দুই দশক আগের কথা। আত্মবিশ্বাস আর আগ্রাসনের বিষাক্ত মিশ্রণে ইরাকের বুকে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। সে সময় বলা হয়েছিল, এটি হবে একটি ঝটিকা অভিযান। কয়েক দিনের মধ্যে মিশন সম্পন্ন হবে, প্রতিষ্ঠা হবে গণতন্ত্র। কিন্তু বাস্তবে জন্ম নিয়েছিল এক অন্তহীন যুদ্ধ। যা গ্রাস করে নিয়েছিল লাখো মানুষের প্রাণ। ভেঙে পড়েছিল গোটা অঞ্চল। আবার সেই একই পথে চলতে শুরু করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একই রকম আত্মবিশ্বাস, একই রকম আগ্রাসী কূটনীতি এবং একই রকম অন্ধত্ব পাল্টেছে শুধু অভিনেতা। এতদিন ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে যে সামরিক পদক্ষেপ ট্রাম্প নিয়েছেন, তা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিকেই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যকেই আবারও ঠেলে দিয়েছিল এক অস্থির, রক্তাক্ত ভবিষ্যতের দিকে। শান্তির দূত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউজে ফিরে আসা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িয়ে ফেলার জন্য একটি নাটকীয় পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনা তো দূরের কথা, ট্রাম্প এখন এমন একটি অঞ্চলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যেটা আবারও বড় যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। অথচ ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে একটি নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী যা করতে চান, সেটা হোয়াইট হাউজকে সঙ্গে নিয়ে করতে অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু মাত্র ১৫০ দিনের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পর মনে হচ্ছে ট্রাম্পও তার পূর্বসূরিদের মতো একই ফাঁদে পড়েছেন। কয়েক প্রজন্মের মধ্যে তিনি ইরানের ওপর এমন এক হামলা চালিয়েছেন, যার প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদে থাকবে।
প্রথম দিকে ধারণা ছিল, ট্রাম্প প্রশাসন নেতানিয়াহুর সামরিক উচ্চাকাক্সক্ষা নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু তারপর মনে হয়েছে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুলোতে সরাসরি হামলা চালাতে কৌশলে টেনে আনতে পেরেছেন। এর আগে একের পর এক চালানো সামরিক হামলা থেকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে নিবৃত্ত করতে পারেনি ওয়াশিংটন। ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের কয়েক দিন আগে তার মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ নেতানিয়াহুর সঙ্গে ইসরায়েলে সাপ্তাহিক ছুটির দিন দেখা করার দাবি নিয়ে ইসরায়েলে যান। এর উদ্দেশ্য ছিল গাজায় হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির আলোচনার জন্য নেতানিয়াহুকে চাপ দেওয়া। ওই সময় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এটিকে ‘ট্রাম্প ফ্যাক্টর’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, যা মার্কিন প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধোঁয়াশা রেখে দেওয়া এবং চুক্তি করার দক্ষতার প্রতি ইঙ্গিত করে। এ ট্রাম্প ফ্যাক্টর ক্ষমতাধর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে সামলানোর ক্ষেত্রে একটি স্পষ্ট সুবিধা দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছিল। নেতানিয়াহু এর আগে বিভিন্ন সময় মার্কিন প্রশাসনকে এ অঞ্চলে তার সামরিক অভিযানকে সমর্থন দিতে রাজি করাতে সক্ষম হলেও ইসরায়েলের কিছু সমালোচক ট্রাম্পের প্রশংসা করতে শুরু করেছিলেন যে তার নেতানিয়াহুর প্রভাব প্রতিহত করার সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু যখন মার্কিন বি-২ বোমারু বিমানগুলো ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে তখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, ট্রাম্পের উপলব্ধিতে পরিবর্তন এসেছে।
ট্রাম্পের যুদ্ধের প্রতি প্রকাশ্য বিতৃষ্ণা ও বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রকে আর কোনো সংঘাতে না জড়ানোর বিষয়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে দেওয়া প্রতিশ্রুতি, আবার দায়িত্ব গ্রহণের ২০০ দিনের কম সময়ের মধ্যে উধাও হয়ে গিয়েছিল। জনসমক্ষে এসে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের গুজব দূর করতে চেয়েছিলেন। তিনি এটা দেখানোরও চেষ্টা করেন যে মার্কিন নীতি ইসরায়েলের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলছে। এর মাধ্যমে মূলত যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকটা অন্ধকারে রেখেই যে ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসী বোমা হামলা চালিয়েছে, সে ধারণা নাকচের চেষ্টা করেছেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্রকে এখন মনে হচ্ছে, তারা ইসরায়েলি হামলাকে সম্পূর্ণরূপে এতদিন সমর্থন করেছে। ট্রাম্প তেহরানকে বলেছিলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি লক্ষ্যবস্তু করা হয়, তাহলে তারা আরও হামলা চালানোর জন্য প্রস্তুত। এরপরও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সসহ ট্রাম্পের নিজের প্রশাসনের কর্মকর্তারা সতর্ক করে আসছেন যে, তেহরান যদি পাল্টা হামলা চালায়, সেটা সীমিত হামলা হলেও তা ইরানে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক অভিযানে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও তা এই মুহূর্তে স্থগিত।
ইরানে চালানো মার্কিন বিমান হামলার কড়া সমালোচনা করেছেন ডেমোক্র্যাট নেতারা। এদিকে ডেমোক্র্যাট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স হামলাকে ‘চরম অসাংবিধানিক’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, এই দেশকে কেবলমাত্র কংগ্রেসই যুদ্ধের দিকে নিতে পারে। প্রেসিডেন্টের সেই এখতিয়ার নেই। তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, যুদ্ধ কখনোই একক সিদ্ধান্তে শুরু হওয়া উচিত নয়। এই হামলা কেবল ইরান নয়, সমগ্র অঞ্চলের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ডেমোক্র্যাট নেতারা ট্রাম্প প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তকে মার্কিন সংবিধান, কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও আন্তর্জাতিক শান্তির পরিপন্থী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তারা প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে অবজ্ঞা করে একতরফা সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন এবং বলেন, কংগ্রেসকে এ বিষয়ে জরুরি অধিবেশন ডেকে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, হামলার আন্তর্জাতিক প্রভাবের পাশাপাশি, এটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বড় ধরনের বিতর্ক ও বিভাজনের জন্ম দিচ্ছে যা যুদ্ধবিরতিতেও শেষ হবে না। বিশ্লেষকরা একে শুধুই রাজনৈতিক ভুল নয়, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলেও আখ্যা দিয়েছেন। এই যুদ্ধকে ঘিরে জনমতও ট্রাম্পের বিপক্ষে। যুদ্ধ কি আদতেই বন্ধ হলো?
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক