দাপ্তরিক বাংলা বাস্তবায়নের বাধা কোথায়
ড. এম এ মোমেন | ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
১৯৪৭-এর ২১ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’ ছাপা হয়। সে সময় বাংলাকে কুপকাত করিয়ে উর্দু প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারি অনুগ্রহ ও আনুকূল্যপ্রাপ্ত কেউ কেউ আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন। শহীদুল্লাহর প্রবন্ধটি থেকে ঈষৎ দীর্ঘ একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করা আবশ্যক :
‘...যাহারা বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে ছাড়িয়া কিংবা বাংলার স্কুল কলেজে শিক্ষার মাধ্যম (মিডিয়াম) রূপে অথবা বাংলাদেশের আইন আদালতের ব্যবহার্য ভাষারূপে উর্দুর পক্ষে ওকালতি করিতেছেন আমি তাহাদিগকে কা-জ্ঞানহীন প-িতমূর্খ ভিন্ন আর কিছুই মনে করিতে পারি না। আমি তাহাদিগকে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করি বাংলাদেশের আরবি ফারসি অভিজ্ঞ মৌলভী মওলানার অভাব নাই, অতীতেও ছিল না। কিন্তু তাহাদের কতজন উর্দুতে গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন? মওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন মরহুম এবং মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেব কেবলমাত্র এই দুই জন (অন্যের কথা ছাড়িয়া দিলে) বাংলা ভাষায় যত ধর্মগ্রন্থ রচনা করিয়াছেন আমি জোরের সহিত বলিব এ পর্যন্ত সমস্ত বাংলাদেশের মওলানা-মৌলভীদিগকে একত্র করিলেও ততখানি পুস্তক তাঁহারা রচনা করিতে পারেন নাই এবং পারিবেনও না।’
১৯৪৭ পরবর্তী পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় ভূখ-, আজকের পঞ্চাশ ছাড়িয়ে একান্নতে পা দেওয়া বাংলাদেশে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, স্বল্পসংখ্যায় হলেও পূর্ববাংলায় উর্দুর পক্ষে লাঠিয়াল জনমত সৃষ্টি হয়েছিল (১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে ভাষা উর্দুর দাবিতে ঢাকার পলাশী ব্যারাকে যারা আক্রমণ চালিয়েছে তাদের হাতে ছিল লাঠি আর ইটপাথর)। এই বাধা থাকার কারণেই উদর্ুুর বিরুদ্ধে বাংলার পক্ষে আন্দোলন হয়েছে, শেষ পর্যন্ত প্রাদেশিক কর্মকা-ে বাংলার পক্ষে রাষ্ট্রীয় ঘোষণা হয়েছে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলীয় কোনো সচিব তথা বড় কর্মকর্তা ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকারকে বাংলায় কোনো চিঠি লিখেছেন কিংবা বাংলায় কোনো জবাব পেয়েছেন এমন কখনো শোনা যায়নি। কিন্তু যখন সব বাধা অপসৃত হলো, দেশ স্বাধীন হলো, ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর একাধিক অভিসন্দর্ভ রচিত হলো, সংবিধান বাংলা ভাষাকে সমুন্নত করল, বাংলা ভাষার প্রয়োগ বাস্তবায়নের জন্য আইন হলো, সচিবালয়ে বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ হলো কার্যত বাংলার ব্যবহার কিছুটা বাড়লেও বাংলার চাহিদা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলো রাষ্ট্র।
১২০৩ থেকে ১৮৩৭ মোট ৬৩৪ বছর দাপ্তরিক কাজে দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছে ফারসি ভাষা। এমনকি রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ১৮০৩-০৪ সালে যখন ফারসি গ্রন্থ ‘তুহফাৎ-উল-মুয়াহিদিন’ (একেশ^রবাদীদের জন্য উপহার) লিখলেন তখন বাংলা গদ্য বিকশিত হয়নি। ঊনবিংশ শতকের সবচেয়ে আলোকোজ্জ্বল বাঙালি রামমোহন রায় তুহফাৎ রচনার আগে লিখেন ‘মানজারতুন আদিয়ান’ ফারসি ভাষার সংবাদপত্র প্রকাশ করে নিজে সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। তখন ফারসি ছিল শিক্ষিতজনের ভাষা, চাকরিজীবীর ভাষা, মামলা-মোকদ্দমার ভাষা, জ্ঞান অন্বেষণের ভাষা সর্বোপরি অর্থ উপার্জনের ভাষা।
‘রামমোহন : সময়-জীবন-সাধনা’ গ্রন্থে মদনমোহন লিখেছেন :
‘সে যুগে শিক্ষার স্থান ছিল প্রধানত তিনটি গুরু মসাইয়ের পাঠশালা, ভট্টাচার্যের চতুষ্পদী আর মৌলভীদের মক্তব। পাঠশালার শিক্ষার মান ছিল একান্তভাবে সাধারণ। কিছু অঙ্ক আর কিছু পত্রলিখন প্রণালীর মধেই এর ক্ষেত্র সীমিত। সাধারণভাবে এ শিক্ষাই বরাদ্দ ছিল সবার জন্য। এরপর যারা ব্রাহ্মণ সন্তান তারা যেতেন ভট্টাচার্যের চতুষ্পদীতে। সেখানে সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হতো। এছাড়া যারা বিষয়ী পরিবারের সন্তান তাদের পক্ষে আরবি ও ফারসি ভাষা শিক্ষা অপরিহার্য ছিল। তখন কোর্ট-কাচারি সর্বত্রই এ উভয় ভাষার চলন। ব্যবহারিক জীবনে ছিল এর প্রচুর দাম। তাই এদের মৌলভীদের মক্তব্যে শিক্ষাগ্রহণ করতে হতো। রামমোহন বাঙালি ব্রাহ্মণ ও বিষয়ী ঘরের সন্তান, তাই পাঠশালা, চতুষ্পদী এবং মক্তবএ তিনটি স্থানেই শিক্ষালাভ করেন।’
১৮৩৭ সালে ফারসি ভাষা দপ্তরে ও আদালতে ব্যবহারের ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা জারি করলে তার প্রকৃত বাস্তবায়নে অর্ধশতক কাল কেটে যায়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে যাবজ্জীবন কারাদ- ও ফাঁসির রায়ে ইংলিশই ব্যবহার হওয়ার কথা। কিন্তু আসলে বিদ্রোহ-সংশ্লিষ্ট ভিন্ন ভিন্ন মামলায় আদালতের কার্যক্রম ও রায় ফারসিতেই হয়েছে। একটি উদাহরণ : ২২ নভেম্বর ১৮৫৭ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও অস্ত্র ধারণ এবং পলায়নের কারণে কফুর খানি ও অপর তিনজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র মামলা করে। ১ ডিসেম্বর ১৮৫৭ রায় ঘোষণা করা হয় কফুর খানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করার সাজা দেওয়া হয় এবং জিউলাল রাম, হীরামন রাম এবং শঙ্কর রামকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়ে দরিয়ার অপর তীরের কারাগারে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। বাদশাহ থেকে শুরু করে কোতোয়াল রাষ্ট্রব্যবস্থায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সবার জন্য ফারসিতে শিক্ষিত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা ছিল। বিরিয়ানি-কাবাব, হালুয়া-মোরব্বা, কিশমিশ-পেস্তাএর সবগুলোই ফারসি ভাষা থেকে বাংলায় এসেছে। ফারসি দাপটের সঙ্গে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে কেবল টিকে ছিল এমন নয়, রাজত্বও করেছে রীতিমতো।
১৯৮০-র দশকে কক্সবাজারে ভূমি-রাজস্ববিষয়ক চাকরি করাকালে আমিও ফারসি দলিলের পাতা উল্টাতে বাধ্য হই। দলিলবহনকারী তার আনা দলিলের বরাতে চকরিয়ার একটি জমির মালিকানা দাবি করে। ফারসি ভাষাজ্ঞান আমার শূন্য, দলিলবহনকারী দাবি করলেও তিনি দলিলে কী লিখা পড়ে শোনাতে পারছেন না। এ কালে ফার্সি জানা বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবুও একজন খুঁজে পাওয়া গেল যিনি দলিল ঘেঁটে বললেন, দলিলদাতা এ জমি ওয়াকফ করে দিয়ে গেছেন, আবেদনকারীদের পূর্বপুরুষ কেউ মোতাওয়াল্লি নিয়োজিত হয়েছিলেন। জমির তখনকার দাগ খতিয়ান দলিল থেকে উদ্ধার করে দিলে বোঝা গেল যে জমির মালিকানা দাবি করা হচ্ছে তার সঙ্গে দলিলের দাগের মিল নেই। বরং দলিলে বর্ণিত জমি ১৯০৩ সালে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। ফারসির দাপ্তরিক রেশ এখনো হয়তো কোথাও কোথাও রয়ে গেছে। তবে বাংলাভাষায় ফারসি যে অনপনেয় প্রভাব রেখে গেছে তাতে শব্দকৃপণ বাংলা অভিধানে ব্যবহারিক শব্দসংখ্যা বহু বেড়েছে। মসজিদে গমন করবেন না বালাখানায় নিশিযাপন করবেন, পরহেজগার হবেন না গুনাহগার সে আপনার ইচ্ছে কিন্তু ফারসি থেকে আপনার মুক্তি নেই মসজিদ, বালাখানা, পারহেজগার, গোনাহগার প্রত্যেকটি শব্দই ফারসি থেকে আহরণ করা। ফারসি পারস্য তো অধিকারে রেখেছেই একদা বাংলাদেশও বিজয় করে নিয়েছিল। আর বাংলা নিজের দেশেই সঙ্কুচিত ও দ্বিধান্বিত অবস্থায় পড়ে আছে, ভাষার দ্যুতি সীমান্তের বাইরে বেরুবে কেমন করে। এখন তো বাঙালিরাই বাংলার বিকাশে প্রধান বাধা। বাঙালিরাই যে বাধা আমার এই বিবেচনা ও অবস্থান কোনো বুদ্ধিজীবী কিংবা হর ফেব্রুয়ারিতে ছিঁচকাঁদুনে কোনো বাঙালি যে চ্যালেঞ্জ করবেন না তা আমি জানি। কারণ তাদের পাঞ্জাবির ঝুল যত বড়ই হোক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পদক ও পুরস্কারে যতই ভূষিত হন বাংলায় যত কাব্য ও উপন্যাস লিখুন তাদের সন্তান, আমাদের সন্তান এবং সন্তানের সন্তান কিন্তু বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থী নন। বাংলা ভাষার ‘পটেনশিয়াল রিডার’-এর তালিকা থেকে তারা বাদ পড়ে গেছেন। বাদ পড়ে যাবে তাদের সন্তানও। তাহলে সাহিত্যের বাংলা, দপ্তরের বাংলা কার জন্য?
ব্রিটিশ সরকার বাংলার প্রশ্নে, বাংলা ভাষার প্রশ্নে অনেকটাই নমনীয়। ১৭৪ বছর আগে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদকীয় থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
‘বহুদিন হইল ব্রিটিশ রাজপুরুষেরা এই রাজ্যের সমুদয় বিচারালয়ে বঙ্গভাষা ব্যবহৃত হইবার অনুমতি দিয়াছেন। ... কিন্তু বিচারালয়ে বঙ্গভাষা ব্যবহারে অনীহা বিধায় আমরা স্বদেশীয় ব্যক্তিদিগ্যে যদ্রুপ দোষী করিতে পারি গবর্নমেন্টকে তদ্রুপ দোষী করিতে পারি না, কারণ তাহারা ভিন্ন দেশীয় মানুষ, অধুনা এতদ্দেশের মনুষ্যরা যদি স্বজাতীয় ভাষা বিষয়ে মনোযোগী হয়েন তবে অনায়াসে কৃতবিদ্য হইতে পারেন, গবর্নমেন্ট তাহাতে কোনো প্রকার নিষেধ করেন না বরং উৎসাহ প্রদান করেন।’ (কামাক্ষা নাথ সেনের একটি রচনা থেকে উদ্ধৃত)
সোজা কথা আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের হুকুম এসেছে পৌনে দু’শ বছর আগে। এখন পর্যন্ত আংশিক কেবল বাস্তবায়ন হয়েছে। ‘ব্যক্তিদিগ্যে যদ্রুপ দোষী করিতে পারি গবর্নমেন্টকে তদ্রুপ দোষী করিতে পারি না’এটাই হচ্ছে সারকথা। এমনকি দপ্তরের নথি বাংলায় উপস্থাপন করা, বাংলায় দাপ্তরিক চিঠিপত্র লেখা, বাংলায় আদালতের কার্যবিবরণী লেখা, বাংলায় রায় লেখাএসব যদি আইনে নিষিদ্ধও থাকত, দপ্তরের ও আদালতের ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিসমূহ তা অমান্য করে বাংলাকে বেছে নিতেন তাহলে তাদের অনুকূলে আইন হতো, নিষেধাজ্ঞার আইন বাতিল হতো। পুরো বিষয়টিই হচ্ছে ব্যক্তির ইচ্ছে। পরিভাষার অভাবসহ বহুধরনের অজুহাত খাড়া করার সুযোগ বরাবরই থাকবে। নির্দিষ্ট পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তির পক্ষেই তার পেশার পরিভাষা তৈরি করা সহজ হওয়ার কথা। উদ্যোগটা তাদের কাছ থেকে এলেই শনাক্তকৃত বাধাগুলো অপসারণ সহজ হয়ে উঠে।
দার্শনিক জেরেমি ব্যানথাম (১৭৪০-১৮৩২) দর্শন, আইন এবং ভাষার ঐক্য সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আইনের ভাষা যদি বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে কিংবা কারও কাছে কিংবা কারও কাজে সহজবোধ্য না হয় তাহলে তার অবশ্যই বঞ্চিত বোধ করার কথাঅধিকার বঞ্চিত মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার হাহাকার থেকেই যাবে। ১৯৪৮ সালের ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস-এর অনুচ্ছেদ ২ মাতৃভাষার প্রতি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে মাতৃভাষার অধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩, অনুচ্ছেদ ১৫৩(২)(৩) এই অধিকারকে আরও সুস্পষ্ট করেছে এবং সুরক্ষিত করেছে। বার্সিলোনা ডিক্লারেশন বা ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব লিঙ্গুইস্টিক রাইটস (১৯৯৬) ভাষার অধিকার সুনিশ্চিত করেছে। ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বাধ্যতামূলক আইন হয়েছে।
১৯৭৫ সালে জারি করা রাষ্ট্রপতির একটি নির্বাহী আদেশ উদ্ধৃত সমীচীন হবে :
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি যে স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই দেশের প্রতি তার ভালোবাসা আছেএ কথা বিশ^াস করতে কষ্ট হয়, দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথি লিখবেন এটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেওয়া যায় না। এই আদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধাসরকারি অফিসে কেবলমাত্র বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে। এই বিষয়ে কোনো অন্যথা হলে উক্ত বিধি লঙ্ঘনকারীকে আইনানুগ শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। বিভিন্ন অফিস-আদালতের কর্তাব্যক্তিরা সতর্কতার সঙ্গে এ আদেশ কার্যকর এবং আদেশ লঙ্ঘনকারীদের শাস্তির বিধানের ব্যবস্থা করবেন।’
এ আদেশ অনেকটাই অরণ্যে রোদন হিসেবে দীর্ঘশ^াস ছাড়তে থাকে। তবে ১৯৮০-র দশকের সামরিক শাসনোত্তর অফিস-আদালতে বাংলা নথি লেখা এবং চিঠিপত্র লেখা যথেষ্ট বেড়ে যায়। ১৯৮৭-র বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন আইন উচ্চ আদালত ছাড়া প্রায় সর্বত্রই দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলার ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। আমি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, সচিবালয়ে ও মাঠ প্রশাসনে কাজ করেছি। সর্বত্রই নথি লিখনে এবং পত্র প্রেরণে বাংলা ভাষাই ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে (যেমন উচ্চ আদালতের কারণ দর্শানোর জবাব, বাংলাদেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক বিদেশি সংস্থা সমূহের প্রতিনিধিকে প্রেরিতব্য চিঠি, বিদেশির কাছে চিঠি) ইংরেজি ভাষাই ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয় বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে বাংলা ভাষা ব্যবহারে দক্ষতার ওপর মূল্যায়নেরও সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। উচ্চ আদালতে কয়েকজন বিচারক বাংলায় রায় লিখে সংবাদে উঠে এসেছেন। সংসদীয় প্রশ্নোত্তরসহ অন্যান্য কার্যক্রম বাংলাতে হচ্ছে। আমি ব্যক্তিমালিকানা খাতের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, সেখানে নিজেদের কথোপকথন ছাড়া বাংলা ব্যবহার হয়নি, নথি চালাচালি খুব কম, সবারই কম্পিউটার দক্ষতা রয়েছে। ইংরেজিতে লেখা ছুটির দরখাস্ত ইলেট্রনিক মেইলে আসত, অনুমোদনও হতো একই পদ্ধতিতেপেপারলেস অফিস বা কাগজশূন্য অফিস সৃষ্টি, এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বাংলাদেশে ইংরেজি, আরবি, জাপানি, কোরিয়ান এবং হিন্দি ভাষাতেও মূল্য সংযোজন ঘটেছে, ঘটেনি বাংলাতে। ফলে বাংলার প্রতি চাকরিদাতার আগ্রহ কমেছে। এ প্রজন্মের হাতে দপ্তরে দপ্তরে যদি বাংলা ভাষা ব্যবহারের শতভাগ বাস্তবায়নও ঘটে তাতে বাংলা ভাষার স্থায়ী সমৃদ্ধি ঘটবে মনে করার কারণ নেই। কারণ বাংলাদেশের ত্রিধারা শিক্ষাব্যবস্থায় মূলধারা বাংলামাধ্যম আর দুএক প্রজন্ম পর এতটাই ক্ষীণধারা হয়ে উঠবে যে দপ্তরে বাংলায় কাজ করার মতো, আদালতে বিচার চালাবার মতো বাংলা জানা উপযুক্ত জনশক্তির জোগান দিতে পারবে না।
অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? অপেক্ষা করুন।
লেখক: সরকারের সাবেক কর্মকর্তা
শেয়ার করুন
ড. এম এ মোমেন | ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

১৯৪৭-এর ২১ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’ ছাপা হয়। সে সময় বাংলাকে কুপকাত করিয়ে উর্দু প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারি অনুগ্রহ ও আনুকূল্যপ্রাপ্ত কেউ কেউ আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন। শহীদুল্লাহর প্রবন্ধটি থেকে ঈষৎ দীর্ঘ একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করা আবশ্যক :
‘...যাহারা বাংলাদেশে বাংলা ভাষাকে ছাড়িয়া কিংবা বাংলার স্কুল কলেজে শিক্ষার মাধ্যম (মিডিয়াম) রূপে অথবা বাংলাদেশের আইন আদালতের ব্যবহার্য ভাষারূপে উর্দুর পক্ষে ওকালতি করিতেছেন আমি তাহাদিগকে কা-জ্ঞানহীন প-িতমূর্খ ভিন্ন আর কিছুই মনে করিতে পারি না। আমি তাহাদিগকে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করি বাংলাদেশের আরবি ফারসি অভিজ্ঞ মৌলভী মওলানার অভাব নাই, অতীতেও ছিল না। কিন্তু তাহাদের কতজন উর্দুতে গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন? মওলানা মোহাম্মদ রুহুল আমীন মরহুম এবং মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সাহেব কেবলমাত্র এই দুই জন (অন্যের কথা ছাড়িয়া দিলে) বাংলা ভাষায় যত ধর্মগ্রন্থ রচনা করিয়াছেন আমি জোরের সহিত বলিব এ পর্যন্ত সমস্ত বাংলাদেশের মওলানা-মৌলভীদিগকে একত্র করিলেও ততখানি পুস্তক তাঁহারা রচনা করিতে পারেন নাই এবং পারিবেনও না।’
১৯৪৭ পরবর্তী পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় ভূখ-, আজকের পঞ্চাশ ছাড়িয়ে একান্নতে পা দেওয়া বাংলাদেশে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, স্বল্পসংখ্যায় হলেও পূর্ববাংলায় উর্দুর পক্ষে লাঠিয়াল জনমত সৃষ্টি হয়েছিল (১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে ভাষা উর্দুর দাবিতে ঢাকার পলাশী ব্যারাকে যারা আক্রমণ চালিয়েছে তাদের হাতে ছিল লাঠি আর ইটপাথর)। এই বাধা থাকার কারণেই উদর্ুুর বিরুদ্ধে বাংলার পক্ষে আন্দোলন হয়েছে, শেষ পর্যন্ত প্রাদেশিক কর্মকা-ে বাংলার পক্ষে রাষ্ট্রীয় ঘোষণা হয়েছে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলীয় কোনো সচিব তথা বড় কর্মকর্তা ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকারকে বাংলায় কোনো চিঠি লিখেছেন কিংবা বাংলায় কোনো জবাব পেয়েছেন এমন কখনো শোনা যায়নি। কিন্তু যখন সব বাধা অপসৃত হলো, দেশ স্বাধীন হলো, ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর একাধিক অভিসন্দর্ভ রচিত হলো, সংবিধান বাংলা ভাষাকে সমুন্নত করল, বাংলা ভাষার প্রয়োগ বাস্তবায়নের জন্য আইন হলো, সচিবালয়ে বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ হলো কার্যত বাংলার ব্যবহার কিছুটা বাড়লেও বাংলার চাহিদা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হলো রাষ্ট্র।
১২০৩ থেকে ১৮৩৭ মোট ৬৩৪ বছর দাপ্তরিক কাজে দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করেছে ফারসি ভাষা। এমনকি রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ১৮০৩-০৪ সালে যখন ফারসি গ্রন্থ ‘তুহফাৎ-উল-মুয়াহিদিন’ (একেশ^রবাদীদের জন্য উপহার) লিখলেন তখন বাংলা গদ্য বিকশিত হয়নি। ঊনবিংশ শতকের সবচেয়ে আলোকোজ্জ্বল বাঙালি রামমোহন রায় তুহফাৎ রচনার আগে লিখেন ‘মানজারতুন আদিয়ান’ ফারসি ভাষার সংবাদপত্র প্রকাশ করে নিজে সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। তখন ফারসি ছিল শিক্ষিতজনের ভাষা, চাকরিজীবীর ভাষা, মামলা-মোকদ্দমার ভাষা, জ্ঞান অন্বেষণের ভাষা সর্বোপরি অর্থ উপার্জনের ভাষা।
‘রামমোহন : সময়-জীবন-সাধনা’ গ্রন্থে মদনমোহন লিখেছেন :
‘সে যুগে শিক্ষার স্থান ছিল প্রধানত তিনটি গুরু মসাইয়ের পাঠশালা, ভট্টাচার্যের চতুষ্পদী আর মৌলভীদের মক্তব। পাঠশালার শিক্ষার মান ছিল একান্তভাবে সাধারণ। কিছু অঙ্ক আর কিছু পত্রলিখন প্রণালীর মধেই এর ক্ষেত্র সীমিত। সাধারণভাবে এ শিক্ষাই বরাদ্দ ছিল সবার জন্য। এরপর যারা ব্রাহ্মণ সন্তান তারা যেতেন ভট্টাচার্যের চতুষ্পদীতে। সেখানে সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হতো। এছাড়া যারা বিষয়ী পরিবারের সন্তান তাদের পক্ষে আরবি ও ফারসি ভাষা শিক্ষা অপরিহার্য ছিল। তখন কোর্ট-কাচারি সর্বত্রই এ উভয় ভাষার চলন। ব্যবহারিক জীবনে ছিল এর প্রচুর দাম। তাই এদের মৌলভীদের মক্তব্যে শিক্ষাগ্রহণ করতে হতো। রামমোহন বাঙালি ব্রাহ্মণ ও বিষয়ী ঘরের সন্তান, তাই পাঠশালা, চতুষ্পদী এবং মক্তবএ তিনটি স্থানেই শিক্ষালাভ করেন।’
১৮৩৭ সালে ফারসি ভাষা দপ্তরে ও আদালতে ব্যবহারের ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা জারি করলে তার প্রকৃত বাস্তবায়নে অর্ধশতক কাল কেটে যায়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে যাবজ্জীবন কারাদ- ও ফাঁসির রায়ে ইংলিশই ব্যবহার হওয়ার কথা। কিন্তু আসলে বিদ্রোহ-সংশ্লিষ্ট ভিন্ন ভিন্ন মামলায় আদালতের কার্যক্রম ও রায় ফারসিতেই হয়েছে। একটি উদাহরণ : ২২ নভেম্বর ১৮৫৭ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও অস্ত্র ধারণ এবং পলায়নের কারণে কফুর খানি ও অপর তিনজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র মামলা করে। ১ ডিসেম্বর ১৮৫৭ রায় ঘোষণা করা হয় কফুর খানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করার সাজা দেওয়া হয় এবং জিউলাল রাম, হীরামন রাম এবং শঙ্কর রামকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়ে দরিয়ার অপর তীরের কারাগারে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। বাদশাহ থেকে শুরু করে কোতোয়াল রাষ্ট্রব্যবস্থায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সবার জন্য ফারসিতে শিক্ষিত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা ছিল। বিরিয়ানি-কাবাব, হালুয়া-মোরব্বা, কিশমিশ-পেস্তাএর সবগুলোই ফারসি ভাষা থেকে বাংলায় এসেছে। ফারসি দাপটের সঙ্গে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে কেবল টিকে ছিল এমন নয়, রাজত্বও করেছে রীতিমতো।
১৯৮০-র দশকে কক্সবাজারে ভূমি-রাজস্ববিষয়ক চাকরি করাকালে আমিও ফারসি দলিলের পাতা উল্টাতে বাধ্য হই। দলিলবহনকারী তার আনা দলিলের বরাতে চকরিয়ার একটি জমির মালিকানা দাবি করে। ফারসি ভাষাজ্ঞান আমার শূন্য, দলিলবহনকারী দাবি করলেও তিনি দলিলে কী লিখা পড়ে শোনাতে পারছেন না। এ কালে ফার্সি জানা বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবুও একজন খুঁজে পাওয়া গেল যিনি দলিল ঘেঁটে বললেন, দলিলদাতা এ জমি ওয়াকফ করে দিয়ে গেছেন, আবেদনকারীদের পূর্বপুরুষ কেউ মোতাওয়াল্লি নিয়োজিত হয়েছিলেন। জমির তখনকার দাগ খতিয়ান দলিল থেকে উদ্ধার করে দিলে বোঝা গেল যে জমির মালিকানা দাবি করা হচ্ছে তার সঙ্গে দলিলের দাগের মিল নেই। বরং দলিলে বর্ণিত জমি ১৯০৩ সালে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। ফারসির দাপ্তরিক রেশ এখনো হয়তো কোথাও কোথাও রয়ে গেছে। তবে বাংলাভাষায় ফারসি যে অনপনেয় প্রভাব রেখে গেছে তাতে শব্দকৃপণ বাংলা অভিধানে ব্যবহারিক শব্দসংখ্যা বহু বেড়েছে। মসজিদে গমন করবেন না বালাখানায় নিশিযাপন করবেন, পরহেজগার হবেন না গুনাহগার সে আপনার ইচ্ছে কিন্তু ফারসি থেকে আপনার মুক্তি নেই মসজিদ, বালাখানা, পারহেজগার, গোনাহগার প্রত্যেকটি শব্দই ফারসি থেকে আহরণ করা। ফারসি পারস্য তো অধিকারে রেখেছেই একদা বাংলাদেশও বিজয় করে নিয়েছিল। আর বাংলা নিজের দেশেই সঙ্কুচিত ও দ্বিধান্বিত অবস্থায় পড়ে আছে, ভাষার দ্যুতি সীমান্তের বাইরে বেরুবে কেমন করে। এখন তো বাঙালিরাই বাংলার বিকাশে প্রধান বাধা। বাঙালিরাই যে বাধা আমার এই বিবেচনা ও অবস্থান কোনো বুদ্ধিজীবী কিংবা হর ফেব্রুয়ারিতে ছিঁচকাঁদুনে কোনো বাঙালি যে চ্যালেঞ্জ করবেন না তা আমি জানি। কারণ তাদের পাঞ্জাবির ঝুল যত বড়ই হোক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পদক ও পুরস্কারে যতই ভূষিত হন বাংলায় যত কাব্য ও উপন্যাস লিখুন তাদের সন্তান, আমাদের সন্তান এবং সন্তানের সন্তান কিন্তু বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থী নন। বাংলা ভাষার ‘পটেনশিয়াল রিডার’-এর তালিকা থেকে তারা বাদ পড়ে গেছেন। বাদ পড়ে যাবে তাদের সন্তানও। তাহলে সাহিত্যের বাংলা, দপ্তরের বাংলা কার জন্য?
ব্রিটিশ সরকার বাংলার প্রশ্নে, বাংলা ভাষার প্রশ্নে অনেকটাই নমনীয়। ১৭৪ বছর আগে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদকীয় থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
‘বহুদিন হইল ব্রিটিশ রাজপুরুষেরা এই রাজ্যের সমুদয় বিচারালয়ে বঙ্গভাষা ব্যবহৃত হইবার অনুমতি দিয়াছেন। ... কিন্তু বিচারালয়ে বঙ্গভাষা ব্যবহারে অনীহা বিধায় আমরা স্বদেশীয় ব্যক্তিদিগ্যে যদ্রুপ দোষী করিতে পারি গবর্নমেন্টকে তদ্রুপ দোষী করিতে পারি না, কারণ তাহারা ভিন্ন দেশীয় মানুষ, অধুনা এতদ্দেশের মনুষ্যরা যদি স্বজাতীয় ভাষা বিষয়ে মনোযোগী হয়েন তবে অনায়াসে কৃতবিদ্য হইতে পারেন, গবর্নমেন্ট তাহাতে কোনো প্রকার নিষেধ করেন না বরং উৎসাহ প্রদান করেন।’ (কামাক্ষা নাথ সেনের একটি রচনা থেকে উদ্ধৃত)
সোজা কথা আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের হুকুম এসেছে পৌনে দু’শ বছর আগে। এখন পর্যন্ত আংশিক কেবল বাস্তবায়ন হয়েছে। ‘ব্যক্তিদিগ্যে যদ্রুপ দোষী করিতে পারি গবর্নমেন্টকে তদ্রুপ দোষী করিতে পারি না’এটাই হচ্ছে সারকথা। এমনকি দপ্তরের নথি বাংলায় উপস্থাপন করা, বাংলায় দাপ্তরিক চিঠিপত্র লেখা, বাংলায় আদালতের কার্যবিবরণী লেখা, বাংলায় রায় লেখাএসব যদি আইনে নিষিদ্ধও থাকত, দপ্তরের ও আদালতের ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিসমূহ তা অমান্য করে বাংলাকে বেছে নিতেন তাহলে তাদের অনুকূলে আইন হতো, নিষেধাজ্ঞার আইন বাতিল হতো। পুরো বিষয়টিই হচ্ছে ব্যক্তির ইচ্ছে। পরিভাষার অভাবসহ বহুধরনের অজুহাত খাড়া করার সুযোগ বরাবরই থাকবে। নির্দিষ্ট পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তির পক্ষেই তার পেশার পরিভাষা তৈরি করা সহজ হওয়ার কথা। উদ্যোগটা তাদের কাছ থেকে এলেই শনাক্তকৃত বাধাগুলো অপসারণ সহজ হয়ে উঠে।
দার্শনিক জেরেমি ব্যানথাম (১৭৪০-১৮৩২) দর্শন, আইন এবং ভাষার ঐক্য সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আইনের ভাষা যদি বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে কিংবা কারও কাছে কিংবা কারও কাজে সহজবোধ্য না হয় তাহলে তার অবশ্যই বঞ্চিত বোধ করার কথাঅধিকার বঞ্চিত মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার হাহাকার থেকেই যাবে। ১৯৪৮ সালের ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস-এর অনুচ্ছেদ ২ মাতৃভাষার প্রতি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে মাতৃভাষার অধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩, অনুচ্ছেদ ১৫৩(২)(৩) এই অধিকারকে আরও সুস্পষ্ট করেছে এবং সুরক্ষিত করেছে। বার্সিলোনা ডিক্লারেশন বা ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব লিঙ্গুইস্টিক রাইটস (১৯৯৬) ভাষার অধিকার সুনিশ্চিত করেছে। ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বাধ্যতামূলক আইন হয়েছে।
১৯৭৫ সালে জারি করা রাষ্ট্রপতির একটি নির্বাহী আদেশ উদ্ধৃত সমীচীন হবে :
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি যে স্বাধীনতার তিন বছর পরও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই দেশের প্রতি তার ভালোবাসা আছেএ কথা বিশ^াস করতে কষ্ট হয়, দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথি লিখবেন এটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলতা চলতে দেওয়া যায় না। এই আদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধাসরকারি অফিসে কেবলমাত্র বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে। এই বিষয়ে কোনো অন্যথা হলে উক্ত বিধি লঙ্ঘনকারীকে আইনানুগ শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। বিভিন্ন অফিস-আদালতের কর্তাব্যক্তিরা সতর্কতার সঙ্গে এ আদেশ কার্যকর এবং আদেশ লঙ্ঘনকারীদের শাস্তির বিধানের ব্যবস্থা করবেন।’
এ আদেশ অনেকটাই অরণ্যে রোদন হিসেবে দীর্ঘশ^াস ছাড়তে থাকে। তবে ১৯৮০-র দশকের সামরিক শাসনোত্তর অফিস-আদালতে বাংলা নথি লেখা এবং চিঠিপত্র লেখা যথেষ্ট বেড়ে যায়। ১৯৮৭-র বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন আইন উচ্চ আদালত ছাড়া প্রায় সর্বত্রই দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলার ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। আমি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, সচিবালয়ে ও মাঠ প্রশাসনে কাজ করেছি। সর্বত্রই নথি লিখনে এবং পত্র প্রেরণে বাংলা ভাষাই ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ প্রয়োজনে (যেমন উচ্চ আদালতের কারণ দর্শানোর জবাব, বাংলাদেশে কর্মরত আন্তর্জাতিক বিদেশি সংস্থা সমূহের প্রতিনিধিকে প্রেরিতব্য চিঠি, বিদেশির কাছে চিঠি) ইংরেজি ভাষাই ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয় বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে বাংলা ভাষা ব্যবহারে দক্ষতার ওপর মূল্যায়নেরও সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। উচ্চ আদালতে কয়েকজন বিচারক বাংলায় রায় লিখে সংবাদে উঠে এসেছেন। সংসদীয় প্রশ্নোত্তরসহ অন্যান্য কার্যক্রম বাংলাতে হচ্ছে। আমি ব্যক্তিমালিকানা খাতের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, সেখানে নিজেদের কথোপকথন ছাড়া বাংলা ব্যবহার হয়নি, নথি চালাচালি খুব কম, সবারই কম্পিউটার দক্ষতা রয়েছে। ইংরেজিতে লেখা ছুটির দরখাস্ত ইলেট্রনিক মেইলে আসত, অনুমোদনও হতো একই পদ্ধতিতেপেপারলেস অফিস বা কাগজশূন্য অফিস সৃষ্টি, এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বাংলাদেশে ইংরেজি, আরবি, জাপানি, কোরিয়ান এবং হিন্দি ভাষাতেও মূল্য সংযোজন ঘটেছে, ঘটেনি বাংলাতে। ফলে বাংলার প্রতি চাকরিদাতার আগ্রহ কমেছে। এ প্রজন্মের হাতে দপ্তরে দপ্তরে যদি বাংলা ভাষা ব্যবহারের শতভাগ বাস্তবায়নও ঘটে তাতে বাংলা ভাষার স্থায়ী সমৃদ্ধি ঘটবে মনে করার কারণ নেই। কারণ বাংলাদেশের ত্রিধারা শিক্ষাব্যবস্থায় মূলধারা বাংলামাধ্যম আর দুএক প্রজন্ম পর এতটাই ক্ষীণধারা হয়ে উঠবে যে দপ্তরে বাংলায় কাজ করার মতো, আদালতে বিচার চালাবার মতো বাংলা জানা উপযুক্ত জনশক্তির জোগান দিতে পারবে না।
অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? অপেক্ষা করুন।
লেখক: সরকারের সাবেক কর্মকর্তা