
ক্রেডিট কার্ড একটি লাইফস্টাইল পণ্য। বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যাংক এখন ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করছে। বাংলাদেশে ইস্যুকৃত মোট ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ২২ লাখ কিন্তু একক (ইউনিক) গ্রাহক সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। ক্রেডিট কার্ড পুরোপুরি জামানতবিহীন পার্সোনাল ঋণ হলেও ঋণ পরিশোধের হার খুব সন্তোষজনক। গ্রাহক পর্যায়ে একটি ক্রেডিট কার্ড দিতে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বেশ কিছু অত্যাবশ্যক কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়। এটিকে ঋণ হিসেবে না দেখে লাইফস্টাইল পণ্য হিসেবে দেখে এর আবশ্যকীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা কিছুটা শিথিল করা হলে ক্রেডিট কার্ড ব্যাপ্তি অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। তখন নিম্ন আয়ের মানুষরাও ক্রেডিট কার্ড নিতে পারবেন, যা ক্যাশলেস সোসাইটি গঠনের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করবে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা দ্রুতগতিতে ডিজিটাল আর্থিক লেনদেনে রূপান্তরিত হচ্ছে। ক্যাশলেস বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ডিজিটাল লেনদেনে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে যেমন পিওএস, এটিএম, সিআরএম, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, কিউআর কোড ইত্যাদি। বিগত বছরগুলোতে ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মার্চ মাসে ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং ই-কমার্সের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার কোটি টাকা, ২০২২ সালে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালের মার্চ মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। তাই বলা যায়, প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুতগতিতে অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে প্রথাগত আর্থিক লেনদেনের পাশাপাশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা।
তুলনামূলক কম ব্যবহারকারী
আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক কম। দেশে ইস্যুকৃত ডেবিট কার্ডের সংখ্যা ৩ কোটি ১০ লাখ যেখানে ইস্যুকৃত ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যার মধ্যে যে বড় ব্যবধান, এর প্রধান এবং অন্যতম কারণ হলো ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে কাগজপত্র জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা। এছাড়া রয়েছে ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কে গ্রাহকদের প্রচলিত বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা।
ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়াতে হলে আগে কার্ড ব্যবহারের ইকোসিস্টেম প্রসারিত করতে হবে। কিউ-আরকোড এবং অ্যাপসভিত্তিক লেনদেন বৃদ্ধি পেলে পুরো দেশে ক্রেডিট কার্ড তথা সামগ্রিকভাবে কার্ডের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়বে।
ব্যবহারকারী কারা
ব্যাংকগুলো চাকরিজীবী এবং ব্যবসায়ী উভয় শ্রেণির গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করছে, তবে এক্ষেত্রে চাকরিজীবীদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ক্রেডিট কার্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ঋণের সহজলভ্যতা এবং সুবিধাজনক পরিশোধ ব্যবস্থা। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের প্রমোশনাল অফার যেমন ইএমআই, ক্যাশব্যাক ডিসকাউন্টসহ বাই ওয়ান গেট ওয়ান, ইন্স্যুরেন্স, রিওয়ার্ড পয়েন্ট, মিট অ্যান্ড গ্রিট, লাউঞ্জ সুবিধা ইত্যাদি।
ঋণ শোধের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়
ক্রেডিট কার্ড আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য পণ্য হয়ে উঠেছে। এটি নিতে হলে ঋণ পরিশোধের যোগ্যতার প্রমাণের সঙ্গে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রমাণও দাখিল করতে হয়। দেশে এখন রিটার্ন জমা দেওয়ার হার বেড়েছে। সবাই প্রতি বছর তার আয়কর রিটার্ন জমা দেয়। কিন্তু অনেকে অসাবধানতাবশত আয়কর রিটার্ন জমা দেয় না। তাছাড়া অনেকের করযোগ্য আয় না থাকায় তারাও রিটার্ন জমা দেয় না। যা ক্রেডিট ইস্যু করার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও প্রভাব বিস্তার করছে বলে মনে করি।
জীবন সহজ করছে ক্রেডিট কার্ড
ক্রেডিট কার্ড আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। এটির ব্যবহারও অত্যন্ত সহজ। ক্রেডিট কার্ড বিলম্বিত বিল পরিশোধের ভিত্তিতে কাজ করে, যার অর্থ আপনি এখন আপনার প্রয়োজনে কার্ড ব্যবহার করে অর্থ ব্যয় করতে পারেন এবং পরে তা সুবিধামতো সময়ে পরিশোধ করতে পারেন। ব্যবহৃত অর্থ গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ডেবিট হয় না। এভাবে গ্রাহক প্রতিবার তার প্রয়োজনে কার্ড ব্যবহার করতে পারেন, যা আমাদের জীবনযাত্রাকে অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল করে তুলেছে। একজন গ্রাহক যদি নিয়মিত সঠিক সময়ে তার ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করেন তাহলে কখনোই সেই গ্রাহক ঋণগ্রস্ত হবেন না। ব্যাংকগুলোর শক্তিশালী মনিটরিং ও রিকভারি ব্যবস্থা থাকার কারণে এই সেক্টরের খেলাপি ঋণের হার তুলনামূলক অনেক কম।
নিরাপত্তায় প্রয়োজন সচেতনতা
ডিজিটাল পেমেন্টগুলো সাধারণত বিভিন্ন ব্যবহারিক কারণে অফলাইন পেমেন্টের চেয়ে বেশি নিরাপদ। যেমন নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি না থাকা, চুরি, জালিয়াতির আশঙ্কা কম থাকা। ডিজিটাল লেনদেনে গ্রাহকের যে ধরনের সচেতনতা প্রয়োজন
কার্ড নম্বর, কার্ডের পেছনের ৩ সংখ্যার কার্ড ভেরিফিকেশন ভ্যালু (CVV2), ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (OTP), মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং নিরাপত্তা পিন কারও সঙ্গে বিনিময় না করা।
সন্দেহজনক কোনো ওয়েবসাইটে ই-কমার্স লেনদেন থেকে বিরত থাকা ও কার্ডের তথ্য সংরক্ষণ থেকে বিরত থাকা।
সন্দেহজনক কোনো ই-মেইল অথবা এসএমএসে থাকা লিঙ্কে প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকা।
সাইবার সংক্রান্ত ঝুঁকি বিবেচনায় ডিজিটাল ডিভাইসের সব সফটওয়্যার হালনাগাদ রাখা এবং নিরাপত্তা সফটওয়্যার ব্যবহার করা।
যেকোনো সন্দেহজনক লেনদেন অতিসত্বর ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ব্রাঞ্চ অথবা ব্যাংকের কল সেন্টারে অবহিত করা।
কার্ড হারানোর পরপরই ব্যাংকের কল সেন্টারে অবহিত করা।
সাধারণত, অধিকাংশ ব্যাংকই নির্দিষ্ট লেনদেনের পরিমাণের ভিত্তিতে ক্রেডিট কার্ডের বার্ষিক ফি সম্পূর্ণ বা আংশিক মওকুফ করে দিয়ে থাকে, যার ফলে এটি গ্রাহকের ওপর বাড়তি কোনো চাপ সৃষ্টি করে না। ক্রেডিট কার্ড একটি লাইফস্টাইল পণ্য, বিশ্বের অন্যান্য দেশের ক্রেডিট কার্ডের সুদের হারের তুলনায় বাংলাদেশে তা অপেক্ষাকৃত অনেক কম। তবে ব্যাংকগুলো সেটেলমেন্টের দিন থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ দিন পর্যন্ত বিনাসুদে বিল পরিশোধের সুযোগ দিয়ে থাকে। তাই যদি কোনো গ্রাহক বুঝে সচেতনভাবে নিয়মিত বিল পরিশোধ করে তবে এটা কিন্তু গ্রাহকদের জন্য একটি চমৎকার সুযোগ।
গ্রাহকদের বিভিন্ন চাহিদার কথা মাথায় রেখে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন উৎসবে নানা ধরনের অফার দিয়ে থাকে যার ফলে গ্রাহক বেশি বেশি লেনদেন করতে উদ্বুদ্ধ হয় যা ব্যবসায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন সুলতান মাহমুদ। ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে ধানমন্ডি এলাকায় ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন এ শিক্ষক। এখনো সেই ফ্ল্যাটের ঋণ পুরোপুরি পরিশোধ হয়নি। সুলতানের ব্যবহৃত ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা দুটি। একটি বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংক আর অন্যটি প্রাইম ব্যাংকের।
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধা জানতে চাইলেন তিনি জানান, ফ্ল্যাটের কিস্তি পরিশোধ, সন্তানদের বেতন আর ফ্যামিলি খরচ পরিশোধ সব মিলিয়ে প্রায় প্রতি মাসের শেষেই আর্থিক সংকট তৈরি হয়। এ সংকট থেকে বাঁচতেই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। তবে মাসের শুরুতে বেতন পেয়েই পরিশোধ করে দিচ্ছেন ক্রেডিট কার্ডের বিল। এতে অতিরিক্ত সুদও গুনতে হচ্ছে না তাকে।
সুলতান মাহমুদ বলেন, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার না করলে হয়তো প্রতি মাসেই আমার বিভিন্নজনের কাছ থেকে ধার করে চলতে হতো। এতে সম্মানহানিরও ঝুঁকি থাকে। কিন্তু এখন ব্যাংক থেকে স্বল্প সময়ের জন্য ধার নিয়ে তা আবার ফেরত দিচ্ছি। এতে কারও কাছে হাত পাততে হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, একসময় মানুষ ক্রেডিট কার্ডের প্রতি কম আগ্রহী হলেও বর্তমানে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে দেশের ৩৯টি ব্যাংক কার্ড সেবা দিচ্ছে। গত মার্চ শেষে এসব ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ লাখ ৭৮ হাজারটি। ঠিক চার বছর আগে ২০১৯ সালে মার্চ শেষে এ কার্ডের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৪৯ হাজারটি। অর্থাৎ মাত্র চার বছরের ক্রেডিট কার্ড বেড়েছে ৮ লাখ ২৮ হাজার বা ৬১ দশমিক ৪২ শতাংশ। এই একই সময়ে লেনদেনের পরিমাণও বেড়েছে। গত মার্চে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের মার্চে এ লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ চার বছরের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে ১৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
শুধু সুলতানই নন, ব্যবসায়ী আমিরুল, সাংবাদিক আক্তার আর চাকরিজীবী তারিকুলও একই কারণে ব্যবহার করছেন দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ক্রেডিট কার্ড। তাদের মতে, ক্রেডিট কার্ডের কারণে সহজ হয়েছে তাদের জীবনযাত্রা। তবে উল্টো চিত্রও আছে। করোনা মহামারীর সময় চাকরি হারানো আজাদুল ইসলাম ক্রেডিট কার্ডে ধার নিয়ে এখন বিপাকে রয়েছেন। তিনি বলেন, করোনার সময় প্রথম দিকে আমাদের বেতন কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়। সে সময় সংসারের খরচ বহন করতে ক্রেডিট কার্ডের সহায়তা নিয়েছেন। যে ঋণ এখন পর্যন্ত টানতে হচ্ছে তাকে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ হবে বলে আশাবাদী এ গ্রাহক।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক্রেডিট কার্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে এর ‘ধার’ নেওয়ার পদ্ধতির জন্য। পাশাপাশি পণ্যের দামে ডিসকাউন্টের পাশাপাশি কিস্তিতে পরিশোধের পদ্ধতিও এ ব্যাপ্তি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। যেটি গ্রাহককে এককালীন বেশি দামের পণ্য কিনতে সহায়তা করে। এবার জেনে নেওয়া যাক ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা-অসুবিধাগুলো।
পণ্য কিনতে কিস্তি সুবিধা : ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কিস্তিতে পণ্য কিনতে একসঙ্গে সব টাকা পরিশোধ করতে হবে না। বিনা সুদে বা নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদে গ্রাহক কয়েক মাসের সমান কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করতে পারবেন। যদিও গ্রাহক তার ক্রেডিট লিমিটের চেয়ে বেশি দামি পণ্য কিনতে পারবেন না। আর কিস্তির টাকাও পরিশোধ করতে হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। এতে কারও কাছে টাকা ধার করার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তবে পরিশোধের ক্ষেত্রে সময়সীমা পার হয়ে গেলে জরিমানা গুনতে হতে পারে।
ঋণের সুবিধা : কিছু ক্রেডিট কার্ড, বিশেষ করে বিদেশে শূন্য শতাংশ সুদে ঋণ দেয়। এসব ক্ষেত্রে মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য পরিশোধ করতে হয়, যা বেশ সুবিধাজনক। আবার কোনো কোনো কার্ডে ঋণে সুদের হার অনেক থাকে। এ ক্ষেত্রেও একটা সুবিধা আছে। বোঝা এড়াতে দ্রুত ঋণ পরিশোধ করা হয়। নিজস্ব ঋণ থাকে না।
পরিবর্তনযোগ্য : এসব ক্ষেত্রে সঠিক কার্ডটি বেছে নিতে পারা জরুরি। একটি ভুল কার্ড দিনের পর দিন ব্যবহার করলে ঋণের বোঝা শুধু বাড়তেই থাকবে। তবে এটা বুঝতে ব্যাংকের পুরো শর্তাবলি মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। যদিও কার্ডের ধরন পরিবর্তন করা যায় খুব সহজে। কারণ প্রতিটি ব্যাংকে বিভিন্ন প্রকারের ক্রেডিট থাকে। আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী কার্ড যেমন নিতে পারবেন তেমনি পরবর্তী সময়ে সেটির ধরন পরিবর্তনও করতে পারবেন। আবার নির্দিষ্ট পরিমাণ লেনদেন করলে বাৎসরিক ফি এড়ানো যায়। যেমন অনেক ব্যাংকের কার্ডে অন্তত ১৮ বার কেনাকাটা করলে বাৎসরিক ফি দিতে হয় না। ব্যাংকভেদে এ নিয়মের ভিন্নতা রয়েছে। দেশের বাইরেও ব্যবহার করা যায় : ক্রেডিট কার্ড ইন্টারন্যাশনাল হলে সেটি ব্যবহার করা যাবে বিশ্বের অনেক দেশেই। টাকার পাশাপাশি ডলারও ধার করে ব্যবহার করা যায়। হোটেল বুকিং, বিমানভাড়া, রেস্টুরেন্ট ও কেনাকাটায় মেলে নানা ছাড় ও পয়েন্ট জেতার সুযোগ। বিদেশে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে যা খরচ করবেন, মাস শেষে আপনার সেই পরিমাণ বিল হিসেবে ইস্যু করবে ব্যাংক। তারপর সুদ বা জরিমানা এড়াতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই বিল পরিশোধ করতে হবে।
অফারের ছড়াছড়ি
বিভিন্ন সময়ে ক্রেডিট কার্ডে বিভিন্ন অফার দেওয়া হয়। যেমন ‘ক্যাশ ব্যাক অফার’, ‘স্পেশাল ডিসকাউন্ট’। দেশের বাইরে বেড়াতে গেলে, হোটেলে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারে অনেক সময়ই মূল্যছাড় দেওয়া হয়। প্লেনের টিকিট কাটতেও অনেক সময় পাওয়া যায় বিশেষ মূল্যছাড়। আর অনলাইন কেনাকাটার জন্যও এখন ক্রেডিট কার্ড বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, নামিদামি হোটেল ও রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়ায় ছাড় এবং অফার দিয়ে থাকে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আবাসিক হোটেলগুলোও ক্রেডিট কার্ডে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে। একটি কিনলে একটি ফ্রি (বাই ওয়ান গেট ওয়ান) অফারও দেওয়া হয়। এ ছাড়া রয়েছে মূল্যছাড়সহ নানা অফার। অনেকেই পরিবার নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে ঘুরতে যান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও হোটেলের নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হোটেল বুক করা যায়। এ ক্ষেত্রেও আপনি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন। তবে বিদেশে হোটেল বুকিংয়ের টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রে ডুয়েল কারেন্সি ক্রেডিট কার্ড প্রয়োজন হবে।
অসুবিধা
ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি অসুবিধাও কম নয়। এজন্য বেশ সতর্ক হতে হবে গ্রাহককে। একটু বেখেয়ালি হলেই পড়তে পারেন ঋণের ফাঁদে।
ঋণের ফাঁদ
ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার সবসময়ই একটি ঋণ নেওয়ার মাধ্যম। মনে রাখতে হবে অর্থ খরচের ৪৫ দিনের মধ্যে সেটি পরিশোধ করতেই হবে। অন্যথায় ঋণের ওপর সুদ শুরু হবে। যা ঋণের পরিমাণ প্রতিদিন বাড়িয়ে দেবে। তাই কিছুটা ঝুঁকি থেকেই যায়।
লুক্কায়িত ব্যয়
সুদের হার পরিশোধই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের একমাত্র ব্যয় নয়। সময়মতো মাসিক বিল পরিশোধ না করলে গ্রাহককে জরিমানা গুনতে হতে পারে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে নগদ অর্থ তুলতে এর জন্য নির্দিষ্ট হারে ফি দিতে হতে পারে। সরাসরি বুথ থেকে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে নগদ অর্থ উত্তোলন করতে গেলে বাড়তি ফি এবং ওইদিন থেকেই (এ ক্ষেত্রে ৪৫ দিন সময় দেওয়া হয় না) সুদ গণনা শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে চেক দিয়ে টাকা সঞ্চয় হিসেবে স্থানান্তর করে তারপর সেটি নগদায়ন করলে ৪৫ দিন সময় পাওয়া যাবে।
বর্তমান সময়টা তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। দেশের আর্থিক লেনদেন বর্তমানে প্রযুক্তিকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন অ্যাপে ঘরে বসেই ব্যাংকিং লেনদেন সম্পন্ন করা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চালু করা এনপিএসবি বা আরটিজিএস গেটওয়ের কথাই ধরেন। কোটি কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ব্যাংকে চলে যাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে। ইসলামী ব্যাংকের কার্ড দিয়ে অন্য ব্যাংকের এটিএম থেকে টাকা তোলা যাচ্ছে মুহূর্তেই। সামনে ট্যাপ অ্যান্ড গো আসবে, হাতে পরার ঘড়ির মধ্যে ভার্চুয়াল কার্ড আসবে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রাহকরা অতি সহজেই ব্যাংকিং কার্যাবলি সম্পন্ন করতে পারছেন। ক্যাশলেস সোসাইটি বাস্তবায়নে আধুনিক ব্যাংকব্যবস্থার বিকল্প নেই। আগে ব্যাংকসেবা গ্রহণ করতে হলে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা নিত হতো। কিন্তু বর্তমানে ডিজিটাল ব্যাংকব্যবস্থা চালু হওয়ায় ঘরে বসেই ব্যাংকসেবা গ্রহণ করা যায়। ইসলামী ব্যাংক ২০১৪ সালে খিদমাহ নামে শরিয়াহভিত্তিক ক্রেডিট কার্ড চালু করে। বর্তমানে বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডসেবা অফার করছে। ক্রেডিট কার্ডে দেশে প্রতি মাসে ২৫-২৭ বিলিয়ন টাকা লেনদেন হচ্ছে। আমাদের দেশে টিআইএন রয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। অন্যদিকে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যার বিচারে কার্ড সংখ্যা ঠিকই আছে। ক্রেডিট কার্ড পুরোপুরি জামানতবিহীন ঋণ হলেও ঋণশোধের হার বেশ ভালো। তবে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারকারী বিভাগীয় শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে ক্রেডিট কার্ড জনপ্রিয় না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো পর্যাপ্ত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সেবা ও সুযোগের অনুপস্থিতি। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিসমৃদ্ধ টেকসই ব্যাংকব্যবস্থায় ক্রেডিট কার্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সেবার গ্রাহক দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাবে।
ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার যোগ্যতা সম্পর্কে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনিরুল মওলা বলেন, চাইলেই যে কেউ ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড নিতে পারবেন না। আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ার প্রমাণ দেখালে তবেই ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড দেবে। এ ক্ষেত্রেও আবার পেশাগত দিক বিবেচনায় নানা মানদণ্ড রয়েছে। যেমন ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বয়স হতে হবে অন্তত এক বছর, যাতে অন্তত ১০ লাখ টাকার লেনদেন হতে হবে। এর পাশাপাশি প্রয়োজন হবে টিআইএন সার্টিফিকেট, ক্ষেত্রবিশেষে ট্রেড লাইসেন্স ও রেফারেন্স এবং চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে ছয় মাসের ব্যাংক হিসাব দেখাতে হবে। মাসিক বেতন হতে হবে ২০ হাজার টাকার বেশি। চাকরির বয়সও ছয় মাসের কম হওয়া চলবে না। অন্য পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে যে পেশায় আছেন, সেখানকার আইডি কার্ড বা এমন কোনো প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। আপনি সব দিক থেকে যোগ্য হলে ব্যাংক উদ্যোগী হয়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
এখন ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড নিতে গেলে শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন সনদ দেখালে হয় না। টিআইএনের বিপরীতে আপনি নিয়মিত রিটার্ন জমা দিচ্ছেন কি না তারও প্রমাণপত্র দেখাতে হয়। নতুন এ বিধান চালুর ফলে ক্রেডিট কার্ড নেওয়া একটু কঠিন হয়েছে। তবে যারা ক্রেডিট কার্ড নিতে ইচ্ছুক তারা পরিপূর্ণ নিয়মাচার মেনে কার্ডের জন্য আবেদন করছে। আয়কর বিবরণী বাধ্যতামূলক করায় আগের তুলনায় ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকের সংখ্যা কিছু কমেছে।
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর নানান সুবিধা রয়েছে। যত খরচ করছেন তার ওপর পয়েন্ট বা ক্যাশব্যাক পাওয়া যায়। সর্বোচ্চ ৪৫ দিন পর্যন্ত দিন চার্জমুক্ত ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। সেবা বা পণ্য কেনার জন্য একসঙ্গে পুরোটা খরচ করতে হয় না। কয়েক মাস ধরে ধাপে ধাপে অর্থ পরিশোধ করা যায়। হোটেলের ভাড়া বা বিমানের টিকিট ক্রেডিট কার্ডে পরিশোধ করলে অনেক সময় ছাড় পাওয়া যায়। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি বা চুরি করে অর্থ তোলা বেশ কঠিন। ডেবিট কার্ডের চেয়ে এর নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো। নগদ টাকার সুবিধা গ্রহণ করলেও একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মুনাফা হার থাকে শূন্য শতাংশ। নির্ধারিত সময় পার হলে মুনাফা কেটে নেওয়া হয়। অবশ্য কোনো কোনো ব্যাংকের নিয়ম-কানুনের জটিলতা ও লুকায়িত চার্জের কারণে গ্রাহকদের মনে এক ধরনের ভীতিও কাজ করে। ফলে অনেকে ক্রেডিট কার্ড নিতে আগ্রহী হন না।
সারা দেশে ক্রেডিট কার্ড ছড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না কেন, এমন প্রশ্নে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংকের এই এমডি বলেন, বাংলাদেশের গ্রামীণ ও জেলা সদর এলাকাগুলোতে এখনো ক্যাশ লেনদেনের প্রাধান্য বেশি। ইসলামী ব্যাংকের দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা শাখাসমূহ থেকে গ্রাহকদের ক্যাশলেস লেনদেনের বিষয়ে আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে। নগদ লেনদেনের নেতিবাচক দিক ও ডিজিটাল লেনদেনের সুবিধার বিষয়ে গ্রাহকদের সচেতন করা হচ্ছে। সাধারণত শহরের জনগোষ্ঠী গ্রামের মানুষের তুলনায় প্রযুক্তি ও পরিষেবাবিষয়ক জ্ঞানে এগিয়ে থাকে। শহরের বড় শপিং মলগুলোতে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করা যায়। যার কারণে শহরে বসবাস করা গ্রাহকরা ক্রেডিট কার্ডের যথাযথ ব্যবহারের সুযোগ পান। ডিজিটাল ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে গ্রাম থেকে শহরে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। আশা করা যাচ্ছে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার সামনের দিনগুলোতে আরও বৃদ্ধি পাবে।
গ্রাহকের জীবন সহজীকরণে ক্রেডিট কার্ডের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, একসময় ক্রেডিট কার্ড আভিজাত্যের প্রতীক হলেও বর্তমানে এটি জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। চলে এসেছে সাধারণের নাগালের মধ্যে। মানুষের মধ্যে কার্ডকে জনপ্রিয় করতে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও ছাড় দিয়ে যাচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে চাকরিজীবী ও পেশাজীবীরা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। হঠাৎ জরুরি টাকার প্রয়োজনে ক্রেডিট কার্ড বড় সমাধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া ইলেকট্রনিক, আসবাবপত্র, পোশাক, গাড়ি, ভোগ্যপণ্যসহ অনেক কিছু বর্তমানে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কেনা যাচ্ছে। দামি পণ্যের ক্ষেত্রে কিস্তির সুবিধাও রয়েছে। হাসপাতালের বিলও দেওয়া যাচ্ছে ক্রেডিট কার্ডে। পকেটে টাকা না থাকলেও সমস্যা নেই, একটি ক্রেডিট কার্ড থাকলেই খাওয়া-দাওয়া কিংবা বাস-ট্রেন-বিমানের টিকিট কেনাও সহজ হয়ে গেছে। প্রতিটি কার্ড ব্যবহারের জন্য বার্ষিক একটা ফি দিতে হয় গ্রাহকদের। তবে কার্ড থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ খরচ করলে সেই ফি থেকে মুক্তি মিলে। ইসলামী ব্যাংক কার্ডের ব্যবহার বাড়াতে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। ব্র্যান্ডের পোশাক, ইলেকট্রনিক, জুতা, হোটেল-রিসোর্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য বা সেবা কিনলে ছাড় মিলছে। প্রতি মাসে কার্ডের বিল জমা দেওয়াটা অনেকের কাছেই ঝামেলা পূর্ণ মনে হয়। অর্থ জমা দেওয়ার শেষের দিনগুলোতে ব্যাংকে প্রচুর ভিড় থাকে। তবে সময়ের ব্যবধানে ইসলামী ব্যাংকে এ কাজও সহজ হয়েছে। ব্যাংকের কার্ডের বিল বর্তমানে ডিজিটাল সেবা ও মোবাইল আর্থিক সেবা বা এমএফএসের মাধ্যমে ঘরে বসেই জমা দেওয়া যাচ্ছে। আবার অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও কার্ডের বিল দেওয়া যায়। সুতরাং অকপটে বলা যায়, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে মানুষের জীবনে গতিময়তা এসেছে।
ক্রেডিট কার্ডে খেলাপির হারও কম। ২০২২ সালের জুনে এ হার ছিল ৪ শতাংশ, যেখানে ব্যাংকব্যবস্থায় খেলাপি প্রায় দ্বিগুণ।
ক্রেডিট কার্ডে বার্ষিক ফি ও মুনাফা হার নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে মনিরুল মওলা বলেন, ইসলামী ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের নিয়মকানুন গ্রাহকদের জন্য অনেক সহজ করা হয়েছে। আমাদের কার্ডে কোনো লুকায়িত চার্জ নেই। এ ক্ষেত্রে সার্বিক বিবেচনায় আমাদের মুনাফার যৌক্তিক পর্যায়ে রয়েছে। সাধারণ মানুষের কার্ডের প্রতি এক ধরনের ভীতি কাজ করে। ব্যাংকিং চ্যানেলের নানা ডকুমেন্টশন, নানান চার্জের চাপ এ সেবা সর্বজনীন করার পথে মূল অন্তরায়। এ ভীতি কাটিয়ে সাধারণ গ্রাহকদের কার্ডের প্রতি আকৃষ্ট করাই ক্রেডিট কার্ডের বাজারে বড় প্রতিবন্ধকতা। এ ছাড়া এর খরচ সর্বসাধারণের নাগালের মধ্যে রাখাটাও এ সেক্টরে বড় চ্যালেঞ্জ বটে। ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকের মধ্যে ক্রেডিট কার্ডের জনপ্রিয়তা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে।
ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার কম থাকলে গ্রাহক এটি ব্যবহারে আগ্রহী হবে। আর যদি সুদের হার বেশি থাকে তাহলে মানুষ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার থেকে দূরে সরে যাবে। এ জন্য ক্রেডিট কার্ডের বিস্তারে সুদের হার সহনীয় পর্যায়ে থাকা আবশ্যক বলে মনে করেন বেসরকারি খাতের ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এমরানুল হক। একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন অভিজ্ঞ এই ব্যাংকার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দেশ রূপান্তরের নিজস্ব প্রতিবেদক এ জেড ভূঁইয়া আনাস।
দেশ রূপান্তর : করোনার সময় দেশের ব্যাংক খাতে প্রযুক্তির বিস্তার ঘটেছে। প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে আপনারা কী পরিমাণ এগিয়েছেন?
এমরানুল হক : করোনার সময় আমরা ডিজিটাল নির্ভর হয়ে পড়েছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় ডিজিটালের বিস্তার ঘটেছে। করোনা পুরো পৃথিবীকে ঘরে বসেই অফিস (ওয়ার্ক ফর হোম) করার বিষয়টি শিখিয়েছে। এ বিষয়টি আগে কেউ জানত না। শুধু ব্যাংকিং খাত নয়, অন্যান্য খাতেও সে সময় বাসায় বসে অফিস করতে হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের কোথাও কোথাও এটা এখনো চলমান রয়েছে। ওয়ার্ক ফর হোম আমাদের পরিচালন খরচ কমিয়ে দিয়েছে। আগে আমরা সবগুলো সভাই সশরীরে উপস্থিত থেকে করতাম। এখন অনলাইনে করার কারণে যেভাবে আমাদের পরিচালন খরচ কমে যাচ্ছে ঠিক একই ভাবে আমাদের সময়ও বেঁচে যাচ্ছে। সভায় উপস্থিত হওয়ার যানজটের ভোগান্তি নেই, যাতায়াত খরচও নেই।
এ ছাড়া আমরা গ্রাহকের সুবিধা এবং কর্মীদের সুবিধার জন্য সে সময় অনেকগুলো ডিজিটাল প্রোগ্রাম নিয়ে এসেছি। আগে অ্যাকাউন্ট খুলতে সব গ্রাহককে ব্যাংকে আসতে হতো। এখন ঢাকা ব্যাংকের ‘ইজি ব্যাংক’ অ্যাপ ব্যবহার করে গ্রাহক ঘরে বসেই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন। ঢাকা ব্যাংক নামে আমাদের আরেকটা অ্যাপস আছে, যার মাধ্যমে আমরা অন্যান্য সার্ভিসও দিচ্ছি। এই অ্যাপসের মাধ্যমে ক্রেডিট কার্ডের আবেদন, ঋণের আবেদনসহ অন্য কাজগুলো করা হয়। এ ছাড়া ট্রেড বিজনেস বা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য আমরা একটি অ্যাপস নিয়ে এসেছি। যাতে গ্রাহক ব্যাংকে না এসেই তার অফিস বা বাসা থেকে এর কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। এ ছাড়া ন্যারো সেভিংস ও ই-ঋণ নামে আমাদের আরও দুটি অ্যাপ রয়েছে। ই-ঋণের মাধ্যমে গ্রাহক ব্যাংকে না এসেই ঋণ নিতে পারছে। তবে এই অ্যাপে আমরা ৩ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়ে থাকি। এই ঋণ পরিশোধ করতে হয় ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে। এতে আমাদের কোনো কর্মীকে ব্যবহারও করতে হচ্ছে না। সম্পূর্ণ ডিজিটাল মাধ্যমেই এসব কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। এতে ঋণখেলাপি হওয়ার আশঙ্কাও কম। করোনা কমে গেলেও গ্রাহকরা এসব অ্যাপের সুবিধা নিচ্ছেন। এতে গ্রাহককে যেভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করতে হচ্ছে না, ঠিক একই ভাবে আমাদেরও পরিচালন খরচ কমে আসছে। এ জন্য ঢাকা ব্যাংক সব সময় প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করে থাকে।
দেশ রূপান্তর : কার্ডভিত্তিক লেনদেনে আপনাদের অবস্থান কেমন?
এমরানুল হক : আমাদের কার্ডভিত্তিক লেনদেন বাড়ছে। গত চার বছরে আমাদের কার্ডের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ২০০৫-০৬ সালের দিকে আমরা কার্ড বিক্রি শুরু করেছিলাম। সে সময় থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমরা যে পরিমাণ কার্ড বিক্রি করেছি, ২০১৯-২২ সাল পর্যন্ত সমপরিমাণ কার্ড বিক্রি করেছি। আমাদের প্রচারণা ও পরিশ্রম পাশাপাশি গ্রাহকরা কার্ডের ব্যবহারের ভালো দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন হচ্ছেন। এটা ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
দেশ রূপান্তর : বর্তমানে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন বাড়ছে। গত মার্চে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে ক্রেডিট কার্ডে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ক্রেডিট কার্ডের ভবিষ্যৎ কেমন?
এমরানুল হক : বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ডের ভবিষ্যৎ খুবই ভালো। পুরো বিশ^ই এখন ক্যাশলেস হয়ে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ এখন ক্যাশ গ্রহণ করতে চায় না। মার্কেটে কেনাকাটায় বা ট্যাক্সির ভাড়া কোনো ক্ষেত্রেই ক্যাশ গ্রহণ করতে চায় না। আমারাও ধীরে ধীরে সেদিকে যাচ্ছি। আগে অনেকেই মনে করত ক্রেডিট কার্ড নিলে খরচ বেড়ে যাবে বা ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার বেশি। এখন মানুষ ধীরে ধীরে ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। ক্রেডিট কার্ড থাকলে মানুষকে ক্যাশ নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে না। পাশাপাশি টাকা না থাকলে গ্রাহক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে পারছেন। এই বিল পরিশোধে গ্রাহক ২০ থেকে ২২ দিন সময়ও পাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো সুদও দিতে হয় না। অনেকেই এই সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করে দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে আমার মনে হয় পৃথিবী যেদিকে যাচ্ছে, আমরাও সেদিকেই যাচ্ছি। ক্রেডিট কার্ডের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে। ধীরে ধীরে এর ব্যবহার এবং সংখ্যা দুটোই বাড়বে।
দেশ রূপান্তর : কারা ক্রেডিট কার্ড বেশি ব্যবহার করছে বলে আপনার মনে হয়?
এমরানুল হক : এখন সব শ্রেণির লোকজনই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন; বিশেষ করে যারা বেতনভোগী ও ব্যবসায়ী তারা ক্রেডিট কার্ড বেশি ব্যবহার করেন। এমনকি বর্তমানে শিক্ষার্থীদের জন্যও আমরা ক্রেডিট কার্ড দিচ্ছি। কারও ১৮ বছর পার হলে তার আয় অথবা তার ফ্যামিলির অবস্থান দেখে আমরা তাদেরও ক্রেডিট কার্ড দিচ্ছি।
দেশ রূপান্তর : ক্রেডিট কার্ড মানুষকে ঋণগ্রস্ত করে তোলে বলে অভিযোগ আছে। আপনি কী মনে করেন?
এমরানুল হক : এটা নির্ভর করবে গ্রাহকের মাইন্ড সেটের ওপর। কোনো গ্রাহক যদি মনে করেন তারা এটি ঋণ নেওয়ার জন্য ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন, তাহলে এটি ভুল হবে। আমি মনে করি, সবার মাথায় রাখা উচিত ক্রেডিট কার্ড মানুষের জীবনকে সচ্ছল নয়, সহজ করে। যদি কেউ এটিকে সচ্ছলতার জন্য ব্যবহার করেন, তাহলে এটি তার জন্য ঋণগ্রস্ত করে তোলার ঝুঁকি তৈরি করে দিতে পারে। ক্রেডিট কার্ড গ্রাহককে অবশ্যই নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। তিনি এমন পরিমাণ টাকা নেবেন, যাতে পরিশোধ করতে পারেন। পাশাপাশি কোন সময়ের মধ্যে পরিশোধ করবেন, এটাও তার প্ল্যানিংয়ে থাকতে হবে। এই প্ল্যানিং যদি থাকে তাহলে ক্রেডিট কার্ড তার জীবনকে সহজ করে তুলবে। ক্রেডিট কার্ড বিতরণের পর রেজাল্ট যদি ভালো আসে তাহলে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। যদি রেজাল্ট খারাপ দেখা যায় তাহলে ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে সাবধানতা বেশি অবলম্বন করবে।
দেশ রূপান্তর : সুদের হার ক্রেডিট কার্ডের বিস্তারে বাধা কি না?
এমরানুল হক : এখন ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার ১২ শতাংশের ওপরে নেওয়া যায় না। একসময় অনেক ব্যাংক এসব সুদের হার ২০, ২২ এমনকি ২৫ শতাংশ পর্যন্ত নিয়েছে। এটা আমি মনে করি ঠিক নয়। যেহেতু এতে ঝুঁকি বেশি, দ্রুত প্রভিশনিং হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে অন্যান্য ঋণের তুলনায় সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ শতাংশ বেশি সুদ ধরা যেতে পারে। এমন কিছু করা উচিত নয় যেন গ্রাহক এটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন; অর্থাৎ অন্যান্য ঋণের তুলনায় ক্রেডিট কার্ডের সুদ কোনোভাবেই দ্বিগুণ হওয়া উচিত নয়। ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার যদি ভালো হয় বা কম হয়, তাহলে গ্রাহকরা ক্রেডিট কার্ডের প্রতি আগ্রহী হবেন। যদি সুদের হার আকাশছোঁয়া হয় বা বেশি হয় তাহলে এর থেকে মানুষ দূরে সরে যাবে। এ জন্য এটি সহনীয় পর্যায়ে রাখা উচিত। তাহলে অনেকেই আগ্রহী হবেন ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার ক্ষেত্রে।
দেশ রূপান্তর : বিভিন্ন অফারের কারণে আপনাদের ক্রেডিট কার্ডের বিস্তার ঘটছে কি না?
এমরানুল হক : আমরা সাধারণত ফেস্টিভ্যালের সময় অফার দিয়ে থাকি; অর্থাৎ রোজা, ঈদ, বৈশাখ বা অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এসব অফার দিয়ে থাকি। তখন ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। অনুষ্ঠান বা ঈদের সময় মানুষ এমনিতেই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বেশি করে। পাশাপাশি যদি অফার দেওয়া হয় তাহলে তার আরও বেশি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হয়। একটা সাধারণ মাসে ক্রেডিট কার্ডের যে পরিমাণ ব্যবহার হয়, যখন অফার দেওয়া হয় তখন সাধারণ সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ, আড়াই গুণ বা কোনো কোনো সময় তিন গুণ হয়ে যায়।
একটা সময় পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ড শুধু উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। লংকাবাংলাই সর্বপ্রথম মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য ক্রেডিট কার্ড নিয়ে আসে। গত কয়েক বছরে এটি নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেও ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন আমরা গ্রামপর্যায়ে ক্রেডিট কার্ড পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। দেশ রূপান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের এসইভিপি ও হেড অব রিটেইল বিজনেস খোরশেদ আলম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দেশ রূপান্তরের নিজস্ব প্রতিবেদক এ জেড ভূঁইয়া আনাস
খোরশেদ আলম বলছিলেন, আমাদের আর্থিক ব্যবস্থা ডিজিটাল হচ্ছে। আমরা বহুদূর এগিয়েছি। এটি বাড়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ডিজিটাল লেনদেন দুভাবে ভাগ করা যায়। একটি পেমেন্ট সিস্টেম, অন্যটি ফান্ড ট্রান্সফার। এর মধ্যে ফান্ড ট্রান্সফার ভালোই হচ্ছে। গার্মেন্টস সেক্টর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলেও এ লেনদেন শুরু হয়েছে ব্যাপকহারে। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন দ্রুতই বাড়ছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে লেনদেনের ৮০ শতাংশ হবে ডিজিটাল। কয়েক দিন আগে আমরা গ্রাহককে চেকের মাধ্যমে পেমেন্ট করতাম। বর্তমানে সেটি ডিএফটিএম মাধ্যমে পরিশোধ করছি। ডিজিটাল লেনদেনে আমরা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি এগিয়েছি। এখনো আমাদের কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, আমাদের মার্চেন্ট লেভেল যেভাবে আধুনিক হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হয়নি।
অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ ক্রেডিট কার্ডে পিছিয়ে আছে। যদিও এখন তা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। দেশে এ ধরনের কার্ডের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খোরশেদ আলম বলেন, জনসংখ্যার বিচারে অনুযায়ী কার্ডের সংখ্যা কম। আগামীতে এটিকে বাড়িয়ে অন্তত চার কোটিতে নিয়ে যেতে হবে। ক্রেডিট কার্ড কম হওয়ার পেছনে যারা ইস্যু করছেন, তাদের গাফিলতি রয়েছে। যদিও এর পেছনে ব্যাংকগুলো ঝুঁকি বিবেচনা করছে। ক্রেডিট কার্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো পুরাতন গ্রাহক ও যাদের হ্যান্ডসাম স্যালারি আছে তাদের বেছে নিচ্ছেন। এজন্য যে গ্রাহককে ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নিয়ে ঋণ দিতে চায় না আমরা তাদেরই টার্গেট করেছি। বিশেষ করে সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা আমাদের ক্রেডিট কার্ড হোল্ডার। আমাদের দেখে অনেক ব্যাংক এখন শিক্ষকদের টার্গেট করে কাজ করছে।
ইন্টার্ন ডাক্তারদের আমরা কার্ড দিয়েছি। দশম থেকে দ্বাদশতম গ্রেডের সরকারি চাকরিজীবীদেরও আমরা কার্ড দিয়েছি। এমনকি যাদের মাসিক আয় ২০ হাজার টাকা তারাও আমাদের কার্ড পেয়েছেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষক, সরকারি চাকরিজীবী, ব্যাংকাররাই মূলত ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক। তাদের লক্ষ্য করে যদি আমরা কাজ করতে পারি তাহলে ক্রেডিট কার্ডের বাজার আরও বড় হবে। ক্রেডিট কার্ড যদি আপনি যথাযথভাবে ব্যবহার করেন, সময়মতো বিল পরিশোধ করেন তাহলে আপনি কখনই বিপদে পড়বেন না। কিন্তু যদি ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা নিয়ে আপনি জমি কেনেন কিংবা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে লোকসান করেন, তাহলে আপনি কার্ডের বিল দিতে সমস্যায় পড়বেন এবং এটি আপনার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
আগে একটা ধারণা ছিল যে, এলিট শ্রেণির মানুষজনই শুধু কার্ড ব্যবহার করবেন। কিন্তু সেটি এখন পরিবর্তন হয়েছে। এখন পর্যায়ক্রমে গ্রামাঞ্চলেও ক্রেডিট কার্ড পৌঁছে দেওয়া সম্ভব বলে মনে করছি।
ক্রেডিট কার্ডে সুবিধা প্রসঙ্গে খোরশেদ আলম বলেন, ভোগ্যপণ্যের সব প্রোডাক্ট আপনি ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কিনতে পারবেন। মাছ, মাংস, ওষুধ, ঘরের আসবাবপত্র, এমনকি পার্লারে বিল পরিশোধও করা যায়। বিয়ের সময় অনেকেই অর্থসংকটে পড়েন। সে ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ডের সহায়তা নিতে পারছেন। আমাদের শিখা কার্ড রয়েছে। কাস্টমারদের ন্যানো লোন দেওয়ার জন্য কাজ করছি। কারও পরিবারের কোনো সদস্য অসুস্থ হলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে তার ডাক্তারের খরচ মেটানো, অপারেশন করাতে হলে আমরা সেই সুবিধাও দিয়ে থাকি। আমরা বিভিন্ন সেক্টরের লোকজনের সঙ্গে এগ্রিমেন্ট করেছি। যদি কেউ আমাদের কার্ড দিয়ে তাদের সঙ্গে কোনো লেনদেন করে তাহলে সে ক্ষেত্রে আমরা তাদের পার্সেন্টেজ হারে ডিসকাউন্ট সুবিধা দিয়ে থাকি, শূন্য শতাংশ সুদে। ক্রেডিট কার্ড এমন একটি প্রোডাক্ট, আপনি চাইলে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই ব্যবহার করতে পারবেন।
অনেক সময় আমরা বিভিন্ন অফার বা বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকি। লেনদেনের টাকা প্রতি মাসে বেতন থেকেও অল্প অল্প করে কেটে নেওয়ার সুবিধা রেখেছি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সে পুরো টাকাটা পরিশোধ করে দিলে কোনো সুদ থাকবে না। কোনো কার্ডহোল্ডার যদি রেগুলার তারিখে পরিশোধ করে দেন তাহলে তিনি ঋণগ্রস্ত হবেন না। তারাই শুধু ঋণগ্রস্ত হন যারা টাকা খরচ করছেন আবার সময়মতো ঋণ পরিশোধ করছেন না।
ক্রেডিট কার্ডে খেলাপি প্রসঙ্গে লংকাবাংলার এ কর্মকর্তা বলেন, বরাবরই আমাদের কার্ডে খেলাপির হার ৮ শতাংশের মধ্যে ছিল। কিন্তু কভিডের মধ্যে এটি বেড়ে যায়। অনেক কার্ডধারী রয়েছেন যারা করোনার কারণে চাকরি হারিয়েছেন। তারা চাকরি হারানোর আগে প্রত্যেক মাসে কার্ড থেকে টাকা উত্তোলন করেছেন এবং সেটি স্যালারি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধ করতে পেরেছেন। তাদের অনেকের চাকরি হারিয়ে বেতন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। আবার কেউ কেউ খেলাপি হয়ে গেছেন। কেউ হয়তো করোনায় মারা গেছেন কিংবা কারও হয়তো বেতন কমে যাওয়ার কারণে খেলাপি হয়ে পড়েছেন। অবশ্য এ বছরের জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসেই খেলাপির পরিমাণ কমছে।
কার্ডের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে খোরশেদ আলম বলেন, ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে সার্ভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আমরা যে সফটওয়্যারটি ব্যবহার করি সেটার নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আমাদের একটি দক্ষ তথ্যপ্রযুক্তি ইউনিট আছে। তারা প্রতিনিয়ত গবেষণার মাধ্যমে ঝুঁকি প্রশমনের কাজ করছে। এখন পর্যন্ত আমাদের ক্রেডিট কার্ডে কোনো ধরনের সাইবার হামলা কিংবা এ ধরনের কোনো কিছু হয়নি। তবে ছোটখাটো জালিয়াতির কিছু ঘটনা ঘটেছে। এজন্য আমরা প্রতিনিয়ত গ্রাহকদের সচেতন করছি কার্ডের পিন কারও সঙ্গে যাতে শেয়ার করা না হয়। এমনকি লংকাবাংলা থেকে ফোন দেওয়া হলেও দেবেন না। লংকাবাংলা কখনই গ্রাহকের কাছে পিন চাইবে না। তবে কেউ কেউ লংকাবাংলার কাস্টমার কেয়ারের নাম ভাঙিয়ে গ্রাহকদের ফোন করে পিন নম্বর চায়। এজন্যই আমরা গ্রাহকদের সতর্ক করছি যে কাউকে পিন নম্বর না দেওয়ার জন্য। সম্প্রতি আমরা কার্ডের বিল জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্ড নম্বরের পরিবর্তে একটি অ্যাকাউন্ট নম্বর তৈরি করেছি। এতে গ্রাহক সেই অ্যাকাউন্ট নম্বর ব্যবহার করে টাকা জমা দেবেন। এতে অন্য কেউ গ্রাহকের কার্ড নম্বর জানতে পারবে না।
দেশ রূপান্তরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী জাফর আলম।
দেশ রূপান্তর : দেশের আর্থিক লেনদেন কতটা ডিজিটাল হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
জাফর আলম : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশে ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে, যেখানে দৈনিক মোট লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ৪৮ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে যুক্ত আছে। যদিও এ সংখ্যা খুবই কম। তবে ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। গত মার্চেই ৪ লাখ নতুন গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এই হিসাবে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ নতুন গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে যুক্ত হচ্ছেন। দেশে প্রায় ৩ কোটি ডেবিট কার্ড ও ২২ লাখ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী আছেন। এসবের সঙ্গে এটিএম, পস, সিআরএম, সিডিএম, আরটিজিএস, ইএফটিএন ইত্যাদির ব্যবহার ডিজিটাল লেনদেনকে উৎসাহিত করছে বলে আমি মনে করি। আসলে প্রযুক্তিকে আমাদের ধারণ করতে হবে। এ হিসেবে আমরা যথাযথভাবে এগোচ্ছি বলে মনে হয়।
দেশ রূপান্তর : লেনদেনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সম্পন্ন হচ্ছে ক্রেডিট কার্ডে। এই সেবার ভবিষ্যৎ কেমন?
জাফর আলম : বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ক্রেডিট কার্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মানুষজন তাৎক্ষণিক টাকার চাহিদা মেটাচ্ছে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে। এখন কার্ডে ব্যাংকের বুথ থেকে নগদ টাকা তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পণ্যের কেনাকাটা ও সেবার মূল্য পরিশোধ করা যাচ্ছে। আর কোনো মুনাফা বা সুদ ছাড়া টাকা পরিশোধে সর্বনিম্ন ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ দিন পর্যন্ত সময় মিলছে। এসব কারণে দেশে দিনে দিনে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে লেনদেনও।
দেশ রূপান্তর : দেশে ডেবিট কার্ডের তুলনায় ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা অনেক কম। এর কারণ কী?
জাফর আলম : ডেবিট কার্ড দিয়ে নিজের ব্যাংক হিসাবের টাকা খরচ করা হয়। আর বেশির ভাগ ব্যাংক হিসাব খোলার সঙ্গেই গ্রাহকদের ডেবিট কার্ড দিয়ে থাকেন। ক্যাশ টাকা বহনের ঝামেলা মানুষ এখন এড়িয়ে চলতে চায়। আর ক্রেডিট কার্ড দিয়ে গ্রাহকদের ব্যাংকের টাকা খরচ করতে হয়। ক্রেডিট কার্ডের খরচ করা টাকার ওপর মুনাফা বা সুদ গুনতে হয়। তাই দেশে ডেবিট কার্ডের তুলনায় ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা কম।
দেশ রূপান্তর : আয়কর বিবরণী জমা বাধ্যতামূলক করায় ক্রেডিট কার্ড ইস্যুর ওপর কোনো প্রভাব ফেলছে কি না?
জাফর আলম : ক্রেডিট কার্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে গ্রাহকদের আয়কর বিবরণী জমা বাধ্যতামূলক করা একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। এর ফলে কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমার মনে হয় না।
দেশ রূপান্তর : কোন শ্রেণি-পেশার গ্রাহক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন? শহরের মধ্যে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক সীমাবদ্ধ কেন? পুরো দেশে ক্রেডিট কার্ড ছড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না কেন?
জাফর আলম : চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ আর্থিকভাবে সচ্ছল যেকোনো মানুষ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। শহরের মধ্যে ক্রেডিট কার্ডের চাহিদা বেশি। আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে শহরের বসবাসকারী মানুষই সাধারণত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন। এসআইবিএল সব সময় ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকবান্ধব। গ্রাহকের বিভিন্ন সুবিধার কথা চিন্তা করে আমরা সর্বদা ভালো কিছু করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আমাদের মার্চেন্ট আউটলেটে ডিসকাউন্ট, ইএমআই ও শূন্য শতাংশ আই পে সুবিধা চালু আছে। আরও বেশি সুবিধা দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা স্কুল-কলেজের শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আমাদের কার্ডসেবা প্রদানের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি। মানুষ এখন নগদ টাকা বহন করতে চায় না। গ্রামেও এর চাহিদা তৈরি হবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ক্রেডিট কার্ডের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ইসলামি শরিয়াহসম্মত ও সুদমুক্ত কার্ড হওয়ায় আমাদের কার্ডের বাজার সম্প্রসারণে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আশা করছি, আগামীতে আমাদের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের চাহিদা আরও বাড়বে। সেই টার্গেট নিয়েই আমরা কাজ করছি।
দেশ রূপান্তর : ডিজিটাল লেনদেনে গ্রাহকের নিরাপত্তা কতটা? গ্রাহকের কী ধরনের সচেতনতা প্রয়োজন?
জাফর আলম : এসআইবিএল শরিয়াহভিত্তিক একটি আধুুনিক ব্যাংক। এর ক্রেডিট কার্ডও সম্পূর্ণ শরিয়াহ কমপ্লায়েন্ট। গ্রাহকরা ক্রেডিট কার্ডের সঙ্গে সাপ্লিমেন্টারি কার্ড নিতে পারেন, যা বিনা মূল্যেই দেওয়া হয়। এসআইবিএলের ক্রেডিট কার্ড অত্যন্ত সুরক্ষিত ও ই-কমার্স লেনদেনও টু ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন দ্বারা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। এসআইবিএলের ক্রেডিট কার্ড শরিয়াহসম্মত ও সুদমুক্ত হওয়ায় এর বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। সমাজে সর্বস্তরের গ্রাহক আমাদের ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। আমরা স্বল্প আয়ের চাকরিজীবীদের জন্য ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করছি।
দেশ রূপান্তর : এসআইবিএলের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধা কী?
জাফর আলম : তুলনামূলকভাবে আমাদের ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডে প্রফিট রেট, ফি ও অন্যান্য চার্জ অনেক কম। শরিয়াহসম্মত হওয়ায় আমাদের কার্ডে কোনো হিডেন চার্জ নেই। গ্রাহকরা বাংলাদেশের যেকোনো এটিএম থেকে কম খরচে ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা তুলতে পারেন। সব ধরনের পিওএস (পয়েন্ট অব সেল) মেশিনে আমাদের কার্ড ব্যবহার করা যায়। এসআইবিএলের কার্ডে বিভিন্ন নির্বাচিত মার্চেন্ট আউটলেটে প্রায় সময়ই বিভিন্ন ধরনের ইএমআই সুবিধায় শূন্য শতাংশ আই-পে সুবিধা দেওয়া হয়, যা গ্রাহককে সহজেই আকৃষ্ট করছে। এ ছাড়া এসআইবিএলের ক্রেডিট কার্ডের পেমেন্ট সিস্টেমও অত্যন্ত নমনীয়, অর্থাৎ গ্রাহকরা পেমেন্ট দিতে সর্বোচ্চ ৫০ দিন পর্যন্ত মুনাফা ফ্রি সময় পান। এই সময়ের মধ্যে পেমেন্ট দিলে কোনো ধরনের মুনাফা চার্জ ধার্য করা হয় না। গ্রাহকরা কার্ড দিয়ে ব্যালান্স ট্রান্সফারের সুবিধা ভোগ করতে পারছেন খুব সহজেই। সেই সঙ্গে তারা বিভিন্ন নির্বাচিত আউটলেটে ডিসকাউন্টসহ ইএমআই সুবিধাও পাচ্ছেন। ব্যাংকের প্লাটিনাম কার্ডধারীদের জন্য বিনা মূল্যে প্রায়োরিটি পাস কার্ড দেওয়া হয়, যা দিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বলাকা ভিআইপি লাউঞ্জে ও বিশ্বব্যাপী নির্বাচিত লাউঞ্জে বিনা মূল্যে প্রবেশাধিকার সুবিধা পাওয়া যায়। গ্রাহকরা এসআইবিএলের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দেশে ও বিদেশে এটিএম থেকে নগদ উত্তোলনের সুযোগ পান। বর্তমান সময়ে ক্রেডিট কার্ড হলো বিপদের বন্ধু। কারণ আমাদের কার্ড দিয়ে গ্রাহক প্রয়োজনের মুহূর্তে যখন-তখন যেকোনো সময়ে এটিএম থেকে টাকা তুলতে পারছেন। বিভিন্ন পিওএস মেশিনে ব্যবহার করতে পারছেন, দেশে ও দেশের বাইরে ই-কমার্স লেনদেন করতে পারছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডিসকাউন্ট, ইএমআই ও শূন্য শতাংশ আই-পে সুবিধা পাচ্ছেন, ব্যালান্স ট্রান্সফারের মাধ্যমে কার্ড থেকে টাকা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে নিয়ে নগদ ব্যবহার করতে পারছেন। কাজেই এসআইবিএলের ক্রেডিট কার্ড আসলেই মানুষের বিপদের বন্ধু, সব সময়ের সঙ্গী।
দেশ রূপান্তর : বিভিন্ন উৎসবে গ্রাহকদের নানা অফার দিচ্ছেন। এতে ব্যবসা কতটা বাড়ে?
জাফর আলম : আসলে ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে এসব অফারের সম্পর্ক নেই। গ্রাহকদের সুবিধার্থে এ ধরনের অফার দেওয়া হয়ে থাকে। আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে আমরা বিভিন্ন শপিং মল, ইলেকট্রনিক ও ফার্নিচার শোরুম, হোটেল ও রেস্তোরাঁর সঙ্গে চুক্তি করছি। গ্রাহকরা তাদের কেনাকাটায় আরও বেশি ডিসকাউন্ট, ইএমআই ও শূন্য শতাংশ আই-পে সুবিধা পেতে পারেন, সে ব্যাপারে কাজ করছে এসআইবিএল। এসআইবিএলের গ্রাহক তাদের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা এবং প্রয়োজন মেটাতে পারছেন।
দেশ রূপান্তর : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
জাফর আলম : আপনাদেরও ধন্যবাদ।
গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের জামালপুর ইউনিয়নের শ্রীকলা গ্রামে মায়ের সঙ্গে নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল দেড় বছরের রুহান। গত মঙ্গলবার বাড়ির উঠানে খেলা করছিল শিশুটি। পরে বাড়িতে না দেখে খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে তাকে পাশের পুকুরে ভাসতে দেখেন স্বজনরা। পুকুর থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রুহানকে মৃত ঘোষণা করেন।
একইদিন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের আউশকান্দি ইউনিয়নের সদরাবাদ গ্রামে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তারা হলো সদরাবা গ্রামের মালেক মিয়ার ছেলে ইকবাল হোসেন, বাবুল হোসেনের ছেলে রাফি আহমেদ। পরিবারের সদস্যদের অগোচরে বাড়ির পাশের পুকুরে গোসল করতে নেমে তলিয়ে যায় ইকবাল ও রাফি। খোঁজখুঁজির একপর্যায়ে পুকুরে তাদের লাশ দেখতে পান স্বজনরা।
দেশে কোনো না কোনো প্রান্তে প্রতিদিনই এরকম ঘটনা ঘটছে। গত এক মাসে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা একশর বেশি। চলতি বছর জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬১।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো দুর্ঘটনার মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যু তালিকার প্রথম দিকেই থাকবে। এটি একটি অবহেলাজনিত জাতীয় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাস্থ্য ও তথ্য জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, বছরে ১ থেকে ১৭ বছর বয়সী ১৪ হাজার ৪৩৮ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। এ সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। এসব মৃত্যুর ৮৮ শতাংশই বাড়ি থেকে ২০ মিটারের মধ্যে ঘটে। পানিতে ডোবার ঘটনা বেশি ঘটে মিঠাপানিতে, যেমন বাড়ির পাশের পুকুর-দীঘি-ডোবায়। খেলতে খেলতে কিংবা গ্রামাঞ্চলে হাত-মুখ ধুতে গিয়েও পানিতে ডুবে মৃত্যুর অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। আবার কখন ডুবে যাওয়া শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে একই সঙ্গে দুজন বা তারও বেশি মৃত্যুর ঘটনাও আছে। এ ছাড়া নদী বা খালে ডুবেও মৃত্যুর ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিয়ে কাজ করছে গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’। সংবাদপত্রে প্রকাশিত পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা। সংগঠনটির হিসাবে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত পানিতে ডুবে ৩ হাজার ৮৪৬ জন মারা গেছে। এর ৮৮ শতাংশই ৫-৯ বছর বয়সী শিশু।
প্রতিষ্ঠানটির তথ্য বলছে, ২০২০ সালে মৃত্যু হয়েছিল ৮০৭ জনের। এর মধ্যে ৫ বছরের শিশু রয়েছে ২৬০টি। এর পরেই আছে ৫-৯ বছর বয়সী ২৮৭, ১০-১৪ বছর বয়সী ১০৬, ১৫-১৮ বছর বয়সী ৩০ জন। আর ১৮ বছরের বেশি বয়সী ১৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২১ সালে মৃত্যু ছিল প্রায় দ্বিগুণ। ওই বছর পানিতে ডুবে মারা গেছে ১ হাজার ৩৪৮ জন। এর মধ্যে অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫৯৭। তার পরেই আছে ৫-৯ বয়সী ৩৮৭, ১০-১৪ বছর বয়সী ১০৬ ও ১৫-১৮ বছর বয়সী ৪৩ জন। এ ছাড়া ১৮ বছরের বেশি বয়সী তরুণ মারা গেছে ২১৫ জন।
২০২২ সালে মারা গেছে ১ হাজার ১৩০ জন। এ সময় অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশু মারা গেছে ৫৬৬ জন, যা মোট মৃত্যুর প্রায় অর্ধেক। অন্যদিকে ৫-৯ বছর বয়সী শিশু মারা গেছে ৩৬৩ জন। এরপরই ১০-১৪ বছর বয়সী ৯৩, ১৫-১৮ বছর বয়সী ৩৮ ও ১৮ বছরের বেশি বয়সী ৬৭ জন মারা গেছে।
২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে দেশে পানিতে ডুবে মারা গেছে ৫৬১ জন। এর মধ্যে ২৯০ জনের বয়স ছিল ৫ বছরের মধ্যে। ৫-৯ বছর বয়সী শিশু মারা গেছে ১৯৪ জন। ১০-১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৪৮। ১৫-১৮ বছর বয়সী রয়েছে ৯ জন। এ ছাড়া ১৮ বছরের বেশি বয়সী মারা গেছে ১৩ জন।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সব বিভাগেই পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার প্রায় কাছাকাছি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় চট্টগ্রাম বিভাগে। এরপরের অবস্থান ঢাকা বিভাগের। এ বিভাগে রাজধানী ঢাকাসহ প্রতিটি জেলায় গড়ে ৪০ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
বছর জুড়ে পানিতে ডুবে শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যায়। এ সময় বর্ষার কারণে পুকুর, খাল-বিল ও নদ-নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার ফলে শিশুমৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটে। পানির উৎস বাড়ির যত কাছাকাছি থাকে, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি ততই বেড়ে যায়।
পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু নিয়ে ‘সমষ্টি’র পরিচালক মীর মাসরুর জামান রনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় আমরা যে তথ্য পাই সেখান থেকে এ প্রতিবেদন তৈরি করা। বাস্তবে চিত্র আরও ভয়াবহ। মাত্র ২৫ শতাংশ মৃত্যুর সংবাদ আমরা পেয়ে থাকি।’
তিনি বলেন, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর একটি বড় কারণ হচ্ছে পারিবারিক অসচেতনতা ও অবহেলা। শুধু বড় জলাশয় বা পুকুরে ডুবে মৃত্যু হয় বিষয়টা এমন নয়। অনেক সময় বালতির পানিতে ডুবেও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এ দুর্ঘটনাগুলো ঘটে থাকে পরিবার বা বাবা-মায়ের অসচেতনতার কারণে। ছয় বছরের বেশি বয়সী একটি শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। অথচ এ বয়সের শিশুদের সাঁতার শেখানোর কথা। যদি তারা সাঁতার জানত তাহলে এ মৃত্যু অনেকাংশে কমে আসত।
বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালের স্বাস্থ্যনীতিতে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুকে একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। শিশু নিরাপত্তায় পাইলট প্রকল্পে পানিতে ডুবে মৃত্যুও বিবেচনা করলেও সরকারের বাস্তবায়িত প্রকল্প এখনো সীমিত। গত বছর সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযতœ কেন্দ্রের মাধ্যমে ‘শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ নামে কর্মসূচি নিয়েছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘ইনটেগ্রেটেড কমিউনিটি বেইজড সেন্টার ফর চাইল্ড কেয়ার, প্রটেকশন অ্যান্ড সুইম-সেইফ ফ্যাসিলিটিজ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সারা দেশে ১৬টি জেলার ৪৫টি উপজেলায় আট হাজার শিশুযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করা হবে। এসব যতœকেন্দ্রে কাজ পাবে ১৬ হাজার গ্রামীণ নারী। প্রতিটি যতœকেন্দ্রে ২৫ শিশুকে ভর্তি করা হবে। একই সঙ্গে ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের সাঁতার শেখানো হবে।
মীর মাসরুর জামান বলেন, ‘শিশুমৃত্যু ঠেকাতে হলে শহর থেকে গ্রামপর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সেখানে প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অথবা কমিউনিটির নেতাদেরও কাজে লাগানো যেতে পারে।’
তিনি বলেন, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু কমানোকে গুরুত্ব দিয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমির অধীনে প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। যদিও এসব প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে বেশিদিন হয়নি। প্রয়োজনে এ ধরনের প্রকল্পকে সরকারীকরণ করতে হবে।
শিশু-কিশোর সংগঠক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীর বাইরেও খাল-বিল, জলা, ডোবা-পুকুর এখন যথেষ্ট রয়েছে। ফলে পানির সঙ্গে এ দেশের মানুষের মিলেমিশে বসবাস করতে হবে। এজন্য সাঁতার শেখার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্কুলের কারিকুলামের মধ্যেই থাকবে সাঁতার শেখা।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার একটা কথা বলি, আনন্দের মধ্যে এবং চারপাশের চেনা প্রতিবেশ ও পরিবেশের মধ্যে দিয়েই শিশুকে শিক্ষা দিতে হবে।’
ডা. লেলিন বলেন, ‘একটি শিশু যখন স্কুলে গেল সেখানেই সাঁতার শেখানো সম্ভব। কারণ দেশের সব জায়াগায় সাঁতার শেখানোর যথেষ্ট উপকরণ রয়েছে। এ ছাড়া যেসব মহানগর বা শহরে সাঁতার শেখানোর জায়গার অপ্রতুলতা রয়েছে, সেসব জায়গায়ও বিশেষ ব্যবস্থায় সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা করতে পারে। প্রাথমিক জীবনের অঙ্গ হিসেবে শিক্ষার শুরু থেকেই সাঁতার শেখানোটা বাধ্যতামূলক করলে এ সমস্যার বড় অংশ সমাধান করা যাবে। দ্বিতীয়ত অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। যেসব জায়গায় ছোট শিশু রয়েছে সেখানে জলাধারগুলোকে চারপাশে ঘেরাও দিতে হবে। যেন শিশু বাইরে থাকলেও সুরক্ষিত থাকে। এ ছাড়া সরকারকে এ বিষয়ে আরও বেশি ভূমিকা রাখতে হবে। যে প্রকল্পগুলো রয়েছে, সেগুলো যেন কার্যকর ভূমিকা রাখে সেটা নজরদারিতে রাখতে হবে।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দেবে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি। এক দফার যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে থাকা দলগুলোও এই কর্মসূচি পালন করবে। চলতি মাসে অনুষ্ঠিত দলটির স্থায়ী কমিটির দুটি বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে বিএনপি সূত্রের দাবি। যার প্রতিফলন দেখা গেছে গতকাল বৃহস্পতিবার বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচিতেও।
সূত্রের দাবি, দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অন্তত তিন নেতা হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন নেতাকর্মীদের।
সূত্রগুলো বলছে, নভেম্বরের যেকোনো সময় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করার কথা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোটগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে ওই তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। বিএনপি চাচ্ছে তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক ফয়সালা নিশ্চিত করতে। এ লক্ষ্যে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বড় ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার চিন্তা রয়েছে তাদের। এসব কর্মসূচির মধ্যে ঢাকা ঘেরাও, সচিবালয় ঘেরাও, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘিরে কর্মসূচিসহ নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়ে দলটির অভ্যন্তরে আলোচনা রয়েছে।
জানা গেছে, এসব কর্মসূচিতে সরকার পক্ষ বাধা দিলে ‘যদি পরিস্থিতি সহিংস হয়ে ওঠে’ তাহলে এক পর্যায়ে অসহযোগ আন্দোলনের দিকেও যেতে পারে দলটি। বিএনপি নেতারা বলছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে দুই ধাপে কর্মসূচি সাজিয়েছে বিএনপি। প্রতিটি ধাপের শেষ দিনের কর্মসূচি হবে শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক। সরকার কঠোর হলে কর্মসূচিও কঠোর হবে। তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত যতটুকু সম্ভব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ রাখতে চাইবে দলটি। পরিস্থিতি বিবেচনায় তফসিলের আগেই হরতালের কর্মসূচি আসতে পারে। তবে দলটির এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তফসিল ঘোষণা হলেই তারা হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
এই কর্মসূচি ঘোষণার আগে আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করা হবে। কীভাবে কর্মসূচি সফল করা যায় তা নিয়ে নতুন করে ছক সাজানো হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে হরতালের মতো কর্মসূচির ইঙ্গিত দিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘যতদিন আপনি (শেখ হাসিনা) থাকবেন দেশ আরও সংঘাতের দিকে যাবে, খারাপের দিকে যাবে এবং সংঘাত আরও বাড়তে থাকবে। এখনো তো সংঘাত শুরু হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ যেভাবে এগোচ্ছে তাতে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে জনগণ রুখে দাঁড়াবে।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘শত প্ররোচনার মুখেও আমরা একেবারে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি। এটার শেষ পরিণতি কী হবে তা নির্ভর করবে সরকারের আচরণ কী হচ্ছে তার ওপর।’
একই দিন পৃথক কর্মসূচিতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী হরতাল কর্মসূচি ঘোষণার কথা বলেন। ভৈরব বাসস্ট্যান্ডে সিলেট অভিমুখী রোডমার্চ কর্মসূচির প্রথম পথসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা হরতাল করিনি, কিন্তু করব না সেই প্রতিজ্ঞাও করিনি। জনগণের চাপের কারণে হরতাল অবরোধ যা যা করা দরকার, গণতান্ত্রিক পন্থায় এই অবৈধ সরকারকে মাটিতে বসিয়ে দেওয়ার জন্য দল, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে সব ধরনের কর্মসূচি হবে। সেই জন্য আপনারা প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। আমাদের এবারের আন্দোলন ডু অর ডাই। হয় মরব, নয়তো লড়ব।’
আর জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের উদ্যোগে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবিতে আয়োজিত আলোচনা সভা ও সম্মেলনে প্রধান অতিথির বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘জনগণকে সম্পৃক্ত করে আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে যাচ্ছি। হরতাল অবরোধ শান্তির প্রবক্তারাই চালু করেছে। সরকার যদি আমাদের রোডমার্চ, মিছিলে জনগণের সম্পৃক্ততায় কোনো বার্তা না পায় বা না বোঝে তাহলে দিনের পর দিন হরতাল অবরোধ করে দেশ অচল করে দেওয়া হবে। সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে।’
জাতীয় সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। চলতি সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হবে আগামী বছরের ২৯ জানুয়ারি। এর আগের ৯০ দিন; অর্থাৎ আগামী ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করতে হবে। সাধারণত নির্বাচনের ৪০ থেকে ৪৫ দিন আগে তফসিল ঘোষণা করা হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর। মাঝখানে ৪৫ দিন সময় রেখে ভোটের তারিখ ছিল ২৩ ডিসেম্বর। তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মুখে ভোটের তারিখ এক সপ্তাহ পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর করা হয়েছিল। দশম সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর। ভোটগ্রহণ করা হয়েছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। তফসিল ঘোষণা ও ভোট গ্রহণের মধ্যে সময় ছিল ৪০ দিন।০
আশ্বিন মাসের সন্ধ্যায় ঢাকায় নামল শ্রাবণের বৃষ্টি। আকাশ ভেঙে পড়া বর্ষণে তলিয়ে গেছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রাস্তা। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে টানা কয়েক ঘণ্টার মুষলধারে বৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকার রাস্তা তলিয়ে যায়। কোথাও কোথাও বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। মাঝরাত পর্যন্ত ওইসব সড়কে থমকে থাকে গাড়ি। অনেকেই যেমন বৃষ্টির কারণে কর্মস্থলেই আটকা পড়েন তেমনি অনেকের অপেক্ষার প্রহর কেটেছে জলমগ্ন সড়কে গাড়িতে বসেই।
এদিকে মিরপুরে সড়কের পাশে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও কয়েকজন। নিহতদের মধ্যে তিনজন একই পরিবারের। তাদের মধ্যে এক শিশু রয়েছে বলে জানিয়েছে মিরপুর মডেল থানার পুলিশ। গতকাল দিনভর মেঘলা আকাশ ও থেকে থেকে বৃষ্টির পর সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি বাড়তে শুরু করে। সঙ্গে থেমে থেমে শুরু হয় ঝড়ো হাওয়া। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ঢাকায় সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। গতকাল রাত সাড়ে ১২টার দিকে আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানান, এদিন সন্ধ্যার পর ঢাকা ছাড়াও রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে বৃষ্টি হয়েছে। আর ঢাকায় বৃষ্টি হতে পারে আজও।
গতকাল রাতের বৃষ্টিতে ঢাকার ফার্মগেট, ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, নিউ মার্কেট, মিরপুর, বনানী এলাকার সড়ক পানিতে ডুবে যায়। রাজধানীর প্রায় সব সড়কে দেখা দেয় তীব্র যানজট। দীর্ঘ সময় স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় যানবাহনকে। অনেকে জানান, তাদের ব্যক্তিগত গাড়িতে পানি ঢুকে গেছে। রাতে কখন তারা বাসায় ফিরতে পারবেন তা অনিশ্চিত।
জানা গেছে, মিরপুর ১০ নম্বরে প্রধান সড়কসহ অলিগলিতে কোমরসমান পানি জমেছে। পানি প্রধান সড়কে চলাচলরত প্রাইভেট গাড়ির ভেতরেও ঢুকে গেছে।
গ্রিন রোড, নর্থ ধানমন্ডিসহ আশপাশের সব গলিতে পানি জমেছে। সেখানকার গ্রিন লাইফ হাসপাতাল, সেন্ট্রাল হাসপাতাল এবং ল্যাবএইডে আসা রোগীরা পড়েছেন বিপদে। একই অবস্থা রাজধানীর মগবাজার, মালিবাগ, সিদ্ধেশ্বরী, বেইলি রোড এবং শান্তিনগরেও। মতিঝিলে রাতে লোক কম থাকলেও পানি হাঁটুর ওপরে উঠে গেছে।
হঠাৎ ভারী বৃষ্টির জন্য পথচারী ও ঘরমুখো মানুষরা মোটেও তৈরি ছিলেন না। এ সময় অনেকেই কাকভেজা হয়ে বাসায় ফেরেন আবার কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছেন যাত্রীছাউনি বা দোকানের নিচে। গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাংলা মোটর মোড়ে বাসে ৩০ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন ফাহাদ হোসাইন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, বৃষ্টি শুরু হলে একটি উঁচু ভবনের নিচে দাঁড়িয়েছিলাম। বৃষ্টি কিছুটা কমলে বাসে উঠি। আধা ঘণ্টা হলো বাস একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
সরকার সৌরভ নামের একজন জানান, তার মোহাম্মদপুর থেকে শাহবাগ আসতে ৩ ঘণ্টার বেশি লেগেছে। ফেরার পথে বাংলা মোটর মোড়েই আটকে আছেন এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে।
গতকাল রাত সাড়ে ১২টার সময়ও গুগল ম্যাপে দেখা যায় রাজধানী জুড়ে তীব্র যানজটের সংকেত। বেশিরভাগ সড়ক রেড মার্ক ছিল সে সময়। গ্রিন রোড, মিরপুর রোডের ধানমন্ডি ২৭, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউসহ বেশ কয়েকটি সড়কেই ছিল যান চলাচল বন্ধের সংকেত। গুগলের তথ্য বলছিল, ওইসব এলাকায় সে সময় যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
আহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আজ শুক্রবারও রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের বেশিরভাগ জায়গায় এবং ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হতে পারে। এ সময় বজ্রপাতও হতে পারে। সেই সঙ্গে রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
মিরপুরে চারজনের মৃত্যু : মিরপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও কয়েকজন। নিহতদের মধ্যে তিনজন একই পরিবারের। তাদের মধ্যে এক শিশু রয়েছে বলে জানিয়েছে মিরপুর মডেল থানার পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পরে আহতদের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
এ দুর্ঘটনার বিষয়টি দেশ রূপান্তরকে নিশ্চিত করেন মিরপুর থানার এসআই রুহুল আমিন। তিনি বলেন, বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন মিজান, তার স্ত্রী মুক্তা, তাদের মেয়ে লিমা এবং এই তিনজনকে বাঁচাতে যাওয়া যুবক অনিক। মৃত মিজান পেশায় সিএনজি অটোরিকশাচালক ছিলেন বলে জানা গেছে।
অভিষেকে ২৬ মিনিট খেলে দুই অ্যাসিস্টের অবদান রাখতে পেরেছিলেন নেইমার। আল হিলাল জিতেছিল। কিন্তু পর পর দুম্যাচ খেললেন পুরো সময়। তেমন কিছুই করতে পারলেন না। ড্র করেছে আল হিলাল আবার।
এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ম্যাচে শেষ দিকের গোলে ১-১ ড্র করে পরাজয় বাঁচিয়েছিল আল হিলাল। আজ সৌদি প্রো লিগে দামাক এফসির বিপক্ষে ম্যালকমের গোলে ৯ মিনিটে এগিয়ে গেলেও শেষপর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারেনি।
সাত ম্যাচে ১৭ পয়েন্ট নিয়ে তবুও শীর্ষেই রইলো আল হিলাল।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক যাত্রীর কাছ থেকে মূল্য দেড় কোটি টাকা মূল্যের ১৭০০ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করেছে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
আজ শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) সকাল ৭টা ২৪ মিনিটে শারজাহ থেকে এয়ার অ্যারাবিয়ার ফ্লাইটে আসা মোহাম্মদ আলী নামের এক যাত্রীর রাইস কুকারে এসব স্বর্ণ পাওয়া যায়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার মো. আহসান উল্লাহ বলেন, আটক ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ব্যাংকপাড়াখ্যাত মতিঝিল এখন মৃতপ্রায়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে না পারায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যত্র সরে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা ঘোরানো মতিঝিলে আবাসিক ভবন, শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান তৈরি না হলে দেশের প্রধান এই বাণিজ্যিক অঞ্চল প্রাণ হারাবে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তাদের মতে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বড় অবদান রয়েছে মতিঝিলের টাকার। শুধু তা-ই নয়, মতিঝিলে উপার্জিত অর্থে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে দুবাই, সিঙ্গাপুর, আমেরিকা, কানাডাসহ আরও অনেক দেশে। এখানকার উপার্জিত টাকা অনেকে জমা রেখেছেন সুইস ব্যাংকেও। শুধু উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি মতিঝিলে। এ যেন মা কাঁকড়ার আত্মত্যাগের গল্প। মা কাঁকড়া বাচ্চাদের আগলে রাখে বুকের ভেতর; যেদিন বাচ্চাগুলো বের হয়ে আসে, সেদিন খোলস ছাড়া মা কাঁকড়ার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। মা কাঁকড়ার মতো দুঃখী ও ত্যাগী বাণিজ্যিক মতিঝিল।
ষাটের দশকে মতিঝিলে গড়ে ওঠে দেশের কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল (সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট-সিবিডি)। সেই থেকে এখনো দেশের প্রধান বাণিজ্যিক অঞ্চল মতিঝিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১। এর মধ্যে সরকারি ৮টি, বেসরকারি ৪৫টি এবং বিদেশি ব্যাংক রয়েছে ৮টি। এ ছাড়া ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ৮১টি বীমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকের বেশির প্রধান কার্যালয় চলে গেছে কারওয়ান বাজার, গুলশান-বনানী ও উত্তরায়। নতুন করে যেসব ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পাচ্ছে, সেগুলোর প্রধান কার্যালয় মতিঝিলের বাইরে করা হচ্ছে।
জানা গেছে, মতিঝিলের আশপাশে পরিকল্পিত কোনো আবাসিক এলাকা, অভিজাত হোটেল, কাজের ফাঁকে অবসর কাটানোর মতো উন্মুক্ত স্থান, শপিং কমপ্লেক্স না থাকায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের সুবিধার জন্য অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয়গুলোও মতিঝিলের বাইরের এলাকা, অর্থাৎ কারওয়ান বাজার, গুলশান অ্যাভিনিউ, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে গড়ে উঠছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক বাংলা, শাপলা চত্বর, মধুমিতা সিনেমা হল এবং ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে এবং দিলকুশা, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ভবন এবং বঙ্গভবনের পাশের এলাকাজুড়ে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল। বিশ্বের বাণিজ্যিক অঞ্চলের ভবনগুলো সুউচ্চ হয়ে থাকে। কিন্তু মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের পাশেই বঙ্গভবন। নিরাপত্তার কারণে বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর কোনো বহুতল ভবন করতে দেওয়া হচ্ছে না। যদিও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, মতিঝিলের প্লটগুলোর ‘নন-রেসট্রিকটেড’ উচ্চতা দেওয়া রয়েছে। কিন্তু বঙ্গভবনের ৫০০ মিটার পরিধির ভেতর সাড়ে চারতলার বেশি উচ্চতার ভবনের অনুমোদন মেলে না। ফলে মূল্যবান ওই প্লটগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে পারছেন না মালিকরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগ জরাজীর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণও রয়েছে কয়েকটি ভবন। একটির সঙ্গে অন্যটি লাগানো। দুটি ভবনের মাঝখানে উন্মুক্ত জায়গা নেই বেশিরভাগ ভবনের। দিলকুশা এলাকার বঙ্গভবন লাগানো ভবনগুলোর মাঝখানেও কোনো ফাঁকা জায়গা দেখা যায় না।
সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, মতিঝিল এলাকার ফুটপাতগুলো হকারদের দখলে। ভাঙাচোরা এবড়োখেবড়ো সড়ক। সড়ক বিভাজকগুলো শ্রীহীন। এগুলোতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হয়নি। প্রধান সড়ক থেকে একটু ভেতরে গেলে মতিঝিলের আরও করুণ দশা চোখে পড়ে। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকার সড়কের ফুটপাতে গড়ে উঠেছে চটের ছালা দিয়ে ঘেরা খাবারের হোটেল, চায়ের দোকান এবং নানা পণ্যের অস্থায়ী দোকান। সামান্য বৃষ্টিতে মতিঝিল এলাকার সড়কগুলো তলিয়ে থাকে পানির নিচে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত। ডিএসসিসি এলাকার জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ চলছে। খসড়া মাস্টারপ্ল্যানে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে মূল্যায়ন করলে মতিঝিল ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। যদিও এটা মানতে নারাজ ডিএসসিসির কারিগরি কমিটি।
মতিঝিল এলাকার বেহাল অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. মোজাম্মেল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিল এলাকার সংস্কার ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে ডিএসসিসি। পরিত্যক্ত প্রায় ১০ কাঠা জায়গার ওপর একটি পার্ক তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মতিঝিলের সড়ক, নর্দমা, ফুটপাত ও সড়ক বিভাজকের অনেক সমস্যা রয়েছে। সেগুলোর সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা দরকার। পর্যায়ক্রমে এ এলাকার বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে কাজ করবে ডিএসসিসি। তবে মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চলের মূল সংস্কার ও আধুনিকায়নের দায়িত্ব রাজউকের। রাজউককে সেসব বিষয় পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কাজে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা লাগলে করপোরেশন সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
মতিঝিল বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে তোলে রাজউক। রাজউক সূত্রে জানা যায়, ষাটের দশক থেকেই মতিঝিলের পুরোপুরি বাণিজ্যিক বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। বিশে^র উন্নত দেশগুলোর বাণিজ্যিক অঞ্চলে শপিং মল, হোটেল, উন্মুক্ত স্থান থাকে। আর কাছাকাছি এলাকায় পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা থাকে। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে সেটা ছিল না। অভিজাত মানের হোটেল পূর্বাণী গড়ে উঠলেও আশপাশে সময় কাটানোর মতো ব্যবস্থা নেই। সে কারণে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দেশ-বিদেশ থেকে আসা লোকজন গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় থাকেন। মতিঝিলের সৌন্দর্য নিশ্চিত করতে ও আধুনিকায়নে যেসব বিষয়ে দৃষ্টি রাখা দরকার ছিল রাজউক ও সিটি করপোরেশন সেটা করেনি।
রাজউক সূত্রে আরও জানা যায়, ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধরা, উত্তরা। সেই সব এলাকা থেকে মানুষ মতিঝিলে আসেন। শহরের জনসংখ্যা বাড়ায় দিন দিন যানজট বাড়ছে। ওই সব এলাকা থেকে মতিঝিলে আসতে সড়কে এক থেকে দেড় ঘণ্টা চলে যায়। দৈনিক ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার মধ্যে ৩০ শতাংশ সময় সড়কে নষ্ট হচ্ছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে চিন্তা করেছে, তার কর্মস্থল এমন একটা জায়গায় হবে যা তার আবাসনের কাছাকাছি। মতিঝিল থেকে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়ও ভূমিকা রেখেছে।
কালের বিবর্তনে গুলশান হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক এলাকা। কারওয়ান বাজার, উত্তরায়ও গেছে কিছু। এসব জায়গায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক কার্যক্রমও সেখানে চলে গেছে। এসব এলাকার আশপাশে গুলশান-বনানী-বারিধারা এলাকায় তাদের বসবাস। আবাসিক এলাকা ছাড়া, পৃথিবীর কোথাও শতভাগ জায়গা শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা অথবা একই শ্রেণির কর্মকান্ডের জন্য ব্যবহার হয় না।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও মুখপাত্র মো. আশরাফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, নগর পরিকল্পনায় ভূমির ব্যবহার সম্পর্কে বলা হয়, যেকোনো জায়গার ব্যবহার হবে ২৪ ঘণ্টা। দেশের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল কর্মচঞ্চল থাকে মাত্র ১২ ঘণ্টা। এরপর ওই জায়গার ব্যবহার হয় না। রাতে নীরব ও ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়।
তিনি বলেন, যে মতিঝিলে দিনের বেলায় হাঁটা যায় না; গাড়ির কারণে, যানজটে; সেই মতিঝিলে রাত ৮টার পরে আবার একাও হাঁটা যায় না; অনিরাপদ বোধ হয়। এ জন্য যারা দিনে বাণিজ্য করতে আসেন, তারা মতিঝিল এলাকার হোটেলগুলোতে থাকেন না। অন্যদিকে গুলশান-বনানী এলাকায় থাকলে তারা শপিংয়ে যেতে পারেন, কফি শপে যেতে পারেন। এসব কারণে সারা বিশ্বে ভূমির মিশ্র ব্যবহারকে উৎসাহিত করেছে।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, মতিঝিল এলাকা যেহেতু ইতিমধ্যে তার আভিজাত্য হারিয়ে ফেলেছে, এ জন্য মতিঝিলের জমির শ্রেণিকে মিশ্র ব্যবহার হিসেবে ঢেলে সাজানোর প্রস্তুতি নিয়েছে রাজউক। সংশোধিত ড্যাপে সে বিষয়ে নির্দেশনা রাখা হয়েছে। পৃথিবীর নগর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ৫০, ৬০ বা ১০০ বছর অন্তর সেসব ঢেলে সাজানো হয়। সেটা বিবেচনায় নিয়েই মতিঝিল এলাকাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। এখানে আবাসিকের বৈশিষ্ট্য দিতে হবে; কনডোমিনিয়াম গড়ে তুলতে হবে। ইতিমধ্যে রাজউক বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে ১৬ একর জায়গা নিয়ে একটি পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে লাইব্রেরি, ওয়াকওয়ে থাকবে। বসার ব্যবস্থা থাকবে। মতিঝিল এলাকায় ঝিল ছিল, ওই ঝিলকে প্রাধান্য দিয়ে পার্কটি তৈরি করা হবে। বহুমুখী ব্যবহার ছাড়া মতিঝিলকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, মতিঝিলের আধুনিকায়ন ও ভূমির মিশ্র ব্যবহারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে। তাহলে মতিঝিল সচল থাকবে; তবে ঢাকা শহর বড় হওয়ায় আরও বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে ওঠা ইতিবাচক। এসব পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা দরকার ছিল; কিন্তু ঢাকার ক্ষেত্রে সে রকম হয়নি। এটা দুঃখজনক। এ জন্য শহরে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ঢাকায় এখন অনেকগুলো বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই সব অঞ্চলে ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত বড় বড় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় মতিঝিলে রয়েছে। তবে ব্যবসা গুলশান, বনানী, উত্তরা, গাজীপুরে সরে যাওয়ায় ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ব্যবসা কেন্দ্রের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে বা পারিবারিক পরিচয়ে রাজনীতির চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এ উপমহাদেশে। বাবার সূত্রে কিংবা দাদার সূত্রে রাজনীতিতে এসে অনেকে পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গেছেন। আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। রাজনীতিতে হয়েছেন বটবৃক্ষ। আবার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও উত্তরাধিকার সূত্রে পদ-পদবি পেয়ে যাওয়ার উদাহরণও আছে। যারা এভাবে রাজনীতিতে এসেছেন, তারা কার্যত বনসাই হয়ে আছেন।
দেশের সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব দলেই উত্তরাধিকারের চর্চা রয়েছে। পারিবারিক সূত্রে এমপি হওয়ার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান একাদশ সংসদে এ সংখ্যা ৯৮। স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহ জাগায় যে, আগামী দ্বাদশ সংসদে এ সংখ্যা কত হবে? যদিও বর্তমান সংসদের ৩৪টি উপনির্বাচনে উত্তরাধিকার সূত্রে এমপি হয়েছেন কমই।
রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের চর্চা যে খারাপ সেটা মোটেও বলা যাবে না। বরং উত্তরাধিকারের কারণে দেশের জন্য, জনগণের জন্য অবদান রাখা ঐতিহ্যবাহী দল আরও শক্তিশালী হওয়ার উজ্জ্বল উদাহরণও আছে। যেমন ভারতের রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধী। বাবা নেহরু গান্ধীর উত্তরসূরি হলেও নিজের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে কংগ্রেসের রাজনীতিকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছেন। তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরাধিকার হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। টানা তিনবারসহ চারবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে পঁচাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটেছে। আরও শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরেছে।
বিএনপির ক্ষেত্রেও বলা যায়, দলটির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটির হাল ধরেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তাদের ছেলে তারেক রহমান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সংসদের ৩০০ আসনে উত্তরসূরি হিসেবে বা পারিবারিক পরিচয়ে মনোনয়ন পাওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত ৫০ আসনেও এই চর্চা আছে। বরং হিসাব করলে বেশিই দেখা যায়।
সব মিলিয়ে একাদশ সংসদেই উত্তরসূরি বা পারিবারিক পরিচয়ে এমপি রয়েছেন শতাধিক। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫৭টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। পারিবারিক সূত্রে রাজনীতিতে আসা সরকারি দলের এমপির সংখ্যা ৮৬। এর মধ্যে প্রায় ৭০ জনই মাঠের রাজনীতি করে আসেননি। বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ২৯ জনের মধ্যে এই সংখ্যা ৭। এ ছাড়া সংসদে প্রতিনিধিত্ব করা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি।
একাদশ সংসদে বিএনপির সাতটি আসন ছিল। এর মধ্যে একটি সংরক্ষিত নারী আসন। তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা সংরক্ষিত আসনে এমপি হন। তার বাবা অলি আহাদ আওয়ামী লীগের প্রথম প্রচার সম্পাদক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বা সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলের প্রভাব ধরে রাখতে নেতার পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে আনা হয়। আবার অনেক সময় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
তবে উত্তরাধিকার চর্চার প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এমন চর্চার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। সংসদে দেখা যায়, অনেকে বক্তব্য দিতে পারেন না। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিও বোঝেন না। আবার জনসমাবেশে অরাজনৈতিক আচরণ করেন, যা সরকার বা দলকে বেকায়দায় ফেলে দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতন্ত্র ও আধুনিক রাজনীতির বিরোধী। দলের জন্য ও রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছরে এ ধারার রাজনীতির চর্চা বেশি হচ্ছে বলেই দুর্বল হয়েছে রাজনীতি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘রাজনৈতিক ত্যাগ-তিতিক্ষা বা যোগ্যতা থাকলে এটা গ্রহণ করা যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদে এত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা অবশ্যই দুশ্চিন্তার। আমি মনে করি, এ সংখ্যা নিয়ে প্রত্যেক দলেরই চিন্তার ব্যাপার আছে। কারণ দাদা, বাবার যোগ্যতায় এসব পদ পেয়ে থাকলে গণতন্ত্র কতটা মজবুত করবে, সেটাও ভাবতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রে উত্তরাধিকারের সুযোগ নেই। আবার এটাকে ধর্মগ্রন্থের বাণী মনে করলেও চলবে না। কারও যদি যোগ্যতা থেকে থাকে, তাহলে বাবা-দাদা থাকলে আসতে পারবেন না সেটাও তো হতে পারে না।’
আওয়ামী লীগের যারা : এমপি ও মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন পঞ্চগড় থেকে নির্বাচিত। তার বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম ১৯৭০, ’৭৩, ’৭৯ ও ’৮৬ সালের এমপি। দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুর রউফ চৌধুরী। তিনি ১৯৯৬ সালের এমপি ও দলের নেতা ছিলেন। ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা। এ ছাড়া তিনবার দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
দিনাজপুরের আরেকটি আসন থেকে নির্বাচিত ইকবালুর রহিমের বাবা প্রয়াত আবদুর রহিম। তিনি সত্তরের এমপি ছিলেন। তবে ইকবালুর রহিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দিনাজপুরের আরেকটি আসনের এমপি শিবলী সাদিক। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান ফিজুও এমপি ছিলেন।
রংপুর-২ আসনের আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরীর চাচা আনিসুল হক চৌধুরী এমপি ছিলেন। গাইবান্ধা-২ আসনের মাহাবুব আরা গিনি পারিবারিক বিবেচনায় এমপি হয়েছেন। বগুড়া-১ আসনের সাহাদারা মান্নান প্রয়াত এমপি আবদুল মান্নানের স্ত্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল ১৯৭৩ সালের এমপি প্রয়াত মইন উদ্দীন আহমদের ছেলে। নওগাঁ-৫ আসনের নিজাম উদ্দিন জলিলের (জন) বাবা প্রয়াত আবদুল জলিল ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী। সিরাজগঞ্জ-১ আসনের তানভীর শাকিল জয় প্রয়াত মন্ত্রী ও নেতা মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে। তার দাদা জাতীয় চার নেতার অন্যতম মনসুর আলী। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মেয়ের জামাই। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের তানভীর ইমাম প্রয়াত নেতা এইচ টি ইমামের ছেলে। সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের মেরিনা জাহান দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য প্রয়াত মযহারুল ইসলামের মেয়ে। তার ভাই চয়ন ইসলামও এমপি ছিলেন। পাবনা-২ আসনের আহমেদ ফিরোজ কবির প্রয়াত আহমেদ তফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি ১৯৭৩ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। মেহেরপুর-১ আসনের ফরহাদ হোসেনের বাবা প্রয়াত মোহাম্মদ সহিউদ্দিন ছিলেন ১৯৭০, ’৭৩ ও ’৮৬ সালের এমপি। কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের দাদা গোলাম কিবরিয়া ছিলেন এমপি। ঝিনাইদহ-২ আসনের তাহজীব আলম সিদ্দিকীর বাবা প্রয়াত নুরে আলম সিদ্দিকী ছিলেন দলের নেতা। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এমপি শফিকুল আজম খান। তার বাবা প্রয়াত শামসুল হুদা জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। যশোর-৫ আসনের স্বপন ভট্টাচার্যের ভাই পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য দলের নেতা। অবশ্য রাজনীতিতে স্বপনেরও অবদান রয়েছে। রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বাবা প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর। তার বাবা মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান তিনবারের এমপি ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ হেলালের ছেলে শেখ ফারহান নাসের তন্ময় বাগেরহাট-২ আসনের এমপি। বাগেরহাট-৩ আসনের হাবিবুন নাহার খুলনার মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের স্ত্রী। খুলনা-২ আসনের শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল শেখ নাসেরের ছেলে। খুলনা-৩ আসনের মন্নুজান সুফিয়ানের স্বামী আবু সুফিয়ান এ আসনের এমপি ছিলেন। তিনি নিজেও অবশ্য রাজনীতি করেছেন। ভোলা-২ আসনের আলী আজম মুকুল দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের ভাতিজা। ভোলা-৪ আসনের আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের বাবা প্রয়াত এমএম নজরুল ইসলাম ১৯৭৯ ও ’৯১ সালের এমপি। টাঙ্গাইল-৬ আসনের আহসানুল ইসলাম সাবেক এমপি হাজি মকবুল আহমেদের ছেলে। টাঙ্গাইলের আরেক আসনের এমপি খান আহমেদ শুভ দলের জেলা সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকের ছেলে। ফারুক ১৯৭৩ সালে এমপি ছিলেন। ময়মনসিংহ-১ আসনের জুয়েল আরেং সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের ছেলে। ময়মনসিংহ-২ আসনের শরীফ আহমেদের বাবা শামসুল হক চারবারের এমপি। ময়মনসিংহ-১০ আসনের ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের বাবা প্রয়াত এমপি আলতাফ হোসেন গোলন্দাজ। নেত্রকোনার এমপি সাজ্জাদ হাসানের বাবা প্রয়াত আখলাকুল হোসাইন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সৈয়দা জাকিয়া নূর চার জাতীয় নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের মেয়ে ও দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন। কিশোরগঞ্জের আরেক এমপি রেজওয়ান আহম্মেদ তৌফিক সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে। অন্য এমপি নাজমুল হাসান পাপনের বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুুর রহমান। তার মা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আইভি রহমান। মানিকগঞ্জের নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বাবা প্রয়াত সায়েদুর রহমান এমপি ছিলেন। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত নসরুল হামিদের বাবা হামিদুর রহমান দলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। মা হাসনা হামিদও রাজনীতি করতেন। গাজীপুরের জাহিদ আহসান রাসেল প্রয়াত নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। সিমিন হোসেন রিমি প্রয়াত জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে। মেহের আফরোজ চুমকির বাবা প্রয়াত ময়েজউদ্দিন ১৯৭০ ও ’৭৩ সালের এমপি। কাজী কেরামত আলীর বাবা কাজী হেদায়েত হোসেন গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। মুজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) বাবা ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মীয়। তার আরেক ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরীও এমপি। ফরিদপুর-৩ আসনের ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন আত্মীয় পরিচয়ে এমপি হন। ফরিদপুরের আরেকটি আসনের এমপি শাহদাব আকবরের মা প্রয়াত এমপি দলের নেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। নাহিম রাজ্জাকের বাবা প্রয়াত নেতা ও এমপি আবদুর রাজ্জাক। জয়া সেনগুপ্তা প্রয়াত এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী। এ কে আবদুল মোমেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভাই। গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের (মিলাদ গাজী) বাবা প্রয়াত এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী। মাহবুব আলীর বাবা আছাদ আলী প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। আনিসুল হকের বাবা প্রয়াত সিরাজুল হক ১৯৭০ সালের এমপি ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা। রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বাবা এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সী ছিলেন জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের এমপি। দীপু মনির বাবা প্রয়াত এমএ ওয়াদুদ ছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আয়েশা ফেরদাউসের স্বামী প্রয়াত এমপি মোহাম্মদ আলী। মাহফুজুর রহমানের বাবা মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের এমপি ছিলেন। এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর বাবা প্রয়াত ফজলুল কবির চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। মহিবুল হাসান চৌধুরীর বাবা চট্টগ্রামের প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বাবা প্রয়াত এমপি আখতারুজ্জামান চৌধুরী। সাইমুম সরওয়ার কমলের বাবা প্রয়াত ওসমান সরওয়ার চৌধুরী ছিলেন ১৯৭৩ সালের এমপি। শাহিনা আক্তার চৌধুরীর স্বামী সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। শিরীন আহমেদের স্বামী প্রয়াত বজলুর রহমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। নাহিদ ইজাহার খানের বাবা খন্দকার নাজমুল হুদা পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর নিহত সেনা কর্মকর্তা। খাদিজাতুল আনোয়ারের বাবা প্রয়াত এমপি রফিকুল আনোয়ার। ওয়াসিকা আয়শা খানের বাবা প্রয়াত আতাউর রহমান খান কায়সার দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন। কানিজ ফাতেমা আহমেদের স্বামী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী আওয়ামী লীগ নেতা। আঞ্জুম সুলতানা সীমার বাবা কুমিল্লার প্রয়াত নেতা আফজল খান। উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগমের (শিউলী আজাদ) স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল আজাদ। রুমানা আলীর বাবা প্রয়াত এমপি রহমত আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন সংগ্রাম। তার মামা খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক পরিচয়ে এমপি হলেও সংগ্রাম এমপি হওয়ার আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সুলতানা নাদিরার স্বামী প্রয়াত নেতা গোলাম সবুর টুলু। হাবিবা রহমান খান শেফালীর বাবা প্রয়াত ফজলুর রহমান খান তিনবারের এমপি ছিলেন। জাকিয়া পারভীন খানমের বাবা সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান খান চুন্নু মিয়া। তার স্বামী আওয়ামী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। অপরাজিতা হকের বাবা প্রয়াত খন্দকার আসাদুজ্জামান ছিলেন তিনবারের এমপি। তামান্না নুসরাত বুবলীর স্বামী প্রয়াত লোকমান হোসেন ছিলেন নরসিংদীর মেয়র। জাকিয়া তাবাসসুমের বাবা প্রয়াত আজিজুর রহমান দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ফরিদা খানম নারী মুক্তিযোদ্ধা। তার স্বামী নোয়াখালী জেলা মুজিব বাহিনী প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েত। রাজবাড়ীর সালমা চৌধুরীর বাবা প্রয়াত আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী ছিলেন এমপি। সৈয়দা রাশিদা বেগমের স্বামী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সৈয়দ নিজাম উদ্দিন লাইট। ফেরদৌসী ইসলাম জেসীর বাবা প্রয়াত ভাষাসৈনিক ও সংসদ সদস্য আ আ ম মেসবাহুল হক বাচ্চু। পারভীন হক সিকদারের বাবা প্রয়াত ব্যবসায়ী জয়নুল হক সিকদার। জামালপুরের আবুল কালাম আজাদ শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ভায়রা। এ ছাড়া শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দীন, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও শামীম ওসমানের পারিবারিক পরিচয় থাকলেও তারা এখন প্রত্যেকে রাজনীতিতে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় পার্টি : বিরোধী দলনেতা রওশন এরশাদ প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্ত্রী। তাদের ছেলে সাদ এরশাদও এমপি। আহসান আদেলুর রহমান প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাগ্নে। জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরও এমপি। নীলফামারী-৪ আসনে আদেলুর রহমান আদেল, তার বাবা ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি ছিলেন। নাসরীন জাহান রত্না দলের কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
অন্যান্য : ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন নেসা খান সংরক্ষিত নারীর আসনে এমপি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু নিজে ও তার স্ত্রী বেগম আফরোজা হকও এমপি। মাহী বি চৌধুরীর বাবা সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সেলিনা ইসলামের স্বামী পদচ্যুত এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল।
সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ৫টি রোডমার্চসহ টানা ১৫ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তবে মাঝে তিন দিন ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর কোনো কর্মসূচি নেই। বিএনপির নতুন ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সমাবেশ, রোডমার্চ ও দোয়া মাহফিল।
গতকাল সোমবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আমাদের অনেক রাজনৈতিক জোট ও দল যুগপৎ আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে আমরা কতগুলো কর্মসূচি হাতে নিয়েছি।
কর্মসূচি ঘোষণার সময় অসুস্থতার কারণে মহাসচিবের অনুরোধে সেটি পড়ে শোনান স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
পাঁচটি রোডমার্চ : ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব থেকে সিলেট (সিলেট বিভাগ), ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল থেকে পটুয়াখালী (বরিশাল বিভাগ), ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ থেকে কিশোরগঞ্জ (ময়মনসিংহ বিভাগ) এবং ৩ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম (কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম বিভাগ) রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকায় হবে সমাবেশ : ১৯ সেপ্টেম্বর জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের টঙ্গী; ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা; ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার, আমিনবাজার; ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ, ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমজীবী সমাবেশ এবং ২ অক্টোবর কৃষক সমাবেশ হবে। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
তবে ২০, ২৪ ও ২৮ সেপ্টেম্বর বিএনপির কোনো কর্মসূচি না থাকলেও যুগপৎ আন্দোলনের অংশীজনদের কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের যুগপৎ আন্দোলনে যে জোট ও দলগুলো আছে, তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থান থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে। তারা হয়তো সবগুলো করবে না।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক সমাবেশ-পদযাত্রার কর্মসূচি গণতন্ত্র মঞ্চের : এদিকে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের দারুস সালাম ভবনে ভাসানী অনুসারী পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করে গণতন্ত্র মঞ্চ। নতুন এই কর্মসূচি হচ্ছে ১৯ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারে পেট্রোবাংলার সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা; ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা এবং ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও পদযাত্রা।
সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম জোটের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কর্মসূচির বাইরে জোটের নিজস্ব কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে সেমিনার ও আলোচনা সভাও হবে। সেসবের তারিখ-স্থানসহ বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম।
গণফোরাম ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির কর্মসূচি: ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা জিঞ্জিরা/কেরানীগঞ্জ এবং গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে, ২১ সেপ্টেম্বর ভৈরব-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজার-সিলেট রোডমার্চ, ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পেশাজীবী সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় সমাবেশ, ২৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর-পটুয়াখালী রোডমার্চ, ২৫ সেপ্টেম্বর নয়াবাজার ও ঢাকা জেলার আমিনবাজারে সমাবেশ, ২৬ সেপ্টেম্বর খুলনা বিভাগ রোডমার্চ, ২৭ সেপ্টেম্বর গাবতলী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লায় জনসমাবেশ, ঢাকায় ২৯ সেপ্টেম্বর মহিলা সমাবেশ ও ৩০ সেপ্টেম্বর কৃষক-শ্রমিক সমাবেশ, ১ অক্টোবর ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রোডমার্চ, ৩ অক্টোবর কুমিল্লা-ফেনী-মিরসরাই-চট্টগ্রাম রোডমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া আইনজীবীদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং আন্দোলনরত সব দল সমর্থন জানাবে বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় দলটি।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪০-৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির অঙ্ক কষছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করছে, সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৪০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রমুখী করতে পারলে নির্বাচন বিতর্ক সামাল দিতে কোনো বেগ পেতে হবে না।
আগামী নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেওয়া নানা পরিকল্পনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হলো ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। এ ছাড়া জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে নির্বাচন নিয়ে জনমত আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর আওয়ামী লীগ এ তিন পরিকল্পনাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান।
চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। এর আগে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল সফর করে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর আওয়ামী লীগে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বলে দাবি করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।
তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিগত দুই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে দেশ-বিদেশে বেশ বিপাকে ফেলেছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না সরকারি দল। সেজন্য আগে থেকেই আটঘাট বেঁধে নামতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না ধরেই কমপক্ষে ৪০ ভাগ ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে এ সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে কেন্দ্রে এলে ভোটের পরে ভোট প্রশ্নবিদ্ধ করার যে চক্রান্ত বিএনপির রয়েছে, সেটি ব্যর্থ হয়ে যাবে। এমন লক্ষ্য নির্ধারণ করার অন্যতম কারণ হলো এটি।
সরকারের ওপর অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের চাপ রয়েছে বিদেশিদের। গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন থেকে ফেরার পর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জনগণ ভোট দিতে পারলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ৫০-৪০ শতাংশ ভোট কাস্টিং করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ। তা সম্ভব হলেই ভোট বিতর্ক এড়ানো যাবে। ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনের পরে সব নির্বাচনেই ভোটার উপস্থিতি হতাশাজনক ছিল। এ বিষয়টি নিয়ে নানা সমালোচনা ও প্রশ্ন উঠেছে। কোনো কোনো ফোরামে আলোচনায় সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে কম ভোটার উপস্থিতির উদাহরণ। তাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির লক্ষ্য নির্ধারণ করে নির্বাচন প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
দলের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে আসবে না এটা ধরে নিয়েই তিন পরিকল্পনায় সফল হতে পারবেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষে আওয়ামী লীগ মনে করে নির্বাচন পর্যন্ত জনআকাক্সক্ষা পূরণ ও দ্রব্যমূল্য বেঁধে রাখা পারলেই নির্বাচন পর্যন্ত আর সমস্যাগুলো বড় বাধা হয়ে আসবে না সরকারের সামনে। বাকিটা হলো ভোটের দিন লক্ষ্য অনুযায়ী ভোটার উপস্থিতি ঘটানো।
ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা আরও বলেন, ভোটার উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তেমন আধুনিক উদ্যোগ নেই। কম ভোট উপস্থিতির এটিও একটি কারণ। প্রত্যেক ভোটারকে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসতে হবে এমনকি পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, সেটি ইসিকে ভাবতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও কেন্দ্রে ভোটার আনতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করেন না। এ নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করতে কী কী উপায় নেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, স্বল্প সময়ে যে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা যায়, সেগুলো আগামী নির্বাচনে করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের কর্মব্যস্ততা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কর্মব্যস্ত জীবনে সময় পেলে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার চেয়ে পরিবারকে একটু সময় দেওয়াকে বেশি গুরুত্বের মনে করেন ভোটাররা।’ ভোট দেওয়ার প্রবণতা পৃথিবীর অনেক দেশেই কমেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি দল নির্বাচনে না যাওয়ায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে মনে করে না ভোটাররা। ফলে নির্বাচন বর্জন করা দলের ভোটাররা কেন্দ্রে যান না এবং দলের প্রার্থী বিজয়ী হবেন এ ভেবে আওয়ামী লীগের ভোটাররাও যান না। গত নির্বাচনগুলোতে ভোট কম পড়ার বড় কারণ এগুলো। তবে আগামী নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন তারা। জাফরউল্যাহ আরও বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেড়ে যাবে।’
আওয়ামী লীগের হিসাবে মোট ভোটারের প্রায় ৩৫ শতাংশই তাদের ভোটার। এবার দলীয় ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটি।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভোটার কেন্দ্রে আনার উদ্যোগ সফল হলে ভোট নিয়ে সব প্রশ্নই দূর করতে পারবে আওয়ামী লীগ। ২০১৪ ও ’১৮ সালের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যে কম ভোটার উপস্থিতিও অন্যতম। তারা চান না এবার সেই প্রশ্ন উঠুক।
আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছোট ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে সরকার বড় বড় কাজ করছে ঠিকই, ছোট কিছু জনআকাক্সক্ষা পূরণ করা সম্ভব হয়নি বলে সাধারণ জনগণের একটি অংশ সরকারের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছে না, এমনটাই মনে করছেন তারা। তাই ভোটের আগে বাকি সময়ে ছোট বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তা পূরণ করা হলে সাধারণ জনগণের ওই অংশটি আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা রাখবে বলে তারা বিশ্বাস করেন।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা বলেন, নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে বাড়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সব শ্রেণির মানুষকে। সংসার জীবনের কশাঘাতে পড়ে সরকারের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ওই শ্রেণির মানুষের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। সংসার সামলাতে যে বিষয়গুলো বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সেগুলোকে নির্বাচন পর্যন্ত কড়া মনিটরিংয়ে রেখে সামাল দেওয়া সম্ভব হলে মধ্যবিত্ত/নিম্নবিত্ত অংশের আস্থা অর্জন করতে পারবে বলে তারা মনে করছেন। আর আস্থা অর্জন করতে পারলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে তাদের বিশ্বাস।
জনআকাক্সক্ষা পূরণের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে বারবার একই চেহারা দেখছেন এলাকার মানুষ। অন্যদিকে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে প্রতিবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন নির্বাচিত ওই জনপ্রতিনিধি। তাতে মানুষ বিরক্ত হন। এলাকার ভোটাররা মনে করেন, একজনকে কতবার ভোট দেব? এটি হলো জনআকাক্সক্ষা। এ জায়গায় নতুন মুখ নিয়ে আসা সম্ভব হলে মানুষের মধ্যে নতুন করে আশা জাগবে। রাজনীতিতে সক্রিয় নন, এমন লোকজনও আগ্রহী হবেন। নতুন প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে ভোটাররা আসবেন।
এদিকে সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপি বিপাকে পড়েছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খুব ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়ে যাবে এ বিষয়টি বিএনপির কাছেও পরিষ্কার হয়ে গেছে। নির্বাচন সময়মতো হয়ে যাবে এটা এখন বিএনপিও বিশ্বাস করে। দলটি ভাবছে, আন্দোলন জমছে না, নির্বাচনও ঠেকানো যাবে না। আর সেটাই তাদের বিপাকের কারণ।’
রুবেলা বা জার্মান মিজেলস একটি সংক্রামক রোগ। এটি রুবেলাভাইরাস থেকে হয়ে থাকে। একে জার্মান হাম বা তিন দিনের হামও বলা হয়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। করোনা ভাইরাসের মতই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি থেকেই এই রোগ ছড়ায়। গর্ভাবস্থায় এই রোগ গর্ভস্থ শিশুর নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
রুবেলা সাধারণত ভাইরাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির ড্রপলেটসের মাধ্যমে বাতাসে ছড়ায় এবং পরবর্তীতে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে আরেকজনকে আক্রান্ত করে। এ ছাড়া গর্ভবতী মা থেকে গর্ভস্থ সন্তানের রুবেলাভাইরাস হতে পারে।
তবে একবার এই রোগটি হয়ে গেলে সাধারণত স্থায়ীভাবে আর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
রুবেলার লক্ষণ বোঝা করা কঠিন, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। কারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাসটি রোগীর দেহে সাত থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
এই রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ সাধারণত ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত ১ থেকে ৫ দিন স্থায়ী হয়।
হালকা জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৮.৯ C) বা তার কম
মাথাব্যথা
নাকে সর্দি বা বন্ধ নাক।
চোখ লাল হয়ে যাওয়া ও চুলকানি হওয়া।
মাথা ও ঘাড়ের পেছনের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা হওয়া, কানের পিছনের লিম্ফ নড পিণ্ডর মতো ফুলে যাওয়া
লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি যা মুখে শুরু হয় এবং দ্রুত ঘাড়, শরীর, বাহু ও পায়ে ছড়িয়ে পড়ে
জয়েন্টগুলোতে ব্যথা, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে
হাঁচি-কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া
শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা
ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা
রুবেলাভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। এটি সাধারণত চিকিৎসা ছাড়াই ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
এমনকি গর্ভবতী নারী আক্রান্ত হলে মা বা শিশুর ও কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে গর্ভবতী নারী রুবেলা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এলে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া যেতে পারে। তাই রুবেলাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি।
তবে একবার আক্রান্ত হলে সে সময় যা যা করতে হবে,
১. যেহেতু রোগটি অনেক ছোঁয়াচে তাই আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে।
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে এবং আক্রান্ত হলে কঠোর পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো
৩. সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে হবে
৪. ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যুক্ত ফলমূল খেতে হবে বেশি করে।
৫. প্রতিদিন গোসল করাতে হবে, শরীরে জ্বর থাকলে ভেজা কাপড় একটু পর পর শরীর মুছতে হবে।
৬. কোনও ওষুধ খাওয়ানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
কেউ যদি গর্ভাবস্থায় রুবেলায় আক্রান্ত হন তবে রুবেলা অনাগত শিশুর ক্ষতি করার পাশাপাশি গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিশুর জন্মের পরে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
হার্টের ত্রুটি
ছানি
বধিরতা
বিলম্বিত শেখা
লিভার এবং প্লীহার ক্ষতি
ডায়াবেটিস
থাইরয়েড সমস্যা
রুবেলার সুনির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা না থাকায় টিকা হলো উত্তম প্রতিষেধক। এই রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল হাম-মাম্পস-রুবেলা (এমএমআর) টিকার দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ। সব বয়সেই এই টিকা নেয়া যায়।
টিকার প্রথম ডোজটি সাধারণত শিশুর নয় থেকে ১৫ মাসের মধ্যে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয় শিশুর সাড়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা এই টিকা নিতে পারেন। সাধারণত প্রথম ডোজ নেয়ার কমপক্ষে এক মাস থেকে তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেয়া হয়।
কিশোরীদের ১৫ বছর বয়সে টিটি টিকার সঙ্গে এক ডোজ হাম-রুবেলা টিকা দিতে হয়। এ ছাড়া গর্ভধারণে ইচ্ছুক নারীদের রুবেলা অ্যান্টিবডি টেস্ট করে প্রয়োজন হলে ৩ মাস ব্যবধানে ২ ডোজ টিকা দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা পরবর্তী এক মাসের মধ্যে সন্তান নিতে নিষেধ করা হয়।
১. অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। কেউ হাঁচি-কাশি দিলে তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে।
২. হাত সবসময় সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হবে।
৩. নাকে, চোখে, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. কাশি বা হাঁচি আসলে সে সময় টিস্যু ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যবহৃত টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে।
৫. যাদের শরীরে ফুসকুড়ি বা র্যাশ জাতীয় আছে তাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে।
৬. অতিরিক্ত ভীর বা জনসমাগম এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।