বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা শেখা
শর্মি বড়ুয়া | ৬ মার্চ, ২০২২ ০০:০০
কোনো ভাষা বৈশ্বিকভাবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তা বুঝবার একটি মাপকাঠি হলো সে ভাষা শেখার প্রবণতা। প্রশ্ন হলো কোনো ভাষা কেনই-বা কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষ গুরুত্ব পায় আর কেনই-বা মানুষ নতুন কোনো ভাষা শেখে? একটি রাষ্ট্র যখন অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক কারণে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ সঞ্চার করে তখন সেই দেশের অধিকাংশ মানুষের মুখের ভাষাটিও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেই দেশে নতুন বিনিয়োগের জন্য, কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতির জন্য সংশ্লিষ্ট ভাষায় যোগাযোগ জরুরি হয়ে ওঠে। এছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বা কেবল ভাষাপ্রেমের কারণেও কেউ কেউ কোনো বিদেশি ভাষা শিখতে পারেন।
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বর্তমানে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি অর্থনৈতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে, কূটনৈতিকভাবে বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এমনকি সিয়েরা লিওনে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা মিশনের অবদানের কারণে বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদাও দেওয়া হয়েছে। দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রকল্পে বিদেশি এনজিও কাজ করছে, নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়াও অনেকে বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করছেন। এসব কারণেই বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার লোক বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তাদের সবারই এদেশের মানুষের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বাংলা ভাষার কিছুটা জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। কারও হয়তো শুধু কুশল বিনিময় করার, বাজার করার, কোনো যানবাহন ভাড়া করার জন্য ন্যূনতম কথাবার্তা জানলেই চলে। আবার অনেক কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল ব্যক্তিদের সঙ্গে দোভাষী থাকায় তাদের বাংলা ভাষা শেখার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কিছু ব্যক্তি আছেন যাদের কর্মসূত্রে মোটামুটি দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে অবস্থান করতে হয়; তাদের ভাষাজ্ঞানের সীমাও তাই বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। এখানে উল্লিখিত প্রথম ও তৃতীয় দলের লোকই বাংলা ভাষা শেখায় আগ্রহ দেখান।
এছাড়াও আরেক দল লোক আছেন যারা জন্মসূত্রে বিদেশি নাগরিক হলেও পূর্বপুরুষের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হন। এই ব্যক্তিদের বিশ্বব্যাপী ‘হেরিটেজ ল্যাঙ্গুয়েজ লার্নার’ নামে ডাকা হয়। যে কারণেই ভাষা শেখা প্রয়োজনীয় হোক না কেন, অনেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বন্ধু, সহকর্মীদের কাছ থেকে কাজ চালানোর মতো বাংলা শিখে নেন। আর কেউ কেউ আছেন যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, কাঠামোবদ্ধ উপায়ে ভাষা শেখায় আগ্রহী হন। অনেকে তাদের নিজেদের দেশ থেকে বাংলা শিখে আসেন; আবার অনেকে বাংলাদেশে অবস্থান করে ভাষাটি শেখেন।
বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, রাশিয়াসহ প্রায় ১০টি দেশে (সংখ্যাটি এর চেয়ে বেশিও হতে পারে) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নন-ডিগ্রি প্রোগ্রাম হিসেবে বাংলা ভাষা শেখানো হয়। এর মধ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়েও বাংলা ভাষা পড়ানো হয়।
যেহেতু বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা তাই বাংলা শিখতে ইচ্ছুক বিদেশি শিক্ষার্থীরা এ দুটি দেশেই আসেন। দুই দেশেই বেসরকারি পর্যায়ে অনেক বাংলা ভাষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটগুলোতেই ভাষা শিখতে আগ্রহী হন। বাংলা ভাষা শেখার জন্য অন্য ভাষাভাষী শিক্ষার্থীরা ভারতে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারকেই সাধারণত বেছে নেন। আর বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট এবং ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউট (বিএলআই) এসব প্রতিষ্ঠানে বিদেশিরা বাংলা শিখতে আসেন। বিএলআই-তে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারি শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে আসা শিক্ষার্থীদের ভাষা শিক্ষাদান করা হয়। এছাড়াও বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখানোর জন্য ঢাকায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে স্থাপিত হয়েছে বাংলা ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
বাংলাদেশে বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখানোর সবচেয়ে পুরনো প্রতিষ্ঠান হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিদেশি ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ সংবিধি অনুসারে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ সালে এখানে বাংলা ভাষা কোর্স চালু হয়। তার আগে ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষা কোর্স চালু করে। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলসহ অন্যান্য দেশের অনেকে বাংলা একাডেমিতে বাংলা শিখতে আসতেন।
আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বাংলা ভাষার চারটি দীর্ঘমেয়াদি (১৮০ ঘণ্টা) কোর্স চালু আছে জুনিয়র, সিনিয়র, ডিপ্লোমা, উচ্চতর ডিপ্লোমা। এছাড়া স্বল্পমেয়াদি কোর্সও (ন্যূনতম ৬০ ঘণ্টা) চালু আছে। এসব কোর্সে এখন পর্যন্ত ২৫টি দেশের প্রায় ৪০০ নাগরিক বাংলা ভাষা শিখেছেন। এছাড়াও চীনের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করছেন এরকম দুটি দলও তিন মাসের বিশেষ ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমে এই ইনস্টিটিউটে এসেছিলেন।
আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বাংলা ভাষা শিক্ষা কেবল শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকে না। শিক্ষার্থীরা যাতে শ্রেণিকক্ষে অর্জিত জ্ঞান বাস্তবে ব্যবহার করতে পারেন তাই তাদের মাঠপর্যায়ে ব্যবহারিক কার্যক্রমেরও ব্যবস্থা থাকে। তাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সাহিত্য, সিনেমা, সংগীত, নাটক, খাবার সম্পর্কেও পাঠদান করা হয় এবং জাদুঘর ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পরিদর্শনেরও ব্যবস্থা করা হয়।
বাংলাদেশে বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করেন এখানকার সাধারণ মানুষ। বিদেশি নাগরিকরা এখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের মতোই স্বাভাবিকভাবে বাংলা বলতে প্রেরণা পান। কারণ, ভাষা শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমমাত্র। শ্রেণিকক্ষে যতই শেখা হোক, তা যদি বাস্তব ব্যবহারের সুযোগ না থাকে তাহলে সে ভাষাশিক্ষা পূর্ণতা পায় না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে বাংলা শেখার এই সুযোগ বিদেশিরা তাদের নিজ দেশে পান না। তাই তারা এর সদ্ব্যবহারও করেন। এর ফলে আরেকটি ঘটনাও ঘটে– তাদের মনে বাংলাদেশ ও এদেশের মানুষ সম্পর্কে ভালোবাসা জন্মে। তারা এই দেশের মানুষের আতিথেয়তায়, সরলতায়, পারিবারিক সম্পর্কের গভীরতায়, বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবে আকৃষ্ট হন। অনেকে তাদের নিজ দেশে ফিরে গিয়েও এখানকার খাবারের, পোশাকের মায়া কাটাতে পারেন না।
বাংলাদেশে বিদেশিদের বাংলা ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমের ৪৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়ে অনেক শিক্ষার্থী বাংলা ভাষা শিখে বাংলা ভাষায় লেখা বই নিজ ভাষায় অনুবাদ করেছেন। অনেকে আবার নিজ ভাষায় লেখা বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন। অনেকে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে, অর্থনৈতিক প্রকল্পে, গণমাধ্যমে কাজ করছেন। অনেকে নিজ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বাংলাদেশে এবং অন্যান্য দেশে বিদেশি নাগরিকরা বাংলা ভাষা শিখলেও এর সংখ্যা এখনো অনেক কম। এই লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে বাংলা ভাষা বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সে তুলনায় বাংলাকে বিদেশি ভাষা হিসেবে শেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রতাপশালী ভাষা ইংরেজি। এর বিস্তারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্রিটিশ কাউন্সিল যা বিশ্বের অনেক দেশে তার কার্যক্রম চালাচ্ছে। শুধু ইংরেজি নয়, ফরাসি, জার্মান, চীনাসহ অনেক ভাষার বিস্তারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এসব ভাষার প্রত্যেকটিরই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র আছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষা বা অন্য যে কোনো কারণে যেতে হলে নির্দিষ্ট ভাষা মূল্যায়ন পরীক্ষায় (যেমন, আইইএলটিএস) অংশগ্রহণ করতে হয়। প্রতি বছর এসব ভাষার প্রচুর শিক্ষা উপকরণ (যেমন, বই) বাজারে আসে এবং এসব উপকরণ তৈরির জন্য গবেষণা খাতে প্রচুর অর্থ বরাদ্দও থাকে। কিন্তু, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এসবের একটি ঘটনাও এখনো পর্যন্ত ঘটেনি।
বাংলাদেশে আসতে হলে বাংলা ভাষার ন্যূনতম কোনো জ্ঞানের প্রয়োজন নেই, তাই কোনো মূল্যায়ন পরীক্ষাও নেই। ভাষা শেখার উপকরণ এখানে তৈরি হয় ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক অর্থবরাদ্দও সীমিত। আর সর্বোপরি এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যেটি সারা বিশ্বে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, বাংলাদেশের ইতিহাসকে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে। এছাড়াও, বাংলাদেশে বাংলা শিখতে আসা বিদেশি নাগরিকদের অনেক ক্ষেত্রে ভর্তি সংক্রান্ত নানা জটিলতারও সম্মুখীন হতে হয়।
তাই সত্যিকার অর্থেই যদি আমরা বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চাই তাহলে তার অনুকূল পরিস্থিতি অবশ্যই তৈরি করতে হবে। এর জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ খুবই প্রয়োজন। এখানে সম্ভাব্য কয়েকটি উদ্যোগের কথা তুলে ধরা হলো:
১. একটি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিভিন্ন দেশে যার কার্যক্রম থাকবে এবং এটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই হওয়া প্রয়োজন।
২. বাংলা ভাষার জন্য একটি মূল্যায়ন পরীক্ষার কাঠামো তৈরি করতে হবে এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে আসতে আগ্রহী ব্যাক্তিদের এই পরীক্ষার নির্দিষ্ট স্তর অতিক্রম করে আসার নিয়ম করা যেতে পারে।
৩. বাংলা ভাষা শেখার শিক্ষা উপকরণ তৈরির এবং গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
৪. বিদেশিদের মধ্যে বাংলা ভাষা বিস্তারের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ তৈরি করতে হবে।
৫. বিভিন্ন দেশে গিয়ে বাংলা ভাষা শেখাতে পারবে এরকম বাংলাদেশি শিক্ষক তৈরি করতে হবে। তার জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স বা বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখানোর বিষয়ে ডিগ্রি প্রোগ্রাম চালু করতে হবে।
৬. বাংলাদেশে বাংলা ভাষা শিখতে আসা বিদেশিদের ভর্তি কার্যক্রম সহজতর করতে হবে।
৭. বাংলাদেশে বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখাকে উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
লেখক : প্রভাষক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন
শর্মি বড়ুয়া | ৬ মার্চ, ২০২২ ০০:০০

কোনো ভাষা বৈশ্বিকভাবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তা বুঝবার একটি মাপকাঠি হলো সে ভাষা শেখার প্রবণতা। প্রশ্ন হলো কোনো ভাষা কেনই-বা কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষ গুরুত্ব পায় আর কেনই-বা মানুষ নতুন কোনো ভাষা শেখে? একটি রাষ্ট্র যখন অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক কারণে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ সঞ্চার করে তখন সেই দেশের অধিকাংশ মানুষের মুখের ভাষাটিও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেই দেশে নতুন বিনিয়োগের জন্য, কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতির জন্য সংশ্লিষ্ট ভাষায় যোগাযোগ জরুরি হয়ে ওঠে। এছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বা কেবল ভাষাপ্রেমের কারণেও কেউ কেউ কোনো বিদেশি ভাষা শিখতে পারেন।
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বর্তমানে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি অর্থনৈতিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে, কূটনৈতিকভাবে বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এমনকি সিয়েরা লিওনে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা মিশনের অবদানের কারণে বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদাও দেওয়া হয়েছে। দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রকল্পে বিদেশি এনজিও কাজ করছে, নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়াও অনেকে বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করছেন। এসব কারণেই বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার লোক বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তাদের সবারই এদেশের মানুষের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বাংলা ভাষার কিছুটা জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। কারও হয়তো শুধু কুশল বিনিময় করার, বাজার করার, কোনো যানবাহন ভাড়া করার জন্য ন্যূনতম কথাবার্তা জানলেই চলে। আবার অনেক কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল ব্যক্তিদের সঙ্গে দোভাষী থাকায় তাদের বাংলা ভাষা শেখার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কিছু ব্যক্তি আছেন যাদের কর্মসূত্রে মোটামুটি দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে অবস্থান করতে হয়; তাদের ভাষাজ্ঞানের সীমাও তাই বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন। এখানে উল্লিখিত প্রথম ও তৃতীয় দলের লোকই বাংলা ভাষা শেখায় আগ্রহ দেখান।
এছাড়াও আরেক দল লোক আছেন যারা জন্মসূত্রে বিদেশি নাগরিক হলেও পূর্বপুরুষের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হন। এই ব্যক্তিদের বিশ্বব্যাপী ‘হেরিটেজ ল্যাঙ্গুয়েজ লার্নার’ নামে ডাকা হয়। যে কারণেই ভাষা শেখা প্রয়োজনীয় হোক না কেন, অনেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বন্ধু, সহকর্মীদের কাছ থেকে কাজ চালানোর মতো বাংলা শিখে নেন। আর কেউ কেউ আছেন যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, কাঠামোবদ্ধ উপায়ে ভাষা শেখায় আগ্রহী হন। অনেকে তাদের নিজেদের দেশ থেকে বাংলা শিখে আসেন; আবার অনেকে বাংলাদেশে অবস্থান করে ভাষাটি শেখেন।
বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, রাশিয়াসহ প্রায় ১০টি দেশে (সংখ্যাটি এর চেয়ে বেশিও হতে পারে) বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নন-ডিগ্রি প্রোগ্রাম হিসেবে বাংলা ভাষা শেখানো হয়। এর মধ্যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়েও বাংলা ভাষা পড়ানো হয়।
যেহেতু বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা তাই বাংলা শিখতে ইচ্ছুক বিদেশি শিক্ষার্থীরা এ দুটি দেশেই আসেন। দুই দেশেই বেসরকারি পর্যায়ে অনেক বাংলা ভাষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটগুলোতেই ভাষা শিখতে আগ্রহী হন। বাংলা ভাষা শেখার জন্য অন্য ভাষাভাষী শিক্ষার্থীরা ভারতে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারকেই সাধারণত বেছে নেন। আর বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট এবং ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউট (বিএলআই) এসব প্রতিষ্ঠানে বিদেশিরা বাংলা শিখতে আসেন। বিএলআই-তে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারি শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে আসা শিক্ষার্থীদের ভাষা শিক্ষাদান করা হয়। এছাড়াও বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখানোর জন্য ঢাকায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে স্থাপিত হয়েছে বাংলা ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
বাংলাদেশে বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখানোর সবচেয়ে পুরনো প্রতিষ্ঠান হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিদেশি ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ সংবিধি অনুসারে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৬ সালে এখানে বাংলা ভাষা কোর্স চালু হয়। তার আগে ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষা কোর্স চালু করে। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলসহ অন্যান্য দেশের অনেকে বাংলা একাডেমিতে বাংলা শিখতে আসতেন।
আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বাংলা ভাষার চারটি দীর্ঘমেয়াদি (১৮০ ঘণ্টা) কোর্স চালু আছে জুনিয়র, সিনিয়র, ডিপ্লোমা, উচ্চতর ডিপ্লোমা। এছাড়া স্বল্পমেয়াদি কোর্সও (ন্যূনতম ৬০ ঘণ্টা) চালু আছে। এসব কোর্সে এখন পর্যন্ত ২৫টি দেশের প্রায় ৪০০ নাগরিক বাংলা ভাষা শিখেছেন। এছাড়াও চীনের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করছেন এরকম দুটি দলও তিন মাসের বিশেষ ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমে এই ইনস্টিটিউটে এসেছিলেন।
আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বাংলা ভাষা শিক্ষা কেবল শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ থাকে না। শিক্ষার্থীরা যাতে শ্রেণিকক্ষে অর্জিত জ্ঞান বাস্তবে ব্যবহার করতে পারেন তাই তাদের মাঠপর্যায়ে ব্যবহারিক কার্যক্রমেরও ব্যবস্থা থাকে। তাদের বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সাহিত্য, সিনেমা, সংগীত, নাটক, খাবার সম্পর্কেও পাঠদান করা হয় এবং জাদুঘর ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পরিদর্শনেরও ব্যবস্থা করা হয়।
বাংলাদেশে বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করেন এখানকার সাধারণ মানুষ। বিদেশি নাগরিকরা এখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের মতোই স্বাভাবিকভাবে বাংলা বলতে প্রেরণা পান। কারণ, ভাষা শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমমাত্র। শ্রেণিকক্ষে যতই শেখা হোক, তা যদি বাস্তব ব্যবহারের সুযোগ না থাকে তাহলে সে ভাষাশিক্ষা পূর্ণতা পায় না। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে বাংলা শেখার এই সুযোগ বিদেশিরা তাদের নিজ দেশে পান না। তাই তারা এর সদ্ব্যবহারও করেন। এর ফলে আরেকটি ঘটনাও ঘটে– তাদের মনে বাংলাদেশ ও এদেশের মানুষ সম্পর্কে ভালোবাসা জন্মে। তারা এই দেশের মানুষের আতিথেয়তায়, সরলতায়, পারিবারিক সম্পর্কের গভীরতায়, বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবে আকৃষ্ট হন। অনেকে তাদের নিজ দেশে ফিরে গিয়েও এখানকার খাবারের, পোশাকের মায়া কাটাতে পারেন না।
বাংলাদেশে বিদেশিদের বাংলা ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমের ৪৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সময়ে অনেক শিক্ষার্থী বাংলা ভাষা শিখে বাংলা ভাষায় লেখা বই নিজ ভাষায় অনুবাদ করেছেন। অনেকে আবার নিজ ভাষায় লেখা বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন। অনেকে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে, অর্থনৈতিক প্রকল্পে, গণমাধ্যমে কাজ করছেন। অনেকে নিজ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বাংলাদেশে এবং অন্যান্য দেশে বিদেশি নাগরিকরা বাংলা ভাষা শিখলেও এর সংখ্যা এখনো অনেক কম। এই লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে বাংলা ভাষা বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সে তুলনায় বাংলাকে বিদেশি ভাষা হিসেবে শেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রতাপশালী ভাষা ইংরেজি। এর বিস্তারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্রিটিশ কাউন্সিল যা বিশ্বের অনেক দেশে তার কার্যক্রম চালাচ্ছে। শুধু ইংরেজি নয়, ফরাসি, জার্মান, চীনাসহ অনেক ভাষার বিস্তারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এসব ভাষার প্রত্যেকটিরই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র আছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষা বা অন্য যে কোনো কারণে যেতে হলে নির্দিষ্ট ভাষা মূল্যায়ন পরীক্ষায় (যেমন, আইইএলটিএস) অংশগ্রহণ করতে হয়। প্রতি বছর এসব ভাষার প্রচুর শিক্ষা উপকরণ (যেমন, বই) বাজারে আসে এবং এসব উপকরণ তৈরির জন্য গবেষণা খাতে প্রচুর অর্থ বরাদ্দও থাকে। কিন্তু, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এসবের একটি ঘটনাও এখনো পর্যন্ত ঘটেনি।
বাংলাদেশে আসতে হলে বাংলা ভাষার ন্যূনতম কোনো জ্ঞানের প্রয়োজন নেই, তাই কোনো মূল্যায়ন পরীক্ষাও নেই। ভাষা শেখার উপকরণ এখানে তৈরি হয় ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক অর্থবরাদ্দও সীমিত। আর সর্বোপরি এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যেটি সারা বিশ্বে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, বাংলাদেশের ইতিহাসকে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে। এছাড়াও, বাংলাদেশে বাংলা শিখতে আসা বিদেশি নাগরিকদের অনেক ক্ষেত্রে ভর্তি সংক্রান্ত নানা জটিলতারও সম্মুখীন হতে হয়।
তাই সত্যিকার অর্থেই যদি আমরা বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চাই তাহলে তার অনুকূল পরিস্থিতি অবশ্যই তৈরি করতে হবে। এর জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ খুবই প্রয়োজন। এখানে সম্ভাব্য কয়েকটি উদ্যোগের কথা তুলে ধরা হলো:
১. একটি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিভিন্ন দেশে যার কার্যক্রম থাকবে এবং এটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই হওয়া প্রয়োজন।
২. বাংলা ভাষার জন্য একটি মূল্যায়ন পরীক্ষার কাঠামো তৈরি করতে হবে এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে আসতে আগ্রহী ব্যাক্তিদের এই পরীক্ষার নির্দিষ্ট স্তর অতিক্রম করে আসার নিয়ম করা যেতে পারে।
৩. বাংলা ভাষা শেখার শিক্ষা উপকরণ তৈরির এবং গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
৪. বিদেশিদের মধ্যে বাংলা ভাষা বিস্তারের বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ তৈরি করতে হবে।
৫. বিভিন্ন দেশে গিয়ে বাংলা ভাষা শেখাতে পারবে এরকম বাংলাদেশি শিক্ষক তৈরি করতে হবে। তার জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স বা বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখানোর বিষয়ে ডিগ্রি প্রোগ্রাম চালু করতে হবে।
৬. বাংলাদেশে বাংলা ভাষা শিখতে আসা বিদেশিদের ভর্তি কার্যক্রম সহজতর করতে হবে।
৭. বাংলাদেশে বিদেশিদের বাংলা ভাষা শেখাকে উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
লেখক : প্রভাষক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়