
শেখ মুজিবর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার এই যাত্রাপথে বিভিন্ন মানুষ নানাভাবে জড়িয়ে রয়েছেন। যেসব ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন, নিঃসন্দেহে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাদের মধ্যে উজ্জ্বলতম মানুষ। তাদের দুজনের সম্পর্ককে অনেকে গুরু-শিষ্য বলেও মহিমান্বিত করেছেন। আর কে না জানে, সুফি ও বাংলার গুরুবাদী ভাবধারায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্কটি দ্বিপাক্ষিক। শিষ্য যেমন গুরুর কাছ থেকে নেন, গুরুও শিষ্যর কাছ থেকে নেন। এই লেনদেন না হলে সম্পর্ক স্থাপিত হয় না, ভালোবাসাও খাঁটি হয় না। এই দেওয়া-নেওয়া বস্তুবাদীও হতে পারে, আধ্যাত্মিকও হতে পারে। এসব তত্ত্ব আলাপের চেয়ে আমরা বরং বঙ্গবন্ধু ও সোহরাওয়ার্দীর সম্পর্কটি বোঝার চেষ্টায় প্রবিষ্ট হই। এই লেখার সেটাই উদ্দেশ্য।
বঙ্গবন্ধুর মাত্র ৫৫ বছরের জীবন পর্যালোচনা করতে গেলে আমাদের বারবার তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়তে হবে। আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হলো, কেমন করে তার সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম, কীভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তার স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।’
১৯৩৮ সালের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়েন। শহরে আসবেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরির দায়িত্ব পড়ল কিশোর শেখ মুজিবের ওপর। সভা শেষে সোহরাওয়ার্দী গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। স্কুলের ছাত্রদের পক্ষে তাকে সংবর্ধনার নেতৃত্বের ভার বঙ্গবন্ধুর কাঁধে। স্কুল থেকে সোহরাওয়ার্দী যখন ফিরছিলেন, হাঁটতে হাঁটতে তাকে লঞ্চঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু। তখনই প্রিয় গুরুর সঙ্গে প্রথম আলাপ কিশোর মুজিবের।
ভাঙা ভাঙা বাংলায় বঙ্গবন্ধুকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলেন সোহরাওয়ার্দী। নোটবুক বের করে নাম-ঠিকানা টুকে নিলেন। পরে একটা ধন্যবাদ চিঠিও পাঠান। আরও বললেন, বঙ্গবন্ধু যেন কলকাতায় গেলে তার সঙ্গে দেখা করেন।
বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতায় গেলেন, সোহরাওয়ার্দীর বাড়ির দারোয়ান প্রথমে তাকে ঢুকতে দিতে চাননি। সোহরাওয়ার্দী তখনো মন্ত্রী। তার দেওয়া কার্ডটি দারোয়ানকে দেখালেন শেখ মুজিব। কার্ড দেখে তাকে তাড়াতাড়ি ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘ম্যাট্রিক তো পাস করে ফেলেছো, এখানেই কলেজে ভর্তি হও। আমার সঙ্গেও কাজ করো।’ এভাবেই বঙ্গবন্ধু কাজ শুরু করেন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্রলীগের প্রাদেশিক শাখায়।
মুসলিম লীগ ভাগ হওয়ায় ছাত্রলীগও বিভক্ত হয়ে যায়। নাজিমুদ্দীন সমর্থিত গ্রুপটির নেতৃত্ব দেন শাহ আজিজুর রহমান। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপকে সমর্থন দিতে থাকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ।
বঙ্গবন্ধুকে ভীষণ স্নেহ করতেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এর একটি প্রমাণ বঙ্গবন্ধুর প্রথম লাহোর সফর। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী পার্টি গঠন বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরামর্শ করতে তাকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কিন্তু লাহোর পৌঁছে বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন, সোহরাওয়ার্দী সেখানে নেই। তখন শীতকাল। এদিকে বঙ্গবন্ধুর কাছে শীতের কাপড়ও নেই। তিনি উপায় না দেখে পূর্বপরিচিত মিয়া ইফতিখার উদ্দিনের বাড়িতে ওঠেন।
সোহরাওয়ার্দী লাহোর ফিরলেন বঙ্গবন্ধু যাওয়ার দুদিন পর। তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন সোহরাওয়ার্দী। খোঁজখবর নিলেন। তারপর একান্তে কথা বললেন স্নেহের শিষ্যের সঙ্গে। তার থাকার জন্য নিজে হোটেল ঠিক করে দিলেন। দোকানে নিয়ে জামা-কাপড় কিনে দিলেন। সেবার লাহোরে থাকার দিনগুলোতে সকালে সোহরাওয়ার্দীর কাছে গিয়ে রাতে ফিরতেন বঙ্গবন্ধু। সারা দিন আলাপ চলত দুজনের।
স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জীবনের বহুদিন তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছি। তার স্নেহ পেয়েছি এবং তার নেতৃত্বে বাংলার লোক পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। যার একটা ইঙ্গিতে হাজার হাজার লোক জীবন দিতে দ্বিধাবোধ করত না, আজ তার কিছুই নেই। মামলা না করলে তার খাওয়ার পয়সা জুটছে না। কত অসহায় তিনি! তার সহকর্মীরা- যারা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করত, তারা আজ তাকে শত্রু ভাবছে। কত দিনে আবার দেখা হয় কী করে বলব? তবে একটা ভরসা নিয়ে চলেছি, নেতার নেতৃত্ব আবার পাব। তিনি নীরবে অত্যাচার সহ্য করবেন না, নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করবেন। পূর্ব বাংলায় আমরা রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করতে পারব এবং মুসলিম লীগের স্থান পূর্ব বাংলায় থাকবে না, যদি একবার তিনি আমাদের সাহায্য করেন। তার সাংগঠনিক শক্তি ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব জাতি আবার পাবে।’
সোহরাওয়ার্দীও স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধুকে তারকা সংগঠক আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন রাজনীতির উত্তপ্ত মাঠের দুর্বার কর্মী। স্নেহের মুজিবের জন্য অনেক করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে ১৯৫৮ সালের এপ্রিলে তিনি যখন আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় অংশ নিতে ঢাকায় আসেন, তখনই বুঝতে পেরেছিলেন শেখ মুজিব সে-ই কাঁচা হীরার টুকরা, যাকে সামান্য দিকনির্দেশ দিতে পারলেই পূর্ব বাংলা তার সবচেয়ে বলিষ্ঠ নেতা পাবে।
ওই বছরই তার প্রস্তাব অনুসারে পশ্চিমা রাজনীতি ও অর্থনীতির রূপরেখা নিয়ে জ্ঞান বাড়াতে বঙ্গবন্ধুকে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে শিক্ষা সফরে পাঠায় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি। দুই মাসের সেই ট্যুরে তিনি সবচেয়ে বেশি সময়, ১২ দিন কাটিয়েছিলেন লন্ডনে।
বঙ্গবন্ধুর সংসারের আয়-রোজগার নিয়েও ভাবতেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাই ১৯৫৭ সালে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার আগেই তিনি বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান চা বোর্ডের সভাপতি করেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সারাক্ষণ রাজনীতি নিয়ে থাকেন। তাই উপার্জনের এমন একটা রাস্তা তাকে সোহরাওয়ার্দী জুটিয়ে দিয়েছিলেন, যে পদটি আলংকারিক; আক্ষরিক অর্থে যেখানে খুব একটা সময় দেওয়ার বালাই ছিল না।
প্রিয় গুরুর জীবনেও বঙ্গবন্ধুর অনেক অবদান। ভাষা আন্দোলন, দলের নাম বদলসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মতবিরোধ হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত শিষ্যের বিচক্ষণ যুক্তি মেনে নিয়েছেন গুরু। এই যেমন, ভাষা আন্দোলনে সোহরাওয়ার্দীর সমর্থন আনতে করাচি গিয়ে হাজির হয়েছিলেন ‘নাছোড়বান্দা’ বঙ্গবন্ধু। আবার ১৯৫৫ সালে দলকে অসাম্প্রদায়িক করতে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিতে রাজি করিয়েছেন। শুরুতে গুরু-শিষ্যের যে লেনদেনের কথা বলছিলাম, সেটা দিয়েই শেষ করি। সোহরাওয়ার্দী যেমন পরিচয়ের প্রথম ক্ষণটিতেই বঙ্গবন্ধুকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুও প্রথম সাক্ষাতে তার পরবর্তী যাত্রাপথের পথপ্রদর্শকের নিশানা পেয়েছিলেন। একদিকে তরুণ শেখ মুজিবের সাংগঠনিক দক্ষতাকে সোহরাওয়ার্দী ব্যবহার করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। অন্যদিকে, তরুণ মুজিবও দ্বীধাহীনভাবে রাজনীতির দিক্ষা সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে বুঝে নিতে দেরি করেননি। গুরু-শিষ্যের এই পরম্পরা বাংলার এক নিবিড় সংরাগ।
তথ্যসূত্র: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান; বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর.কম; টিবিএস.কম বাংলা।
ব্রিটিশ ভারতে জন্ম নেওয়া শিশুটির নাম রাখা হয় খোকা। পরের পাঁচ দশকে ভারতবর্ষ দেখেছে বিভাজন আর মানচিত্র বদলে যাওয়ার জটিল-কুটিল রাজনীতি। এই পরিক্রমায় সেদিনের খোকা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব, মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা। ইতিহাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে দূরদ্রষ্টার মতো যিনি চলেন অমরত্বের পথে। আমরা সেই ঊর্ধ্বমুখী যাত্রাপথের ১৫টি ধাপ ছুঁয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে স্মরণ করছি জনকের জন্মদিন।
দুরন্ত কিশোর পেল পথের দেখা
১
তরুণ রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিব ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ সফরে আসা তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন।
১৯৩৮ সাল। বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আসবেন গোপালগঞ্জে। করা হয়েছে বিশাল জনসভার আয়োজন। এ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিপুল আলোড়ন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ভার মিশন স্কুলের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর।
সভা শেষে মিশন স্কুল দেখতে গেলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বঙ্গবন্ধুসহ অন্যরা তাকে সংবর্ধনা দিলেন। এরপর সোহরাওয়ার্দী যখন হেঁটে লঞ্চের দিকে চলছিলেন, বঙ্গবন্ধুও ছিলেন তার পাশে। তখন কিছু কথা হয় তাদের মধ্যে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নোটবুক বের করে বঙ্গবন্ধুর নাম-ঠিকানা লিখে নিলেন। কয়েক দিন পর পাঠালেন চিঠি। সেই চিঠিতে বঙ্গবন্ধুকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি কলকাতায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন সোহরাওয়ার্দী।
১৯৪৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। সে বছর তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের (অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের শাখা) কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এবং ভারত বিভাজন পর্যন্ত তার দায়িত্ব প্রশংসনীয়ভাবে পালন করে যান। ১৯৪৭ সালে মহাত্মা গান্ধী শান্তি মিশনে কলকাতা এলে শেখ মুজিবুর রহমান তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারত ও পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে স্বতন্ত্র, স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন। যদিও এই উদ্যোগ বাতিল হয় কিন্তু পরে এটিই একজন জাতির পিতার স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি হয়ে ওঠে।
বেকার স্ট্রিট থেকে মোগলটুলি
২
সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে প্রোগ্রেসিভ (উদারপন্থি) নেতারা ছিলেন, তারা নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। কলকাতা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকেলে ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরে সেই দলের নাম পরিবর্তন হয়ে হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী সেই দলের নামকরণ করা হয়। সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে আটক থাকলেও তাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
১৯৫২ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরের বছর সাধারণ সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ সালের আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সব ধর্মের মানুষের অন্তর্ভুক্তি এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ‘মুসলিম’ শব্দটি প্রত্যাহার করে নাম রাখা হয় ‘আওয়ামী লীগ’। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বন্ধু
৩
১৯৪৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের চাকরির নিরাপত্তা বিধান এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সমর্থন জানান। ১৯ এপ্রিল চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পক্ষে মিছিল বের করার প্রস্তুতিকালে কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ শেখ মুজিবুর রহমানকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগের আগে ছাত্রলীগ
৪
১৯৪৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য মুসলিম লীগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য কর্মতৎপরতা শুরু করেন। ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবসে’ ধর্মঘট পালনকালে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় কয়েকজন সহকর্মীসহ শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন। তার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ মুসলিম লীগ সরকার শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্য ছাত্রনেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে গেলেন বৈশ্বিক অঙ্গনে
৫
১৯৫২ সালে জেলবন্দি অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন এবং আন্দোলনকে সফল করার জন্য জেল থেকেই পাঠাতেন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শেখ মুজিবুর রহমান জেলের ভেতরেই ১১ দিন ধরে আমরণ অনশন করেন এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ধর্মঘট আহ্বান করে। আন্দোলনরত ছাত্রজনতা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে অগ্রসর হলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিউরসহ অনেকে। জেল থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান শহীদদের প্রতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানান। একই বছর শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে চীন সফর করেন। শান্তি সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় বক্তৃতা দেন, ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে যান বৈশ্বিক অঙ্গনে।
মন্ত্রিত্ব থেকে নেতৃত্বে
৬
১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ একাই ১৪৩টি আসনে জয়ী হয়। শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত হন এবং ১৫ মে নতুন প্রাদেশিক সরকারের সমবায় ও কৃষিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ২৯ মে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার হঠাৎ করে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। ৩০ মে শেখ মুজিবুর রহমান করাচি থেকে ঢাকায় পা রাখা মাত্রই গ্রেপ্তার হন। ২৩ ডিসেম্বর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
গঠন করলেন নিউক্লিয়াস
৭
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান সামরিক শাসন জারি করে এবং সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে। ১১ অক্টোবর আবার শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। একের পর এক মিথ্যা মামলায় তাকে হয়রানি করতে থাকে সামরিক সরকার। ১৪ মাস পর শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে জেলগেটেই আবার গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৬১ সালে হাইকোর্ট আটকাদেশ অবৈধ ঘোষণা করার পর শেখ মুজিবুর রহমান কারাগার থেকে মুক্তি পান। সে সময়ই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করতে উদ্যমী ছাত্র নেতাদের নিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যা নিউক্লিয়াস নামে পরিচিত।
ছয় দফায় দেখালেন নতুন দিশা
৮
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপনের চেষ্টা করেন। তিনি ছয় দফাকে সম্মেলনের এজেন্ডা করতে চাইলে অধিকাংশ নেতা ছয় দফাকে পাকিস্তানকে টুকরো করার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এর প্রতিবাদে শেখ মুজিব সম্মেলন থেকে ওয়াকআউট করেন। এরপর তিনি ঢাকায় এসে ছয় দফা নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। প্রস্তাবিত ছয় দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন। ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে তিনি সারা বাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। এ সময় তাকে আটবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং সর্বশেষ ৮ মে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় তিন বছর শেখ মুজিবুর রহমান কারারুদ্ধ ছিলেন।
আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে আগরতলা
৯
১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন বাঙালির (রাজনীতিবিদ এবং সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা) বিরুদ্ধে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে। জেলে বন্দি থাকা অবস্থাতেই ১৮ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে আবার গ্রেপ্তারি আদেশ জারি করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে গণবিক্ষোভ শুরু হয়।
হলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ বললেন ‘বাংলাদেশ’
১০
১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন শুরু হয়। টানা গণ-আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সব বন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল ছাত্রসমাবেশে লাখো শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আওয়ামী লীগের এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের নাম রাখেন ‘বাংলাদেশ’।
সত্তরের নির্বাচনে মহানায়ক
১১
১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার আলোকে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগের জন্য তিনি নৌকা প্রতীক বেছে নেন। ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে উপকূল এলাকায় লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটে। শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনী প্রচারণা স্থগিত রেখে ঘূর্ণিঝড়বিধ্বস্ত অঞ্চলে ছুটে যান। ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হয়।
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’
১২
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে। এ ঘোষণার ফলে সর্বস্তরের বাঙালি রাস্তায় নেমে আসে। ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানের (পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
ঘোষণা করলেন স্বাধীনতা
১৩
২৫ মার্চ রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শতাব্দীর ঘৃণ্যতম গণহত্যা চালায়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এরপরই তাকে ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল এ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের নেতৃত্বে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এ সরকারের পরিচালনায় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে। ৯ মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করে, পুড়িয়ে দেয় লাখো মানুষের ঘরবাড়ি। প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
স্বাধীন করে ফিরলেন দেশে
১৪
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক চাপের মুখে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। লন্ডন এবং নয়াদিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে ফিরে আসেন। লাখো জনতার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় স্নাত হয়ে বঙ্গবন্ধু তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে আসেন এবং জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ১২ জানুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে শেখ মুজিবুর রহমান নতুন বাংলাদেশকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করেন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ নবপ্রণীত সংবিধানের আলোকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ২৩ মে বিশ্ব শান্তিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব শান্তি পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কারে ভূষিত করে। সেপ্টেম্বরে শেখ মুজিবুর রহমান আলজেরিয়ার জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দেন।
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ পরিষদের সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় বক্তব্য দেন। বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষায় এটিই প্রথম ভাষণ।
চিরকালের
১৫
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী ও উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক কর্মকর্তার হাতে প্রায় সপরিবারে নিহত হন। দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যান। বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্ধকারতম দিন ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয় এবং স্মরণ করা হয় বিশাল হৃদয়ের মহাপ্রাণ মানুষটিকে যিনি তার সাহস, শৌর্য, আদর্শ ও ভালোবাসার মধ্য দিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন বাঙালির অন্তরে।
তথ্যসূত্র : ১. মযহারুল ইসলাম, ২০১১, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, ঢাকা, আগামী প্রকাশনী ২. শেখ হাসিনা (সম্পাদিত), ২০২১, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ, ৩. মুজিবপিডিয়া।
ছাত্রলীগ হচ্ছে পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠন, আওয়ামী লীগের পূর্বসূরি। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড় বছর আগে, আর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪ মাস ১৯ দিন পর এর প্রতিষ্ঠা (৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮)। বঙ্গবন্ধু সে সময়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’-এর ছাত্র। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় তিনিই যে মূল উদ্যোক্তা ছিলেন, পূর্বাপর ঘটনাও তার প্রমাণ বহন করে।
‘ছাত্রলীগ গঠন করার সাথে সাথে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল। এক মাসের মধ্যে আমি প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমউদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হতো। একদল সহকর্মী পেয়েছিলাম, যারা সত্যিকারের নিঃস্বার্থ কর্মী।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৮৯]
ভাষা-আন্দোলনের প্রথম পর্বে বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সে স্থান পূরণ করেন। শুধু ভাষা-আন্দোলন বা মুসলিম লীগ সরকারের প্রাথমিক জেল-জুলুম-নির্যাতন মোকাবিলায় নয়, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় ও এর সংগঠন গড়ে তুলতেও ছাত্রলীগ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় :
‘আওয়ামী লীগ গড়ে উঠবার পূর্ব পর্যন্ত একমাত্র ছাত্রলীগই সরকারের অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরত’ (আত্মজীবনী, পৃ. ২৩৬)।
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার দুই মাস যেতে না যেতেই প্রথম চ্যালেঞ্জ আসে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ মার্চ হরতাল সফল করার। বঙ্গবন্ধু এই সুযোগে ছাত্রলীগের সংগঠন গুছানোর জন্য সচেষ্ট হন। ১১ মার্চ ঢাকার রাজপথে বঙ্গবন্ধু পিকেটিংয়ে নামেন শত শত ছাত্রের সঙ্গে। এসময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাকিস্তানে এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম জেল। তবে এই সফল হরতালের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ছিল পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর গভর্নর জেনারেল হিসেবে প্রথম সফর। এ কারণে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ সরকার আপস করতে চায়। তারা ৮-দফা আপস প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে সেটা পাঠায় কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। বলা হয়, তিনি সম্মতি দিলে পূর্ব পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা চালাবে এবং আটক সব বন্দিকে মুক্তি দেবে। এই চুক্তি তিনি অনুমোদন করেন। ১৫ মার্চ মুক্ত হয়ে তিনি পরদিন আমতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেন- ‘বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হলো।’ [পৃষ্ঠা ৯৬]
বঙ্গবন্ধুই ছিলেন এ ছাত্রসংগঠনের প্রাণশক্তি। সমসাময়িক ছাত্রনেতাদের মধ্যে অনেকের চেয়ে তিনি ছিলেন বয়সে জ্যেষ্ঠ। তিনি তখনই মনে মনে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার পক্ষে মনস্থির করে ফেলেছিলেন। হয়তো সে কারণে তিনি নিজেকে ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত করেননি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়লে ছাত্রত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের অবসান ঘটে।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর যুগ্মসম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েই বঙ্গবন্ধু জেলায়-মহকুমায় আওয়ামী লীগ গঠনে মনেযোগী হন। একইসঙ্গে প্রতিটি স্থানে তিনি ছাত্রলীগ গড়ে তোলার কাজেও অংশ নিতে থাকেন। তিনি ছাত্রদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যার সমাধান, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার দাবিতে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু নিজে আর ছাত্র না থাকায়, ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব তিনি নেননি। ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ ঢাকার তাজমহল সিনেমা হলে ছাত্রলীগের প্রথম আনুষ্ঠানিক সম্মেলনে অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি রাজি হননি।
পরদিন ১৭ সেপ্টেম্বর আরমানিটোলা ময়দানে ছাত্র-জনসভা অনুষ্ঠিত হয় মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে। জনসভায় ভাসানী বলেন- ছাত্র বন্ধুরা, মজিবরকে তোমাদের কাছ থেকে আমি নিয়ে নিলাম। জানি, তোমরা কষ্ট পেয়েছো। কিন্তু জালেম মুসলিম লীগকে সরাতে হলে আওয়ামী লীগকে গ্রামে গ্রামে গড়ে তুলতে হবে। এ কাজে আমার আতাউর রহমান, সালাম খান, শামসুল হক আছে। কিন্তু মজিবরের মতো উপযুক্ত যুবক ছাড়া আমি কিছুই করতে পারব না।
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, ছাত্ররা জেগে উঠেছে। ছাত্রলীগ সফল সম্মেলন করেছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানে মাত্র ৫ শতাংশ লোক লেখাপড়া জানে। এ অবস্থায় ছাত্রদের রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় ভূমিকা রাখার বিকল্প নেই। অন্যথায় জনগণের দুঃখ-কষ্ট দূর করা যাবে না। নির্যাতন আসবে, সেটা উপেক্ষা করে ছাত্রদের এগিয়ে যেতে হবে। ছাত্র আন্দোলন করার জন্য বৃত্তি কেটে নেওয়া হয়। ছাত্রছাত্রীদের জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো দমননীতি তোমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। ছাত্রলীগ সম্পর্কিত আরও কিছু স্মৃতিচারণা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যদিও আমি সদস্য ছিলাম না, তবুও ছাত্রনেতারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। প্রয়োজন মতো বুদ্ধি পরামর্শ দিতে কার্পণ্য করি নাই। এরাই আমাকে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শ্রদ্ধা করেছে’ (পৃ. ১২৭)।
যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বহিষ্কার করেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নির্বাচিত ছাত্র সংসদ ‘ডাকসু’ ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে প্রবল ছাত্র-গণ আন্দোলন গড়ে কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে আনে এবং তাকে বরণ করে নেয় ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে। এর দুই বছর পর এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় তার আহ্বানে ডাকসু নেতৃত্ব উত্তোলন করে বাংলাদেশের লাল-সবুজ-সোনালি রঙের ‘জাতীয় পতাকা’, ১৭ এপ্রিল ‘মুজিব নগরে’ বাংলাদেশ সরকার যাকে অভিবাদন জানিয়ে আনুষ্ঠানিক শপথ নেয়। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রসমাজের ঐতিহ্যবাহী ও সবচেয়ে পুরনো সংগঠন এই ছাত্রলীগই ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একটি নাম, যার অঙ্গুলি হেলনে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিজেদের জীবন চালিত করেছে একাত্তরে। দলমত-নির্বিশেষে তিনি সবার জাতীয় নেতা। তিনি একটি দলের প্রধান হলেও সব দল নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়েছিলেন দেশ মুক্ত করার জন্য।
ব্রিটিশ টেলিভিশন সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকারের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সাতটি বাক্যে তিনি নেতৃত্বের বিশ্লেষণ করেছেন এভাবেÑ ‘সত্যিকারের নেতৃত্ব আসে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। একজন মানুষ এক দিনে হঠাৎ করেই নেতা হতে পারেন না। এটা অবশ্যই একটি প্রক্রিয়া, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। তাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে, তিনি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে। মানবতার জন্য আত্মত্যাগে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। তার মধ্যে অবশ্যই নীতি-আদর্শ থাকতে হবে। যদি কোনো নেতার এসব গুণ থাকে, তবে তিনি নেতা।’
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও তৎকালীন নেতৃত্বের স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধু যেসব দলমত-নির্বিশেষে সবার নেতা হয়ে উঠেছিলেন তার পরিক্রমাটি বুঝতে পারা যায়। একদিকে ডানপন্থি, অন্যদিকে বামপন্থি; উভয়কেই স্বাধীনতার আন্দোলনের স্রোতে শামিল করেছিলেন। সামলাতে হয়েছে উগ্রপন্থিদের দাবি-দাওয়াকেও। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর প্রতিষ্ঠা লাভ করায় আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার শুরুতে নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দ যুক্ত রাখতে হয়েছিল। তবে ১৯৫৫ সালে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে (তখন তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক) দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে সংগঠনের সদস্যপদ সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
বাসসের সাবেক সিটি এডিটর অজিত কুমার সরকার বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মাঝে মানুষকে আকৃষ্ট করার মোহনীয় শক্তি ছিল। তিনি শুধু ভালো বক্তা নন, তিনি প্রকৃত অর্থে একজন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের কথা তিনি এমনভাবে তুলে ধরতেন যে মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠত।’ [বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং বিশ্ব মিডিয়া, যুগান্তর, ১ আগস্ট ২০২১]। বঙ্গবন্ধু সে সময়কার বাম নেতাদের সঙ্গেও যথোচিত সংযোগ রাখতেন।
বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ৩৮ বছরের রাজনৈতিক জীবন গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে যে সত্যটি বের হয়ে আসে তা হলোÑ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দলের নেতৃত্ব দিলেও তার রাজনীতি কখনো সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির স্বার্থে পরিচালিত করেননি। শেখ মুজিব পাকিস্তানি শোষণ, নির্যাতন, বৈষম্য, জাতিগত নিপীড়ন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে যতটা দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করেছিলেন তা আর অন্য কোনো দল বা রাজনৈতিক নেতার মধ্যে দেখা যায়নি।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ডান-বাম-উগ্র সবার কথাই নিজের ভাষায় এমনভাবে বললেন যে তা সবার ভাষ্য হয়ে ওঠে। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, এক পক্ষ, যারা বিশ্বাস করতেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ পরিক্রমণের মধ্য দিয়ে জনগণের রায়সমৃদ্ধ হয়ে একটা পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীনতার আহ্বান উচ্চারিত হবে। যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন প্রতিষ্ঠিত করার দিবাস্বপ্নে বিভোর ছিলেন, তাদের চাপ ছিল ৭ মার্চে রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। বাংলার স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরণে যারা বিশ্বাসী ছিলেন, তাদের চেতনার মণিকোঠায় ছিল ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেবেনÑ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যাতে তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে বিশেষ করে এই বাংলার মানুষকে তারা ভুল বোঝাতে না পারে, আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে। তাই বঙ্গবন্ধুকে অতি সুকৌশলে স্বাধীনতার বার্তাটি উচ্চারণ করতে হবে, যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে।
তিনি বলেন, মানিক মিয়ার চিন্তার উত্তরাধিকারী হিসেবে সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ আওয়ামী লীগের বেশ কিছু প্রবীণ নেতা বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়েছিলেন, ক্ষমতার পথ ব্যবহার করাই হচ্ছে বাংলার কল্যাণের ও শোষণের প্রতিশোধের একমাত্র উপায়। জন-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা এবং সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি যাদের প্রতীতি ও প্রত্যয় ছিল অবিচল, তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আমাদের চেতনার আঙ্গিকে যারা আমার অগ্রজ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, এনায়েতুর রহমান, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ ছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন, ম্যান্ডেটের পর আঘাত হানলে জীবনের বিনিময়ে হলেও শুধু প্রতিরোধই নয়, প্রত্যাঘাতও করা হবে। উল্লিখিত তিনটি শক্তিকেই বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুকৌশলে পোষ মানিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সমস্ত সত্তায় বাংলার মানুষের হৃদয় অনুরণিত হতো। এ কারণেই স্বাধীনতা-পূর্বকালে সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে তিনি বাংলার মানুষকে একটি অদৃশ্য ঐক্যের রাখিবন্ধনে বাঁধতে পারলেন।
উল্লেখ্য, তখন বিশ্ব ছিল দুই ব্লকে বিভক্তÑ সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মতো একটি ক্ষুদ্র দেশের পক্ষে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। এমন স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির হাল ধরেন শক্ত হাতে। আমরা সচরাচর দেখি, বেশির ভাগ নেতার কথা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। অনেকেই ‘পুঁজিবাদ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ’, ‘বুর্জোয়া’, ‘পেটিবুর্জোয়া’ ও ‘প্রোলেতারিয়েত’ ধরনের কিছু গৎবাঁধা শব্দ ছাড়া সাধারণ মানুষের ভাষায় যেন কথাই বলতে পারে না। বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে এমন কোনো শব্দ ব্যবহার করতেন না। কৃষক-শ্রমিক-রাজনীতিক-শিক্ষক সবাই তার কথা বুঝতে পারত। তন্ময় হয়ে শুনত।
তৎকালীন অনেক বাঘা বাঘা নেতৃত্বকে পেছনে ফেলে শেখ মুজিব সবার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন তার সাহস ও স্বকীয়তায়। তার সামগ্রিক ত্যাগ ও সাহসী নেতৃত্বের ফলেই বাঙালি পেয়েছে হাজার বছরের কাক্সিক্ষত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।
পরাধীন মানুষের নেতা হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে জন্মদিন পালন পছন্দ করতেন না। উৎসবের নামে ব্যয়বাহুল্যগুলো তিনি কখনো প্রশ্রয়ও দেননি। তার বাসায়ও কখনো জন্ম উৎসব পালিত হতো না। কিন্তু যে কটা জন্মদিন তার জেলে কেটেছে সেই মুহূর্তগুলোর বিশেষ এই দিনটাকে পরিবারের সবার খুব বেশি মনে পড়ত। জন্মদিনে তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়ে আগে থেকেই জেল কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিতেন বঙ্গবন্ধুর পরিবার। একবার দেখা করার অনুমতিও পেয়েছিলেন। পরিবারের সদস্যরা তার জন্য কিছু ফুল, মিষ্টি আর কয়েকটি বই নিয়ে গিয়েছিলেন। পরিবারকে কাছে পেয়ে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বঙ্গবন্ধুর চোখ-দুটো চিকচিক করে উঠেছিল। তাকে জন্মদিনের শুভকামনা জানিয়ে নীরবে ফিরে এসেছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা। নিজ থেকে জন্মদিন পালন না করলেও একাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত সমগ্র জাতি আপন অনুভূতির আলোকে উদযাপন করে প্রিয় নেতার জন্মদিন। এদিন ভোর থেকেই চেনা-অচেনা মানুষে ভরে যেত ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাড়ির আঙিনা। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ভরা থাকত তাদের মুখ। হাজারো মানুষের সঙ্গে মিলিত হতে পেরে বঙ্গবন্ধুও উচ্ছল হয়ে উঠতেন। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ এই ছয় বছরের সব দৈনিক পত্রিকা ঘেঁটে তৈরি করা হয়েছে এই প্রতিবেদন।
১৭ মার্চ ১৯৭১, বুধবার
কালো পতাকা-শোভিত ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িতে ছিল না কোনো বিশেষ আয়োজন। এদিন রাজনৈতিক সংকট নিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক করেন। রমনা পার্কের বিপরীত পাশে প্রেসিডেন্ট ভবনে এক ঘণ্টা বৈঠক শেষে বেলা ১১টা ৬ মিনিটে কালো পতাকা-শোভিত গাড়িতে করে বের হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু। দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীরা গেটে তাকে ঘিরে ধরেন। গেটের একটু সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের উদ্দেশ বলেন, ‘দেখুন, আমার কিছুই বলার নাই। আলোচনা অব্যাহত আছে।’ এরপর বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনের দিকে রওনা দেন। সাংবাদিকরাও তার পিছু নেন। ৩২ নম্বরের বাড়িতে সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরলেন। বললেন, আজ আপনার ৫২তম জন্মদিন। জন্মদিনে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই। বঙ্গবন্ধু বেদনার্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি তো আমার জন্মদিন পালন করি না। আমি তো আমার জন্মদিনে কেক কাটি না, মোমের বাতি জ¦ালি না। যে দেশের মানুষ কথায় কথায় গুলি খায়, অনাহারে-অর্ধাহারে মৃত্যুবরণ করে; সে দেশের নেতা হিসেবে আমার জন্মদিনই-বা কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমি তো আমার জীবন বাংলার জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি। আমার জন্মদিনের একমাত্র বক্তব্য হলোÑ লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলতে থাকবে। সত্য ও ন্যায় আমাদের পক্ষে। জয় আমাদের অনিবার্য।’ শেখ মুজিবের মুখে এই সংগ্রামের আহ্বান ও বিজয়ের বাণীই সেদিন মুখ্য হয়ে ওঠে।
ওইদিন সন্ধ্যার পর লোকজন ছোট-বড় মিছিল নিয়ে ফুলের তোড়া ও কেক হাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে গিয়ে হাজির হন। লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় অত্যন্ত ঘরোয়া পরিবেশে বঙ্গবন্ধু লনে এসে শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে আন্তরিকতায় মেতে ওঠেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে রবীন্দ্র কাব্যের কয়েকটি চরণ ঘুরে-ফিরে উচ্চারিত হচ্ছিলÑ ‘চারদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ^াস/শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’ তার মুখে ছিল নজরুলের কবিতাÑ ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত;/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল/আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ/ভীম রণভূমে রণিবে না।’ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে স্থানীয় গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ভিত্তিতে ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ’ নামাঙ্কিত একটি রেকর্ড প্রকাশ করে।
১৭ মার্চ ১৯৭২, শুক্রবার
বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিনটি ছিল অনাড়ম্বর কিন্তু গভীর আন্তরিকতার। এ দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তিন দিনের সফরে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন। জন্মদিন উপলক্ষে শ্রীমতি গান্ধী ভারতের পঞ্চান্ন কোটি মানুষের শুভেচ্ছা, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের নিদর্শনস্বরূপ স্বদেশে থেকে ফল ও মিষ্টি নিয়ে আসেন। তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমেই তিনি এসব উপহার বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে পাঠিয়ে দেন। এর আগে স্নিগ্ধ সকালে হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগী সমবেত হয় ৩২ নম্বর বাড়ির সেই অতিপরিচিত অঙ্গনে। তাদের দেখে স্মিতমুখে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘আমার আবার জন্মোৎসব কিরে? আয় আয় তোরা আমার কাছে আয়।’ এ যেন নেহাত কোনো ব্যক্তির আমন্ত্রণ নয়, যেন ছিল একটি সাগরের আহ্বান। শ্রদ্ধার বিনম্র চিত্তে সবাই এগিয়ে এলো। প্রিয় নেতার হাতে তুলে দিল পুষ্পস্তবক। গলায় পরিয়ে দিল মালা।
এদিন সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে তেজগাঁও বিমানবন্দরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। সঙ্গে ছিল ছোট ছেলে শেখ রাসেল। শ্রীমতি গান্ধী সস্নেহে রাসেলের মাথায় হাত বুলান। গার্ড অব অনার দেওয়ার পর আলোকচিত্র-সাংবাদিকদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু ও শ্রীমতি গান্ধীকে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয়। এরপর তারা একটি হেলিকপ্টারে করে বঙ্গভবনের উদ্দেশে রওনা হন। অপরাহ্ণে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু ও শ্রীমতি গান্ধী বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে ওইদিন ঢাকার প্রভাতি দৈনিকগুলো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে।
১৭ মার্চ ১৯৭৩, শনিবার
আগের দিন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। বাহ্যিক আড়ম্বর নয়, হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসার ঐশ^র্য দিয়ে সমগ্র জাতি, বঙ্গবন্ধুর ৫৪তম জন্মদিন পালন করে। ভোরের সূর্য পূর্ণদীপ্তি নিয়ে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই জাতির জনকের বাসভবনের সামনে শুভেচ্ছা প্রকাশে ইচ্ছুক মানুষের ভিড় জমে যায়। বঙ্গবন্ধু সকালে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করে জনতার কাতারে নেমে আসেন। শুভেচ্ছা গ্রহণ ও মাল্যভূষিত হওয়ার সময় জাতির জনক আবেগরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সেদিন নিরাপত্তাব্যবস্থার দিকে খেয়াল ছিল না বঙ্গবন্ধুর। ভোরবেলা থেকে যে জনস্রোত তলায় এবং গেটের সামনে ভিড় জমে যায়। গণভবনে সমবেত জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনাদের ভালোবাসা আর আশীর্বাদ ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নাই। আর কিছু পেতেও চাই না। আমি যা পেয়েছি, বিশে^র কোনো নেতা এতটা পেয়েছেন কি না জানি না। এত পাওয়া খুব কম লোকের ভাগ্যেই ঘটে। এখন কামনা হচ্ছে, আমি যেন এ দেশের মানুষের মুখে হাসি দেখে মরতে পারি।’ প্রিয় জনগণকে কাছে পেয়ে বঙ্গবন্ধু আনন্দে মেতে উঠেছিলেন। পরে তিনি সবুজ লনে নেমে খাঁচায় রক্ষিত একটি ময়ূর ও হরিণ-ছানাকে নিজ হাতে খাওয়ান এবং অনুগামী সাংবাদিকদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় যোগ দেন।
১৭ মার্চ ১৯৭৪, রবিবার
চুয়াত্তরে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটা ছিল অন্যরকম। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার নবতর সংগ্রামে দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১১ মার্চ হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক নূরুল ইসলাম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে সম্পূর্ণ বিশ্রামের পরামর্শ দেন। মন্ত্রিসভার সদস্য সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতারা, ছাত্রনেতাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে তার বাসভবনে সমবেত হন। উপহারস্বরূপ পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলতে সকাল থেকেই আলোকচিত্রীরা ভিড় জমান। রশীদ তালুকদারের ক্যামেরা নিয়ে বঙ্গবন্ধু ছবি তুলতে থাকেন। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. মজহারুল ইসলাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ শীর্ষক বইটি বঙ্গবন্ধুর হাতে অর্পণ করেন। ওইদিন অসুস্থ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ দুই নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। সরকারি ও বেসরকারি ভবনের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিবসটি সূচনা হয়। বিভিন্ন মসজিদে বঙ্গবন্ধুর সুস্থতা কামনা করে মিলাদ মাহফিল ও বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করা হয়। ১৯ মার্চ সকালে উন্নত চিকিৎসার জন্য মস্কোতে রওনা হন। বঙ্গবন্ধুকে মস্কোতে নিয়ে যাওয়ার জন্য সোভিয়েত সরকার একটি বিশেষ বিমান ও দুজন শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ পাঠান।
১৭ মার্চ ১৯৭৫, সোমবার
কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা সবাই বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে নিয়ে যান ফুল। কেউ নিয়ে যান ফুলের মালা। কেউবা প্রস্ফুটিত গোলাপ। প্রাণের সব অর্ঘ্য ঢেলে গুঁজে দেন নেতার হাতে। মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু কখনো গলা বাড়িয়ে, কখনো হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেন সেই ফুল। সেই ফুল তিনি বেশিক্ষণ তার কাছে রাখেননি। পাঠিয়ে দিয়েছেন সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ভাষাশহীদদের সমাধিতে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কমপক্ষে ৫০ হাজার লোকের সমাগম হয়। বঙ্গবন্ধু সবার আগে তার অসুস্থ পিতার সঙ্গে মিলিত হন এবং জন্মদিনের মাহেন্দ্রক্ষণে জন্মদাতার আশীর্বাদ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি দোতলা থেকে নেমে এসে জনতার সঙ্গে মিলিত হন। সেদিন নেতা ও জনতার সম্মিলনে কোনো বাধা ছিল না। ছিল না কোনো রাষ্ট্রীয় প্রটোকল। সকাল ৭টা থেকে সোয়া ১১টা পর্যন্ত চার ঘণ্টার বেশি সময় তিনি শুভার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জনতার এই স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দনে নিজেও মাঝে মাঝে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে কবিগুরুর ‘সোনার তরী’ থেকে কবিতা আবৃত্তি শুরু করেন। বেলা ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু সমবেত শুভার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার জন্মদিনে আমি ছুটি ঘোষণা করি নাই। তাই আজ আমি অফিসে যাব। অল্পক্ষণের জন্য হলেও অফিসের কাজ করব।’ বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে তিনি গণভবনের উদ্দেশে বাসভবন ত্যাগ করেন। গণভবনে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েরা বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে এলে তিনি খুদে অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে গণভবনের পুকুরে মাছ দেখাতে যান।
দেশে ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি ইন্টারনেট সেবা চালু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। অন্য অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক একই সেবা চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সব মোবাইল অপারেটরই দেশের বেশিরভাগ স্থানে ফোরজি সেবা চালু করেছে। আর সে হিসেবেই তারা ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু গ্রাহকরা ফোরজি ইন্টারনেট কিনলেও দেশের অনেক এলাকায় টুজি-থ্রিজি’র সেবা পাচ্ছেন। তারা অপারেটর কোম্পানিগুলোকে এ ব্যাপারে বারবার অভিযোগ জানালেও এর সুরাহা হচ্ছে না।
জানা গেছে, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে মোটামুটিভাবে গ্রাহকরা ফোরজি সেবা পাচ্ছেন। তবে এসব এলাকায়ও অনেক সময় ফোরজি থাকে না, থ্রিজিতে নেমে আসে নেটওয়ার্ক। তবে জেলা পর্যায়ে বেশিরভাগ সময়েই থাকে থ্রিজি। আর মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ সময় সেই থ্রিজিও থাকে না, তখন টুজি নেটওয়ার্কই ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইন্টারনেট প্যাকেজ যথাযথভাবে থাকার পর তা কাজ করে না, বাফারিং হয়। এতে গ্রাহকরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো সারা দেশের ব্যবসা একত্রে হিসাব না করে এলাকাভিত্তিক ব্যবসার হিসাব-নিকাশ করার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা দেখেন, কোন এলাকায় তাদের গ্রাহক সংখ্যা কত, সেখানে কত সিমে ইন্টারনেট চালু আছে। যদি দেখা যায়, তাদের হিসাব মতে তা সন্তোষজনক আছে তাহলে সেখানে ফোরজি সেবা চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বহাল রাখে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক টাওয়ার নির্মাণ করে। কিন্তু যদি দেখে সন্তোষজনক গ্রাহক নেই তাহলে সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় না, এতে সেই এলাকায় ফোরজি পাওয়া যায় না। অথচ শহর এলাকাগুলোতে তারা বেশি ব্যবসা করলেও সেটাকে হিসাবে ধরে না। কিন্তু মফস্বল এলাকা থেকে কল বাবদ প্রয়োজনের বেশি ব্যবসা হলেও তা ইন্টারনেটের সঙ্গে সমন্বয় করে না।
মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর ফেসবুক পেইজে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অভিযোগ জানান গ্রাহকরা। অভিযোগ অনুযায়ী, অপারেটরদের মধ্যে টেলিটকের নেটওয়ার্কই বেশি দুর্বল। টেলিটকের ফেসবুক পেজের এক পোস্টে মো. ফয়জুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই, নেটওয়ার্ক পাই না সকাল থেকে। মিরপুর-২ নম্বরে বাসা স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে। আর আমার গ্রামের কথা না হয় বাদ দিলাম।’ আরাফাত আলী লেখেন, ‘২জিবি নেট কিনলে দেড় জিবি নষ্ট হয়। মেয়াদ ১৫ দিন তাও ফুরাতে পারি না। তাহলে বুঝেন নেটওয়ার্ক কত ভালো।’ কার্জন চাকমা লেখেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় ফোরজি নিশ্চিত করুন। আমাদের পার্বত্য এলাকাগুলোতে টেলিটকের গ্রাহক সবচেয়ে বেশি, কিন্তু শুধু থ্রিজি-টুজিতে সীমাবদ্ধ।’ রাসেল আহমেদ লেখেন, ‘গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাংগা গ্রামে থ্রিজি নেটওয়ার্ক তো নেই-ই। মাঝেমধ্যে টুজি’ও নেই। বুঝুন অবস্থাটা। আমাদের থ্রিজি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করুন।’
টেলিটকের মহাব্যবস্থাপক (সিস্টেম অপারেশন) নুরুল মাবুদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ফাইভজি রেডিনেস প্রজেক্ট শুরু করেছি। যা শেষ হতে এক বছর বা তার কিছু বেশি সময় লাগতে পারে। এর ফলে আমাদের কাভারেজ এলাকাগুলোতে ফোরজি সেবা নিশ্চিত হবে। এছাড়া আমাদের কাভারেজ বাড়ানোরও বড় পরিকল্পনা রয়েছে।’
বাংলালিংকের পেজের একটি পোস্টে মাহাদী হাসান তালহা লেখেন, ‘আমার এলাকায় আপনাদের সিম ব্যবহার করতে হলে ফোন গাছের ডালে বেঁধে লাউডস্পিকার দিয়ে কথা বলা লাগে। এত্তো ফাস্ট কেন আপনাদের নেটওয়ার্ক।’ আকরাম হোসাইন লেখেন, ‘ভাই আপনাদের সবই ঠিক, তবে নেটওয়ার্ক সেøা।’
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অফিসার তৈমুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফোরজি সেবার জন্য ২৩০০ মেগাহার্জের স্পেকটার্ম প্রয়োজন হয়। কিন্তু টুজিতে তা লাগে মাত্র ৯০০ মেগাহার্জ। আমরা ইতিমধ্যে ৯৫ শতাংশ কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা নিশ্চিত করেছি। তবে আমাদের আরও বেশি সাইট লাগবে। যদি সব অপারেটর মিলে আমরা টাওয়ার শেয়ার করতে পারি, তাহলে সব গ্রাহকের কাছে ভালো সেবা পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে।’
রবির পেজে এক পোস্টে তানভীর আহমেদ লেখেন, ‘কলাপাড়া থানা শহরে যদি থ্রিজি নেটওয়ার্ক না পাওয়া যায়, এরচেয়ে দুঃখজনক কিছুই হতে পারে না।’ এইচএমএম ইসমাঈল লেখেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার চম্পকনগর ইউনিয়নে রবি সিমের থ্রিজি নেই। অথচ অনেক বছর আগে রবি টাওয়ার বসানো হয়েছে। আমরা রবি সিম দিয়ে ইন্টারনেট চালাতে অক্ষম।’
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলটরি অফিসার শাহেদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা রয়েছে। তবে দেখা যায়, অনেক ফোন ফোরজি সাপোর্ট করে না। আর কাভারেজ এলাকা থেকে যতদূরে যাওয়া যাবে, নেটওয়ার্ক তত কমতে থাকবে। এছাড়া আমাদের কিছু জায়গায় নেটওয়ার্কের কাজ চলছে। পাশাপাশি নতুন কিছু টাওয়ার তৈরির কাজও আমাদের চলছে।’
গ্রামীণের পেইজে একটি পোস্টে রহিদুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই আমি যখন গ্রামে যাই তখন নেটওয়ার্কের ঝামেলা হয়।’ সাইদুর রহমান লেখেন, ‘এমন সার্ভিস হলে চলবে? কলরেট, ইন্টারনেটের দাম তো ঠিকই বেশি আপনাদের, বাকি সব অপারেটরদের থেকে।’
গত বছরের ২৮ এপ্রিল টেলিকম অপারেটররা বহুল প্রতীক্ষিত ‘আনলিমিটেড’ ও ‘মেয়াদবিহীন’ ইন্টারনেট ডাটা প্যাক চালু করেছে। তবে এতে গ্রাহকদের খুব বেশি সুবিধা হচ্ছে না। কারণ এজন্য প্যাকেজের দাম বাড়িয়েছে অপারেটররা। আর মেয়াদহীন ইন্টারনেট পেতে প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একই প্যাকেজ চালু করতে হবে। কিন্তু গ্রাহকের সব সময় একই ধরনের ইন্টারনেট প্যাকেজ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে গ্রাহকের কেনা ইন্টারনেট। এছাড়া মেয়াদবিহীন হিসেবে মোবাইল অপারেটররা যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে গ্রাহকদের।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে সচল সিমের সংখ্যা ১৮ কোটি ২০ লাখ ৬১ হাজার। এরমধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ৭ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার, রবির ৫ কোটি ৫০ লাখ ১৪ হাজার, বাংলালিংকের ৪ কোটি ৮৫ হাজার এবং টেলিটকের ৬০ লাখ ৬৭ হাজার। আর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৫০ লাখ। এরমধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি ও পিএসটিএন)-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ লাখ ৮৭ হাজার গ্রাহক।
বাংলাদেশের ৫৩তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস রবিবার।
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত গণহত্যা অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে এবং বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি বেসামরিক লোকের ওপর গণহত্যা শুরু করে।
তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং সকল সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। ওই ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়।
বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তারের আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পাশাপাশি যে কোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
মুহূর্তের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় বাস্তবতা ও নিরাপত্তা জনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা নথি সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সময়ে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তৎকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পরে। পরে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধর পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে একটি ভূখণ্ডের, যার নাম বাংলাদেশ।
রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধির মধ্যেই তৈরি পোশাক খাতের আকাশে দেখা দিয়েছে শঙ্কার মেঘ। কয়েক মাস ধরেই খাতটির উদ্যোক্তারা রপ্তানি আয় কমে যাওয়া নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন। তারা বলছেন, রপ্তানির প্রধান প্রধান অঞ্চলগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকায় আগামীতে ওই সব অঞ্চলে রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। তাদের ভাষ্য, ইতিমধ্যে তার প্রভাবও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। অর্ডার কমে যাওয়ায় কমেছে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যও বলছে সে কথা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলার হার নেমেছে প্রায় অর্ধেকে।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তবে এই খাতের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির পুরোটাই আমদানিনির্ভর; যা চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাপক হারে কমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) টেক্সটাইল ফেব্রিক্স আমদানির এলসি বা ঋণপত্র খোলা কমেছে ২৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ৬২৬ কোটি ডলারের এলসি খোলেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৬৫ কোটি ডলার।
তবে প্রস্তুত কাপড়ের চেয়ে বেশি আমদানি কমেছে কাঁচামালের। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে কাঁচা তুলা বা কটন আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এ সময়ে কাঁচা তুলা আমদানিতে ১৫৩ কোটি ডলারের এলসি খোলেন ব্যবসায়ীরা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে তুলা আমদানিতে ২৭২ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল। আবার তুলার চেয়ে সুতা আমদানি আরও কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সুতা আমদানিতে এলসি খোলা হয় ১০৭ কোটি ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৪২ কোটি ডলার। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুতা আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৬ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের আট মাসে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা কমেছে ৫৪ দশমিক ১১ শতাংশ। এই সময় টেক্সটাইল যন্ত্রপাতির এলসি খোলা কমেছে ৭০ দশমিক ৪২ শতাংশ। আর গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৬৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন। অর্থাৎ শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে। আর এটি কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা ব্যবসা সম্প্রসারণ কিংবা নতুন কলকারখানা স্থাপন অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। এতে দেশে বিনিয়োগ ও উৎপাদনে ‘ধস’ নামার একটা অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে কাঁচামাল ও জাহাজভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার ব্যাপক পতন, বিভিন্ন দেশে মন্দার শঙ্কাসহ নানা কারণে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে উচ্চ আমদানি ব্যয়ের কারণে দেশে ডলার সংকট দেখা দিলে এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার। এতে ডলারের ওপর চাপ কিছুটা কমানো গেলেও আমদানি জটিলতায় পড়েছে তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য খাত।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানির ক্রয়াদেশ কিছুটা কমেছে। কিন্তু উচ্চমূল্যের পণ্য রপ্তানি বাড়ায় রপ্তানি আয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রভাব পড়েনি। যেহেতু সাধারণ পোশাক রপ্তানি কমেছে সে কারণে কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানিও কমেছে। পাশাপাশি ডলার সংকটও আমদানি কমে যাওয়াতে ভূমিকা রেখেছে। ফারুকের আশঙ্কা, উন্নত দেশগুলোতে ব্যাংকিং খাতে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তার কারণেও রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে এসব বিষয় মোকাবিলায় পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ করার মতো অর্থের সংকট রয়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করতে পারছে না। পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার বড় অবমূল্যায়নের কারণে মালিকরা খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আনছেন না। অবশ্য আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমায় আমদানির পরিমাণে প্রভাব পড়েছে বলেও মনে করেন ফজলে শামীম এহসান।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দার আশঙ্কায় কেউ নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। তবে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়াটাকে তারাও আসন্ন সংকট হিসেবে দেখছেন। গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশে ডলারের সংকটের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল আমদানি করতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এটা খুব ভালো লক্ষণ নয়। তবে তিনি আশাও দেখছেন। তার ভাষ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম কমে যাওয়ায় মূলত আমদানি ব্যয় কম হয়েছে। আমদানির পরিমাণ খুব একটা কমেছে বলে মনে করেন না তিনি।
পুলিশ ভেরিফিকেশন না হওয়ায় চাকরি স্থায়ীকরণ হচ্ছিল না। কিন্তু তার দেরি সয়নি। নিজের তত্ত্বাবধানে থাকা সার্ভিস বইয়ের পাতায় কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে স্থায়ী করে নিলেন নিজের চাকরি। এই ব্যক্তি হলেন ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী মো. মনোয়ার হোছাইন। স্থানীয় সরকার বিভাগ তদন্তের পর থানায় মামলা হয়। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে তার বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের চারটির প্রমাণ মিলে। দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট আইনের দুটি ধারায় তার ১২ বছর সাজা ও অর্থদ- হয়েছে। পুলিশ মনোয়ারকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৪ সালের ১৯ মে ‘ক্রু’ বা মশককর্মী পদে যোগ দেন মনোয়ার হোছাইন। দপ্তরের চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী, এলডিএ কাম টাইপিস্ট হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু অসম্ভবকে সম্ভব করে তিনি ওই পদও বাগিয়েছেন। ওই পদ থেকে উচ্চমান সহকারী (হেড ক্লার্ক) পদেও পদোন্নতি নিয়েছেন। এরপর দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে নেন। তথ্য গোপন করে পদোন্নতি নেওয়া এই কর্মকর্তার বাদ ছিল চাকরিতে স্থায়ী হওয়া। প্রথমবার কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে বিধিবহির্ভূত পদোন্নতি নেওয়ার পর তার উচ্চাকাক্সক্ষা বেড়ে যায়। ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল স্বাক্ষর করে চাকরি স্থায়ী করেন। এর আগে দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. রওশন আরা তালুকদারকে চাকরি স্থায়ী করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি।
এ ঘটনার পর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্থানীয় সরকার বিভাগ ও দুদকের তদন্ত কমিটির কাছে লিখিতভাবে তার স্বাক্ষর জাল করার বিষয়ে অভিযোগ করেন। ২০১১ সালে মনোয়ারকে বরখাস্ত করা হয়।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. রওশন আরা তালুকদার তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগের পক্ষে বিভিন্ন প্রমাণও জমা দেন। তিনি লিখিত বক্তব্যে জানান, অভিযুক্ত মনোয়ার হোছাইনের চাকরি স্থায়ীকরণ সংক্রান্ত চাকরি বইয়ের দ্বিতীয় খ-ের নবম পৃষ্ঠায় যে স্বাক্ষর রয়েছে তা তার নয়। ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখের স্বাক্ষরটি মনোয়ারের সৃজনকৃত। চাকরিকালীন তার বিষয়ে কোনো পুলিশ ভেরিফিকেশন করানো হয়নি। এ জন্য তার চাকরিও স্থায়ী করা হয়নি। আর সার্ভিস বইয়ে যে সিল ব্যবহার করা হয়েছে তা তার সময়ে ব্যবহৃত সিল থেকে ভিন্ন। সিলের নিচে যে স্বাক্ষর রয়েছে তিনি বলতে পারবেন সেটা কীভাবে হলো। ইস্যু রেজিস্টার খাতায় ৪৬ নম্বর দিয়ে যে চিঠিটি তৈরি করা হয়েছে তার কোনো কপি কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। ৪৬ নম্বর ক্রমিকটি ২০১০ সালের ২৬ জানুয়ারি লেখা রয়েছে। অন্যান্য কলাম খালি রয়েছে। পরের পাতায় ২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি ২৬ নম্বর ক্রমিক দিয়ে একটি বদলির চিঠি ইস্যু করা হয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরও জানান, ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের উচ্চমান সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন মনোয়ার হোছাইন। দপ্তরের বিধি-বিধান অনুযায়ী নথি, রেকর্ডপত্র, সার্ভিস বই তার কাছে রক্ষিত ছিল। এ কারণে জাল স্বাক্ষরের দায় তিনি কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। দপ্তরে জমা দেওয়া তার এলএলবি পাসের সনদও সঠিক ছিল না। জাতীয় বিশ^বিদ্যালয় থেকে তার ওই সনদ সঠিক নয় বলে লিখিতভাবে দপ্তরকে জানানো হয়েছে।
মনোয়ারের বিরুদ্ধে অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপ, নিয়োগ বাণিজ্য, স্বাক্ষর জাল, নিজেই নিজের চাকরি স্থায়ীকরণ এবং নথি, রেকর্ডপত্র, সার্ভিস বইয়ে ত্রুটি ঘটানোসহ পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে চারটি অভিযোগের প্রমাণ মেলে।
ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তর সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশে ২০১৩ সালের ১৮ জুন দপ্তরের পক্ষ থেকে চকবাজার থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা (নম্বর-৪) করা হয়। পরে মামলাটি তদন্তের জন্য দুদকে পাঠানো হয়। দুদক তদন্ত করে মনোয়ারের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট আইনের একটি ধারায় তার পাঁচ বছরের কারাদ- হয়। পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের সশ্রম কারাদ- দেয় আদালত। আরেকটি ধারায় সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়ার পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের বরখাস্ত উচ্চমান সহকারী মনোয়ার হোছাইন দেশ রূপান্তরকে বলেন, একটি চক্র তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। তাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে তিনি কর্মস্থল থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল এবং আদালতের সাজার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা কত কিছু করছে। কোথায় আবার কী করেছে বুঝতে পারছি না। এ প্রসঙ্গটি বারবার উত্থাপন করলেও তিনি এড়িয়ে যান।
দেশে ইতিমধ্যে কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি ইন্টারনেট সেবা চালু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক। অন্য অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক একই সেবা চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সব মোবাইল অপারেটরই দেশের বেশিরভাগ স্থানে ফোরজি সেবা চালু করেছে। আর সে হিসেবেই তারা ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু গ্রাহকরা ফোরজি ইন্টারনেট কিনলেও দেশের অনেক এলাকায় টুজি-থ্রিজি’র সেবা পাচ্ছেন। তারা অপারেটর কোম্পানিগুলোকে এ ব্যাপারে বারবার অভিযোগ জানালেও এর সুরাহা হচ্ছে না।
জানা গেছে, রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে মোটামুটিভাবে গ্রাহকরা ফোরজি সেবা পাচ্ছেন। তবে এসব এলাকায়ও অনেক সময় ফোরজি থাকে না, থ্রিজিতে নেমে আসে নেটওয়ার্ক। তবে জেলা পর্যায়ে বেশিরভাগ সময়েই থাকে থ্রিজি। আর মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ সময় সেই থ্রিজিও থাকে না, তখন টুজি নেটওয়ার্কই ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইন্টারনেট প্যাকেজ যথাযথভাবে থাকার পর তা কাজ করে না, বাফারিং হয়। এতে গ্রাহকরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো সারা দেশের ব্যবসা একত্রে হিসাব না করে এলাকাভিত্তিক ব্যবসার হিসাব-নিকাশ করার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা দেখেন, কোন এলাকায় তাদের গ্রাহক সংখ্যা কত, সেখানে কত সিমে ইন্টারনেট চালু আছে। যদি দেখা যায়, তাদের হিসাব মতে তা সন্তোষজনক আছে তাহলে সেখানে ফোরজি সেবা চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বহাল রাখে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক টাওয়ার নির্মাণ করে। কিন্তু যদি দেখে সন্তোষজনক গ্রাহক নেই তাহলে সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় না, এতে সেই এলাকায় ফোরজি পাওয়া যায় না। অথচ শহর এলাকাগুলোতে তারা বেশি ব্যবসা করলেও সেটাকে হিসাবে ধরে না। কিন্তু মফস্বল এলাকা থেকে কল বাবদ প্রয়োজনের বেশি ব্যবসা হলেও তা ইন্টারনেটের সঙ্গে সমন্বয় করে না।
মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর ফেসবুক পেইজে প্রতিনিয়ত অসংখ্য অভিযোগ জানান গ্রাহকরা। অভিযোগ অনুযায়ী, অপারেটরদের মধ্যে টেলিটকের নেটওয়ার্কই বেশি দুর্বল। টেলিটকের ফেসবুক পেজের এক পোস্টে মো. ফয়জুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই, নেটওয়ার্ক পাই না সকাল থেকে। মিরপুর-২ নম্বরে বাসা স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে। আর আমার গ্রামের কথা না হয় বাদ দিলাম।’ আরাফাত আলী লেখেন, ‘২জিবি নেট কিনলে দেড় জিবি নষ্ট হয়। মেয়াদ ১৫ দিন তাও ফুরাতে পারি না। তাহলে বুঝেন নেটওয়ার্ক কত ভালো।’ কার্জন চাকমা লেখেন, ‘পাহাড়ি এলাকায় ফোরজি নিশ্চিত করুন। আমাদের পার্বত্য এলাকাগুলোতে টেলিটকের গ্রাহক সবচেয়ে বেশি, কিন্তু শুধু থ্রিজি-টুজিতে সীমাবদ্ধ।’ রাসেল আহমেদ লেখেন, ‘গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার নলডাংগা গ্রামে থ্রিজি নেটওয়ার্ক তো নেই-ই। মাঝেমধ্যে টুজি’ও নেই। বুঝুন অবস্থাটা। আমাদের থ্রিজি সেবা দেওয়ার চেষ্টা করুন।’
টেলিটকের মহাব্যবস্থাপক (সিস্টেম অপারেশন) নুরুল মাবুদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ফাইভজি রেডিনেস প্রজেক্ট শুরু করেছি। যা শেষ হতে এক বছর বা তার কিছু বেশি সময় লাগতে পারে। এর ফলে আমাদের কাভারেজ এলাকাগুলোতে ফোরজি সেবা নিশ্চিত হবে। এছাড়া আমাদের কাভারেজ বাড়ানোরও বড় পরিকল্পনা রয়েছে।’
বাংলালিংকের পেজের একটি পোস্টে মাহাদী হাসান তালহা লেখেন, ‘আমার এলাকায় আপনাদের সিম ব্যবহার করতে হলে ফোন গাছের ডালে বেঁধে লাউডস্পিকার দিয়ে কথা বলা লাগে। এত্তো ফাস্ট কেন আপনাদের নেটওয়ার্ক।’ আকরাম হোসাইন লেখেন, ‘ভাই আপনাদের সবই ঠিক, তবে নেটওয়ার্ক সেøা।’
বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অফিসার তৈমুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফোরজি সেবার জন্য ২৩০০ মেগাহার্জের স্পেকটার্ম প্রয়োজন হয়। কিন্তু টুজিতে তা লাগে মাত্র ৯০০ মেগাহার্জ। আমরা ইতিমধ্যে ৯৫ শতাংশ কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা নিশ্চিত করেছি। তবে আমাদের আরও বেশি সাইট লাগবে। যদি সব অপারেটর মিলে আমরা টাওয়ার শেয়ার করতে পারি, তাহলে সব গ্রাহকের কাছে ভালো সেবা পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে।’
রবির পেজে এক পোস্টে তানভীর আহমেদ লেখেন, ‘কলাপাড়া থানা শহরে যদি থ্রিজি নেটওয়ার্ক না পাওয়া যায়, এরচেয়ে দুঃখজনক কিছুই হতে পারে না।’ এইচএমএম ইসমাঈল লেখেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার চম্পকনগর ইউনিয়নে রবি সিমের থ্রিজি নেই। অথচ অনেক বছর আগে রবি টাওয়ার বসানো হয়েছে। আমরা রবি সিম দিয়ে ইন্টারনেট চালাতে অক্ষম।’
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলটরি অফিসার শাহেদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাভারেজ এলাকায় ফোরজি সেবা রয়েছে। তবে দেখা যায়, অনেক ফোন ফোরজি সাপোর্ট করে না। আর কাভারেজ এলাকা থেকে যতদূরে যাওয়া যাবে, নেটওয়ার্ক তত কমতে থাকবে। এছাড়া আমাদের কিছু জায়গায় নেটওয়ার্কের কাজ চলছে। পাশাপাশি নতুন কিছু টাওয়ার তৈরির কাজও আমাদের চলছে।’
গ্রামীণের পেইজে একটি পোস্টে রহিদুল ইসলাম লেখেন, ‘ভাই আমি যখন গ্রামে যাই তখন নেটওয়ার্কের ঝামেলা হয়।’ সাইদুর রহমান লেখেন, ‘এমন সার্ভিস হলে চলবে? কলরেট, ইন্টারনেটের দাম তো ঠিকই বেশি আপনাদের, বাকি সব অপারেটরদের থেকে।’
গত বছরের ২৮ এপ্রিল টেলিকম অপারেটররা বহুল প্রতীক্ষিত ‘আনলিমিটেড’ ও ‘মেয়াদবিহীন’ ইন্টারনেট ডাটা প্যাক চালু করেছে। তবে এতে গ্রাহকদের খুব বেশি সুবিধা হচ্ছে না। কারণ এজন্য প্যাকেজের দাম বাড়িয়েছে অপারেটররা। আর মেয়াদহীন ইন্টারনেট পেতে প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে একই প্যাকেজ চালু করতে হবে। কিন্তু গ্রাহকের সব সময় একই ধরনের ইন্টারনেট প্যাকেজ নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে অব্যবহৃতই থেকে যাচ্ছে গ্রাহকের কেনা ইন্টারনেট। এছাড়া মেয়াদবিহীন হিসেবে মোবাইল অপারেটররা যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে গ্রাহকদের।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে সচল সিমের সংখ্যা ১৮ কোটি ২০ লাখ ৬১ হাজার। এরমধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ৭ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার, রবির ৫ কোটি ৫০ লাখ ১৪ হাজার, বাংলালিংকের ৪ কোটি ৮৫ হাজার এবং টেলিটকের ৬০ লাখ ৬৭ হাজার। আর গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ৫০ লাখ। এরমধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি ও পিএসটিএন)-এর মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন ১১ লাখ ৮৭ হাজার গ্রাহক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
বাংলাদেশের অপরাধীরা আগে ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করত। এরপর জানা গেল, সেখান থেকে দেশে অপরাধ ঘটায় তারা। কারও কারও নেপালে অবস্থানের কথাও জানা যায়। ভারতকে নিরাপদ মনে না করায় আরব আমিরাতের দুবাই বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা। সেখানে তারা আস্তানা গেড়েছে।
পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের অপরাধজগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীরা অপরাধ করেই দুবাই চলে যাচ্ছে। সেখানে বসেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কলকাঠি নাড়ছে। এখন বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরাও দুবাইকে কেন্দ্র করে নানা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। সেখানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে। তাদের কেউ কেউ সোনার কারবারও করছেন। ওই দেশে ভারতের দুর্ধর্ষ অপরাধী দাউদ ইব্রাহিমের শিষ্যত্ব নেওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ওইসব অপরাধীর তথ্য জানার পরও তাদের ফেরত আনতে পারছেন না। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিসের’ দিকেই তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। তালিকাভুক্ত অপরাধীদের ধরতে রেড নোটিস জারি হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর অনেকে পার পেয়ে গেছে। যদিও মামলাটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। তবে নতুন করে আলোচিত মামলাটির পুনঃতদন্ত করার কথা ভাবছে পুলিশ। এ নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ রূপান্তরকে জানান, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ সড়কে গুলি চালিয়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয়। গুলিতে নিহত হন এক কলেজছাত্রী। চাঞ্চল্যকর এই জোড়া খুনের মূল হোতা সুমন শিকদার ওরফে মুসা ঘটনার রাতেই দেশ ছেড়ে চলে যায় দুবাইয়ে। সেখানে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও জয়ের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে মুসা চলে যায় ওমানে। জিসান ও জয় এখনো দুবাইতেই বসবাস করছে। যদিও ওমান থেকে মুসাকে ওই বছরের ৯ জুন ইন্টারপোলের মাধ্যমে ঢাকায় ফিরিয়ে আনে পুলিশ সদর দপ্তর। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের আলোচনায় আসে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও হিরো আলমের দুবাই সফরকে কেন্দ্র করে। তারা বনানীতে পুলিশ হত্যাকাণ্ডের আসামি আরাভ খান নামধারী রবিউল ইসলামের সোনার দোকান উদ্বোধন করতে সেখানে যান। দুবাই যাওয়ার কারণে সাকিব ও হিরো আলমকে যেকোনো সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে ডাকা হতে পারে। এ ছাড়া ‘প্লেজার ট্যুরের’ জন্য এখন দেশের শিল্পপতিদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছে দুবাই। কারণ ঢাকাকে তারা নিরাপদ মনে করছেন না। পাশাপাশি দেশে আটক সোনার চালানের ৮০ শতাংশ জব্দ হচ্ছে দুবাইফেরত বিভিন্ন এয়ারলাইনস থেকে। সব মিলিয়ে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে দুবাই।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরাধীরা যে দেশেই থাকুক না কেন, তাদের চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে আটক করার পর দুবাই থেকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনতে চেয়েছিল পুলিশ। সম্প্রতি আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আরাভকে দুবাই থেকে ফেরত আনতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আশা করি অল্প সময়ে সুখবর দেওয়া সম্ভব হবে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে জানান, সম্প্রতি আলোচনায় আসা আরাভ খানকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ভারতের পাসপোর্টধারী। দেশে তার নামে ১২টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। ওইসব পরোয়ানার কপি ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে পাঠানোর পর দ্রুতই তাকে ফেরানো সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও এর আগে জিসান ও জয়কে দুবাই থেকে ফেরত আনার উদ্যেগ নিয়েও আনতে পারেনি। টের পেয়ে তারা দুবাই ছেড়ে কানাডায় চলে যায়। তারা আবার দুবাই এসেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বিতর্কিত মডেল, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা এই দেশে অপরাধ করে দুবাই গিয়ে আস্তানা গাড়েন। ইতিমধ্যে পুলিশ একটি তালিকা করেছে। ওই তালিকায় গুলশান ও বনানী এলাকার মডেলের সংখ্যা বেশি। বছরখানেক আগে গ্রেপ্তার হওয়া ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকেন। তাদের সঙ্গে অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সখ্য আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। এমনকি বনানীতে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যাকান্ডে তাদেরও সম্পৃক্ততা ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনার পর পিয়াসা, রাজ ও আরাভকে আটকও করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের এক বড় মাপের নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তার অনুরোধে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয় নিয়ে পুনরায় তদন্ত করা হতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংগীতশিল্পী, এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী ও কয়েকজন মডেল নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ধরা পড়েছে। আবার কেউ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তাড়া খেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে আছে কেউ কেউ। আত্মগোপনে থেকেই তারা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই দুবাই রয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ নিয়ে পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা কয়েক দফায় বৈঠক করেছেন। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আলাদাভাবে বৈঠক হয়েছে। ওইসব বৈঠকে বলা হয়েছে, ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করার পরও কেন তারা ধরা পড়ছে না তা খতিয়ে দেখতে হবে। ২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাই চলে যায়। সেখান থেকেও ঢাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। তার সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সোহেল শাহরিয়ার ওরফে শটগান সোহেল, কামরুল হাসান হান্নান, ইব্রাহীম, রবিন ও শাহাদৎ হোসেন বেশিরভাগ সময় দুবাই থাকে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্দিবিনিময় চুক্তি থাকায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধীকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়। শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, শাহাদৎ, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামি নুর হোসেনসহ অনেকেই কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। নুর হোসেন ছাড়া অন্য সন্ত্রাসীদের দেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। সুব্রত, মোল্লা মাসুদ ও শাহাদৎ ভারতে সুবিধা করতে না পেরে মুম্বাই হয়ে দুবাই চলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার অপরাধজগতের এক সন্ত্রাসী এ প্রতিবেদককে বলেন, অপরাধীরা এখন আর ভারত যেতে চায় না। কারণ ওই দেশে শান্তিতে থাকা যায় না। ফলে সবাই এখন দুবাইমুখী হচ্ছে। দুবাইয়ে সবাই নিরাপদে থাকতে পারছে।