প্রথম বাংলা অভিধান রচয়িতা ম্যানুয়েল-দা-আস্সুম্পসাউ
| ৬ মার্চ, ২০২২ ০০:০০
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শনসমূহের বয়স হাজার বছরের বেশি। তবে বাংলা ভাষাচর্চার সংগঠিত রূপের ততটা প্রাচীন নিদর্শন ও দালিলিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন যে, পাল আমলেও বাংলা ভাষা যেমন রাজ আনুকূল্য পায়নি তেমনি সেই কালে বাংলা ভাষা বিকাশমান পর্যায়েই রয়ে গিয়েছিল। বাংলা অঞ্চলে মুসলিম শাসনের সূচনার পর বাংলার সুলতানরা ধীরে ধীরে বাংলা ভাষাকে রাজ আনুকূল্য দেন এবং স্থানীয় ভাষায় সাহিত্যচর্চার সহায়ক হিসেবে কাজ করেন। মুসলিম সুলতানি আমলেই বাংলা ভাষায় প্রথম রামায়ণ ও মহাভারত অনুবাদ হয়। এক্ষেত্রে সুলতানি আমলে রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতার কথাও সুবিদিত। কিন্তু এটাও স্পষ্ট যে, সাহিত্যচর্চায় রাজ আনুকূল্য থাকলেও সেসময় বাংলা ভাষার বিকাশে ব্যক্তি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সুসংগঠিত কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায় না। দেখা যাচ্ছে বাংলায় ইউরোপীয় জাতিসমূহের আগমনের পর বাংলা ভাষার চর্চা ও বিকাশে একটা নতুন জোয়ার আসে। খ্রিষ্টধর্ম প্রচার এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও শাসনকাজের সুবিধার্থে ইউরোপীয় জাতিগুলো এই কাজে মনোনিবেশ করে। এই যুগেই আমরা বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও বাংলা ভাষার অভিধান রচনার নানা সংগঠিত প্রয়াস দেখতে পাই। এক্ষেত্রে পর্তুগিজ ও ইংরেজ জাতি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে।
বাংলায় পর্তুগিজ জাতির আগমন ঘটে ইংরেজদের বেশ আগেই। ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই পর্তুগিজরা ব্যবসা-বাণিজ্য, ধর্মপ্রচারসহ লুটতরাজের মতো বিচিত্র উদ্দেশ্যে হুগলি ও ব্যান্ডেল থেকে শুরু করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সপ্তদশ শতকেই পর্তুগিজ ভাষা বাংলায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং সে সময় থেকেই অগুনতি পর্তুগিজ শব্দ বাংলা ভাষায় মিশে গিয়েছিল। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে পর্তুগিজরা বাংলার কৃষি ও ভাষা-সংস্কৃতিতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। পর্তুগিজ মিশনারিরা খ্রিষ্টের সুসমাচার প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষা শিখে এদেশীয় মানুষদের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের কেউ কেউ বাংলা ভাষায় বই লেখারও চেষ্টা করেছেন। আর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, পর্তুগিজ পাদ্রি ম্যানুয়েল-দা-আস্সুম্পসাউ (Manoel da Assumpcao) বাংলা ভাষায় অভিধান রচনার প্রথম প্রয়াসের সফল রচয়িতা। পর্তুগিজ পাদ্রি ম্যানুয়েল-দা-আস্সুম্পসাউ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে একাধিক কারণে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আস্সুম্পসাউ ঢাকার উত্তর দিকে একটি পর্তুগিজ মিশনের প্রধান ছিলেন। ভাওয়াল গড়ের প্রান্তে অবস্থিত এই ক্যাথলিক মিশন বর্তমানে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জের নাগরীতে ‘সাধু নিকোলাস তোলেন্তিনো গির্জা’ (Missio de S. Nicola Tolentino) নামে পরিচিত। এ সময় ম্যানুয়েল-দ্য-আস্সুম্পসাউ বাংলা ভাষার প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’ রচনা করেন। একই সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ ও শব্দকোষ বা অভিধান রচনার কৃতিত্বও তারই। ম্যানুয়েল-দা-আস্সুম্পসাউ-এর ব্যাকরণ ও শব্দকোষ সম্পর্কে লেখক-গবেষক হাবীবুর রশীদ ‘বাংলা অভিধানের কথা’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বাংলা-পর্তুগিজ ও পর্তুগিজ বাংলা শব্দকোষটি (Vocabulario em Idioma Bengalla e Portuguez, dividedo im duas partes) ব্যাকরণের পরিশিষ্ট রূপে মুদ্রিত হয়েছিল। ব্যাকরণ অংশের পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল মোট ৫২৯। বইটি পর্তুগিজ রীতি অনুযায়ী রোমান অক্ষরে (বাংলায় মুদ্রণযন্ত্র তখনও অনাবিষ্কৃত) লিসবন শহর থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে।’
বাংলা ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব ঘটে অভিধান সংকলনের মধ্য দিয়ে। আঠারো শতকের শেষভাগে এবং উনিশ শতকের বিভিন্ন দশকে কাছাকাছি সময়ে অনেকগুলো বাংলা অভিধান রচনার প্রয়াস দেখা যায়। প্রথম দিককার বাংলা অভিধানগুলোর বেশিরভাগ ছিল দ্বিভাষিক। অনেকগুলো একভাষিক ও কয়েকটি বহুভাষিক অভিধান রচিত হয়। বাংলা ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব ঘটে এসব অভিধান সংকলনের মধ্য দিয়ে। ভাষাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এই সময়ের বহুভাষিক অভিধানগুলোর যে তালিকা দিয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে: আস্সুম্পসাউ (১৭৪৩), ফরস্টার (১৭৯৯, ১৮০২), মোহনপ্রসাদ (১৮১০), কেরি (১৮১৫-১৮২৫), রামকৃষ্ণ (১৮২১), জগন্নাথপ্রসাদ (১৮৩১), হটন (১৮৩৩), রামকমল (১৮৩৪), ডি’রোজারিও (১৮৩৭), দেবীপ্রসাদ (১৮৪১)। প্রথম দিককার বাংলা অভিধান সম্পর্কে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের নিচের বক্তব্য এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন, ‘এসব অভিধান সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে বাঙলা ভাষাকে: স্থির করে বাঙলা শব্দসম্ভার, সুস্থিত করে শব্দের বানান, নির্দিষ্ট করে শব্দের অর্থ, এবং সাহায্য করে বাঙলা ভাষার মানরূপ অর্জন ও সুস্থিতিতে। এসব অভিধান আনুশাসনিক, যাদের লক্ষ্য বাঙলা ভাষার শুদ্ধ শব্দ নির্দেশ করা। তবে, বাংলা ভাষার প্রথম অভিধানটি, আস্সুম্পসাউ’র ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগাল্লা ই পোর্তুগীজ, আনুশাসনিক ছিলো না। এটা অনেকটা বর্ণনামূলক। আস্সুম্পসাউ’র অভিধানে সংগৃহীত হয়েছিলো প্রধানত ভাওয়াল অঞ্চলের আঞ্চলিক শব্দ। কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারীরা ক্রমশ আঞ্চলিক ও প্রাত্যহিক শব্দ পরিহার ক’রে সংস্কৃত থেকে ঋণ করতে থাকেন বিপুল থেকে বিপুলতর শব্দ, যার একটি বড় অংশ হয়তো কখনো কেউ ব্যবহার করেনি। আনুশাসনিক অভিধান প্রণেতারা পালন করেন বাঙলা ভাষা-পরিকল্পনাকারীর দায়িত্ব; তাঁরা বাঙলা শব্দসম্ভার যেমন বাড়িয়ে দেন তেমনি বাঙলা ভাষার বিশুদ্ধ রূপ সম্পর্কে সৃষ্টি করেন একটি সুস্পষ্ট ধারণা। তাঁদের সংকলিত শব্দরাশির একটা বড়ো অংশ গৃহীত হ’য়ে যায় বাঙলা ভাষায়; এবং বাঙলা ভাষা একটি আঞ্চলিক বা বহু-আঞ্চলিক ভাষা থেকে মানভাষায় পরিণত হয়। শুধু আঞ্চলিক ও প্রাত্যহিক শব্দে বাঙলা ভাষার পক্ষে বর্তমান রূপ অর্জন করা সম্ভব ছিলো না।’ (হুমায়ুন আজাদ, বাংলা ভাষা, ২য় খন্ড)
সুপ্রাচীনকাল থেকে বাংলায় যে বহু ধর্ম-বর্ণ-ভাষার নানা জাতি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে তাদের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্কও বহুমাত্রিক। একদিকে যেমন বাংলা অঞ্চল ও বাঙালি জাতি বিদেশিদের দ্বারা শাসিত ও শোষিত হয়েছে; অন্যদিকে তেমনি এইসব জাতি-গোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতি দিয়েও বাঙালি প্রভাবিত হয়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, পর্তুগিজ জাতির সঙ্গে বাঙালির সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভাষা-সংস্কৃতি ও কৃষিতে যে আদান-প্রদান হয়েছে তা বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। পর্তুগিজ পাদ্রি ম্যানুয়েল-দা-আস্সুম্পসাউ রচিত বাংলায় মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ, প্রথম বাংলা অভিধান ও ব্যাকরণের মতোই আজকের বাংলা ভাষাতেও মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে পর্তুগিজ জাতির ভাষাও। এ কালের বাংলা ভাষাতেও বহুল প্রচলিত আনারস, আলমারি, আতা, আলকাতরা, কর্জ, কপি, কাকাতুয়া, কামিজ, সায়া, খ্রিষ্টান, পেয়ারা, বাষ্প, বরগা বা পাউ-রুটির মতো শব্দগুলো এখনো সেই সাক্ষ্য বয়ে চলেছে।
গ্রন্থনা : আহমেদ মুনীরুদ্দিন
শেয়ার করুন
| ৬ মার্চ, ২০২২ ০০:০০

বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শনসমূহের বয়স হাজার বছরের বেশি। তবে বাংলা ভাষাচর্চার সংগঠিত রূপের ততটা প্রাচীন নিদর্শন ও দালিলিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন যে, পাল আমলেও বাংলা ভাষা যেমন রাজ আনুকূল্য পায়নি তেমনি সেই কালে বাংলা ভাষা বিকাশমান পর্যায়েই রয়ে গিয়েছিল। বাংলা অঞ্চলে মুসলিম শাসনের সূচনার পর বাংলার সুলতানরা ধীরে ধীরে বাংলা ভাষাকে রাজ আনুকূল্য দেন এবং স্থানীয় ভাষায় সাহিত্যচর্চার সহায়ক হিসেবে কাজ করেন। মুসলিম সুলতানি আমলেই বাংলা ভাষায় প্রথম রামায়ণ ও মহাভারত অনুবাদ হয়। এক্ষেত্রে সুলতানি আমলে রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতার কথাও সুবিদিত। কিন্তু এটাও স্পষ্ট যে, সাহিত্যচর্চায় রাজ আনুকূল্য থাকলেও সেসময় বাংলা ভাষার বিকাশে ব্যক্তি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সুসংগঠিত কোনো উদ্যোগের কথা জানা যায় না। দেখা যাচ্ছে বাংলায় ইউরোপীয় জাতিসমূহের আগমনের পর বাংলা ভাষার চর্চা ও বিকাশে একটা নতুন জোয়ার আসে। খ্রিষ্টধর্ম প্রচার এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ও শাসনকাজের সুবিধার্থে ইউরোপীয় জাতিগুলো এই কাজে মনোনিবেশ করে। এই যুগেই আমরা বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও বাংলা ভাষার অভিধান রচনার নানা সংগঠিত প্রয়াস দেখতে পাই। এক্ষেত্রে পর্তুগিজ ও ইংরেজ জাতি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে।
বাংলায় পর্তুগিজ জাতির আগমন ঘটে ইংরেজদের বেশ আগেই। ১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই পর্তুগিজরা ব্যবসা-বাণিজ্য, ধর্মপ্রচারসহ লুটতরাজের মতো বিচিত্র উদ্দেশ্যে হুগলি ও ব্যান্ডেল থেকে শুরু করে ঢাকা ও চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সপ্তদশ শতকেই পর্তুগিজ ভাষা বাংলায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং সে সময় থেকেই অগুনতি পর্তুগিজ শব্দ বাংলা ভাষায় মিশে গিয়েছিল। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে পর্তুগিজরা বাংলার কৃষি ও ভাষা-সংস্কৃতিতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। পর্তুগিজ মিশনারিরা খ্রিষ্টের সুসমাচার প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষা শিখে এদেশীয় মানুষদের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের কেউ কেউ বাংলা ভাষায় বই লেখারও চেষ্টা করেছেন। আর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, পর্তুগিজ পাদ্রি ম্যানুয়েল-দা-আস্সুম্পসাউ (Manoel da Assumpcao) বাংলা ভাষায় অভিধান রচনার প্রথম প্রয়াসের সফল রচয়িতা। পর্তুগিজ পাদ্রি ম্যানুয়েল-দা-আস্সুম্পসাউ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে একাধিক কারণে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আস্সুম্পসাউ ঢাকার উত্তর দিকে একটি পর্তুগিজ মিশনের প্রধান ছিলেন। ভাওয়াল গড়ের প্রান্তে অবস্থিত এই ক্যাথলিক মিশন বর্তমানে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জের নাগরীতে ‘সাধু নিকোলাস তোলেন্তিনো গির্জা’ (Missio de S. Nicola Tolentino) নামে পরিচিত। এ সময় ম্যানুয়েল-দ্য-আস্সুম্পসাউ বাংলা ভাষার প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’ রচনা করেন। একই সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ ও শব্দকোষ বা অভিধান রচনার কৃতিত্বও তারই। ম্যানুয়েল-দা-আস্সুম্পসাউ-এর ব্যাকরণ ও শব্দকোষ সম্পর্কে লেখক-গবেষক হাবীবুর রশীদ ‘বাংলা অভিধানের কথা’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বাংলা-পর্তুগিজ ও পর্তুগিজ বাংলা শব্দকোষটি (Vocabulario em Idioma Bengalla e Portuguez, dividedo im duas partes) ব্যাকরণের পরিশিষ্ট রূপে মুদ্রিত হয়েছিল। ব্যাকরণ অংশের পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল মোট ৫২৯। বইটি পর্তুগিজ রীতি অনুযায়ী রোমান অক্ষরে (বাংলায় মুদ্রণযন্ত্র তখনও অনাবিষ্কৃত) লিসবন শহর থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে।’
বাংলা ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব ঘটে অভিধান সংকলনের মধ্য দিয়ে। আঠারো শতকের শেষভাগে এবং উনিশ শতকের বিভিন্ন দশকে কাছাকাছি সময়ে অনেকগুলো বাংলা অভিধান রচনার প্রয়াস দেখা যায়। প্রথম দিককার বাংলা অভিধানগুলোর বেশিরভাগ ছিল দ্বিভাষিক। অনেকগুলো একভাষিক ও কয়েকটি বহুভাষিক অভিধান রচিত হয়। বাংলা ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব ঘটে এসব অভিধান সংকলনের মধ্য দিয়ে। ভাষাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এই সময়ের বহুভাষিক অভিধানগুলোর যে তালিকা দিয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে: আস্সুম্পসাউ (১৭৪৩), ফরস্টার (১৭৯৯, ১৮০২), মোহনপ্রসাদ (১৮১০), কেরি (১৮১৫-১৮২৫), রামকৃষ্ণ (১৮২১), জগন্নাথপ্রসাদ (১৮৩১), হটন (১৮৩৩), রামকমল (১৮৩৪), ডি’রোজারিও (১৮৩৭), দেবীপ্রসাদ (১৮৪১)। প্রথম দিককার বাংলা অভিধান সম্পর্কে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের নিচের বক্তব্য এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন, ‘এসব অভিধান সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে বাঙলা ভাষাকে: স্থির করে বাঙলা শব্দসম্ভার, সুস্থিত করে শব্দের বানান, নির্দিষ্ট করে শব্দের অর্থ, এবং সাহায্য করে বাঙলা ভাষার মানরূপ অর্জন ও সুস্থিতিতে। এসব অভিধান আনুশাসনিক, যাদের লক্ষ্য বাঙলা ভাষার শুদ্ধ শব্দ নির্দেশ করা। তবে, বাংলা ভাষার প্রথম অভিধানটি, আস্সুম্পসাউ’র ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগাল্লা ই পোর্তুগীজ, আনুশাসনিক ছিলো না। এটা অনেকটা বর্ণনামূলক। আস্সুম্পসাউ’র অভিধানে সংগৃহীত হয়েছিলো প্রধানত ভাওয়াল অঞ্চলের আঞ্চলিক শব্দ। কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারীরা ক্রমশ আঞ্চলিক ও প্রাত্যহিক শব্দ পরিহার ক’রে সংস্কৃত থেকে ঋণ করতে থাকেন বিপুল থেকে বিপুলতর শব্দ, যার একটি বড় অংশ হয়তো কখনো কেউ ব্যবহার করেনি। আনুশাসনিক অভিধান প্রণেতারা পালন করেন বাঙলা ভাষা-পরিকল্পনাকারীর দায়িত্ব; তাঁরা বাঙলা শব্দসম্ভার যেমন বাড়িয়ে দেন তেমনি বাঙলা ভাষার বিশুদ্ধ রূপ সম্পর্কে সৃষ্টি করেন একটি সুস্পষ্ট ধারণা। তাঁদের সংকলিত শব্দরাশির একটা বড়ো অংশ গৃহীত হ’য়ে যায় বাঙলা ভাষায়; এবং বাঙলা ভাষা একটি আঞ্চলিক বা বহু-আঞ্চলিক ভাষা থেকে মানভাষায় পরিণত হয়। শুধু আঞ্চলিক ও প্রাত্যহিক শব্দে বাঙলা ভাষার পক্ষে বর্তমান রূপ অর্জন করা সম্ভব ছিলো না।’ (হুমায়ুন আজাদ, বাংলা ভাষা, ২য় খন্ড)
সুপ্রাচীনকাল থেকে বাংলায় যে বহু ধর্ম-বর্ণ-ভাষার নানা জাতি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে তাদের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্কও বহুমাত্রিক। একদিকে যেমন বাংলা অঞ্চল ও বাঙালি জাতি বিদেশিদের দ্বারা শাসিত ও শোষিত হয়েছে; অন্যদিকে তেমনি এইসব জাতি-গোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতি দিয়েও বাঙালি প্রভাবিত হয়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, পর্তুগিজ জাতির সঙ্গে বাঙালির সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভাষা-সংস্কৃতি ও কৃষিতে যে আদান-প্রদান হয়েছে তা বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। পর্তুগিজ পাদ্রি ম্যানুয়েল-দা-আস্সুম্পসাউ রচিত বাংলায় মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ, প্রথম বাংলা অভিধান ও ব্যাকরণের মতোই আজকের বাংলা ভাষাতেও মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে পর্তুগিজ জাতির ভাষাও। এ কালের বাংলা ভাষাতেও বহুল প্রচলিত আনারস, আলমারি, আতা, আলকাতরা, কর্জ, কপি, কাকাতুয়া, কামিজ, সায়া, খ্রিষ্টান, পেয়ারা, বাষ্প, বরগা বা পাউ-রুটির মতো শব্দগুলো এখনো সেই সাক্ষ্য বয়ে চলেছে।
গ্রন্থনা : আহমেদ মুনীরুদ্দিন