সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

কালো টাকার দুষ্টচক্র

আপডেট : ২৪ জুন ২০২৫, ১২:২৬ এএম

‘কালো টাকা’র কথা দেশবাসী কমবেশি জানে। কিন্তু সব শ্রেণির মানুষ বোঝে না, তার চরিত্র কী বা সেটি কোন ধরনের প্রভাব ফেলে অর্থনীতিতে। ফলে সমাজে কোন শ্রেণির মানুষ শোষিত হচ্ছেন এবং কারা হচ্ছেন নাদুসনুদুস, সেটি তাদের কল্পনার বাইরে। যে কারণে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে, দীর্ঘদিন ধরে কালো টাকাকে বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছিল বাজেটে। শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। ১৯৭৩ সালে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৭ ভাগ। দীর্ঘ সময় পার হয়ে ২০১২-১৩ সাল থেকে জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার একটা স্থায়ী নিয়ম তৈরি হয়। প্রতিবারই বলা হয়েছে, এটাই শেষ সুযোগ। কিন্তু কালো টাকা শেয়ারবাজার বা আবাসন খাতের মতো সুনির্দিষ্ট কিছু জায়গায় এলে, সেটি দেশের অর্থনীতিতে সত্যিকারভাবে কতটা ভূমিকা রাখে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অজস্রবার। অর্থনীতিবিদরা এ ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। উল্টো বিভিন্ন সরকার তাকে বৈধতা দিয়েছে। 

প্রকৃত অর্থে, কালো টাকা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। কারণ বিপুল অর্থের কর আদায় না হওয়ায় সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। আবার ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গেও এ অর্থের  কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে বৈধ ক্ষুদে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই বেশি কালো টাকা থাকলে দুর্নীতি বাড়ে। অনেকেই বলেন, অপ্রদর্শিত অর্থের আয়কর রিটার্ন ঘোষণা দিয়ে সাদা করলে নাকি অর্থনীতিতে তা অবদান রাখে। এটি কর জিডিপির হার বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের বাজেট ঘাটতি কমাতে সহায়তা করে!   অর্থনৈতিক চাপের প্রভাব কাটাতে বিগত সরকার এই সুযোগ দিয়েছে দীর্ঘ সময়। আদতে লাভ হয়েছে কতটুকু?

বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ কত, তা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের কোনো গবেষণা নেই। তবে ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণার তথ্যমতে, ২০০২-২০০৩ সালে বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ ছিল মোট জিডিপির ৩৭ দশমিক ৭ ভাগ। অন্যদিকে ২০১১ সালে বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় কালো টাকা নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০১০ সালে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৬২ দশমিক ৭৫ ভাগ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। গবেষণায় আরও বলা হয়, ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৩৫ দশমিক ৬ ভাগ। চলতি অর্থবছরের বাজেটে জমি ও ফ্ল্যাট কেনায় অপ্রদর্শিত আয় বা ‘কালো টাকা সাদা’ করার সুযোগ বাতিল করেছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। বিষয়টিকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা। বর্তমানে ফ্ল্যাট ও ভবনে বাড়তি কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার বৈধ পন্থা বন্ধ হয়ে গেল। এ ছাড়া আয়কর, ভ্যাট ও কর ব্যবস্থায় সামান্য পরিবর্তন এনে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট পাস হয়েছে। এ বাজেট আগামী ১ জুলাই কার্যকর হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে জমি বা ফ্ল্যাট  কেনার মাধ্যমে কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ থাকলেও, নানা মহলের সমালোচনায় চূড়ান্ত অনুমোদনের সময় সেটি বাদ দেওয়া হলো। সরকারের দাবি, এই সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও সুশাসনের প্রতিফলন। তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এটি নৈতিকভাবে প্রশংসনীয় হলেও এর বাস্তব প্রভাব সীমিত থাকবে। অপ্রদর্শিত অর্থের মোড়কে অবৈধভাবে অর্জিত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়াকে শুরু থেকেই বৈষম্যমূলক এবং অনৈতিক বলে দাবি করেছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ ব্যাপারে বিগত সরকারের সময় যুক্তি দেওয়া হতো, এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অর্থ সঞ্চালন বাড়ার কারণে রাজস্ব আদায় বাড়বে এবং টাকা পাচার রোধ করা যাবে। সরকারের বাজেট ঘাটতি কমবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে কালো টাকা তেমন ভূমিকা রাখেনি বলে দাবি অর্থনীতিবিদদের। বাস্তবে এর ফলে বাংলাদেশের কর-জিডিপি বাড়েনি। বারবার সুযোগ দেওয়ার ফলে ‘দুর্নীতির এই দুষ্টচক্র’ থেকে বেরিয়ে আসা যায়নি। বরং এই সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে সৎ ও বৈধ আয়ের করদাতাদের সঙ্গে ‘বৈষম্যমূলক আচরণ’ করা হয়েছে। এখন দেখার পালা, এই সিদ্ধান্তের ফলে কালো টাকার দুষ্টচক্রের প্রভাবে অর্থনীতির সূচকে কোন ধরনের পরিবর্তন আসে এবং অর্থ পাচারের পাল্লা বাস্তবে কোন দিকে মোড় নেবে? 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত