পৃথিবী জুড়ে শিল্পীরা এখন শুধু সৌন্দর্য সৃষ্টির মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছেন না; বরং তাদের কাজকে করে তুলেছেন প্রতিরোধের মাধ্যম। এ নিয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব
আপনি কি পরিবেশ নিয়ে ভাবেন? বিশ্বাস করেন যে শিল্প শুধু ঘর সাজানোর মাধ্যম নয়, বরং এর চেয়েও অনেক বেশি কিছু? যদি আপনার উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্যই।
বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন এক বিশাল চ্যালেঞ্জ, যা আমাদের অস্তিত্বের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। এই পরিস্থিতিতে শিল্পীরা নীরব দর্শক নন। তারা তাদের সৃষ্টিতে হাতিয়ার করে তুলে ধরেছেন পরিবেশের করুণ চিত্র, আহ্বান জানাচ্ছেন পরিবর্তনের। শিল্প শুধু আমাদের চোখকে তৃপ্তি দেয় না, এটি আমাদের বিবেককে জাগ্রত করে, প্রশ্ন করতে শেখায় এবং চিন্তার নতুন খোরাক জোগায়।
এখানে আমরা সাতজন সমসাময়িক শিল্পীর কাজ দেখব, যারা তাদের শিল্পকর্ম এবং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে পরিবেশগত সমস্যাগুলোকে সামনে নিয়ে আসছেন। পৃথিবী জুড়ে শিল্পীরা এখন শুধু সৌন্দর্য সৃষ্টির মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছেন না; বরং তাদের কাজ করে তুলেছেন প্রতিরোধের মাধ্যম (form of activism)। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা, যেমন ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, উষ্ণতা বৃদ্ধি, বন উজাড় এবং প্লাস্টিক দূষণ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে তারা শিল্পকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। রিসাইকেল করা উপকরণ থেকে শুরু করে আক্ষরিক অর্থেই আবর্জনা দিয়ে শিল্পকর্ম তৈরি করে, পরিবেশবাদী শিল্পীরা জলবায়ু সংকটের এক গভীর ভাষ্য তুলে ধরছেন। এই ফিচারে আমরা সমসাময়িক কয়েকজন চিত্রশিল্পী, প্রিন্টমেকার, ভাস্কর এবং ইনস্টলেশন শিল্পীর কাজ সম্পর্কে জানব, যারা তাদের শিল্পকর্মের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা করছেন।
তান জি জি
সিঙ্গাপুরের শিল্পী তান জি জি, যিনি ‘মেসিএমএসএক্সআই’ (MessyMsxi) নামেও পরিচিত, তার কৌতুকপূর্ণ অথচ তীক্ষè কাজগুলোর মাধ্যমে সমুদ্র দূষণের ভয়াবহতা তুলে ধরেন। তার ‘প্লাস্টিক ওশান’ (Plastic Ocean ইনস্টলেশনের জন্য তিনি প্রায় ৫০০ কেজি (২৬,০০০ এরও বেশি টুকরা) পরিত্যক্ত সামুদ্রিক প্লাস্টিক সংগ্রহ, পরিষ্কার এবং সজ্জিত করেছিলেন। এই অভিজ্ঞতামূলক প্রদর্শনীতে (experiential exhibition) প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষ স্থিরভাবে শূন্যে ঝুলিয়ে দেখানো হয়েছে, যা বোঝায় কীভাবে আমাদের বৈশ্বিক সামুদ্রিক পরিবেশ প্লাস্টিক বর্জ্য দ্বারা শ্বাসরুদ্ধ হচ্ছে। দর্শকরা যখন এই ‘জলের নিচে’র রাজ্যে প্রবেশ করতেন, তখন তারা অনুভব করতে পারতেন যে সমুদ্রকে নিজেদের আবাসস্থল মনে করে এমন প্রাণীদের দৃষ্টিকোণ থেকে প্লাস্টিক দূষণ কেমন দেখায়। কিছু প্লাস্টিক পচতে ১,০০০ বছরেরও বেশি সময় নেয়, তাই তান জি জি-এর এই অস্বস্তিকর প্রদর্শনী আমাদের মহাসাগরের ভবিষ্যতের একটি ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে, যদি আমরা এখনই পদক্ষেপ না নিই তাহলে এর ফলাফল কী হবে?
গ্যাভিন টার্ক
ধারণাবাদী শিল্পী (Conceptual artist) গ্যাভিন টার্ক একবার ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্রের উদ্দেশ্য ও মূল্যকে নতুন করে কল্পনা করেন।
‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’ তাকে অভিহিত করেছে ‘বর্জ্যরে কবি’ বা ‘The Laureate of Waste’ হিসেবে।
গ্যাভিনের শিল্পকর্মে ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া বস্তুর মাধ্যমে সমাজের বর্জ্য ও মূল্যবোধের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। তার কাজের ভেতর দিয়ে পুনর্ব্যবহার ও পুনর্নির্দেশের ভাবনা বারবার উঠে আসে যা আমাদের শেখায়, পুনর্ব্যবহারের মধ্যেই লুকিয়ে আছে রূপান্তরের শক্তি। একদিকে গ্যাভিন টার্ক তার শিল্পে নতুন কৌশল ও ধারণার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, অন্যদিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেন ব্যাপক উৎপাদন ও ভোগবাদ-নির্ভর সমাজের ক্ষতিকর বাস্তবতা। তার শিল্পকর্ম যেন এক নীরব প্রতিবাদ যেখানে ফেলে দেওয়া জিনিসও নতুন অর্থে ফিরে আসে।
অ্যান্ডি গোল্ডসওয়ার্দি
ব্রিটিশ শিল্পী, ভাস্কর ও পরিবেশবিদ অ্যান্ডি গোল্ডসওয়ার্দি এমন শিল্পকর্ম তৈরি করেন, যেগুলো সরাসরি প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত এবং সেই পরিবেশের ক্ষণস্থায়ী রূপ বা পরিবর্তনশীলতা অন্বেষণ করে। তার কাজের মূল ভাবনা প্রকৃতির জন্ম, বিকাশ এবং বিলুপ্তি এই চক্রের সৌন্দর্য উদযাপন করা। ভূ-শিল্প (Land Art) ধারার এই শিল্পী নিজের কাজের জন্য ব্যবহার করেন প্রাকৃতিক বা শহুরে পরিবেশ থেকে সংগৃহীত উপাদান শিলা, পাতা, পাইন গাছের সুচ, পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ি ও ডালপালা, এমনকি বরফের টুকরো। তার এসব শিল্পকর্ম দীর্ঘস্থায়ী হয় না বৃষ্টি, বাতাস, রোদ, তুষার কিংবা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বিলীন হয়ে যায়। এই অস্থায়ীতাই অ্যান্ডির কাজের প্রকৃত সৌন্দর্য। তিনি নিজের শিল্পকর্মের পরিবর্তন ও বিলুপ্তি ধাপে ধাপে ফটোগ্রাফির মাধ্যমে নথিবদ্ধ করেন, যেন প্রকৃতির ওপর মানুষের প্রভাব নয়, বরং প্রকৃতির নিজের নিয়ম-ই শিল্পের অংশ হয়ে ওঠে। যদিও অ্যান্ডি গোল্ডসওয়ার্দি তার শিল্পকর্মের মাধ্যমে পরিবেশ নিয়ে সরাসরি কোনো বক্তৃতা দেন না, তার প্রতিটি কাজ আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই শিল্প আমাদের শেখায় আমরা প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতিও আমাদের অংশ। তার শিল্পকর্ম প্রকৃতি ও শিল্পের মধ্যে এক গভীর, নীরব, কিন্তু অর্থবহ সংলাপ।
ওলাফুর এলিয়াসন
আইসল্যান্ডিক-ড্যানিশ শিল্পী ওলাফুর এলিয়াসন পরিবেশ-সচেতন শিল্পের জগতে একটি পরিচিত নাম। তিনি এমন শিল্পকর্ম তৈরি করেন, যা দর্শকদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পরিবেশ সংকটকে অনুভব করতে বাধ্য করে। তার কাজের মূল কথা সরাসরি অভিজ্ঞতার চেয়ে সচেতনতা তৈরি করার আর ভালো উপায় নেই। এই বিখ্যাত ধারণাবাদী শিল্পীকে সম্প্রতি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP)-এর ‘জলবায়ু কর্মের জন্য শুভেচ্ছা দূত’ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। এর আগে তিনি জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে শিল্পের মাধ্যমে জলবায়ু সংকট নিয়ে কাজ করার গুরুত্ব নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। তার আলোচিত প্রকল্প ‘আইস ওয়াচ’ (Ice Watch, 2014) ছিল এ ভাবনার বাস্তব উদাহরণ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি গ্রিনল্যান্ডের নুক শহরের কাছের সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া হিমবাহের বরফ সংগ্রহ করেন। তারপর সেই বরফের বড় বড় খণ্ড প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলনসহ বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে এনে প্রকাশ্যে রেখে দেন। দর্শকরা বরফের খণ্ডগুলোর চারপাশে ঘুরতে পারতেন, স্পর্শ করতে পারতেন, গলে যেতে দেখতে পারতেন। পৃথিবীর দূরবর্তী মেরু অঞ্চলের হিমবাহের গলন যেন মুহূর্তেই এসে পৌঁছাত আমাদের শহরের মাঝখানে। এই কাজের উদ্দেশ্য ছিল গলিত হিমবাহ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা মানুষকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে, বাস্তবভাবে অনুভব করানো। যেন পরিবেশ বিপর্যয় আর শুধু খবরের শিরোনামে আটকে না থাকে, বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। ওলাফুর এলিয়াসনের শিল্প তাই শুধু দেখার জন্য নয় অনুভব করার জন্য, ভাবার জন্য এবং পরিবর্তনের জন্য।
আই ওয়েইওয়েই
এটাই প্রথম নয় যে চীনা শিল্পী ও সমাজকর্মী আই ওয়েইওয়েই তার সৃজনশীল প্রতিভা ব্যবহার করে বিশ্বকে কোনো গভীর বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। তার সাম্প্রতিক প্রদর্শনী ‘রুটস’ (Roots)-এ তিনি শিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন পৃথিবীর অন্যতম বড় সংকট আমাজন রেইনফরেস্টের ধ্বংস। এই প্রদর্শনীতে দেখা যায় ব্রাজিলের বিপন্ন পেকুই ভিনেগ্রেইরো (Pequi Vinagreiro) গাছের বিশাল শেকড়ের আদলে তৈরি বিশাল লোহার কাঠামো। যেন মৃত শেকড়ের সেই আকৃতি আমাদের চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয় আমরা ধ্বংস করছি আমাদের পৃথিবীর ফুসফুস। প্রদর্শনীর সময়ও ছিল প্রতীকী। যখন ব্রাজিলের আমাজনে আগুন ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছিল, ঠিক তখনই রিও ডি জেনিরোতে এই কাজ প্রদর্শিত হয়। যেন আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক শোকসংগীত। ‘রুটস’ কেবল বন উজাড়ের কথা বলে না, বরং আরও গভীর একটি বাস্তবতা সামনে আনে এই বনভূমিগুলোতে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্বও যেন সেই শেকড়ের মতো উপড়ে ফেলা হচ্ছে। এটি একদিকে ধ্বংসের দলিল, অন্যদিকে প্রতিরোধের ভাষা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতির এই অপূরণীয় ক্ষতির দায় আমাদেরই।
জেনি কেন্ডলার
শিল্পী জেনি কেন্ডলার তৈরি করেছেন একটি ৪০ ফুট দীর্ঘ ভাস্কর্য ‘Birds Watching’, যেখানে অ্যালুমিনিয়ামের ওপর বসানো আছে ১০০টি পাখির চোখ। এই চোখগুলো শুধু সাধারণ পাখির চোখ নয় প্রতিটি চোখই এমন একেকটি পাখির, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপন্ন বলে বিবেচিত। এই ইনস্টলেশনটি যেন এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা তৈরি করে। সাধারণত আমরা চারপাশের জগৎকে দেখি, কিন্তু এখানে দর্শকদেরই যেন পাখিগুলো দেখছে। চোখগুলোর সেই অনড় দৃষ্টি দর্শকদের অস্বস্তিতে ফেলতে বাধ্য করে। গ্যালারিতে বা ছবির পর্দায় আমরা যা দেখি, সেটি সাধারণত একমুখী শুধু আমরা দেখি। কিন্তু এখানে দেখা পারস্পরিক, যেন প্রকৃতি আমাদের দিকে তাকিয়ে আমাদের আচরণ বিচার করছে। ‘বার্ডস ওয়াচিং’ মনে করিয়ে দেয়, জলবায়ু সংকটে আমরা কেউ নির্দোষ নই। প্রকৃতির এই নির্বাক চোখগুলো যেন বলে আমরা যা করছি, তার জবাবদিহি আমাদেরই করতে হবে।
বেঞ্জামিন ওয়েস্ট
কোলাজিস্ট এবং ফটোগ্রাফার বেঞ্জামিন ওয়েস্ট দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশগত সংকট নিয়ে কাজ করে আসছেন। তার শিল্পকর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক বিশেষ করে কীভাবে সেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক থেকে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছে। বেঞ্জামিনের কোলাজগুলোতে আমরা দেখি, জৈব ও ফুলের নকশাগুলো সূক্ষ্মভাবে স্তরে স্তরে যান্ত্রিক ও কৃত্রিম দৃশ্যের ওপর বসানো হয়েছে। এই সংমিশ্রণে জন্ম নেয় এক ধরনের পরাবাস্তব সৌন্দর্য, যা দেখতে আকর্ষণীয় হলেও ভেতরে লুকিয়ে থাকে হালকা রাজনৈতিক ইঙ্গিত প্রকৃতির ওপর মানুষের আধিপত্য, অবহেলা ও ধ্বংসাত্মক প্রভাবের বিরুদ্ধে এক নীরব প্রতিবাদ। এই বিপরীতধর্মী উপস্থাপনার মাধ্যমে বেঞ্জামিন আমাদের সামনে তুলে ধরেন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমরা কি প্রকৃতি থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি? আমাদের উন্নয়ন কি প্রকৃতির বিনাশের বিনিময়ে? তবে তার কাজ শুধু বিষণœতা নয়, বরং আশার ইঙ্গিতও বহন করে। বিভিন্ন কোলাজে তিনি প্রকৃতি ও প্রযুক্তির সম্ভাব্য সহাবস্থানের ইঙ্গিত দেন। মনে করিয়ে দেন চাইলে প্রযুক্তি ও প্রকৃতি একসঙ্গে মিলেও একটি সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে। বেঞ্জামিন ওয়েস্টের শিল্প আমাদের চোখের জন্য শুধু সৌন্দর্য নয়, বরং চিন্তার খোরাকও। এই শিল্পীরা তাদের সৃজনশীলতার মাধ্যমে আমাদের চারপাশে ঘটে চলা পরিবেশগত পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে কেবল তথ্যই দিচ্ছেন না, বরং দর্শকদের গভীরভাবে চিন্তা করতে এবং এই বৈশ্বিক সংকটের অংশ হিসেবে নিজেদের ভূমিকা উপলব্ধি করতে উৎসাহিত করছেন। তাদের কাজগুলো প্রমাণ করে যে শিল্প কেবল দেখার বিষয় নয়, এটি পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী হাতিয়ারও বটে।