২৪ জুন, ক্যালেন্ডারের আরেকটি সাধারণ তারিখ হলেও বিশ্ব জুড়ে কোটি ফুটবল ভক্তের কাছে এটি ভীষণ আবেগের দিন। এই দিনেই জন্ম নিয়েছিলেন ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি, লিওনেল মেসি। আর্জেন্টিনার রোজারিওর এক খুদে ছেলে থেকে তিনি হয়ে উঠেছেন ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে মুগ্ধকর অধ্যায়ের রচয়িতা। ডিফেন্ডারদের মধ্যে নাচতে থাকা নিখুঁত ছন্দ, তার প্রতিটি গোল যেন এক শিল্পকর্ম। মেসির যাত্রা শুধু মাঠেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি অনুপ্রেরণার গল্প। জন্মদিনে তাকে শুধু রেকর্ড বা ট্রফির জন্য নয় বরং উদযাপন করা হয় সেই অব্যাখ্যেয় প্রতিভাকে, যিনি ফুটবল খেলাটিকেই নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
পালমেইরাসের বিপক্ষে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের গুরুত্বপূর্ণ শেষ ম্যাচে মাঠে নামবেন লিওনেল মেসি। ম্যাচটি শেষ হওয়ার এক ঘণ্টা বাদেই ৩৮-এ পা দেবেন ফুটবল জাদুকর। তবে এবারই প্রথম নয়। নিজের জন্মদিন কিংবা আগে-পরে ফুটবল মাঠে উত্তেজনা ছড়িয়েছেন মেসি বহুবার। এ আয়োজন সেই সব স্মৃতিগুলোকেই রোমন্থনের প্রয়াস।
জার্মানিতে ২০০৬ সালে ফিফা বিশ্বকাপ অভিষেক হয় মেসির। তখন তার বয়স মাত্র ১৯। জন্মদিন অর্থাৎ ২৪ জুন মেক্সিকোর বিপক্ষে শেষ ষোলোর ম্যাচে তিনি ৮৪তম মিনিটে বদলি হিসেবে মাঠে নামেন। অতিরিক্ত সময়ে আর্জেন্টিনা ২-১ গোলে ম্যাচ জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০১০ বিশ্বকাপে নিজের জন্মদিনের একদিন আগে ২২ জুন গ্রুপ পর্বের ম্যাচে গ্রিসের বিপক্ষে খেলতে নেমেছিলেন মেসি। ডেমেশেলেস ও পালেরমোর গোলে তাদের ২-০ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা। পরের বছর আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে জন্মদিনের চার দিন আগে ২০ জুন আলবেনিয়ার মুখোমুখি হয়ে ৪-০ ব্যবধানে ম্যাচ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। ওই ম্যাচে নিজে একটি গোল ও জোড়া অ্যাসিস্ট করেছিলেন মেসি।
ব্রাজিলে ২০১৪ বিশ্বকাপ চলাকালে জন্মদিন উদযাপনের পরদিনই মেসি খেলতে নেমেছিলেন নাইজেরিয়ার বিপক্ষে। গ্রুপের প্রথম দুই ম্যাচ জিতে আগেই পরের রাউন্ড নিশ্চিত ছিল। তবুও লড়তে হয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। মেসির জোড়া গোলে দুবার ম্যাচে এগিয়ে গিয়েও সমতা টেনেছিল নাইজেরিয়া। শেষ পর্যন্ত মার্কোস রোহার গোলে ৩-২ ব্যবধানে জয় পায় আলবিসেলেস্তেরা। পরের বছর ২০১৫ কোপা আমেরিকার আমেজের মধ্যেই জন্মদিন পালন করেন মেসি। ওই আসরের ফাইনালে টাইব্রেকারে চিলির কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল মেসিদের। শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে পরের বছরেই ফের মাঠে গড়ায় কোপা আমেরিকা। ২০১৬’র সেই মৌসুমে ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্রকে ৪-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ওঠার খুশি নিয়ে জন্মদিন পালন করলেও ২৭ জুন দ্বিতীয় দফায় চিলির কাছে মন ভাঙে মেসিদের। মেসি নিজেই সেই ম্যাচে পেনাল্টি মিস করেছিলেন।
রাশিয়ায় ২০১৮ বিশ্বকাপে মেসির জন্মদিনের একদিন পরেই ছিল আর্জেন্টিনার ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচ। প্রতিপক্ষ সেই একই, আগের বিশ্বকাপের মতো নাইজেরিয়া। গ্রুপ পর্বের গুরুত্বপূর্ণ এই লড়াইয়ে মেসি ম্যাচের প্রথম গোলটি করেন। তার দারুণ পারফরম্যান্সে আর্জেন্টিনা ২-১ ব্যবধানে জয় পায় এবং পরবর্তী রাউন্ডে জায়গা করে নেয়। ২০১৯ কোপা আমেরিকা চলাকালে জন্মদিনের আগের রাতে কাতারের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচটি খেলেন মেসি। নিজে গোল না করলেও ২-০ ব্যবধানের সহজ জয় দিয়ে জন্মদিন উদযাপনে মেতেছিলেন মেসি ও তার সতীর্থরা। ২০২০ সালে বার্সেলোনার মেসি লা লিগার ম্যাচ শেষ করেই পা দেন পরের বছরে। ন্যু ক্যাম্পে অ্যাথলেটিক বিলবাওকে ১-০ গোলে হারানোর ম্যাচে ইভান রাকিতিচ এনে দিয়েছিলেন সতীর্থ মেসির জন্য আনন্দের মুহূর্ত।
ব্রাজিলে ২০২১ কোপা আমেরিকার আসরে জন্মদিনের ঠিক আগে ২২ জুন প্যারাগুয়ের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে পুরো ৯০ মিনিট খেলেন মেসি। যদিও গোল করতে পারেননি, তবে দল ১-০ ব্যবধানে জয় পায়। পরে এই টুর্নামেন্টেই অধিনায়ক মেসির নেতৃত্বে কোপার শিরোপা জেতে আর্জেন্টিনা। শুরু হয় দলটির উত্থানপর্বের অনন্য গল্প। ২০২২ সালে জন্ম মাসের প্রথম দিনে ফিনালিসিমায় জোড়া অ্যাসিস্ট করে ইতালিকে ৩-০ গোলে হারিয়ে আনন্দের উপলক্ষ পান মেসি। একই বছর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ট্রফি জেতেন ফুটবল জাদুকর।
২০২৩ সালের ২৪ জুন ম্যাক্সি রদ্রিগেজের সম্মানে আয়োজিত এক প্রীতি ম্যাচে জন্মস্থান রোজারিওতে নিজের প্রথম ক্লাব নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজের মাঠে খেলতে নেমে দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক করেছিলেন জাদুকর মেসি। ২০২৪ সালেও মেসি তার জন্মদিন পালন করেন কোপা আমেরিকার আবহের মধ্যে। ২১ জুন কানাডাকে ২-০ ও ২৬ জুন চিলিকে ১-০ গোলে হারায় আর্জেন্টিনা। ওই আসরেও আর্জেন্টিনাকে কোপা আমেরিকা জিতিয়েছিলেন জাদুকর।
সময় গড়িয়ে আরও এক বছর পর আবার নিজের জন্মদিনের ঠিক আগমুহূর্তে ফিফার আরেকটি বড় আয়োজনে মাঠ মাতাতে নামবেন লিওনেল মেসি। ফ্লোরিডায় সোমবার রাতের ম্যাচে (বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সকাল ৭টা) মুখোমুখি হতে চলেছে গ্রুপ ‘এ’-এর শীর্ষে থাকা ব্রাজিলিয়ান ক্লাব পালমেইরাস ও ইন্টার মায়ামি। এই ম্যাচেই নির্ধারণ হবে এ গ্রুপ থেকে নকআউট পর্বে কারা জায়গা করে নেবে। ক্লাব বিশ^কাপের শেষ ষোলোয় পৌঁছাতে দুই দলেরই প্রয়োজন মাত্র একটি পয়েন্ট।
উল্টোদিকে দ্বিতীয় ম্যাচে পোর্তোর বিপক্ষে মেসির দুর্দান্ত ফ্রি-কিক মায়ামিকে ২-১ ব্যবধানে জিতিয়ে এনে দেয় দামি ৩টি পয়েন্ট। কিন্তু দলের প্রাণভোমরার জন্মদিনের উপলক্ষটি জয়ের রঙে রাঙাতে মরিয়া চেষ্টা চালাবেন মায়ামির খেলোয়াড়রা। মায়ামির জন্য সুখবর, জর্দি আলবা সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং হয়তো নোয়া অ্যালেনকে বদলি করে ফিরতে পারেন একাদশে। এই ম্যাচটি শুধু পরের রাউন্ডে যাওয়ার লড়াই নয়, বরং এটি দুই মহাদেশের ফুটবল ঐতিহ্যের দ্বৈরথ। ফুটবলে দক্ষিণ আমেরিকার ঐতিহ্য বনাম উত্তর আমেরিকার নতুন উদ্দীপনার লড়াই। জন্মদিনে মাঠে নামা অনেক খেলোয়াড়ের জন্য চাপের হতে পারে, তবে মেসি বারবার প্রমাণ করেছেন তিনি জন্ম থেকেই তৈরি বড় মঞ্চের জন্য। আর সেটি প্রমাণের আরেকটি মঞ্চ পালমেইরাসের বিপক্ষে এই ম্যাচ।