রাষ্ট্রভাষা পরিস্থিতি এবং বাংলা প্রচলন আইন
শিশির ভট্টাচার্য্য | ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল সেই ১৯৪৮-৫২ সালে। এই আন্দোলনের ফলে বাঙালি একটি রাষ্ট্রের অধিকারী হয়ে গেছে বটে, কিন্তু যে উদ্দেশ্যে আন্দোলন হয়েছিল সেটা সফল হয়নি, অর্থাৎ বাংলাকে রাষ্ট্রের পঞ্চরঙ্গ : শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, দেশরক্ষা, ব্যবসায় ও শিক্ষায় ব্যবহৃত একমাত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে এই ব্যর্থতা নিয়ে অনেক মায়াকান্না হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, গত দুই দশকে প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বেড়েছে। আমলারা বাংলাতেই তাদের নথি পড়েন এবং বিভিন্ন আদেশ দিয়ে থাকেন। নিম্ন আদালতে বাংলায় রায় দেওয়া হয়।
কিন্তু তবুও সরকার ও জনগণের পছন্দের ভাষা যে বাংলা নয়, তা বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামকরণ প্রবণতাতেই প্রকাশ পাচ্ছে। একটি বিভাগীয় ক্রিকেট দলের নামও বাংলায় রাখা হয়নি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম : ‘টেলিটক’, ‘বিজিবি’ ও ‘এনসিটিবি’। উচ্চ আদালত বাংলায় রায় দেয় না। দেয় না ঠিক নয়, দিতে অক্ষম, অনিচ্ছুক। আপাতত কাজীর গরু কাগজে আছে, গোয়ালে নেই। বাংলা ‘ডি জুরো’ বা আইনত বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হলেও কার্যত বা ‘ডি ফ্যাক্টো’ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে? এটা কি নিছক কিছু বেকার লোকের আবেগের প্রশ্ন? যারা ভূতাবস্থা বজায় রাখতে চান, তারা তা-ই মনে করেন এবং বাংলাকে কার্যত রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে তারা কমপক্ষে তিনটি যুক্তি তুলে ধরেন।
প্রথম যুক্তি : বাংলা ভাষার আন্দোলন নিছকই স্বাধীনতার অর্জনের একটি পর্যায়। স্বাধীনতা যেহেতু অর্জিত হয়ে গেছে, সেহেতু রাষ্ট্রভাষা নিয়ে হইচই করে লাভ কী?
দ্বিতীয় যুক্তি : চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের পৃথিবী আর আজকের পৃথিবী এক নয়। এখনকার পৃথিবীতে বাংলার তুলনায় ইংরেজির গুরুত্ব অনেক বেশি। সুতরাং ইংরেজির দিকেই আমাদের ঝুঁকতে হবে।
তৃতীয় যুক্তি : ভাষা আন্দোলন ছিল উর্দুর বিরুদ্ধে। উর্দুর রাষ্ট্রভাষা হওয়ার আশঙ্কা যেহেতু নেই, সেহেতু রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন তোলারও কোনো প্রয়োজন নেই।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল প্রেরণা ছিল অর্থনৈতিক। উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে বাংলাভাষীরা অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়ত। রাষ্ট্র গঠন, রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা... এই সবকিছু আমরা করেছি একটা মাত্র কারণে : ‘আমার সন্তান যাতে থাকে দুধেভাতে!’ এই যে দুধভাত যা কি না উন্নয়নের রূপক, সেই উন্নয়ন শতভাগ জ্ঞাননির্ভর। আমরা যদি আজ জ্ঞানচর্চা না করি, তবে আগামী শতাব্দীতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও একইভাবে জ্ঞানের জন্য পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে। ভাষা বা জ্ঞানগত উন্নয়নের সঙ্গে ভৌত উন্নয়নের তফাৎ আছে। বিদেশি কোনো কোম্পানিকে দিয়ে রাস্তাঘাট, ভবন বা নগরের উন্নয়ন করিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু ভাষা বা জ্ঞানগত উন্নয়ন করতে হলে কোনো জনগোষ্ঠীর কয়েক দশকের নিরলস প্রস্তুতি ও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
প্রাকৃতিক কারণেই গড় বাঙালি কখনোই ইংরেজি শিখতে পারবে না। কী রকম? চমস্কির দাবি : মানবশিশু ‘বিশ্বব্যাকরণ’ নামে একটি ভাষা অঙ্গ বা ডিভাইস নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু সেই ডিভাইস ব্যবহার করার একটা অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে, একটা বিশেষ বয়সে (ধরা যাক, সাত বছর বয়স পর্যন্ত) বিশেষ ভাষার ইনপুট দিয়ে এই ডিভাইস নিয়মিত অ্যাক্টিভেইট করতে হয়। বাঙালি শিশুর শতকরা সাড়ে নিরানব্বই ভাগ ভাষা অর্জনের বয়সে ইংরেজি ইনপুট পায় না। বাংলাদেশের সর্বত্র যে ভাষাটির ইনপুট আছে, সেটি হচ্ছে আঞ্চলিক ও প্রমিত বাংলা। যেখানে বাংলাই ঠিকমতো শেখাতে পারছি না, সেখানে ইংরেজি শেখানো কীভাবে সম্ভব হবে? জোর করে ইংরেজি শেখাতে গিয়ে বর্তমান প্রজন্ম বাংলাও শিখছে না, ইংরেজিও শিখছে না। এর অব্যবহিত ফলশ্রুতি হিসেবে দ্বিভাষী বা বাইলিঙ্গুয়াল না হয়ে বর্তমান প্রজন্মের একেকজন কিশোর-কিশোরী হয়ে উঠছে অর্ধভাষী বা সেমিলিঙ্গুয়াল। ভাষায় যার উপযুক্ত দখল নেই, সে কীভাবে জ্ঞানচর্চায় শামিল হবে?
আমরা যদি পরনির্ভরতা কমাতে জ্ঞানভিত্তিক টেকসই উন্নয়ন চাই, তবে বাংলাকেই শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যম করতে হবে। অতীতে গ্রিক, রোমান, ভারতীয়, ইংরেজ ও রুশরা যখন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতির শীর্ষে উঠতে যাচ্ছিল, তখন রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তারা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? রাশিয়ায় দীর্ঘদিন রুশের তুলনায় ফরাসির গ্রহণযোগ্যতা বেশি ছিল। কিন্তু বিপ্লবের পর অপেক্ষাকৃত দুর্বল রুশকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। চীনা ভাষার অন্তত দশটি উপভাষা ছিল, এখনো আছে। কিন্তু বিপ্লবের পর থেকে ম্যান্ডারিনকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে। যে ভাষাকে উন্নয়নের মাধ্যম করলে উন্নয়ন সবচেয়ে সাশ্রয়ী, সবচেয়ে টেকসই হবে, শিক্ষা ও রাষ্ট্রপরিচালনার মাধ্যম হিসেবে সেই ভাষাটিকেই বেছে নিয়েছে সেসব জাতি, যাদের জ্ঞান ও কা-জ্ঞান দুই-ই আছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জারি রাখার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা নিশ্চিত হয়েছেন যে বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা ঠিক হবে না। ‘কাগজে-কলমে’ এ দাবি করতে না পারলেও ‘কাজে-কর্মে’ বাংলাকে হটিয়ে ইংরেজিকে অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ষড়যন্ত্র তারা করে চলেছেন। ইংরেজি ভাষায় বিসিএস, সরকারি বিদ্যালয়ে ইংলিশ ভার্সন চালু, উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহারে গড়িমসি, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও পণ্যের ইংরেজি নাম, উর্দু-হিন্দির অনুকরণে ২১শে ফেব্রুয়ারি, ৭ই মার্চ, ১লা বৈশাখকে যথাক্রমে ‘২১ ফেব্রুয়ারি’, ‘৭ মার্চ’ ও ‘১ বৈশাখ’ বলে বাংলা ভাষা ব্যবহারে দ্বিধার অবকাশ সৃষ্টি করা সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নেরই আলামত।
আম বাংলাভাষীও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। শিক্ষায় বাংলার ব্যবহার কমছে। বাড়ছে দুর্বল, অতি দুর্বল ইংরেজির ব্যবহার। ভোলার চর কুকরি-মুকরিতেও সম্ভবত খোলা হয়েছে তথাকথিত ‘ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’। নামেই পরিচয়, ‘ইংলিশ মিডিয়াম’, সুতরাং ‘মিডিয়াম’ মানের ইংরেজিই সেখানে পড়ানো হয়। গত দুই শতকে প্রতিষ্ঠিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও বাংলা রাখা হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যে শিক্ষায়তন ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার, সেখানেই অনেক বিভাগে, ইনস্টিটিউটে ইংরেজিতে পড়ানো, পরীক্ষায় ইংরেজিতে উত্তর দেওয়া অনেকটাই বাধ্যতামূলক।
শিক্ষার ইতিহাসে এই ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। এটা মূলত ‘মধ্যযুগীয়’ বদভ্যাস। মধ্যযুগের দ্বিতীয় পর্বে (১০০০-১৫০০) ইউরোপে স্থাপিত হওয়া উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ছিল লাতিন। লাতিন ৫০০ সাল থেকেই মৃত ভাষা। এই ভাষাটিকেই জীবিত ভাষা হিসেবে চালানো হচ্ছিল, অথচ তখন জনগণের ভাষা ইংরেজি, ফরাসি বা জার্মানকে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার ঘোরবিরোধী ছিলেন মধ্যযুগের নীতিনির্ধারকরা। মধ্যযুগের শিক্ষার ইতিহাসের আলোকে দাবি করা যেতে পারে, যে ভাষা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ব্যবহার্য নয়, সেই ভাষাকে খুব বেশি দিন শিক্ষার মাধ্যম করা যায় না শুধু নয়, জোর করে শিক্ষার মাধ্যম করতে গেলে সেই ভাষাটির মৃত্যু হয়। রেনেসাঁ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরেই কৃত্রিমভাগে পুনরুজ্জীবিত লাতিনের পুনর্মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল, শিক্ষার মাধ্যম হয়ে উঠেছিল জনগণের মুখের ভাষা ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ কিংবা ইংরেজি। জনগণের সংখ্যার বিচারে ইংরেজিকে কখনোই বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা করা যাবে না। বাংলা আগে-পরে বাংলাদেশের সর্বত্রগামী রাষ্ট্রভাষা হবেই হবে, ঠিক যেভাবে পুনর্জাগরণের যুগে ফ্রান্সে লাতিনকে হটিয়ে ফরাসি কিংবা ইংল্যান্ডে ফরাসিকে হটিয়ে ইংরেজি রাষ্ট্রভাষা হয়ে উঠেছিল।
বাংলাদেশের ভাষাসমস্যার একমাত্র এবং আশু সমাধান : একটি পূর্ণাঙ্গ, বিশদ ও বোধগম্য বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রণয়ন। সংবিধানে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ লেখা থাকলেই কিংবা ‘বাংলা প্রচলন আইন-১৯৮৭’ পাস করা হলেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা সর্বস্তরে প্রচলিত হয়ে যায় না। আইনটি বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হয়। আইন করে এবং আইনভঙ্গের শাস্তি বিধানের মাধ্যমে দুই প্রতিযোগী ভাষার মধ্যে দুর্বলতরটিকে সংরক্ষণ এমনকি অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যে সম্ভব তার প্রমাণও আছে : ‘ফরাসি ভাষা আইন ১০১’ প্রয়োগের মাধ্যমে কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্র কানাডার কুইবেক প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষা ফরাসিকে তিন দশকের মধ্যে (১৯৭৪-২০০৪) রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভবপর হয়েছে। ফরাসি ভাষা আইনের ধারাগুলোতে ‘ফরাসি’ কথাটার জায়গায় ‘বাংলা’ কথাটা বসিয়ে দিলেই একটি খসড়া বাংলা প্রচলন আইন প্রণয়ন করা অসম্ভব নয়।
‘ফরাসি ভাষা আইন ১০১’-এর আদলে বাংলা প্রচলন আইনে একটি ভাষা কমিশন গঠনের ব্যবস্থা থাকবে এবং (অনেকটা নির্বাচন কমিশনের মতো) এই ভাষা কমিশন সরকারের অধীন হবে না, রাষ্ট্রপতির অধীন হবে। সরকার এবং রাষ্ট্রের পঞ্চরঙ্গ : বিচার, শাসন, দেশরক্ষা, শিক্ষা, ব্যবসায়ের ভাষিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবে এই কমিশন। রাষ্ট্রপতি প্রতি পাঁচ বছরের জন্য যোগ্য কোনো নাগরিককে ভাষা কমিশনের সভাপতি নির্বাচিত করবেন। দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে বাংলা ভাষা কমিশনের অফিস থাকবে। ভাষা কমিশনের মুখ্য দায়িত্ব হবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা। পাঠ্যবই ও আইনের অনুবাদ করা, প্রতিশব্দ তৈরি করা থেকে শুরু করে বাংলা প্রচলনে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করা হবে বাংলা ভাষা কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে ভাষা কমিশনের অগ্রগতির প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে এবং জনসমক্ষে পেশ করতে হবে।
‘ফরাসি ভাষা আইন ১০১’-এর আদলে বাংলা ভাষা আইনে আরও দুটি সংগঠন সৃষ্টির ব্যবস্থা থাকবে : ১. বাংলা প্রচলন (অধি/পরি) দপ্তর এবং ২. বাংলা প্রচলন উপদেষ্টা পরিষদ। বাংলা প্রচলন আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকবে বাংলা প্রচলন দপ্তর। এই দপ্তর প্রতি বছর বাংলা প্রচলনের অগ্রগতি কিংবা বাংলা প্রচলন করতে গিয়ে উদ্ভূত কোনো সমস্যার ব্যাপারে কমিশনকে অবহিত করবে। পেশাদার, ডিগ্রিধারী এবং স্বনামধন্য ভাষাবিজ্ঞানীরা হবেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, যাতে করে বাংলা প্রচলনে যেকোনো সমস্যা সম্পর্কে তারা ভাষা কমিশনের সভাপতিকে পরামর্শ দিতে পারেন।
বাংলায় ‘টোফেল’ বা ‘আইইলটিএস’-এর আদলে পেশাদার ভাষাবিজ্ঞানীদের দিয়ে একাধিক পরীক্ষাপদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে। শাসন বিভাগে এমন কোনো আমলা, বিচার বিভাগে এমন কোনো বিচারক কিংবা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাবে না, যিনি ওই বাংলা পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফল লাভ করবেন না। যারা এরই মধ্যে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদেরও পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হলে ওই পরীক্ষা পাস করতে হবে। নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাজ্ঞানের আবশ্যিকতাকে যদি প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তবে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠিত হতে দেরি হবে না।
ভাষা আইনে পরিষ্কার বলা থাকবে, কোন ধারা ভঙ্গ করার জন্য কী দ- হবে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম বাংলায় রাখা না হলে কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা না হলে কিংবা ইংরেজি অক্ষরের তুলনায় বাংলা অক্ষর যথেষ্ট বড় না হলেও জরিমানার ব্যবস্থা থাকবে। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারালয়... রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান জরিমানার আওতাভুক্ত হবে। কোনো আমলা, বিচারক, শিক্ষকের ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার প্রমাণ যদি পাওয়া যায়, তবে ধরা যাক, তাকে হাজার বিশেক টাকা জরিমানা করতে হবে (কুইবেকের ভাষা আইনে এটা ৫০০ ডলার)। একই ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে জরিমানার পরিমাণ দ্বিগুণ বা তিন গুণ হবে। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই জরিমানার হার কয়েক গুণ বেশি হতে পারে।
বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের মূল লক্ষ্য হবে বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা। কোনো ভাষার তিন ধরনের প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা যেতে পারে : ১. সামাজিক প্রতিষ্ঠা, ২. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা এবং ৩. অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা। বাংলার সামাজিক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মধ্যযুগে, সুলতানি আমলে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। বাকি আছে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা যেটি নিশ্চিত করার ওপর নির্ভর করছে বাংলা ভাষার দীর্ঘজীবিতা এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি। বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যত বেশি দীর্ঘসূত্রতা হবে, ততই পিছিয়ে যাবে সর্বস্তরে বাধ্যতামূলক বাংলা ভাষার প্রয়োগ এবং এর ফলে ব্যাহত হবে বাংলাদেশে টেকসই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন।
লেখক : অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন
শিশির ভট্টাচার্য্য | ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল সেই ১৯৪৮-৫২ সালে। এই আন্দোলনের ফলে বাঙালি একটি রাষ্ট্রের অধিকারী হয়ে গেছে বটে, কিন্তু যে উদ্দেশ্যে আন্দোলন হয়েছিল সেটা সফল হয়নি, অর্থাৎ বাংলাকে রাষ্ট্রের পঞ্চরঙ্গ : শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, দেশরক্ষা, ব্যবসায় ও শিক্ষায় ব্যবহৃত একমাত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে এই ব্যর্থতা নিয়ে অনেক মায়াকান্না হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, গত দুই দশকে প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বেড়েছে। আমলারা বাংলাতেই তাদের নথি পড়েন এবং বিভিন্ন আদেশ দিয়ে থাকেন। নিম্ন আদালতে বাংলায় রায় দেওয়া হয়।
কিন্তু তবুও সরকার ও জনগণের পছন্দের ভাষা যে বাংলা নয়, তা বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামকরণ প্রবণতাতেই প্রকাশ পাচ্ছে। একটি বিভাগীয় ক্রিকেট দলের নামও বাংলায় রাখা হয়নি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম : ‘টেলিটক’, ‘বিজিবি’ ও ‘এনসিটিবি’। উচ্চ আদালত বাংলায় রায় দেয় না। দেয় না ঠিক নয়, দিতে অক্ষম, অনিচ্ছুক। আপাতত কাজীর গরু কাগজে আছে, গোয়ালে নেই। বাংলা ‘ডি জুরো’ বা আইনত বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হলেও কার্যত বা ‘ডি ফ্যাক্টো’ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে? এটা কি নিছক কিছু বেকার লোকের আবেগের প্রশ্ন? যারা ভূতাবস্থা বজায় রাখতে চান, তারা তা-ই মনে করেন এবং বাংলাকে কার্যত রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে তারা কমপক্ষে তিনটি যুক্তি তুলে ধরেন।
প্রথম যুক্তি : বাংলা ভাষার আন্দোলন নিছকই স্বাধীনতার অর্জনের একটি পর্যায়। স্বাধীনতা যেহেতু অর্জিত হয়ে গেছে, সেহেতু রাষ্ট্রভাষা নিয়ে হইচই করে লাভ কী?
দ্বিতীয় যুক্তি : চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের পৃথিবী আর আজকের পৃথিবী এক নয়। এখনকার পৃথিবীতে বাংলার তুলনায় ইংরেজির গুরুত্ব অনেক বেশি। সুতরাং ইংরেজির দিকেই আমাদের ঝুঁকতে হবে।
তৃতীয় যুক্তি : ভাষা আন্দোলন ছিল উর্দুর বিরুদ্ধে। উর্দুর রাষ্ট্রভাষা হওয়ার আশঙ্কা যেহেতু নেই, সেহেতু রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন তোলারও কোনো প্রয়োজন নেই।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল প্রেরণা ছিল অর্থনৈতিক। উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে বাংলাভাষীরা অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়ত। রাষ্ট্র গঠন, রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা... এই সবকিছু আমরা করেছি একটা মাত্র কারণে : ‘আমার সন্তান যাতে থাকে দুধেভাতে!’ এই যে দুধভাত যা কি না উন্নয়নের রূপক, সেই উন্নয়ন শতভাগ জ্ঞাননির্ভর। আমরা যদি আজ জ্ঞানচর্চা না করি, তবে আগামী শতাব্দীতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও একইভাবে জ্ঞানের জন্য পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে। ভাষা বা জ্ঞানগত উন্নয়নের সঙ্গে ভৌত উন্নয়নের তফাৎ আছে। বিদেশি কোনো কোম্পানিকে দিয়ে রাস্তাঘাট, ভবন বা নগরের উন্নয়ন করিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু ভাষা বা জ্ঞানগত উন্নয়ন করতে হলে কোনো জনগোষ্ঠীর কয়েক দশকের নিরলস প্রস্তুতি ও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
প্রাকৃতিক কারণেই গড় বাঙালি কখনোই ইংরেজি শিখতে পারবে না। কী রকম? চমস্কির দাবি : মানবশিশু ‘বিশ্বব্যাকরণ’ নামে একটি ভাষা অঙ্গ বা ডিভাইস নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু সেই ডিভাইস ব্যবহার করার একটা অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে, একটা বিশেষ বয়সে (ধরা যাক, সাত বছর বয়স পর্যন্ত) বিশেষ ভাষার ইনপুট দিয়ে এই ডিভাইস নিয়মিত অ্যাক্টিভেইট করতে হয়। বাঙালি শিশুর শতকরা সাড়ে নিরানব্বই ভাগ ভাষা অর্জনের বয়সে ইংরেজি ইনপুট পায় না। বাংলাদেশের সর্বত্র যে ভাষাটির ইনপুট আছে, সেটি হচ্ছে আঞ্চলিক ও প্রমিত বাংলা। যেখানে বাংলাই ঠিকমতো শেখাতে পারছি না, সেখানে ইংরেজি শেখানো কীভাবে সম্ভব হবে? জোর করে ইংরেজি শেখাতে গিয়ে বর্তমান প্রজন্ম বাংলাও শিখছে না, ইংরেজিও শিখছে না। এর অব্যবহিত ফলশ্রুতি হিসেবে দ্বিভাষী বা বাইলিঙ্গুয়াল না হয়ে বর্তমান প্রজন্মের একেকজন কিশোর-কিশোরী হয়ে উঠছে অর্ধভাষী বা সেমিলিঙ্গুয়াল। ভাষায় যার উপযুক্ত দখল নেই, সে কীভাবে জ্ঞানচর্চায় শামিল হবে?
আমরা যদি পরনির্ভরতা কমাতে জ্ঞানভিত্তিক টেকসই উন্নয়ন চাই, তবে বাংলাকেই শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার মাধ্যম করতে হবে। অতীতে গ্রিক, রোমান, ভারতীয়, ইংরেজ ও রুশরা যখন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতির শীর্ষে উঠতে যাচ্ছিল, তখন রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তারা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? রাশিয়ায় দীর্ঘদিন রুশের তুলনায় ফরাসির গ্রহণযোগ্যতা বেশি ছিল। কিন্তু বিপ্লবের পর অপেক্ষাকৃত দুর্বল রুশকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। চীনা ভাষার অন্তত দশটি উপভাষা ছিল, এখনো আছে। কিন্তু বিপ্লবের পর থেকে ম্যান্ডারিনকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে। যে ভাষাকে উন্নয়নের মাধ্যম করলে উন্নয়ন সবচেয়ে সাশ্রয়ী, সবচেয়ে টেকসই হবে, শিক্ষা ও রাষ্ট্রপরিচালনার মাধ্যম হিসেবে সেই ভাষাটিকেই বেছে নিয়েছে সেসব জাতি, যাদের জ্ঞান ও কা-জ্ঞান দুই-ই আছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জারি রাখার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা নিশ্চিত হয়েছেন যে বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা ঠিক হবে না। ‘কাগজে-কলমে’ এ দাবি করতে না পারলেও ‘কাজে-কর্মে’ বাংলাকে হটিয়ে ইংরেজিকে অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ষড়যন্ত্র তারা করে চলেছেন। ইংরেজি ভাষায় বিসিএস, সরকারি বিদ্যালয়ে ইংলিশ ভার্সন চালু, উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহারে গড়িমসি, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও পণ্যের ইংরেজি নাম, উর্দু-হিন্দির অনুকরণে ২১শে ফেব্রুয়ারি, ৭ই মার্চ, ১লা বৈশাখকে যথাক্রমে ‘২১ ফেব্রুয়ারি’, ‘৭ মার্চ’ ও ‘১ বৈশাখ’ বলে বাংলা ভাষা ব্যবহারে দ্বিধার অবকাশ সৃষ্টি করা সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নেরই আলামত।
আম বাংলাভাষীও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। শিক্ষায় বাংলার ব্যবহার কমছে। বাড়ছে দুর্বল, অতি দুর্বল ইংরেজির ব্যবহার। ভোলার চর কুকরি-মুকরিতেও সম্ভবত খোলা হয়েছে তথাকথিত ‘ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’। নামেই পরিচয়, ‘ইংলিশ মিডিয়াম’, সুতরাং ‘মিডিয়াম’ মানের ইংরেজিই সেখানে পড়ানো হয়। গত দুই শতকে প্রতিষ্ঠিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও বাংলা রাখা হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যে শিক্ষায়তন ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার, সেখানেই অনেক বিভাগে, ইনস্টিটিউটে ইংরেজিতে পড়ানো, পরীক্ষায় ইংরেজিতে উত্তর দেওয়া অনেকটাই বাধ্যতামূলক।
শিক্ষার ইতিহাসে এই ঘটনা অবশ্য নতুন নয়। এটা মূলত ‘মধ্যযুগীয়’ বদভ্যাস। মধ্যযুগের দ্বিতীয় পর্বে (১০০০-১৫০০) ইউরোপে স্থাপিত হওয়া উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ছিল লাতিন। লাতিন ৫০০ সাল থেকেই মৃত ভাষা। এই ভাষাটিকেই জীবিত ভাষা হিসেবে চালানো হচ্ছিল, অথচ তখন জনগণের ভাষা ইংরেজি, ফরাসি বা জার্মানকে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার ঘোরবিরোধী ছিলেন মধ্যযুগের নীতিনির্ধারকরা। মধ্যযুগের শিক্ষার ইতিহাসের আলোকে দাবি করা যেতে পারে, যে ভাষা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ব্যবহার্য নয়, সেই ভাষাকে খুব বেশি দিন শিক্ষার মাধ্যম করা যায় না শুধু নয়, জোর করে শিক্ষার মাধ্যম করতে গেলে সেই ভাষাটির মৃত্যু হয়। রেনেসাঁ শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরেই কৃত্রিমভাগে পুনরুজ্জীবিত লাতিনের পুনর্মৃত্যু হয়ে গিয়েছিল, শিক্ষার মাধ্যম হয়ে উঠেছিল জনগণের মুখের ভাষা ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ কিংবা ইংরেজি। জনগণের সংখ্যার বিচারে ইংরেজিকে কখনোই বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা করা যাবে না। বাংলা আগে-পরে বাংলাদেশের সর্বত্রগামী রাষ্ট্রভাষা হবেই হবে, ঠিক যেভাবে পুনর্জাগরণের যুগে ফ্রান্সে লাতিনকে হটিয়ে ফরাসি কিংবা ইংল্যান্ডে ফরাসিকে হটিয়ে ইংরেজি রাষ্ট্রভাষা হয়ে উঠেছিল।
বাংলাদেশের ভাষাসমস্যার একমাত্র এবং আশু সমাধান : একটি পূর্ণাঙ্গ, বিশদ ও বোধগম্য বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রণয়ন। সংবিধানে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ লেখা থাকলেই কিংবা ‘বাংলা প্রচলন আইন-১৯৮৭’ পাস করা হলেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা সর্বস্তরে প্রচলিত হয়ে যায় না। আইনটি বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হয়। আইন করে এবং আইনভঙ্গের শাস্তি বিধানের মাধ্যমে দুই প্রতিযোগী ভাষার মধ্যে দুর্বলতরটিকে সংরক্ষণ এমনকি অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যে সম্ভব তার প্রমাণও আছে : ‘ফরাসি ভাষা আইন ১০১’ প্রয়োগের মাধ্যমে কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্র কানাডার কুইবেক প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষা ফরাসিকে তিন দশকের মধ্যে (১৯৭৪-২০০৪) রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভবপর হয়েছে। ফরাসি ভাষা আইনের ধারাগুলোতে ‘ফরাসি’ কথাটার জায়গায় ‘বাংলা’ কথাটা বসিয়ে দিলেই একটি খসড়া বাংলা প্রচলন আইন প্রণয়ন করা অসম্ভব নয়।
‘ফরাসি ভাষা আইন ১০১’-এর আদলে বাংলা প্রচলন আইনে একটি ভাষা কমিশন গঠনের ব্যবস্থা থাকবে এবং (অনেকটা নির্বাচন কমিশনের মতো) এই ভাষা কমিশন সরকারের অধীন হবে না, রাষ্ট্রপতির অধীন হবে। সরকার এবং রাষ্ট্রের পঞ্চরঙ্গ : বিচার, শাসন, দেশরক্ষা, শিক্ষা, ব্যবসায়ের ভাষিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবে এই কমিশন। রাষ্ট্রপতি প্রতি পাঁচ বছরের জন্য যোগ্য কোনো নাগরিককে ভাষা কমিশনের সভাপতি নির্বাচিত করবেন। দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে বাংলা ভাষা কমিশনের অফিস থাকবে। ভাষা কমিশনের মুখ্য দায়িত্ব হবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা। পাঠ্যবই ও আইনের অনুবাদ করা, প্রতিশব্দ তৈরি করা থেকে শুরু করে বাংলা প্রচলনে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করা হবে বাংলা ভাষা কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে ভাষা কমিশনের অগ্রগতির প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে এবং জনসমক্ষে পেশ করতে হবে।
‘ফরাসি ভাষা আইন ১০১’-এর আদলে বাংলা ভাষা আইনে আরও দুটি সংগঠন সৃষ্টির ব্যবস্থা থাকবে : ১. বাংলা প্রচলন (অধি/পরি) দপ্তর এবং ২. বাংলা প্রচলন উপদেষ্টা পরিষদ। বাংলা প্রচলন আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকবে বাংলা প্রচলন দপ্তর। এই দপ্তর প্রতি বছর বাংলা প্রচলনের অগ্রগতি কিংবা বাংলা প্রচলন করতে গিয়ে উদ্ভূত কোনো সমস্যার ব্যাপারে কমিশনকে অবহিত করবে। পেশাদার, ডিগ্রিধারী এবং স্বনামধন্য ভাষাবিজ্ঞানীরা হবেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, যাতে করে বাংলা প্রচলনে যেকোনো সমস্যা সম্পর্কে তারা ভাষা কমিশনের সভাপতিকে পরামর্শ দিতে পারেন।
বাংলায় ‘টোফেল’ বা ‘আইইলটিএস’-এর আদলে পেশাদার ভাষাবিজ্ঞানীদের দিয়ে একাধিক পরীক্ষাপদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে। শাসন বিভাগে এমন কোনো আমলা, বিচার বিভাগে এমন কোনো বিচারক কিংবা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যাবে না, যিনি ওই বাংলা পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফল লাভ করবেন না। যারা এরই মধ্যে নিয়োগ পেয়েছেন, তাদেরও পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হলে ওই পরীক্ষা পাস করতে হবে। নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাজ্ঞানের আবশ্যিকতাকে যদি প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তবে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠিত হতে দেরি হবে না।
ভাষা আইনে পরিষ্কার বলা থাকবে, কোন ধারা ভঙ্গ করার জন্য কী দ- হবে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম বাংলায় রাখা না হলে কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা না হলে কিংবা ইংরেজি অক্ষরের তুলনায় বাংলা অক্ষর যথেষ্ট বড় না হলেও জরিমানার ব্যবস্থা থাকবে। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারালয়... রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান জরিমানার আওতাভুক্ত হবে। কোনো আমলা, বিচারক, শিক্ষকের ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার প্রমাণ যদি পাওয়া যায়, তবে ধরা যাক, তাকে হাজার বিশেক টাকা জরিমানা করতে হবে (কুইবেকের ভাষা আইনে এটা ৫০০ ডলার)। একই ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে জরিমানার পরিমাণ দ্বিগুণ বা তিন গুণ হবে। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই জরিমানার হার কয়েক গুণ বেশি হতে পারে।
বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের মূল লক্ষ্য হবে বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা। কোনো ভাষার তিন ধরনের প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা যেতে পারে : ১. সামাজিক প্রতিষ্ঠা, ২. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা এবং ৩. অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা। বাংলার সামাজিক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মধ্যযুগে, সুলতানি আমলে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। বাকি আছে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা যেটি নিশ্চিত করার ওপর নির্ভর করছে বাংলা ভাষার দীর্ঘজীবিতা এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি। বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যত বেশি দীর্ঘসূত্রতা হবে, ততই পিছিয়ে যাবে সর্বস্তরে বাধ্যতামূলক বাংলা ভাষার প্রয়োগ এবং এর ফলে ব্যাহত হবে বাংলাদেশে টেকসই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন।
লেখক : অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়