শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ড্রিমলাইনারের ত্রুটিপূর্ণ ইতিহাস

আপডেট : ১৮ জুন ২০২৫, ০৩:০৪ এএম

১১ জুন, ২০২৫ সালে আহমেদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭ বিমান (এআই ১৭১)-এর মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলেছে। ড্রিমলাইনারের একটি ত্রুটিপূর্ণ দীর্ঘ ইতিহাস আছে, সেটি নিয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব

উড্ডয়নের মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হওয়া বোয়িং ৭৮৭ বিমানটি সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরের সীমানায় একটি মেডিকেল কলেজের ওপর আছড়ে পড়ে। ২৪২ জন আরোহী নিয়ে বিমানটি যখন সবেমাত্র ৬২৫ ফুট উচ্চতায় উঠেছিল, তখনই পাইলটরা ‘মে ডে’ (গধু ফধু) কল করেছিলেন, কিন্তু এরপরই বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ২০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এবং এর শিকার হয়েছেন গুজরাটের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রুপানির মতো উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরাও। এটি ১৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে পরিষেবা দেওয়া বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের ইতিহাসে প্রথম প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা, যা এই বিমানের নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিনের উদ্বেগকে নতুন করে সামনে এনেছে।

ত্রুটির দীর্ঘ ছায়া

বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনারকে আধুনিক বিমান শিল্পের এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। ১৮৬ ফুট দীর্ঘ, ১৯৬ ফুট ডানার বিস্তৃতি এবং ২৪৮ জন যাত্রী বহনের সক্ষমতা নিয়ে এটি ২০১১ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার বহরে যুক্ত হয়। জেনারেল ইলেকট্রিক জিইএনএক্স-১ বি/রোলস-রয়স ট্রেন্ট ১০০ ইঞ্জিনের শক্তি নিয়ে এটি ১৩,৫৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারত। বোয়িং গর্ব করে বলেছিল যে, ড্রিমলাইনার জ¦ালানি ব্যবহার ২৫% কমিয়ে এনেছে এবং গত ১৪ বছরে এক বিলিয়নের বেশি যাত্রী পরিবহন ও ৪২৫টি নতুন নন-স্টপ রুট উন্মোচন করেছে। কিন্তু এই গর্বের আড়ালেই লুকিয়ে ছিল এক দীর্ঘ এবং উদ্বেগজনক ত্রুটির ইতিহাস।

প্রাথমিক বিপর্যয়

ড্রিমলাইনারের সমস্যা শুরু হয়েছিল এর উড্ডয়নের মাত্র দুবছর পরই। ২০১৩ সালের মার্চে জাপান এয়ারলাইনসের একটি ৭৮৭ বিমানে দুবার জ¦ালানি লিকের ঘটনা ঘটে, যার ফলে বিমানটিকে ‘গ্রাউন্ডেড’ করতে হয়। প্রায় একই সময়ে ইউনাইটেড এয়ারলাইনসের একটি ৭৮৭ বিমানের মূল ব্যাটারিতেও সমস্যা দেখা যায়। এই ঘটনাগুলো এতটাই গুরুতর ছিল যে, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সরকার দ্রুত তাদের ড্রিমলাইনার বহরকে সাময়িকভাবে গ্রাউন্ডেড করে এবং একটি ব্যাপক নিরাপত্তা পর্যালোচনা শুরু করে।

ভারতে, বোয়িং এয়ার ইন্ডিয়াকে উচ্চ স্তরের বজ্রঝড়ের কাছাকাছি ড্রিমলাইনার না ওড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিল, কারণ ইঞ্জিনে বরফ জমার ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছিল। এর ফলে দিল্লি-টোকিও রুট থেকে বিমানটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় এয়ার ইন্ডিয়া। মার্কিন ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের নিরাপত্তা তদন্ত চলার সময়, এয়ার ইন্ডিয়ার দিল্লি-কলকাতা রুটের একটি ৭৮৭ বিমান তার উইন্ডশিল্ডে ফাটল ধরার পর দিল্লিতে ফিরে আসে। এ ছাড়াও দুটি ৭৮৭ বিমান গ্রাউন্ডেড করা হয়, কারণ তাদের জিই (এঊ) ইঞ্জিনগুলো সেই একই সিরিজের ছিল, যা এফএএ তখন পরীক্ষা করছিল।

এয়ার ইন্ডিয়ার কাঁধে বোঝা

ড্রিমলাইনারের উদ্বোধনের মাত্র ১৪ মাসের মধ্যেই এয়ার ইন্ডিয়ার বহরে ১৩৬টি ছোটখাটো ত্রুটি ধরা পড়ে। এর ফলে এয়ার ইন্ডিয়াকে প্রতিদিন অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয় প্রায় ৬০ লাখ টাকা শুধু অন্যান্য বিমান প্রতিস্থাপনের জন্য। এ ছাড়াও বিমান অর্থায়ন ও পাইলট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতিদিন অতিরিক্ত ১.৪৩ কোটি টাকা খরচ করতে হয়, যা সিভিল এভিয়েশন মন্ত্রণালয় রাজ্যসভায় জানিয়েছিল। এই বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে বোয়িং একটি ‘মডিফিকেশন প্যাকেজ’ বাস্তবায়ন করে, যার মধ্যে বিমান সফটওয়্যার এবং উপাদানগুলোর আপগ্রেড অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং সব ড্রিমলাইনার বিমানের জন্য ১০ দিনের রক্ষণাবেক্ষণের গ্রাউন্ডিং করা হয়।

২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে, এয়ার ইন্ডিয়ার ৭৮৭ ফ্লাইটগুলোতে মোট ৩২টি বড় ঘটনার রিপোর্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে ছিল ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়া, ফ্লাইট নিয়ন্ত্রণ ‘গ্লিচ’, গিয়ার আটকে যাওয়া, কেবিনের ভেতরে ধোঁয়া, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, ফাটল ধরা উইন্ডশিল্ড, কেবিনের চাপ সংক্রান্ত সমস্যা, তীব্র অস্থিরতা, উচ্চতা কমে যাওয়া,  সø্যাট ‘ম্যালফাংশন’, টায়ার ফেটে যাওয়া এবং হাইড্রোলিক লিক। দুটি ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও, কোনো প্রাণহানি হয়নি। আহমেদাবাদের এই ফ্লাইটটিই প্রথম, যা প্রাণঘাতী দুর্ঘটনায় পরিণত হলো।

হুইসেলব্লোয়ারদের অভিযোগ

বোয়িংয়ের এই ‘স্বপ্নিল’ বিমানের ত্রুটিপূর্ণ ইতিহাস কেবল প্রযুক্তিগত সমস্যাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এর উৎপাদন প্রক্রিয়ার গভীরেও ত্রুটি ছিল।

২০১৯ সালে, বোয়িংয়ের প্রাক্তন গুণগতমান ব্যবস্থাপক জন বার্নেট, যিনি ২০১৭ সালে অবসর নিয়েছিলেন, একটি ‘হুইসেলব্লোয়ার’ অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, বিমানের ফ্লাইট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে সংযুক্তকারী তারগুলোর চারপাশে অত্যন্ত অগোছালো কাজ করা হচ্ছে। বোল্ট লাগানোর সময় ধাতব ‘শ্যাভিং’ ফেলে রাখা হতো, যা তারগুলোর ইনসুলেশন ভেদ করে ‘বিপর্যয়কর’ পরিণতি ঘটাতে পারত। বার্নেট আরও অভিযোগ করেন, ক্ষতিগ্রস্ত বা নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ৭৮৭-এ স্থাপন করা হচ্ছে, এমনকি ‘স্ক্র্যাপ’-এর জন্য নির্ধারিত বিন থেকে একটি ডেন্টেড হাইড্রোলিক টিউবও উদ্ধার করা হয়েছিল। এফএএ বার্নেট রিপোর্ট করা শ্যাভিং মুক্ত বলে দাবি করা বেশ কয়েকটি ৭৮৭ পরিদর্শন করে এবং আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে শ্যাভিং খুঁজে পায়। এফএএ তখন বোয়িংকে নির্দেশ দেয় যে বিমানগুলো গ্রাহকদের কাছে ডেলিভারির আগে সমস্যাগুলো সংশোধন করতে হবে।

অবসর গ্রহণের পর বার্নেট বোয়িংয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন, অভিযোগ করেন যে, কোম্পানি তার চরিত্র হনন করেছে এবং কর্মজীবনে তার উন্নতিতে বাধা দিয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে, জন বার্নেটকে তার ট্রাকের মধ্যে আত্মঘাতী বন্দুকের গুলিতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তার পরিবার একটি ভুল মৃত্যুর মামলা দায়ের করে এবং অভিযোগ করে, ‘বোয়িং হয়তো ট্রিগার টানেনি, কিন্তু বোয়িংয়ের আচরণই ছিল এর স্পষ্ট কারণ।’ গত বছর বোয়িং এবং ড্রিমলাইনারের জন্য আরও খারাপ প্রমাণিত হয়েছিল যখন অন্য এক হুইসেলব্লোয়ার, প্রকৌশলী স্যাম সালেহপুর, সামনে আসেন। তিনি অভিযোগ করেন, ড্রিমলাইনারের ফিউসেলেজের বিভিন্ন অংশ অনুপযুক্তভাবে সংযুক্ত করা হচ্ছে, যার ফলে ফাঁক তৈরি হচ্ছে এবং ওড়ানোর সময় বিমান ভেঙে যেতে পারে। সালেহপুর দাবি করেন যে, যখন অংশগুলো ঠিকমতো ফিট করত না, তখন কর্মীরা ‘বর্বর শক্তি’ ব্যবহার করতেন। ক্যাপিটল হিলের সাক্ষ্যে তিনি বলেছিলেন, আমি আক্ষরিক অর্থেই দেখেছি লোকেরা বিমানের টুকরোগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেগুলোকে সারিবদ্ধ করার জন্য... ঝাঁপিয়ে পড়ে আপনি অংশগুলোকে বিকৃত করছেন, যাতে সাময়িকভাবে গর্তগুলো মিলে যায়। আমি এটাকে ‘টারজান ইফেক্ট’ বলতাম।

বোয়িং তাদের ওয়েবসাইটে ড্রিমলাইনারের অখণ্ডতা রক্ষা করে একটি বিবৃতি দেয়, কিন্তু এফএএ আবার মে মাসে পদক্ষেপ নেয়। তারা বোয়িংকে নির্দেশ দেয়, ‘উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে থাকা সব ৭৮৭ বিমান পুনঃপরিদর্শন করতে হবে এবং পরিষেবারত বহরের সমস্যা সমাধানের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।’ এটি প্রথমবার ছিল না যে সরকার ড্রিমলাইনারের ফিউসেলেজে অগ্রহণযোগ্য ফাঁকের সমস্যা নিয়ে পদক্ষেপ নিয়েছিল। ২০২১ সালের মে থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত, এফএএ নতুন ড্রিমলাইনারের ডেলিভারি বন্ধ করে দিয়েছিল। ডেলিভারি পুনরায় শুরু হলেও, সালেহপুরের সাক্ষ্য অনুযায়ী, কারখানার মেঝেতে ত্রুটিপূর্ণ কাজ অব্যাহত ছিল।

এরই মধ্যে, ২০২৪ সালের মার্চে, ল্যাটাম এয়ারলাইনসের সিডনি থেকে অকল্যান্ডগামী একটি ফ্লাইট হঠাৎ করে ৪০০ ফুট নিচে নেমে যায়, কারণ ৭৮৭ বিমানের পাইলটের আসন অপ্রত্যাশিতভাবে সামনের দিকে নড়ে গিয়েছিল। যদিও ক্যাপ্টেন বিমানকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন, ১০ জন যাত্রী এবং কেবিন ত্রুদের তিন সদস্য আহত হন।

কিছু ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা

আহমেদাবাদের দুর্ঘটনা বোয়িং ৭৮৭-এর জন্য প্রথম হলেও, বৈশ্বিক বিমান চলাচল ইতিহাসে এমন আরও অনেক বিপর্যয় রয়েছে, যা মানবতাকে শোকাহত করেছে এবং বিমান নিরাপত্তার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২, ১৯৮৫ :

১৯৮৫ সালের ২৩ জুন, মন্ট্রিল থেকে লন্ডনগামী এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৪৭-এর একটি ফ্লাইট আয়ারল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর বিস্ফোরিত হয়। বিমানের কার্গো হোল্ডে বোমা বিস্ফোরণের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল, যাতে ৩২৯ জন আরোহীর সবাই নিহত হন। এটি শিখ চরমপন্থিদের একটি সন্ত্রাসী হামলা ছিল।

চার্খি দাদরি আকাশপথের সংঘর্ষ, ১৯৯৬  :

১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর, ভারতের নয়াদিল্লির কাছে চার্খি দাদরিতে সংঘটিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ আকাশপথের সংঘর্ষ। সৌদি এরাবিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বোয়িং ৭৪৭ এবং কাজাখস্তান এয়ারলাইনসের একটি ইলিয়ুশিন আইএল-৭৬ বিমানের মধ্যে মধ্য-আকাশে সংঘর্ষ হয়। এই ঘটনায় দুই বিমানের ৩৪৯ জন আরোহীর সবাই নিহত হন। এটি এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল এবং বৈমানিকদের যোগাযোগের ত্রুটির ফল ছিল।

মালয়েশিয়া এয়ারলাইনস ফ্লাইট ১৭, ২০১৪ :

২০১৪ সালের ১৭ জুলাই, অ্যামস্টারডাম থেকে কুয়ালালামপুরগামী মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের বোয়িং ৭৭৭ বিমানটি ইউক্রেনের ওপর দিয়ে ওড়ার সময় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ভূপাতিত হয়। এই ঘটনায় ২৯৮ জন আরোহীর সবাই নিহত হন। তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, এটি রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা ছোড়া ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রের surface-to-air missile) আঘাতে ঘটেছিল।

চলমান তদন্ত

বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে ১,১০০টিরও বেশি ড্রিমলাইনার এখনো আকাশে উড়ছে। তবে আহমেদাবাদের এয়ার ইন্ডিয়া দুর্ঘটনার তদন্তের ফলাফল এই বহরের ভবিষ্যতের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। ভারতের এয়ারক্রাফট অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (এএআইবি-অঅওই)-এর নেতৃত্বে এই তদন্ত সম্ভবত শুধু এআই ১৭১ ফ্লাইটেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং ৭৮৭ এস-এর ১৪ বছরের দীর্ঘ ইতিহাস এবং অসংখ্য অভিযোগ, উদ্বেগ ও হুইসেলব্লোয়ার রিপোর্টগুলোকেও খতিয়ে দেখবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত