
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একটি নাম, যার অঙ্গুলি হেলনে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ নিজেদের জীবন চালিত করেছে একাত্তরে। দলমত-নির্বিশেষে তিনি সবার জাতীয় নেতা। তিনি একটি দলের প্রধান হলেও সব দল নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়েছিলেন দেশ মুক্ত করার জন্য।
ব্রিটিশ টেলিভিশন সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকারের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সাতটি বাক্যে তিনি নেতৃত্বের বিশ্লেষণ করেছেন এভাবেÑ ‘সত্যিকারের নেতৃত্ব আসে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। একজন মানুষ এক দিনে হঠাৎ করেই নেতা হতে পারেন না। এটা অবশ্যই একটি প্রক্রিয়া, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। তাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে, তিনি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে। মানবতার জন্য আত্মত্যাগে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। তার মধ্যে অবশ্যই নীতি-আদর্শ থাকতে হবে। যদি কোনো নেতার এসব গুণ থাকে, তবে তিনি নেতা।’
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও তৎকালীন নেতৃত্বের স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধু যেসব দলমত-নির্বিশেষে সবার নেতা হয়ে উঠেছিলেন তার পরিক্রমাটি বুঝতে পারা যায়। একদিকে ডানপন্থি, অন্যদিকে বামপন্থি; উভয়কেই স্বাধীনতার আন্দোলনের স্রোতে শামিল করেছিলেন। সামলাতে হয়েছে উগ্রপন্থিদের দাবি-দাওয়াকেও। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর প্রতিষ্ঠা লাভ করায় আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার শুরুতে নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দ যুক্ত রাখতে হয়েছিল। তবে ১৯৫৫ সালে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে (তখন তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক) দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে সংগঠনের সদস্যপদ সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
বাসসের সাবেক সিটি এডিটর অজিত কুমার সরকার বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মাঝে মানুষকে আকৃষ্ট করার মোহনীয় শক্তি ছিল। তিনি শুধু ভালো বক্তা নন, তিনি প্রকৃত অর্থে একজন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের কথা তিনি এমনভাবে তুলে ধরতেন যে মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠত।’ [বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং বিশ্ব মিডিয়া, যুগান্তর, ১ আগস্ট ২০২১]। বঙ্গবন্ধু সে সময়কার বাম নেতাদের সঙ্গেও যথোচিত সংযোগ রাখতেন।
বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ৩৮ বছরের রাজনৈতিক জীবন গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে যে সত্যটি বের হয়ে আসে তা হলোÑ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দলের নেতৃত্ব দিলেও তার রাজনীতি কখনো সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির স্বার্থে পরিচালিত করেননি। শেখ মুজিব পাকিস্তানি শোষণ, নির্যাতন, বৈষম্য, জাতিগত নিপীড়ন ইত্যাদি বিষয়গুলোকে যতটা দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করেছিলেন তা আর অন্য কোনো দল বা রাজনৈতিক নেতার মধ্যে দেখা যায়নি।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ডান-বাম-উগ্র সবার কথাই নিজের ভাষায় এমনভাবে বললেন যে তা সবার ভাষ্য হয়ে ওঠে। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, এক পক্ষ, যারা বিশ্বাস করতেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ পরিক্রমণের মধ্য দিয়ে জনগণের রায়সমৃদ্ধ হয়ে একটা পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীনতার আহ্বান উচ্চারিত হবে। যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন প্রতিষ্ঠিত করার দিবাস্বপ্নে বিভোর ছিলেন, তাদের চাপ ছিল ৭ মার্চে রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। বাংলার স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরণে যারা বিশ্বাসী ছিলেন, তাদের চেতনার মণিকোঠায় ছিল ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেবেনÑ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যাতে তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে বিশেষ করে এই বাংলার মানুষকে তারা ভুল বোঝাতে না পারে, আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে। তাই বঙ্গবন্ধুকে অতি সুকৌশলে স্বাধীনতার বার্তাটি উচ্চারণ করতে হবে, যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে।
তিনি বলেন, মানিক মিয়ার চিন্তার উত্তরাধিকারী হিসেবে সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ আওয়ামী লীগের বেশ কিছু প্রবীণ নেতা বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়েছিলেন, ক্ষমতার পথ ব্যবহার করাই হচ্ছে বাংলার কল্যাণের ও শোষণের প্রতিশোধের একমাত্র উপায়। জন-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা এবং সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি যাদের প্রতীতি ও প্রত্যয় ছিল অবিচল, তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আমাদের চেতনার আঙ্গিকে যারা আমার অগ্রজ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, এনায়েতুর রহমান, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ ছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন, ম্যান্ডেটের পর আঘাত হানলে জীবনের বিনিময়ে হলেও শুধু প্রতিরোধই নয়, প্রত্যাঘাতও করা হবে। উল্লিখিত তিনটি শক্তিকেই বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুকৌশলে পোষ মানিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সমস্ত সত্তায় বাংলার মানুষের হৃদয় অনুরণিত হতো। এ কারণেই স্বাধীনতা-পূর্বকালে সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে তিনি বাংলার মানুষকে একটি অদৃশ্য ঐক্যের রাখিবন্ধনে বাঁধতে পারলেন।
উল্লেখ্য, তখন বিশ্ব ছিল দুই ব্লকে বিভক্তÑ সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মতো একটি ক্ষুদ্র দেশের পক্ষে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। এমন স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির হাল ধরেন শক্ত হাতে। আমরা সচরাচর দেখি, বেশির ভাগ নেতার কথা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। অনেকেই ‘পুঁজিবাদ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ’, ‘বুর্জোয়া’, ‘পেটিবুর্জোয়া’ ও ‘প্রোলেতারিয়েত’ ধরনের কিছু গৎবাঁধা শব্দ ছাড়া সাধারণ মানুষের ভাষায় যেন কথাই বলতে পারে না। বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে এমন কোনো শব্দ ব্যবহার করতেন না। কৃষক-শ্রমিক-রাজনীতিক-শিক্ষক সবাই তার কথা বুঝতে পারত। তন্ময় হয়ে শুনত।
তৎকালীন অনেক বাঘা বাঘা নেতৃত্বকে পেছনে ফেলে শেখ মুজিব সবার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন তার সাহস ও স্বকীয়তায়। তার সামগ্রিক ত্যাগ ও সাহসী নেতৃত্বের ফলেই বাঙালি পেয়েছে হাজার বছরের কাক্সিক্ষত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ।
ব্রিটিশ ভারতে জন্ম নেওয়া শিশুটির নাম রাখা হয় খোকা। পরের পাঁচ দশকে ভারতবর্ষ দেখেছে বিভাজন আর মানচিত্র বদলে যাওয়ার জটিল-কুটিল রাজনীতি। এই পরিক্রমায় সেদিনের খোকা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব, মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা। ইতিহাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে দূরদ্রষ্টার মতো যিনি চলেন অমরত্বের পথে। আমরা সেই ঊর্ধ্বমুখী যাত্রাপথের ১৫টি ধাপ ছুঁয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে স্মরণ করছি জনকের জন্মদিন।
দুরন্ত কিশোর পেল পথের দেখা
১
তরুণ রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিব ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ সফরে আসা তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন।
১৯৩৮ সাল। বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আসবেন গোপালগঞ্জে। করা হয়েছে বিশাল জনসভার আয়োজন। এ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিপুল আলোড়ন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ভার মিশন স্কুলের ছাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর।
সভা শেষে মিশন স্কুল দেখতে গেলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বঙ্গবন্ধুসহ অন্যরা তাকে সংবর্ধনা দিলেন। এরপর সোহরাওয়ার্দী যখন হেঁটে লঞ্চের দিকে চলছিলেন, বঙ্গবন্ধুও ছিলেন তার পাশে। তখন কিছু কথা হয় তাদের মধ্যে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নোটবুক বের করে বঙ্গবন্ধুর নাম-ঠিকানা লিখে নিলেন। কয়েক দিন পর পাঠালেন চিঠি। সেই চিঠিতে বঙ্গবন্ধুকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি কলকাতায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন সোহরাওয়ার্দী।
১৯৪৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন। সে বছর তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের (অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের শাখা) কাউন্সিলর নির্বাচিত হন এবং ভারত বিভাজন পর্যন্ত তার দায়িত্ব প্রশংসনীয়ভাবে পালন করে যান। ১৯৪৭ সালে মহাত্মা গান্ধী শান্তি মিশনে কলকাতা এলে শেখ মুজিবুর রহমান তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভারত ও পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে স্বতন্ত্র, স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন। যদিও এই উদ্যোগ বাতিল হয় কিন্তু পরে এটিই একজন জাতির পিতার স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি হয়ে ওঠে।
বেকার স্ট্রিট থেকে মোগলটুলি
২
সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে প্রোগ্রেসিভ (উদারপন্থি) নেতারা ছিলেন, তারা নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। কলকাতা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকেলে ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরে সেই দলের নাম পরিবর্তন হয়ে হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী সেই দলের নামকরণ করা হয়। সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে আটক থাকলেও তাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
১৯৫২ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরের বছর সাধারণ সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ সালের আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সব ধর্মের মানুষের অন্তর্ভুক্তি এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ‘মুসলিম’ শব্দটি প্রত্যাহার করে নাম রাখা হয় ‘আওয়ামী লীগ’। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বন্ধু
৩
১৯৪৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের চাকরির নিরাপত্তা বিধান এবং অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সমর্থন জানান। ১৯ এপ্রিল চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের পক্ষে মিছিল বের করার প্রস্তুতিকালে কয়েকজন শিক্ষার্থীসহ শেখ মুজিবুর রহমানকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগের আগে ছাত্রলীগ
৪
১৯৪৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম বিরোধীদলীয় ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য মুসলিম লীগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য কর্মতৎপরতা শুরু করেন। ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবসে’ ধর্মঘট পালনকালে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় কয়েকজন সহকর্মীসহ শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন। তার গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ মুসলিম লীগ সরকার শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্য ছাত্রনেতাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে গেলেন বৈশ্বিক অঙ্গনে
৫
১৯৫২ সালে জেলবন্দি অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন এবং আন্দোলনকে সফল করার জন্য জেল থেকেই পাঠাতেন গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা। ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শেখ মুজিবুর রহমান জেলের ভেতরেই ১১ দিন ধরে আমরণ অনশন করেন এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ধর্মঘট আহ্বান করে। আন্দোলনরত ছাত্রজনতা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে অগ্রসর হলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিউরসহ অনেকে। জেল থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমান শহীদদের প্রতি গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানান। একই বছর শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে চীন সফর করেন। শান্তি সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় বক্তৃতা দেন, ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে যান বৈশ্বিক অঙ্গনে।
মন্ত্রিত্ব থেকে নেতৃত্বে
৬
১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ একাই ১৪৩টি আসনে জয়ী হয়। শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ আসন থেকে নির্বাচিত হন এবং ১৫ মে নতুন প্রাদেশিক সরকারের সমবায় ও কৃষিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ২৯ মে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার হঠাৎ করে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। ৩০ মে শেখ মুজিবুর রহমান করাচি থেকে ঢাকায় পা রাখা মাত্রই গ্রেপ্তার হন। ২৩ ডিসেম্বর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
গঠন করলেন নিউক্লিয়াস
৭
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান সামরিক শাসন জারি করে এবং সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে। ১১ অক্টোবর আবার শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। একের পর এক মিথ্যা মামলায় তাকে হয়রানি করতে থাকে সামরিক সরকার। ১৪ মাস পর শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে জেলগেটেই আবার গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৬১ সালে হাইকোর্ট আটকাদেশ অবৈধ ঘোষণা করার পর শেখ মুজিবুর রহমান কারাগার থেকে মুক্তি পান। সে সময়ই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করতে উদ্যমী ছাত্র নেতাদের নিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যা নিউক্লিয়াস নামে পরিচিত।
ছয় দফায় দেখালেন নতুন দিশা
৮
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপনের চেষ্টা করেন। তিনি ছয় দফাকে সম্মেলনের এজেন্ডা করতে চাইলে অধিকাংশ নেতা ছয় দফাকে পাকিস্তানকে টুকরো করার ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এর প্রতিবাদে শেখ মুজিব সম্মেলন থেকে ওয়াকআউট করেন। এরপর তিনি ঢাকায় এসে ছয় দফা নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। প্রস্তাবিত ছয় দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন। ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে তিনি সারা বাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। এ সময় তাকে আটবার গ্রেপ্তার করা হয় এবং সর্বশেষ ৮ মে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় তিন বছর শেখ মুজিবুর রহমান কারারুদ্ধ ছিলেন।
আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে আগরতলা
৯
১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন বাঙালির (রাজনীতিবিদ এবং সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা) বিরুদ্ধে পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে। জেলে বন্দি থাকা অবস্থাতেই ১৮ জানুয়ারি তার বিরুদ্ধে আবার গ্রেপ্তারি আদেশ জারি করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে গণবিক্ষোভ শুরু হয়।
হলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ বললেন ‘বাংলাদেশ’
১০
১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন শুরু হয়। টানা গণ-আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সব বন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল ছাত্রসমাবেশে লাখো শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আওয়ামী লীগের এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের নাম রাখেন ‘বাংলাদেশ’।
সত্তরের নির্বাচনে মহানায়ক
১১
১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার আলোকে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগের জন্য তিনি নৌকা প্রতীক বেছে নেন। ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে উপকূল এলাকায় লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটে। শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনী প্রচারণা স্থগিত রেখে ঘূর্ণিঝড়বিধ্বস্ত অঞ্চলে ছুটে যান। ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হয়।
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’
১২
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে। এ ঘোষণার ফলে সর্বস্তরের বাঙালি রাস্তায় নেমে আসে। ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স ময়দানের (পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
ঘোষণা করলেন স্বাধীনতা
১৩
২৫ মার্চ রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শতাব্দীর ঘৃণ্যতম গণহত্যা চালায়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এরপরই তাকে ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল এ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের নেতৃত্বে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এ সরকারের পরিচালনায় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে। ৯ মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করে, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করে, পুড়িয়ে দেয় লাখো মানুষের ঘরবাড়ি। প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
স্বাধীন করে ফিরলেন দেশে
১৪
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক চাপের মুখে স্বৈরাচারী পাকিস্তানি সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। লন্ডন এবং নয়াদিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে ফিরে আসেন। লাখো জনতার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় স্নাত হয়ে বঙ্গবন্ধু তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে আসেন এবং জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ১২ জানুয়ারি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে শেখ মুজিবুর রহমান নতুন বাংলাদেশকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করেন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ নবপ্রণীত সংবিধানের আলোকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ২৩ মে বিশ্ব শান্তিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব শান্তি পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কারে ভূষিত করে। সেপ্টেম্বরে শেখ মুজিবুর রহমান আলজেরিয়ার জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দেন।
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ পরিষদের সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় বক্তব্য দেন। বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষায় এটিই প্রথম ভাষণ।
চিরকালের
১৫
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী ও উচ্চাভিলাষী বিশ্বাসঘাতক কর্মকর্তার হাতে প্রায় সপরিবারে নিহত হন। দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যান। বাঙালি জাতির ইতিহাসে অন্ধকারতম দিন ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয় এবং স্মরণ করা হয় বিশাল হৃদয়ের মহাপ্রাণ মানুষটিকে যিনি তার সাহস, শৌর্য, আদর্শ ও ভালোবাসার মধ্য দিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন বাঙালির অন্তরে।
তথ্যসূত্র : ১. মযহারুল ইসলাম, ২০১১, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, ঢাকা, আগামী প্রকাশনী ২. শেখ হাসিনা (সম্পাদিত), ২০২১, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ, ৩. মুজিবপিডিয়া।
শেখ মুজিবর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার এই যাত্রাপথে বিভিন্ন মানুষ নানাভাবে জড়িয়ে রয়েছেন। যেসব ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন, নিঃসন্দেহে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাদের মধ্যে উজ্জ্বলতম মানুষ। তাদের দুজনের সম্পর্ককে অনেকে গুরু-শিষ্য বলেও মহিমান্বিত করেছেন। আর কে না জানে, সুফি ও বাংলার গুরুবাদী ভাবধারায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্কটি দ্বিপাক্ষিক। শিষ্য যেমন গুরুর কাছ থেকে নেন, গুরুও শিষ্যর কাছ থেকে নেন। এই লেনদেন না হলে সম্পর্ক স্থাপিত হয় না, ভালোবাসাও খাঁটি হয় না। এই দেওয়া-নেওয়া বস্তুবাদীও হতে পারে, আধ্যাত্মিকও হতে পারে। এসব তত্ত্ব আলাপের চেয়ে আমরা বরং বঙ্গবন্ধু ও সোহরাওয়ার্দীর সম্পর্কটি বোঝার চেষ্টায় প্রবিষ্ট হই। এই লেখার সেটাই উদ্দেশ্য।
বঙ্গবন্ধুর মাত্র ৫৫ বছরের জীবন পর্যালোচনা করতে গেলে আমাদের বারবার তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়তে হবে। আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হলো, কেমন করে তার সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম, কীভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তার স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।’
১৯৩৮ সালের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়েন। শহরে আসবেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরির দায়িত্ব পড়ল কিশোর শেখ মুজিবের ওপর। সভা শেষে সোহরাওয়ার্দী গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। স্কুলের ছাত্রদের পক্ষে তাকে সংবর্ধনার নেতৃত্বের ভার বঙ্গবন্ধুর কাঁধে। স্কুল থেকে সোহরাওয়ার্দী যখন ফিরছিলেন, হাঁটতে হাঁটতে তাকে লঞ্চঘাট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু। তখনই প্রিয় গুরুর সঙ্গে প্রথম আলাপ কিশোর মুজিবের।
ভাঙা ভাঙা বাংলায় বঙ্গবন্ধুকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করলেন সোহরাওয়ার্দী। নোটবুক বের করে নাম-ঠিকানা টুকে নিলেন। পরে একটা ধন্যবাদ চিঠিও পাঠান। আরও বললেন, বঙ্গবন্ধু যেন কলকাতায় গেলে তার সঙ্গে দেখা করেন।
বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতায় গেলেন, সোহরাওয়ার্দীর বাড়ির দারোয়ান প্রথমে তাকে ঢুকতে দিতে চাননি। সোহরাওয়ার্দী তখনো মন্ত্রী। তার দেওয়া কার্ডটি দারোয়ানকে দেখালেন শেখ মুজিব। কার্ড দেখে তাকে তাড়াতাড়ি ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘ম্যাট্রিক তো পাস করে ফেলেছো, এখানেই কলেজে ভর্তি হও। আমার সঙ্গেও কাজ করো।’ এভাবেই বঙ্গবন্ধু কাজ শুরু করেন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্রলীগের প্রাদেশিক শাখায়।
মুসলিম লীগ ভাগ হওয়ায় ছাত্রলীগও বিভক্ত হয়ে যায়। নাজিমুদ্দীন সমর্থিত গ্রুপটির নেতৃত্ব দেন শাহ আজিজুর রহমান। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপকে সমর্থন দিতে থাকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগ।
বঙ্গবন্ধুকে ভীষণ স্নেহ করতেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এর একটি প্রমাণ বঙ্গবন্ধুর প্রথম লাহোর সফর। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী পার্টি গঠন বিষয়ে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরামর্শ করতে তাকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। কিন্তু লাহোর পৌঁছে বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন, সোহরাওয়ার্দী সেখানে নেই। তখন শীতকাল। এদিকে বঙ্গবন্ধুর কাছে শীতের কাপড়ও নেই। তিনি উপায় না দেখে পূর্বপরিচিত মিয়া ইফতিখার উদ্দিনের বাড়িতে ওঠেন।
সোহরাওয়ার্দী লাহোর ফিরলেন বঙ্গবন্ধু যাওয়ার দুদিন পর। তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন সোহরাওয়ার্দী। খোঁজখবর নিলেন। তারপর একান্তে কথা বললেন স্নেহের শিষ্যের সঙ্গে। তার থাকার জন্য নিজে হোটেল ঠিক করে দিলেন। দোকানে নিয়ে জামা-কাপড় কিনে দিলেন। সেবার লাহোরে থাকার দিনগুলোতে সকালে সোহরাওয়ার্দীর কাছে গিয়ে রাতে ফিরতেন বঙ্গবন্ধু। সারা দিন আলাপ চলত দুজনের।
স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জীবনের বহুদিন তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছি। তার স্নেহ পেয়েছি এবং তার নেতৃত্বে বাংলার লোক পাকিস্তান আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। যার একটা ইঙ্গিতে হাজার হাজার লোক জীবন দিতে দ্বিধাবোধ করত না, আজ তার কিছুই নেই। মামলা না করলে তার খাওয়ার পয়সা জুটছে না। কত অসহায় তিনি! তার সহকর্মীরা- যারা তাকে নিয়ে গর্ববোধ করত, তারা আজ তাকে শত্রু ভাবছে। কত দিনে আবার দেখা হয় কী করে বলব? তবে একটা ভরসা নিয়ে চলেছি, নেতার নেতৃত্ব আবার পাব। তিনি নীরবে অত্যাচার সহ্য করবেন না, নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করবেন। পূর্ব বাংলায় আমরা রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করতে পারব এবং মুসলিম লীগের স্থান পূর্ব বাংলায় থাকবে না, যদি একবার তিনি আমাদের সাহায্য করেন। তার সাংগঠনিক শক্তি ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব জাতি আবার পাবে।’
সোহরাওয়ার্দীও স্মৃতিচারণায় বঙ্গবন্ধুকে তারকা সংগঠক আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন রাজনীতির উত্তপ্ত মাঠের দুর্বার কর্মী। স্নেহের মুজিবের জন্য অনেক করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে ১৯৫৮ সালের এপ্রিলে তিনি যখন আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় অংশ নিতে ঢাকায় আসেন, তখনই বুঝতে পেরেছিলেন শেখ মুজিব সে-ই কাঁচা হীরার টুকরা, যাকে সামান্য দিকনির্দেশ দিতে পারলেই পূর্ব বাংলা তার সবচেয়ে বলিষ্ঠ নেতা পাবে।
ওই বছরই তার প্রস্তাব অনুসারে পশ্চিমা রাজনীতি ও অর্থনীতির রূপরেখা নিয়ে জ্ঞান বাড়াতে বঙ্গবন্ধুকে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে শিক্ষা সফরে পাঠায় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি। দুই মাসের সেই ট্যুরে তিনি সবচেয়ে বেশি সময়, ১২ দিন কাটিয়েছিলেন লন্ডনে।
বঙ্গবন্ধুর সংসারের আয়-রোজগার নিয়েও ভাবতেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাই ১৯৫৭ সালে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার আগেই তিনি বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান চা বোর্ডের সভাপতি করেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সারাক্ষণ রাজনীতি নিয়ে থাকেন। তাই উপার্জনের এমন একটা রাস্তা তাকে সোহরাওয়ার্দী জুটিয়ে দিয়েছিলেন, যে পদটি আলংকারিক; আক্ষরিক অর্থে যেখানে খুব একটা সময় দেওয়ার বালাই ছিল না।
প্রিয় গুরুর জীবনেও বঙ্গবন্ধুর অনেক অবদান। ভাষা আন্দোলন, দলের নাম বদলসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মতবিরোধ হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত শিষ্যের বিচক্ষণ যুক্তি মেনে নিয়েছেন গুরু। এই যেমন, ভাষা আন্দোলনে সোহরাওয়ার্দীর সমর্থন আনতে করাচি গিয়ে হাজির হয়েছিলেন ‘নাছোড়বান্দা’ বঙ্গবন্ধু। আবার ১৯৫৫ সালে দলকে অসাম্প্রদায়িক করতে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিতে রাজি করিয়েছেন। শুরুতে গুরু-শিষ্যের যে লেনদেনের কথা বলছিলাম, সেটা দিয়েই শেষ করি। সোহরাওয়ার্দী যেমন পরিচয়ের প্রথম ক্ষণটিতেই বঙ্গবন্ধুকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুও প্রথম সাক্ষাতে তার পরবর্তী যাত্রাপথের পথপ্রদর্শকের নিশানা পেয়েছিলেন। একদিকে তরুণ শেখ মুজিবের সাংগঠনিক দক্ষতাকে সোহরাওয়ার্দী ব্যবহার করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। অন্যদিকে, তরুণ মুজিবও দ্বীধাহীনভাবে রাজনীতির দিক্ষা সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে বুঝে নিতে দেরি করেননি। গুরু-শিষ্যের এই পরম্পরা বাংলার এক নিবিড় সংরাগ।
তথ্যসূত্র: অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান; বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর.কম; টিবিএস.কম বাংলা।
ছাত্রলীগ হচ্ছে পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথম সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠন, আওয়ামী লীগের পূর্বসূরি। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড় বছর আগে, আর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪ মাস ১৯ দিন পর এর প্রতিষ্ঠা (৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮)। বঙ্গবন্ধু সে সময়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’-এর ছাত্র। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় তিনিই যে মূল উদ্যোক্তা ছিলেন, পূর্বাপর ঘটনাও তার প্রমাণ বহন করে।
‘ছাত্রলীগ গঠন করার সাথে সাথে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল। এক মাসের মধ্যে আমি প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমউদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হতো। একদল সহকর্মী পেয়েছিলাম, যারা সত্যিকারের নিঃস্বার্থ কর্মী।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৮৯]
ভাষা-আন্দোলনের প্রথম পর্বে বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সে স্থান পূরণ করেন। শুধু ভাষা-আন্দোলন বা মুসলিম লীগ সরকারের প্রাথমিক জেল-জুলুম-নির্যাতন মোকাবিলায় নয়, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় ও এর সংগঠন গড়ে তুলতেও ছাত্রলীগ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় :
‘আওয়ামী লীগ গড়ে উঠবার পূর্ব পর্যন্ত একমাত্র ছাত্রলীগই সরকারের অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত এবং জনগণ ও ছাত্রদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরত’ (আত্মজীবনী, পৃ. ২৩৬)।
ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার দুই মাস যেতে না যেতেই প্রথম চ্যালেঞ্জ আসে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ মার্চ হরতাল সফল করার। বঙ্গবন্ধু এই সুযোগে ছাত্রলীগের সংগঠন গুছানোর জন্য সচেষ্ট হন। ১১ মার্চ ঢাকার রাজপথে বঙ্গবন্ধু পিকেটিংয়ে নামেন শত শত ছাত্রের সঙ্গে। এসময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাকিস্তানে এটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম জেল। তবে এই সফল হরতালের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ছিল পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর গভর্নর জেনারেল হিসেবে প্রথম সফর। এ কারণে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ সরকার আপস করতে চায়। তারা ৮-দফা আপস প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করে সেটা পাঠায় কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। বলা হয়, তিনি সম্মতি দিলে পূর্ব পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা চালাবে এবং আটক সব বন্দিকে মুক্তি দেবে। এই চুক্তি তিনি অনুমোদন করেন। ১৫ মার্চ মুক্ত হয়ে তিনি পরদিন আমতলায় অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় সভাপতিত্ব করেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেন- ‘বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হলো।’ [পৃষ্ঠা ৯৬]
বঙ্গবন্ধুই ছিলেন এ ছাত্রসংগঠনের প্রাণশক্তি। সমসাময়িক ছাত্রনেতাদের মধ্যে অনেকের চেয়ে তিনি ছিলেন বয়সে জ্যেষ্ঠ। তিনি তখনই মনে মনে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার পক্ষে মনস্থির করে ফেলেছিলেন। হয়তো সে কারণে তিনি নিজেকে ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত করেননি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়লে ছাত্রত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের অবসান ঘটে।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর যুগ্মসম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েই বঙ্গবন্ধু জেলায়-মহকুমায় আওয়ামী লীগ গঠনে মনেযোগী হন। একইসঙ্গে প্রতিটি স্থানে তিনি ছাত্রলীগ গড়ে তোলার কাজেও অংশ নিতে থাকেন। তিনি ছাত্রদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যার সমাধান, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার দাবিতে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু নিজে আর ছাত্র না থাকায়, ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব তিনি নেননি। ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ ঢাকার তাজমহল সিনেমা হলে ছাত্রলীগের প্রথম আনুষ্ঠানিক সম্মেলনে অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি রাজি হননি।
পরদিন ১৭ সেপ্টেম্বর আরমানিটোলা ময়দানে ছাত্র-জনসভা অনুষ্ঠিত হয় মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে। জনসভায় ভাসানী বলেন- ছাত্র বন্ধুরা, মজিবরকে তোমাদের কাছ থেকে আমি নিয়ে নিলাম। জানি, তোমরা কষ্ট পেয়েছো। কিন্তু জালেম মুসলিম লীগকে সরাতে হলে আওয়ামী লীগকে গ্রামে গ্রামে গড়ে তুলতে হবে। এ কাজে আমার আতাউর রহমান, সালাম খান, শামসুল হক আছে। কিন্তু মজিবরের মতো উপযুক্ত যুবক ছাড়া আমি কিছুই করতে পারব না।
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, ছাত্ররা জেগে উঠেছে। ছাত্রলীগ সফল সম্মেলন করেছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানে মাত্র ৫ শতাংশ লোক লেখাপড়া জানে। এ অবস্থায় ছাত্রদের রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় ভূমিকা রাখার বিকল্প নেই। অন্যথায় জনগণের দুঃখ-কষ্ট দূর করা যাবে না। নির্যাতন আসবে, সেটা উপেক্ষা করে ছাত্রদের এগিয়ে যেতে হবে। ছাত্র আন্দোলন করার জন্য বৃত্তি কেটে নেওয়া হয়। ছাত্রছাত্রীদের জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো দমননীতি তোমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। ছাত্রলীগ সম্পর্কিত আরও কিছু স্মৃতিচারণা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যদিও আমি সদস্য ছিলাম না, তবুও ছাত্রনেতারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। প্রয়োজন মতো বুদ্ধি পরামর্শ দিতে কার্পণ্য করি নাই। এরাই আমাকে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শ্রদ্ধা করেছে’ (পৃ. ১২৭)।
যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বহিষ্কার করেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নির্বাচিত ছাত্র সংসদ ‘ডাকসু’ ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে প্রবল ছাত্র-গণ আন্দোলন গড়ে কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে আনে এবং তাকে বরণ করে নেয় ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে। এর দুই বছর পর এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় তার আহ্বানে ডাকসু নেতৃত্ব উত্তোলন করে বাংলাদেশের লাল-সবুজ-সোনালি রঙের ‘জাতীয় পতাকা’, ১৭ এপ্রিল ‘মুজিব নগরে’ বাংলাদেশ সরকার যাকে অভিবাদন জানিয়ে আনুষ্ঠানিক শপথ নেয়। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রসমাজের ঐতিহ্যবাহী ও সবচেয়ে পুরনো সংগঠন এই ছাত্রলীগই ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
পরাধীন মানুষের নেতা হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে জন্মদিন পালন পছন্দ করতেন না। উৎসবের নামে ব্যয়বাহুল্যগুলো তিনি কখনো প্রশ্রয়ও দেননি। তার বাসায়ও কখনো জন্ম উৎসব পালিত হতো না। কিন্তু যে কটা জন্মদিন তার জেলে কেটেছে সেই মুহূর্তগুলোর বিশেষ এই দিনটাকে পরিবারের সবার খুব বেশি মনে পড়ত। জন্মদিনে তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়ে আগে থেকেই জেল কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিতেন বঙ্গবন্ধুর পরিবার। একবার দেখা করার অনুমতিও পেয়েছিলেন। পরিবারের সদস্যরা তার জন্য কিছু ফুল, মিষ্টি আর কয়েকটি বই নিয়ে গিয়েছিলেন। পরিবারকে কাছে পেয়ে ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বঙ্গবন্ধুর চোখ-দুটো চিকচিক করে উঠেছিল। তাকে জন্মদিনের শুভকামনা জানিয়ে নীরবে ফিরে এসেছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা। নিজ থেকে জন্মদিন পালন না করলেও একাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত সমগ্র জাতি আপন অনুভূতির আলোকে উদযাপন করে প্রিয় নেতার জন্মদিন। এদিন ভোর থেকেই চেনা-অচেনা মানুষে ভরে যেত ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাড়ির আঙিনা। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ভরা থাকত তাদের মুখ। হাজারো মানুষের সঙ্গে মিলিত হতে পেরে বঙ্গবন্ধুও উচ্ছল হয়ে উঠতেন। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ এই ছয় বছরের সব দৈনিক পত্রিকা ঘেঁটে তৈরি করা হয়েছে এই প্রতিবেদন।
১৭ মার্চ ১৯৭১, বুধবার
কালো পতাকা-শোভিত ধানম-ির ৩২ নম্বর বাড়িতে ছিল না কোনো বিশেষ আয়োজন। এদিন রাজনৈতিক সংকট নিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক করেন। রমনা পার্কের বিপরীত পাশে প্রেসিডেন্ট ভবনে এক ঘণ্টা বৈঠক শেষে বেলা ১১টা ৬ মিনিটে কালো পতাকা-শোভিত গাড়িতে করে বের হয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু। দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীরা গেটে তাকে ঘিরে ধরেন। গেটের একটু সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের উদ্দেশ বলেন, ‘দেখুন, আমার কিছুই বলার নাই। আলোচনা অব্যাহত আছে।’ এরপর বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনের দিকে রওনা দেন। সাংবাদিকরাও তার পিছু নেন। ৩২ নম্বরের বাড়িতে সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরলেন। বললেন, আজ আপনার ৫২তম জন্মদিন। জন্মদিনে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই। বঙ্গবন্ধু বেদনার্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আমি তো আমার জন্মদিন পালন করি না। আমি তো আমার জন্মদিনে কেক কাটি না, মোমের বাতি জ¦ালি না। যে দেশের মানুষ কথায় কথায় গুলি খায়, অনাহারে-অর্ধাহারে মৃত্যুবরণ করে; সে দেশের নেতা হিসেবে আমার জন্মদিনই-বা কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমি তো আমার জীবন বাংলার জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি। আমার জন্মদিনের একমাত্র বক্তব্য হলোÑ লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলতে থাকবে। সত্য ও ন্যায় আমাদের পক্ষে। জয় আমাদের অনিবার্য।’ শেখ মুজিবের মুখে এই সংগ্রামের আহ্বান ও বিজয়ের বাণীই সেদিন মুখ্য হয়ে ওঠে।
ওইদিন সন্ধ্যার পর লোকজন ছোট-বড় মিছিল নিয়ে ফুলের তোড়া ও কেক হাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে গিয়ে হাজির হন। লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় অত্যন্ত ঘরোয়া পরিবেশে বঙ্গবন্ধু লনে এসে শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে আন্তরিকতায় মেতে ওঠেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে রবীন্দ্র কাব্যের কয়েকটি চরণ ঘুরে-ফিরে উচ্চারিত হচ্ছিলÑ ‘চারদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ^াস/শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’ তার মুখে ছিল নজরুলের কবিতাÑ ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত;/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল/আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ/ভীম রণভূমে রণিবে না।’ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে স্থানীয় গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানি ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ভিত্তিতে ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ’ নামাঙ্কিত একটি রেকর্ড প্রকাশ করে।
১৭ মার্চ ১৯৭২, শুক্রবার
বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিনটি ছিল অনাড়ম্বর কিন্তু গভীর আন্তরিকতার। এ দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তিন দিনের সফরে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন। জন্মদিন উপলক্ষে শ্রীমতি গান্ধী ভারতের পঞ্চান্ন কোটি মানুষের শুভেচ্ছা, বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের নিদর্শনস্বরূপ স্বদেশে থেকে ফল ও মিষ্টি নিয়ে আসেন। তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমেই তিনি এসব উপহার বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে পাঠিয়ে দেন। এর আগে স্নিগ্ধ সকালে হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগী সমবেত হয় ৩২ নম্বর বাড়ির সেই অতিপরিচিত অঙ্গনে। তাদের দেখে স্মিতমুখে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘আমার আবার জন্মোৎসব কিরে? আয় আয় তোরা আমার কাছে আয়।’ এ যেন নেহাত কোনো ব্যক্তির আমন্ত্রণ নয়, যেন ছিল একটি সাগরের আহ্বান। শ্রদ্ধার বিনম্র চিত্তে সবাই এগিয়ে এলো। প্রিয় নেতার হাতে তুলে দিল পুষ্পস্তবক। গলায় পরিয়ে দিল মালা।
এদিন সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে তেজগাঁও বিমানবন্দরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। সঙ্গে ছিল ছোট ছেলে শেখ রাসেল। শ্রীমতি গান্ধী সস্নেহে রাসেলের মাথায় হাত বুলান। গার্ড অব অনার দেওয়ার পর আলোকচিত্র-সাংবাদিকদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু ও শ্রীমতি গান্ধীকে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয়। এরপর তারা একটি হেলিকপ্টারে করে বঙ্গভবনের উদ্দেশে রওনা হন। অপরাহ্ণে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু ও শ্রীমতি গান্ধী বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে ওইদিন ঢাকার প্রভাতি দৈনিকগুলো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে।
১৭ মার্চ ১৯৭৩, শনিবার
আগের দিন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। বাহ্যিক আড়ম্বর নয়, হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসার ঐশ^র্য দিয়ে সমগ্র জাতি, বঙ্গবন্ধুর ৫৪তম জন্মদিন পালন করে। ভোরের সূর্য পূর্ণদীপ্তি নিয়ে প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই জাতির জনকের বাসভবনের সামনে শুভেচ্ছা প্রকাশে ইচ্ছুক মানুষের ভিড় জমে যায়। বঙ্গবন্ধু সকালে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করে জনতার কাতারে নেমে আসেন। শুভেচ্ছা গ্রহণ ও মাল্যভূষিত হওয়ার সময় জাতির জনক আবেগরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সেদিন নিরাপত্তাব্যবস্থার দিকে খেয়াল ছিল না বঙ্গবন্ধুর। ভোরবেলা থেকে যে জনস্রোত তলায় এবং গেটের সামনে ভিড় জমে যায়। গণভবনে সমবেত জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনাদের ভালোবাসা আর আশীর্বাদ ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নাই। আর কিছু পেতেও চাই না। আমি যা পেয়েছি, বিশে^র কোনো নেতা এতটা পেয়েছেন কি না জানি না। এত পাওয়া খুব কম লোকের ভাগ্যেই ঘটে। এখন কামনা হচ্ছে, আমি যেন এ দেশের মানুষের মুখে হাসি দেখে মরতে পারি।’ প্রিয় জনগণকে কাছে পেয়ে বঙ্গবন্ধু আনন্দে মেতে উঠেছিলেন। পরে তিনি সবুজ লনে নেমে খাঁচায় রক্ষিত একটি ময়ূর ও হরিণ-ছানাকে নিজ হাতে খাওয়ান এবং অনুগামী সাংবাদিকদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় যোগ দেন।
১৭ মার্চ ১৯৭৪, রবিবার
চুয়াত্তরে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটা ছিল অন্যরকম। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার নবতর সংগ্রামে দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ১১ মার্চ হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক নূরুল ইসলাম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাকে সম্পূর্ণ বিশ্রামের পরামর্শ দেন। মন্ত্রিসভার সদস্য সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতারা, ছাত্রনেতাসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে তার বাসভবনে সমবেত হন। উপহারস্বরূপ পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বঙ্গবন্ধুর ছবি তুলতে সকাল থেকেই আলোকচিত্রীরা ভিড় জমান। রশীদ তালুকদারের ক্যামেরা নিয়ে বঙ্গবন্ধু ছবি তুলতে থাকেন। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. মজহারুল ইসলাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ শীর্ষক বইটি বঙ্গবন্ধুর হাতে অর্পণ করেন। ওইদিন অসুস্থ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ দুই নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। সরকারি ও বেসরকারি ভবনের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিবসটি সূচনা হয়। বিভিন্ন মসজিদে বঙ্গবন্ধুর সুস্থতা কামনা করে মিলাদ মাহফিল ও বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করা হয়। ১৯ মার্চ সকালে উন্নত চিকিৎসার জন্য মস্কোতে রওনা হন। বঙ্গবন্ধুকে মস্কোতে নিয়ে যাওয়ার জন্য সোভিয়েত সরকার একটি বিশেষ বিমান ও দুজন শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ পাঠান।
১৭ মার্চ ১৯৭৫, সোমবার
কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা সবাই বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে নিয়ে যান ফুল। কেউ নিয়ে যান ফুলের মালা। কেউবা প্রস্ফুটিত গোলাপ। প্রাণের সব অর্ঘ্য ঢেলে গুঁজে দেন নেতার হাতে। মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু কখনো গলা বাড়িয়ে, কখনো হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেন সেই ফুল। সেই ফুল তিনি বেশিক্ষণ তার কাছে রাখেননি। পাঠিয়ে দিয়েছেন সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ভাষাশহীদদের সমাধিতে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কমপক্ষে ৫০ হাজার লোকের সমাগম হয়। বঙ্গবন্ধু সবার আগে তার অসুস্থ পিতার সঙ্গে মিলিত হন এবং জন্মদিনের মাহেন্দ্রক্ষণে জন্মদাতার আশীর্বাদ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি দোতলা থেকে নেমে এসে জনতার সঙ্গে মিলিত হন। সেদিন নেতা ও জনতার সম্মিলনে কোনো বাধা ছিল না। ছিল না কোনো রাষ্ট্রীয় প্রটোকল। সকাল ৭টা থেকে সোয়া ১১টা পর্যন্ত চার ঘণ্টার বেশি সময় তিনি শুভার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জনতার এই স্বতঃস্ফূর্ত অভিনন্দনে নিজেও মাঝে মাঝে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে কবিগুরুর ‘সোনার তরী’ থেকে কবিতা আবৃত্তি শুরু করেন। বেলা ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু সমবেত শুভার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার জন্মদিনে আমি ছুটি ঘোষণা করি নাই। তাই আজ আমি অফিসে যাব। অল্পক্ষণের জন্য হলেও অফিসের কাজ করব।’ বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে তিনি গণভবনের উদ্দেশে বাসভবন ত্যাগ করেন। গণভবনে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েরা বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে এলে তিনি খুদে অতিথিদের সঙ্গে নিয়ে গণভবনের পুকুরে মাছ দেখাতে যান।
বর্তমান সময়ে একটি খবর অনেক শেয়ার হতে দেখেছি ফেসবুকে। সেট হলো বিয়ে বিচ্ছেদের খবর। আধুনিক তরুণ-তরুণীরা একসঙ্গে বেশি দিন থাকতে চান না। এ মানসিকতা কেন গড়ে উঠল? এমনকি প্রেমের বিয়েও টিকছে না। এই জটিল পরিস্থিতি নিয়ে কিছু কথা মনে পড়ল। যেমন-
‘আমাদের সোসাইটির সমস্যাটাই এখানে। আমরা সব সময় সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে চিন্তা করি। আরে বাবা প্রেমটা তো প্রেমই। প্রেমের আবার পরিণতি থাকতে হবে কেন? সম্পর্কের আগে অবশ্যই মানুষ চিন্তা ভাবনা করে সম্পর্কে জড়াবে না। কারণ এটা মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে হয়ে যায়। কারো সাথে জোর করে তো সম্পর্ক হয় না।’
কথাগুলো বলেছে কুঞ্জ। সুশ্রী, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার কুঞ্জ অবশ্য বাস্তব কোনো চরিত্র নয়। একটি উপন্যাসের চরিত্র। উপন্যাসটির নাম ‘প্রেম যমুনার মাতাল হাওয়া’। এর লেখক মাহবুব নাহিদ।
কুঞ্জ বাস্তবে বিচরণ না করলেও আধুনিক সময়ের নাগরিকদের মনের এক জটিল জিজ্ঞাসাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এই যে ‘প্রেমের আবার পরিণতি থাকতে হবে কেন?’ কিংবা বিয়ের পরও প্রেম থাকে কি না-এ সংকট অনেকের বেঁচে থাকাকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
উপন্যাসেও কুঞ্জকে আমরা পাই বিপন্ন অবস্থায়। সৌহার্দ্যের সঙ্গে তার প্রেমের পর বিয়ে হলেও ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
আমাদের সমাজে বিয়ের পর সেপারেশনে থাকা একজন নারীকে কী যন্ত্রণা পোহাতে হয় তার উদাহরণ এই কুঞ্জ। ঘরের মা থেকে শুরু করে সমাজের নানা অংশের মানুষ তাদের জীবন বিষিয়ে তোলে।
‘বিষ’ দিয়ে শুরু হয় মাহবুব নাহিদের উপন্যাস ‘প্রেম যমুনার মাতাল হাওয়া’। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের হাসি, কষ্ট, রাগ, অভিমান নিয়ে শুরু হওয়া উপন্যাসটি এগিয়ে যেতে থাকে কুঞ্জকে কেন্দ্র করে। ইন্টেরিয়র ডিজাইনার কুঞ্জ সৌহার্দ্যের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর এক বান্ধবীর বাবার রিসোর্টে কাজের অফার পায়। তবে পরিবারের নির্দেশে একা শ্রীমঙ্গলে যাওয়া হয় না তার। বোন বৃন্তকে সঙ্গে নিতে হয়। এই বৃন্ত খুব মজার এক চরিত্র উপন্যাসে। নিজের দুষ্টু বুদ্ধি দিয়ে পরিবারের সব মুশকিল আসান করে সে।
শ্রীমঙ্গলে কুঞ্জর সঙ্গে দেখা হয় দিহানের। দিহানও মজার একটি চরিত্র। ক্ষণে ক্ষণে পাঠককে হাসাতে পারার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। দিহানের আচরণে কুঞ্জ মাঝে মাঝে রেগে যায় আবার হেসেও দেয়।
তাদের দুজনের সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হওয়ার সময়ে রিসোর্টে এসে হাজির সৌহার্দ্য। উপন্যাসের শুরু থেকে যে কষ্ট কুঞ্জর মনকে আবদ্ধ করে রাখছিল, পাঠকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় এখানে এসে।
এরপর এক বৃষ্টির দিনে কুঞ্জ আর সৌহার্দ্য দেখা থেকে শুরু করে প্রেমের ঘটনা জানা যায়। আধুনিক মনস্ক দুটি ব্যক্তি কত যে টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যায়! তারপর তাদের যখন সংসার হয়, যতই প্রেম থাকুক, দুজন মানুষ যখন সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকতে শুরু করে-তখন তাদের একে অপরের অন্য রূপ দেখতে পায়। যেমন সৌহার্দ্য বলে, ‘আমরা পুরুষ মানুষ ভারী অদ্ভুত এ বুঝলে। তুমি হয়তো জান না। প্রায় প্রত্যেক পুরুষের মাঝেই এক ধরনের অচেনা সত্তা বাস করে। ভয়ংকর সত্তা। অবচেতন মনে এরা ভয়ংকর কল্পনায় মেতে ওঠে। অথচ নিজেও সেটা কোনো দিন টের পায় না। তুমি সেই রূপ দেখেছ তাই তোমার কাছে আমার অপ্রকাশ্য আর কিছুই নেই। তুমি যদি শাস্তিস্বরূপ আমাকে আজীবন দূরে সরিয়ে রাখতে চাও, রাখতে পারো। কিন্তু বিশ্বাস করো কুঞ্জ, আমরা দুজন দুজনকে অসম্ভব ভালোবাসি। আমরা একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারব না। অযথা এই শাস্তি নিজেকে দিও না।’
কুঞ্জও যেমন ভাবে, ‘প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে গেলো কুঞ্জ। পুরুষ মানুষ এমনও হয়! এ আবেগের নাম কি দেবে সে? তার নিজের একজন ইস্পাতের মতো কঠিন পুরুষ মানুষ আছে। সেই মানুষের সম্পূর্ণ বিপরীত এই পুরুষ মানুষটি। তার মানুষটা উদাসীন, প্রিয়তমা ও সংসারের বাইরে ভিন্ন একজন মানুষ। আর দিহান, প্রচণ্ড সংসারীমনা, প্রিয়তমাকে ভালোবেসে সর্বক্ষণ নিজের উজাড় করে দিতে প্রস্তুত ধরনের একজন। জগতে কত অদ্ভুত প্রজাতির মানুষ বাস করে তা বোঝা মুশকিল।’
শেষ পর্যন্ত কুঞ্জ ভাবে, ‘ভালোবাসা এমন একটা অসহ্য বিষয়, না একেবারে ছেড়ে থাকা যায়, না পুরোপুরি নিয়ে থাকা যায়!’
একটি সরল উপন্যাসে জীবনের জটিল দিকটি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন মাহবুব নাহিদ। তার উপন্যাসে এমন একটি মেসেজ আছে যা বিয়ে বিচ্ছেদ, সম্পর্কের টানাপোড়েনের জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। কী সেই মেসেজ তা অবশ্য পাঠককে পড়েই জানতে হবে।
বইটি প্রকাশ করেছে দাঁড়িকমা, প্রচ্ছদ করেছেন সাদিতউজ্জামান। ৮০ পৃষ্ঠার বইটির দাম ২৫০ টাকা।
রাজধানীর বনানীর একটি ক্লাবে গোপন বৈঠক চলাকাল বিএনপির ৫৪ নেতাকর্মীকে আটক করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
রোববার (১৯ মার্চ) রাতে তাদের আটক করা হয়। সোমবার (২০ মার্চ) সকালে এই তথ্য জানিয়েছেন বনানী থানার ডিউটি অফিসার এসআই সিদ্দিক।
তিনি জানান, রোববার রাতে বনানী ক্লাবে গোপন বৈঠকে রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনা করছিলেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। খবর পেয়ে রাত একটার দিকে সেখানে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। পরে ৫৪ জনকে আটক করা হয়।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা বলেন, রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনার জন্য দেশের বিভিন্ন জেলার বিএনপির নেতৃবৃন্দ বনানী ক্লাবে গোপন বৈঠক করছে বলে খবর আসে পুলিশের কাছে। পরে ক্লাবটিতে অভিযান চালানো হয়।
আটকদের বিরুদ্ধে বনানী থানায় রাষ্ট্রবিরোধী পরিকল্পনার মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকার বেসরকারি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে উল্লেখ্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাই প্রতিটি সেক্টরকে উদ্যোক্তাদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। কারণ সরকারের একার পক্ষে দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়।
সোমবার (২০ মার্চ) সরকারি বাসভবন গণভবনে রপ্তানি সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির ১১তম সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
২০২৬ সালের পর স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার কথা বিবেচনা করে নতুন দীর্ঘমেয়াদি রপ্তানি নীতি প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ২০২৬ সালের পর যখন আমরা এলডিসি থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হব, আমরা কিছু সুযোগ পাব... আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এবং দেশের আরও উন্নয়ন করতে আমাদের সেই সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।
তিনি উল্লেখ করেন যে একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর লক্ষ্য হবে উন্নত দেশে পরিণত হওয়া।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য বাড়ানোর সুযোগ কাজে লাগাতেও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে থাকায় বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে।তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে খাদ্য সামগ্রী আমদানিতে আগ্রহ দেখিয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে আমরা খাদ্য সামগ্রী রপ্তানি করতে পারতাম। আমরা এর জন্য উদ্যোগ নিতে পারি।তিনি বলেন, দেশে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প স্থাপন এবং সেসব পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার রপ্তানি খাতকে গুরুত্ব দিয়েছে। তিনি বলেন, ভারত গ্রহণের পর, আমরা এক বছরের ভিত্তিতে নীতির পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি রপ্তানি নীতি প্রণয়নের পদক্ষেপ নিয়েছি। অর্জনগুলো ধরে রাখতে হলে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, সরকার ২০২৪ (২০২১-২০০৪) পর্যন্ত রপ্তানি নীতি প্রণয়ন করেছে।...কিন্তু এর পর আমরা কী করব? এরই মধ্যে, আমরা একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হচ্ছি। আমি মনে করি আগামী দিনে আমরা কী করব বা আমরা কীভাবে এগিয়ে যাব তা বিবেচনা করার এটাই সঠিক সময়।
তিনি বিশ্বব্যাপী বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিরতার কথা মাথায় রেখে অর্থনীতির জন্য পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নির্ধারণের ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, আমাদের সারা বিশ্বে নতুন বাজার খুঁজতে হবে। আমাদের পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে, আমাদের রপ্তানি ঝুড়িতে নতুন আইটেম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, রপ্তানি খাতের উন্নয়নের জন্য একটি কৌশল গ্রহণ করতে হবে এবং পণ্য চিহ্নিত করতে হবে। এজন্য আমরা একটি সম্ভাব্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি-২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে একটি উন্নত দেশে পরিণত করতে।
প্রধানমন্ত্রী আইসিটি এবং ডিজিটাল ডিভাইস, আরএমজি, ফার্মাসিউটিক্যালস, হালকা ও মাঝারি ওজনের শিল্প, মোটরযান এবং ইলেকট্রনিক মোটর গাড়ির কথা উল্লেখ করে পণ্য বৈচিত্র্যের কথা বলেন।
তিনি বলেন, সরকার দেশ-বিদেশের বিনিয়োগ নিয়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছে। বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে বলেও জানান তিনি।
দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টির (জাপা) ভেতর বিভক্তি আবারও প্রকট হয়ে উঠছে। আজ সোমবার পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্মদিন পালনের মধ্য দিয়ে সেই বিভাজন ও দ্বন্দ্ব দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এরশাদের স্ত্রী, পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং এরশাদের ভাই ও পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের আলাদা কর্মসূচি নিয়েছেন। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে জন্মদিন পালন করছেন দুপক্ষের নেতাকর্মীরা। কেউ কাউকে আমন্ত্রণ জানাননি। এমনকি যৌথভাবে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের জন্মদিন পালনে কোনো উদ্যোগও নেয়নি কোনোপক্ষ।
জাপায় অভ্যন্তরীণ বিভাজন এতটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, দুপক্ষের শীর্ষনেতারা পরস্পরকে দলের ‘কেউ না’ বলেও মন্তব্য করেছেন। জিএম কাদেরপন্থিরা বলছেন, তাদের অংশই পার্টির মূল। রওশন এরশাদের সঙ্গে যারা আছেন, তারা পার্টির কেউ না। আবার রওশনপন্থিদের অভিমত, পার্টির মূলধারার নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গে আছেন। সুতরাং তারাই জাপার মূল অংশ। এই পক্ষ জিএম কাদেরপন্থিদের ‘প্রতারক’ বলেও মন্তব্য করেছেন ও কাদেরপন্থিরা তাদের ‘কেউ না’ বলে জানিয়েছেন।
৯৪তম জন্মদিন আজ : আজ পালিত হচ্ছে এরশাদের ৯৪তম জন্মদিন। ১৯৩০ সালের ২০ মার্চ কুড়িগ্রাম শহরের ‘লাল দালান’ বাড়িখ্যাত নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সাবেক এ রাষ্ট্রপতি ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান ১৯৫২ সালে। ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ করেন এরশাদ। ১৯৮৬ সালে তার প্রতিষ্ঠিত দল জাপার প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি দেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু করেন। বিরোধী দলের লাগাতার আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন। এরপর গ্রেপ্তার হয়ে ছয় বছর কারারুদ্ধ ছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক কীর্তি গড়েছেন এরশাদ। ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান। কারাগারে থাকাকালীন ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের নির্বাচনে পাঁচটি করে আসনে জয়ী হন। এরশাদের হাতে গড়া জাপা এখন সংসদে প্রধান বিরোধী দল। দশম জাতীয় সংসদেও প্রধান বিরোধী দল ছিল জাপা। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এরশাদ।
পরস্পরকে অস্বীকার দুপক্ষের : পৃথকভাবে জন্মদিন পালনের ব্যাপারে জিএম কাদেরপন্থি জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গতকাল রবিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পার্টির পক্ষ থেকে আমরা জন্মদিন পালন করছি। এর অংশ হিসেবে আগামীকাল (আজ সোমবার) জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্যারের (এরশাদ) প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও বিকেল ৩টায় বনানী কার্যালয়ে কেক কাটব। আর স্যারের জন্মদিন উপলক্ষে ২২ মার্চ আলোচনা সভা হবে। সেখানে কাদের সিদ্দিকীসহ আরও কয়েকজন অতিথি অংশ নেবেন।’
এরশাদের জন্মদিন উপলক্ষে রওশনপন্থিদের কর্মসূচির ব্যাপারে জাপা মহাসচিব বলেন, ‘ম্যাডামের পক্ষ থেকে তার বাসভবনে পারিবারিকভাবে মিলাদের আয়োজন করেছে। তারা একসঙ্গে জন্মদিন পালনের কোনো আলাপ-আলোচনা জাপার কারও সঙ্গে, বিশেষ করে আমার সঙ্গে করেনি।’
পৃথক এ জন্মদিন পালনের মধ্য দিয়ে দলের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ব্যাপারে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘পার্টির বাইরে কেউ কিছু বললে আমাদের বলার কিছু নেই। তারা পার্টির কেউ কিছু না।’
কিন্তু রওশনপন্থি জাপার নেতা ও এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশীদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেহেতু স্যার জীবিত নেই, ম্যাডাম জীবিত আছেন, তাই তার বাসায় একটা কোরআন তেলাওয়াত দোয়ার আয়োজন করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আছি। জিএম কাদের আমাদের কোনোদিন ডাকেন না। সুতরাং আমরা তো স্বাভাবিকভাবে আমাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের জন্মদিন পালন করব।’
কাদেরপন্থি জাপার ব্যাপারে এ নেতা বলেন, ‘পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান হয়েছিল জানুয়ারিতে। ওই অনুষ্ঠানটা একসঙ্গে করার কথা ছিল। এর জন্য একটা যৌথ বিবৃতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনুষ্ঠানে দেখা গেল, একটা প্রতারণা করে জিএম কাদেররা শুধু ম্যাডামকে নিয়ে গেছেন। আমাদের মঞ্চে আনুপাতিক হারে আসন দেবে বা কোথায় বসবে, সেটা আয়োজন করার কথা ছিল। কিন্তু সেগুলোর কিছুই করা হয়নি। তাদের এখন আমরা প্রতারক হিসেবে জানি। ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য হবে কি না, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।’
দুপক্ষের পৃথক কর্মসূচি : জন্মদিন উপলক্ষে জিএম কাদেরপন্থি জাপা সকাল ১০টায় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় কাকরাইল চত্বরে এরশাদের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে। এ ছাড়া আগামীকাল বুধবার বিকেল ৩টায় কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের মাল্টিপারপাস হলে আলোচনা সভা রয়েছে। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন জিএম কাদের। জাপা চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি-০২ খন্দকার দেলোয়ার জালালী এক বিজ্ঞপ্তিতে এ কর্মসূচির তথ্য জানান।
অন্যদিকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, আজ বেলা ১১টায় গুলশানের ৬৭ নম্বর সড়কের ৪/১-এ বিরোধীদলীয় নেতার বাসভবনে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বিশেষ দোয়া ও কেক কাটার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে রওশন এরশাদ প্রধান অতিথি হিসেবে এবং এরশাদপুত্র রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ এমপিসহ পার্টির শীর্ষ নেতারা উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া স্বাধানীতা দিবস উপলক্ষে ২৭ মার্চ আলোচনা সভা, দোয়া ও ইফতার আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়েছে : গত বছর নভেম্বরে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী, দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ দলের ভেতর ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। সে ডাকে সাড়া দিয়ে বেশ কিছু উদ্যোগও নিতে দেখা গেছে এরশাদের ছোটভাই ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে। এরই অংশ হিসেবে জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাপার নেতারা রওশন এরশাদের সঙ্গে কয়েক দফা দেখা করেন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দল পরিচালনায় বেশ কিছু অঙ্গীকারও করেন।
ঐক্যের অংশ হিসেবে ঐক্যবদ্ধভাবে ১ জানুয়ারি জাপার ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন করা হয়। প্রায় চার বছর পর ওই অনুষ্ঠানে একমঞ্চে পাশাপাশি বসেন দেবর-ভাবি কাদের-রওশন। এমনকি টানা ১১ মাস পর সেদিন পার্টির কোনো অনুষ্ঠানে সশরীরেও যোগ দেন রওশন এরশাদ। সর্বশেষ ২০১৮ সালে দলের এক অনুষ্ঠানে একসঙ্গে মঞ্চে ছিলেন এ দুই নেতা।
জাপা নেতরা জানান, জানুয়ারির পর দুপক্ষের মধ্যে আর কোনো ধরনের সমঝোতা বা ঐক্যের আভাস পাওয়া যায়নি। বরং জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে রওশনপন্থি দুই নেতার মামলার কারণে দেবর-ভাবির সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটে। সেই অবনতির সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে দেখা দেয় এরশাদের জন্মদিন।
এ ব্যাপারে রওশনপন্থি নেতারা দেশ রূপান্তরকে জানান, জিএম কাদের গত ৬ মার্চ এরশাদের জন্মদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। সেই কর্মসূচির ব্যাপারে রওশন এরশাদকে কিছুই বলেননি। জিএম কাদের ঐক্যবদ্ধভাবে পালন করতে রাজি না। উনি বিভাজন রেখেই যাচ্ছেন।
দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হচ্ছে জানিয়ে রওশনপন্থি শীর্ষ নেতারা জানান, রওশনপন্থি জাপা ইতিমধ্যেই দেশের ৫২ জেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেছে। এসব জেলায় যারা পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন ও এরশাদের সময় থেকে পার্টির সঙ্গে আছেন, জিএম কাদের তাদের বাদ দিয়ে নিজের লোকজনদের নিয়ে কমিটি করেছেন। মূলধারার লোকজনদের বাদ দিয়ে রাজনীতি করছেন। এরই অংশ হিসেবে সর্বশেষ ১৫ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আহ্বায়ক কমিটির তথ্য জানানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রওশনপন্থি এক নেতা বলেন, রওশন এরশাদ আবারও জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রোজার পর থেকে সম্মেলনের কাজ পুরোদমে শুরু হবে। ২৭ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি সম্মেলন স্থগিত প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে পারেন। সম্মেলন হবে।
জিএম কাদেরের মামলার ব্যাপারে রওশনপন্থি নেতারা বলেন, আমরাও চাই মামলা থেকে জিএম কাদের অব্যাহতি পাক। সে জন্য আমরা নতুন করে আপিল করিনি। আপিল করেও ঝুলিয়ে রেখেছি। উনি যদি সোজা পথে আসেন তাহলে মামলাটা শেষ করব। কিন্তু উনি সেটা চাইছেন না বলে আমরাও সময়ক্ষেপণ করছি। আমরা ওনাকে সুযোগ দিচ্ছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) হল দখল, উন্নয়নকাজের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছাত্রী ও সাংবাদিক হেনস্তাসহ নানা বিশৃঙ্খলায় অছাত্র ও বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের নাম আসছে বারবার। সেই সব অছাত্র, বহিষ্কৃত ও বহিরাগতদের ক্যাস্পাস ত্যাগের নির্দেশ দিলেও তারা এখনো বহাল।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বোর্ড অব রেসিডেন্স, হেলথ অ্যান্ড ডিসিপ্লিনের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ১৫ মার্চের মধ্যে ছাত্রত্বহীন ও বহিরাগতদের আবাসিক হল ও ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু নির্দিষ্ট সময়সীমার তিন দিন পেরিয়ে গেলেও প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয়নি; বরং প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনো সদুত্তরও পাওয়া যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসনের সদিচ্ছা এবং নির্দেশনা বাস্তবায়নে উদাসীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে ক্যাম্পাসের পরিবেশ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ রাখতে রাতে অভিযান চলমান আছে বলে জানিয়েছেন সহকারী প্রক্টর মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নিয়মিত রাতে অভিযান চালানো শুরু করেছি। ক্যাম্পাসে বহিরাগত লোকজনকে আমরা সতর্ক করে দিচ্ছি। বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাতে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতে দেখলেই আমরা তাদের সতর্ক করে দিই, যেন তারা অকারণে ঘোরাঘুরি না করে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরও যারা হলে আছেন ও যারা বহিষ্কৃত, তাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাই প্রশাসন তাদের ক্যাম্পাস ত্যাগের নির্দেশনা দিলেও সেটা বাস্তবায়নে উদাসীনতা দেখাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষার্থী বলেন, ক্যাম্পাসে যারা অছাত্র আছে, তাদের হাত ধরেই অধিকাংশ অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের কাছে অনিরাপদ। আবার যেসব জুনিয়র শিক্ষার্থী বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত, তাদেরও এই অছাত্ররাই নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। এতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপ, উপগ্রুপের দফায় দফায় সংঘর্ষ, উপাচার্যের কক্ষ ভাঙচুর, শিক্ষক প্রার্থীকে মারধর, হল দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছাত্রী হেনস্তা, সাংবাদিক হেনস্তাসহ ইত্যাদি ঘটনায় সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। অধিকাংশ ঘটনায় জড়িত বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে বেশির ভাগ ছাত্রলীগ নেতার ছাত্রত্ব নেই। এতে ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই সংকট কাটাতে অছাত্র ও বহিরাগতদের ক্যাম্পাস ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও আবাসিক হলগুলো ছাড়েনি তারা। অংশ নিচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। এমনকি বোর্ড অব রেসিডেন্স, হেলথ অ্যান্ড ডিসিপ্লিনের সদস্য সচিব ও প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদার তার দায়িত্ব গ্রহণের সময় ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে অনেক অছাত্র ও বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী।
এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ বলেন, ‘সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে না পেরে প্রশাসনিক দেউলিয়াত্বের পরিচয় দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করা তাদের ব্যর্থতা।’
প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে লোক দেখানো বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী।
তবে সমন্বিত উদ্যোগের কথা বলেছেন আরেক সহকারী প্রক্টর সৌরভ সাহা জয়। তিনি বলেন, ‘আমরা পুরো প্রক্টরিয়াল বডি নতুন নিয়োগ পেয়েছি। আমরা এ বিষয়ে অবগত আছি। তবে আমরা কিছুটা সময় নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগে এ বিষয়টির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব। কারণ, এতে অনেকগুলো বিষয়ের সমন্বয় প্রয়োজন।’
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক