সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

চলমান রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক অনিশ্চয়তা

আপডেট : ২৪ জুন ২০২৫, ১২:০৭ এএম

বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতি এখন এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, যেখানে সংবাদ পড়া আর কৌতুক শোনা প্রায় একই অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন কবে হবে? বলা যায় এ নিয়ে ‘টাগ অব ওয়ার’ চলছে রাজনৈতিক দল, বিশেষত বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে। কেউ বলছেন, এগুলো রাজনৈতিক নাটক। কেউ বলছেন, এটি গণতন্ত্রের শেষ স্তবক। কিন্তু যাই বলা হোক না কেন, একজন সাধারণ নাগরিকের মনে যা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তা হলো : ভোটে কি আদৌ কিছু বদলায়? জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১০ মাসে তার নেতৃত্বাধীন সরকারের নানাবিধ কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে সংস্কারের বিষয় তুলে ধরার পাশাপাশি এই সময়ের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও প্রত্যাশিত, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি মোটামুটি চূড়ান্ত সময়সীমার কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন- ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে।’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘এপ্রিল তত্ত্ব’ এখন আর শুধু তারিখ নয় হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক কল্পনা, প্রতিশ্রুতি, শঙ্কার মিশ্র প্রতীক। তথ্যগত দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটিও এপ্রিল মাসে হয়নি। নির্বাচনের মাসগুলো ছিল মূলত জানুয়ারিতে ২টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩টি, মার্চে ২টি, মে, জুন, অক্টোবরে ১টি করে এবং ডিসেম্বরে ২টি। অর্থাৎ, এপ্রিল এখনো একটি ‘অজানা’ নির্বাচনী মাস হিসেবে রয়ে গেছে। যদি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সত্যিই ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে সেটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ‘এপ্রিল নির্বাচন’। এটিকে শুধু একটি ক্যালেন্ডার রেকর্ড হিসেবে না দেখে, রাজনৈতিক দিক থেকেও একটি প্রতীকী ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। বিশেষত এমন এক সময়ে যখন ‘তারিখ’ বা ‘সময়সীমা’ ঘিরে রাজনৈতিক বিশ্বাস ও সংশয়ের মধ্যে দোলাচল চলছে।

নতুন প্রতিশ্রুতি, পুরনো অভিশাপ : বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দুই প্রধান শক্তির হাতে বন্দি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুপক্ষই গণতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু কার্যত একে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করতে যেন তৎপর। আওয়ামী লীগ একদিকে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরতে চায়, বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনমনে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের আভাস দিতে চায়; অপরদিকে বিরোধী দল দমন করে, কণ্ঠরোধ করে এবং রাতের আঁধারে নির্বাচন সম্পন্ন করে একধরনের কর্র্তৃত্ববাদী বাস্তবতা গড়ে তুলেছিল। অন্যদিকে বিএনপি নিজেদের ‘আপসহীন’ বললেও, দলটির নেতৃত্ব কাঠামো ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিশেষত, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করে রাজনীতি পরিচালনা করছেন যা এক ধরনের ‘ছায়া নেতৃত্ব’-এর বাস্তবতা তৈরি করেছে। এর ফলে গণতন্ত্রের বদলে ‘দলতন্ত্র’ দৃশ্যমান হয় যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বদলে এককেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত মুখ্য হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি বড় পারসেপশন এখন কাজ করছে যে, ‘নির্বাচন হলেই বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করবে।’ কিন্তু আদতে কি সত্যিই তা-ই হবে? বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে বারবার বলে আসছেন, ‘আগামী নির্বাচন বিএনপির জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে’, তার পেছনে কি কোনো অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা বা কৌশলগত হিসাব আছে? বাংলাদেশের রাজনীতি এই মুহূর্তে ঠিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে নেই, বরং এটি প্রবেশ করেছে এক কাঠামোগত উত্তরণপর্বে যেখানে চেনা নেতৃত্বের চেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে অদৃশ্য ঐক্য, বিদেশি হিসাব এবং অভ্যন্তরীণ ছায়া-কৌশল। গণতন্ত্র যদি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়, তবে ছায়ানীতির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসাই এখন চ্যালেঞ্জ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম : ব্যালটের প্রতিপক্ষ : এক সময় দেয়াল লিখনে প্রকাশ পেত জনগণের আশা, অভিযোগ ও প্রতিবাদ। এখন তার জায়গা নিয়েছে ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স (সাবেক টুইটার)। নির্বাচনের মাঠ এখন যতটা না রাস্তায়, তার চেয়েও বেশি ভার্চুয়াল মিডিয়ায়। এখানে মানুষ নিজের মতামত বলছে, ট্রল করছে, ব্যঙ্গ করছে এবং আশ্চর্যজনকভাবে সেখানেই সবচেয়ে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে জনমত। তরুণরা ‘ভোট’ শব্দটির সঙ্গে রসিকতা করছে, কেউ বলছে : ‘ভোট মানেই সেই মোজাটা পরা, যেটা ফুটো কিন্তু অন্যটার চেয়ে একটু কম দুর্গন্ধযুক্ত।’ এই ব্যঙ্গ কিন্তু নিছক কৌতুক নয় এটা নাগরিক রাগ, হতাশা ও রাজনৈতিক বঞ্চনার এক গভীর প্রতিবাদ। রাষ্ট্র যদি ভোটারকে শ্রদ্ধা না করে, তবে ভোটারও রাষ্ট্রকে ভয় পায় না এটাই নতুন বাস্তবতা।

যখন সংস্কার শব্দটি ম্লান হয়ে যায় : আমরা বলি, সংস্কার দরকার। কিন্তু সংস্কারের নামে যখন নতুনরা পুরনোদের নকল করে, তখন সেই সংস্কার এক খণ্ড নাটক হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে নিজেদের অনেকখানি নিঃশেষ করেছে। কিন্তু তার জায়গায় যাদের মানুষ দেখতে চায়, তাদের আচরণ দেখলে কি মনে কোনো ভিন্ন প্রশ্ন জাগে? পথ কি কেবলই অনিশ্চয়তা? প্রশ্ন উঠেই যায় আমরা ভোট দিতে যাব কেন? ব্যালট বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে যদি মনে হয় এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কিছুই বদলাবে না, তাহলে সেই ভোট কি একরকম অপমান নয়? ভোট যদি কেবল ‘আনুষ্ঠানিকতা’ হয় তাহলে সেটা গণতন্ত্র নয়, সেটি গণবিচ্ছেদ। জনগণ চায় নেতৃত্ব, গঠনমূলক বিতর্ক, ভবিষ্যতের দিশা। তারা জানতে চায় দেশের প্রকৃত মালিক কে? তারা চায় রাজনীতি হোক এমন এক চর্চা, যেখানে তারা নিজেকে বোঝে, পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে, আত্মমর্যাদা খুঁজে পায়।

গণতন্ত্র অথবা জেগে ওঠা মানুষ : তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, গত ১০ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের যে পারফরম্যান্স, দেশের সর্বত্র যে বিশৃঙ্খলা, এখনো বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন গোষ্ঠী যেভাবে মব সৃষ্টি করতে পারছে; সেনাবাহিনী বিচারিক ক্ষমতাসহ মাঠে থাকার পরেও জনমনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা যেহেতু এখনো একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে আছে। ফলে এই সরকার কি শেষ পর্যন্ত একটি অবাধ-সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ-প্রভাবমুক্ত-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে? এ রকম অজস্র প্রশ্ন মানুষের মনে আছে যে কথার কোনো উত্তর নেই। তা ছাড়া অবস্থা এমন হয়েছে যে, এখন দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কোনো আগাম মন্তব্য করা কঠিন। কেননা, শেখ হাসিনার মতো একজন প্রবল ক্ষমতাধর শাসকের যে অভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটবে, সেটি গত বছরের ৫ আগস্ট ভোরেও হয়তো দেশের অধিকাংশ মানুষ ধারণা করেনি। সুতরাং আগামী এপ্রিলেই নির্বাচন হবে কি না বা এপ্রিলের আগে দেশে আরও কী কী ঘটবে তা এখনই বলা কঠিন। এই অবস্থার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা বুঝতে গেলে কিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় : একটি সরকার, যে কিনা গণআন্দোলনের চাপে গঠিত, তার মূল দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল কী? কেন বর্তমানে জনজীবনে অস্থিরতা, স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচির ওপর দমন-পীড়ন এবং গণতন্ত্রমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বল উপস্থিতি? এসব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের মনে এক গভীর হতাশা জন্ম নিচ্ছে।

সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তাব্যবস্থা শক্ত অবস্থানে থাকলেও জনমনে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজমান। বিভিন্ন বিষয় জনগণের সামনে অর্ধেক প্রকাশিত, অর্ধেক গুজব। ফলে রাজনৈতিক আলোচনায় যুক্তি নয়, কল্পনা প্রবল হয়ে উঠছে। এসব প্রেক্ষাপটে একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কেবল প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতারও একটি কঠিন পরীক্ষা। অন্যদিকে, যারা বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছেন, তাদের মধ্যেও লক্ষণীয় ঐক্যহীনতা, কৌশলগত দুর্বলতা ও এক ধরনের ‘নেতৃত্বহীন সাহস’। ফলে সাধারণ জনগণের একাংশ হতাশ হয়ে রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, আরেক অংশ অপেক্ষা করছে আরও বড় কিছু ঘটার। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি এক ভয়ের গল্প যেখানে চরিত্রগুলো দুর্বল, সংলাপগুলো ভাঙা আর দর্শক ক্লান্ত। কিন্তু এই কাহিনির শেষ কী? একটি জাতি কি কেবল ব্যঙ্গ-বিদ্রuপে ডুবে যাবে? নাকি একদিন হঠাৎ জেগে উঠবে কোনো বিকল্প শক্তি, নতুন চেতনা এবং বলবে আমরা আর হাসতে আসিনি, এবার আমরা বলব ‘না’? এই ‘না’ যদি সত্য হয় তাহলে গণতন্ত্র আবার পথ পাবে। আর সত্য না হলে!

লেখকঃ রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত