
ব্রিটিশ ভারতে জন্ম নেওয়া শিশুটির নাম রাখা হয় খোকা। পরের পাঁচ দশকে ভারতবর্ষ দেখেছে বিভাজন আর মানচিত্র বদলে যাওয়ার জটিল-কুটিল রাজনীতি। এই পরিক্রমায় সেদিনের খোকা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব, মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা। ইতিহাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে দূরদ্রষ্টার মতো যিনি চলেন অমরত্বের পথে। আমরা সেই ঊর্ধ্বমুখী যাত্রাপথের ১৫টি ধাপ ছুঁয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে স্মরণ করছি জনকের জন্মদিন।
দুরন্ত কিশোর পেল পথের দেখা
১
তরুণ রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিব ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ সফরে আসা তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন।
১৯৩৮ সাল। বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আসবেন গোপালগঞ্জে। করা হয়েছে বিশাল জনসভার আয়োজন। এ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিপুল আলোড়ন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ভার মিশন স্কুলের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর।
সভা শেষে মিশন স্কুল দেখতে গেলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বঙ্গবন্ধুসহ অন্যরা তাকে সংবর্ধনা দিলেন। এরপর সোহরাওয়ার্দী যখন হেঁটে লঞ্চের দিকে চলছিলেন, বঙ্গবন্ধুও ছিলেন তার পাশে। তখন কিছু কথা হয় তাদের মধ্যে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নোটবুক বের করে বঙ্গবন্ধুর নাম-ঠিকানা লিখে নিলেন। কয়েক দিন পর পাঠালেন চিঠি। সেই চিঠিতে বঙ্গবন্ধুকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি কলকাতায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন সোহরাওয়ার্দী।
১৯৪৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। সে বছর তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের (অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের শাখা) কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এবং ভারত বিভাজন পর্যন্ত তার দায়িত্ব প্রশংসনীয়ভাবে পালন করে যান। ১৯৪৭ সালে মহাত্মা গান্ধী শান্তি মিশনে কলকাতা এলে শেখ মুজিবুর রহমান তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারত ও পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে স্বতন্ত্র, স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন। যদিও এই উদ্যোগ বাতিল হয় কিন্তু পরে এটিই একজন জাতির পিতার স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি হয়ে ওঠে।
বেকার স্ট্রিট থেকে মোগলটুলি
২
সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে প্রোগ্রেসিভ (উদারপন্থি) নেতারা ছিলেন, তারা নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। কলকাতা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকেলে ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরে সেই দলের নাম পরিবর্তন হয়ে হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী সেই দলের নামকরণ করা হয়। সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে আটক থাকলেও তাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
১৯৫২ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরের বছর সাধারণ সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ সালের আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সব ধর্মের মানুষের অন্তর্ভুক্তি এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ‘মুসলিম’ শব্দটি প্রত্যাহার করে নাম রাখা হয় ‘আওয়ামী লীগ’। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বন্ধু
৩
১৯৪৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের চাকরির নিরাপত্তা বিধান এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সমর্থন জানান। ১৯ এপ্রিল চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পক্ষে মিছিল বের করার প্রস্তুতিকালে কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ শেখ মুজিবুর রহমানকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগের আগে ছাত্রলীগ
৪
১৯৪৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য মুসলিম লীগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য কর্মতৎপরতা শুরু করেন। ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবসে’ ধর্মঘট পালনকালে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় কয়েকজন সহকর্মীসহ শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন। তার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ মুসলিম লীগ সরকার শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্য ছাত্রনেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে গেলেন বৈশ্বিক অঙ্গনে
৫
১৯৫২ সালে জেলবন্দি অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন এবং আন্দোলনকে সফল করার জন্য জেল থেকেই পাঠাতেন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শেখ মুজিবুর রহমান জেলের ভেতরেই ১১ দিন ধরে আমরণ অনশন করেন এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ধর্মঘট আহ্বান করে। আন্দোলনরত ছাত্রজনতা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে অগ্রসর হলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিউরসহ অনেকে। জেল থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান শহীদদের প্রতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানান। একই বছর শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে চীন সফর করেন। শান্তি সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় বক্তৃতা দেন, ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে যান বৈশ্বিক অঙ্গনে।
মন্ত্রিত্ব থেকে নেতৃত্বে
৬
১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ একাই ১৪৩টি আসনে জয়ী হয়। শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত হন এবং ১৫ মে নতুন প্রাদেশিক সরকারের সমবায় ও কৃষিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ২৯ মে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার হঠাৎ করে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। ৩০ মে শেখ মুজিবুর রহমান করাচি থেকে ঢাকায় পা রাখা মাত্রই গ্রেপ্তার হন। ২৩ ডিসেম্বর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
গঠন করলেন নিউক্লিয়াস
৭
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান সামরিক শাসন জারি করে এবং সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে। ১১ অক্টোবর আবার শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। একের পর এক মিথ্যা মামলায় তাকে হয়রানি করতে থাকে সামরিক সরকার। ১৪ মাস পর শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে জেলগেটেই আবার গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৬১ সালে হাইকোর্ট আটকাদেশ অবৈধ ঘোষণা করার পর শেখ মুজিবুর রহমান কারাগার থেকে মুক্তি পান। সে সময়ই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করতে উদ্যমী ছাত্র নেতাদের নিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যা নিউক্লিয়াস নামে পরিচিত।
ছয় দফায় দেখালেন নতুন দিশা
৮
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপনের চেষ্টা করেন। তিনি ছয় দফাকে সম্মেলনের এজেন্ডা করতে চাইলে অধিকাংশ নেতা ছয় দফাকে পাকিস্তানকে টুকরো করার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এর প্রতিবাদে শেখ মুজিব সম্মেলন থেকে ওয়াকআউট করেন। এরপর তিনি ঢাকায় এসে ছয় দফা নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। প্রস্তাবিত ছয় দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন। ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে তিনি সারা বাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। এ সময় তাকে আটবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং সর্বশেষ ৮ মে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় তিন বছর শেখ মুজিবুর রহমান কারারুদ্ধ ছিলেন।
আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে আগরতলা
৯
১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন বাঙালির (রাজনীতিবিদ এবং সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা) বিরুদ্ধে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে। জেলে বন্দি থাকা অবস্থাতেই ১৮ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে আবার গ্রেপ্তারি আদেশ জারি করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে গণবিক্ষোভ শুরু হয়।
হলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ বললেন ‘বাংলাদেশ’
১০
১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন শুরু হয়। টানা গণ-আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সব বন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল ছাত্রসমাবেশে লাখো শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আওয়ামী লীগের এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের নাম রাখেন ‘বাংলাদেশ’।
সত্তরের নির্বাচনে মহানায়ক
১১
১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার আলোকে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগের জন্য তিনি নৌকা প্রতীক বেছে নেন। ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে উপকূল এলাকায় লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটে। শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনী প্রচারণা স্থগিত রেখে ঘূর্ণিঝড়বিধ্বস্ত অঞ্চলে ছুটে যান। ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হয়।
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’
১২
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে। এ ঘোষণার ফলে সর্বস্তরের বাঙালি রাস্তায় নেমে আসে। ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানের (পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
ঘোষণা করলেন স্বাধীনতা
১৩
২৫ মার্চ রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শতাব্দীর ঘৃণ্যতম গণহত্যা চালায়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এরপরই তাকে ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল এ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের নেতৃত্বে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এ সরকারের পরিচালনায় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে। ৯ মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করে, পুড়িয়ে দেয় লাখো মানুষের ঘরবাড়ি। প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
স্বাধীন করে ফিরলেন দেশে
১৪
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক চাপের মুখে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। লন্ডন এবং নয়াদিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে ফিরে আসেন। লাখো জনতার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় স্নাত হয়ে বঙ্গবন্ধু তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে আসেন এবং জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ১২ জানুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে শেখ মুজিবুর রহমান নতুন বাংলাদেশকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করেন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ নবপ্রণীত সংবিধানের আলোকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ২৩ মে বিশ্ব শান্তিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব শান্তি পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কারে ভূষিত করে। সেপ্টেম্বরে শেখ মুজিবুর রহমান আলজেরিয়ার জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দেন।
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ পরিষদের সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় বক্তব্য দেন। বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষায় এটিই প্রথম ভাষণ।
চিরকালের
১৫
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী ও উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক কর্মকর্তার হাতে প্রায় সপরিবারে নিহত হন। দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যান। বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্ধকারতম দিন ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয় এবং স্মরণ করা হয় বিশাল হৃদয়ের মহাপ্রাণ মানুষটিকে যিনি তার সাহস, শৌর্য, আদর্শ ও ভালোবাসার মধ্য দিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন বাঙালির অন্তরে।
তথ্যসূত্র : ১. মযহারুল ইসলাম, ২০১১, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, ঢাকা, আগামী প্রকাশনী ২. শেখ হাসিনা (সম্পাদিত), ২০২১, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ, ৩. মুজিবপিডিয়া।
শেখ মুজিবর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার এই যাত্রাপথে বিভিন্ন মানুষ নানাভাবে জড়িয়ে রয়েছেন। যেসব ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন, নিঃসন্দেহে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাদের মধ্যে উজ্জ্বলতম মানুষ। তাদের দুজনের সম্পর্ককে অনেকে গুরু-শিষ্য বলেও মহিমান্বিত করেছেন। আর কে না জানে, সুফি ও বাংলার গুরুবাদী ভাবধারায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্কটি দ্বিপাক্ষিক। শিষ্য যেমন গুরুর কাছ থেকে নেন, গুরুও শিষ্যর কাছ থেকে নেন। এই লেনদেন না হলে সম্পর্ক স্থাপিত হয় না, ভালোবাসাও খাঁটি হয় না। এই দেওয়া-নেওয়া বস্তুবাদীও হতে পারে, আধ্যাত্মিকও হতে পারে। এসব তত্ত্ব আলাপের চেয়ে আমরা বরং বঙ্গবন্ধু ও সোহরাওয়ার্দীর সম্পর্কটি বোঝার চেষ্টায় প্রবিষ্ট হই। এই লেখার সেটাই উদ্দেশ্য।
বঙ্গবন্ধুর মাত্র ৫৫ বছরের জীবন পর্যালোচনা করতে গেলে আমাদের বারবার তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়তে হবে। আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হলো, কেমন করে তার সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম, কীভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তার স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।’
১৯৩৮ সালের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়েন। শহরে আসবেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরির দায়িত্ব পড়ল কিশোর শেখ মুজিবের ওপর। সভা শেষে সোহরাওয়ার্দী গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। স্কুলের ছাত্রদের পক্ষে তাকে সংবর্ধনার নেতৃত্বের ভার বঙ্গবন্ধুর কাঁধে। স্কুল থেকে সোহরাওয়ার্দী যখন ফিরছিলেন, হাঁটতে হাঁটতে তাকে লঞ্চঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু। তখনই প্রিয় গুরুর সঙ্গে প্রথম আলাপ কিশোর মুজিবের।
ভাঙা ভাঙা বাংলায় বঙ্গবন্ধুকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলেন সোহরাওয়ার্দী। নোটবুক বের করে নাম-ঠিকানা টুকে নিলেন। পরে একটা ধন্যবাদ চিঠিও পাঠান। আরও বললেন, বঙ্গবন্ধু যেন কলকাতায় গেলে তার সঙ্গে দেখা করেন।
বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতায় গেলেন, সোহরাওয়ার্দীর বাড়ির দারোয়ান প্রথমে তাকে ঢুকতে দিতে চাননি। সোহরাওয়ার্দী তখনো মন্ত্রী। তার দেওয়া কার্ডটি দারোয়ানকে দেখালেন শেখ মুজিব। কার্ড দেখে তাকে তাড়াতাড়ি ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘ম্যাট্রিক তো পাস করে ফেলেছো, এখানেই কলেজে ভর্তি হও। আমার সঙ্গেও কাজ করো।’ এভাবেই বঙ্গবন্ধু কাজ শুরু করেন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্রলীগের প্রাদেশিক শাখায়।
মুসলিম লীগ ভাগ হওয়ায় ছাত্রলীগও বিভক্ত হয়ে যায়। নাজিমুদ্দীন সমর্থিত গ্রুপটির নেতৃত্ব দেন শাহ আজিজুর রহমান। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপকে সমর্থন দিতে থাকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ।
বঙ্গবন্ধুকে ভীষণ স্নেহ করতেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এর একটি প্রমাণ বঙ্গবন্ধুর প্রথম লাহোর সফর। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী পার্টি গঠন বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরামর্শ করতে তাকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কিন্তু লাহোর পৌঁছে বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন, সোহরাওয়ার্দী সেখানে নেই। তখন শীতকাল। এদিকে বঙ্গবন্ধুর কাছে শীতের কাপড়ও নেই। তিনি উপায় না দেখে পূর্বপরিচিত মিয়া ইফতিখার উদ্দিনের বাড়িতে ওঠেন।
সোহরাওয়ার্দী লাহোর ফিরলেন বঙ্গবন্ধু যাওয়ার দুদিন পর। তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন সোহরাওয়ার্দী। খোঁজখবর নিলেন। তারপর একান্তে কথা বললেন স্নেহের শিষ্যের সঙ্গে। তার থাকার জন্য নিজে হোটেল ঠিক করে দিলেন। দোকানে নিয়ে জামা-কাপড় কিনে দিলেন। সেবার লাহোরে থাকার দিনগুলোতে সকালে সোহরাওয়ার্দীর কাছে গিয়ে রাতে ফিরতেন বঙ্গবন্ধু। সারা দিন আলাপ চলত দুজনের।
স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জীবনের বহুদিন তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছি। তার স্নেহ পেয়েছি এবং তার নেতৃত্বে বাংলার লোক পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। যার একটা ইঙ্গিতে হাজার হাজার লোক জীবন দিতে দ্বিধাবোধ করত না, আজ তার কিছুই নেই। মামলা না করলে তার খাওয়ার পয়সা জুটছে না। কত অসহায় তিনি! তার সহকর্মীরা- যারা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করত, তারা আজ তাকে শত্রু ভাবছে। কত দিনে আবার দেখা হয় কী করে বলব? তবে একটা ভরসা নিয়ে চলেছি, নেতার নেতৃত্ব আবার পাব। তিনি নীরবে অত্যাচার সহ্য করবেন না, নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করবেন। পূর্ব বাংলায় আমরা রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করতে পারব এবং মুসলিম লীগের স্থান পূর্ব বাংলায় থাকবে না, যদি একবার তিনি আমাদের সাহায্য করেন। তার সাংগঠনিক শক্তি ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব জাতি আবার পাবে।’
সোহরাওয়ার্দীও স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধুকে তারকা সংগঠক আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন রাজনীতির উত্তপ্ত মাঠের দুর্বার কর্মী। স্নেহের মুজিবের জন্য অনেক করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে ১৯৫৮ সালের এপ্রিলে তিনি যখন আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় অংশ নিতে ঢাকায় আসেন, তখনই বুঝতে পেরেছিলেন শেখ মুজিব সে-ই কাঁচা হীরার টুকরা, যাকে সামান্য দিকনির্দেশ দিতে পারলেই পূর্ব বাংলা তার সবচেয়ে বলিষ্ঠ নেতা পাবে।
ওই বছরই তার প্রস্তাব অনুসারে পশ্চিমা রাজনীতি ও অর্থনীতির রূপরেখা নিয়ে জ্ঞান বাড়াতে বঙ্গবন্ধুকে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে শিক্ষা সফরে পাঠায় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি। দুই মাসের সেই ট্যুরে তিনি সবচেয়ে বেশি সময়, ১২ দিন কাটিয়েছিলেন লন্ডনে।
বঙ্গবন্ধুর সংসারের আয়-রোজগার নিয়েও ভাবতেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাই ১৯৫৭ সালে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার আগেই তিনি বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান চা বোর্ডের সভাপতি করেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সারাক্ষণ রাজনীতি নিয়ে থাকেন। তাই উপার্জনের এমন একটা রাস্তা তাকে সোহরাওয়ার্দী জুটিয়ে দিয়েছিলেন, যে পদটি আলংকারিক; আক্ষরিক অর্থে যেখানে খুব একটা সময় দেওয়ার বালাই ছিল না।
প্রিয় গুরুর জীবনেও বঙ্গবন্ধুর অনেক অবদান। ভাষা আন্দোলন, দলের নাম বদলসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মতবিরোধ হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত শিষ্যের বিচক্ষণ যুক্তি মেনে নিয়েছেন গুরু। এই যেমন, ভাষা আন্দোলনে সোহরাওয়ার্দীর সমর্থন আনতে করাচি গিয়ে হাজির হয়েছিলেন ‘নাছোড়বান্দা’ বঙ্গবন্ধু। আবার ১৯৫৫ সালে দলকে অসাম্প্রদায়িক করতে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিতে রাজি করিয়েছেন। শুরুতে গুরু-শিষ্যের যে লেনদেনের কথা বলছিলাম, সেটা দিয়েই শেষ করি। সোহরাওয়ার্দী যেমন পরিচয়ের প্রথম ক্ষণটিতেই বঙ্গবন্ধুকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুও প্রথম সাক্ষাতে তার পরবর্তী যাত্রাপথের পথপ্রদর্শকের নিশানা পেয়েছিলেন। একদিকে তরুণ শেখ মুজিবের সাংগঠনিক দক্ষতাকে সোহরাওয়ার্দী ব্যবহার করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। অন্যদিকে, তরুণ মুজিবও দ্বীধাহীনভাবে রাজনীতির দিক্ষা সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে বুঝে নিতে দেরি করেননি। গুরু-শিষ্যের এই পরম্পরা বাংলার এক নিবিড় সংরাগ।
তথ্যসূত্র: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান; বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর.কম; টিবিএস.কম বাংলা।
ছাত্রলীগ হচ্ছে পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠন, আওয়ামী লীগের পূর্বসূরি। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড় বছর আগে, আর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪ মাস ১৯ দিন পর এর প্রতিষ্ঠা (৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮)। বঙ্গবন্ধু সে সময়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’-এর ছাত্র। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় তিনিই যে মূল উদ্যোক্তা ছিলেন, পূর্বাপর ঘটনাও তার প্রমাণ বহন করে।
‘ছাত্রলীগ গঠন করার সাথে সাথে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল। এক মাসের মধ্যে আমি প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমউদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হতো। একদল সহকর্মী পেয়েছিলাম, যারা সত্যিকারের নিঃস্বার্থ কর্মী।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৮৯]
ভাষা-আন্দোলনের প্রথম পর্বে বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সে স্থান পূরণ করেন। শুধু ভাষা-আন্দোলন বা মুসলিম লীগ সরকারের প্রাথমিক জেল-জুলুম-নির্যাতন মোকাবিলায় নয়, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় ও এর সংগঠন গড়ে তুলতেও ছাত্রলীগ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় :
‘আওয়ামী লীগ গড়ে উঠবার পূর্ব পর্যন্ত একমাত্র ছাত্রলীগই সরকারের অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরত’ (আত্মজীবনী, পৃ. ২৩৬)।
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার দুই মাস যেতে না যেতেই প্রথম চ্যালেঞ্জ আসে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ মার্চ হরতাল সফল করার। বঙ্গবন্ধু এই সুযোগে ছাত্রলীগের সংগঠন গুছানোর জন্য সচেষ্ট হন। ১১ মার্চ ঢাকার রাজপথে বঙ্গবন্ধু পিকেটিংয়ে নামেন শত শত ছাত্রের সঙ্গে। এসময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাকিস্তানে এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম জেল। তবে এই সফল হরতালের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ছিল পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর গভর্নর জেনারেল হিসেবে প্রথম সফর। এ কারণে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ সরকার আপস করতে চায়। তারা ৮-দফা আপস প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে সেটা পাঠায় কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। বলা হয়, তিনি সম্মতি দিলে পূর্ব পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা চালাবে এবং আটক সব বন্দিকে মুক্তি দেবে। এই চুক্তি তিনি অনুমোদন করেন। ১৫ মার্চ মুক্ত হয়ে তিনি পরদিন আমতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেন- ‘বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হলো।’ [পৃষ্ঠা ৯৬]
বঙ্গবন্ধুই ছিলেন এ ছাত্রসংগঠনের প্রাণশক্তি। সমসাময়িক ছাত্রনেতাদের মধ্যে অনেকের চেয়ে তিনি ছিলেন বয়সে জ্যেষ্ঠ। তিনি তখনই মনে মনে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার পক্ষে মনস্থির করে ফেলেছিলেন। হয়তো সে কারণে তিনি নিজেকে ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত করেননি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়লে ছাত্রত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের অবসান ঘটে।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর যুগ্মসম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েই বঙ্গবন্ধু জেলায়-মহকুমায় আওয়ামী লীগ গঠনে মনেযোগী হন। একইসঙ্গে প্রতিটি স্থানে তিনি ছাত্রলীগ গড়ে তোলার কাজেও অংশ নিতে থাকেন। তিনি ছাত্রদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যার সমাধান, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার দাবিতে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু নিজে আর ছাত্র না থাকায়, ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব তিনি নেননি। ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ ঢাকার তাজমহল সিনেমা হলে ছাত্রলীগের প্রথম আনুষ্ঠানিক সম্মেলনে অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি রাজি হননি।
পরদিন ১৭ সেপ্টেম্বর আরমানিটোলা ময়দানে ছাত্র-জনসভা অনুষ্ঠিত হয় মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে। জনসভায় ভাসানী বলেন- ছাত্র বন্ধুরা, মজিবরকে তোমাদের কাছ থেকে আমি নিয়ে নিলাম। জানি, তোমরা কষ্ট পেয়েছো। কিন্তু জালেম মুসলিম লীগকে সরাতে হলে আওয়ামী লীগকে গ্রামে গ্রামে গড়ে তুলতে হবে। এ কাজে আমার আতাউর রহমান, সালাম খান, শামসুল হক আছে। কিন্তু মজিবরের মতো উপযুক্ত যুবক ছাড়া আমি কিছুই করতে পারব না।
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, ছাত্ররা জেগে উঠেছে। ছাত্রলীগ সফল সম্মেলন করেছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানে মাত্র ৫ শতাংশ লোক লেখাপড়া জানে। এ অবস্থায় ছাত্রদের রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় ভূমিকা রাখার বিকল্প নেই। অন্যথায় জনগণের দুঃখ-কষ্ট দূর করা যাবে না। নির্যাতন আসবে, সেটা উপেক্ষা করে ছাত্রদের এগিয়ে যেতে হবে। ছাত্র আন্দোলন করার জন্য বৃত্তি কেটে নেওয়া হয়। ছাত্রছাত্রীদের জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো দমননীতি তোমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। ছাত্রলীগ সম্পর্কিত আরও কিছু স্মৃতিচারণা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যদিও আমি সদস্য ছিলাম না, তবুও ছাত্রনেতারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। প্রয়োজন মতো বুদ্ধি পরামর্শ দিতে কার্পণ্য করি নাই। এরাই আমাকে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শ্রদ্ধা করেছে’ (পৃ. ১২৭)।
যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বহিষ্কার করেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নির্বাচিত ছাত্র সংসদ ‘ডাকসু’ ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে প্রবল ছাত্র-গণ আন্দোলন গড়ে কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে আনে এবং তাকে বরণ করে নেয় ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে। এর দুই বছর পর এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় তার আহ্বানে ডাকসু নেতৃত্ব উত্তোলন করে বাংলাদেশের লাল-সবুজ-সোনালি রঙের ‘জাতীয় পতাকা’, ১৭ এপ্রিল ‘মুজিব নগরে’ বাংলাদেশ সরকার যাকে অভিবাদন জানিয়ে আনুষ্ঠানিক শপথ নেয়। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রসমাজের ঐতিহ্যবাহী ও সবচেয়ে পুরনো সংগঠন এই ছাত্রলীগই ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একটি নাম, যার অঙ্গুলি হেলনে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিজেদের জীবন চালিত করেছে একাত্তরে। দলমত-নির্বিশেষে তিনি সবার জাতীয় নেতা। তিনি একটি দলের প্রধান হলেও সব দল নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়েছিলেন দেশ মুক্ত করার জন্য।
ব্রিটিশ টেলিভিশন সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকারের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সাতটি বাক্যে তিনি নেতৃত্বের বিশ্লেষণ করেছেন এভাবেÑ ‘সত্যিকারের নেতৃত্ব আসে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। একজন মানুষ এক দিনে হঠাৎ করেই নেতা হতে পারেন না। এটা অবশ্যই একটি প্রক্রিয়া, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। তাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে, তিনি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে। মানবতার জন্য আত্মত্যাগে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। তার মধ্যে অবশ্যই নীতি-আদর্শ থাকতে হবে। যদি কোনো নেতার এসব গুণ থাকে, তবে তিনি নেতা।’
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও তৎকালীন নেতৃত্বের স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধু যেসব দলমত-নির্বিশেষে সবার নেতা হয়ে উঠেছিলেন তার পরিক্রমাটি বুঝতে পারা যায়। একদিকে ডানপন্থি, অন্যদিকে বামপন্থি; উভয়কেই স্বাধীনতার আন্দোলনের স্রোতে শামিল করেছিলেন। সামলাতে হয়েছে উগ্রপন্থিদের দাবি-দাওয়াকেও। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর প্রতিষ্ঠা লাভ করায় আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার শুরুতে নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দ যুক্ত রাখতে হয়েছিল। তবে ১৯৫৫ সালে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে (তখন তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক) দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে সংগঠনের সদস্যপদ সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
বাসসের সাবেক সিটি এডিটর অজিত কুমার সরকার বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মাঝে মানুষকে আকৃষ্ট করার মোহনীয় শক্তি ছিল। তিনি শুধু ভালো বক্তা নন, তিনি প্রকৃত অর্থে একজন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের কথা তিনি এমনভাবে তুলে ধরতেন যে মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠত।’ [বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং বিশ্ব মিডিয়া, যুগান্তর, ১ আগস্ট ২০২১]। বঙ্গবন্ধু সে সময়কার বাম নেতাদের সঙ্গেও যথোচিত সংযোগ রাখতেন।
বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ৩৮ বছরের রাজনৈতিক জীবন গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে যে সত্যটি বের হয়ে আসে তা হলোÑ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দলের নেতৃত্ব দিলেও তার রাজনীতি কখনো সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির স্বার্থে পরিচালিত করেননি। শেখ মুজিব পাকিস্তানি শোষণ, নির্যাতন, বৈষম্য, জাতিগত নিপীড়ন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে যতটা দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করেছিলেন তা আর অন্য কোনো দল বা রাজনৈতিক নেতার মধ্যে দেখা যায়নি।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ডান-বাম-উগ্র সবার কথাই নিজের ভাষায় এমনভাবে বললেন যে তা সবার ভাষ্য হয়ে ওঠে। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, এক পক্ষ, যারা বিশ্বাস করতেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ পরিক্রমণের মধ্য দিয়ে জনগণের রায়সমৃদ্ধ হয়ে একটা পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীনতার আহ্বান উচ্চারিত হবে। যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন প্রতিষ্ঠিত করার দিবাস্বপ্নে বিভোর ছিলেন, তাদের চাপ ছিল ৭ মার্চে রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। বাংলার স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরণে যারা বিশ্বাসী ছিলেন, তাদের চেতনার মণিকোঠায় ছিল ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেবেনÑ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যাতে তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে বিশেষ করে এই বাংলার মানুষকে তারা ভুল বোঝাতে না পারে, আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে। তাই বঙ্গবন্ধুকে অতি সুকৌশলে স্বাধীনতার বার্তাটি উচ্চারণ করতে হবে, যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে।
তিনি বলেন, মানিক মিয়ার চিন্তার উত্তরাধিকারী হিসেবে সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ আওয়ামী লীগের বেশ কিছু প্রবীণ নেতা বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়েছিলেন, ক্ষমতার পথ ব্যবহার করাই হচ্ছে বাংলার কল্যাণের ও শোষণের প্রতিশোধের একমাত্র উপায়। জন-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা এবং সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি যাদের প্রতীতি ও প্রত্যয় ছিল অবিচল, তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আমাদের চেতনার আঙ্গিকে যারা আমার অগ্রজ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, এনায়েতুর রহমান, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ ছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন, ম্যান্ডেটের পর আঘাত হানলে জীবনের বিনিময়ে হলেও শুধু প্রতিরোধই নয়, প্রত্যাঘাতও করা হবে। উল্লিখিত তিনটি শক্তিকেই বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুকৌশলে পোষ মানিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সমস্ত সত্তায় বাংলার মানুষের হৃদয় অনুরণিত হতো। এ কারণেই স্বাধীনতা-পূর্বকালে সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে তিনি বাংলার মানুষকে একটি অদৃশ্য ঐক্যের রাখিবন্ধনে বাঁধতে পারলেন।
উল্লেখ্য, তখন বিশ্ব ছিল দুই ব্লকে বিভক্তÑ সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মতো একটি ক্ষুদ্র দেশের পক্ষে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। এমন স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির হাল ধরেন শক্ত হাতে। আমরা সচরাচর দেখি, বেশির ভাগ নেতার কথা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। অনেকেই ‘পুঁজিবাদ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ’, ‘বুর্জোয়া’, ‘পেটিবুর্জোয়া’ ও ‘প্রোলেতারিয়েত’ ধরনের কিছু গৎবাঁধা শব্দ ছাড়া সাধারণ মানুষের ভাষায় যেন কথাই বলতে পারে না। বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে এমন কোনো শব্দ ব্যবহার করতেন না। কৃষক-শ্রমিক-রাজনীতিক-শিক্ষক সবাই তার কথা বুঝতে পারত। তন্ময় হয়ে শুনত।
তৎকালীন অনেক বাঘা বাঘা নেতৃত্বকে পেছনে ফেলে শেখ মুজিব সবার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন তার সাহস ও স্বকীয়তায়। তার সামগ্রিক ত্যাগ ও সাহসী নেতৃত্বের ফলেই বাঙালি পেয়েছে হাজার বছরের কাক্সিক্ষত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।
পরাধীন মানুষের নেতা হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে জন্মদিন পালন পছন্দ করতেন না। উৎসবের নামে ব্যয়বাহুল্যগুলো তিনি কখনো প্রশ্রয়ও দেননি। তার বাসায়ও কখনো জন্ম উৎসব পালিত হতো না। কিন্তু যে কটা জন্মদিন তার জেলে কেটেছে সেই মুহূর্তগুলোর বিশেষ এই দিনটাকে পরিবারের সবার খুব বেশি মনে পড়ত। জন্মদিনে তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়ে আগে থেকেই জেল কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিতেন বঙ্গবন্ধুর পরিবার। একবার দেখা করার অনুমতিও পেয়েছিলেন। পরিবারের সদস্যরা তার জন্য কিছু ফুল, মিষ্টি আর কয়েকটি বই নিয়ে গিয়েছিলেন। পরিবারকে কাছে পেয়ে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বঙ্গবন্ধুর চোখ-দুটো চিকচিক করে উঠেছিল। তাকে জন্মদিনের শুভকামনা জানিয়ে নীরবে ফিরে এসেছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা। নিজ থেকে জন্মদিন পালন না করলেও একাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত সমগ্র জাতি আপন অনুভূতির আলোকে উদযাপন করে প্রিয় নেতার জন্মদিন। এদিন ভোর থেকেই চেনা-অচেনা মানুষে ভরে যেত ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাড়ির আঙিনা। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ভরা থাকত তাদের মুখ। হাজারো মানুষের সঙ্গে মিলিত হতে পেরে বঙ্গবন্ধুও উচ্ছল হয়ে উঠতেন। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ এই ছয় বছরের সব দৈনিক পত্রিকা ঘেঁটে তৈরি করা হয়েছে এই প্রতিবেদন।
১৭ মার্চ ১৯৭১, বুধবার
কালো পতাকা-শোভিত ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িতে ছিল না কোনো বিশেষ আয়োজন। এদিন রাজনৈতিক সংকট নিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক করেন। রমনা পার্কের বিপরীত পাশে প্রেসিডেন্ট ভবনে এক ঘণ্টা বৈঠক শেষে বেলা ১১টা ৬ মিনিটে কালো পতাকা-শোভিত গাড়িতে করে বের হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু। দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীরা গেটে তাকে ঘিরে ধরেন। গেটের একটু সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের উদ্দেশ বলেন, ‘দেখুন, আমার কিছুই বলার নাই। আলোচনা অব্যাহত আছে।’ এরপর বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনের দিকে রওনা দেন। সাংবাদিকরাও তার পিছু নেন। ৩২ নম্বরের বাড়িতে সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরলেন। বললেন, আজ আপনার ৫২তম জন্মদিন। জন্মদিনে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই। বঙ্গবন্ধু বেদনার্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি তো আমার জন্মদিন পালন করি না। আমি তো আমার জন্মদিনে কেক কাটি না, মোমের বাতি জ¦ালি না। যে দেশের মানুষ কথায় কথায় গুলি খায়, অনাহারে-অর্ধাহারে মৃত্যুবরণ করে; সে দেশের নেতা হিসেবে আমার জন্মদিনই-বা কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমি তো আমার জীবন বাংলার জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি। আমার জন্মদিনের একমাত্র বক্তব্য হলোÑ লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলতে থাকবে। সত্য ও ন্যায় আমাদের পক্ষে। জয় আমাদের অনিবার্য।’ শেখ মুজিবের মুখে এই সংগ্রামের আহ্বান ও বিজয়ের বাণীই সেদিন মুখ্য হয়ে ওঠে।
ওইদিন সন্ধ্যার পর লোকজন ছোট-বড় মিছিল নিয়ে ফুলের তোড়া ও কেক হাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে গিয়ে হাজির হন। লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় অত্যন্ত ঘরোয়া পরিবেশে বঙ্গবন্ধু লনে এসে শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে আন্তরিকতায় মেতে ওঠেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে রবীন্দ্র কাব্যের কয়েকটি চরণ ঘুরে-ফিরে উচ্চারিত হচ্ছিলÑ ‘চারদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ^াস/শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’ তার মুখে ছিল নজরুলের কবিতাÑ ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত;/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল/আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ/ভীম রণভূমে রণিবে না।’ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে স্থানীয় গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ভিত্তিতে ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ’ নামাঙ্কিত একটি রেকর্ড প্রকাশ করে।
১৭ মার্চ ১৯৭২, শুক্রবার
বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিনটি ছিল অনাড়ম্বর কিন্তু গভীর আন্তরিকতার। এ দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তিন দিনের সফরে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন। জন্মদিন উপলক্ষে শ্রীমতি গান্ধী ভারতের পঞ্চান্ন কোটি মানুষের শুভেচ্ছা, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের নিদর্শনস্বরূপ স্বদেশে থেকে ফল ও মিষ্টি নিয়ে আসেন। তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমেই তিনি এসব উপহার বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে পাঠিয়ে দেন। এর আগে স্নিগ্ধ সকালে হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগী সমবেত হয় ৩২ নম্বর বাড়ির সেই অতিপরিচিত অঙ্গনে। তাদের দেখে স্মিতমুখে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘আমার আবার জন্মোৎসব কিরে? আয় আয় তোরা আমার কাছে আয়।’ এ যেন নেহাত কোনো ব্যক্তির আমন্ত্রণ নয়, যেন ছিল একটি সাগরের আহ্বান। শ্রদ্ধার বিনম্র চিত্তে সবাই এগিয়ে এলো। প্রিয় নেতার হাতে তুলে দিল পুষ্পস্তবক। গলায় পরিয়ে দিল মালা।
এদিন সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে তেজগাঁও বিমানবন্দরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। সঙ্গে ছিল ছোট ছেলে শেখ রাসেল। শ্রীমতি গান্ধী সস্নেহে রাসেলের মাথায় হাত বুলান। গার্ড অব অনার দেওয়ার পর আলোকচিত্র-সাংবাদিকদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু ও শ্রীমতি গান্ধীকে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয়। এরপর তারা একটি হেলিকপ্টারে করে বঙ্গভবনের উদ্দেশে রওনা হন। অপরাহ্ণে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু ও শ্রীমতি গান্ধী বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে ওইদিন ঢাকার প্রভাতি দৈনিকগুলো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে।
১৭ মার্চ ১৯৭৩, শনিবার
আগের দিন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। বাহ্যিক আড়ম্বর নয়, হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসার ঐশ^র্য দিয়ে সমগ্র জাতি, বঙ্গবন্ধুর ৫৪তম জন্মদিন পালন করে। ভোরের সূর্য পূর্ণদীপ্তি নিয়ে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই জাতির জনকের বাসভবনের সামনে শুভেচ্ছা প্রকাশে ইচ্ছুক মানুষের ভিড় জমে যায়। বঙ্গবন্ধু সকালে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করে জনতার কাতারে নেমে আসেন। শুভেচ্ছা গ্রহণ ও মাল্যভূষিত হওয়ার সময় জাতির জনক আবেগরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সেদিন নিরাপত্তাব্যবস্থার দিকে খেয়াল ছিল না বঙ্গবন্ধুর। ভোরবেলা থেকে যে জনস্রোত তলায় এবং গেটের সামনে ভিড় জমে যায়। গণভবনে সমবেত জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনাদের ভালোবাসা আর আশীর্বাদ ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নাই। আর কিছু পেতেও চাই না। আমি যা পেয়েছি, বিশে^র কোনো নেতা এতটা পেয়েছেন কি না জানি না। এত পাওয়া খুব কম লোকের ভাগ্যেই ঘটে। এখন কামনা হচ্ছে, আমি যেন এ দেশের মানুষের মুখে হাসি দেখে মরতে পারি।’ প্রিয় জনগণকে কাছে পেয়ে বঙ্গবন্ধু আনন্দে মেতে উঠেছিলেন। পরে তিনি সবুজ লনে নেমে খাঁচায় রক্ষিত একটি ময়ূর ও হরিণ-ছানাকে নিজ হাতে খাওয়ান এবং অনুগামী সাংবাদিকদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় যোগ দেন।
১৭ মার্চ ১৯৭৪, রবিবার
চুয়াত্তরে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটা ছিল অন্যরকম। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার নবতর সংগ্রামে দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১১ মার্চ হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক নূরুল ইসলাম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে সম্পূর্ণ বিশ্রামের পরামর্শ দেন। মন্ত্রিসভার সদস্য সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতারা, ছাত্রনেতাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে তার বাসভবনে সমবেত হন। উপহারস্বরূপ পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলতে সকাল থেকেই আলোকচিত্রীরা ভিড় জমান। রশীদ তালুকদারের ক্যামেরা নিয়ে বঙ্গবন্ধু ছবি তুলতে থাকেন। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. মজহারুল ইসলাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ শীর্ষক বইটি বঙ্গবন্ধুর হাতে অর্পণ করেন। ওইদিন অসুস্থ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ দুই নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। সরকারি ও বেসরকারি ভবনের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিবসটি সূচনা হয়। বিভিন্ন মসজিদে বঙ্গবন্ধুর সুস্থতা কামনা করে মিলাদ মাহফিল ও বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করা হয়। ১৯ মার্চ সকালে উন্নত চিকিৎসার জন্য মস্কোতে রওনা হন। বঙ্গবন্ধুকে মস্কোতে নিয়ে যাওয়ার জন্য সোভিয়েত সরকার একটি বিশেষ বিমান ও দুজন শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ পাঠান।
১৭ মার্চ ১৯৭৫, সোমবার
কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা সবাই বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে নিয়ে যান ফুল। কেউ নিয়ে যান ফুলের মালা। কেউবা প্রস্ফুটিত গোলাপ। প্রাণের সব অর্ঘ্য ঢেলে গুঁজে দেন নেতার হাতে। মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু কখনো গলা বাড়িয়ে, কখনো হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেন সেই ফুল। সেই ফুল তিনি বেশিক্ষণ তার কাছে রাখেননি। পাঠিয়ে দিয়েছেন সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ভাষাশহীদদের সমাধিতে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কমপক্ষে ৫০ হাজার লোকের সমাগম হয়। বঙ্গবন্ধু সবার আগে তার অসুস্থ পিতার সঙ্গে মিলিত হন এবং জন্মদিনের মাহেন্দ্রক্ষণে জন্মদাতার আশীর্বাদ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি দোতলা থেকে নেমে এসে জনতার সঙ্গে মিলিত হন। সেদিন নেতা ও জনতার সম্মিলনে কোনো বাধা ছিল না। ছিল না কোনো রাষ্ট্রীয় প্রটোকল। সকাল ৭টা থেকে সোয়া ১১টা পর্যন্ত চার ঘণ্টার বেশি সময় তিনি শুভার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জনতার এই স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দনে নিজেও মাঝে মাঝে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে কবিগুরুর ‘সোনার তরী’ থেকে কবিতা আবৃত্তি শুরু করেন। বেলা ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু সমবেত শুভার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার জন্মদিনে আমি ছুটি ঘোষণা করি নাই। তাই আজ আমি অফিসে যাব। অল্পক্ষণের জন্য হলেও অফিসের কাজ করব।’ বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে তিনি গণভবনের উদ্দেশে বাসভবন ত্যাগ করেন। গণভবনে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েরা বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে এলে তিনি খুদে অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে গণভবনের পুকুরে মাছ দেখাতে যান।
ঢাকাকে বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে এখন পর্যন্ত যেসব পরিকল্পনা বা মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কিন্তু জনঘনত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এক-তৃতীয়াংশ নগর সুবিধায় ঢাকায় চার গুণের বেশি মানুষের বসবাস। অবকাঠামো বিবেচনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ বহন করছে দেশের রাজধানী শহর।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রণীত ঢাকার ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)’ ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিকল্পিত শহরের ৬০ ভাগ জায়গায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রাখা হয়। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ নগরবাসীর প্রয়োজনের আলোকে অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ৪০০ বছরের পুরনো শহর ঢাকায় সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে প্রায় ২৪ ভাগ। আর অবকাঠামো তৈরি হয়েছে ৭৬ ভাগ জায়গায়। একটি পরিকল্পিত শহরে প্রতি একরে সর্বোচ্চ ১০০-১২০ জন বসবাস করে। ঢাকায় বর্তমানে একর প্রতি বসবাস করছে ৪০০-৫০০ জন।
দুই সিটিতে বিভক্ত ঢাকা মহানগরের আয়তন ৩০৫ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী শহরে জনসংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮২। তবে বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়।
রাজউকের ড্যাপের তথ্যমতে, ঢাকায় সড়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৪৫ ভাগ, জলাশয় রয়েছে ১৩ দশমিক ৯২ ভাগ এবং উন্মুক্ত স্থান রয়েছে ১ দশমিক ৩৫ ভাগ। জনঘনত্ব হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় একরপ্রতি জনঘনত্ব ৩৯৩ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসবাসকৃত এলাকার জনঘনত্ব ৫০০ জন।
ড্যাপে আরও বলা হয়েছে, ঢাকার লালবাগ এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৫১ জন মানুষ বসবাস করে। জনঘনত্বের দিক থেকে যা বিশে^র সর্বোচ্চ। চকবাজারে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ৩০ হাজার ১২২ জন মানুষ বসবাস করে। যা বিশে^ তৃতীয়। কোতোয়ালিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ লাখ ১ হাজার ৬৯৩ জন বসবাস করে। যা জনঘনত্বের দিক থেকে বিশে^ দশম।
রাজউকের নগরপরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে হলে মূল ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হবে। এ জন্য ঢাকার আশপাশে পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সেখান থেকে ঢাকার সঙ্গে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগের জন্য অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাহলে মূল ঢাকার জনঘনত্ব কমবে। আর জনঘনত্ব কমলে মূল ঢাকা অনেকাংশ বসবাস উপযোগী হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ঢাকায় জলাভূমি ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমেছে ১৩৪ বর্গকিলোমিটার। আর এ সময়ে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কংক্রিট। ইতিমধ্যে ঢাকার দুই সিটি এলাকার প্রায় ৮২ ভাগ কংক্রিট আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে।
পরিকল্পনাবিদদের এ সংগঠটি বলছে, পরিকল্পিত নগর গড়ে তুলতে সড়ক থাকা দরকার ২৫ শতাংশ, জলাশয় ১৫ শতাংশ, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থান থাকা দরকার ২০ শতাংশ। অর্থাৎ নাগরিক সুবিধার জন্য ৬০ ভাগ জায়গা খালি থাকা দরকার। আর ৪০ ভাগ জায়গায় আবাসন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, মার্কেট গড়ে উঠবে। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব এবং অন্যান্য বিবেচনায় সড়ক, জলাশয়, সবুজ ও উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। তবে কোনো শহরের ৪০ ভাগের বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করলে তার বাসযোগ্য পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
নিরাপত্তার বিবেচনায়ও ঢাকা যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে, সেটা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৮ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৫ শতাংশ। আর গত বছর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গ্লোবাল লাইভবিলিটি ইনডেক্স অনুসারে ঢাকা বিশে^র সপ্তম কম বসবাসযোগ্য শহর।
চলতি মাসে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সাড়ে আট ভাগ সবুজ রয়েছে। ঢাকার উন্মুক্ত স্থান ও জলাশয়কেন্দ্রিক সুবজ এলাকা ধরে এ গবেষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার বর্তমান সড়ক, জলাশয় ও উন্মুক্ত স্থান রয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। আর জনসংখ্যা রয়েছে চার গুণ অর্থাৎ, ঢাকা অবকাঠামোর তুলনায় প্রায় ১২ গুণ বেশি চাপ নিয়ে চলেছে। ভালো হতো ১২ ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যা থাকলে।
তিনি বলেন, ঢাকার বাস্তবতা বিবেচনায় চাইলেই আদর্শ জায়গায় যাওয়া সম্ভব হবে না। ইচ্ছা করলেই এখন সড়কের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে এখনো কিছু উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে। সেটা হলো, বিদ্যমান সড়কগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে।
ড. আদিল বলেন, ‘ঢাকার উন্মুক্ত জায়গা বাড়ানো তো দূরের কথা, যেগুলো আছে সেগুলোও টিকিয়ে রাখতে পারছে না সরকার। এ জন্য পলিসি পর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনতে হবে। এখনো ঢাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ে ছোট ছোট উন্মুক্ত জায়গা সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া রাজউকের ড্যাপের কিছু প্রস্তাবনা রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করে ঢাকার জনঘনত্ব কমানো এবং গণপরিসর বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি ঢাকার জনঘনত্ব কমাতে ঢাকায় নতুন কোনো কর্মস্থান সৃষ্টি করা যাবে না। যেমন শিল্প, কলকারখানা এবং অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তাহলে জনসংখ্যার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে।’
পরিকল্পনা হয় বাস্তবায়ন হয় না : ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে ১৯১৭ সালে নগরপরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডিসকে দিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান করে ব্রিটিশরা। এটাকে মাস্টারপ্ল্যানের ধারণাপত্র বলা হয়। এর নাম ছিল ‘ঢাকা টাউন প্ল্যান’। ঢাকা সমতল আর বৃষ্টিপ্রবণ শহর। এ দুটো বাস্তবতা ধরে বিশদ পরিকল্পনার সুপারিশ করেন ওই নগরপরিকল্পনাবিদ। কিন্তু ওই সুপারিশের আর বাস্তব রূপ পায়নি। সে সময় ঢাকার চারদিকে চারটি নদীর পাশাপাশি শহরে অনেক খালও ছিল। একসময় শহরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৫০টি প্রাকৃতিক খাল দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে নদীতে পড়ত। ফলে জলাবদ্ধতা হতো না। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৮-১০ লাখ।
এরপর পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য আরেকটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী বেশ কিছু অবকাঠামো, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়। তবে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ১৯৫৯ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ।
বাংলাদেশে পরিকল্পনাবিদদের সমন্বয়ে ঢাকার জন্য প্রথম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয় ২০১০ সালে। সে সময় ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় কোটি ধরা হতো। রাজউকের নেতৃত্বে প্রণয়ন করা এ মাস্টারপ্ল্যানের নাম ড্যাপ। মাস্টারপ্ল্যানটি পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য নগর গঠনের সূচকের বিবেচনায় ৭০ ভাগ সঠিক ছিল। তবে ৩০ ভাগ নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। ২০১৫ সালে ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর ২০১৬ থেকে ২০৩৫ সালের জন্য ড্যাপ সংশোধন করা হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে সংশোধিত ড্যাপ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এবারের ড্যাপে ঢাকার জনঘনত্ব কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা সব সময়ই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ক্ষেত্র বিশেষে এরা নীতিনির্ধারকও হয়ে ওঠে। ক্ষমতার মধু আহরণে এরা সামনের কাতারে থাকলেও, পালাবদলের আগেই ওরা রূপ পাল্টাতে শুরু করে! ওদের কাছে কি কোনো বার্তা আছে বদলে যাওয়া বা বদলে ফেলার বার্তা?
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসের মাটিতে কেমন যেন একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, এরাও যেন দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রূপ পাল্টে যারা আওয়ামী সেজে এতদিন চারদিক দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন, খোলস পাল্টাতে এদের কেউ কেউ প্রস্তুতি শুরু করেছেন, প্রবাসের মাটিতে এরা রূপ পাল্টিয়ে ইতিমধ্যে নতুন রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন। এরা কি তাহলে নতুন কোনো আগমনী বার্তায় উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন? কী সেই বার্তা? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তনের বার্তা দেওয়ার মালিক জনগণ, আর তার একমাত্র উপায় গণভোট। এখনো সেই গণভোটের বাকি এক বছর, তাহলে বসন্তের কোকিলদের মাঝে এত দৌড়ঝাঁপ কেন?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতা নামের লগ্নিকারকদের দারুণ প্রভাব। সরকার ও রাজনীতিতে আড়ালে-আবডালে এরা নানাভাবে কলকাঠি নাড়ে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, উন্নয়ন অংশীদার বা দাতা পরিচয়ে এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নানারকম কর্মকা- চালায়। সোজাসাপ্টা ভাষায়, আমরা যাদের ডিপ্লোমেট বা কূটনীতিক নামে চিনি, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী এদের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকা- নিয়ে সরব হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়েও এরা তৎপর হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মানবাধিকারের নামে চাপাচাপির বার্তা চালায়।
প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, নিষেধাজ্ঞার খড়্গ আসতেই পারে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাদের মানবাধিকার তখন জাগ্রত হলো না!
একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ যারা নিহত হলেন, তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হলো, পার্লামেন্টারিয়ান আহসান উল্লাহ মাস্টার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হলেন, তখনো এদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না! সাঈদীকে চাঁদ দেখার গুজব রটিয়ে শত শত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অঙ্গার হয়ে অসার দেহ পড়ে থাকল, তখনো তাদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না!
একুশ বছরে বিকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠে একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-ই সত্যরূপে আবির্ভূত হয়। গত এক যুগে একাত্তরের পরাজিত আদর্শের অনুসারী একদল সুবিধাবাদী রঙ পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই ধারাটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসের মাটিতেও সক্রিয় ছিল। কূটনীতিকদের লম্ফঝম্ফ দেখে এরা আবারও রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। এতদিন ‘জয়বাংলা’ বলে যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে তাদের আপত্তি!
অগ্নিঝরা মার্চ আর বিজয়ের ডিসেম্বর! এ মাস দুটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের মাস। তবুও এ মাসগুলোতেই যেন কিছু মানুষের হৃদয়ের দহন বেড়ে যায়! যন্ত্রণায় এদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। অন্তরাত্মাকে শীতল করতে এরা প্রচন্ড প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এর অন্তরালে কাজ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুদূরপ্রসারী হীন প্রচেষ্টা। এই ঘৃণ্য অপশক্তির প্রথম টার্গেট ছিল ১৫ আগস্ট।
একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দিন। পনেরো আগস্ট, ৩ নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কময় দিবস। প্রবাসে থাকলেও এসব দিবসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি না। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকেই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। ২০২২-এর বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আয়োজকদের মতে, প্রবাসের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকশিত করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। উপস্থিত বারোজন সংবর্ধিত মুক্তিযোদ্ধার একজন বাদে কেউই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলেননি! এ মহান নেতার নামটিও উচ্চারণ করেননি। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে চলার এমন হীন চেষ্টা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন, বিশ্বব্যাংককে অবজ্ঞা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাত-দিন কাজ করছেন, তবুও চারদিকে এত ষড়যন্ত্র কেন?
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়ক শাসক দলের ব্যাপক ক্ষমতাবান নেতাদের মুহূর্তে কপর্দকহীন করে শেখ হাসিনা তাদের আইনের মুখোমুখি করেছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ চক্র, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে রেল আর সড়ক যোগাযোগে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত অবধি বিস্তৃত হচ্ছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এতসবের পরও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আবারও বঙ্গবন্ধুর নামকে মুছে দিতে দেশি-বিদেশি লম্ফঝম্ফ দৃশ্যমান হচ্ছে! স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করেই এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এরা দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সোল এজেন্ট, এদের রুখতেই হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়ন গবেষক
ক্যালগেরি, কানাডা
আজ বুধবার (২৯ মার্চ) ভোর ৫টায় দৈনিক প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমবাগান এলাকার নিজ বাসা থেকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)-এর একটি দল।
স্বাধীনতা দিবসে প্রথম আলো পত্রিকার আলোচিত রিপোর্টটির কারণে তাকে আটক করা হয়েছে বলে সিআইডির দলটি উপস্থিত ব্যক্তিদের জানিয়েছেন।
এভাবে গভীর রাতে তল্লাশি চালিয়ে একজন সংবাদকর্মীকে আটক বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর চরম আঘাত বলে মনে করে গণতন্ত্র মঞ্চ। এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃবৃন্দ।
কুখ্যাত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বানানোর পর থেকেই বিরোধী মতের রাজনৈতিক কর্মীরা যেমন মতপ্রকাশ করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তেমনি গণমাধ্যম কর্মীরাও নির্যাতিত হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলামসহ সারাদেশে বহু গণমাধ্যমকর্মীদের ওপরই সরকারি সংস্থা কিংবা দলের লোকের নির্যাতনের খবর এসেছে। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে শামসুজ্জামান শামসকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানাচ্ছে। সেই সাথে গণমাধ্যম কর্মীসহ মত প্রকাশের অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে তাদের মামলা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবী জানান নেতৃবৃন্দ।
চারদিকে পাহাড় ও সবুজের অরণ্য। এই সবুজ বিনাশ করে সড়ক নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। পাহাড়ি এলাকায় সড়ক নির্মাণের প্রকৌশলগত জ্ঞানের অভাব কিংবা অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা, রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার অংশ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের আওতায় চলে যাওয়া বা রেল লাইনের ওপর ব্রিজ নির্মাণসহ নানা জটিলতায় একের পর এক আটকে যাওয়া প্রকল্পটি ইতিমধ্যে ২৭ বছর পার করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ও পরিমার্জনে শুরুর ৪০ কোটি টাকার প্রকল্প এখন ৩৫৩ কোটিতে পৌঁছেছে। তারপরও শেষের দেখা নেই ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ ডিটি-বায়েজীদ (বায়েজীদ লিংক রোড) সংযোগ সড়কের।
দীর্ঘদিন ধরে রেললাইনের ওপরে নির্মিত ব্রিজের কাজ প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পর এখন চলছে। গত সপ্তাহে দেখা যায়, রেললাইনের ওপরের অংশে গার্ডার বসানোর কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন। এতদিন রেললাইনের উভয় প্রান্তে গার্ডার বসলেও রেললাইনের ওপরের অংশে খালি রাখা হয়েছিল। রেললাইন বিড়ম্বনার পাশাপাশি রোডের গা ঘেঁষে রয়েছে সুউচ্চ পাহাড়। টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ধসে রাস্তার ওপর পড়তে পারে এবং এতে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। অর্ধকাটা এসব পাহাড় নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও রোড নির্মাণ বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মধ্যে বিরোধ চলছে। পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১০ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। অর্ধকাটা এসব পাহাড় কেটে ঝুঁকিমুক্ত করার বিষয়ে শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এখনো এর সুরাহা নেই। যথারীতি আরেকটি বর্ষা আসছে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে খাড়া পাহাড়। বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে জানমালের ক্ষতি হতে পারে সেই শঙ্কায় গত বছর বর্ষায় এই রোডে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে। এবারও কি একই পথে হাঁটতে হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে কথা হয় রোড বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের সঙ্গে। তিনি বলেন, পাহাড়ের বিষয়টি নিয়ে এই সপ্তাহে পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে আমাদের মিটিং রয়েছে। আশা করছি বিষয়টি সুরাহা হবে।’
এদিকে পাহাড় নিয়ে সুরাহার পথ সুগম হলেও জনগণের যাতায়াতের ওপর টোল বসাচ্ছে সিডিএ। চট্টগ্রাম মহানগরীতে নগরবাসীর চলাচলের কোনো পথে টোল নেই (কর্ণফুলী সেতু ও টোল রোড ছাড়া)। এরমধ্যে টোল রোডটি শুধুমাত্র পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলের জন্য নির্মিত। কিন্তু ডিটি-বায়েজীদ সংযোগ সড়কে টোল যুক্ত হতে যাচ্ছে। ৩২০ কোটি টাকার প্রকল্প সরকার ৩৫৩ কোটি টাকায় বর্ধিতকরণের অনুমোদনের সময় অতিরিক্ত ৩৩ কোটি টাকা টোল আদায়ের মাধ্যমে পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘রোড মেইনটেনেন্স আমরা করব। একইসঙ্গে সড়কবাতি স্থাপন, রেললাইনের ওপরে ব্রিজ নির্মাণ, নালা সংস্কার কাজগুলো নতুন করে করা হবে।’ টোল প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘টোল প্লাজা বসবে ফৌজদারহাট অংশে। শহর প্রান্ত দিয়ে এসে টোল প্লাজা ক্রস করলেই শুধুমাত্র টোল দিতে হবে। রোডের সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে গেলে টোল দিতে হবে না।’
কবে নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে পারে জানতে চাইলে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, চলতি বছরের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করে দ্বিতীয় ব্রিজটি চালু করে আনুষ্ঠানিকভাবে তা ওপেন করে দিতে চাই। যদিও ইতিমধ্যে এই রোড দিয়ে অনেক যান চলাচল করছে। কিন্তু ওভারব্রিজটি চালু না করায় তা পূর্ণতা পায়নি।
টোল কবে থেকে যুক্ত হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আগামী বছর থেকে টোল যুক্ত হতে পারে।’
সড়কের ইতিবৃত্ত বায়েজীদ বোস্তামী রোডের সঙ্গে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোডকে (ডিটি রোড) যুক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রায় ছয় কিলোমিটার পাহাড়ি এলাকার ওপর দিয়ে এই রোড নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ৪০ কোটি টাকার সেই প্রকল্পের অধীনে ব্যাপক হারে পাহাড় কেটে সড়ক নির্মাণ করলেও বর্ষা এলেই পুরো রাস্তাসহ পাহাড়ি ঢলে চলে যেত। ফলে প্রকল্পটি বারবার হোঁচট খায়। এই প্রকল্পের মাঝখানের এক কিলোমিটার অংশ আবার এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন করার সময় তাদের ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে যায়। ফলে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ক্যাম্পাসের বাইরে দিয়ে নতুন করে বাঁক নিয়ে সড়কের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। দুই লেনের সেই প্রকল্প প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৭২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে এসে আবারও নকশায় পরিবর্তন। এবার দুই লেনের পরিবর্তে চার লেনে উন্নীত করা হয়। যথারীতি বাজেট ৩২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। ২০২১ সালে এসে তা ৩৫৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
প্রথমবারের মত মা হলেন চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি।
মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) রাত ১১টা ২০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মাহির স্বামী রাকিব সরকার।
তিনি জানান, মা ও ছেলে দুজনেই সুস্থ আছেন। পুত্রের নাম এখনও ঠিক করা হয়নি বলে জানান তিনি।
২০১২ সালে ‘ভালোবাসার রঙ’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে বড়পর্দায় অভিষেক ঘটে রাজশাহীর মেয়ে মাহির। পরবর্তীতে ‘অগ্নি’ ‘কী দারুণ দেখতে, ‘দবির সাহেবের সংসার’, ‘অনেক সাধের ময়না’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’সহ বেশ কয়েকটি আলোচিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
দুই বছর আগে গাজীপুরের ব্যবসায়ী রকিবকে বিয়ে করেন মাহি। তার কয়েক মাস আগে পারভেজ মাহমুদ অপুর সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মা হচ্ছেন বলে খবর দিয়েছিলেন এই চিত্রনায়িকা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’