রোববার, ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

বেবিচকে ‘চিঠি’ আতঙ্ক!

আপডেট : ২৪ জুন ২০২৫, ০৭:২৪ এএম

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতিসহ নানা অপরাধের লাগাম টেনে ধরতে উদ্যোগ নিয়েছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান। কঠোর সতর্কবার্তা দেওয়ার পরও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ কেউ বেপরোয়া হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। গত ৪ জুন দুর্নীতি দমন কমিশনকে একাধিক কর্মকর্তার বিষয়ে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছেন বেবিচক চেয়ারম্যান। এর আগেও দুদক অন্তত শতাধিক কর্মকর্তার বিষয়ে তদন্ত করছে।

দুদককে চিঠি দেওয়ায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা বছরের পর বছর একই স্থানে ঘাঁটি গেড়ে আছেন। বদলির আদেশ করেও তাদের সরানো যাচ্ছে না। এ নিয়ে ক্ষোভও দেখা দিয়েছে। তারা ঊর্ধ্বতনদের কাছে তদবির করে বদলির আদেশ বাতিল করে ফেলছেন।

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণীতে কোনো ধরনের সন্দেহ দেখা দিলে তা বিভাগীয় তদন্তের আওতায় আনা হচ্ছে। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমেও তদন্তের জন্য পাঠানো হচ্ছে। সংস্থাটিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে যা যা করা দরকার তাই করা হবে।

নজরদারিতে আলোচিত কর্তারা : সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, গত ১৫ বছর যেসব কর্মকর্তা ও কর্মচারী নানা অপকর্ম চালিয়ে আসছিলেন, তাদের কেউ কেউ এখনো আগের মতোই। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে সুবিধা নিয়েও এখন তারা সুবিধা নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই বৈষম্যর শিকার হওয়ার কথা বলে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। গত বছর ২২ সেপ্টেম্বর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেই আলোকে গত বছর ১ অক্টোবর বেবিচকের প্রায় সাড়ে চার হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সম্পদের হিসাব দিতে আরেকটি চিঠি পাঠায় সংস্থাটি। এখন পর্যন্ত কেউ সম্পদের হিসাব দেয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই বেবিচকে নানা অনিয়ম চলে আসছে। টেন্ডার ও নিয়োগবাণিজ্যসহ সব ধরনের কর্মকা- চালিয়ে আসছে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। কর্তৃপক্ষ অনিয়মের লাগাম টেনে ধরতে একের পর এক নজরদারি করলেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না।

প্রকৌশল শাখা বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। ছদ্মনামে টেন্ডার ভাগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এই শাখার শীর্ষ কর্তা থেকে শুরু করে কর্মচারীরা পর্যন্ত টেন্ডারে ভাগ বসাচ্ছেন। সংস্থাটির বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ ওঠায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চোখ গেছে। আলাদাভাবে নজরদারি শুরু করছে দুদক। এতে কর্মকর্তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। নজরদারিতে রাখা হয়েছে আলোচিত কর্তাদের।

যাদের বিরুদ্ধে তথ্য চেয়ে দুদকে চিঠি : বেবিচক সূত্র জানায়, গত ৪ জুন বেবিচক চেয়ারম্যান শীর্ষ ছয় প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ থাকলে তা জানাতে দুদকে চিঠি পাঠিয়েছেন। ওই চিঠিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা, তদন্ত বা অভিযোগ থাকলে তা জানাতে বলা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, যাদের সম্পর্কে দুদকে তথ্য চাওয়া হয়েছে, সেই কর্মকর্তারা হলেন বেবিচকের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী জাকারিয়া হোসেন, ই/এম সার্কেল প্রকল্পের (ইলেকট্রো মেকানিক) প্রকৌশলী শুভাশীষ বড়ুয়া, ই/এম প্রকৌশলী শাহারিয়ার মোর্শেদ সিদ্দিকি, ই/এম বিভাগ-২-এর প্রকৌশলী হাসান মিয়া, ই/এম বিভাগ-১-এর প্রকৌশলী জাকিয়া সুলতানা এবং সিভিল বিভাগ-১-এর প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম। চিঠিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো মামলা, তদন্ত কিংবা অভিযোগ থাকলে তা জানানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

বদলি করেও সরানো যাচ্ছে না : গত ৩ জুন বেবিচক চেয়ারম্যান একাধিক কর্মকর্তাকে বদলির প্রজ্ঞাপন জারি করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা দীর্ঘদিন ধরে একই স্থানে ঘাঁটি গেড়ে আছেন। বদলির আদেশ বাতিল করতে নানা মহলে তদবির চালিয়ে আসছেন। কারও কারও বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ আছে। তারা কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে থাকছেন। বেবিচক সদর দপ্তর, সিলেট ও চট্টগ্রামে কর্মরত তিন প্রকৌশলীকে বদলি করা হয়। ঈদের পর অফিস খোলার পর বিষয়টি নিয়ে বেবিচকে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ওই আদেশে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়) গোলাম মোস্তফাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাকে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বদলি করা হয়। শাহ আমানতের সহকারী প্রকৌশলী সাগর দেওয়ানজিকে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সদর দপ্তরের সিভিল বিভাগ-৪-এর সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল আলিমকে সিভিল বিভাগ-৩-এ বদলি করা হয়েছে।

একই স্থানেই ৫ বছর : বেবিচক সূত্র জানায়, গোলাম মোস্তফা গত পাঁচ বছর ধরে ওসমানী বিমানবন্দরে কর্মরত আছেন। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকেই দাপটের সঙ্গে চাকরি করে আসছেন। তিনি কোনো নিয়মের মধ্যেই থাকেন না। তাকে বদলি করা হলেও নড়াতে পারছেন না। অভিযোগ উঠেছে, ওসমানী বিমানবন্দরে পরিচালক হাফিজুর রহমান তার আস্থাভাজন। বিমানবন্দরের যেসব কাজ হয়ে থাকে তার কমিশন পেয়ে থাকেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে বেবিচকের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, গোলাম মোস্তফা সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তার লোকজনকে কাজ দিতে বাধ্য করান। তার অধীন কর্মকর্তাদের পাত্তাই দেন না। চিফ ইঞ্জিনিয়ার কোনো নির্দেশ বা পরামর্শ দিলে তিনি উল্টোটা করে বসেন। সিলেটের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদও করতে পারেন না।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, গোলাম মোস্তফাকে বদলি করার পর পরিচালক হাফিজুর রহমান বলে বেড়াচ্ছেন, চটগ্রামে যোগ দিতে হবে না তাকে। চেয়ারম্যান দেশে এলে বদলির আদেশ বাতিল করা হবে। যদিও সরকারি নিয়ম অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা সাধারণত দুই থেকে তিন বছরের বেশি এক জায়গায় থাকতে পারেন না। এর আগেও তাকে একাধিকবার বদলি করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি সে আদেশ মানেননি। এবারও বদলি হলেও এখনো তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগ দেননি। বরং বদলি ঠেকাতে বিভিন্নভাবে তদবির করছেন। অন্যদেরও একই অবস্থা। চেয়ারম্যান স্যার চাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতি ও অপরাধমুক্ত করতে। কিন্তু কতিপয় কর্মকর্তাদের কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠছে না।

পুরনো সিন্ডিকেটের তৎপরতা : সূত্র আরও জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বেবিচক ঘিরে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল। সিন্ডিকেটগুলো সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত। এখনো সিন্ডিকেট বলবৎ আছে। কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী গত ১৫ বছর কোটিপতি হয়েছেন। সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার চিঠি ইস্যুর পর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পড়েছেন আতঙ্কের মধ্যে। শেখ হাসিনা সরকারের সময় বেবিচকের যেসব কর্মকর্তা নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে নিজের এবং স্ত্রী-সন্তানদের নামে ফ্ল্যাট, প্লট, গাড়ি ও বাড়ি বানিয়েছেন তারা আছেন বেশি দুশ্চিন্তায়। আবার অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী দেশের বাইরে সম্পদের পাহাড় গেড়েছেন। আর এ কারণে দীর্ঘদিন ধরেই দুদক বেবিচকের কর্মকা- নিয়ে অনুসন্ধান করে আসছে। কোন কোন খাতে বেশি দুর্নীতি হয়, সেই তথ্য উদঘাটনও করে সংস্থাটি। তার মধ্যে বেবিচকে ৩৬টি খাত নিয়ে বেশি অভিযোগ উঠেছে বলে দুদক তথ্য পেয়েছে।

গত বছর ২২ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর হিসাব চেয়ে চিঠি ইস্যু করা হয়। ওই বছরের ১ অক্টোবর বেবিচক ৪৩টি শাখায় এ চিঠি পাঠায়। চিঠি ইস্যুর পরই মূলত শুরু হয় অস্থিরতা। বিভিন্ন দায়িত্বে থেকে যারা নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি করে টাকা কামিয়েছেন, তারা বিপদে পড়তে যাচ্ছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নানা অনিয়মের পেছনে ছিলেন বেবিচকের প্রকৌশল বিভাগসহ আরও কয়েকটি বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ার পর বেবিচকের দৃশ্যও পাল্টে যায়। বেবিচকের সব বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পাশাপাশি স্ত্রী-সন্তানদেরও সম্পদের হিসাব দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগই সম্পদের হিসাব দেননি বলে জানা গেছে।

দুদকের তালিকায় যা আছে : দুদকের একটি তালিকায় বলা হয়েছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এয়ার কন্ডিশনার ডাক্ট স্থাপন, এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম আপগ্রেডেশন, বিমানবন্দরে কাউন্টার এবং কনভেয়ার বেল্ট স্থাপন, তার যন্ত্রাংশ সরবরাহ, নতুন বোডিং ব্রিজ স্থাপন, পুরাতন বোডিং ব্রিজে যন্ত্রাংশ সরবরাহ ও স্থাপন, বিমানবন্দরের বিভিন্ন স্থানে এলইডি লাইট কেনা ও ফিটিংস, বাগান আলোকসজ্জা, এইচটি এবং এলটি সুইচগিয়ার স্থাপন কাজের নামে অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে। তাছাড়া বিমানবন্দরের ফ্লোর মাউন্টেড এবং ওয়াল মাউন্টেড প্যানেল স্থাপন, বিমানবন্দরে বিভিন্ন সাইজের পাওয়ার কেবল সরবরাহ, এয়ারফিল্ড গ্রাউন্ড লাইটিং সিস্টেম স্থাপন, রানওয়ে, টেক্সিওয়ে, অ্যাপ্রোন লাইট ও লাইট ফিটিংস সরবরাহ, আবাসিক ভবনে ইন্টারনাল ইলেকট্রিফিকেশন কাজ, সিএএবির নতুন সদর দপ্তরের ভবনের বিভিন্ন ইকুপমেন্ট সরবরাহসহ ইএম-সংক্রান্ত কাজ, টার্মিনাল বিল্ডিংসহ বিমানবন্দরের অন্যান্য ভবনের ডেকোরেশেন-সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইএম কাজ, বিভিন্ন স্থানে অ্যাপ্রোন মাস্ট লাইট স্থাপন, সিসিআর বিল্ডিং সংশ্লিষ্ট সব ইএম কাজ, রানওয়ে লাইটিংয়ের জন্য বিভিন্ন সাইজের কেবল সরবরাহ ও সংস্থাপন কাজেও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে।

বেবিচকের এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বেবিচকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্পদের হিসাব দেননি। নতুন করে দুদককে চিঠি দেওয়ায় সবার মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সত্য। বেবিচকের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানসহ ৯ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধানে ৭টি প্রকল্প কাজের যাবতীয় নথিপত্র তলব করা হয়। দুদক অনেকের বিষয়েই তদন্ত করছে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত