মধ্যপ্রাচ্যের পরমাণু শক্তিধর দুই দেশ ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাস অনেক পুরনো। তবে দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে তীব্র হয়েছে। দীর্ঘদিনের কথার লড়াই ও ছায়া যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এসে দেশটি দুটি প্রকাশ্য যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। যা অঞ্চলটিতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি বড় পরিসরে যুদ্ধ ব্যাপ্তির আশঙ্কাও বাড়িয়েছে। কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই গত শুক্রবার ভোর রাত থেকে তেহরানে দেশটির পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ইসরায়েল হামলা চালালে সাম্প্রতিক এই সংঘাতে সূত্রপাত হয়। জবাবে ইসরায়েলেও তীব্র হামলা করেছে ইরান। দেশটির আয়রন ডোম প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙে ইসরায়েলে অন্তত ২৪ জন নিহত হয়েছে। যা সাধারণ ইসরায়েলিদের নিরাপত্তা উদ্বেগ বাড়িয়েছে। তবুও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ইসরায়েলের বেপরোয়া ভাব থামছে না। বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিন্দা ও উদ্বেগের পরোয়া না করেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যা করার বিষয়টি পুনরায় বিবেচনা করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। খামেনিকে সাদ্দাম হোসেনের পরিণতির বরণের হুমকি দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। ইরানের সঙ্গে সংঘাতের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাতেও আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মিত্রদের সমর্থন ও দেশটির ওপর কার্যকর কোনো চাপ না আসায় মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে ইসরায়েল; যা দেশটির উগ্র জাতীয়তাবাদী সরকারের বেপরোয়া মনোভাবের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।
সম্প্রতি এবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেন, আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যা করা হলে সংঘাতের শেষ হবে ও পারমাণবিক যুদ্ধ এড়ানো যাবে। কয়েক দিন আগে ইরানে গুপ্ত হামলা চালিয়ে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেন বলে জানায় হোয়াইট হাউজ সূত্র। গত শুক্রবার ভোররাতে ইরানে হামলা চালিয়ে দেশটির সেনাপ্রধান, অভিজাত ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের প্রধানসহ অন্তত ২০ জন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করে ইসরায়েল। সেদিন হামলায় খামেনির একজন উপদেষ্টাও নিহত হন। গতকাল মঙ্গলবার ইরানের যুদ্ধকালীন চিফ অব স্টাফ এবং দেশটির সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডার হিসেবে পরিচিত মেজর জেনারেল আলি শাদমানিকে হত্যার দাবি করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এদিনই ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের সময় খামেনিকে সাদ্দাম হোসেনের পরিণতির বরণের হুমকি দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। কাৎজ বলেন, ইরানের এই স্বৈরাচারী নেতা যেন ভুলে না যান প্রতিবেশী এক দেশের স্বৈরশাসকের পরিণতি। যিনি একসময় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একই পথে হাঁটতে গিয়েছিলেন। সবমিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ জিইয়ে রেখে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে অগ্রসর হতে চায় নেতানিয়াহুর সরকার এমনটাই মত সমর বিশেষজ্ঞদের।
আর ইসরায়েলের এই বেপরোয়া মনোভাবের পেছেনে কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে তাদের পশ্চিমা মিত্রদের নগ্ন সমর্থন ও সামরিক সহায়তার প্রভাব। ইরানের নজিরবিহীন হামলার পর যেখানে গোটা বিশ্ব ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানাচ্ছে, তখন ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়েছে শিল্পোন্নত সাত দেশের জোট জি-৭ এর নেতারা। একই সঙ্গে চলমান সংঘাত ওমধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার উৎস হিসেবে ইরানকে দায়ী করেছেন তারা। যদিও গত সোমবার রাতে দেওয়া এক যৌথ বিবৃতিতে জি-৭ জোটের নেতারা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনারও আহ্বান জানিয়েছেন। তবে সংঘাত বন্ধে তাদের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে প্রকাশ্যে মদদ না দিলেও, শক্তি ধর মিত্র রাষ্ট্রগুলোর নীরব ভূমিকা ইসরায়েলকে ব্যাপক পরিসরে সংঘাতে উদ্বুদ্ধ করছে।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে এটিও পরিলিক্ষিত হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি হয়তো আগের মতো গুরুবাক্য হিসেবে মানবে না ইসরায়েল। কেননা তেহরানে হামলার আগে বেশ কয়েকবার ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতানিয়াহুকে ইরানে হামলা চালানো থেকে বিরত থাকতে বলেছিলেন। এমনকি ট্রাম্প আটকে দিলেও, খামেনিকে হত্যার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অর্থও তেমন কিছুরই জানান দিচ্ছে। আবার কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, ট্রাম্পের আপত্তি উপেক্ষা করে ইরানে হামলা চালিয়ে পরোক্ষভাবে এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সম্পৃক্ত করতে চাইছেন নেতানিয়াহু। যদিও ইরানের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে না পড়তে নিজ দেশে ও কংগ্রেসে চাপের মুখে রয়েছেন ট্রাম্প। এখন দেখার অপেক্ষা-মিত্রদের নগ্ন সমর্থনে ইসরায়েল অঞ্চলটিতে আরও বেপরোয়া হবে; নাকি ইসরায়েলের এই আগ্রাসী মনোভাবে লাগাম পড়বে।