বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

পারমাণবিক নীতিতে দ্বৈত মানদণ্ড?

আপডেট : ২৪ জুন ২০২৫, ১২:০৬ এএম

প্রতিবছর শত শত কোটি ডলার ব্যয় হয় বিশ্ব জুড়ে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে। চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, আন্তর্জাতিক পরিদর্শকরা তাদের কাজ করেন, সবকিছুই নাকি নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে। কিন্তু এই বিশ্বব্যাপী উদ্যোগের মধ্যেও একটি ভয়াবহ ব্যতিক্রম সব সময়ই নজর এড়িয়ে যায়, তাহলো ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ।

ইসরায়েলের পারমাণবিক সক্ষমতা নিয়ে ব্যাপক ধারণা থাকলেও, বিশ্ব এতে অদ্ভুতভাবে নীরব। যেখানে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো কেবল পারমাণবিক কর্মসূচির সন্দেহেই নিষেধাজ্ঞা ও বিশ্বব্যাপী নিন্দার মুখে পড়ে, সেখানে ইসরায়েলকে নির্বিঘ্নে এড়িয়ে চলে। ইসরায়েলের পারমাণবিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকের গোড়ায়, যখন গঠিত হয়েছিল ইসরায়েলি পারমাণবিক শক্তি কমিশন। এরপর অতি গোপনে এটি রূপ নেয় পূর্ণাঙ্গ অস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচিতে। ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সহায়তায় ইসরায়েল দক্ষিণ নেগেভ মরুভূমিতে নির্মাণ করে ডিমোনা পারমাণবিক চুল্লী। ১৯৬০-এর দশকের শেষ নাগাদ অনেক বিশেষজ্ঞই ধারণা করেন, ইসরায়েল ইতিমধ্যেই পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলেছে।

ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে কখনোই স্বীকার করেনি যে, তারা পারমাণবিক অস্ত্রধারী। কিন্তু স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, ইসরায়েলের হাতে আনুমানিক ৮০ থেকে ২০০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে, যার মধ্যে গ্র্যাভিটি বোমা, ভূমি, আকাশ ও সমুদ্রপথে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত। আমেরিকার বিজ্ঞানীদের ফেডারেশনও এই তথ্য সমর্থন করে জানায়, ইসরায়েলের কাছে রয়েছে সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র যা তাকে দ্বিতীয় দফার পারমাণবিক প্রতিঘাত বা ‘সেকেন্ড-স্ট্রাইক ক্যাপাবিলিটি’ নিশ্চিত করে। এমনকি কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ইসরায়েল থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র উন্নয়নের পথেও অগ্রসর হচ্ছে।

পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে বৈশ্বিক চুক্তির ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি)-র দিকে তাকালে দেখা যায়, ইসরায়েল এই চুক্তিতে কখনোই স্বাক্ষর করেনি। যদি ইসরায়েল এই চুক্তিতে যোগ দিত, তবে তাকে নিরস্ত্রীকরণে বাধ্য করা হতো। কিন্তু চুক্তির বাইরে থেকে, ইসরায়েল তার কর্মসূচি চালিয়ে যেতে পেরেছে। অন্যদিকে, বিশ্বের বাকি দেশগুলোকে বাধ্য করা হয়েছে মেনে চলতে। এই বৈপরীত্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখনই, যখন ইরানের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ইরান হলো একটি স্বাক্ষরকারী দেশ, যারা আইএইএর নিয়মিত পরিদর্শনের আওতায় রয়েছে এবং শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক শক্তি অর্জনের উদ্দেশ্যে তাদের কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেছে। তবুও ইরান নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এবং সর্বশেষ ইসরায়েল, আমেরিকার অবৈধ সামরিক আগ্রাসনের মুখোমুখি হয়েছে। অপরদিকে, ইসরায়েল বছরে পাচ্ছে ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মার্কিন সহায়তা, সামরিক সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক সুরক্ষা। ইসরায়েলের মিত্ররা যুক্তি দেন, শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় ইসরায়েলের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তার পারমাণবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা বৈধ। কিন্তু যদি নিরাপত্তাহীনতা কোনো দেশের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের বৈধতা দেয়, তবে বৈশ্বিক নিরস্ত্রীকরণ ব্যবস্থা অর্থহীন। তাহলে একই যুক্তি কেন তেহরান, রিয়াদ বা কায়রোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না?

এনটিপি একটি নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।  তা হলো যারা পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করে, তারা শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তি পাবে এবং যারা অস্ত্রধারী, তারা ধীরে ধীরে নিরস্ত্রীকরণে প্রতিশ্রুত থাকবে। কিন্তু যখন একটি দেশ স্থায়ীভাবে এই নিয়মের বাইরে থাকে, তখন অন্যরা এই ব্যবস্থায় আস্থা হারায়। তাহলে ইরান বা সৌদি আরব নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবে কেন, যদি ইসরায়েলের পারমাণবিক একাধিপত্য মেনে নেওয়া এবং রক্ষা করা হয়? এই বোধের অনুপস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে। ফলে, গোটা অঞ্চল এখন বিপজ্জনক এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে। পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত এক মধ্যপ্রাচ্য যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র এবং পারস্পরিক বিশ্বাস দুর্লভ যা একটি বিপর্যয়ের অব্যর্থ সুযোগ। দুর্ঘটনাজনিত উত্তেজনা, ভুল হিসাব কিংবা সাইবার হামলার মাধ্যমে শুরু হওয়া সংঘর্ষ সহজেই ভয়াবহ পরিণতিতে পৌঁছাতে পারে। এখনই সময়, এই ভয়াবহ ভণ্ডামির অবসান ঘটানোর। ইসরায়েলকে তার পারমাণবিক সক্ষমতা সম্পর্কে স্বচ্ছ হতে উৎসাহিত করা উচিত, প্রয়োজনে বাধ্য করতে হবে। পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ আপাতত বাস্তবসম্মত না হলেও স্বচ্ছতা অর্জন সম্পূর্ণভাবে সম্ভব। তাদের অস্ত্রভাণ্ডারের অস্তিত্ব স্বীকার করাটাই হবে প্রথম ধাপ যা ইসরায়েলকে আঞ্চলিক অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক পরিদর্শনের আওতায় আনার পথ খুলে দেবে।

ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে বৈশ্বিক নীরবতা কোনো অসাবধানতা নয় এটি সচেতনভাবে লালিত একটি নীতি, যা কৌশলগত সুবিধা ও রাজনৈতিক কাপুরুষতার ফল। কিন্তু এই নীরবতার মূল্য চরম : বৈশ্বিক বিশ্বাসযোগ্যতা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং নৈতিক সামঞ্জস্য। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সত্যিকার অর্থে পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে থাকে, তবে তাদের উচিত একই নিয়ম সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা। অন্যথায়, বার্তাটি স্পষ্ট : পারমাণবিক ভণ্ডামি কেবল সহ্য করা হয় না বরং সেটাকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। এবং সেই প্রশ্ন, যা প্রতিটি কূটনীতিক ও নীতিনির্ধারকের বিবেককে তাড়িত করা উচিত, তা হলো এই ভণ্ডামিতে বিশ্ব আর কতদিন অভিনয় করে যেতে পারবে?

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত