
সময়টা ২০০৯ সাল। বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে একের পর এক যুক্ত হচ্ছে নতুন সংবাদপত্র। সে বছরের ১ নভেম্বর। সমকাল থেকে কালের কণ্ঠের রিপোর্টিং বিভাগে ‘সেল চিফ’ হিসেবে যোগ দিই আমি। তখন পত্রিকাটির ‘সফট ডামি’ চলছিল। রিপোর্টিং বিভাগের যাবতীয় কার্যক্রম পাঁচটি সেলের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, বাংলাদেশের মিডিয়া হাউজে এ সেল পদ্ধতি অমিতদার (অমিত হাবিব) নিজস্ব চিন্তার ফসল, যা দৈনিক যায়যায়দিন থেকে শুরু করেছিলেন। যাই হোক, আমি যে সেলের দায়িত্বে ছিলাম, সেটার নাম ছিল ‘সরকার ও জনপ্রশাসন’। সেখানে ছিল বাংলাদেশ সচিবালয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কূটনীতি ও যোগাযোগ খাত। কূটনৈতিক রিপোর্টার ছিলেন বশির আহমেদ। কিন্তু পত্রিকা বের হওয়ার কয়েক দিন আগেই বশির আরেকটি পত্রিকায় চলে যান। রীতিমতো আমার ‘কপালে ভাঁজ’। অমিতদা ছিলেন কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক। সঙ্গে সঙ্গে তাকে বিষয়টি জানালাম। তিনি বললেন, ‘আপনি কি চিন্তিত? টেনশন করবেন না, বুদ্ধি করে কাজ করে ফেলবেন, এরপর টেনশন। চিন্তার কোনো কারণ নেই।’ আমি বললাম কীভাবে সম্ভব, এত দ্রুত কোত্থেকে রিপোর্টার আনব। তিনি তার চিরাচরিত শব্দহীন কঠিন অর্থবহ হাসিতে বাম গালে হাত দিয়ে বললেন, ‘আজই দেব, আবেদ ভাইয়ের (কালের কণ্ঠের তৎকালীন সম্পাদক আবেদ খান) সঙ্গে আলাপ করে নিই।’ কয়েক ঘণ্টা পর আমার রুমে এসে দেখা করল এডিটরিয়াল বিভাগের সিনিয়র সহসম্পাদক মেহেদী হাসান। ও বলল, ‘ভাই, আমাকে কূটনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে আপনার সেলে ট্রান্সফার করা হয়েছে। আজ থেকেই কাজ শুরু করতে চাই।’ আমি বললাম, ‘কখনো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়েছ?’ সে বলল, ‘না। তবে কোনো অসুবিধা হবে না ভাই।’ তারপর মেহেদীকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। দুর্দান্ত ও অসাধারণ সব রিপোর্ট করে অল্প সময়ে দেশের কূটনৈতিক রিপোর্টারদের শীর্ষ কয়েকজনের মধ্যে জায়গা করে নেয়।
অথচ তখন আমাদের কারও মাথায় আসেনি যে, মেহেদী একজন রিপোর্টার হবে, আবার কূটনৈতিক বিটের। কিন্তু অমিতদা ঠিকই টের পেয়েছিলেন। খুঁজে বের করেছিলেন ওর প্রতিভাকে। আজ মেহেদী তার বিটের একজন নামকরা সাংবাদিক।
শুধু মেহেদী নয়, এভাবেই অমিতদা অসংখ্য মেধাবী ও পরিশ্রমীদের খুঁজে বের করে সঠিক স্থানে বসিয়েছেন। তাদের অনেকেই এখন বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, অমিতদা প্রায় সময়ই বলতেন দৈনিক পত্রিকা হচ্ছে প্রতিদিনের যুদ্ধ। এখানে আলসেমির কোনো সুযোগ নেই। যার যার কাজের ব্যাপারে দিনভর ‘ধ্যান’ করতে হবে। সব বিষয়েই আপডেট থাকতে হবে। ছোট ছোট বাক্য, নির্ভুল বানান, আকর্ষণীয় সব হেডিং দিতে হবে। তাহলেই একটি পত্রিকা সহজেই পাঠকের মন জয় করতে পারবে। শেষের দিকে আরও বলতেন, এখন ডিজিটালের যুগ। সব খবর টিভি, নিউজপোর্টালে প্রতিমুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছে। তাই পত্রিকার পাতায় থাকতে হবে একেবারেই নতুন অর্থাৎ ব্রেকিং নিউজ। অথবা সারা দিনে যেসব নিউজ সৃষ্টি হয়, সেগুলোর নেপথ্যে যা আছে, তা তুলে আনতে হবে। আর এগুলো সুষ্ঠুভাবে কার্যকর করতে দরকার দক্ষ মানবসম্পদ। এ ক্ষেত্রে তিনি অগ্রাধিকার দিতেন মেধাবী ও পরিশ্রমীদের। তার ধারণা ছিলÑ অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী মানুষ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে, অন্যদিকে মেধাসম্পন্ন মানুষ অলসতার কারণে সেই লক্ষ্যে যেতে পারে না। আর দৈনিক পত্রিকায় অলস মানুষের কোনো জায়গা নেই।
পত্রিকার সব বিভাগেই নিয়োগের সময় সেরাদের নিয়ে টিম গঠনের চেষ্টা করতেন। তবে রিপোর্টিং ও ফটো বিভাগের ওপর বিশেষ নজর ছিল তার। অমিতদা একটি কথা প্রায় সময়ই বলতেন, ভালো বাজার না করলে, রাঁধুনি যতই ভালো হোক না কেন, রান্না ভালো হবে না। রিপোর্টার যদি ভালো রিপোর্ট না আনেন অথবা ফটোসাংবাদিক যদি ভালো ছবি তুলতে না পারেন, তাহলে পত্রিকার প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা কেমন করে সাজাব। এ দুই পৃষ্ঠায় আকর্ষণীয় সব নিউজ ও ছবি দিয়ে সাজাতে পারলে পাঠকের চোখ পত্রিকার ওপর পড়তে বাধ্য।
তিনি বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কাজ করেছেন। এর মধ্যে যায়যায়দিন, কালের কণ্ঠ ও দেশ রূপান্তর অন্যতম। পত্রিকাগুলোর টিম গঠনে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন দাদা। টিম করার সময় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেখেছি দাদার সাংবাদিক অন্বেষণের নানা প্রক্রিয়া। গভীর অনুসন্ধানের পর খুঁজে বের করতেন মেধাবী ও পরিশ্রমীদের। এ ক্ষেত্রে তিনি বেশ কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। প্রায় প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকাগুলো (বাংলা ও ইংরেজি) মনোযোগ দিয়ে স্ক্যান করতেন। বিভিন্ন পত্রিকার ভালো প্রতিবেদনের রিপোর্টারের নাম বাছাই করতেন। হয়তো ওই রিপোর্টারকে তিনি কোনো দিন দেখেননি। এমন একটি ঘটনা ঘটেছে ২০০৫ সালের শেষের দিকে। দাদা যায়যায়দিন পত্রিকার টিম করছিলেন। তখন আমি নিউএজে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি। ২০০৩ সালের শুরুর দিকে ভোরের কাগজ থেকে আমি নিউএজে যোগ দিই। তখন ভোরের কাগজের বার্তা সম্পাদক ছিলেন অমিতদা। সেই সূত্রে আমি তার বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলাম। নিউএজে কাজ করলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ সবসময়ই ছিল। একদিন আমাকে দৈনিক যায়যায়দিনে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। আমি রাজি হয়ে যাই। এরপর আমাকে কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহীদ এজাজ (বর্তমানে প্রথম আলোর কূটনৈতিক রিপোর্টার), বিজনেস রিপোর্টার আসজাদুল কিবরিয়া (বর্তমানে ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্ল্যানিং এডিটর, এনার্জি বিটের রিপোর্টার শামসুল আল আমীন শামীমকে (পেশা ছেড়ে ইউএসএইডির একটি প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি বললাম, কেন? তিনি বললেন, এদের যায়যায়দিনে আনতে চাই। ওরা অনেক ভালো রিপোর্ট করেন। আমি বললাম, ওরা তো ইংরেজি সাংবাদিকতা করেন। আবার আপনার সঙ্গে পরিচয়ও নেই। তিনি বললেন, তাতে কী, আপনিও তো ইংরেজি পত্রিকায় আছেন। আমার উত্তরÑ কিন্তু আপনার সঙ্গে তো আমার অনেক দিনের সম্পর্ক। তখন তিনি তার চিরাচরিত মুচকি হাসি না দিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে আমার উদ্দেশে বললেন, অনেক দিনের সম্পর্ক বিবেচনায় কিন্তু আপনাকে টিমে নেওয়া হয়নি। আপনার কাজের জন্যই নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, আমি তখন সচিবালয় বিটের একজন সক্রিয় রিপোর্টার হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেছি। যাই হোক, আমিসহ আমার ওই তিন সহকর্মী যায়যায়দিনে যোগ দিয়ে ফেললাম। শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালে কালের কণ্ঠের টিম করার সময় আমার নিউএজের আরেক সহকর্মী টিটুদত্ত গুপ্তকে (বর্তমানে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর উপসম্পাদক) অর্থনীতি সেলের চিফ হিসেবে নিয়োগ দিলেন। এখানে বলা দরকার, ওই সময় টিটু বিজনেস বিটের একজন দক্ষ রিপোর্টার হিসেবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। যাই হোক, তিনি রিপোর্টারদের সবসময়ই স্পটে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। বলতেন, ‘রিপোর্টারের পায়ে পায়ে লক্ষ্মী।’ অর্থাৎ এ কথা দিয়ে বোঝাতে চাইতেন যে, স্পটে উপস্থিত থাকলে অথবা যত বেশি সোর্সের কাছে যাওয়া যাবে, ততই সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার সমৃদ্ধ হবেন, প্রতিবেদনটি হবে জীবন্ত, পাওয়া যাবে টাটকা সব তথ্য-উপাত্ত। এ ক্ষেত্রে বারবার রিপোর্টারদের মনে করিয়ে দিতেন পরিশ্রমের বিকল্প নেই। নতুন রিপোর্টিং টিম গঠনের সময় এসব বিষয় বেশ ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে নিতেন তিনি।
অন্যদিকে ডেস্কের লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে অমিতদা যেসব বিষয় খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন, সেগুলো হচ্ছেÑ ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদে পারদর্শী কি না, বাংলা ভাষায় দক্ষতা এবং নিউজ ও কমন সেন্স। তিনি বলতেন, সম্পাদনা হচ্ছে একটি শিল্প। আর এসব গুণাবলি না থাকলে একটি রিপোর্ট সুপাঠ্য করে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। পাশাপাশি নিয়মিত ডেইলি পত্রিকার ফাইল পড়ার ওপরও জোর দিতেন। বিশেষ করে সমসাময়িক বিষয়ের ওপর আপডেট না থাকলে সম্পাদনা করার সময় তেমন কোনো ইনপুট দেওয়া যায় না অথবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশ্নও রিপোর্টারকে জিজ্ঞেস করা সম্ভব হয় না। অর্থাৎ রিপোর্টার যা লিখবেন, সেই লেখার ওপরই ব্যাকরণ অথবা বানান অথবা বাক্য ঠিক করেই ছেড়ে দিতে হবে। এতে কনটেন্ট সমৃদ্ধ হবে না। একজন রিপোর্টার নির্ভুল তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে একটি প্রতিবেদন দাঁড় করালে সেটি ঘষামাজা করে পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করার মূল দায়িত্ব হচ্ছে একজন সহসম্পাদকের।
অমিত দা আরও বলতেন, উল্লিখিত গুণাবলি কোনো সহসম্পাদকের থাকলে সে হেডিং, শোল্ডার, টিকার ও গ্রাফিকসের ব্যাপারেও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারেন সম্পাদক অথবা মেকআপ প্যানেলের সংশ্লিষ্টদের। এতে একটি প্রতিবেদন পাঠককে খুব সহজেই আকৃষ্ট করতে পারে। এখানেই নিউজ ডেস্ক সদস্যের মুনশিয়ানা।
একটি প্রতিবেদন তৈরির সময় বেশ গুরুত্ব দিতেন হেডিং এবং ইন্ট্রো বা সূচনার (সংবাদপত্রে পরিভাষা) ওপর। এখানে উল্লেখ করতে চাইÑ ভোরের কাগজ, যায়যায়দিন, সমকাল ও কালের কণ্ঠে প্রকাশিত আমার ৯৯ শতাংশ রিপোর্ট অমিতদা সম্পাদনা করেছেন। তিনি আমাকে পাশে বসিয়ে কাজ করতেন। খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তার সম্পাদনাসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম। কোনো কোনো সময় তিনি প্রতিবেদনে সরাসরি বিষয়ভিত্তিক হেডিং না করে ‘থার্ড অ্যাঙ্গেল’ থেকে করতেন। এতে পাঠক নতুনত্বের স্বাদ পান। এ প্রসঙ্গে আমার একটি স্টোরির হেডিং উল্লেখ না করে পারছি না। তখন সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছি। একেবারেই ছোট একটি নিউজ। প্রথম পৃষ্ঠায় সিঙ্গেল কলাম ছিল প্রাথমিক পরিকল্পনায়। কিন্তু মেকআপে বসে সারওয়ার ভাই (তৎকালীন সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার) হেডিং দেখেই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার ভাঁজের ওপরের দিকে বক্স আইটেম করে দিলেন। হেডিং ছিলÑ ‘দেড় মাসে তিন লাফ’। আমার বাই-লাইন স্টোরি ছিল। স্টোরির মূল বিষয় একজন সেলিব্রেটি আমলা সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি থেকে দেড় মাসে তিনটি পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হয়েছিলেন। যা বিধিসম্মত হয়নি। যদিও ওই আমলা আগে একাধিকবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছিলেন। কিন্তু পদোন্নতি পেতে ঊর্ধ্বতন পদগুলোতে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অবস্থান করতে হয়। সেটি অনুসরণ করা হয়নি।
আরেকটি ঘটনা না বললে আজকের এ লেখাটিই অপূর্ণ থেকে যাবে। কারণ আমি অমিতদাকে নিয়ে যার অনুরোধে লিখছি, তিনি হলেন দেশ রূপান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোস্তফা মামুন। তার বেশিরভাগ সময় কেটেছে ক্রীড়া সাংবাদিকতায়। স্পোর্টস রিপোর্টিংয়ে একজন ব্যতিক্রমী ও তারকা রিপোর্টার হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলেন। আমি নিজেও তার লেখার বেশ ভক্ত। তিনিও অমিতদার যায়যায়দিন ও কালের কণ্ঠের টিমের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। দুটিতেই তিনি স্পোর্টস এডিটরের দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে কালের কণ্ঠের উপসম্পাদক হয়েছিলেন। মামুনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন দাদা। আমাকে বলতেন, মামুনকে ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে হবে। আমি বললাম, স্পোর্টস থেকে? জি, ওর মধ্যে প্রতিভা আছে, আমি টের পেয়েছি। ঠিকই অমিতদা তাকে দেশ রূপান্তরের নির্বাহী সম্পাদক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। দাদার মৃত্যুর পর এখন তিনি ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। পত্রিকা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের সাংবাদিকতা জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে ক্রীড়াজগতে। অর্থাৎ মোস্তফা মামুনকে তিনি ঠিকই চিনেছিলেন, নিয়েছিলেন তার সর্বশেষ পত্রিকা টিম দেশ রূপান্তরে।
সবশেষে বলতে চাই, অমিতদা প্রায়োগিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। প্রথাগত সাংবাদিকতার গণ্ডি পেরিয়ে আধুনিক ও নতুন ধারার সংবাদ জগৎ সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। সাংবাদিকতার ভাষাকে আরও সহজবোধ্য করে পাঠকের মনোজগৎ বিস্তৃত করার প্রয়াস ছিল। তার সেই চিন্তা-চেতনা, মেধা ও জ্ঞান শুধু নিজের ভেতরে না রেখে সহকর্মীদের মধ্যে প্রোথিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। নিজের টিমের কেউ তার সেই আলোর স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হতেন না। সেই আলোতে আলোকিত হয়েই আজকের আধুনিক সাংবাদিকতার অনেক তারকার জন্ম। সেই আলোর পেছনের ‘বাতিঘর’ অমিতদা আজ অনেক দূরে থেকেও যেন তার বিকিরণ ছড়িয়ে যাচ্ছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়Ñ
‘প্রয়োজন আরও অনেক কিছুর জানি
আপাতত দেই শুধু এই ক’টি শব্দ।
এই নিয়ে হোক তোমাদের পথচলা
চলতে চলতে চেনা হোক পথখানি
জানা হোক গত পথের বিঘœগুলি।
তারপর যদি বিঘœ ডিঙাতে চাও
এসো মোর কাছে, আছে আরও আছে
তোমার হাতেই তুলে দেব বলে এত
লুকিয়ে রেখেছি ভালোবাসা চাপা দিয়ে
বুকের ভিতরে নির্ঘুম নিস্তব্ধ
স্বপ্ন আমার, সাধনা আমার যত।’
লেখক : উপসম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর
অমিত হাবিব, মানে আমাদের অমিতদা মারা গেছেন এক বছর হয়ে গেল। যেকোনো মানুষ মারা যাওয়ার পর ক্যালেন্ডার চলবে, সময় গড়াবে, স্বাভাবিক।
এই এক বছরে তার শূন্যতা প্রতিমুহূর্তে অনুভূত হয়েছে। যেকোনো মানুষ মারা গেলে, তার শূন্যতা কোথাও না কোথাও অনুভূত হবেই। সেটাও স্বাভাবিক।
সেই ধারায় মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণসভা-দোয়া ইত্যাদি হবে। কিন্তু আমাদের মনে হলো, নিয়মরক্ষার স্মরণসভায় অমিত হাবিবকে ঠিক ধরা যাবে না। এবং সাধারণ স্বজন হারানোর বেদনাজনিত আর্তিতেও তিনি ঠিক মানানসই নন। তিনি মানানসই এক জায়গাতেই। তার সাংবাদিকতার বহুস্তরবিশিষ্ট চিন্তায়। বহুমুখী বোধের বিন্যস্ততায়। আর তাই এই ম্যাগাজিনে প্রথাগত স্মৃতিচারণমূলক লেখার বদলে বিশ্লেষণ করা হয়েছে অমিত হাবিবের সাংবাদিক সত্তাকে। তার সংবাদ ভাবনাকে নানা স্তরে ভাগ করে প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিটাকে বোঝার-বোঝানোর চেষ্টা করেছি। আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, ম্যাগাজিনটার আকার আরও বাড়িয়ে, বিষয়বস্তু আরও বিস্তৃত করে একটা বই করার, যা সাংবাদিক-সাংবাদিকতার ছাত্র-গবেষকদের জন্য হতে পারে শিক্ষাসহায়ক।
এ লেখাগুলো লেখার জন্য আমরা তাদেরই দ্বারস্থ হয়েছি যারা বছরের পর বছর অমিত হাবিবের চিন্তার মুনশিয়ানা দেখেছেন, তাতে সমৃদ্ধ হয়েছেন। আশা করি, এ চেষ্টা অমিত হাবিবকে যেমন জীবন্ত রাখবে, তেমনি পেশাদার-বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রয়োজন বোঝাতেও সাহায্য হবে।
আমরা সব সময়ই বলেছি, অমিত হাবিব জীবনকে যেভাবে যাপন করেছেন, তাতে মৃত্যুশোকের চেয়ে জীবন উদযাপনই তার সঙ্গে মানানসই। ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রেও একই কথা। এটা তাকে নিয়ে দুঃখ করার খতিয়ান নয়, তার ছড়িয়ে যাওয়া আলোয় আলোকসজ্জার বয়ান।
তাই আজ একদিকে অমিতশূন্যতা। অন্যদিকে অমিত আলোকসজ্জা।
বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণ থেকে আমরা সবাই অমিতদাকে বিদায় বললাম। আসর জমিয়ে রাখা অমিত হাবিব সেই বাদল দিনে নিঃসাড় শুয়েছিলেন কফিনে। অনেক দূরের পথ, সেই মহেশপুরের পথে তাকে বহন করছিল লাশবাহী গাড়ি। এই শহরে বিয়াল্লিশ বছর আগে তিনি এসেছিলেন মহেশপুরের মায়া আর ছায়াঘেরা জীবন ছেড়ে। জীবন গড়বেন বলে। কিন্তু মৃত্যু জীবনের সঙ্গে বিয়োগ ঘটিয়ে দেয়। কখনো সাড়ম্বরে, কখনো অকস্মাৎ।
তখনো সম্পাদকের টেবিলে বসেছিলেন অমিত হাবিব। সেই বিকেলে কী ভাবছিলেন অমিতদা? লিড নিউজের হেডলাইন? নাকি কাগজের স্টক নিয়ে? পূর্ণ সম্পাদক হিসেবে যে কয় বছর অমিতদাকে পেয়েছি এই তো তার রোজকার ভাবনা। যদি বলি উদ্বেগ, সেটাও। পত্রিকার আপার ফোল্ড বা উপরি ভাঁজটা কেমন হবে? আমাকে প্রায়ই বলতেন, খোকন ব্যাক পেজেরও একটা ক্যারেক্টার দাঁড় করানো উচিত। অমিতদা চাইতেন, পত্রিকা বারো কিংবা ষোলো কিংবা কুড়ি যত পৃষ্ঠারই হোক প্রত্যেক পাতার আলাদা আলাদা চরিত্র থাকা চাই। সীমিত সামর্থ্যে সেটা আর কুলিয়ে ওঠা যায় না। সেই যে গার্ডিয়ানের বিখ্যাত সম্পাদক সিপি স্কট বলেছিলেন, সম্পাদকের নিউজ এথিক্স আর বিজনেস দুটোর ভারসাম্য রাখতে হয়। সচেতনভাবে না হলেও অবচেতনেও সম্পাদক এই কাজই করে যান। সিপি স্কটের সেই কথার শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে।
সংবাদপত্র শিল্প আয়ুষ্কালের শেষ সীমায় বলা যায়। এ যুগে সম্পাদকের গড় আয়ু কম হওয়ার কথা। অমিত হাবিব পেলেন তারও কম। পূর্ণ সম্পাদক হিসেবে মাত্র সাড়ে চার বছর। আরও বেশি সময় তিনি ডিজার্ভ করতেন। প্রতীকী অর্থে লিখলাম। কিন্তু বাস্তবে অমিতদা ষাটও পুরো করতে পারলেন না। আটান্নর ক্যামিওতেই সাজঘরে ডাক। ক্রিকেট তার প্রিয় স্পোর্টস। প্রায় সময় ক্রিকেটের ভাষায় রসিকতা করতেন। হতাশা প্রকাশেও ক্রিকেটের আশ্রয় চাইতেন। ধরুন, তেত্রিশে যে যুবক দেশের সবচেয়ে অভিজাত দৈনিকের জাঁদরেল বার্তা সম্পাদক তাকে সম্পাদক হতে অপেক্ষা করতে হলো আরও কুড়ি বছর! মাঝখানে অন্তত তিন-চারবার নানা নামে সম্পাদকের প্রক্সি দিয়েছেন। এতগুলো আলোচিত সংবাদপত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে থেকে ষাট পুরোবার আগেই জীবনের ময়দান ছেড়ে দেওয়া তো ক্যামিও-ই। আর কী নামে তার জীবন বলেন বা ক্যারিয়ার বলেন তাকে বিবৃত করব!
জীবনে-যাপনেও প্রচলিত শৃঙ্খলার পথে হাঁটেননি তিনি। আনএক্সামিনড লাইফ সৃষ্টিশীল মানুষের সঙ্গে খুব যে খাপ খায় তা আমরা দেখি না। অমিত হাবিব কবিতা লেখা ছাড়লেও কবিমন তো তাকে ছেড়ে যায়নি। পাখির মন না হলেও চনমনে কবিমন। শেষবার যখন তার সঙ্গে গল্প করতে গেছি বললেন, আড্ডা দিয়ে মজা পাচ্ছি না। দেশ রূপান্তর অফিসের একই ভবনে অফিস নিতে বলে বললেন, এখানে চলে আসেন। সামনের স্পেসটা খালি আছে। অমিতদার আড্ডাপ্রীতি, জীবনতৃষ্ণার কথাই শুধু বলছি। সাংবাদিক অমিত হাবিব কেমন ছিলেন সেটা বরং পাঠকের জানা দরকার বেশি।
১৯৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থা থেকে ঘটনাচক্রে তার সঙ্গে একই বার্তাকক্ষে কাজ করার সুযোগ আসে আমার। বাংলা মোটরের পুরনো ভোরের কাগজ অফিসে। তীক্ষè যুক্তি, প্রমিত বাংলায় বাক্যবাণে প্রায় অসম্ভব তর্কেও তিনি বিজয়ীর হাসি হাসতেন। তার ব্যক্তিত্বের সেই ছায়া কাগজে দেখা যেত। সেকালে বার্তা সম্পাদক পদটি সংবাদপত্রে ডি ফ্যাক্টো সম্পাদকের মতো ছিল। সহজ করে বললে বলতে হবে, পত্রিকার কনটেন্ট, খবর বিন্যাস ও অঙ্গসজ্জায় সম্পাদকের টোন থাকলেও ছায়া থাকত বার্তা সম্পাদকের। বার্তা সম্পাদকই পত্রিকা পরিকল্পনা ও তা এক্সিকিউট করতেন। এখনকার মতো মিনিটে মিনিটে ঘটনার আপডেট বা কানেকটিভিটি সেসময় কল্পনাই করা যেত কেবল। ডেস্কটপ পাবলিকেশনও তখন আসেনি। আমরা লিখতাম নিউজপ্রিন্টের প্যাডে। তো রিপোর্টার বা সাব-এডিটররা শত পাতার ছোট নিউজপ্রিন্ট প্যাডও প্রায় সময় ভরে ফেলতেন। অনেক রিপোর্টার দীর্ঘ প্রতিবেদন লিখে এনে বার্তা সম্পাদক বা নিউজ এডিটরের টেবিলে রেখেই ছুট। অমিতদাকে দেখতাম, বলছেন... ইয়ে বসেন। তখন নিউজরুমে এসিও ছিল না। নেন, সিগারেট নেন। তারপর দুহাতে নিউজপ্রিন্ট প্যাডে লেখা নিউজ তুলে ওজন করার ভঙ্গি করতেন। নাহ, অর্ধেক কমিয়ে নিয়ে আসেন। রিপোর্টার হয়তো অনেক কিছু বাদ দিয়ে নিয়ে এলেন। আবার সেই মাপের ভঙ্গি। আরও অর্ধেক কমাতে হবে যে! পৃষ্ঠা সংখ্যা চার ভাগের একভাগে নেমে এলে উনি হয়তো নিজে দেখলেন না হলে পাশে বসা জয়েন্ট নিউজ এডিটর কিংবা অন্য কাউকে বললেন দেখে দিতে। জটিল নিউজ এলে বেশির ভাগ সময় নিজেই লাল কালিতে ছাইরঙা নিউজপ্রিন্ট রাঙিয়ে দিতেন। রিরাইট করতেন অনেক। বহু রিপোর্টারের পুরো রিপোর্ট নতুন করে নিজেই লিখতেন। নিউজ লেখার ক্ষেত্রে একটিভ ভয়েসে লেখাটাই গ্রামাটিক্যালি প্রেফার করা হয়। বাংলায় এই কাজটি করা একটু কঠিন। অমিতদার ভাষার মধ্যে ডিরেক্ট স্পিচ থাকত। সাংবাদিক গদ্যের গতিময়তা ছিল। নির্মেদ, বাহুল্যবিহীন ও বিশেষণবিহীন। এই নিয়ম সংবাদ লেখার আবশ্যকীয় শর্ত হলেও বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতার অতীতকালে এসব অনুপস্থিত ছিল। নব্বইয়ের দশকে আজকের কাগজ প্রকাশের মাধ্যমে সাংবাদিকতায় যে নতুন ঢেউ বা ওয়েভের সৃষ্টি হয় বাংলায় এই ভাষাভঙ্গি প্রচলনও হয় তখন। অমিতদা এই সাংবাদিক ভাষাভঙ্গির সূচনাকারীদের একজন।
সাংবাদিকতায় গসিপ ছিল। জল্পনা ছিল। স্ট্রেইট জ্যাকেট নিউজ লেখার চেয়ে অলংকারবহুল খবর লেখা হতো। আজকের কাগজ তাতেও একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে বলে আমার ধারণা। সাংবাদিক হিসেবে ডিফাইন করতে হলে অমিত হাবিবকে বাংলা সাংবাদিকতার বাঁক বদলের অন্যতম নায়ক বলে মানতে হবে। এই ক্ষেত্রে আমার যুক্তি হচ্ছে, যে পত্রিকাটিতে এই নতুন ওয়েবটি পরিপূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়েছিল সেই পত্রিকাটির বার্তা সম্পাদক ছিলেন তিনি। এ বিষয়ে অথেনটিক কোনো গবেষণা আমার বক্তব্যকে সমর্থন করছে কিনা আমি জানি না। সহজবোধ্য ও সাবলীল ভাষায় খবর লেখার দক্ষতা যেমন অমিতদাকে এগিয়ে রেখেছিল তেমনি তার শিরোনাম বা হেডলাইন লেখার দক্ষতা ও সৃষ্টিশীলতার খবর সাংবাদিক সমাজে সুবিদিত ছিল। এখানে একটি ছোট্ট ঘটনার কথা বলে রাখি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম মেয়াদের সরকারের সময় তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের শাশুড়ির মৃতদেহ পাওয়া যায় তাদের ঢাকার বাসায়। মৃত্যু অপঘাতে। গুলিবিদ্ধ লাশ। পুলিশ নিশ্চিত নয়, হত্যা না আত্মহত্যা। তারা অতি সতর্ক। এদিকে পত্রিকা তো ছাড়তে হবে। খবরও দিতে হবে। সত্যের প্রতিও অনুগত থাকতে হবে। কে জানি অমিতদাকে ফোন করলেন, অমিত কী হেডলাইন করবা? আমি তো বুঝতে পারছি না। এপ্রান্ত থেকে অমিতদাকে বলতে শুনলাম, লিখে দেন পুতুলের শাশুড়ির গুলিবিদ্ধ লাশ। অমিতদা নিজে কিন্তু তখনো শিরোনাম করেননি। হেডলাইন করার ক্ষেত্রে তার মুন্সিয়ানার সুনাম শহরজুড়েই ছিল। তখন আমি অমিতদার সঙ্গে কাজ করি না। সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ মারা গেছেন। তিনি তখন কালের কণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক। হেডলাইনে চোখ আটকাল, অনন্ত নির্জনতায় মার্কেজ। আমি দেখেই ভাবলাম, এই হেডলাইন অমিতদারই হবে। খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হলাম। সর্বশেষ দেশ রূপান্তরে কাজ করার সময়ও দেখেছি হেডলাইন খুঁজতেন তিনি। যুৎসই হেডলাইন না হলে ঘুরে ঘুরে আসতেন গ্রাফিক্স রুমে। সাংবাদিক হিসেবে দক্ষতার পাশাপাশি সংগঠক হিসেবে তিনি ছিলেন রীতিমতো ক্যারিশম্যাটিক। পত্রিকার বড় বড় প্রজেক্ট করেছেন। সেখানে জড়ো করতেন সেরা সাংবাদিকদের। দৈনিক যায়যায়দিন করার সময়টায় আমি অমিতদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। দরকারি লোকটিকে পেতে মাঝরাতে তার বাসায় উপস্থিত হয়ে তার স্ত্রীকে কনভিন্স করার কত উদাহরণ যে আছে! কেউ আসতে রাজি না থাকলে কি কৌশলে তার ইচ্ছাকে প্রভাবিত করা যায় তার সম্ভাব্য সব অপশন ভেবে রাখতেন তিনি।
ছোট ছোট বাক্যে অমিতদাকে ধরার এই চেষ্টায় পরিপূর্ণ মানুষটিকে আঁকা একদম অসম্ভব। তার সাংবাদিক জীবনের কিছু দিক বলার চেষ্টা করার পর মনে হলো আসল কথাটাই বলিনি। যেই গুণটি আজকের সাংবাদিকতায় রীতিমতো বিরল। আজকাল শুনেছি অনেক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তাদের মিডিয়ায় সম্পাদক নিয়োগ দেন পাবলিক রিলেশন্স দেখার জন্য। বলা বাহুল্য, অমিতদাকে এ রকম দাওয়াত খাওয়ার সাংবাদিকতা করতে দেখিনি। দীর্ঘ সময় ধরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেও তিনি সরকারি প্লটের জন্য ধরনা দেননি। ক্ষমতাবানদের এড়িয়ে চলেছেন, পাছে আবার অনেক বেশি অনুরোধ রক্ষার আব্দার আসতে পারে ভেবে!
অমিতদা তর্ক করতে পছন্দ করতেন খুব। কিন্তু টকশোতে যেতেন না। ফেসবুকে থাকতেন সবসময়, কিন্তু একটিভ থাকতেন না। আমি বলতাম, শোতে তো যেতে পারেন। টুকটাক লিখতেও তো পারেন। তিনি বলতেন, আমি ওল্ড স্কুলের। আমার যা বলার পত্রিকার মাধ্যমেই তো বলার সুযোগ আছে। কিন্তু পত্রিকাতেও স্বনামে লিখতেন না কিছুই। তিনি পুরনো কথাটি মনে রাখতেন, সম্পাদকের স্বর শোনা যাবে কিন্তু তাকে দেখা যাবে না। সেই সম্পাদকের স্বর স্তব্ধ হয়ে গেছে এক বছর আগে! স্মৃতিতে দেখা যায় অনেক।
লেখক : দেশ রূপান্তরের সাবেক যুগ্না সম্পাদক
নামে কী-বা আসে যায়! বহুল প্রচলিত কথা। কিন্তু নামেই আসে যায়। আর তা যদি হয় শিরোনাম, তাহলে তো কথাই নেই। সংবাদপত্রের শিরোনামই পাঠককে টানে। সংবাদের গভীরে নিয়ে যায়। আর শিরোনাম না টানলে যত তির্যক সংবাদই হোক না কেন, তা পাঠক পড়ে না। তাই সংবাদপত্রে শিরোনামের এত কদর।
সংবাদপত্রে দুভাবে শিরোনাম হয়। একটি হচ্ছে সাজেস্টিভ হেডিং বা শিরোনাম। যা আসে রিপোর্টারের কাছ থেকে। বাকিটা হলো ডেস্ক থেকে দেওয়া শিরোনাম। ডেস্কের দেওয়া শিরোনামই বেশি হয়। কারণ রিপোর্টার সারা দিন ঘটনার মধ্যে থাকেন। তাদের দেখাটা অনেক সময়ই একপেশে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর যারা ডেস্কে বসে সবকিছু মাথায় নেন, তাদের শিরোনাম হয় সামগ্রিক।
ছাতার নিচে বসে রিপোর্টাররা দেখেন আর ছাতার ওপরে বসে ডেস্কের সহসম্পাদকরা দেখেন। ছাতার ওপর থেকে পুরো ঘটনাটি সহজেই বোঝা যায়। ছাতার নিচ থেকে একাংশ দেখা যায়। তাই সহসম্পাদকদের শিরোনামই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়।
অমিত হাবিব ছিলেন ছাতার ওপরে বসে থাকা সাংবাদিক। একাংশ দেখতেন না, তিনি শিরোনামে তুলে আনতেন পুরো ঘটনা। রিপোর্টাররা ঘটনাস্থলে ঘুরে বেড়ান। যারা ঘটনা ঘটান তাদের সঙ্গে ওঠাবসা তাদের। কিন্তু সম্পাদনা বিভাগের সাংবাদিকরা থাকেন আড়ালে। এসব আড়ালে থাকা সাংবাদিকদের মধ্যে অমিত হাবিব ছিলেন আরও বেশি আড়ালের। আড়ালে থেকেও তিনি শিরোনাম করায় ছিলেন সামনের সারির। ঘটনার আবেগে ভেসে যেতেন না। নিখুঁতভাবে সংবাদের গুরুত্ব বিচার করে ঘটনার জুতসই শিরোনাম করতে পারতেন অবলীলায়। শিরোনাম করতে কসরত করতে দেখা যেত না তাকে। সংবাদের যে অংশটা পাঠক সব থেকে বেশি পড়ে, সেটা হচ্ছে শিরোনাম। তাই শিরোনাম যথাযথ করতে তাগাদা বোধ করতেন তিনি।
ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। এটি একটি নীতিকথামূলক প্রবাদ। এর অর্থ হচ্ছে সত্য কখনো গোপন থাকে না। সাময়িকভাবে ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পারলেও তা একসময় না একসময় প্রকাশ হয়ই। এ প্রবাদটি আশ্রয় করে অমিত হাবিব শিরোনাম করেছিলেন ‘সুবিধার কল একদিকে নড়ে’।
সরকারি চাকরিতে কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের মধ্যে অনেক বৈষম্য। বেতনে বৈষম্য তো আছেই। এর বাইরে ভাতায়, যানবাহনে সোজা কথায় দৈনন্দিন সুবিধা প্রাপ্তিতে ব্যাপক বৈষম্য আছে। এ নিয়ে সরকারি কর্মচারীরা মন্ত্রিপরিষদ সচিব, অর্থ সচিবের কাছে চিঠি লিখে সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন। সমাধান না পেয়ে কর্মচারীরা চরম হতাশ হয়ে পড়েন। এসব সচিব বিষয়টি নিয়ে কাজ করেননি। তারা বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। এসব বৈষম্য নিয়ে একটা রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর অমিত হাবিব শিরোনাম করেছিলেন ‘সুবিধার কল একদিকে নড়ে’। গ্রামীণ নীতিকথামূলক প্রবাদ আশ্রয় করে তিনি শিরোনাম করেছিলেন। অর্থবোধক এ শিরোনামটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।
দৈনিক সংবাদপত্র সাজাতে হয় গুরুত্ব অনুযায়ী। দিনে একাধিক বড় ঘটনা থাকলে নিখুঁতভাবে বিচার করতে হয়। বড় ঘটনাটি লিড হয়। তারপর গুরুত্ব অনুযায়ী প্রথম পাতায় সেকেন্ড লিড, থার্ড লিড বসে। অনেক সময় বড় ঘটনা থাকলেও বিশেষ নিউজ দিয়ে লিড করা হয়। কিন্তু সেই বিশেষ নিউজটি আক্ষরিক অর্থেই ভালো নিউজ হতে হয়। যখন নিউজ ম্যানেজার নিশ্চিত হন বিশেষ নিউজটিও পরদিন অলোড়ন তুলবে, তখন তারা বিশেষ নিউজটিই লিড করেন। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। আর সেটি যদি হয় নিমতলীর মতো ভয়ংকর অগ্নিকা-ের দিনে তাহলে লিড বসানোর কাজটি বেশ জটিল হয়ে পড়ে।
২০১০ সালের ২ জুন কালের কণ্ঠে লিড হয়েছিল ‘বিরল ভালোবাসা’ শিরোনামের একটি নিউজ। আগের দিন অর্থাৎ ১ জুন বন্ধ করে দেওয়া হয় ওই সময়ের জনপ্রিয় দৈনিক আমার দেশ। একই দিনে ঢাকার বেগুনবাড়ীতে পাঁচতলা বাড়ি ধসে পড়ার নিউজ ছিল। যার শিরোনাম ছিল ৩ লাশ আটকা পড়েছে শতাধিক। ১ জুন রাতে যখন লিডের জায়গায় ‘বিরল ভালোবাসা’ বসানো হয়, তখনই ভবন ধসের খবর পাওয়া যায়। সে রাতেই মৃত্যুর সংখ্যা ডাবল ডিজিটে পৌঁছায়। প্রথম সংস্করণে লিড করলেও অনেক সময় তা দ্বিতীয় সংস্করণে বদলে ফেলা হয়।
এ অবস্থায় কী করবেন অমিত হাবিব? ওই সময়ে তিনি ছিলেন কাগজটির নির্বাহী সম্পাদক। পদটি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ হলেও তার ভূমিকা ছিল এক নম্বরের, অর্থাৎ সম্পাদকের। ওই পদে থেকেও তিনি নিজে পত্রিকার পাতা সাজাতেন। নিউজ এডিটর, জয়েন্ট নিউজ এডিটর, শিফট ইনচার্জসহ যারা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তারা একেকজন একেক পরামর্শ দিতে লাগলেন। বিরল ভালোবাসার রিপোর্টারও অপেক্ষা করছেন নিজের লিড নিউজের ভাগ্য দেখতে। ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।
একই দিনে মুসা ইব্রাহীমের এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছানোর খবরও নিউজরুমে আসে। সেটিও গণমাধ্যমের জন্য বড় খবর ছিল।
শেষ পর্যন্ত বিরল ভালোবাসাটাই লিড রাখা হয়।
এ নিয়ে একটা ব্যাখ্যা অমিত হাবিব সহকর্মীদের দিয়েছিলেন। বিরল ভালোবাসা দুই মাস পরিশ্রম করে করা একটা নিউজ। প্রথম সংস্করণে ছাপা হওয়ায় নিউজটা তুলে ফেলা সম্ভব নয়। আর সেকেন্ড লিড করা হলে নিউজটার ওজন কমে যাবে। তাই বিরল ভালোবাসা লিডই থাকছে। তবে বেগুনবাড়ীর ভবন ধসের খবরও গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হবে বলে তিনি সহকর্মীদের আশ্বস্ত করেন।
পরদিন সব কাগজে ভবন ধস লিড নিউজ। একমাত্র ব্যতিক্রম কালের কণ্ঠ। ভবন ধসে পাঠক সমবেদনা জানিয়েছেন। আর বিরল ভালোবাসার নিউজ পড়ে পাঠক ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। বিরল ভালোবাসায় জুটেছে অনেক পুরস্কার, অনেক সম্মান।
অমিত হাবিব সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারঙ্গম ছিলেন। তিনি সেদিন ভবন ধসের নিউজ লিড করলে বিরল ভালোবাসা পাঠকের হৃদয়ে সাড়া ফেলত না।
ঘটনার প্রথম দিন ভবন ধস লিড না করা হলেও পরদিন থেকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেদিন থেকে বেগুনবাড়ীসংক্রান্ত নিউজে কালের কণ্ঠ ছিল শীর্ষে। অনেক মানবিক সংবাদ করে, অনুসন্ধানী নিউজ করে পাঠকের ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
ডেস্ক থেকে বিরল ভালোবাসা নিউজের শিরোনাম করা হয় ‘এতিম’ শেখ হাসিনার জন্য একখ- জমি কিনে গেছেন গফরগাঁওয়ের হাসমত আলী। কাগজের প্রথম সংস্করণ ছাড়ার আগমুহূর্তে অমিত হাবিব শিরোনাম বদলে দেন বিরল ভালোবাসা। ডেস্কের করা শিরোনাম তিনি রেখেছিলেন উপ-শিরোনাম হিসেবে।
যেকোনো দেশে অন্য দেশের দূতাবাস মানেই হচ্ছে তা সার্বভৌম। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ধনী এ দেশটিতে প্রচুর নারীশ্রমিক কাজ করতে যান। বাংলাদেশি নারীদের সে দেশে পাঠানোর সময়ই সরকারের এ সিদ্ধান্ত বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। যাই হোক, দেশটিতে বাংলাদেশি নারীরা কোনো বিপদে পড়লে দূতাবাসের শেল্টার হোমে আশ্রয় নেন। সেই শেল্টার হোমের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে যাওয়া নারীদের ধর্ষণ করেন। এ ধরনের একটি রিপোর্ট আইডিয়া জানার পর থেকেই অমিত হাবিব তাগাদা দিতে থাকেন। প্রতিদিন তথ্য সংগ্রহের অগ্রগতি জানতে চাইতেন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত সব তথ্য হাতে আসার পর অমিত হাবিব জানতে পারেন। তাগাদা দেন সেদিনই লিখে দেওয়ার।
যেকোনো ভালো রিপোর্ট পেলেই তিনি উত্তেজনা অনুভব করতেন। রিপোর্ট তার হাতে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি থামতেন না। এ রিপোর্টের বেলায়ও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। সন্ধ্যার দিকে রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর দীর্ঘ সময় নিয়ে তিনি নিজেই সম্পাদনা করেছিলেন। ওই সময় তিনি চোখের সমস্যায় ভুগছিলেন। সাধারণত ১৪ পয়েন্টে প্রিন্ট করা হলেও সম্পাদকের জন্য নিউজটি ১৬ পয়েন্টে প্রিন্ট করে দেওয়া হয়। তারপরও চোখে সমস্যা হচ্ছিল। ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে পড়ার চেষ্টা করলেন। সুবিধা করতে না পারায় আরও বড় পয়েন্টে প্রিন্ট দেওয়া হয়।
রিপোর্টারের তরফ থেকে সাজেস্টিভ হেডিং ছিল রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসে গৃহকর্মী ধর্ষণ। এডিট করার পর অমিত হাবিব রিপোর্টারকে ডেকে বললেন, ‘ধর্ষণের নিউজ কাগজে লিড করি কীভাবে?’
এতদিন যে নিউজ নিয়ে চরম উত্তেজনা দেখিয়েছেন, সেই নিউজ নিয়ে সম্পাদককে এভাবে কথা বলতে দেখে বিমর্ষ হয়ে পড়লেন রিপোর্টার। তার অবস্থা টের পেয়ে তিনি শুধু বললেন, ‘একটা হেডিং বের করেন তো দেখি। আপনার সাজেস্টিভ হেডিং দিয়ে ঘটনার ব্যাপকতা প্রকাশ পাচ্ছে না।’ হেডিং নিয়ে ভাবতে বলে তিনি নিজেও হেডিংয়ের চিন্তায় ডুবে গেলেন।
রাত ১১টায় ফার্স্ট এডিশন ছাড়ার পূর্বপর্যন্ত তিনি অস্থিরভাবে পায়চারি করলেন। শেষমুহূর্তে হেডিং করলেন ‘পবিত্র ভূমিতে পাপাচার’।
সৌদি আরব এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে পূণ্যভূমি। সেই আবেগ আশ্রয় করে তিনি শিরোনামটি করেছিলেন। এটিও তার অনন্য শিরোনামের একটি।
রিপোর্টার রিপোর্টের মূলকপি যেভাবে তৈরি করতেন, অমিত হাবিব তা আরও উন্নত করার চেষ্টা করতেন। অনেক সাব-এডিটর অপরিহার্য অংশ কেটেছেঁটে সংবাদমূল্য নষ্ট করে ফেলেন। যদিও এ নষ্ট করা কখনই ইচ্ছাকৃতভাবে করেন না। অমিত হাবিব নিউজের ফাঁকফোকর খুব ভালোভাবে ধরতে পারতেন। তার কলম সেই ফোকরে চলে যেত অবলীলায়।
কিছু পাঠকের অভ্যাসই শুধু শিরোনাম পড়া। মাঝেমধ্যে এমন হয়, শিরোনামে আকৃষ্ট হয়েই তারা পুরো সংবাদ পড়েন। পাঠকের মনকে প্রভাবিত করে শিরোনাম। পুরো সংবাদপত্রের ভাবমূর্তি সৃষ্টি করে সংবাদের এ অংশটি। যে শিরোনামে পর্যাপ্ত তথ্য থাকে না, স্পষ্ট হয় না, সেগুলো পাঠকের মনোযোগও কাড়ে না। এমনই একটি হেডিং ছিল ‘দেড় মাসে তিন লাফ’।
অমিত হাবিব সমকালে উপসম্পাদক ছিলেন। সেই সময় রিপোর্টারের সাজেস্টিভ হেডিং বাদ দিয়ে তিনি হেডিং করেছিলেন ‘দেড় মাসে তিন লাফ’। নিউজটি একজন সেলিব্রেটি আমলাকে নিয়ে। অমিত হাবিব বুঝতে পেরেছিলেন পরদিন নিউজটি নিয়ে তোলপাড় হবে। ভালো হেডিং করেও তিনি ভালো ট্রিটমেন্ট দেননি। এর একটি কারণ ছিল, ওই আমলা এত বেশি প্রভাবশালী ছিলেন যে, তিনি কাগজের বিনিয়োগকারীকে ফোন দিতে পারেন। এ কারণে তিনি বেশি কাভারেজ দেননি।
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। ভালো শিরোনামের ছোট্ট নিউজটি নিয়ে প্রশাসনে তোলপাড় হয়। সম্পাদককে বিনিয়োগকারী ফোন দেন। তার আগে বিনিয়োগকারী ফোন পেয়েছেন সেই প্রভাবশালী আমলার। নিউজের প্রতিবাদ ছাপলেই চলবে না। রিপোর্টারকে এমন নিউজ করতে হবে যাতে করে তার ক্ষতি পোষানো যায়।
উল্টো নিউজ করা সহজ কাজ নয়। করব করছি করে সময় পার করছিলেন রিপোর্টার। এর মধ্যেই ওই আমলার আরও বড় ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি দেড় মাসে তিন লাফ দিয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব হয়েছিলেন। একটা পদ থেকে পরের পদে পদোন্নতি পেতে হলে কয়েক বছরের নির্ধারিত সময় পার করতে হয়। সেসব উপেক্ষা করে অতিরিক্ত সচিব করা হয়েছে। দেড় মাসে তিন লাফ নিউজ করার পর ওই সেলিব্রেটি আমলার বন্ধুরা সচিব হয়ে যান। সেলিব্রেটি আমলাকে ডেকে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয় ‘তোমাকে নিয়ে মিডিয়ায় নিউজ হয়েছে। আপাতত তোমার বিষয়টি থাক। পরে দেখা যাবে।’
সেই সেলিব্রেটি আমলার দুঃখ দেখে কে। সে কপাল চাপড়ে বলেছিল, নিউজের ভেতরের তথ্য যতটা না ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে হেডিং। এ হেডিং আমার সব শেষ করে দিল।
শিরোনাম করা খুব চৌকস কাজ। খুব অল্প জায়গায় ক্ষুদ্র পরিসরে শিরোনাম লেখা হলেও সংবাদের পুরো প্রতিফলন ঘটাতে হয় শিরোনামে। শিরোনাম অর্থবোধক হতে হয় এবং বোঝার ক্ষেত্রে কোনো অসম্পূর্ণতা থাকতে পারবে না। দেড় মাসে তিন লাফ ছিল সেই ধরনের এক হেডিং।
পদোন্নতি হলে আজও প্রশাসনে বলা হয় দেখি দেড় মাসে তিন লাফ দিল কে?
অমিত হাবিবের ভাষার ভা-ার সমৃদ্ধ ছিল। ভাষাকে সংক্ষিপ্ত করে ভাবের ইঙ্গিতময় প্রকাশ ঘটিয়ে কঠিন বক্তব্যকে রসময় করে শিরোনাম করতেন। শিরোনামে উপমা ব্যবহার করতেন, যার আড়ালে একটা অর্থ থাকত। শিরোনামে ভাষার বৈচিত্র্য প্রকাশ পেত। শিরোনামে তিনি বাগধারা ব্যবহার করতেন। শিরোনামে সংখ্যা ব্যবহার করতেন। এতে বেশি মানুষ আকৃষ্ট হয়। ব্যস্ত দুনিয়ায় পাঠক পড়ার আগে চিন্তা করেন লেখাটা তার কোনো কাজে লাগবে কি না। অল্প সময়ে লেখাটা থেকে তিনি কিছু জানতে পারবেন কি না। যদি পাঠক বুঝতে পারেন তাহলে তিনি লেখার ভেতরে যান। এ ভাবনা থেকে অমিত হাবিব শিরোনামে সংখ্যা ব্যবহার করতেন। কালের কণ্ঠের উদ্বোধনী সংখ্যা থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রমাণ মেলে।
সাধারণত তিনি প্রশ্নবোধক শিরোনাম এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু যে প্রশ্নের কাক্সিক্ষত উত্তর তিনি পাঠককে দিয়ে বলিয়ে নিতে পারবেন, সেখানেই প্রশ্নবোধক ব্যবহার করতেন।
শিরোনামেও আছে আগে দর্শনধারী, পরে গুণ বিচারির গল্প। শিরোনামে অনেক শব্দ ব্যবহার করলে তা দেখতে ভালো হয় না। অল্প কথার শিরোনাম যেমন দেখতে ভালো হয়, তেমন পাঠককেও আকৃষ্ট করে। অমিত হাবিবও তাই করতেন। তিনি কখনো ডায়েরি ব্যবহার করতেন না। নিউজের আইডিয়া তার মাথায় গেঁথে যেত। রিপোর্টারের কাছ থেকে যখন শুনতেন, তখনই শিরোনাম ঠিক করে ফেলতেন।
অমিত হাবিবের অনুসন্ধানী মনোভাব অনেক পোক্ত ছিল। আর্থিক বিষয়ের চেয়েও জোরালো ছিল তার দেশাত্মবোধের আবেগ।
সাংবাদিকতার নিরপেক্ষতা প্রধানত রাজনৈতিক মানদন্ডে বিচার করা হয়। কিন্তু অমিত হাবিব রাজনীতির বাইরে গিয়েও তার নিরপেক্ষতা প্রমাণ করেছেন। নিউজের সব বিষয়কে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে সংবাদপত্রের পাতা সাজাতেন। নিপুণভাবে এ কাজ করতে গিয়েই তাকে তথ্যে বিচিত্রগামী হতে হয়েছে। নিজে একসময় লিখেছেন টেলিভিশন সমালোচনা। সেখান থেকে স্পোর্টসেও বিচরণ ছিল। ব্যাপক পাঠাভ্যাস ছিল। অনুরাগী ছিলেন রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির। এ অনুরাগই তাকে ভালো শিরোনাম করার প্রেরণা জুগিয়েছে।
বার্ট্রান্ড রাসেলের একটা মজার গল্প আছে সংবাদমাধ্যমে।
গল্পটা এরকম : একপাল হাতি সুশৃঙ্খলভাবে হেঁটে চলেছে এক প্রত্যন্ত জঙ্গলে। হঠাৎ মাথার ওপরে প্রবল শব্দ করে একটি উড়োজাহাজ উড়তে থাকে। এর আগে হাতির দল কখনই উড়োজাহাজ দেখেনি। হাতির দল ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। এমনিতে হাতিরা খুব শান্তিপ্রিয় এবং দল বেঁধে যাতায়াত করে। এরকম এক অচেনা দৈত্য দেখে হাতিদের মধ্যে প্রায় দাঙ্গা বেঁধে যাওয়ার জোগাড়। তবে তা ছিল মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার। মুহূর্তেই উড়োজাহাজটি মেঘের মধ্যে মিলিয়ে যায়। শব্দও নাই হয়ে যায়। হাতিরা আবার সারি বেঁধে নিঃশব্দে নীরবে সেই মাঠের মধ্য দিয়ে নিজেদের মতো হাঁটতে লাগল।
রাসেল এ লেখাটা লিখে প্রশ্ন করেছেন বলতে পারেন, কেন এমন একটা ঘটনা এত সহজে নিয়ন্ত্রণে চলে এলো? কোনো গোলমাল বাধল না? এর জবাবটাও রাসেল নিজেই দিয়েছেন, ওই হাতির পালের মধ্যে কোনো সাংবাদিক হাতি ছিল না!
সাংবাদিকরা হরদম তিলকে তাল করেন।
অমিত হাবিব তিলকে তাল করতেন না।
লেখক: চিফ রিপোর্টার, দেশ রূপান্তর।
প্রায়োগিক সাংবাদিকতার সঙ্গে তাত্ত্বিক পঠন-পাঠনের কিছু ফারাক অনেক ক্ষেত্রে থেকেই যায়। হয়তো সে কারণে সংবাদকক্ষের সাধারণ দৃশ্য সংবাদের কাভারেজ ট্রিটমেন্ট নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা, কখনো কখনো বিতর্ক। অবশ্য কোনো কোনো সংবাদ গল্পের ক্ষেত্রে এসবের কিছুই নাও হতে পারে। অমিত হাবিব, আমাদের অমিতদা, আমরা যারা তার সঙ্গে কাজ করেছি, বুঝতে পেরেছিলাম প্রায়োগিক সাংবাদিকতার একটি মানদণ্ড তিনি গড়ে তুলেছেন। দীর্ঘদিন বার্তাকক্ষে কাটিয়ে দেওয়া মানুষটি স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজতেন সংবাদ গল্পের মধ্যে। প্রখর সংবাদচেতনা আর অসাধারণ সংবাদবোধের নিপুণ প্রয়োগ তাকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করে দিয়েছিল।
অমিত দাকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এমন অকপট বক্তব্য আমাদের মুগ্ধতাবশত বিভ্রান্তি কি না, তা যাচাই করতে সাংবাদকিতার কিছু তত্ত্ব তালাশ করে দেখা যাক। সংবাদ বা খবরের সংজ্ঞা সংক্রান্ত আলাপে সাংবাদিকতার প-িতরা বলছেন, গুণের বা উপাদানের ভিন্নতার কারণে দুটি সংবাদের একটি আরেকটিকে ছাপিয়ে যায়। সুতরাং, খবরের ট্রিটমেন্ট এ নিরিখেই আলাদা হয়ে যায়। যদিও দুটিই খবর। একই সঙ্গে সংবাদের সংজ্ঞাও আপেক্ষিকতার দোষে দুষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সড়কে সুইজারল্যান্ডের একজন অচেনা নাগরিকের মৃত্যুর খবরে বাংলাদেশের পাঠকের কিছুই আসে যায় না। তার মানে স্থানকালপাত্র ও পরিস্থিতিভেদে সংবাদের উপাদান ও মূল্য বদলে যায়।
তারপরও কথা থাকে, তা হলো পাঠকের সন্তুষ্টি। প-িতরাও পাঠকের মনস্তত্ত্বকে আমলে নিয়েছেন। তারা বলছেন, এই কারণে সংবাদও একাধিক শ্রেণিভুক্ত। মোটা দাগে, অমিতদার সংবাদবোধ ও বুদ্ধি সব শ্রেণির সংবাদকেই তার সৃজনশীলতার পরিসরে স্থান দিয়েছিল। এমনকি খবর ছাড়াও সংবাদপত্রের সব বিষয় তার মনোযোগ পেয়েছিল তিনি সম্পাদক হওয়ার অনেক আগেই। এই হয়ে ওঠার জন্য তিনি কোনো সংক্ষিপ্ত রাস্তায় হাঁটেননি। বার্তা বিভগের প্রায় সব ধাপ পার হয়েছেন নিজেকে শুধুই সাংবাদিকতায় নিবেদিত করার মাধ্যমে।
দলবাজি কিংবা সাংবাদিক রাজনীতির বাইরে থাকা আপাদমস্তক সাংবাদিক অমিত হাবিবের সংবাদচিন্তায় প্রাধান্য পেত নতুনত্ব আর অভিনবত্ব। মহাশয় কার্ল ওয়ারেন বলেছেন, শিল্প বা সত্য শব্দটির মতো খবর শব্দটাও ক্ষুদ্র, কিন্তু এর অর্থ বহুবিদ। সংক্ষিপ্ত অর্থে তা সাবান বা জুতার মতো সাদামাটা বস্তু। ব্যাপক অর্থে তা গুণের দিক দিয়ে অভিনব বা অগতানুগতিক, বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে অনন্ত এবং তা জীবনের মতো সীমাহীন।
অভিনব প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা কথা বলে রাখা ভালো, সফলতা বা ব্যর্থতার মানদণ্ডে অমিতদাকে বিচার করা ঠিক হবে না। দৈনিক যায়যায়দিন, কালের কণ্ঠ ও সর্বশেষ দেশ রূপান্তর সবখানেই সংগঠক ও নেতৃত্বের ভূমিকায় নতুন চিন্তার ছাপ রেখেছেন তিনি। ছাপা কাগজের বিষয়ে, আঙ্গিকে সৃজনশীলতার ঝলক দেখিয়েছেন।
অমিত হাবিবকে নিয়ে যেকোনো আলোচনায় এখনো তার সংবাদ ভাবনা, পরিকল্পনা, অ্যাঙ্গেল, সম্পাদনা, ট্রিটমেন্ট এসব নিয়ে কথা হয়। আর অবধারিতভাবে আসবে ‘শিরোনাম’। দেশ রূপান্তরের আগে কালের কণ্ঠে ছিলেন তিনি। ভোরের কাগজের পর এ পত্রিকাতেই বেশি দিন কাজ করেছেন তিনি। কালের কণ্ঠের বয়স তখন প্রায় ছয় মাস। একটি সংবাদ প্রধান শিরোনাম হয়েছিল, গতানুগতিক সংবাদের বাইরের এ সংবাদগল্পটি তখন তুমুল আলোচিত হয়েছিল। কবে প্রকাশিত হয়েছিল, তারিখ মনে পড়ছিল না, শুধু শিরোনাম মনে আছে ‘বিরল ভালোবাসা’। সেদিন আর কী কী গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছিল? সেই কৌতূহল থেকে ফোন করেছিলাম পত্রিকাটির রেফারেন্স বিভাগের জাহাঙ্গীর আলম সজীবকে। সংবাদ গল্পটির বিষয়ে জানতে চাইতেই তিনি বললেন, ‘এটা তো আইকনিক স্টোরি।’ জানালেন, এই সংবাদ গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১০ সালের ২ জুন।
এই সংবাদ গল্পে পাওয়া যাচ্ছে পঁচাত্তরের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা পর বঙ্গবন্ধুর এতিম কন্যা শেখ হাসিনার নামে ৭ শতাংশ জমি কিনেছিলেন ময়মনসিংহের দরিদ্র ভ্যানচালক হাসমত আলী। সেই জমির দলিল তিনি হস্তান্তর করে যেতে পারেননি। স্ত্রী রমিজা খাতুনের কাছে রেখে গিয়েছিলেন। ততদিনে রমিজাকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে হয়েছে। রাজধানীর রাস্তায় ভিক্ষা করার পাশাপাশি শেখ হাসিনার হাতে সেই দলিলটি তুলে দেওয়ার জন্য কোমরে গুঁজে সবসময় নিজের সঙ্গে রাখতেন। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। তার সঙ্গে দেখা করা কি রমিজার পক্ষে সম্ভব? এই জমি নিয়ে ছেলে কাদিরের সঙ্গে শ্যামলীর রাস্তায় ঝগড়ার সূত্রে খবরটি পেয়েছিলেন প্রতিবেদক। সেই খবরটিই কালের কণ্ঠের প্রধান শিরোনাম করলেন তখন নির্বাহী সম্পাদক পদে থাকা অমিত হাবিব। পাঠক হৃদয়কে আলোড়িত করা এ সংবাদ গল্পটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও আবেগে ভাসিয়েছে। পরদিন প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে নিলেন রমিজাকে, বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। বদলে গেল রমিজার হাত পেতে চলা নির্মম জীবন।
খবরটি কোন বিবেচনায় অমিতদা প্রধান শিরোনাম করলেন। কী আছে এই খবরে? সংবাদটির শিরোনাম পাঠককে প্রথমেই বলে দিচ্ছে ভালোবাসার এমন দৃষ্টান্ত সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ অভিনবত্ব আছে এ খবরে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার এতিম সন্তানের জন্য একজন ভক্তের এমন মানবিক নিবেদন অকল্পনীয়। হাসমত আলীর মতো মানবেতর ব্যক্তির এ নিবেদন একজন অবিসংবাদিত নেতার জন্য, যিনি বাংলাদেশের মহানায়ক।
খবরটি যেদিন প্রকাশিত হলো, সেদিন বড় আর যে দুটি খবর ছিল তার একটি ‘আমার দেশ’ পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত আর বেগুনবাড়ী এলাকায় ভবন ধস। পরিস্থিতি বাদ দিলে ‘বিরল ভালোবাসা’ শিরোনামের সংবাদ গল্পটির বড় খবর হওয়ার প্রায় সব উপাদানই আছে। যেমন পাঠকের আগ্রহ, নৈকট্য, বিষমতা, অভিনবত্ব, প্রসিদ্ধি, তাৎপর্য, প্রভাব ইত্যাদি।
এবার দেখা যাক, বড় ঘটনা কাভারেজ দেওয়ার ক্ষেত্রে অমিত হাবিব কী করতেন? ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন যখন শুরু হয় তিনি তখন দ্বিতীয় দফায় কালের কণ্ঠে, উপদেষ্টা সম্পাদকের ভূমিকায়। এ আন্দোলনের ব্যাপকতা ও অভিঘাতের আদ্যোপান্ত কালের কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় তুলে এনেছিলেন তিনি। সে সময় এক দিন দেশের প্রভাবশালী একটি বাংলা দৈনিকের সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হতেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শোনা গিয়েছিল তার কণ্ঠে। পাঠক কী ভাববে সেটা নয়, বরং কী নিয়ে ভাববে তা তুলে আনাই তো সাংবাদিকের কাজ। ইস্যু সৃষ্টি করা নয়, বরং ইস্যুটার সব দিক পাঠককে জানানো। এ নিরিখে অমিত হাবিব গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে খুঁটিনাটিসহ পাঠকের সামনে কালক্ষেপণ না করেই তুলে ধরতে পেরেছিলেন।
ওই বছরই সারা দেশকে কাঁপিয়ে দেওয়া হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরের অবস্থান কর্মসূচি ও তা-বের ঘটনা ছিল আরেকটি বড় ঘটনা। ওই সময় সংগঠনটি দাবি করেছিল যে, তাদের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী নিখোঁজ। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে এ দাবির সত্যতা মেলেনি। এ সংবাদটিও গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছিল তখন। হেফাজত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। ওই সময় অমিতদা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার কথা বলতেন। তার এ সাংবাদিকতার প্রতিফলন ঘটেছে পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনায়। তার মধ্যে ২০১৬ সালে হলি আর্টিসান বেকারি অ্যান্ড রেস্তোরাঁয় হামলা ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্যতম। সরাসরি বলতে না পারলে ঘুরিয়ে কীভাবে পাঠককে সত্যটা জানানো যায় সে কৌশল প্রয়োগ করতে দেখেছি বিতর্কিত ওই নির্বাচনের সময়। তখন শুধু দেশ রূপান্তর প্রকাশিত হয়েছে। তার পরে করোনা মহামারীর সময় আমরা দেখেছি, প্রথম আলোর মালিক লতিফুর রহমানের মৃত্যুর খবর শুধু প্রথম পৃষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশ করেননি, শিরোনামেই পাঠককে জানিয়েছেন তার মতো একজন উদ্যোক্তা সংবাদপত্রের জন্য খুবই দরকার এখন।
প্রায় চার দশকের সাংবাদিকতার জীবনে এলটন জনের গানও নিজে অনুবাদ করে সংবাদপত্রে জায়গা দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারকে স্থান দিয়েছেন প্রধান খবরের জায়গায়। কাভারেজ দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন উদারতার নজিরও রেখেছেন। কারও কারও মনে হতে পারে যে, এসবের সঠিকতা-বেঠিকতা তর্কাতীত নয়। সে বাহাসে যাব না, বরং অমিত হাবিবের কাজ প্রায়োগিক সাংবাদিকতাকে কতটা সমৃদ্ধ করতে পেরেছে, তা নিয়ে সাংবাদিকতার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণা করতে পারেন।
লেখক: নিউজ এডিটর, দেশ রূপান্তর।
২০০৯ সাল। দৈনিক কালের কণ্ঠের যাত্রা শুরুর আগের কথা। প্রথমে ভেবেছিলাম নতুন পত্রিকায় প্রতিদিন গড়ে ৪ পৃষ্ঠা করে ফিচার আয়োজন থাকবে। সেরকম করেই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। অমিতদা পত্রিকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সবকিছু বদলে গেল। প্রথমে টার্গেট ছিল, ধীরে ধীরে সার্কুলেশন বাড়িয়ে শীর্ষস্থানের দিকে যাত্রা করবে কালের কণ্ঠ। দাদা বললেন, না, শুরুতেই মার্কেট পেনিট্রেট করে লিড নিয়ে নিতে হবে। বড় আকারে শুরু করতে হবে। পত্রিকা হবে মোট ৩২ পৃষ্ঠার।
আমরা তো আঁতকে উঠলাম, ‘বলেন কী? তাহলে খরচ বেড়ে যাবে না?’
‘বাড়বে’, নির্বিকারভাবে বললেন দাদা। ‘কিন্তু মার্কেটে এক নম্বর হতে পারলে, বিজ্ঞাপন দিয়ে সে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যাবে।’ কিমাশ্চর্য, মালিকপক্ষও এ পরামর্শ মেনে নিল! আমাদের সবার মধ্যেই বেশ একটা জোশ এসে গেল। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আকারের পত্রিকা করতে যাচ্ছি আমরা।
আমি তখন ফিচার এডিটর, জামিল বিন সিদ্দিক ডেপুটি ফিচার এডিটর। দুজনেই অমিতদার পূর্বপরিচিত। আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়াটা বেশ ভালো। আমার সাংবাদিকতা জীবনের শুরুতে ভোরের কাগজ, তারপর যায়যায়দিন পত্রিকায় অমিতদার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাও আছে। যায়যায়দিনেও দেখেছি, বড় করে ভাবার একটা ‘বাতিক’ আছে তার। যাই হোক, অচিরেই এক অপরাহ্ণে আমাদের দিকে তাকিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন তিনি, প্রতিদিন ৮ পৃষ্ঠা ফিচার করতে হবে। কী, পারবেন না?
চ্যালেঞ্জের সুরে এরকম করে বললে খুব লাগে। আরে, আমরা কি আর কারেও ডরাই/ভাঙতে পাড়ি লোহার কড়াই। অমøান বদনে বলে দিলাম, কোনো ব্যাপার না। কিন্তু সাপোর্ট লাগবে দাদা। বললেন, সেটা পাবেন। আপনার দ্রুত প্ল্যান করেন। সময় কম।
ব্যস, আবার নতুন করে সাজানো শুরু হলো ফিচার পাতাগুলো। নতুন নতুন বিষয় যুক্ত হলো, নতুন কর্মীও। যেকোনো নতুন পত্রিকায় নতুন কোনো ফিচার আয়োজন থাকতে হয়। আমরা দিয়েছিলাম মগজ ধোলাই। মগজ ধোলাই প্রথমে ব্রডশিটে এক বা দুই পৃষ্ঠার কথা ভাবা হয়েছিল, সেটাকে আস্ত একটা ম্যাগাজিনের রূপ দেওয়া হলো। আলোকচিত্র নিয়ে পুরো এক পৃষ্ঠার একটা আয়োজন যোগ করা হলো। এভাবে বদল হলো আরও অনেক কিছুর।
সব পরিকল্পনা নিয়ে অমিতদার সঙ্গে বসে চূড়ান্ত করতে গেলাম একদিন। বসার পর দেখা গেল, অন্য বিভাগ থেকেও কিছু ফিচার আয়োজন আছে। সেসবের সঙ্গে ম্যাচ করাতে গিয়ে একটি বাড়তি দিন দরকার হচ্ছে। মানে, মগজ ধোলাই ও ঘোড়ার ডিম নামে দুটি ম্যাগাজিন হবে কিন্তু হাতে দিন থাকছে একটি। কী করা? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালেন অমিতদা। বিকল্প কিছু না পেয়ে আমরা একটা অভিনব প্রস্তাব দিলাম, ‘দুটোই ব্যাক-টু-ব্যাক কাভার দিয়ে একদিনেই ছেপে দিলে কেমন হয়?’ বললাম বটে কিন্তু প্রস্তাব পাস হবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। বাংলা মুল্লুকে কেন, পত্রিকার জগতেই এরকমটা আগে দেখেছি বলে মনে পড়ল না। কিন্তু খানিকক্ষণ ভেবে অমিতদা মাথা নেড়ে সায় দিলেন। অবশেষে ১৬ পৃষ্ঠা করে মোট ৩২ পৃষ্ঠার ম্যাগাজিন হলো। একদিকে মগজ ধোলাই, উল্টো দিক দিয়ে পড়লে ঘোড়ার ডিম। পাঠক কীভাবে নেবে তা নিয়ে যেটুকু সংশয় ছিল পত্রিকা বাজারে যাওয়ার পর তা নিমেষেই উবে গেল। দেখা গেল আইডিয়াটা বেশ জমে গেছে। ডাবল কাভারের এই ম্যাগাজিন নিয়ে পাঠকদের মধ্যে যে তুমুল উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল তা স্মরণ করলে এখনো বেশ ভালোই লাগে। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত, অমিতদার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে এই প্রস্তাব আদৌ পাস করানো যেত কি না সন্দেহ।
মূলত নিউজের লোক হলেও কী ফিচার কী সাহিত্য, কী সম্পাদকীয় সব বিভাগেই অমিতদার ইনপুট থাকত এবং সেটা হাওয়া থেকে না। বই পড়া, ছবি দেখা, গান শোনা এগুলো তার জীবনচর্যার অংশ ছিল। চিন্তায় মননে তার মতো সমৃদ্ধ সম্পাদক বাংলাদেশে খুব বেশি একটা এখনো দেখতে পাই না। শিল্পকলার যে কোনো মাধ্যম নিয়েই তার সঙ্গে আড্ডা দেওয়া যেত। সব বিষয়ে তুমুল আগ্রহ তার। খেলা পাগল তো ছিলেনই। মার্লোন ব্রান্ডো কেন অস্কার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তার বৃত্তান্তও বিজনেসইনসাইডার থেকে (সম্ভবত ২০১৪ সালে) প্রিন্ট নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে দেখেছি তাকে। তার অন্তরাত্মা জুড়ে ছিল সত্যসন্ধ সাংবাদিকের সেই অমোঘ তৃষ্ণা : জানা ও জানানো।
পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বটা তিনি এমন আলগোছে পালন করতেন যে টের পাওয়া যেত না, কোথাও কোনো চোট লাগত না। হুকুমদারি কিংবা নিজেকে জাহির করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। নিজেকে সবরকমভাবে আড়ালে রেখে অন্যদের এগিয়ে দিতেন।
লিখতে পারতেন চমৎকার। অমিতদার লেখকসত্তার কথা হয়তো অনেকেই জানেন না। আমি কিন্তু সাংবাদিকতায় আসার আগে তার লেখা পড়েই মুগ্ধ হয়েছি। সম্ভবত গত শতকের আশির দশকের শুরুর দিকে, অধুনা নামে একটা লিটল ম্যাগাজিন বের হতো। ক্ষীণতনু লিটল ম্যাগটি রচনাসম্পদে ছিল ভরপুর। মাত্র পাঁচটা সংখ্যা বের হয়েই বন্ধ হয়ে যায়। সেখানেই প্রথম অমিতদার লেখা পড়ি এবং সেগুলো শিল্পসাহিত্য বিষয়ক! তার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, অল্প কথায় মূল বক্তব্যটা তুলে ধরা। অর্থঘন শব্দচয়নে ছিলেন অসাধারণ। তির্যক মন্তব্যে অতুলনীয়। তার সঙ্গে যারা আড্ডা দিয়েছেন তারা বুঝবেন, তার লেখার স্টাইল তার কথোপকথনেরই পরিশীলিত রূপ। অথচ এই লোককে পরে আর কখনো লিখতে দেখিনি। আমাকে কখনো লেখার তাগিদ দিলে পাল্টা বলতাম, আপনি লেখেন না কেন? লাজুক হেসে বলতেন, আলস্য। অথচ অন্যকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ছিলেন সদাতৎপর।
২০১৪ সালের কথা। শাহবাগ আন্দোলন তখন তুঙ্গে। নিউজ তো ছাপা হচ্ছেই, ফিচার বিভাগ থেকেও থাকছে বিভিন্ন আয়োজন। এর মধ্যে দাদা বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানদের শাহবাগে ঘুরে এসে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ টাইপের লেখা দিতে বললেন। নিউজ এডিটর, বিজনেস এডিটর, মফস্বল এডিটর কেউ বাদ গেলেন না। স্পোর্টস এডিটর মোস্তফা মামুন তো জাত লেখক, বসলেই গড়গড়িয়ে লিখতে পারে। কিন্তু আমরা যারা অলেখক তারা মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। আমি চাকরি জীবনের শুরুতে চারটে পয়সা পাওয়ার আশায় এন্তার লিখেছি। এমনও হয়েছে, বেতনের চেয়ে লিখে সম্মানী পেতাম কয়েকগুণ বেশি। কিন্তু সে যুগ হয়েছে বাসি। এখন আর কলম সরে না। কালের কণ্ঠে এসে ঠেকায় পড়ে গীতাঞ্জলির শতবর্ষ উপলক্ষে একটা ঢাউস লেখা লিখতে হয়েছিল। ব্যস, ওই পর্যন্তই। ফলে যখন অমিতদা বললেন, আপনাকে লিখতে হবে। তখন কাষ্ঠ হাসি হেসে বললাম, মাফ করে দেন অমিতদা। অভ্যেস নেই। কিন্তু দাদা নাছোড়। বারবার পিছলে যাওয়ার চেষ্টা করেও কাজ হলো না। গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে ঠিকই শেষ পর্যন্ত একটা লেখা বের করে ছাড়লেন। লেখার শুরুটা হালকা চালে ছিল, সম্ভবত মমতাজের কোনো একটা গানের কলি দিয়ে শুরু করেছিলাম। দাদা বললেন, পরামর্শের সুরে, এটা রাখবেন?
এই একটা ব্যাপার, কখনো কোনো লেখা নিজে বদল করতেন না। লেখককে ডেকে, আলাপ করে, তাকে কনভিন্স করে তাকে দিয়েই বদলে নিতেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা বেটার হতো। কালের কণ্ঠের অনেক ফিচারের উপস্থাপনা কিংবা শিরোনামের ক্ষেত্রেও এরকমটা হয়েছে। খবরদারি নয়, সহযোগিতা এটাই ছিল তার দায়িত্ব পালনের অন্যতম মূলমন্ত্র।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কথাও বলা যায়। ফি বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সময় পত্রিকায় নতুন কিছু ইন্ট্রোডিউস করার একটা তাড়না থাকত। ফিচারের বিভিন্ন পাতায় নতুন কিছু বিভাগ চালু করা হতো। একবার আস্ত দুটি নতুন পাতা করার প্রস্তাব এলো। বিভাগের সবার সঙ্গে পরামর্শ করে দুটো পাতার আইডিয়া ঠিক করলাম। একটা বিজ্ঞাপন বিরতি, অন্যটার নাম মনে পড়ছে না। দাদা বললেন, সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটা পাতা করেন। আমরা একটু গাঁইগুঁই করলাম এ ধরনের পাতা আগে অনেক হয়েছে, কেউ মন খুলে কথা বলতে চায় না, সেই একই জিনিস ছাপা হবে ইত্যাদি। দাদা বললেন, ‘তবু করেন। আমার মনে হয় ভালো হবে।’ তা-ই হলো। কালের কণ্ঠের অন্যতম আকর্ষণীয় পাতা ছিল কথায় কথায়। অনেক খ্যাতিমান লোকও পাতার ইনচার্জকে ফোন করে বলতেন, কই মিয়া তোমরা তো আমার সাক্ষাৎকার নিলা না।
আরও একটা হ্যাপা ছিল, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যার আয়োজন করা। বেশ কয়েকবারই ফিচার বিভাগ থেকে এটা করা হয়েছে। আমি আর জামিল একবার পরিকল্পনা করলাম বাংলাদেশের সাংবাদিকতার সেকাল একাল আগামীকাল নিয়ে তিনটা ফোল্ডার করব। দাদাকে বললাম, কোনো এক্সপার্টের মতামত নিতে পারলে ভালো হতো। দাদা বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম বিভাগের কারও সঙ্গে পরামর্শ করে করেন, ভালো হবে। শুধু বললেন না, তাৎক্ষণিকভাবে রোবায়েত ফেরদৌসকে ফোন দিয়ে অফিসে দাওয়াত দিলেন। পরে আমাদের পরিকল্পনা নিয়ে রোবায়েতের সঙ্গে বসে তিনটি ফোল্ডারের বিষয় চূড়ান্ত করা হলো। সেই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছিল।
এরকম অনেক পরামর্শ, অনেক সহযোগিতা আর এন্তার স্বাধীনতা দিয়ে আমাদের ফিচার বিভাগের পথ চলাকে সুগম করে দিয়েছিলেন অমিতদা। এজন্য আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ।
লেখক : উপসম্পাদক, কালের কণ্ঠ
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।