয়াম নয় এই ভূমি এক গৌরবময় ইতিহাস, এক সাংস্কৃতিক সত্তা, এক প্রতিরোধী আত্মার প্রতিচ্ছবি। যুদ্ধ নয়, ইরান চায় মর্যাদার সহাবস্থান। ধ্বংস নয়, তারা চায় আস্থা ও আলোচনার উন্মুক্ত পথ। ইরানকে অন্ধকারের কারিগর ভেবে ভুল করলে, ইতিহাসের পথভ্রষ্ট আরেকটি পরমাণু ছায়া ডেকে আনবে। সময় পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে নিঃশব্দে। কূটনীতির দ্বার যতই বন্ধ হোক, শান্তির আশ্বাস কখনো নির্বাপিত হয় না। আগুনের নিচে শুধু মাটিই জ্বলছে না। জ্বলছে মানবিকতা, জ্বলছে মানসিকতা। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থেকেও যদি মানবতা পিছু হটে, তবে সভ্যতার দীপ্তি নিভে যেতে বাধ্য। ধ্বংস নয়, সংলাপই হোক শেষ শব্দ। প্রতিশোধ নয়, প্রজ্ঞাই হোক পরিণতি। মধ্যপ্রাচ্যের বুক থেকে যুদ্ধের অশনি সরে যাক। বালুকণার দেশগুলোয় শান্তির বৃষ্টি হোক।

লেখক: শিক্ষক, গবেষক ও সংগঠক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত