সম্প্রতি ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলার প্রেক্ষাপটে ‘আমরা এখন যুদ্ধেই আছি’ এ বাক্যটি উচ্চারণ করেছেন রুশ দার্শনিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলেকসান্দর দুগিন। এটি ভবিষ্যতের কোনো পূর্বাভাস নয়, বরং বর্তমানের এক নির্মম বাস্তবতা। সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রের ইঙ্গিতে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ইরানে অযাচিত হামলা করে দেশটির সামরিক প্রধান, পরমাণুবিজ্ঞানীসহ শত শত সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন উত্তেজনার সূচনা করেছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে হঠাৎ করে ইরানের পারমাণবিক সাইটগুলোতে বোমা হামলা করেছে। বিভিন্ন দেশ এ হামলার নিন্দা জানাচ্ছে। ইরানও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ইসরায়েলে ফিরতি মিসাইল হামলা অব্যাহত রেখেছে। এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, চীনের সামরিক প্রস্তুতি ও হুতিদের লোহিত সাগর অবরোধ তো আছেই। ইরানের পার্লামেন্ট ইতিমধ্যে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করার জন্য অনুমতি দিয়েছে। অর্থাৎ এটি এখন বৈশ্বিক সংঘাতের শুরুর সংকেতমাত্র, যেখানে কোনো পক্ষ নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ পাবে না।
ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র যে বিমান হামলা চালিয়েছে, তা শুধু একটি রাষ্ট্রের ওপর হামলা নয়, একটি ভূরাজনৈতিক কৌশলের ওপর সরাসরি আক্রমণ। এটি ইরানকে দমন করার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ, বিশেষত ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব খর্ব করার উদ্দেশ্যে এ আগ্রাসন। আলেকসান্দর দুগিন বলেন, ‘যদি কোনো কিছুই যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানে বোমা হামলা থেকে বিরত না রাখতে পারে, তবে কেউই তাদের রাশিয়াকে আক্রমণ করতে থামাতে পারবে না।’
দুগিন তার বক্তব্যে তুলনা করেছেন ইউক্রেন ও ইসরায়েলের মধ্যকার ভূমিকাকে। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল যেমন পশ্চিমাদের প্রক্সি হিসেবে গড়ে উঠেছিল, ইউক্রেনকেও একইভাবে ব্যবহৃত হতে হচ্ছে।’ ইসরায়েল গাজায় যেমন নির্বিচার বোমাবর্ষণ করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, ইউক্রেন সরকারও একইভাবে দনবাস অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আসছে, যদিও সেই হামলাগুলো আন্তর্জাতিক মনোযোগ থেকে বেশিরভাগ সময় আড়ালেই থেকেছে।
এ বাস্তবতা থেকে একটি প্রশ্ন উঠে আসে একপক্ষ কি শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে, অথচ অন্যপক্ষে একটানা আগ্রাসী অবস্থান নেয়? ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে এ দ্বৈতনীতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু পশ্চিমাদের সাহায্য চাই না, আমরা চাই আমাদের অস্ত্রভাণ্ডার পারমাণবিক অস্ত্রসহ উন্নত প্রযুক্তি।’ এ যেন এক প্রক্সি রাষ্ট্রের অঘোষিত স্বীকারোক্তি।
বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম কেন্দ্রস্থল হরমুজ প্রণালি এখন কার্যত বন্ধ। হুতিরা লোহিত সাগরের বাণিজ্যপথে বাধা সৃষ্টি করেছে। এসব ঘটনা একে একে যুক্ত হচ্ছে একটি বৈশ্বিক সংঘাতের সূত্রে। চীন এখনো সরাসরি যুদ্ধে নামেনি, তবে বেইজিংয়ের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইমস’ স্পষ্ট ভাষায় বলেছে, ‘যদি মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ আমাদের তেল ও প্রযুক্তি সরবরাহের ওপর প্রভাব ফেলে, চীন প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হবে।’
অন্যদিকে, হুতি নেতা আবদুল মালিক আল-হুতি স্পষ্ট বলেছেন, ‘পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমরা শুধু একটি জাতির নয়, সমস্ত নিপীড়িত বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করছি।’ এ বক্তব্য ইঙ্গিত দেয়, যুদ্ধ কেবল রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্র নয় এ এক দুনিয়াব্যাপী ক্ষমতার কাঠামোতে বড়সড় ধাক্কা।
আলেকসান্দর দুগিন আরও বলেন, ট্রাম্প আবারও নিওকনজারভেটিভদের কবলে পড়েছে। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ প্রকল্প শেষ। আমেরিকার ‘বিপ্লবী জাতীয়তাবাদ’ এখন পরিণত হয়েছে পুরনো ধাঁচের বিশ্বায়নে। এর পরিণাম হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসন, ইউরোপে সামরিক ব্যয়বৃদ্ধি এবং এশিয়ায় উত্তেজনা। ট্রাম্পের মতো নেতাও, যিনি একসময় ‘যুদ্ধ নয়, চুক্তি’ সেøাগানে উঠে এসেছিলেন, এখন সরাসরি হামলা অনুমোদন করছেন।
স্মরণ করিয়ে দিই, ২০২০ সালে সোলাইমানিকে হত্যা করার পর ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, তবে যদি কেউ আমাদের ক্ষতি করে, আমরা চুপ থাকব না।’ কিন্তু এ ‘প্রতিরক্ষা’ কৌশল এখন যুদ্ধের প্রথম অধ্যায় হয়ে উঠেছে।
এ সংকটে জাতিসংঘের ভূমিকা কার্যত শূন্য। রাশিয়া-ইরান-চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশ যখন শান্তি ও মধ্যস্থতার দাবি করছে, তখন পশ্চিমা শক্তিগুলোর ভেটো ক্ষমতা সেই উদ্যোগকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘জাতিসংঘ আজ এমন এক মঞ্চে পরিণত হয়েছে, যেখানে যুদ্ধ নীতিকে কূটনৈতিক ভাষায় বৈধতা দেওয়া হয়।’ একই সুরে কথা বলেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট, ‘যদি জাতিসংঘ কোনো ব্যবস্থা না নেয়, আমরা আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করব।’
দুগিনের কথায়, “প্রশ্ন এখন আর ‘যুদ্ধ করব কি না’ তা নয়; রাশিয়া তো যুদ্ধেই আছে। প্রশ্ন হলো ‘কীভাবে যুদ্ধ করব’?” অর্থাৎ, রাশিয়ার সামনে এখন কৌশলগত পুনর্বিবেচনার সময়। পুরনো পন্থা যেমন সংযম, পশ্চিমের সঙ্গে চুক্তি, জাতিসংঘের মাধ্যমে সমাধান সবই ব্যর্থ প্রমাণিত হচ্ছে। এখন প্রয়োজন এক নতুন যুদ্ধ কৌশল, যা শুধু রণাঙ্গনে নয়, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সব পরিসরে কার্যকর।
বিশ্ব কি আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? যদি আমরা কেবল কূটনৈতিক ব্যর্থতা, জাতিসংঘের অকার্যকারিতা এবং পশ্চিমাদের একচেটিয়া নীতিকে দেখি, তবে উত্তর হবে ‘হ্যাঁ’। কিন্তু মানবজাতি যদি একবার নিজেদের জিজ্ঞাসা করে, এ সংঘাতের মূল্য কী? তাহলে হয়তো এই সর্বনাশের পথ থেকে ফেরার সুযোগ এখনো আছে।
দুগিন যেমনটা বলেছিলেন, ‘যদি ইরান ভেঙে পড়ে, তবে শুধু নিজেকে নয়; আমাদের সবাইকেই আক্রমণের মুখে ফেলে দেবে।’ এ সতর্কবার্তা শুধু রাশিয়া নয়, গোটা বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য। বিশ্ব এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে সামান্য একটি ভুল, একটি বোমা, একটি বক্তব্যই হতে পারে এক নতুন মহাযুদ্ধের সূচনা।
লেখক: কবি, রাজনৈতিক-আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক