রবীন্দ্রনাথ এক বিশাল আকাশ
মার্টিন কেম্পশেন | ৬ মার্চ, ২০২২ ০০:০০
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা করা শান্তিনিকেতনে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রখ্যাত জার্মান অনুবাদক, রবীন্দ্রগবেষক ও সমাজকর্মী মার্টিন কেম্পশেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তরের নিয়মিত কলামনিস্ট ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক সৌমিত্র দস্তিদার। গত ফেব্রুয়ারি মাসে নেওয়া সাক্ষাৎকারটি সৌমিত্র দস্তিদারের সংক্ষিপ্ত ভূমিকা ও প্রশ্নোত্তরসহ ছাপা হলো।
টান টান সুঠাম চেহারার যে চিরতরুণ আমার সামনে বসে আছেন, উইকিপিডিয়ায় তার পরিচয় দেওয়া আছে লেখক, অনুবাদক, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী বলে। তিনি নিজে এসব কোনো পরিচয় নিয়েই খুব স্বাচ্ছন্দ্য নন। বরং কেউ তাকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দীন সেবক বললেই বেশি খুশি হন। তার বন্ধু ও গুণগ্রাহী পশ্চিমবঙ্গের অত্যন্ত বিদগ্ধ, ফরাসি ভাষার পন্ডিত চিন্ময় গুহ অবশ্য মনে করেন মার্টিন কেম্পশেন আসলে সত্যিকারের সাধক ও আক্ষরিক অর্থে একজন বিশ্বপথিক। কিন্তু মিশতে মিশতে বুঝেছিলাম, চাপা কোনো অভিমান থাকলেও কখনো কোনো খারাপ কথা ওর মুখ দিয়ে বের হবে না। দীর্ঘদিন ধরে মার্টিন কেম্পশেন শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা। কতবার তার ভাড়া বাসার পাশ দিয়ে গেছি, কিন্তু ওখানে যে বাংলা সাহিত্যের এক সাধক থাকেন তা জানতেও পারিনি।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক ‘দেশ রূপান্তর’-এর পক্ষ থেকে আপনার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছি শুনে মার্টিন সাহেব একবার যেন সামান্য হেসে তাকালেন। এক চিলতে মৃদু হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। হতে পারে তিনি বলতে চাইলেন, যে এটাই স্বাভাবিক; খোদ শান্তিনিকেতনেও কেউ সেভাবে আমার খোঁজ রাখে না।
শান্তিনিকেতনে আমার বহু দিনের যোগাযোগ। এখনো সেখানে কত বন্ধু। তাও সত্যি কথা বলতে কি মার্টিন কেম্পশেন কোথায় থাকেন বা নিদেনপক্ষে ফোন নম্বর পাওয়াও সহজ হয়নি। বেশ কষ্টে প্রথমে কেম্পশেন সাহেবের সহযোগী সন্ন্যাসী লোহারের সৌজন্যে অবশেষে তাকে ফোনে পেলাম। সন্ন্যাসী দা বলে দিয়েছিলেন বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে ফোন করবেন। ওই সময় তিনি সবার সঙ্গে কথা বলেন। কথামতো ফোন করতেই ও প্রান্তে ঝরঝরে বাংলায় যে মানুষটি কথা বলে উঠলেন, বলা বাহুল্য তিনি পৃথিবীর অন্যতম রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ মার্টিন কেম্পশেন। ঘটনাচক্রে দেখা হওয়ার পর খুব দ্রুত তিনি আমার ‘মার্টিন দা’ হয়ে উঠলেন।
শান্তিনিকেতনে মেলার মাঠের পাশে তার ভাড়ার বাসা। কথামতো ফোন করে অপেক্ষা করছি। তিনি কাউকে পাঠাচ্ছেন আমাকে নিয়ে যেতে। এক মিনিট হয়েছে কি হয়নি কমল বিশ্বাস কিছুটা হন্তদন্ত হয়ে চলে এলেন। এই কমল বিশ্বাস, সন্ন্যাসী লোহারদের বাদ দিয়ে মার্টিন কেম্পশেন সম্পূর্ণ নন।
এক-একজন দীর্ঘ সময় ধরে মার্টিন সাহেবের সহযোগী, সহযোদ্ধা। বড়সড় এক লন। কয়েকটা চেয়ার পাতা রয়েছে। লোকজন কেউই নেই। বোধহয় আমার সঙ্গে শান্ত হয়ে বসে দু’দন্ড কথা বলবেন বলেই হয়তো অন্য ভিজিটরদের আজ ছুটি দিয়েছেন মার্টিন সাহেব। না হলে শুনেছি লোকজন, বিশেষ করে গ্রামের গরিব লোকরা ভিড় করে এ সময় সাহেবের কাছে নানা পরামর্শ নিতে আসেন।
একটুও অপেক্ষা করতে হলো না। লম্বা, ঈষৎ ঝুঁকে যে মানুষটি এলেন তাকে দেখে কে বলবে ১৯৪৮ সালে তার জন্ম। এক একজন থাকেন নিমেষে আপন করে নিতে পারেন। মার্টিন কেম্পশেন তেমনই একজন।
আমরা টেবিলের দু-প্রান্তে বসেই ঠিক করে নিলাম, কোনো মামুলি সাক্ষাৎকার হবে না। বরং খানিকটা আড্ডা হতেই পারে।
মার্টিন দা বাংলা শিখেছেন মন দিয়ে। বঙ্গসংস্কৃতি ভালোবেসেছেন গভীরভাবে। একসঙ্গেই রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চর্চা করেছেন। জার্মান ভাষাভাষী মানুষের কাছে রামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ দক্ষতার সঙ্গে পৌঁছে দিয়েছেন অনুবাদের মাধ্যমে।
সৌমিত্র দস্তিদার : রামকৃষ্ণ পরমহংস ও বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুটো আলাদা ধারা। সত্যি কথা বলতে কি স্বামী বিবেকানন্দ ও রবিঠাকুর সমসাময়িক হলেও সেভাবে দুজনের সখ্য গড়ে উঠেছে বলেও শুনিনি। আপনি দুই ধারাকে কোন জাদুতে মেলালেন?
কেম্পশেন : (মৃদু হাসলেন) দুটো আলাদা ধারা ঠিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং কিন্তু বলেছিলেন, ভারতকে জানতে চাইলে বিবেকানন্দ পড়তেই হবে। আর রামকৃষ্ণ চর্চা শুরু করেছিলাম অল্প বয়সে। ১৯৭১ সালে প্রথম কলকাতায় আসি। তিন বছরের জন্য। জার্মান সরকারের অনুদান পেয়ে। উঠি রামকৃষ্ণ মিশন কালচারাল ইনস্টিটিউটের গেস্টহাউজে। তখন ওখানকার দায়িত্বে ছিলেন স্বামী নিত্য স্বরূপানন্দ মহারাজ। পরে আলাপ হয় আর একজন মহারাজ স্বামী লোকেশ্বরনন্দ জির সঙ্গে। বস্তুত ওই দুজনের সান্নিধ্যেই আমার রামকৃষ্ণ চর্চা। বলা যায় এক ধরনের ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ।
সৌমিত্র দস্তিদার : আপনি তো রামকৃষ্ণ মিশন কালচারাল ইনস্টিটিউটে পরে পড়িয়েছিলেন?
কেম্পশেন : ওই জার্মান শেখাতাম। ভাষা বিভাগে। তিন বছর পড়িয়েছি। গোলপার্ক ছাড়া নরেন্দ্রপুর মিশনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। সমাজকর্মী হিসেবে যেটুকু যা কাজ তা বোধহয় নরেন্দ্রপুর মিশনের প্রভাবে। ওরা লোকেশ্বরনন্দ জির নেতৃত্বে নানা ধরনের সামাজিক কাজ করতেন। ওখানে আর একজন ছিলেন শিবশঙ্কর চক্রবর্তী। সবাই তখন তরুণ। ফলে কাজের উৎসাহ ছিল খুবই।
সৌমিত্র দস্তিদার : ১৯৭১ সালে তো কলকাতা অগ্নিগর্ভ। মৃণাল সেন সিনেমা অবধি করলেন, ‘কলকাতা-৭১’ নামে। আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
কেম্পশেন : আমি তো প্রথমে উঠেছিলাম এক পুলিশ অফিসারের বাড়ি। পি কে সেন। তার ছেলে আমার বন্ধু ছিল। তিনি একটু সাবধান করতেন। কিন্তু আমার কোনো দিন কোনো ঝামেলা ঝঞ্ঝাট হয়নি। টো টো করে সারা শহর ঘুরে বেড়াতাম। সবার সঙ্গে মিশতাম। অনেক নকশাল তরুণের সঙ্গেও আড্ডা হতো। আমি আমার মতো থাকতাম। খুব নাটক দেখতাম। এখনো ‘তিন পয়সার পালা’ নাটকের কথা মনে আছে।
সৌমিত্র দস্তিদার : আপনি তো ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান ভাষা সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। পরে ভিয়েনা থেকেই ডক্টরেট করলেন।
কেম্পশেন : হ্যাঁ।
সৌমিত্র দস্তিদার : পরে ফের ১৯৮০ সালে ফিরে এলেন শান্তি নিকেতনে। সেখানে ফের দ্বিতীয় ডক্টরেট করলেন। কেন? এর পেছনে কি নির্দিষ্ট কারণ ছিল?
কেম্পশেন : ফিরে এলাম না। সেই প্রথম শান্তিনিকেতনে এলাম। তারপর থেকে এই জায়গাই আমার সব। কভিডের কারণে দেশে গিয়েছিলাম। আবার একটু সুযোগ পেয়েই ফের শান্তিনিকেতনে।
দ্বিতীয় ডক্টরেট দর্শন নিয়ে। সাত বছর ধরে কাজটা করলাম। তখন এখানে কালিদাস ভট্টাচার্যের মতো অসাধারণ শিক্ষক আমি পেয়েছিলাম। ধীরে-সুস্থে ডক্টরেট শেষ করলাম। তখন তো আমি ঠিক করেই ফেলেছি এখানে থাকব। তাই আমার তো কোনো তাড়া নেই। এখানকার পরিবেশ, বাংলা-ভাষা সাহিত্য এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তখন আমি ধীরে ধীরে সবকিছু ভালোবেসে ফেলেছি।
সৌমিত্র দস্তিদার : আপনি তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অজস্র লেখা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছেন। প্রথম দিকে স্ফুলিঙ্গ, লিখন, কণিকা থেকে ১০০ কবিতা অনুবাদ করেছেন। পরে ৫০টি তার থেকে বেছে পেপার ব্যাক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। আর পেপার ব্যাক সংস্করণ তো সাত হাজার কপি শুধু বিক্রিই হয়নি, জার্মান সুধীসমাজ যথেষ্ট সমাদর ও স্বীকৃতি দিয়েছে আপনার কাজ। তার পরও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একাধিক কাজ করেই চলেছেন। একটা জিনিস দেখলাম, যে আপনার প্রথম দিককার অনেক কাজ যারা ছেপেছেন, তাদের প্রায় সবাই মূলত ধর্মগ্রন্থের প্রকাশক। তারা কেন রবীন্দ্রনাথ ছাপলেন?
কেম্পশেন : আসলে ইউরোপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক ধরনের সন্তু বা সেইন্ট, মরমি-মিস্টিক ইমেজ বহু দিন ধরেই আছে। সেই গীতাঞ্জলির জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকেই। ফলে জার্মান প্রকাশকদের যখন অ্যাপ্রোচ করলাম তখন তাদের মধ্যে সন্তু রবীন্দ্রনাথকেই মনে এসেছিল নিশ্চয়ই। ফলে ধর্মীয় প্রকাশকদের কাছেই তিনি বেশি গ্রহণযোগ্য হলেন। পরে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের লেখা অনুবাদ করলাম বা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জার্মানির সম্পর্ক নিয়ে কাজ করলাম তখন কিন্তু এ সমস্যা হয়নি। সাহিত্যের খ্যাতনামা পাবলিশার্স হাউজ এগিয়ে এসেছে।
আরও পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্বাচিত লেখা, কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নির্বাচিত চিঠি এবং আইনস্টাইনের সঙ্গে তার কথোপকথন বের হলো তখন জার্মান বিদগ্ধ সমাজ একেবারে, যাকে বলে বিমোহিত।
সৌমিত্র দস্তিদার : আপনার কথায় শেকসপিয়ার, দান্তে তলস্তয়-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জার্মান সুধীসমাজে এক আসনে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিলেন।
কেম্পশেন : (একটু হেসে) হ্যাঁ সত্যিই তাই।
সৌমিত্র দস্তিদার : এত বছর শান্তিনিকেতনে আছেন। বিশ্বভারতী কোনো পুরস্কার, স্বীকৃতি দিয়েছে!
কেম্পশেন : (একটু আনমনা হয়ে কী যেন ভাবলেন) না। মনে পড়ছে না। সেভাবে কেউ আমাকে চেনে বলেও মনে হয় না। রবীন্দ্র ভারতী আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৯২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ দিয়েছে।
কেম্পশেন : আপনি শান্তিনিকেতন থেকে আট কিলোমিটার দূরে ঘোষাল ডাঙায় আদিবাসীদের জন্য স্কুল করেছেন। লিখছেন। আবার স্কুল করেছেন। এত সময় বের করেন কী করে!
কেম্পশেন : বয়স বাড়ছে। এখন রোজ স্কুলে যাই না। তা ছাড়া আমি পুরো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। অনেক ব্যাপার আমি আজকাল সহকর্মীদের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। স্কুল অনেকটাই দেখে এখন সন্ন্যাসীরা।
সৌমিত্র দস্তিদার : একটা বিতর্ক তুলব! আপনি দুই বঙ্গে গেছেন। পশ্চিমবঙ্গ না বাংলাদেশ কোন বঙ্গ আপনার পছন্দের?
কেম্পশেন : এখানে, পশ্চিমবঙ্গে আমি এত বছর আছি। আর ওপারে গেছি একবার। ম্যাক্সমুলার ভবনের (ঢাকায় গ্যেয়েটে ইনস্টিটিউট) উদ্যোগে দুই বাংলার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটা সম্মেলনে। ফলে তুলনা করা কঠিন। তবে ওপারের মানুষজন অনেক উষ্ণ এটা মনে হয়েছে।
সৌমিত্র দস্তিদার : শেষে ঘুরে-ফিরে সেই প্রশ্ন করব, যা একদম শুরুতে করেছিলাম। রামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আপনার পক্ষপাত কার দিকে?
কেম্পশেন : রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ আধ্যাত্মিক জগতের লোক। তাদের দর্শন আলাদা। রবিঠাকুরের সঙ্গে মিলবে না। আর রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন বিশাল এক আকাশ। তিনিই এক মহাপৃথিবী। তার তুলনা নেই। তাকে নিয়েই বেঁচে থাকি। জীবনে কত কষ্ট, যন্ত্রণায় এখনো সম্বল তার লেখা ও গান। কয়েক হাজার গান রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। তবু এখনো জীবনে ঝড় উঠলে আপনমনে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে... ।’
সৌমিত্র দস্তিদার : দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কেম্পশেন : আপনাকে এবং দেশ রূপান্তরকেও অনেক ধন্যবাদ।
শেয়ার করুন
মার্টিন কেম্পশেন | ৬ মার্চ, ২০২২ ০০:০০

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা করা শান্তিনিকেতনে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রখ্যাত জার্মান অনুবাদক, রবীন্দ্রগবেষক ও সমাজকর্মী মার্টিন কেম্পশেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তরের নিয়মিত কলামনিস্ট ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক সৌমিত্র দস্তিদার। গত ফেব্রুয়ারি মাসে নেওয়া সাক্ষাৎকারটি সৌমিত্র দস্তিদারের সংক্ষিপ্ত ভূমিকা ও প্রশ্নোত্তরসহ ছাপা হলো।
টান টান সুঠাম চেহারার যে চিরতরুণ আমার সামনে বসে আছেন, উইকিপিডিয়ায় তার পরিচয় দেওয়া আছে লেখক, অনুবাদক, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী বলে। তিনি নিজে এসব কোনো পরিচয় নিয়েই খুব স্বাচ্ছন্দ্য নন। বরং কেউ তাকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দীন সেবক বললেই বেশি খুশি হন। তার বন্ধু ও গুণগ্রাহী পশ্চিমবঙ্গের অত্যন্ত বিদগ্ধ, ফরাসি ভাষার পন্ডিত চিন্ময় গুহ অবশ্য মনে করেন মার্টিন কেম্পশেন আসলে সত্যিকারের সাধক ও আক্ষরিক অর্থে একজন বিশ্বপথিক। কিন্তু মিশতে মিশতে বুঝেছিলাম, চাপা কোনো অভিমান থাকলেও কখনো কোনো খারাপ কথা ওর মুখ দিয়ে বের হবে না। দীর্ঘদিন ধরে মার্টিন কেম্পশেন শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা। কতবার তার ভাড়া বাসার পাশ দিয়ে গেছি, কিন্তু ওখানে যে বাংলা সাহিত্যের এক সাধক থাকেন তা জানতেও পারিনি।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক ‘দেশ রূপান্তর’-এর পক্ষ থেকে আপনার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছি শুনে মার্টিন সাহেব একবার যেন সামান্য হেসে তাকালেন। এক চিলতে মৃদু হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। হতে পারে তিনি বলতে চাইলেন, যে এটাই স্বাভাবিক; খোদ শান্তিনিকেতনেও কেউ সেভাবে আমার খোঁজ রাখে না।
শান্তিনিকেতনে আমার বহু দিনের যোগাযোগ। এখনো সেখানে কত বন্ধু। তাও সত্যি কথা বলতে কি মার্টিন কেম্পশেন কোথায় থাকেন বা নিদেনপক্ষে ফোন নম্বর পাওয়াও সহজ হয়নি। বেশ কষ্টে প্রথমে কেম্পশেন সাহেবের সহযোগী সন্ন্যাসী লোহারের সৌজন্যে অবশেষে তাকে ফোনে পেলাম। সন্ন্যাসী দা বলে দিয়েছিলেন বারোটা থেকে দুটোর মধ্যে ফোন করবেন। ওই সময় তিনি সবার সঙ্গে কথা বলেন। কথামতো ফোন করতেই ও প্রান্তে ঝরঝরে বাংলায় যে মানুষটি কথা বলে উঠলেন, বলা বাহুল্য তিনি পৃথিবীর অন্যতম রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ মার্টিন কেম্পশেন। ঘটনাচক্রে দেখা হওয়ার পর খুব দ্রুত তিনি আমার ‘মার্টিন দা’ হয়ে উঠলেন।
শান্তিনিকেতনে মেলার মাঠের পাশে তার ভাড়ার বাসা। কথামতো ফোন করে অপেক্ষা করছি। তিনি কাউকে পাঠাচ্ছেন আমাকে নিয়ে যেতে। এক মিনিট হয়েছে কি হয়নি কমল বিশ্বাস কিছুটা হন্তদন্ত হয়ে চলে এলেন। এই কমল বিশ্বাস, সন্ন্যাসী লোহারদের বাদ দিয়ে মার্টিন কেম্পশেন সম্পূর্ণ নন।
এক-একজন দীর্ঘ সময় ধরে মার্টিন সাহেবের সহযোগী, সহযোদ্ধা। বড়সড় এক লন। কয়েকটা চেয়ার পাতা রয়েছে। লোকজন কেউই নেই। বোধহয় আমার সঙ্গে শান্ত হয়ে বসে দু’দন্ড কথা বলবেন বলেই হয়তো অন্য ভিজিটরদের আজ ছুটি দিয়েছেন মার্টিন সাহেব। না হলে শুনেছি লোকজন, বিশেষ করে গ্রামের গরিব লোকরা ভিড় করে এ সময় সাহেবের কাছে নানা পরামর্শ নিতে আসেন।
একটুও অপেক্ষা করতে হলো না। লম্বা, ঈষৎ ঝুঁকে যে মানুষটি এলেন তাকে দেখে কে বলবে ১৯৪৮ সালে তার জন্ম। এক একজন থাকেন নিমেষে আপন করে নিতে পারেন। মার্টিন কেম্পশেন তেমনই একজন।
আমরা টেবিলের দু-প্রান্তে বসেই ঠিক করে নিলাম, কোনো মামুলি সাক্ষাৎকার হবে না। বরং খানিকটা আড্ডা হতেই পারে।
মার্টিন দা বাংলা শিখেছেন মন দিয়ে। বঙ্গসংস্কৃতি ভালোবেসেছেন গভীরভাবে। একসঙ্গেই রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চর্চা করেছেন। জার্মান ভাষাভাষী মানুষের কাছে রামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ দক্ষতার সঙ্গে পৌঁছে দিয়েছেন অনুবাদের মাধ্যমে।
সৌমিত্র দস্তিদার : রামকৃষ্ণ পরমহংস ও বিবেকানন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুটো আলাদা ধারা। সত্যি কথা বলতে কি স্বামী বিবেকানন্দ ও রবিঠাকুর সমসাময়িক হলেও সেভাবে দুজনের সখ্য গড়ে উঠেছে বলেও শুনিনি। আপনি দুই ধারাকে কোন জাদুতে মেলালেন?
কেম্পশেন : (মৃদু হাসলেন) দুটো আলাদা ধারা ঠিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং কিন্তু বলেছিলেন, ভারতকে জানতে চাইলে বিবেকানন্দ পড়তেই হবে। আর রামকৃষ্ণ চর্চা শুরু করেছিলাম অল্প বয়সে। ১৯৭১ সালে প্রথম কলকাতায় আসি। তিন বছরের জন্য। জার্মান সরকারের অনুদান পেয়ে। উঠি রামকৃষ্ণ মিশন কালচারাল ইনস্টিটিউটের গেস্টহাউজে। তখন ওখানকার দায়িত্বে ছিলেন স্বামী নিত্য স্বরূপানন্দ মহারাজ। পরে আলাপ হয় আর একজন মহারাজ স্বামী লোকেশ্বরনন্দ জির সঙ্গে। বস্তুত ওই দুজনের সান্নিধ্যেই আমার রামকৃষ্ণ চর্চা। বলা যায় এক ধরনের ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ।
সৌমিত্র দস্তিদার : আপনি তো রামকৃষ্ণ মিশন কালচারাল ইনস্টিটিউটে পরে পড়িয়েছিলেন?
কেম্পশেন : ওই জার্মান শেখাতাম। ভাষা বিভাগে। তিন বছর পড়িয়েছি। গোলপার্ক ছাড়া নরেন্দ্রপুর মিশনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। সমাজকর্মী হিসেবে যেটুকু যা কাজ তা বোধহয় নরেন্দ্রপুর মিশনের প্রভাবে। ওরা লোকেশ্বরনন্দ জির নেতৃত্বে নানা ধরনের সামাজিক কাজ করতেন। ওখানে আর একজন ছিলেন শিবশঙ্কর চক্রবর্তী। সবাই তখন তরুণ। ফলে কাজের উৎসাহ ছিল খুবই।
সৌমিত্র দস্তিদার : ১৯৭১ সালে তো কলকাতা অগ্নিগর্ভ। মৃণাল সেন সিনেমা অবধি করলেন, ‘কলকাতা-৭১’ নামে। আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
কেম্পশেন : আমি তো প্রথমে উঠেছিলাম এক পুলিশ অফিসারের বাড়ি। পি কে সেন। তার ছেলে আমার বন্ধু ছিল। তিনি একটু সাবধান করতেন। কিন্তু আমার কোনো দিন কোনো ঝামেলা ঝঞ্ঝাট হয়নি। টো টো করে সারা শহর ঘুরে বেড়াতাম। সবার সঙ্গে মিশতাম। অনেক নকশাল তরুণের সঙ্গেও আড্ডা হতো। আমি আমার মতো থাকতাম। খুব নাটক দেখতাম। এখনো ‘তিন পয়সার পালা’ নাটকের কথা মনে আছে।
সৌমিত্র দস্তিদার : আপনি তো ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্মান ভাষা সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। পরে ভিয়েনা থেকেই ডক্টরেট করলেন।
কেম্পশেন : হ্যাঁ।
সৌমিত্র দস্তিদার : পরে ফের ১৯৮০ সালে ফিরে এলেন শান্তি নিকেতনে। সেখানে ফের দ্বিতীয় ডক্টরেট করলেন। কেন? এর পেছনে কি নির্দিষ্ট কারণ ছিল?
কেম্পশেন : ফিরে এলাম না। সেই প্রথম শান্তিনিকেতনে এলাম। তারপর থেকে এই জায়গাই আমার সব। কভিডের কারণে দেশে গিয়েছিলাম। আবার একটু সুযোগ পেয়েই ফের শান্তিনিকেতনে।
দ্বিতীয় ডক্টরেট দর্শন নিয়ে। সাত বছর ধরে কাজটা করলাম। তখন এখানে কালিদাস ভট্টাচার্যের মতো অসাধারণ শিক্ষক আমি পেয়েছিলাম। ধীরে-সুস্থে ডক্টরেট শেষ করলাম। তখন তো আমি ঠিক করেই ফেলেছি এখানে থাকব। তাই আমার তো কোনো তাড়া নেই। এখানকার পরিবেশ, বাংলা-ভাষা সাহিত্য এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তখন আমি ধীরে ধীরে সবকিছু ভালোবেসে ফেলেছি।
সৌমিত্র দস্তিদার : আপনি তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অজস্র লেখা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছেন। প্রথম দিকে স্ফুলিঙ্গ, লিখন, কণিকা থেকে ১০০ কবিতা অনুবাদ করেছেন। পরে ৫০টি তার থেকে বেছে পেপার ব্যাক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। আর পেপার ব্যাক সংস্করণ তো সাত হাজার কপি শুধু বিক্রিই হয়নি, জার্মান সুধীসমাজ যথেষ্ট সমাদর ও স্বীকৃতি দিয়েছে আপনার কাজ। তার পরও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একাধিক কাজ করেই চলেছেন। একটা জিনিস দেখলাম, যে আপনার প্রথম দিককার অনেক কাজ যারা ছেপেছেন, তাদের প্রায় সবাই মূলত ধর্মগ্রন্থের প্রকাশক। তারা কেন রবীন্দ্রনাথ ছাপলেন?
কেম্পশেন : আসলে ইউরোপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক ধরনের সন্তু বা সেইন্ট, মরমি-মিস্টিক ইমেজ বহু দিন ধরেই আছে। সেই গীতাঞ্জলির জন্য নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর থেকেই। ফলে জার্মান প্রকাশকদের যখন অ্যাপ্রোচ করলাম তখন তাদের মধ্যে সন্তু রবীন্দ্রনাথকেই মনে এসেছিল নিশ্চয়ই। ফলে ধর্মীয় প্রকাশকদের কাছেই তিনি বেশি গ্রহণযোগ্য হলেন। পরে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেমের লেখা অনুবাদ করলাম বা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জার্মানির সম্পর্ক নিয়ে কাজ করলাম তখন কিন্তু এ সমস্যা হয়নি। সাহিত্যের খ্যাতনামা পাবলিশার্স হাউজ এগিয়ে এসেছে।
আরও পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্বাচিত লেখা, কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নির্বাচিত চিঠি এবং আইনস্টাইনের সঙ্গে তার কথোপকথন বের হলো তখন জার্মান বিদগ্ধ সমাজ একেবারে, যাকে বলে বিমোহিত।
সৌমিত্র দস্তিদার : আপনার কথায় শেকসপিয়ার, দান্তে তলস্তয়-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জার্মান সুধীসমাজে এক আসনে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিলেন।
কেম্পশেন : (একটু হেসে) হ্যাঁ সত্যিই তাই।
সৌমিত্র দস্তিদার : এত বছর শান্তিনিকেতনে আছেন। বিশ্বভারতী কোনো পুরস্কার, স্বীকৃতি দিয়েছে!
কেম্পশেন : (একটু আনমনা হয়ে কী যেন ভাবলেন) না। মনে পড়ছে না। সেভাবে কেউ আমাকে চেনে বলেও মনে হয় না। রবীন্দ্র ভারতী আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৯২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ দিয়েছে।
কেম্পশেন : আপনি শান্তিনিকেতন থেকে আট কিলোমিটার দূরে ঘোষাল ডাঙায় আদিবাসীদের জন্য স্কুল করেছেন। লিখছেন। আবার স্কুল করেছেন। এত সময় বের করেন কী করে!
কেম্পশেন : বয়স বাড়ছে। এখন রোজ স্কুলে যাই না। তা ছাড়া আমি পুরো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। অনেক ব্যাপার আমি আজকাল সহকর্মীদের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। স্কুল অনেকটাই দেখে এখন সন্ন্যাসীরা।
সৌমিত্র দস্তিদার : একটা বিতর্ক তুলব! আপনি দুই বঙ্গে গেছেন। পশ্চিমবঙ্গ না বাংলাদেশ কোন বঙ্গ আপনার পছন্দের?
কেম্পশেন : এখানে, পশ্চিমবঙ্গে আমি এত বছর আছি। আর ওপারে গেছি একবার। ম্যাক্সমুলার ভবনের (ঢাকায় গ্যেয়েটে ইনস্টিটিউট) উদ্যোগে দুই বাংলার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর একটা সম্মেলনে। ফলে তুলনা করা কঠিন। তবে ওপারের মানুষজন অনেক উষ্ণ এটা মনে হয়েছে।
সৌমিত্র দস্তিদার : শেষে ঘুরে-ফিরে সেই প্রশ্ন করব, যা একদম শুরুতে করেছিলাম। রামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আপনার পক্ষপাত কার দিকে?
কেম্পশেন : রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ আধ্যাত্মিক জগতের লোক। তাদের দর্শন আলাদা। রবিঠাকুরের সঙ্গে মিলবে না। আর রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন বিশাল এক আকাশ। তিনিই এক মহাপৃথিবী। তার তুলনা নেই। তাকে নিয়েই বেঁচে থাকি। জীবনে কত কষ্ট, যন্ত্রণায় এখনো সম্বল তার লেখা ও গান। কয়েক হাজার গান রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। তবু এখনো জীবনে ঝড় উঠলে আপনমনে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠি ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে... ।’
সৌমিত্র দস্তিদার : দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কেম্পশেন : আপনাকে এবং দেশ রূপান্তরকেও অনেক ধন্যবাদ।