দেশের ১১ জেলা ডেঙ্গুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে এখনো সর্বোচ্চ সংক্রমণ রাজধানী ঢাকায়। বাকি ১০ জেলা ঢাকার বাইরে। এসব জেলায় গত দুই মাসে চার গুণ রোগী বেড়েছে। বিশেষ করে বরগুনা, বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ এপ্রিল এই ১১ জেলায় ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিল ১ হাজার ৪৩৪ জন। সেখানে গতকাল মঙ্গলবার সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৯৮ জনে। অর্থাৎ চার গুণ বেশি।
বিশেষ করে এ বছর সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে বরিশাল বিভাগ। এ বছরের রোগীর ৪৬ শতাংশই এই বিভাগে। অন্যদিকে, জেলার মধ্যে বরিশাল বিভাগের বরগুনায় সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড হয়েছে। বছরের রোগীর ২৮ শতাংশই এখানকার। এরপর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে রাজধানী। বছরের রোগীর ২৩ শতাংশ এখানে।
ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বরগুনাকে ‘ডেঙ্গু হটস্পট’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। বরগুনাসহ ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) রোগতত্ত্ববিদদের নিয়ে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করেছে। সেই দল ইতিমধ্যেই বরগুনা গেছে। তারা অন্যান্য জেলায়ও অনুসন্ধান চালাবে।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক ডা. ফরহাদ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্ষাকালে ডেঙ্গু এমনিতেই একটু বাড়ে। সেই হিসেবে হয়তো বাড়ছে। কিন্তু বরিশাল বিভাগে বেশি। ঢাকার বাইরে কেন বাড়ছে, সেটা জানতে আইইডিসিআরের একটি টিম কাজ করছে। তারা বরগুনা গেছে।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, এডিস মশা এই ডেঙ্গুর বাহক। এই মশা নিয়ন্ত্রণ সঠিকভাবে হচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে। ঢাকা ও প্রধান শহরগুলোয় যেভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি আছে, ঢাকার বাইরে সেভাবে নেই। এটাও ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের একটি কারণ হতে পারে। শহরের মানুষ যতটা সচেতন, ঢাকার বাইরে তেমন না। আগে শহরাঞ্চলে ডেঙ্গু বেশি ছিল। গ্রামে ছিল না। ফলে শহরাঞ্চলে যে ধরনের সচেতনতা ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, গ্রামাঞ্চলে সেটা হয়নি। সেখানে মানুষের মধ্যে সচেতনতাও গড়ে ওঠেনি। এখন সেখানে ডেঙ্গু বেশি হচ্ছে।
এই কর্মকর্তা পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে। এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা কিছুটা বেশি। কিন্তু ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য প্রথম যে করণীয়, নিজের বাসা ও বাসার আশপাশে পরিষ্কার রাখি, পানি যাতে না জমে ও মশা বিস্তার লাভ করতে না পারে, সেটা ব্যক্তির দায়িত্ব। আমরা রোগীদের চিকিৎকসা দিচ্ছি। প্রত্যেকটা হাসপাতাল প্রস্তুত আছে ও চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসার জন্য নতুন গাইডলাইন করা হচ্ছে। সেটা সবাইকে দেওয়া হয়েছে। মশা যাতে আমার কাছে আসতে না পারে, সে ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে।’
দিনের ৫৭% রোগী বরিশাল বিভাগে : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ২৪৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ভর্তি হয়েছেন ১৩৮ জন, যা দিনের রোগীর ৫৭ শতাংশ এবং এই বিভাগের বরগুনায় সর্বোচ্চ ৮২ জন ভর্তি হয়েছে, যা দিনের রোগীর ৩৪ শতাংশ। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৩২ জন, ঢাকা বিভাগে ২৬, রাজশাহী বিভাগে ২৪, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪ ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১ জন ভর্তি হয়েছে। নতুন রোগীদের মধ্যে ১৬০ জন পুরুষ ও ৮৪ জন নারী। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৬ হাজার ৪৬৬ জন ও মারা গেছে ৩০ জন।
ঝুঁকিপূর্ণ ১১ জেলা : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর এখন পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ১০ জেলায় সর্বোচ্চ রোগী পাওয়া গেছে। এ বছর এখন পর্যন্ত এই ১১ জেলায় রোগী পাওয়া গেছে ৫ হাজার ৩৯৮ জন। অথচ দুই মাস আগে গত ১৫ এপ্রিল এসব জায়গায় রোগী ছিল ১ হাজার ৪৩৪ জন। সে হিসেবে এই দুই মাসে রোগী বেড়েছে চার গুণের বেশি।
এ বছর সর্বোচ্চ রোগী পাওয়া গেছে বরগুনায় ১ হাজার ৮৩২ জন, বছরের রোগীর ২৮ শতাংশ। অথচ দুই মাস আগেও এখানে রোগী ছিল মাত্র ১২৮ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণ রাজধানীতে। এখানে রোগী ১ হাজার ৪৭২ জন, যা বছরের রোগীর ২৩ শতাংশ। এরপর বরিশালে ৫৭৫ জন, পটুয়াখালী ৩৭৯, চট্টগ্রামে ৩১২, কুমিল্লা ২০৪, গাজীপুরে ১৩৭, কক্সবাজারে ১৩৪, মাদারীপুরে ১২৩, পিরোজপুরে ১১৯ ও চাঁদপুরে ১১১ জন রোগী পাওয়া গেছে।
এ বছর রোগীর ৮৩ শতাংশ এই ১১ জেলার। বাকি ৪৮ জেলায় ১ হাজার ৬৮ জন রোগী।
সর্বোচ্চ বরিশালে, সর্বনিম্ন সিলেটে : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রোগী বরিশাল বিভাগে, ২ হাজার ৯৮০ জন, যা বছরের রোগীর ৪৬ শতাংশ। এরপর চট্টগ্রামে ৯৬৪ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৯২৯, ঢাকা বিভাগে ৬১৯, ঢাকা উত্তর সিটিতে ৫২৩, খুলনা বিভাগে ১৮১, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০৫ ও রাজশাহী বিভাগে ১২২ জন রোগী পাওয়া গেছে।
বরগুনায় প্রাথমিক দুই কারণ : ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বগতির কারণ চিহ্নিত করতে বরগুনায় গেছেন আইইডিসিআরের সাত সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল। সে দলের প্রধান আইইডিসিআরের রোগতত্ত্ববিদ ডা. তারিকুল ইসলাম লিমন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা সোমবার এসেছি। অনুসন্ধান শুরু করেছি। সিভিল সার্জন, ডিসি, পৌরসভার প্রশাসক, রোগীদের সঙ্গে কথা বলেছি। কাতের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে মানুষের বৃষ্টির পানি জমানোর একটা প্রবণতা আছে। তারা পানি ধরে রাখে। এখন বৃষ্টি হচ্ছে। বাড়ির আশপাশে প্রচুর পরিষ্কার পানি জমে থাকে। এই পানি এডিস মশার লার্ভার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ। সে কারণে প্রচুর মশা হচ্ছে। আরেকটা মনে হয়েছে, এখানে মশারি ব্যবহারটা সঠিকভাবে হচ্ছে না। বাসার একজনের ডেঙ্গু হয়েছে। রোগীকে সঠিকভাবে মশারির নিচে রাখতে পারেনি। এতে বাসার কয়েকজন করে আক্রান্ত হয়েছে।’
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘রোগতত্ত্বের কাজগুলো করছি। যেসব রোগী মারা গেছে, তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলব। এপিডোমিওলজি টিম আছে। আমরা মশার নমুনা সংগ্রহ করছি। আশা করছি অনুসন্ধান শেষ হলে প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’
ডেঙ্গুর সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে এই রোগতত্ত্ববিদ বলেন, ‘এ বছর ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু বেশি। আগেও ছিল। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। গত বছরও বরগুনাকে ডেঙ্গু ছিল। তখন বেশি বেড়ে গিয়েছিল সেপ্টেম্বরের দিকে। এবার অনেক আগেই ডেঙ্গু দেখা দিয়েছে। দুই মাস ধরেই এখানে খারাপ অবস্থা। যে কারণে অনুসন্ধান ছাড়া বলা কঠিন এবার আগেভাগেই কেন ঢাকার বাইরে ১১-১২টি জেলা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে কেন রোগী এত বেশি? বিশেষ করে বরিশাল বিভাগের বরগুনাসহ অন্য আরও কিছু অঞ্চল উপকূলীয় জেলা। এখানকার পানি লবণাক্ত। তা হলে সেখানে কেন বেশি ডেঙ্গু হচ্ছে? আশা করছি এর কারণ আমরা বের করতে পারব।’
স্থানীয় সরকার বিভাগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি : ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি এমন জেলাগুলোয় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। গত সোমবার স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব বরাবর এই চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তা জানান, চিঠিতে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় বিশেষ করে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, বরিশাল, বরগুনাসহ যেসব এলাকায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে মশক নিধন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকরণ, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ জরুরি। এ ছাড়া, এ বিভাগের অধীন তৃণমূলপর্যায়ের কমিটিগুলোর মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক বার্তা প্রচার-প্রচারণাসহ প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা অপরিহার্য। এসব বিভাগের আওতাধীন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোয় শূন্য পদে দ্রুত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা প্রয়োজন।