বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানির খাত। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ এখন সারা বিশে^ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা তাদের শ্রমলব্ধ অর্থ দেশে পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরও গতিশীল করছে। বলতে গেলে জনশক্তি রপ্তানি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণসঞ্চার করেছে। এই অবস্থায় বিদেশে নিত্যনতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করে ব্যাপকহারে আরও জনশক্তি রপ্তানির পথ উন্মুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করার পথ সুগম করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং কর্র্তৃপক্ষকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। শ্রমিকরা যাতে প্রতারণার শিকার না হয় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। অভিবাসন ব্যয় কমাতেও নিতে হবে কার্যকর ব্যবস্থা। সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত। সেখানে চিকিৎসক এবং নার্সের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সেখানে ডাক্তার ও নার্স পাঠাতে পারছে না বাংলাদেশ। প্রবাসে যে সমস্ত শ্রমিক কাজ করছে তাদের ৯৮ ভাগই অদক্ষ। বর্তমানে বছরে ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাচ্ছে সরকার জনশক্তি রপ্তানি খাত থেকে। এই অর্থ কয়েকগুণ করা সম্ভব যদি দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করা যায়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ডাক্তার এবং নার্সের যে চাহিদা রয়েছে সে চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ থেকে ডাক্তার নার্স পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারলে জনশক্তি রপ্তানির আয় সহজেই বাড়ানো যায়।
বিদেশের বাজারটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। যেসব জনশক্তি রপ্তানি করে তারা শুধু দক্ষ জনশক্তি তৈরিই করে না তাদের কীভাবে বিদেশে পাঠানো যায় সে ব্যাপারেও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু আমাদের দেশে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এ ব্যাপারে তেমন কোনো তৎপরতা নেই। এ কারণে দক্ষ জনশক্তির শ্রমবাজার প্রায় হারাতে বসেছে বাংলাদেশ। প্রবাসীদের আয়ের প্রতি নজর আছে। অর্থাৎ রেমিট্যান্স যাতে বাড়ে সেটি নিয়ে আকাক্সক্ষা আছে, কিন্তু তাদের সুখ-দুঃখ দেখার ব্যাপারে রয়েছে উদাসীনতা। বিদেশে যাওয়ার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি বা ‘আদম ব্যাপারির’ খপ্পর থেকে বিদেশগামীদের রক্ষা করতে হবে। যেখানে বিদেশে যেতে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা খরচ হওয়ার কথা সেখানে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা নেওয়া হয়। এই বাড়তি টাকার মাশুল গুনতেই প্রবাসীদের অনেক বছর লেগে যায়। বর্তমানে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কাতার, ওমান, কুয়েত, ইরাক, লিবিয়ায় ডাক্তার-নার্সদের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিককালে সৌদি সরকার সে দেশের স্বাস্থ্য সেক্টরে ব্যাপক বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করছে। ফলে চিকিৎসক-নার্স ও অন্যান্য দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশ ডাক্তার-নার্স নেওয়ার জন্য ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, নেপালের মতো দেশের দিকে ঝুঁকছে। অথচ এক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হলে বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় এই দক্ষ জনশক্তির বাজার ধরতে পারত। মধ্যপ্রাচ্যে দক্ষ জনশক্তির যে বাজার সৃষ্টি হয়েছে সে সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য অবশ্যই তৎপরতা চালাতে হবে। এতে একদিকে বিদেশে দেশের ডাক্তার-নার্সদের কর্মসংস্থান হবে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও বৃদ্ধি পাবে। আর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন যত বাড়বে দেশের জন্য তা ততই মঙ্গল। সরকার দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির জন্য সারাদেশে ট্রেনিং সেন্টার গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে দেশে ৩৭টি সরকারি ও ৭০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এসব মেডিকেল কলেজ থেকে বছরে ৫ হাজার ডাক্তার বের হচ্ছে। পাশাপাশি দেশে প্রায় ১০ হাজার নার্স বেকার রয়েছে। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তার-নার্সদের কর্মসংস্থানে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
অন্যদিকে মালয়েশিয়ায় রয়েছে বাংলাদেশের একটি বড় শ্রমবাজার। এই বাজার যাতে স্থায়ী বাজারে পরিণত হয় এ জন্য বাংলাদেশ সরকার কাজ করে যেতে হবে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে মালয়েশিয়ায় কলিং ভিসায় কর্মী নেওয়া শুরু করলে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বেসরকারি পর্যায়ে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বেশি টাকা নেওয়া, দালাল কর্র্তৃক প্রতারিত হওয়া, মালয়েশিয়ার আউটসোর্সিং কোম্পানি কর্র্তৃক প্রতারণা-চুক্তি অনুযায়ী যথাযথভাবে কাজ না দেওয়া ইত্যাকার নানা অভিযোগের প্রেক্ষাপটে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দেয় চার বছর আগে। মালয়েশিয়ায় বিপুল পরিমাণ কর্মী নিয়োগের প্রয়োজন হবে। কিন্তু তারা চায় অভিবাসন ব্যয় কমাতে। অভিবাসন ব্যয় কমলে মালয়েশিয়ায় যেতে একজন শ্রমিকের সর্বসাকল্যে খরচ হবে অনেক কম। খরচ কম হওয়ায় তিন বছরে একজন শ্রমিক তা পুষিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু দালাল চক্র বা মধ্যস্বত্ব ভোগীদের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ হলে অভিবাসন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। এতে একজন শ্রমিক বিদেশ যেতে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ করে। এই টাকা উঠাতেই তাদের কয়েক বছর লেগে যায়। তারপরও প্রতারণার ফাঁদ তো রয়েছেই। সভ্যতার ইতিহাস অভিবাসনের ইতিহাস। এ জন্য মানুষ যেখানে অন্ন এবং বাসস্থানের জন্য অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে সেখানেই তার আবাস গেড়েছে। দেখা যায় প্রায়ই বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন অবৈধ পথে শ্রমিকরা বিদেশ যাওয়ার সময় ধরা পড়ে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব মানুষ দুই পয়সা আয় করার জন্য বিদেশ বিভুঁইয়ে পাড়ি জমায়। অর্থাৎ বিদেশে শ্রমিকের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। সরকার সেই বাজারটি ধরতে পারছে না। কিংবা দালাল ও অসাধু জনশক্তি রপ্তানিকারকদের দৌরাত্ম্যের কারণে চাহিদা থাকা সত্ত্বে¡ও সেসব জায়গায় শ্রমিক পাঠানো সম্ভব হয় না। সেজন্য অবৈধভাবে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেন। এই চেষ্টা বন্ধ করতে হলে জনশক্তি রপ্তানি ব্যয় কমাতে হবে। বন্ধ করতে হবে অসাধু দালাল চক্রের অপতৎপরতা। বিদেশে শ্রমিকরা গিয়ে অনেক সময় অনেক সমস্যার মধ্যে পড়েন। এজন্য সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলো সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক সময় শ্রমিকরা বিপদে পড়েও দূতাবাস কর্মকর্তাদের কোনোরকম সহায়তা পান না। এতে যে ওই শ্রমিকটি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শুধু তাই নয়, দেশ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়। এ ব্যাপারটি অবশ্যই মাথায় রেখে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। এ ছাড়া বিদেশে গিয়ে অনেকেই নানা রকম ইচ্ছা-অনিচ্ছায় নানা রকম অপরাধ কর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এতে ওই সব দেশে শ্রমবাজার নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এজন্য এ ব্যাপারেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এর সঙ্গে দেশের সুনামের বিষয়টিও জড়িত। বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, ২০২৪ সালে বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়ে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮৬৯ জন কর্মী কাজের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। তাদের মধ্যে ৯ লাখ ৬৬২ জনই গেছেন সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই)। যা গত বছর মোট জনশক্তি রপ্তানির ৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ জনশক্তি রপ্তানি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এই পাঁচ দেশের ওপর। সেজন্য নতুন নতুন শ্রমবাজার যেমন খুঁজে বের করতে হবে, তেমনি বাজার ধরে রাখার জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আর জোর দিতে হবে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর দিকে। এজন্য প্রয়োজনে দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টির জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এই খাতটি যাতে কিছুতেই কোনো রকম হুমকির মুখে না পড়ে সে ব্যাপারেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
বাংলাদেশ ১৬৮টি দেশে কর্মী পাঠায়, এটি সরকারের দাবি হলেও ৯০ শতাংশের বেশি কর্মী যান গুটিকয়েক দেশে। বিএমইটির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে বিদেশে গেছেন ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন কর্মী। এর মধ্যে সৌদি আরব যান ৬ লাখ ১২ হাজার ৪১৮ জন। ২০২৩ সালে মোট কর্মী রপ্তানি হয় ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন; সৌদি আরব যান ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৪ জন। গত বছর মোট ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৩ জনের মধ্যে সৌদি আরব গেছেন ৬ লাখ ২৮ হাজার ৫৬৪ জন। গত এক বছরে মালয়েশিয়া, ইউএই এবং ওমান তাদের শ্রমবাজার বন্ধ করে দিয়েছে। কাতার, কুয়েত এবং সৌদি আরব বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ কমিয়েছে। এ অবস্থায় অভিবাসন খাতের পতন ঠেকাতে প্রচলিত বাজার পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি নতুন বাজার সৃষ্টির দিকে সরকারের নজর বাড়াতে হবে। সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কর্মী পাঠানো হয়েছে। গত কয়েক বছরে যারা গেছেন, তাদের বেশিরভাগ কম বেতনে কাজ করছেন। গত কয়েক বছরে সৌদি আরবে কর্মীদের বড় একটি অংশ গেছেন ফ্রি ভিসায়। তাদের কাজের কোনো চুক্তি নেই, কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তাও নেই। কাজ জোগাড় করে নিতে হয়। বেশি কর্মী যাওয়ায় দেশটিতে কাজের সুযোগ কমেছে।
ফ্রি ভিসায় যাওয়া কর্মীদের অনেকে সপ্তাহে এক-দুই দিন কাজ করতে পারেন। আবার যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুক্তিতে কাজ করছেন, তারাও প্রত্যাশা অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। সরকার নতুন শ্রমবাজার খোঁজার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে রয়েছে রাশিয়া, পর্তুগাল, মাল্টা, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও ইরাক। এজন্য দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে প্রশিক্ষণ বাড়ানো এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে সরাসরি চুক্তি করার উদ্যোগ রয়েছে। বেশ কিছু নতুন শ্রমবাজার নিয়ে কাজ চলছে। রাশিয়া বর্তমানে এসব গন্তব্যের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। পাশাপাশি ইরাকেও কর্মী যাচ্ছেন। শুধু ইরাকেই ৫০ হাজারের বেশি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। আর বর্তমানে ইরানে যাওয়ার পরিস্থিতি নেই। এর কারণ সবাই জানেন। যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহু, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ লাগিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে অশান্তির আগুন জ¦ালিয়েছেন। বিদেশে চাকরিপ্রার্থী কেউ যাতে দালাল বা অসাধু চক্র কিংবা সরকারি কোনো কর্মী দ্বারা কোনোভাবেই হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে চাকরিপ্রার্থী, সেখানেই অবৈধ অর্থের লেনদেন- প্রচলিত এই কুসংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। জনশক্তি রপ্তানির যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পাশাপাশি তাই দুর্নীতি মাথাচাড়া দেওয়ার সব ফাঁকফোকরও বন্ধ করতে হবে। আর এক্ষেত্রে কোনো শৈথিল্য, অব্যবস্থা, অসাধুতা এবং দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিকভাবে তার বা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট