আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলার ভাব ভাষা ও লালন চর্চা
সাইমন জাকারিয়া | ৬ মার্চ, ২০২২ ০০:০০
বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার ভাব, ভাষার অন্তর্গত সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা ও গবেষণার জন্য বাংলা বিভাগ চালু রয়েছে। আমার সৌভাগ্য হয়েছে সাম্প্রতিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক-শিক্ষক-গবেষকসহ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ, ভাববিনিময় এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সভা-সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও বক্তৃতা প্রদান করার। এর মধ্যে আমেরিকার দি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর বাংলা বিভাগসহ সংগীত বিভাগ ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সম্মেলনে বক্তৃতা প্রদানসহ ক্লাস লেকচার দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। পাশাপাশি আমেরিকার ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বক্তৃতা প্রদানের সুযোগ হয়েছে। এ ছাড়া বাংলার সংগীত সংস্কৃতি, ভাব-দর্শন, প্রাচীন পান্ডুলিপি নিয়ে বিভিন্নভাবে অধ্যয়ন, গবেষণ ও চর্চারত পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ করেছি। এমনকি ইউরোপ, এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্চিত বাংলার ভাব-দর্শন-সংস্কৃতি-সাহিত্য প্রভৃতিবিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন, গবেষণার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছি।
এসব আন্তর্জাতিক সংযোগের ভিত্তিতে দীর্ঘদিন ধরে ‘ভাবনগর : ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব বেঙ্গল স্টাডিজ’ প্রকাশ করে আসছি। যেখানে মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা চর্চাকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবাঙালি অধ্যাপকরা বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ লিখে থাকেন। এরই মধ্যে ভাবনগর : ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব বেঙ্গল স্টাডিজে আমেরিকা, ফ্রান্স, চেক রিপাবলিক, পোল্যান্ড, রাশিয়া, ইতালি, জার্মান, জাপান, চীন, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের রচিত বাংলা ভাষায় রচিত বহু মৌলিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেই সূত্রে ভাবনগর : ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন ভাষিক অধ্যাপক-গবেষকদের বাংলা ভাষা চর্চার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চা ও গবেষণা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান নিয়ে গবেষণার প্রবণতা, কোনো বিশ^বিদ্যালয়ে আবার বাংলার সমকালীন ঐতিহ্যিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার চর্চাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, কোথাও আবার বাংলার ভাববাদ, সংগীত সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ভাববাদ ও সংগীত সংস্কৃতির মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অধ্যাপক-গবেষকদের প্রিয় বিষয় হলো লালন সাঁই থেকে শুরু করে ভবা পাগলা, আবদুল গফুর হালী প্রমুখ। এরই মধ্যে এদের প্রত্যেকের ওপর বিভিন্ন ভাষা প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা যেমন সম্পন্ন হয়েছে, তেমনি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যেমন : লালন সাঁইয়ের জীবন, সংগীত ও সমকালীন চর্চা-গবেষণা নিয়ে জাপানি ভাষায় গ্রন্থ এবং লালন সাঁইয়ের গানের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা ইংরেজি ভাষায় প্রণীত হয়েছে, ইতালীয় ভাষায় ভবা পাগলার ওপর গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে ও ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে, আবদুল গফুর হালীর ওপর জার্মান ভাষায় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অবাঙালি গবেষকদের অনেকে বাংলার ভাব-ভাষা-সংস্কৃতি গবেষণায় এতটাই নিবেদিত হয়েছেন যে, নিয়মানুযায়ী গুরুবাদে দীক্ষা নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। অনেকে আবার আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে এ দেশের লোকায়ত ভাবপরিমন্ডলের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশে ও অবস্থান নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন আমেরিকার গবেষক ক্যারোল সলোমন, জার্মানের অধ্যাপক হান্স হার্ডার, জাপানের অধ্যাপক মাসাহিকো তোগাওয়া, ইতালির অধ্যাপক ক্যারোলা এরিকা লোরেয়া প্রমুখ।
একটি প্রবন্ধে এদের প্রত্যেকের গবেষণাকর্ম সম্পর্কে তথ্য উপস্থাপন সম্ভব নয়। তাই এই প্রবন্ধে জাপানের প্রখ্যাত গবেষক মাসাহিকো কর্তৃক বিদেশি ভাষায় রচিত লালনবিষয়ক প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ ‘শুক্যোনি কৌসুর সেইজা : হিন্দু-কিও তো ইসলাম ওয়া মিগুরু শইউকিওউ গ্যাইনিন নো সাইকোউছিকু’ সম্পর্কে কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, অধ্যাপক মাসাহিকো তোগাওয়া এ ধরনের গবেষণা প্রণয়নের বহু বছর আগেই কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামের লালনপন্থি এক সাধকের কাছে লালনপন্থায় দীক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জনসংস্কৃতি সমীক্ষণ করেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম ভাবচর্চা, হিন্দু সংস্কৃতি এবং লালনপন্থি ভাবসাধকদের জীবন, সংগীত ও দর্শন নিয়ে একাধিক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা হলো ‘শুক্যোনি কৌসুর সেইজা : হিন্দু-কিও তো ইসলাম ওয়া মিগুরু শইউকিওউ গ্যাইনিন নো সাইকোউছিকু’ ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে জাপানের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
মাসাহিকো তোগাওয়া রচিত জাপানি ভাষায় গ্রন্থ ‘শুক্যোনি কৌসুর সেইজা : হিন্দু-কিও তো ইসলাম ওয়া মিগুরু শইউকিওউ গ্যাইনিন নো সাইকোউছিকু’-এর ভাবগত অর্থ হলো আধুনিকযুগের ধর্ম এবং একজন সাধকের দর্শন। এ ধরনের শিরোনামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একজন সাধক হলেন লালন সাঁই। এতে লালন সাঁইয়ের বিতর্কিত জীবনী থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ও লালন সাঁইয়ের দর্শন; ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশে লালন চর্চার বিবর্তনের ধারা, এমনকি ২০০০ খ্রিস্টাব্দে লালনের আখড়া রক্ষার আন্দোলনের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করা হয়েছে।
ভূমিকাসহ গ্রন্থটি ৭টি অধ্যায়ে বিভক্ত। গ্রন্থের ভূমিকায় ধর্মের ধারণা, ইসলাম ও হিন্দুধর্মের বৈশিষ্ট্য, ইসলাম ও সুফি সাধনার সম্পর্ক, হিন্দুধর্ম ও সাধুদের সম্পর্ক, বাউল কী, হিন্দুধর্ম ও ইসলামের সঙ্গে বাউলের সম্পর্ক কী, সাধক বলতে কী বোঝায় ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘লালন হিন্দু কি মুসলমান’। এই অধ্যায়ে ফকির লালন সাঁইয়ের জীবনীর প্রচলিত ধারণা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, একই সঙ্গে হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত লালনের জীবনী, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে লালন, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ ব্রিটিশ কাল পর্বে লালনের জীবনীর বিভিন্ন দিক, পাকিস্তান কাল পর্বে লালন জীবনী নিয়ে দ্বিমত শুরুর প্রসঙ্গ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে লালনের জীবনী লেখার ইতিহাস বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এই অধ্যায়ে পাকিস্তান আমলে ‘দ্বিমত শুরু’ উপ-শিরোনামে হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত লালন-জীবনীর ইঙ্গিত, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি, প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত বসন্তকুমার পালের রচনা এবং মোহাম্মদী পত্রিকায় প্রকাশিত নূর মোহাম্মদের রচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ের লালন গবেষক আবু তালিব, এস এম লুৎফর রহমান, খোন্দকার রিয়াজুল হক, আনোয়ারুল করীমের মতামত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এরপর ‘মতের বিরুদ্ধে’ উপ-শিরোনামে এ এইচ এম ইমামউদ্দিন, আবুল আহসান চৌধুরী, ম. মনিরুজ্জামান প্রমুখ গবেষকের বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম ‘লালনের ধর্মীয় দর্শন’। এই অধ্যায়ে গবেষক মাসাহিকো তোগাওয়া যথাক্রমে বাংলার বাউল ও লালন ফকির, ফোকলোর ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে কবীর থেকে বাউলদের দর্শন ও লালনের গানের বাণীর বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। একই সঙ্গে লালনের গানের সান্ধ্যভাষা বা গূঢ়তত্ত্ব এবং দেহতত্ত্বের গানের মর্মকথা ব্যাখ্যা করেছেন। তবে, তিনি এই অধ্যায়ে শেষে লালনের গানের অর্থ বোঝার জন্য একটাই সমাধান দিয়েছেন, আর তা হলো সাধনা ছাড়া লালনের গান বোঝা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তিনি হয়তো সাধুদের মতোই গুরুকে শরণ নেওয়াকেই ইঙ্গিত করেছেন।
তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম ‘সুফিবাদী ইসলাম ও লালন’। এই অধ্যায়ে ইসলাম ধর্মের শরিয়তি ধারা ও মারফতি ধারার তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে আল্লাহ এবং খাস তরিকার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পাশাপাশি পুনর্জন্ম ভেদ প্রসঙ্গে লালনের তান্ত্রিক সাধনার কথা এবং সুফিবাদের মধ্যে তন্ত্রসাধনার প্রভাব বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এই অধ্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এখানে বাংলাদেশের ধর্মী সাধনার বিস্তার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গবেষক পর্যবেক্ষণ করেছেন, বাংলাদেশের ধর্মীয় সাধনার বিস্তারের একদিকে রয়েছে সুফি সাধনার ধারা, অন্যদিকে রয়েছে তান্ত্রিক সাধনপদ্ধতি। লালনের সাধনার ধারা এ সমাজের মধ্যে স্বতন্ত্র এবং তা পর্যবেক্ষণমূলক। এ ছাড়া, সুফিবাদ ও বাউলতত্ত্বের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত তিনটি হরফ আলিফ, লাম ও মিমের ব্যাখ্যা হাজির করেছেন এই গ্রন্থে।
চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বাউল সাধকদের রক্ষার আন্দোলন’। এই অধ্যায়ে গবেষক মাসাহিকো তোগাওয়া ইতিহাসের আলোকে বাউল সাধক শিরোমণি লালন সাঁইজির মতো, দর্শন, জীবন-সাধনা এবং বাউল-সাধকদের আশ্রম বা আখড়া বাড়ি রক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ের আন্দোলন বিশ্লেষণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ করে ব্রিটিশ উপনিবেশকালে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে শরিয়তপন্থিদের প্রবর্তিত বাউল ধ্বংস ফতোয়া থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারিভাবে লালন সাঁইজির মাজার দখলের ঘটনা বিশ্লেষণ করেছেন। এই অধ্যায়ের আলোচনায় তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারিভাবে লালন সাঁইজির মাজার দখলের সময় পুলিশের লাঠির আঘাতে লালনপন্থি সাধক বিল্লাল শাহ মারাত্মকভাবে আহত হন এবং পরে মরা যান। এই অধ্যায়ের আলোচনায় ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ‘লালন আখড়া রক্ষা কমিটি’ গঠন-সংক্রান্ত বিশ্লেষণে মাসাহিকো তোগাওয়া তথ্য দিয়েছেন যে, ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে শেখ হাসিনা লালনের আখড়া বাড়িতে অডিটোরিয়াম ও রেস্টহাউজ নির্মাণের ঘোষণা দেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কবি, লেখক ও সুধীসমাজের তৎপরতায় লালন আখড়া রক্ষা কমিটি গঠিত হয়। এই রক্ষা কমিটির আন্দোলনের মুখে হাইকোর্ট লালনের আখড়ার মধ্যে সব ধরনের ভবন নির্মাণের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরই মধ্যে লালনপন্থি ফকিরদের সমন্বয়ে আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহের নেতৃত্বে লালন মাজার শরিফ ও সেবা-সদন কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু গবেষক এই অধ্যায়ের বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, ঢাকার সুধীসমাজ কর্তৃক গঠিত লালন সাঁইজির আখড়া রক্ষার কমিটি ও লালনপন্থি সাধকদের সেবা-সদন কমিটির মধ্যে সেই আন্দোলনে কোনো সমন্বয় ছিল না।
পঞ্চম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বাউলের সংগ্রাম’। এই অধ্যায়ে লালনপন্থি সাধক হিসেবে গবেষক মাসাহিকো তোগাওয়া তার নিজের কথা জানান দিয়েছেন। কেননা, তিনি কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামের লালনপন্থি সাধক আলাউদ্দিন শাহের কাছে লালনমতে দীক্ষা নিয়েছেন। লালন আখড়া রক্ষার আন্দোলনের জন্য তিনি জাপান থেকে বাংলাদেশে আসেন এবং বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র প্রথম আলো-তে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এই অধ্যায় থেকে জানা যায়, তার সেই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাময়িকভাবে লালন আখড়া প্রাঙ্গণে নির্মাণকাজ থেমে যায়। কিন্তু ২০০১ খ্রিস্টাব্দে আবার কোনো এক রহস্যময় কারণে নির্মাণকাজ শুরু হয়। গবেষক এই অধ্যায়ে লালন আখড়া রক্ষার সেই ব্যর্থ সংগ্রামের রহস্য ব্যাখ্যা করেছেন।
ষষ্ঠ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে বাউল গান’। এই অধ্যায়ে ইউনেসকো কর্তৃক ইন্ট্যানজিবল হেরিটেজ হিসেবে বাউল গানের স্বীকৃতি দানের প্রসঙ্গ এবং বাংলাদেশের নগরকেন্দ্রিক শিল্পীদের মধ্যে বাউল গানের চর্চা নিয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে। এই আলোচনায় গবেষক মাসাহিকো তোগাওয়া লালনসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী ফরিদা পরভীন থেকে শুরু করে একেবারে সাম্প্রতিক তরুণ শিল্পী আনুশেহ আনাদিলের গায়কি নিয়ে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। একই সঙ্গে মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাউল গান চর্চার সাম্প্রতিক ধারা বিশ্লেষণ করেছেন।
সপ্তম অধ্যায়টি হলো এই গ্রন্থের উপসংহার, যার শিরোনাম হচ্ছে ‘ধর্মীয় দর্শন ও লালন’। এই অধ্যায়ে গবেষক মূলত আধুনিকযুগে লালন সাঁইজির দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করেছেন। গবেষণাগ্রন্থের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এই গ্রন্থে প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র, শব্দের ব্যাখ্যা, নির্ঘণ্ট এবং মানচিত্র, আলোকচিত্র, হস্তলিপি ইত্যাদি মুদ্রিত হয়েছে।
জাপানের সুধীসমাজে বাংলাদেশের ভাবসাধক শিরোমণি লালন সাঁইয়ের জীবন-দর্শন ও সংগীতকে গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে গ্রন্থটি বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছে। একই সঙ্গে লালন সাঁইয়ের দর্শনের বীজ একজন ভিন্নভাষী গবেষকের দৃষ্টিতে কীভাবে ব্যাখ্যাত এবং বিশ্লেষিত তা জানার জন্য গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশের উদ্যোগ নিলে ভালো হতো।
উল্লেখ্য, মাসাহিকো তোগাওয়ার এই গ্রন্থ প্রকাশের প্রায় আট বছর পর ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ওয়াশিংটন বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রয়াত শিক্ষক-গবেষক-অনুবাদ ডক্টর ক্যারোল সলোমনের দীর্ঘদিনের লালন-গবেষণার ফসল ‘সিটি অব মিরোরস : সংস অব লালন সাঁই’ তথা ‘আরশিনগর : লালন সাঁইয়ের গান’ প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থে লালন সাঁইয়ের ১৩৭টি গানের মূল বাংলা পাঠ, ট্রান্সলিটারেশন, ইংরেজি অনুবাদ, ইংরেজি ব্যাখ্যা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া, গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন ইউরোপের বিখ্যাত বাউল গবেষক জিয়ান ওপেনশ এবং প্রসঙ্গ-কথা লিখেছেন ওয়াশিংটন বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড সলোমন। আমাদের সৌভাগ্য যে, ক্যারোল সলোমনকৃত গ্রন্থটি সম্পাদনাকর্মে আমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন আমেরিকার আরেক বিখ্যাত গবেষক কিথ ই. কান্তু। উল্লেখ্য, ক্যারোল সলোমন তার এই গ্রন্থের জন্য লালন সাঁইয়ের প্রতিটি গানের প্রামাণ্য বাংলা পাঠ নির্ধারণে লালন সাঁইয়ের প্রত্যক্ষ শিষ্যদের হস্তলিখিত পা-ুলিপি, রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি দীর্ঘদিন ধরে লালন সাঁইয়ের গানের প্রামাণ্য পাঠ নির্ধারণে পা-ুলিপির পাশাপাশি লালনপন্থি শ্রেষ্ঠ সাধকশিল্পী ও সংগীতগুরু খোদাবক্স সাঁইয়ের সঙ্গ লাভ করেন এবং সেই সঙ্গের ভিত্তিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন খোদাবক্স সাঁইয়ের ভাব-কন্যা। খোদাবক্স সাঁইয়ের তিরোধানের পর তিনি সাধকশিল্পী আবদুল করিম শাহের সহায়তা গ্রহণ করেন।
ক্যারোল সলোমনের ‘সিটি অব মিরোরস : সংস অব লালন সাঁই’ (আরশিনগর : লালন সাঁইয়ের গান) এখন পর্যন্ত লালন সাঁইয়ের সংগীত নিয়ে সর্ববৃহৎ অ্যাকাডেমিক প্রকাশনা এবং একমাত্র আন্তর্জাতিক অ্যাকাডেমিক প্রকাশনা যেখানে লালন সাঁইয়ের রচিত প্রতিটি গানের নির্ভরযোগ্য বাংলা প্রামাণ্য পাঠ করার আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষ করা যায়। একই সঙ্গে গ্রন্থটি বাংলা ও ইংরেজি দ্বিভাষিক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা হিসেবে স্বীকৃত। এই গ্রন্থটির ভেতর দিয়ে লালন সাঁইয়ের সংগীত গবেষণার আন্তর্জাতিক দিগন্ত নতুনভাবে উন্মোচিত হয়েছে।
লেখক : নাট্যকার ও গবেষক
শেয়ার করুন
সাইমন জাকারিয়া | ৬ মার্চ, ২০২২ ০০:০০

বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার ভাব, ভাষার অন্তর্গত সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা ও গবেষণার জন্য বাংলা বিভাগ চালু রয়েছে। আমার সৌভাগ্য হয়েছে সাম্প্রতিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক-শিক্ষক-গবেষকসহ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ, ভাববিনিময় এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সভা-সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও বক্তৃতা প্রদান করার। এর মধ্যে আমেরিকার দি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর বাংলা বিভাগসহ সংগীত বিভাগ ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সম্মেলনে বক্তৃতা প্রদানসহ ক্লাস লেকচার দেওয়ার সুযোগ হয়েছে। পাশাপাশি আমেরিকার ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বক্তৃতা প্রদানের সুযোগ হয়েছে। এ ছাড়া বাংলার সংগীত সংস্কৃতি, ভাব-দর্শন, প্রাচীন পান্ডুলিপি নিয়ে বিভিন্নভাবে অধ্যয়ন, গবেষণ ও চর্চারত পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ করেছি। এমনকি ইউরোপ, এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্চিত বাংলার ভাব-দর্শন-সংস্কৃতি-সাহিত্য প্রভৃতিবিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন, গবেষণার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছি।
এসব আন্তর্জাতিক সংযোগের ভিত্তিতে দীর্ঘদিন ধরে ‘ভাবনগর : ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব বেঙ্গল স্টাডিজ’ প্রকাশ করে আসছি। যেখানে মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা চর্চাকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবাঙালি অধ্যাপকরা বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ লিখে থাকেন। এরই মধ্যে ভাবনগর : ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব বেঙ্গল স্টাডিজে আমেরিকা, ফ্রান্স, চেক রিপাবলিক, পোল্যান্ড, রাশিয়া, ইতালি, জার্মান, জাপান, চীন, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের রচিত বাংলা ভাষায় রচিত বহু মৌলিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেই সূত্রে ভাবনগর : ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন ভাষিক অধ্যাপক-গবেষকদের বাংলা ভাষা চর্চার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চা ও গবেষণা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান নিয়ে গবেষণার প্রবণতা, কোনো বিশ^বিদ্যালয়ে আবার বাংলার সমকালীন ঐতিহ্যিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার চর্চাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, কোথাও আবার বাংলার ভাববাদ, সংগীত সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ভাববাদ ও সংগীত সংস্কৃতির মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অধ্যাপক-গবেষকদের প্রিয় বিষয় হলো লালন সাঁই থেকে শুরু করে ভবা পাগলা, আবদুল গফুর হালী প্রমুখ। এরই মধ্যে এদের প্রত্যেকের ওপর বিভিন্ন ভাষা প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা যেমন সম্পন্ন হয়েছে, তেমনি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যেমন : লালন সাঁইয়ের জীবন, সংগীত ও সমকালীন চর্চা-গবেষণা নিয়ে জাপানি ভাষায় গ্রন্থ এবং লালন সাঁইয়ের গানের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা ইংরেজি ভাষায় প্রণীত হয়েছে, ইতালীয় ভাষায় ভবা পাগলার ওপর গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে ও ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে, আবদুল গফুর হালীর ওপর জার্মান ভাষায় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অবাঙালি গবেষকদের অনেকে বাংলার ভাব-ভাষা-সংস্কৃতি গবেষণায় এতটাই নিবেদিত হয়েছেন যে, নিয়মানুযায়ী গুরুবাদে দীক্ষা নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। অনেকে আবার আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে এ দেশের লোকায়ত ভাবপরিমন্ডলের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশে ও অবস্থান নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য হলেন আমেরিকার গবেষক ক্যারোল সলোমন, জার্মানের অধ্যাপক হান্স হার্ডার, জাপানের অধ্যাপক মাসাহিকো তোগাওয়া, ইতালির অধ্যাপক ক্যারোলা এরিকা লোরেয়া প্রমুখ।
একটি প্রবন্ধে এদের প্রত্যেকের গবেষণাকর্ম সম্পর্কে তথ্য উপস্থাপন সম্ভব নয়। তাই এই প্রবন্ধে জাপানের প্রখ্যাত গবেষক মাসাহিকো কর্তৃক বিদেশি ভাষায় রচিত লালনবিষয়ক প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ ‘শুক্যোনি কৌসুর সেইজা : হিন্দু-কিও তো ইসলাম ওয়া মিগুরু শইউকিওউ গ্যাইনিন নো সাইকোউছিকু’ সম্পর্কে কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, অধ্যাপক মাসাহিকো তোগাওয়া এ ধরনের গবেষণা প্রণয়নের বহু বছর আগেই কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামের লালনপন্থি এক সাধকের কাছে লালনপন্থায় দীক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জনসংস্কৃতি সমীক্ষণ করেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম ভাবচর্চা, হিন্দু সংস্কৃতি এবং লালনপন্থি ভাবসাধকদের জীবন, সংগীত ও দর্শন নিয়ে একাধিক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা হলো ‘শুক্যোনি কৌসুর সেইজা : হিন্দু-কিও তো ইসলাম ওয়া মিগুরু শইউকিওউ গ্যাইনিন নো সাইকোউছিকু’ ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে জাপানের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
মাসাহিকো তোগাওয়া রচিত জাপানি ভাষায় গ্রন্থ ‘শুক্যোনি কৌসুর সেইজা : হিন্দু-কিও তো ইসলাম ওয়া মিগুরু শইউকিওউ গ্যাইনিন নো সাইকোউছিকু’-এর ভাবগত অর্থ হলো আধুনিকযুগের ধর্ম এবং একজন সাধকের দর্শন। এ ধরনের শিরোনামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একজন সাধক হলেন লালন সাঁই। এতে লালন সাঁইয়ের বিতর্কিত জীবনী থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ও লালন সাঁইয়ের দর্শন; ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশে লালন চর্চার বিবর্তনের ধারা, এমনকি ২০০০ খ্রিস্টাব্দে লালনের আখড়া রক্ষার আন্দোলনের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করা হয়েছে।
ভূমিকাসহ গ্রন্থটি ৭টি অধ্যায়ে বিভক্ত। গ্রন্থের ভূমিকায় ধর্মের ধারণা, ইসলাম ও হিন্দুধর্মের বৈশিষ্ট্য, ইসলাম ও সুফি সাধনার সম্পর্ক, হিন্দুধর্ম ও সাধুদের সম্পর্ক, বাউল কী, হিন্দুধর্ম ও ইসলামের সঙ্গে বাউলের সম্পর্ক কী, সাধক বলতে কী বোঝায় ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘লালন হিন্দু কি মুসলমান’। এই অধ্যায়ে ফকির লালন সাঁইয়ের জীবনীর প্রচলিত ধারণা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, একই সঙ্গে হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত লালনের জীবনী, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে লালন, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ ব্রিটিশ কাল পর্বে লালনের জীবনীর বিভিন্ন দিক, পাকিস্তান কাল পর্বে লালন জীবনী নিয়ে দ্বিমত শুরুর প্রসঙ্গ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে লালনের জীবনী লেখার ইতিহাস বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এই অধ্যায়ে পাকিস্তান আমলে ‘দ্বিমত শুরু’ উপ-শিরোনামে হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত লালন-জীবনীর ইঙ্গিত, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি, প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত বসন্তকুমার পালের রচনা এবং মোহাম্মদী পত্রিকায় প্রকাশিত নূর মোহাম্মদের রচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ের লালন গবেষক আবু তালিব, এস এম লুৎফর রহমান, খোন্দকার রিয়াজুল হক, আনোয়ারুল করীমের মতামত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এরপর ‘মতের বিরুদ্ধে’ উপ-শিরোনামে এ এইচ এম ইমামউদ্দিন, আবুল আহসান চৌধুরী, ম. মনিরুজ্জামান প্রমুখ গবেষকের বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম ‘লালনের ধর্মীয় দর্শন’। এই অধ্যায়ে গবেষক মাসাহিকো তোগাওয়া যথাক্রমে বাংলার বাউল ও লালন ফকির, ফোকলোর ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে কবীর থেকে বাউলদের দর্শন ও লালনের গানের বাণীর বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। একই সঙ্গে লালনের গানের সান্ধ্যভাষা বা গূঢ়তত্ত্ব এবং দেহতত্ত্বের গানের মর্মকথা ব্যাখ্যা করেছেন। তবে, তিনি এই অধ্যায়ে শেষে লালনের গানের অর্থ বোঝার জন্য একটাই সমাধান দিয়েছেন, আর তা হলো সাধনা ছাড়া লালনের গান বোঝা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তিনি হয়তো সাধুদের মতোই গুরুকে শরণ নেওয়াকেই ইঙ্গিত করেছেন।
তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম ‘সুফিবাদী ইসলাম ও লালন’। এই অধ্যায়ে ইসলাম ধর্মের শরিয়তি ধারা ও মারফতি ধারার তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে আল্লাহ এবং খাস তরিকার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। পাশাপাশি পুনর্জন্ম ভেদ প্রসঙ্গে লালনের তান্ত্রিক সাধনার কথা এবং সুফিবাদের মধ্যে তন্ত্রসাধনার প্রভাব বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এই অধ্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এখানে বাংলাদেশের ধর্মী সাধনার বিস্তার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গবেষক পর্যবেক্ষণ করেছেন, বাংলাদেশের ধর্মীয় সাধনার বিস্তারের একদিকে রয়েছে সুফি সাধনার ধারা, অন্যদিকে রয়েছে তান্ত্রিক সাধনপদ্ধতি। লালনের সাধনার ধারা এ সমাজের মধ্যে স্বতন্ত্র এবং তা পর্যবেক্ষণমূলক। এ ছাড়া, সুফিবাদ ও বাউলতত্ত্বের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত তিনটি হরফ আলিফ, লাম ও মিমের ব্যাখ্যা হাজির করেছেন এই গ্রন্থে।
চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বাউল সাধকদের রক্ষার আন্দোলন’। এই অধ্যায়ে গবেষক মাসাহিকো তোগাওয়া ইতিহাসের আলোকে বাউল সাধক শিরোমণি লালন সাঁইজির মতো, দর্শন, জীবন-সাধনা এবং বাউল-সাধকদের আশ্রম বা আখড়া বাড়ি রক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ের আন্দোলন বিশ্লেষণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ করে ব্রিটিশ উপনিবেশকালে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে শরিয়তপন্থিদের প্রবর্তিত বাউল ধ্বংস ফতোয়া থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারিভাবে লালন সাঁইজির মাজার দখলের ঘটনা বিশ্লেষণ করেছেন। এই অধ্যায়ের আলোচনায় তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে সরকারিভাবে লালন সাঁইজির মাজার দখলের সময় পুলিশের লাঠির আঘাতে লালনপন্থি সাধক বিল্লাল শাহ মারাত্মকভাবে আহত হন এবং পরে মরা যান। এই অধ্যায়ের আলোচনায় ২০০০ খ্রিস্টাব্দে ‘লালন আখড়া রক্ষা কমিটি’ গঠন-সংক্রান্ত বিশ্লেষণে মাসাহিকো তোগাওয়া তথ্য দিয়েছেন যে, ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে শেখ হাসিনা লালনের আখড়া বাড়িতে অডিটোরিয়াম ও রেস্টহাউজ নির্মাণের ঘোষণা দেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কবি, লেখক ও সুধীসমাজের তৎপরতায় লালন আখড়া রক্ষা কমিটি গঠিত হয়। এই রক্ষা কমিটির আন্দোলনের মুখে হাইকোর্ট লালনের আখড়ার মধ্যে সব ধরনের ভবন নির্মাণের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরই মধ্যে লালনপন্থি ফকিরদের সমন্বয়ে আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহের নেতৃত্বে লালন মাজার শরিফ ও সেবা-সদন কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু গবেষক এই অধ্যায়ের বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন, ঢাকার সুধীসমাজ কর্তৃক গঠিত লালন সাঁইজির আখড়া রক্ষার কমিটি ও লালনপন্থি সাধকদের সেবা-সদন কমিটির মধ্যে সেই আন্দোলনে কোনো সমন্বয় ছিল না।
পঞ্চম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বাউলের সংগ্রাম’। এই অধ্যায়ে লালনপন্থি সাধক হিসেবে গবেষক মাসাহিকো তোগাওয়া তার নিজের কথা জানান দিয়েছেন। কেননা, তিনি কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামের লালনপন্থি সাধক আলাউদ্দিন শাহের কাছে লালনমতে দীক্ষা নিয়েছেন। লালন আখড়া রক্ষার আন্দোলনের জন্য তিনি জাপান থেকে বাংলাদেশে আসেন এবং বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্র প্রথম আলো-তে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এই অধ্যায় থেকে জানা যায়, তার সেই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সাময়িকভাবে লালন আখড়া প্রাঙ্গণে নির্মাণকাজ থেমে যায়। কিন্তু ২০০১ খ্রিস্টাব্দে আবার কোনো এক রহস্যময় কারণে নির্মাণকাজ শুরু হয়। গবেষক এই অধ্যায়ে লালন আখড়া রক্ষার সেই ব্যর্থ সংগ্রামের রহস্য ব্যাখ্যা করেছেন।
ষষ্ঠ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে বাউল গান’। এই অধ্যায়ে ইউনেসকো কর্তৃক ইন্ট্যানজিবল হেরিটেজ হিসেবে বাউল গানের স্বীকৃতি দানের প্রসঙ্গ এবং বাংলাদেশের নগরকেন্দ্রিক শিল্পীদের মধ্যে বাউল গানের চর্চা নিয়ে আলোচনা স্থান পেয়েছে। এই আলোচনায় গবেষক মাসাহিকো তোগাওয়া লালনসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী ফরিদা পরভীন থেকে শুরু করে একেবারে সাম্প্রতিক তরুণ শিল্পী আনুশেহ আনাদিলের গায়কি নিয়ে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। একই সঙ্গে মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাউল গান চর্চার সাম্প্রতিক ধারা বিশ্লেষণ করেছেন।
সপ্তম অধ্যায়টি হলো এই গ্রন্থের উপসংহার, যার শিরোনাম হচ্ছে ‘ধর্মীয় দর্শন ও লালন’। এই অধ্যায়ে গবেষক মূলত আধুনিকযুগে লালন সাঁইজির দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করেছেন। গবেষণাগ্রন্থের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এই গ্রন্থে প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র, শব্দের ব্যাখ্যা, নির্ঘণ্ট এবং মানচিত্র, আলোকচিত্র, হস্তলিপি ইত্যাদি মুদ্রিত হয়েছে।
জাপানের সুধীসমাজে বাংলাদেশের ভাবসাধক শিরোমণি লালন সাঁইয়ের জীবন-দর্শন ও সংগীতকে গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে গ্রন্থটি বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছে। একই সঙ্গে লালন সাঁইয়ের দর্শনের বীজ একজন ভিন্নভাষী গবেষকের দৃষ্টিতে কীভাবে ব্যাখ্যাত এবং বিশ্লেষিত তা জানার জন্য গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশের উদ্যোগ নিলে ভালো হতো।
উল্লেখ্য, মাসাহিকো তোগাওয়ার এই গ্রন্থ প্রকাশের প্রায় আট বছর পর ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ওয়াশিংটন বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রয়াত শিক্ষক-গবেষক-অনুবাদ ডক্টর ক্যারোল সলোমনের দীর্ঘদিনের লালন-গবেষণার ফসল ‘সিটি অব মিরোরস : সংস অব লালন সাঁই’ তথা ‘আরশিনগর : লালন সাঁইয়ের গান’ প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থে লালন সাঁইয়ের ১৩৭টি গানের মূল বাংলা পাঠ, ট্রান্সলিটারেশন, ইংরেজি অনুবাদ, ইংরেজি ব্যাখ্যা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া, গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন ইউরোপের বিখ্যাত বাউল গবেষক জিয়ান ওপেনশ এবং প্রসঙ্গ-কথা লিখেছেন ওয়াশিংটন বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিচার্ড সলোমন। আমাদের সৌভাগ্য যে, ক্যারোল সলোমনকৃত গ্রন্থটি সম্পাদনাকর্মে আমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন আমেরিকার আরেক বিখ্যাত গবেষক কিথ ই. কান্তু। উল্লেখ্য, ক্যারোল সলোমন তার এই গ্রন্থের জন্য লালন সাঁইয়ের প্রতিটি গানের প্রামাণ্য বাংলা পাঠ নির্ধারণে লালন সাঁইয়ের প্রত্যক্ষ শিষ্যদের হস্তলিখিত পা-ুলিপি, রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি দীর্ঘদিন ধরে লালন সাঁইয়ের গানের প্রামাণ্য পাঠ নির্ধারণে পা-ুলিপির পাশাপাশি লালনপন্থি শ্রেষ্ঠ সাধকশিল্পী ও সংগীতগুরু খোদাবক্স সাঁইয়ের সঙ্গ লাভ করেন এবং সেই সঙ্গের ভিত্তিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন খোদাবক্স সাঁইয়ের ভাব-কন্যা। খোদাবক্স সাঁইয়ের তিরোধানের পর তিনি সাধকশিল্পী আবদুল করিম শাহের সহায়তা গ্রহণ করেন।
ক্যারোল সলোমনের ‘সিটি অব মিরোরস : সংস অব লালন সাঁই’ (আরশিনগর : লালন সাঁইয়ের গান) এখন পর্যন্ত লালন সাঁইয়ের সংগীত নিয়ে সর্ববৃহৎ অ্যাকাডেমিক প্রকাশনা এবং একমাত্র আন্তর্জাতিক অ্যাকাডেমিক প্রকাশনা যেখানে লালন সাঁইয়ের রচিত প্রতিটি গানের নির্ভরযোগ্য বাংলা প্রামাণ্য পাঠ করার আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষ করা যায়। একই সঙ্গে গ্রন্থটি বাংলা ও ইংরেজি দ্বিভাষিক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা হিসেবে স্বীকৃত। এই গ্রন্থটির ভেতর দিয়ে লালন সাঁইয়ের সংগীত গবেষণার আন্তর্জাতিক দিগন্ত নতুনভাবে উন্মোচিত হয়েছে।
লেখক : নাট্যকার ও গবেষক