কল্পনা করুন, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মরুভূমির মাঝ দিয়ে উঠে আসা একটি সরু সমুদ্রপথ। চারদিকে শান্ত জলরাশি, কিন্তু নিচ দিয়ে চলেছে বিশাল বিশাল তেলভর্তি ট্যাংকারের দীর্ঘ সারি। এই সংকীর্ণ জলপথটির নাম হরমুজ প্রণালি। এ বিষয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব
মাত্র ৩৯ কিলোমিটার প্রশস্ত এই প্রণালি দিয়েই বিশ্ব জুড়ে ব্যবহৃত প্রতিদিনের তেলের ২০ শতাংশ পরিবাহিত হয়। এ যেন পৃথিবীর জ্বালানির প্রধান শিরা, যদি কেউ এটাকে চেপে ধরে, পুরো দুনিয়ার অর্থনীতি হাঁপিয়ে উঠবে। কিন্তু এটি শুধু একটি জলপথ নয়। এটি ভূ-রাজনৈতিক দাবার ছকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালগুলোর একটি। আর সেই চাল এখন ইরানের হাতে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
হরমুজ প্রণালি কেবল একটি ভৌগোলিক সীমারেখা নয়; এটি অর্থনীতি, রাজনীতি, সামরিক শক্তি এবং উপনিবেশবাদের এক জটিল ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। প্রাচীনকাল থেকেই পারস্য উপসাগর ও ভারত মহাসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় এই অঞ্চলটি বাণিজ্যিক ও সামরিক উভয় দিক থেকেই কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
উপনিবেশবাদের যুগ ও ক্ষমতার পালাবদল
১৫০৭ সালে পর্তুগিজরা হরমুজ দ্বীপ দখল করে এবং এখানে শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণ করা। প্রায় এক শতাব্দী পর ১৬২২ সালে পারস্যের সাফাভিদ রাজবংশ ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যৌথ আক্রমণে পর্তুগিজদের বিতাড়িত করা হয়। এই ঘটনা ছিল ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ ও মধ্যপ্রাচ্যের স্থানীয় শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ সূচনা।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশরা পারস্য উপসাগরে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। হরমুজ প্রণালি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথে পরিণত হয়, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
তেলের যুগ ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি
বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তেল আবিষ্কারের পর হরমুজ প্রণালির গুরুত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়। ১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ‘ট্যাংকার যুদ্ধ’ (Tanker War) নামে পরিচিত সংঘাত শুরু হয়। ইরান ও ইরাক একে অপরের তেলবাহী ট্যাংকারে হামলা চালাত, যা এই প্রণালিকে বিশ্ব জুড়ে ‘বিশে^র শক্তি প্রবাহের গলা ধরা পথ’ হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়।
পরবর্তী সময়ে ২০১১, ২০১২ এবং ২০১৯ সালে ইরান বারবার এই প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়। বিশেষ করে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ইরানের উচ্চপর্যায়ের নেতারা ঘোষণা করেন, ‘যদি আমরা আমাদের তেল বিক্রি না করতে পারি, তাহলে অন্য কেউও পারবে না।’
এখন ২০২৫ সালের দিকে এসে সেই পুরনো হুমকি নতুন করে ভয় ধরাচ্ছে গোটা পৃথিবীতে। হরমুজ প্রণালি আজও বিশে^র অন্যতম সংবেদনশীল এবং কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হিসেবে বিবেচিত। হরমুজ প্রণালি যদি বন্ধ হয়, তাহলে কী হবে?
বিশ্ববাজারে তেলের দাম আকাশছোঁয়া হবে :
বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন প্রায় ১৭-২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এই প্রণালি দিয়ে যায়। যদি হঠাৎ করে এই প্রবাহ থেমে যায়, তেলের দাম দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়ে যেতে পারে। এর প্রভাব পড়বে বিশ্বব্যাপী শিল্প উৎপাদনে, খাদ্যের দামে, পরিবহন খরচে, বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতিতে, এক কথায় পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতে।
এশিয়া ও ইউরোপ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে :
বিশেষ করে চীন, ভারত, জাপান এবং ইউরোপীয় দেশগুলো যারা মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভর করে, তাদের অর্থনীতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলো আরও বেশি সমস্যায় পড়বে।
বিকল্প রুটের সংকট : সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত কিছুটা বিকল্প পাইপলাইন নির্মাণ করেছে, কিন্তু সেটি মোট চাহিদার অল্প অংশই সামাল দিতে পারবে। হরমুজের বাস্তবিক অর্থে কোনো বিকল্প নেই।
সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা বাড়বে : হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত মিলিতভাবে সামরিক অভিযান শুরু করতে পারে। তখন ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংঘর্ষ সরাসরি যুদ্ধের দিকে গড়াতে পারে।
বৈশি^ক শক্তির পুনর্বিন্যাস শুরু হবে : ইরানের পাশে থাকবে রাশিয়া ও চীন। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকবে পশ্চিমা শক্তিগুলো ও আরব দেশগুলো। ফলে এই অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে নতুন এক ‘প্রক্সি যুদ্ধ’-এর মঞ্চ, যেমনটা সিরিয়া বা ইউক্রেনে দেখা গেছে।
হরমুজ প্রণালিকে ঘিরে জটিল খেলা
ইরান খুব ভালো করেই জানে যে, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার হুমকি তাদের সবচেয়ে বড় কৌশলগত অস্ত্র। যখনই আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর হয় বা তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ বাড়ে, তখনই তারা এই তুরুপের তাসটি বের করে। ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (IRGC)-এর নৌবাহিনী এই প্রণালিকে অচল করে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। তারা ছোট ছোট স্পিডবোট, ড্রোন, মাইন এবং অ্যান্টি-শিপ মিসাইল ব্যবহার করে এই কাজ করতে পারে। তবে তাদের মূল কৌশল হলো হুমকি দেখিয়ে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নিজেদের সুবিধা আদায় করা। প্রণালি পুরোপুরি বন্ধ করা ইরানের জন্য একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হবে, কারণ এতে তাদের নিজস্ব অর্থনীতিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু এই হুমকির মাধ্যমে তারা বারবার বিশ্বব্যবস্থাকে চাপের মুখে ফেলে এবং নিজেদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করে।
সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট : ২০২৫ সালের দিকে হুমকির ছায়া আরও গাঢ় বর্তমানে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সব মিলিয়ে হরমুজ এখন এক বিস্ফোরক অঞ্চল। ইরান সম্প্রতি বড় পরিসরে সামরিক মহড়া চালিয়েছে এখানে। ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ট্যাংকার আক্রমণের মহড়া হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
চীন ও রাশিয়া এরই মধ্যে ইরানকে আধুনিক অস্ত্র সহায়তা দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির ভারসাম্য পাল্টানোর একটি প্রচেষ্টা চলছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা হরমুজ প্রণালিতে ‘Operation Sentinel’-এর মাধ্যমে যৌথভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব
বাংলাদেশ তার মোট জ্বালানির ৯০ শতাংশের বেশি আমদানির ওপর নির্ভরশীল, যার একটি বড় অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এমতাবস্থায় হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
জ্বালানি সংকট ও উচ্চমূল্য : মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বহুগুণ বাড়বে, যা সামগ্রিকভাবে বিদ্যুৎ সংকটের সৃষ্টি করতে পারে।
পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি : আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে খাদ্য পরিবহন এবং অন্যান্য পণ্য আমদানি-রপ্তানির খরচ বাড়বে, যা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে।
শিল্প খাতে প্রভাব : শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, অনেক শিল্প বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে।
মুদ্রাস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি : ডলারের ওপর চাপ বাড়বে, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট তীব্র হবে এবং এর ফলে মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় আরও অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাবে।
হরমুজ প্রণালির অচলাবস্থা বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর দেশের জন্য এক বিশাল অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ প্রসঙ্গ বর্তমানে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, তার মূলে রয়েছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা এবং ইসরায়েলের আঞ্চলিক নিরাপত্তা উদ্বেগ। ইরান সরাসরি ঘোষণা দিয়েছে, ‘ইসরায়েল যদি ইরানে হামলা চালায়, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়া হবে।’ ইসরায়েল মাঝে মধ্যেই সিরিয়া ও ইরাকে ইরান-সমর্থিত বাহিনী বা অস্ত্রভাণ্ডারে বিমান হামলা চালায়। পাল্টা হিসেবে ইরান হিজবুল্লাহ, হুতিদের মতো গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। এই যুদ্ধ যদি পূর্ণমাত্রায় বিস্ফোরিত হয়, তাহলে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ শুধু সম্ভাবনা নয়, বাস্তবতা হয়ে উঠতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েল যদি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়, ইরান হয়তো ‘ব্লাফ’ না করে সত্যিই এই প্রণালি বন্ধের চেষ্টা করবে।
রাশিয়া-চীন-ইরান ত্রিভুজ কৌশল
ইরান একা নয়। বিশ্ব রাজনীতির পটভূমিতে রাশিয়া ও চীন এখন ইরানের কৌশলগত মিত্রে পরিণত হয়েছে। তিনটি দেশ মিলিতভাবে একটি নতুন ‘অ্যান্টি-ওয়েস্ট’ অক্ষ গঠনের পথে এগোচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় বিপর্যস্ত। চীন চাইছে পশ্চিমা প্রভাব খর্ব করে নতুন ‘সিল্ক রুট’ বা বেল্ট-রোড ইনিশিয়েটিভ সফল করতে। আর ইরান মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য ভাঙতে চায়।
এই তিন দেশের মধ্যে একাধিক সামরিক মহড়া, অস্ত্র বিনিময় এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা চলছে। চীন ইতোমধ্যে ইরান থেকে বড় আকারে তেল আমদানির চুক্তি করেছে। রাশিয়া ইরানকে ড্রোন প্রযুক্তি দিয়েছে। এই ত্রিভুজ কৌশলকে অনেকে ‘নতুন শীতল যুদ্ধ’-এর পূর্বাভাস বলেও দেখছেন।
বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
বাংলাদেশের জ্বালানিনির্ভরতার বড় অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। হরমুজ প্রণালি যদি আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, বাংলাদেশের ওপর তাৎক্ষণিক চাপ পড়বে তেলের দামে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তার প্রভাব আরও গভীর হবে।
প্রথমত, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়বে, যার ফলে শিল্পকারখানার উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাবে। এতে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের প্রতিযোগিতা কমে যাবে, বিশেষ করে পোশাক খাতে। দ্বিতীয়ত, বিদেশি মুদ্রার সংকট আরও গভীর হতে পারে, কারণ তেল আমদানির জন্য বেশি ডলার প্রয়োজন হবে। এর ফলে টাকার মান আরও পড়ে যেতে পারে।
তৃতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদে খাদ্যপণ্য আমদানি ও পরিবহনে ব্যয় বাড়বে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বাড়িয়ে দেবে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি এমন বৈশ্বিক সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ বিকল্প ব্যবস্থা খুব সীমিত।