রাজকীয় প্রশাসনে বাংলা ভাষা
কালী রঞ্জন বর্মণ | ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
ভাষার জন্ম গোষ্ঠীবদ্ধ সাধারণ মানুষের মুখে, কোনো রাজকীয় অনুশাসন বা রাজদরবারে নয়। তবে একথা সত্য যে, রাজ আনুকূল্য অনেক ক্ষেত্রেই ভাষার সমৃদ্ধি ও বিকাশ সাধনে সহায়তা করেছে সে অগাস্টাস যুগে রোমক সাহিত্য, এলিজাবেথীয় যুগে ইংরেজি সাহিত্য এবং গুপ্ত-সেনযুগের সংস্কৃত সাহিত্য হোক; আর বাংলার স্বাধীন পাঠান সুলতানদের, আরাকানের বৌদ্ধ রাজাদের অথবা উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থানীয় রাজাদের আমলের বাংলা সাহিত্যই হোক। যদিও প্রাচীন যুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে রাজ আনুকূল্যের বিপরীতেই টিকে থাকতে হয়েছে বহুকাল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম প্রামাণ্য পুঁথি ‘চর্যাপদে’র সারা শরীরজুড়ে তারই চিহ্ন উৎকীর্ণ হয়ে আছে।
সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গে শক্তিশালী স্বাধীন রাজা শশাঙ্ক তার রাজ্যসীমা বঙ্গের বাইরে সম্প্রসারিত করলেও তখনো বাংলা ভাষার বিকাশ ও চর্চা রাজ আনুকূল্য পাওয়ার মতো পর্যায়ে ছিল না। তারপর অষ্টম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়জুড়ে উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিম বঙ্গের বেশিরভাগ অঞ্চল শাসন করেছেন পাল রাজারা। তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং বৌদ্ধধর্ম ও পালিভাষা পরিচর্যায় সহায়তা করেছেন বিস্তর। কিন্তু তখনো বাংলা ভাষা পাল রাজাদের আনুকূল্য পায়নি।
একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে প্রায় দেড়শ বছর বাংলায় রাজত্ব করেছেন সেন রাজবংশ। তারা এসেছিলেন দক্ষিণ ভারত থেকে এবং বিশ্বাসী ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মে। হিন্দুদের ধর্মীয় ভাষা যেহেতু সংস্কৃত, সে কারণে সেন রাজদরবারে এবং রাজদরবারের বাইরেও সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় তারা অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা করে গেছেন। এই আমলে সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য, শাস্ত্র দর্শন, ব্যাকরণ রচনা করে যারা বিখ্যাত হয়েছিলেন তাদের অনেকেই ছিলেন এই বঙ্গভূমির সন্তান এবং তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কবি জয়দেব গোস্বামী। তিনি বাংলাভূমিতে জন্ম নিলেও এবং স্থানীয় ভাষায় কথা বললেও তার অসামান্য কাব্য ‘গীতগোবিন্দম্’ রচনা করেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়।
অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ১২০৪ সালে তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খিলজির গৌড় বিজয়ের পর। রাজদরবারে তখন সংস্কৃতের বদলে আরবি-ফারসির প্রচলন শুরু হয়। মুসলমান শাসনকর্তাদের ধর্মীয় ভাষা আরবি আর রাজসরকারের ভাষা ফারসি হলেও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে তারা স্থানীয় জনগণের ভাষা ‘বাংলা’কে ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে পোষকতা করতে থাকেন। আর এভাবেই বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসনামলে বাংলা ভাষা কিছুটা মর্যাদার আসনে উন্নীত হয়।
সুলতানদের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ্ (১৩৯৩-১৪১০) প্রথম এই রাজকীয় আনুকূল্যের হাত প্রসারিত করেন। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় কবি শাহ্ মুহম্মদ সগীর কর্তৃক ‘ইউসুফ জুলেখা’ কাব্যটি রচিত হয়। শাহ্ মুহম্মদ সগীরই প্রথম কবি যিনি গৌড়েশ্বরের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম বাংলা ভাষায় কাব্য রচনা করেন। হিন্দু ধর্মীয় বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে সুলতান জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহের (১৪১৮-১৪৩৩) প্রণোদনায় কবি কৃত্তিবাস প্রথম সংস্কৃত রামায়ণে অনুবাদ করেন এবং এজন্যে গৌড়েশ্বর কর্তৃক সম্মানিত হন।
১৪৯৩ সালে গৌড়ের সিংহাসনে আসীন হন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্ (১৪৯৩-১৫১৯)। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রসারে হুসেন শাহী আমল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ঐতিহাসিক তার আমলকে সুলতানি আমলের ‘স্বর্ণযুগ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় কবি বিজয় গুপ্ত ‘মনসামঙ্গল’ ও বিপ্রদাস পিপিলাই ‘মনসাবিজয়’ কাব্য রচনা করেন।
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শেষের দিকে মোগল যুগে (১৫৭৬-১৭৫৭) শাসনকর্তারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি কোনো আগ্রহ বা আনুকূল্য প্রকাশ না করলেও এ সময়েও বাংলা সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি সাধন হয়েছে। এক্ষেত্রে সে যুগে দেশীয় রাজা ও জমিদাররা পৃষ্ঠপোষকতায় এই সাহিত্য সৃষ্টির ধারা প্রবহমান থাকে। এই সময়ে মোদিনীপুর জেলার আরার জমিদার রঘুনাথ রায়ের অনুরোধে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ‘চ-ীমঙ্গল’ এবং কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে তার সভাকবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সংযোজন।
অপরদিকে মধ্যযুগের এই সময়েই বাংলার সীমান্তের বাইরে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত আরাকান রাজসভায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের কবিরা সৃষ্টি করে চলেন এক ভিন্নধারার সাহিত্য সম্ভার। বাংলার সীমান্ত সংলগ্ন (চট্টগ্রামের দক্ষিণে) ‘মগের মুল্লুক’ বলে পরিচিত ‘রোসাঙ্গ’ রাজগণ ভিনদেশি, ভিন্নভাষী হওয়া সত্ত্বেও তাদের অনুগ্রহে এবং রাজসভার বিভিন্ন অমাত্যদের আদেশে কবি দৌলতকাজী ‘সতীময়না’ এবং কবি আলাওল ‘পদ্মাবতী’, ‘সপ্তপয়কর’, ‘সেকান্দরনামা’, ‘সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামান’ প্রভৃতি কাব্য রচনা করে নিজেদের কবিত্ব শক্তির পরিচয় প্রদানসহ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারা প্রবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
যাই হোক, দুঃখিনী বাংলা ভাষার দুর্গম পথযাত্রায় মধ্যযুগে বাংলার স্বাধীন সুলতানরা অথবা বাংলার বাইরের রাজ্য আরাকানের বৌদ্ধ রাজারা এই ভাষার প্রতি অনুকম্পা, উৎসাহ বা পৃষ্ঠপোষণা প্রদর্শন করলেও রাজপরিবার, রাজদরবার বা রাজ্যের কাজে-কর্মে, বচনে ও আচরণে তা কখনো ব্যবহৃত হয়নি এবং রাজকীয় স্বীকৃতিও পায়নি। এর প্রধান কারণ হয়তো এই যে, রাজাসনের কেউই মনেপ্রাণে বাঙালি ছিলেন না। তাই বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা জ্ঞানে ভালোবাসা ও দায়বোধ থেকে ব্যক্তিগত দ্বিধা এবং প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার মতো মনের জোর হয়তো তারা খুঁজে পাননি।
মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বরং রাজকীয় আদরে বাংলা ভাষার চর্চা হয়েছিল বিভাগপূর্ব উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে। পনের, ষোল শতক থেকে অহোম, কাছার, ত্রিপুরা, কোচবিহার, মণিপুর ও মেঘালয় রাজ্যের রাজকীয় পরিবার অথবা রাজসভায় কখনো ইতিহাস রচনা, কখনো স্বয়ং রাজা বা রাজকীয় পরিবারের সদস্য কর্তৃক সাহিত্যচর্চা, চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজ, শিলালিপি, রাজকীয় ফরমান, আইন গ্রন্থ প্রণয়নসহ স্কুল-কলেজে শিক্ষার মাধ্যম এবং সরকারি কাজকর্মের ভাষা হিসেবে এই ‘বাংলা ভাষা’ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এই অঞ্চলে ত্রিপুরার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম নিদর্শন ‘রাজমালা’। আদি-মধ্যযুগে সংকলিত এই রাজকাহিনী নানা সময়ে রচিত হয়েছে। মুখ্যত পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ‘রাজমালার’র ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজা ধর্মমাণিক্যের (১৪৩১-৬২) সময়ে পুরোহিত (চন্তাই) দুর্লভেন্দ্র প-িত, বাণেশ্বর ও শুক্রেশ্বর ‘রাজমালা’র রচনা শুরু করেন। পরবর্তীকালে এই ‘রাজমালা’ নানা সময়ে সমাপ্ত করেছেন যথাক্রমে রণচতুর নারায়ণ (দ্বিতীয় লহর), গঙ্গাধর সিদ্ধান্তবাগীশ (তৃতীয় লহর), জয়দেব উজির ও দুর্গম (চতুর্থ লহর)’। (প্রসূন বর্মন, উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলা ভাষা সাহিত্য আবৃত ইতিহাসের সন্ধানে; সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা ১২৪ বর্ষ ৩-৪ সংখ্যা, ১৪২৪, কলকাতা)।
ওপরের বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রায় ৫০০ বছর পূর্ব থেকেই বাংলা ভাষায় এই ‘রাজমালা’র রচনা শুরু হয়। এর কিছুকাল পর থেকেই ত্রিপুরা রাজ্যের প্রশাসনিক ও অন্যান্য কাজেও বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ত্রিপুরার রাজারা তিব্বতি-বর্মী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এবং তাদের মাতৃভাষা ‘কক্বরক্’ হলেও তাদের রাজভাষা ছিল বাংলা। তারা রাজ-অধ্যাদেশ, দলিল-দস্তাবেজ, তাম্রপট, সনদ সবকিছুতেই বাংলা ভাষার ব্যবহার করেছেন। এছাড়া রাজারা, রাজকুমার ও রাজকুমারীরাও বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেছেন। বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় এই রাজবংশের রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য (১৮৩৯-৯৬) সর্বাধিক আত্মনিয়োগ ও সুনাম অর্জন করেছিলেন।
এই অঞ্চলে ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলা ভাষা চর্চার অন্যতম নিদর্শন কাছাড়িরাজ মেঘনারায়ণের (১৫৭৬-৮৩) শিলালিপি। কাছাড়ের রাজধানী মাইবঙে প্রাপ্ত শিলালিপিটির সময়কাল প্রদর্শিত হয়েছে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ। পরবর্তী সময়ে রাজা তাম্রনারায়ণ (১৬৯১-১৭০৮) সমতল কাছাড়ের প্রজাদের জন্য বাংলায় ‘কাছাড়ির আইন’ প্রণয়ন করেন। এছাড়া কাছাড়রাজ সুরদর্পনায়ারণ (১৭০৮-১৭২০) এবং রাজচন্দ্রধ্বজ নারায়ণ (১৭২৮-১৭৩৫) বাংলাভাষায় শাক্ত সংগীত ও বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেন। ‘শিলালিপির গদ্য, আইন বিষয়ক রচনা, অনুবাদ ও নানা কিসিমের পদ রচনায় সমৃদ্ধ ডিমাসা রাজবংশের মধ্যযুগের সাহিত্য। প্রায় পাঁচশো বছর পূর্ব থেকে শুধু পৃষ্ঠপোষকতাই নয়, রাজবংশের সদস্যরাও বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। রাজসভায় এই ভাষা ও সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের সমাজ সংস্কৃতির ভিন্ন এক পথের সন্ধান পাওয়া যায়।’ (প্রসূন বর্মণ, পূর্বোক্ত)
১৯০১ সালে জুন মাসের ২৭ তারিখ আসামের তেজপুর থেকে প্রকাশিত ‘আসামবন্তী’ পত্রিকায় বাংলা ভাষায় লেখা একটি পত্র প্রকাশিত হয়; যা ১৫৫৫ সালে অহমরাজকে লিখেছিলেন কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণ। সেই চিঠিতে যে ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে তা বাংলা গদ্যের আদি নিদর্শন হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্বীকৃত। কিন্তু এ ছাড়াও সেই সময়ে এই অঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যের রাজা ও রাজকর্মচারীদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন চিঠিপত্রে বাংলা গদ্যের আদি নিদর্শনের কিছু সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন : কোচরাজা প্রাণনারায়ণের কাছে স্বর্গদেউ জয়ধ্বজ সিংহের পত্র (১৬৬৩), জয়ন্তিয়ারাজ যশমত্ত রায়ের কাছে স্বর্গদেউ চক্রধ্বজ সিংহের পত্র (১৬৬৪), অহোমমন্ত্রী দুয়রা বরফুকনের কাছে কাছাড়রাজ তাম্রধ্বজ নারায়ণের পত্র (১৬৯৮), শ্রীহট্টের থানাদারের প্রতি রুদ্রসিংহের পত্র (১৭০৭), ত্রিপুররাজ দ্বিতীয় রতœমাণিক্যের প্রতি রুদ্রসিংহের পত্র (১৭১১) ইত্যাদি।
সমসাময়িককালে অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যে মণিপুর রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয়েছিল ‘বিজয় পঞ্চালি’ বা ‘মৈতে পুরাণ’ (মণিপুরের ইতিহাস)। খাসি-জয়ন্তিয়া ও গাড়ো পাহাড় (বর্তমান মেঘালয়) অঞ্চলেও ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজসভায় বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। সে সময় জয়ন্তিয়া রাজদরবারে রচিত হয়েছিল ‘রতœাবলী’ ও ‘অদ্ভূত ভারত’ নামক গ্রন্থ। জয়ন্তিয়া রাজ্যের শেষ রাজা রাজেন্দ্র সিংহ স্বয়ং বেশ কিছু বৈষ্ণব পদ রচনা করেছিলেন। (প্রসূন বর্মণ, প্রাগুক্ত)
এরমধ্যে অষ্টাদশ শতাব্দীতে মোগল ও মোগল প্রতিনিধিদের হটিয়ে বাংলাসহ পুরো ভারতবর্ষে জাঁকিয়ে বসে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। মোগল আমলে রাজসরকারের ভাষা ছিল ফারসি। ইংরেজরা ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে প্রথমেই ফারসিকে বর্জন না করলেও তারা এই নব্য সাম্রাজ্য শাসনে ফারসির বিকল্প ভাষা চিন্তা করতে থাকেন। হয়তো তারা চিন্তা করেছিলেন স্থানীয় ভাষা হিসেবে ‘বাংলা’ই সেই অভাব পূরণ করতে পারবে।
কিন্তু বাংলা ভাষার ফারসির বিকল্প হিসেবে রাজভাষা হওয়ার একটা সম্ভাবনা ও সুযোগ সৃষ্টি হলেও বাস্তবে দেখা গেল যে, স্থানীয় লোকজন বিশেষত কলকাতা ও আশপাশের লোকজন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ইংরেজদের সঙ্গলাভ করে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য খুব আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে ১৮৩৫ সালে ইংরেজি ভাষকেই ব্রিটিশ ভারতের সরকারি কাজকর্মের ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী বঙ্গ প্রদেশের কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হলেও ‘বাংলা’ রাজভাষা হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো।
লেখক : লেখক ও গবেষক
শেয়ার করুন
কালী রঞ্জন বর্মণ | ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

ভাষার জন্ম গোষ্ঠীবদ্ধ সাধারণ মানুষের মুখে, কোনো রাজকীয় অনুশাসন বা রাজদরবারে নয়। তবে একথা সত্য যে, রাজ আনুকূল্য অনেক ক্ষেত্রেই ভাষার সমৃদ্ধি ও বিকাশ সাধনে সহায়তা করেছে সে অগাস্টাস যুগে রোমক সাহিত্য, এলিজাবেথীয় যুগে ইংরেজি সাহিত্য এবং গুপ্ত-সেনযুগের সংস্কৃত সাহিত্য হোক; আর বাংলার স্বাধীন পাঠান সুলতানদের, আরাকানের বৌদ্ধ রাজাদের অথবা উত্তর-পূর্ব ভারতের স্থানীয় রাজাদের আমলের বাংলা সাহিত্যই হোক। যদিও প্রাচীন যুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে রাজ আনুকূল্যের বিপরীতেই টিকে থাকতে হয়েছে বহুকাল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম প্রামাণ্য পুঁথি ‘চর্যাপদে’র সারা শরীরজুড়ে তারই চিহ্ন উৎকীর্ণ হয়ে আছে।
সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গে শক্তিশালী স্বাধীন রাজা শশাঙ্ক তার রাজ্যসীমা বঙ্গের বাইরে সম্প্রসারিত করলেও তখনো বাংলা ভাষার বিকাশ ও চর্চা রাজ আনুকূল্য পাওয়ার মতো পর্যায়ে ছিল না। তারপর অষ্টম থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়জুড়ে উত্তর ও দক্ষিণ পশ্চিম বঙ্গের বেশিরভাগ অঞ্চল শাসন করেছেন পাল রাজারা। তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং বৌদ্ধধর্ম ও পালিভাষা পরিচর্যায় সহায়তা করেছেন বিস্তর। কিন্তু তখনো বাংলা ভাষা পাল রাজাদের আনুকূল্য পায়নি।
একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে প্রায় দেড়শ বছর বাংলায় রাজত্ব করেছেন সেন রাজবংশ। তারা এসেছিলেন দক্ষিণ ভারত থেকে এবং বিশ্বাসী ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মে। হিন্দুদের ধর্মীয় ভাষা যেহেতু সংস্কৃত, সে কারণে সেন রাজদরবারে এবং রাজদরবারের বাইরেও সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় তারা অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা করে গেছেন। এই আমলে সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য, শাস্ত্র দর্শন, ব্যাকরণ রচনা করে যারা বিখ্যাত হয়েছিলেন তাদের অনেকেই ছিলেন এই বঙ্গভূমির সন্তান এবং তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কবি জয়দেব গোস্বামী। তিনি বাংলাভূমিতে জন্ম নিলেও এবং স্থানীয় ভাষায় কথা বললেও তার অসামান্য কাব্য ‘গীতগোবিন্দম্’ রচনা করেছিলেন সংস্কৃত ভাষায়।
অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ১২০৪ সালে তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খিলজির গৌড় বিজয়ের পর। রাজদরবারে তখন সংস্কৃতের বদলে আরবি-ফারসির প্রচলন শুরু হয়। মুসলমান শাসনকর্তাদের ধর্মীয় ভাষা আরবি আর রাজসরকারের ভাষা ফারসি হলেও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে তারা স্থানীয় জনগণের ভাষা ‘বাংলা’কে ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে পোষকতা করতে থাকেন। আর এভাবেই বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসনামলে বাংলা ভাষা কিছুটা মর্যাদার আসনে উন্নীত হয়।
সুলতানদের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ্ (১৩৯৩-১৪১০) প্রথম এই রাজকীয় আনুকূল্যের হাত প্রসারিত করেন। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় কবি শাহ্ মুহম্মদ সগীর কর্তৃক ‘ইউসুফ জুলেখা’ কাব্যটি রচিত হয়। শাহ্ মুহম্মদ সগীরই প্রথম কবি যিনি গৌড়েশ্বরের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম বাংলা ভাষায় কাব্য রচনা করেন। হিন্দু ধর্মীয় বিধিনিষেধ অগ্রাহ্য করে সুলতান জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহের (১৪১৮-১৪৩৩) প্রণোদনায় কবি কৃত্তিবাস প্রথম সংস্কৃত রামায়ণে অনুবাদ করেন এবং এজন্যে গৌড়েশ্বর কর্তৃক সম্মানিত হন।
১৪৯৩ সালে গৌড়ের সিংহাসনে আসীন হন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্ (১৪৯৩-১৫১৯)। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রসারে হুসেন শাহী আমল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ঐতিহাসিক তার আমলকে সুলতানি আমলের ‘স্বর্ণযুগ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় কবি বিজয় গুপ্ত ‘মনসামঙ্গল’ ও বিপ্রদাস পিপিলাই ‘মনসাবিজয়’ কাব্য রচনা করেন।
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শেষের দিকে মোগল যুগে (১৫৭৬-১৭৫৭) শাসনকর্তারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি কোনো আগ্রহ বা আনুকূল্য প্রকাশ না করলেও এ সময়েও বাংলা সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি সাধন হয়েছে। এক্ষেত্রে সে যুগে দেশীয় রাজা ও জমিদাররা পৃষ্ঠপোষকতায় এই সাহিত্য সৃষ্টির ধারা প্রবহমান থাকে। এই সময়ে মোদিনীপুর জেলার আরার জমিদার রঘুনাথ রায়ের অনুরোধে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ‘চ-ীমঙ্গল’ এবং কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নির্দেশে তার সভাকবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সংযোজন।
অপরদিকে মধ্যযুগের এই সময়েই বাংলার সীমান্তের বাইরে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত আরাকান রাজসভায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের কবিরা সৃষ্টি করে চলেন এক ভিন্নধারার সাহিত্য সম্ভার। বাংলার সীমান্ত সংলগ্ন (চট্টগ্রামের দক্ষিণে) ‘মগের মুল্লুক’ বলে পরিচিত ‘রোসাঙ্গ’ রাজগণ ভিনদেশি, ভিন্নভাষী হওয়া সত্ত্বেও তাদের অনুগ্রহে এবং রাজসভার বিভিন্ন অমাত্যদের আদেশে কবি দৌলতকাজী ‘সতীময়না’ এবং কবি আলাওল ‘পদ্মাবতী’, ‘সপ্তপয়কর’, ‘সেকান্দরনামা’, ‘সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামান’ প্রভৃতি কাব্য রচনা করে নিজেদের কবিত্ব শক্তির পরিচয় প্রদানসহ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারা প্রবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
যাই হোক, দুঃখিনী বাংলা ভাষার দুর্গম পথযাত্রায় মধ্যযুগে বাংলার স্বাধীন সুলতানরা অথবা বাংলার বাইরের রাজ্য আরাকানের বৌদ্ধ রাজারা এই ভাষার প্রতি অনুকম্পা, উৎসাহ বা পৃষ্ঠপোষণা প্রদর্শন করলেও রাজপরিবার, রাজদরবার বা রাজ্যের কাজে-কর্মে, বচনে ও আচরণে তা কখনো ব্যবহৃত হয়নি এবং রাজকীয় স্বীকৃতিও পায়নি। এর প্রধান কারণ হয়তো এই যে, রাজাসনের কেউই মনেপ্রাণে বাঙালি ছিলেন না। তাই বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা জ্ঞানে ভালোবাসা ও দায়বোধ থেকে ব্যক্তিগত দ্বিধা এবং প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার মতো মনের জোর হয়তো তারা খুঁজে পাননি।
মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বরং রাজকীয় আদরে বাংলা ভাষার চর্চা হয়েছিল বিভাগপূর্ব উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে। পনের, ষোল শতক থেকে অহোম, কাছার, ত্রিপুরা, কোচবিহার, মণিপুর ও মেঘালয় রাজ্যের রাজকীয় পরিবার অথবা রাজসভায় কখনো ইতিহাস রচনা, কখনো স্বয়ং রাজা বা রাজকীয় পরিবারের সদস্য কর্তৃক সাহিত্যচর্চা, চিঠিপত্র, দলিল দস্তাবেজ, শিলালিপি, রাজকীয় ফরমান, আইন গ্রন্থ প্রণয়নসহ স্কুল-কলেজে শিক্ষার মাধ্যম এবং সরকারি কাজকর্মের ভাষা হিসেবে এই ‘বাংলা ভাষা’ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এই অঞ্চলে ত্রিপুরার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম নিদর্শন ‘রাজমালা’। আদি-মধ্যযুগে সংকলিত এই রাজকাহিনী নানা সময়ে রচিত হয়েছে। মুখ্যত পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ‘রাজমালার’র ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজা ধর্মমাণিক্যের (১৪৩১-৬২) সময়ে পুরোহিত (চন্তাই) দুর্লভেন্দ্র প-িত, বাণেশ্বর ও শুক্রেশ্বর ‘রাজমালা’র রচনা শুরু করেন। পরবর্তীকালে এই ‘রাজমালা’ নানা সময়ে সমাপ্ত করেছেন যথাক্রমে রণচতুর নারায়ণ (দ্বিতীয় লহর), গঙ্গাধর সিদ্ধান্তবাগীশ (তৃতীয় লহর), জয়দেব উজির ও দুর্গম (চতুর্থ লহর)’। (প্রসূন বর্মন, উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলা ভাষা সাহিত্য আবৃত ইতিহাসের সন্ধানে; সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা ১২৪ বর্ষ ৩-৪ সংখ্যা, ১৪২৪, কলকাতা)।
ওপরের বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রায় ৫০০ বছর পূর্ব থেকেই বাংলা ভাষায় এই ‘রাজমালা’র রচনা শুরু হয়। এর কিছুকাল পর থেকেই ত্রিপুরা রাজ্যের প্রশাসনিক ও অন্যান্য কাজেও বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ত্রিপুরার রাজারা তিব্বতি-বর্মী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এবং তাদের মাতৃভাষা ‘কক্বরক্’ হলেও তাদের রাজভাষা ছিল বাংলা। তারা রাজ-অধ্যাদেশ, দলিল-দস্তাবেজ, তাম্রপট, সনদ সবকিছুতেই বাংলা ভাষার ব্যবহার করেছেন। এছাড়া রাজারা, রাজকুমার ও রাজকুমারীরাও বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেছেন। বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় এই রাজবংশের রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য (১৮৩৯-৯৬) সর্বাধিক আত্মনিয়োগ ও সুনাম অর্জন করেছিলেন।
এই অঞ্চলে ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলা ভাষা চর্চার অন্যতম নিদর্শন কাছাড়িরাজ মেঘনারায়ণের (১৫৭৬-৮৩) শিলালিপি। কাছাড়ের রাজধানী মাইবঙে প্রাপ্ত শিলালিপিটির সময়কাল প্রদর্শিত হয়েছে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ। পরবর্তী সময়ে রাজা তাম্রনারায়ণ (১৬৯১-১৭০৮) সমতল কাছাড়ের প্রজাদের জন্য বাংলায় ‘কাছাড়ির আইন’ প্রণয়ন করেন। এছাড়া কাছাড়রাজ সুরদর্পনায়ারণ (১৭০৮-১৭২০) এবং রাজচন্দ্রধ্বজ নারায়ণ (১৭২৮-১৭৩৫) বাংলাভাষায় শাক্ত সংগীত ও বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেন। ‘শিলালিপির গদ্য, আইন বিষয়ক রচনা, অনুবাদ ও নানা কিসিমের পদ রচনায় সমৃদ্ধ ডিমাসা রাজবংশের মধ্যযুগের সাহিত্য। প্রায় পাঁচশো বছর পূর্ব থেকে শুধু পৃষ্ঠপোষকতাই নয়, রাজবংশের সদস্যরাও বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। রাজসভায় এই ভাষা ও সাহিত্য চর্চার মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের সমাজ সংস্কৃতির ভিন্ন এক পথের সন্ধান পাওয়া যায়।’ (প্রসূন বর্মণ, পূর্বোক্ত)
১৯০১ সালে জুন মাসের ২৭ তারিখ আসামের তেজপুর থেকে প্রকাশিত ‘আসামবন্তী’ পত্রিকায় বাংলা ভাষায় লেখা একটি পত্র প্রকাশিত হয়; যা ১৫৫৫ সালে অহমরাজকে লিখেছিলেন কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণ। সেই চিঠিতে যে ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে তা বাংলা গদ্যের আদি নিদর্শন হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্বীকৃত। কিন্তু এ ছাড়াও সেই সময়ে এই অঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যের রাজা ও রাজকর্মচারীদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন চিঠিপত্রে বাংলা গদ্যের আদি নিদর্শনের কিছু সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন : কোচরাজা প্রাণনারায়ণের কাছে স্বর্গদেউ জয়ধ্বজ সিংহের পত্র (১৬৬৩), জয়ন্তিয়ারাজ যশমত্ত রায়ের কাছে স্বর্গদেউ চক্রধ্বজ সিংহের পত্র (১৬৬৪), অহোমমন্ত্রী দুয়রা বরফুকনের কাছে কাছাড়রাজ তাম্রধ্বজ নারায়ণের পত্র (১৬৯৮), শ্রীহট্টের থানাদারের প্রতি রুদ্রসিংহের পত্র (১৭০৭), ত্রিপুররাজ দ্বিতীয় রতœমাণিক্যের প্রতি রুদ্রসিংহের পত্র (১৭১১) ইত্যাদি।
সমসাময়িককালে অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যে মণিপুর রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত হয়েছিল ‘বিজয় পঞ্চালি’ বা ‘মৈতে পুরাণ’ (মণিপুরের ইতিহাস)। খাসি-জয়ন্তিয়া ও গাড়ো পাহাড় (বর্তমান মেঘালয়) অঞ্চলেও ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাজসভায় বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। সে সময় জয়ন্তিয়া রাজদরবারে রচিত হয়েছিল ‘রতœাবলী’ ও ‘অদ্ভূত ভারত’ নামক গ্রন্থ। জয়ন্তিয়া রাজ্যের শেষ রাজা রাজেন্দ্র সিংহ স্বয়ং বেশ কিছু বৈষ্ণব পদ রচনা করেছিলেন। (প্রসূন বর্মণ, প্রাগুক্ত)
এরমধ্যে অষ্টাদশ শতাব্দীতে মোগল ও মোগল প্রতিনিধিদের হটিয়ে বাংলাসহ পুরো ভারতবর্ষে জাঁকিয়ে বসে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। মোগল আমলে রাজসরকারের ভাষা ছিল ফারসি। ইংরেজরা ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে প্রথমেই ফারসিকে বর্জন না করলেও তারা এই নব্য সাম্রাজ্য শাসনে ফারসির বিকল্প ভাষা চিন্তা করতে থাকেন। হয়তো তারা চিন্তা করেছিলেন স্থানীয় ভাষা হিসেবে ‘বাংলা’ই সেই অভাব পূরণ করতে পারবে।
কিন্তু বাংলা ভাষার ফারসির বিকল্প হিসেবে রাজভাষা হওয়ার একটা সম্ভাবনা ও সুযোগ সৃষ্টি হলেও বাস্তবে দেখা গেল যে, স্থানীয় লোকজন বিশেষত কলকাতা ও আশপাশের লোকজন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ইংরেজদের সঙ্গলাভ করে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য খুব আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে ১৮৩৫ সালে ইংরেজি ভাষকেই ব্রিটিশ ভারতের সরকারি কাজকর্মের ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী বঙ্গ প্রদেশের কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হলেও ‘বাংলা’ রাজভাষা হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো।
লেখক : লেখক ও গবেষক