চীনের বাংলাভাষী গুণিজন পাই খাই ইউয়ান
শান্তা মারিয়া | ৬ মার্চ, ২০২২ ০০:০০
অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ান। চীনের প্রবীণ লেখক, পণ্ডিত, গবেষক এবং বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। তিনি রবীন্দ্র রচনাবলী, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাসহ বাংলা সাহিত্যের অনেক সম্পদ চীনাভাষীদের কাছে তুলে ধরেছেন অনুবাদ ও নিজস্ব লেখার মাধ্যমে।
এই অসামান্য গুণী মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ২০১১ সালে। আমি তখন চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগে বিদেশি বিশেষজ্ঞ হিসেবে চাকরি নিয়ে সদ্য পেইচিং গিয়েছি। দেখলাম একজন সৌম্যদর্শন প্রৌঢ় চীনা ভদ্রলোক বাঙালি রীতিতে সালাম জানিয়ে পরিচিত হলেন। চীন আন্তর্জাতিক বেতারের নবীন প্রবীণ সব সহকর্মীই বাংলা ভাষা জানেন। বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ সহকর্মীরা তো যথেষ্ট ভালো বাংলা বলেন। তাই পাই সাহেব বাংলায় কথা বলায় অবাক হইনি। কিন্তু অবাক হলাম তার উচ্চারণ শুনে। চীনা সহকর্মীরা যত ভালো বাংলাই বলুন না কেন, তাদের উচ্চারণে একটা বিদেশি টান সহজেই লক্ষণীয়। কিন্তু এই ভদ্রলোকের বাংলায় কোনো বিদেশি সুর তো নেই-ই বরং তার মতো অমন পরিশীলিত ও প্রমিত বাংলা খুব কম বাঙালির কণ্ঠেই শোনা যায়। ক্রমে পরিচিত হলাম তার লেখার সঙ্গে। বেতারের কাজে তিনি যে লেখাগুলো আমাকে দেখতে দিতেন আমি সেগুলো সম্পাদনা করার বা পরিবর্তনের তেমন কোনো ফাঁক খুঁজে পেতাম না। উল্টো তার লেখা থেকে অনেক ভুলে যাওয়া বাংলা শব্দ নতুনভাবে মনে পড়ত। বলা যায় অনেক বাঙালি লেখকের চেয়েও তিনি ভালো বাংলা জানেন।
পরে আমি পাই খাই ইউয়ানের সুদীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে পারি। জানতে পারি তার বাংলা ভাষা চর্চার প্রেক্ষাপট।
চীনের মহান কমিউনিস্ট বিপ্লবের (১৯৪৯ সাল) মাত্র চার বছর আগে ১৯৪৫ সালে জিয়াং সু প্রদেশের চাং চৌ শহরে পাই খাই ইউয়ানের জন্ম। ১৯৬৫ সালে বিশ বছরের তরুণ পাই প্রথম পা রাখেন বাংলাদেশে। তখন এই ভূখণ্ডের পরিচিতি ছিল পূর্ব পাকিস্তান নামে। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা ভাষা শেখেন বাংলা একাডেমিতে। তখনই তিনি বিশ্বের মধুরতম ভাষাটির প্রেমে পড়েন আকণ্ঠ এবং পাশাপাশি ভালোবেসে ফেলেন পূর্ব বাংলার সংস্কৃতি।
চীন ও বাংলাদেশ। দুই দেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির যোগসূত্র স্থাপনে যে মুষ্ঠিমেয় গুণী মানুষরা কাজ করছেন তাদের মধ্যে অন্যতম অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ান।
১৯৬৯ সালে চীন আন্তর্জাতিক বেতারের (সে সময় রেডিও পিকিং) বাংলা বিভাগে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক পাই সাহেব ১৯৮৫ সালে আবার ঢাকায় আসেন দ্বিতীয় সাফ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। দ্বিতীয় সাফ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ শিরোনামে ম্যাস জিমনাস্টিকস প্রদর্শনে বাংলাদেশের ক্রীড়া বিভাগকে যে চীনা কোচ দল সাহায্য করে, সেই দলের অনুবাদক ছিলেন তিনি।
পাই সাহেব আবার বাংলাদেশে আসেন নব্বইয়ের দশকে। ১৯৯১-৯২ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেন।
দীর্ঘ ৩৬ বছর চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগে সাংবাদিকতা করার পর ২০০৬ সালে অবসর নেন পাই খাই ইউয়ান। কিন্তু নিয়মিত চাকরি শেষ হলেও কাজ তাকে ছাড়েনি। তিনি বাংলা বিভাগে বিশেষ কর্মী হিসেবে কাজ চালিয়ে যান।
২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত চীনের কুনমিং শহরে ইউননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষকও তিনি। বর্তমানে তিনি চীনের ন্যাশনাল ট্রান্সলেশন অ্যাসোসিয়েশন এবং চীনের ভারতীয় সাহিত্য গবেষণা অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা সমগ্রের চীনা অনুবাদ গ্রন্থের অন্যতম প্রধান সম্পাদক তিনি। বাংলা ভাষা থেকে অনূদিত সমস্ত কবিতা সম্পাদনা করা তার দায়িত্ব।
এবার আসি তার অনুবাদ কর্মের প্রসঙ্গে। চীনে রবীন্দ্র রচনাবলির অন্যতম প্রধান অনুবাদক ও সম্পাদক তিনি। ‘শান্তিনিকেতনের প্রাণের সুর’ নামে তার অনুবাদ করা রবীন্দ্রনাথের তিনশ’ কবিতার সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয় চীনের কুয়াংসি প্রদেশের গণপ্রকাশনালয় থেকে। চীন আন্তর্জাতিক বেতারের প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত হয় পাই অনূদিত রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শনমূলক কবিতা সংকলন। এখানে কণিকা, লেখন ও স্ফুলিঙ্গ বইয়ের কবিতাগুলো সংকলিত হয়। তার অনূদিত পুনশ্চ, শেষ সপ্তক, পত্রপুট ও শ্যামলী বইয়ের কবিতাগুলো নিয়ে ‘রবীন্দ্রনাথের গদ্য কবিতা সংকলন’ প্রকাশিত হয়েছে চেজিয়াং প্রদেশের সাহিত্য প্রকাশনালয় থেকে। চীনের জিয়াংসু প্রদেশের অনুবাদ প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গীতি কবিতা সংকলন।
চীনের কুয়াংতং প্রদেশের সাহিত্য প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত ‘বিশ্ব কাব্যভাণ্ডার’ নামের বিশাল গ্রন্থে স্থান পেয়েছে পাই খাই ইউয়ান অনূদিত মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কপোতাক্ষ নদ’, ‘পুরুরবার প্রতি ঊর্বশী’, বিষ্ণু দে’র ‘মহাশ্বেতা’, ‘ভারতীয় বিমানবাহিনী’, ‘বেনুর জন্য’ ‘ছত্তিশগড়ীর গান’, ‘২২ শে শ্রাবণ’ বুদ্ধদেব বসু’র ‘অসূর্যস্পর্শা’, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ ‘কোনো কুকুরের প্রতি’ ‘স্মৃতির প্রতি’ ‘ভিনদেশী’, ‘বেশ্যার মৃত্যু’ জীবনানন্দ দাশের ‘নগ্ন নির্জন হাত’, ‘রাত্রিদিন’, ‘অদ্ভুত আঁধার এক’, ‘ভোর’, ‘ছটি বোমার ১৯৪২’, ‘তোমাকে ভালোবাসে’, জসীম উদ্দীনের ‘কবর’, শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা’, ‘প্রলয়ান্তে’ ‘আভাস’, সৈয়দ আলী আহসানের ‘আমার পূর্ব বাংলা’,‘সিন্ধু মরুভূমির মধ্যে’।
পাই খাই ইউয়ান আরও বেশ কিছু বই চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতা সংকলন প্রকাশ হয়েছে চীনের কুয়াংসি প্রদেশের লিজিয়াং প্রকাশনালয় থেকে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উপন্যাস নৌকাডুবি চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। চীনের আনহুই প্রদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সনেট সংকলন। রবীন্দ্রনাথের শিশু ও শিশু ভোলানাথ বই দুটি প্রকাশ হয়েছে আনহুই থেকে। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সংকলন ‘গঙ্গা নদীর তপোবন’ নামে প্রকাশ করেছে চীন বেতার ও টিভি প্রকাশনালয়। রবীন্দ্রনাথের য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র, যাভাযাত্রীর পত্র, রাশিয়ার চিঠি এবং টকস ইন চায়নার অনুবাদ রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণকাহিনী সংকলন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কাহিনী কবিতার বই ‘কথা কাহিনী’ প্রকাশ হয়েছে সাংহাই থেকে। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, সোনারতরী, নদী, চিত্রা, কণিকা, লেখন, কাহিনী, কল্পনা, স্মরণ, শিশু, গীতালী, বলাকা, পলাতকা, শিশু ভোলানাথ, পুরবী, বনবাণী, পরিশেষ, পুনশ্চ, বিচিত্রা, শেষ সপ্তক, পত্রপুট, শ্যামলী, খাপছাড়া, ছড়ার ছবি, প্রান্তিক, সেঁজুতি, প্রহাসিনী, আকাশপ্রদীপ, নবজাতক, সানাই, রোগশয্যা, আরোগ্য, জন্মদিনে, ছড়া, শেষলেখা, সহজপাঠ, স্ফুলিঙ্গ অনুবাদ করেছেন এবং এগুলো হ্যপেই প্রদেশের শিক্ষা প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অন্য দুজন অনুবাদকের সঙ্গে যুক্তভাবে অনুবাদ করেছেন সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল, মানসী, চৈতালী, নৈবেদ্য, কেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, মহুয়া, বীথিকা ও কবিকাহিনী।
চীন আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশ হয়েছে তার অনূদিত রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণমূলক বই জীবন স্মৃতি, আমার ছেলেবেলা ও ছিন্নপত্র। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস যোগাযোগ অনুবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন প্রকাশ করেছে কুয়াংসি প্রদেশের লিজিয়াং প্রকাশনালয়। চীনের যুব প্রকাশনালয় প্রকাশ করেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা সংকলন ও গল্প সংকলন। চীনের বাণিজ্য প্রকাশনালয় প্রকাশ করেছে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থ ‘জীবন প্রসংগে’, ‘শিক্ষা প্রসংগে’, ‘সাহিত্য প্রসংগে’।
রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি ইংরেজি বইয়েরও অনুবাদ করেছেন তিনি। চীন আন্তর্জাতিক বেতারের প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা সংকলন। দুই খন্ডে প্রকাশিত ১০৯৭ পৃষ্ঠার এই বইতে অনূদিত হয়েছে নজরুলের ৪১৯টি কবিতা ও ১৫২টি গান। বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক দিলারা হাশেমের উপন্যাস ‘ঘর মন জানালা’ অনুবাদ করেছেন তিনি।
অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ান বয়সের দিক থেকে এখন বৃদ্ধ। কিন্তু কোনো কোনো মানুষ আছেন যারা কর্মক্ষমতা ও প্রাণচাঞ্চল্যের দিক থেকে চিরতরুণ। আমাদের প্রিয় ‘পাই ভাই’ তেমনি একজন তরুণ। তিনি এখনো বাংলা সাহিত্যকে চীনাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছেন আনন্দের সঙ্গে।
চীনের ইউননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই তখন আমার সেখানে চাকরি হওয়ার পেছনে মূল ভূমিকায় ছিলেন পাই খাই ইউয়ান এবং চীনা তরুণী কাও রুহি হোং। সেসময় দেখেছি পাই ভাই কী উদ্যমী এবং বাংলা ভাষাপ্রেমী একজন শিক্ষক। তরুণ ছাত্রছাত্রীদের কী নিষ্ঠার সঙ্গেই না তিনি বাংলা ভাষায় পাঠদান করেন। তার পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানের পরিধিও আমাকে অবাক করে। বিভিন্ন বিচিত্র বিষয়ে, ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী। চীনে শিক্ষক এবং শ্রদ্ধেয় মানুষকে ‘লাওশি’ বলে সম্বোধন করা হয়। আমি অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ানকে ‘পাই লাওশি’ নামে ডাকি। কারণ তার কাছ থেকে সব সময়েই আমি নতুন কিছু জানতে পারি, শিখতে পারি। এমন একজন মানুষ সমগ্র জাতির সম্পদ।
চীন বেতারে কাজের সময়ও তাকে দেখেছি বাংলাভাষাকে চীনাভাষীর দরবারে পেশ করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতে।
সব মিলিয়ে অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ান আমার একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় বড়ভাই। তার বিষয়ে কিছু লিখতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করছি। আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যদি পাই খাই ইউয়ানকে কোনো সম্মাননা প্রদান করা হয় সেটা হবে বাংলা ভাষাপ্রেমী এই পণ্ডিত গুণীজনের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। তাহলে জাতি হিসেবে আমরা এই মহান গুণী মানুষের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করতে পারব।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
শেয়ার করুন
শান্তা মারিয়া | ৬ মার্চ, ২০২২ ০০:০০

অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ান। চীনের প্রবীণ লেখক, পণ্ডিত, গবেষক এবং বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। তিনি রবীন্দ্র রচনাবলী, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাসহ বাংলা সাহিত্যের অনেক সম্পদ চীনাভাষীদের কাছে তুলে ধরেছেন অনুবাদ ও নিজস্ব লেখার মাধ্যমে।
এই অসামান্য গুণী মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ২০১১ সালে। আমি তখন চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগে বিদেশি বিশেষজ্ঞ হিসেবে চাকরি নিয়ে সদ্য পেইচিং গিয়েছি। দেখলাম একজন সৌম্যদর্শন প্রৌঢ় চীনা ভদ্রলোক বাঙালি রীতিতে সালাম জানিয়ে পরিচিত হলেন। চীন আন্তর্জাতিক বেতারের নবীন প্রবীণ সব সহকর্মীই বাংলা ভাষা জানেন। বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ সহকর্মীরা তো যথেষ্ট ভালো বাংলা বলেন। তাই পাই সাহেব বাংলায় কথা বলায় অবাক হইনি। কিন্তু অবাক হলাম তার উচ্চারণ শুনে। চীনা সহকর্মীরা যত ভালো বাংলাই বলুন না কেন, তাদের উচ্চারণে একটা বিদেশি টান সহজেই লক্ষণীয়। কিন্তু এই ভদ্রলোকের বাংলায় কোনো বিদেশি সুর তো নেই-ই বরং তার মতো অমন পরিশীলিত ও প্রমিত বাংলা খুব কম বাঙালির কণ্ঠেই শোনা যায়। ক্রমে পরিচিত হলাম তার লেখার সঙ্গে। বেতারের কাজে তিনি যে লেখাগুলো আমাকে দেখতে দিতেন আমি সেগুলো সম্পাদনা করার বা পরিবর্তনের তেমন কোনো ফাঁক খুঁজে পেতাম না। উল্টো তার লেখা থেকে অনেক ভুলে যাওয়া বাংলা শব্দ নতুনভাবে মনে পড়ত। বলা যায় অনেক বাঙালি লেখকের চেয়েও তিনি ভালো বাংলা জানেন।
পরে আমি পাই খাই ইউয়ানের সুদীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য কর্মজীবন সম্পর্কে জানতে পারি। জানতে পারি তার বাংলা ভাষা চর্চার প্রেক্ষাপট।
চীনের মহান কমিউনিস্ট বিপ্লবের (১৯৪৯ সাল) মাত্র চার বছর আগে ১৯৪৫ সালে জিয়াং সু প্রদেশের চাং চৌ শহরে পাই খাই ইউয়ানের জন্ম। ১৯৬৫ সালে বিশ বছরের তরুণ পাই প্রথম পা রাখেন বাংলাদেশে। তখন এই ভূখণ্ডের পরিচিতি ছিল পূর্ব পাকিস্তান নামে। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা ভাষা শেখেন বাংলা একাডেমিতে। তখনই তিনি বিশ্বের মধুরতম ভাষাটির প্রেমে পড়েন আকণ্ঠ এবং পাশাপাশি ভালোবেসে ফেলেন পূর্ব বাংলার সংস্কৃতি।
চীন ও বাংলাদেশ। দুই দেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির যোগসূত্র স্থাপনে যে মুষ্ঠিমেয় গুণী মানুষরা কাজ করছেন তাদের মধ্যে অন্যতম অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ান।
১৯৬৯ সালে চীন আন্তর্জাতিক বেতারের (সে সময় রেডিও পিকিং) বাংলা বিভাগে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক পাই সাহেব ১৯৮৫ সালে আবার ঢাকায় আসেন দ্বিতীয় সাফ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। দ্বিতীয় সাফ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ শিরোনামে ম্যাস জিমনাস্টিকস প্রদর্শনে বাংলাদেশের ক্রীড়া বিভাগকে যে চীনা কোচ দল সাহায্য করে, সেই দলের অনুবাদক ছিলেন তিনি।
পাই সাহেব আবার বাংলাদেশে আসেন নব্বইয়ের দশকে। ১৯৯১-৯২ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেন।
দীর্ঘ ৩৬ বছর চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা বিভাগে সাংবাদিকতা করার পর ২০০৬ সালে অবসর নেন পাই খাই ইউয়ান। কিন্তু নিয়মিত চাকরি শেষ হলেও কাজ তাকে ছাড়েনি। তিনি বাংলা বিভাগে বিশেষ কর্মী হিসেবে কাজ চালিয়ে যান।
২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত চীনের কুনমিং শহরে ইউননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষকও তিনি। বর্তমানে তিনি চীনের ন্যাশনাল ট্রান্সলেশন অ্যাসোসিয়েশন এবং চীনের ভারতীয় সাহিত্য গবেষণা অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সদস্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা সমগ্রের চীনা অনুবাদ গ্রন্থের অন্যতম প্রধান সম্পাদক তিনি। বাংলা ভাষা থেকে অনূদিত সমস্ত কবিতা সম্পাদনা করা তার দায়িত্ব।
এবার আসি তার অনুবাদ কর্মের প্রসঙ্গে। চীনে রবীন্দ্র রচনাবলির অন্যতম প্রধান অনুবাদক ও সম্পাদক তিনি। ‘শান্তিনিকেতনের প্রাণের সুর’ নামে তার অনুবাদ করা রবীন্দ্রনাথের তিনশ’ কবিতার সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয় চীনের কুয়াংসি প্রদেশের গণপ্রকাশনালয় থেকে। চীন আন্তর্জাতিক বেতারের প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত হয় পাই অনূদিত রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শনমূলক কবিতা সংকলন। এখানে কণিকা, লেখন ও স্ফুলিঙ্গ বইয়ের কবিতাগুলো সংকলিত হয়। তার অনূদিত পুনশ্চ, শেষ সপ্তক, পত্রপুট ও শ্যামলী বইয়ের কবিতাগুলো নিয়ে ‘রবীন্দ্রনাথের গদ্য কবিতা সংকলন’ প্রকাশিত হয়েছে চেজিয়াং প্রদেশের সাহিত্য প্রকাশনালয় থেকে। চীনের জিয়াংসু প্রদেশের অনুবাদ প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গীতি কবিতা সংকলন।
চীনের কুয়াংতং প্রদেশের সাহিত্য প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত ‘বিশ্ব কাব্যভাণ্ডার’ নামের বিশাল গ্রন্থে স্থান পেয়েছে পাই খাই ইউয়ান অনূদিত মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কপোতাক্ষ নদ’, ‘পুরুরবার প্রতি ঊর্বশী’, বিষ্ণু দে’র ‘মহাশ্বেতা’, ‘ভারতীয় বিমানবাহিনী’, ‘বেনুর জন্য’ ‘ছত্তিশগড়ীর গান’, ‘২২ শে শ্রাবণ’ বুদ্ধদেব বসু’র ‘অসূর্যস্পর্শা’, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ ‘কোনো কুকুরের প্রতি’ ‘স্মৃতির প্রতি’ ‘ভিনদেশী’, ‘বেশ্যার মৃত্যু’ জীবনানন্দ দাশের ‘নগ্ন নির্জন হাত’, ‘রাত্রিদিন’, ‘অদ্ভুত আঁধার এক’, ‘ভোর’, ‘ছটি বোমার ১৯৪২’, ‘তোমাকে ভালোবাসে’, জসীম উদ্দীনের ‘কবর’, শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা’, ‘প্রলয়ান্তে’ ‘আভাস’, সৈয়দ আলী আহসানের ‘আমার পূর্ব বাংলা’,‘সিন্ধু মরুভূমির মধ্যে’।
পাই খাই ইউয়ান আরও বেশ কিছু বই চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতা সংকলন প্রকাশ হয়েছে চীনের কুয়াংসি প্রদেশের লিজিয়াং প্রকাশনালয় থেকে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উপন্যাস নৌকাডুবি চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। চীনের আনহুই প্রদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সনেট সংকলন। রবীন্দ্রনাথের শিশু ও শিশু ভোলানাথ বই দুটি প্রকাশ হয়েছে আনহুই থেকে। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সংকলন ‘গঙ্গা নদীর তপোবন’ নামে প্রকাশ করেছে চীন বেতার ও টিভি প্রকাশনালয়। রবীন্দ্রনাথের য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র, যাভাযাত্রীর পত্র, রাশিয়ার চিঠি এবং টকস ইন চায়নার অনুবাদ রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণকাহিনী সংকলন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কাহিনী কবিতার বই ‘কথা কাহিনী’ প্রকাশ হয়েছে সাংহাই থেকে। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী, সোনারতরী, নদী, চিত্রা, কণিকা, লেখন, কাহিনী, কল্পনা, স্মরণ, শিশু, গীতালী, বলাকা, পলাতকা, শিশু ভোলানাথ, পুরবী, বনবাণী, পরিশেষ, পুনশ্চ, বিচিত্রা, শেষ সপ্তক, পত্রপুট, শ্যামলী, খাপছাড়া, ছড়ার ছবি, প্রান্তিক, সেঁজুতি, প্রহাসিনী, আকাশপ্রদীপ, নবজাতক, সানাই, রোগশয্যা, আরোগ্য, জন্মদিনে, ছড়া, শেষলেখা, সহজপাঠ, স্ফুলিঙ্গ অনুবাদ করেছেন এবং এগুলো হ্যপেই প্রদেশের শিক্ষা প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অন্য দুজন অনুবাদকের সঙ্গে যুক্তভাবে অনুবাদ করেছেন সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল, মানসী, চৈতালী, নৈবেদ্য, কেয়া, গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, মহুয়া, বীথিকা ও কবিকাহিনী।
চীন আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশ হয়েছে তার অনূদিত রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণমূলক বই জীবন স্মৃতি, আমার ছেলেবেলা ও ছিন্নপত্র। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস যোগাযোগ অনুবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন প্রকাশ করেছে কুয়াংসি প্রদেশের লিজিয়াং প্রকাশনালয়। চীনের যুব প্রকাশনালয় প্রকাশ করেছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা সংকলন ও গল্প সংকলন। চীনের বাণিজ্য প্রকাশনালয় প্রকাশ করেছে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থ ‘জীবন প্রসংগে’, ‘শিক্ষা প্রসংগে’, ‘সাহিত্য প্রসংগে’।
রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি ইংরেজি বইয়েরও অনুবাদ করেছেন তিনি। চীন আন্তর্জাতিক বেতারের প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা সংকলন। দুই খন্ডে প্রকাশিত ১০৯৭ পৃষ্ঠার এই বইতে অনূদিত হয়েছে নজরুলের ৪১৯টি কবিতা ও ১৫২টি গান। বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক দিলারা হাশেমের উপন্যাস ‘ঘর মন জানালা’ অনুবাদ করেছেন তিনি।
অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ান বয়সের দিক থেকে এখন বৃদ্ধ। কিন্তু কোনো কোনো মানুষ আছেন যারা কর্মক্ষমতা ও প্রাণচাঞ্চল্যের দিক থেকে চিরতরুণ। আমাদের প্রিয় ‘পাই ভাই’ তেমনি একজন তরুণ। তিনি এখনো বাংলা সাহিত্যকে চীনাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছেন আনন্দের সঙ্গে।
চীনের ইউননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন শিক্ষক হিসেবে যোগ দিই তখন আমার সেখানে চাকরি হওয়ার পেছনে মূল ভূমিকায় ছিলেন পাই খাই ইউয়ান এবং চীনা তরুণী কাও রুহি হোং। সেসময় দেখেছি পাই ভাই কী উদ্যমী এবং বাংলা ভাষাপ্রেমী একজন শিক্ষক। তরুণ ছাত্রছাত্রীদের কী নিষ্ঠার সঙ্গেই না তিনি বাংলা ভাষায় পাঠদান করেন। তার পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানের পরিধিও আমাকে অবাক করে। বিভিন্ন বিচিত্র বিষয়ে, ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী। চীনে শিক্ষক এবং শ্রদ্ধেয় মানুষকে ‘লাওশি’ বলে সম্বোধন করা হয়। আমি অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ানকে ‘পাই লাওশি’ নামে ডাকি। কারণ তার কাছ থেকে সব সময়েই আমি নতুন কিছু জানতে পারি, শিখতে পারি। এমন একজন মানুষ সমগ্র জাতির সম্পদ।
চীন বেতারে কাজের সময়ও তাকে দেখেছি বাংলাভাষাকে চীনাভাষীর দরবারে পেশ করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতে।
সব মিলিয়ে অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ান আমার একজন অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় বড়ভাই। তার বিষয়ে কিছু লিখতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করছি। আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যদি পাই খাই ইউয়ানকে কোনো সম্মাননা প্রদান করা হয় সেটা হবে বাংলা ভাষাপ্রেমী এই পণ্ডিত গুণীজনের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। তাহলে জাতি হিসেবে আমরা এই মহান গুণী মানুষের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করতে পারব।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক