বাংলাদেশে সারা বছর ৫৩ লাখ টন ফলের উৎপাদনের পরও বিদেশ থেকে আমদানি হচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকার ফলমূল। তারপরও দৈনিক ভোগের হিসাবে দেশের মানুষের দৈনিক মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় কম বলে জানিয়েছেন কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে দেশীয় ফলের উৎপাদন বাড়াতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন (কেআইবি) চত্বরে জাতীয় ফল মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান উপস্থিত ছিলেন। তিন দিনব্যাপী শুরু হওয়া এ ফল মেলা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত। যেখানে আসা দর্শনার্থীরা ফল চাষের বিভিন্ন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে ও বিভিন্ন জাতের মৌসুমি ফল কিনতে পারছেন।
কৃষি উপদেষ্টা বলেন, খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে বাংলাদেশে বাৎসরিক ১১ দশমিক ৫ শতাংশ হারে ফলের উৎপাদন বাড়ছে। বিশেষ করে আম ও পেয়ারার উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ, পেঁপের আড়াইগুণ, লিচুর ৫০ শতাংশ, মাল্টার ১৫-২০ শতাংশ ও কমলার উৎপাদন ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। মানুষ এখন নিজেদের স্বাস্থ্যের কথা ভাবছে, উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি ফল খাওয়ার দিকে ঝুঁকছে। অন্যদিকে দানাজাতীয় খাদ্যশস্য অপেক্ষা দেশি ফলের গড় ফলন ও বাজারমূল্য বেশি হওয়ায় তুলনামূলকভাবে আয়ও অনেক বেশি। পাশাপাশি দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে আমরা ফল বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি।
মেলা উপলক্ষে খামারবাড়ির বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের অডিটরিয়ামে ‘স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও বাণিজ্যিকীকরণে দেশি ফল : বর্তমান প্রেক্ষিত, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা বলেন, দেশীয় ফল উৎপাদনে প্রত্যাশিত অগ্রগতিতেও বিদেশি ফল আমদানি করতে হচ্ছে। প্রতি বছর দেশে প্রায় সাড়ে আট লাখ টন ফল আমদানি করতে ১০ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা চলে যায়। আমদানি হওয়া ফলের প্রায় ৮৫ শতাংশই আপেল, কমলা, মাল্টা ও আঙুরের দখলে। তবে আশার কথা, দেশেও সীমিত পরিসরে কমলা ও মাল্টার চাষ হচ্ছে, যা ক্রমান্বয়ে ফল আমদানি নির্ভরতা কমাবে।
উপদেষ্টা বলেন, মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে উৎপাদন বৃদ্ধিসহ নিরাপদ ফল নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি নিরাপদ ফল সংগ্রহ ও সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ও অপচয় কমাতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ উৎপাদিত ফলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলের বিভিন্ন ধাপে যথাযথভাবে সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার অভাবে নষ্ট হচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, দেশে কলা, পেঁপে, পেয়ারা, লিচু ও আমে ২৫-৩৫ শতাংশ পর্যন্ত সংগ্রহোত্তর ক্ষতি ও অপচয় হয়। ফলমূলকে অপচয়ের হাত থেকে বাঁচাতে আমাদের সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাত সম্পর্কে ফলের উৎপাদনকারী বা চাষি, পরিবহনকারী, প্রক্রিয়াজাতকারী, ভোক্তাসহ সবার সচেতনতা বিশেষ প্রয়োজন।
উপদেষ্টা বলেন, এক দশক আগে বাংলাদেশে উৎপাদিত ফলের সংখ্যা ছিল ৫৬টি, যা গবেষণা এবং সম্প্রসারণের মাধ্যমে বেড়ে এখন ৭২টিতে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন বার্ষিক কাঁঠাল উৎপাদনে দ্বিতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম ও পেয়ারা উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম এবং মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বে দশম অবস্থানে রয়েছে। এ ছাড়া জাম, লিচু, বড়ই, কামরাঙা, কদবেল, লেবু, আনারস, লটকন, আতা ও সফেদার মতো ফলগুলোও উল্লেখযোগ্য হারে চাষ করা হচ্ছে। এমনকি ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফ্রুট ও মাল্টার মতো বিদেশি ফলের চাষও ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
দেশবাসীকে দেশি ফল খাওয়ার আহ্বান জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, দেশি ফল খেলে বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। আমরা বিদেশে প্রচুর দেশি ফল পাঠাচ্ছি। যার মধ্যে রয়েছে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা। চীনে নতুনভাবে আম পাঠানো শুরু হয়েছে। রপ্তানি বাড়লে কৃষকরা উপকৃত হবেন।
তিনি বলেন, ৬৪ জেলায় এ মেলা হবে, উপজেলায়ও মেলা হবে। এর উদ্দেশ্য হলো দেশীয় ফল সবার কাছে পরিচিত করা। অনেকেই দেশি ফল চেনেন না। তারা আঙুর, আপেলের মতো বিদেশি ফল খান। অথচ আমাদের ফলের গুণগত মান ও স্বাদ বিদেশি ফলের থেকেও বেশি।
মেলায় যেসব মৌসুমি ফলের সমাহার হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে কাঁচা-পাকা খেজুর, ডাব, কাঁঠাল, আম, আনারস, বেল, তরমুজ, বাতাবিলেবু, কলা, পেয়ারা, তাল, পানিতে ভাসছে করমচা, লটকন, কদবেল, আম, খেজুর, শসা, শাপলার ওপর কাঁঠাল, ড্রাগন ও লেবু। বিএডিসির স্টলে বড় বড় কাঁঠাল, আমড়া, পশুর ফল, জামরুল, অড়বরই, আলুবোখারা, খুদে জাম, তাল, সবরি ও সাগর কলা, আমলকী, সফেদা, মিশরীয় ডুমুর, ভেরিকেটেড মাল্টা, গোলফল, করোসল, চিয়াংমাই আম, ল্যাংড়া, হিমসাগর, আম্রপালি, এভোকাডো, জারা লেবু, রাম্বুটান, কাঁঠালি লিচু, বেদানা লিচু, কাঠবাদামসহ নানা ফলের প্রদর্শনী করা হচ্ছে।