
ধার পেতে মানুষ আগে বন্ধু, সহকর্মী বা আত্মীয়স্বজনের ওপর নির্ভর করত। এসব ধারকর্জ পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির সাধ্য বা ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল ছিল। বন্ধু, সহকর্মী বা আত্মীয় থেকে যদিও টাকা পেত তাহলেই মিটত প্রয়োজন। কিন্তু দেশে প্রযুক্তির বিকাশের ফলে এখন তাৎক্ষণিক টাকার চাহিদা মেটাচ্ছে ক্রেডিট কার্ড। এই কার্ডে ব্যাংকের বুথ থেকে নগদ টাকা তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পণ্যের কেনাকাটা ও সেবার মূল্য পরিশোধ করা যাচ্ছে। আর কোনো সুদ ছাড়া টাকা পরিশোধে ৪৫ দিন পর্যন্ত সময় মিলছে। এসব কারণে দেশে দিনে দিনে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে লেনদেনও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত মার্চ মাসে দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। এই মাসে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। এর আগে ২০২২ সালের এপ্রিলে দেশের ইতিহাসে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছিল। ওই মাসে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা। দেশে দিন দিন ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যাও বাড়ছে। গত মার্চে ক্রেডিট কার্ড বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ লাখ ৭৮ হাজারটি। গত ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ২১ লাখ ১৫ হাজার ৮৪১টি। অর্থাৎ ৩ মাসের ব্যবধানে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা বেড়েছে ৬২ হাজার ২০৫টি।
ব্যাংকাররা বলছেন, কার্ডভিত্তিক লেনদেনে গ্রাহক আকৃষ্ট করতে বছরজুড়ে নানা প্রচার চালায় অনেক ব্যাংক। ঈদ বা অন্য উৎসবকে কেন্দ্র করে বাড়তি আকর্ষণের জন্য কেনাকাটার বিল পরিশোধে মূল্যছাড় বা ক্যাশব্যাক অফার দেওয়া হয়। তবে শুধু শুধু অফার বা প্রচারের কারণে নয়, ব্যাংকের সেবার ধরন এবং সুবিধা বিবেচনায় নিজের পছন্দের ব্যাংক বেছে নেন গ্রাহক।
গত এক বছরে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা ২ লাখ ৮৩ হাজার বা ১৫ দশমিক ৪১ শতাংশ বেড়ে ২১ লাখ ১৬ হাজারে ঠেকেছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত শীর্ষ ১০ ব্যাংকে রয়েছে ১৪ লাখ ৪২ হাজার কার্ড। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে সিটি ব্যাংক, যাদের ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা হচ্ছে ৩ লাখ ২০ হাজার, যা মোট কার্ডের ১৭ শতাংশ। গত ডিসেম্বর মাসে সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন হয়েছে ২৭১ কোটি টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্র্যাক ব্যাংকের ২ লাখ ৩৬ হাজার কার্ডের বিপরীতে লেনদেন ছিল ২৭০ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে থাকা প্রাইম ব্যাংকের ১ লাখ ৬৭ হাজার কার্ডের বিপরীতে লেনদেন হয়েছে ৪৭ কোটি টাকা। চতুর্থ অবস্থানে থাকা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের এক লাখ ২৮ হাজার ৪৬টি কার্ড রয়েছে। মাত্র ৭ শতাংশ কার্ড নিয়ে এই ব্যাংকটি লেনদেন করেছে ২৫৩ কোটি টাকা। আর পঞ্চম অবস্থানে থাকা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের পরিমাণ এক লাখ ১৮ হাজার ৫৭৮টি। এই ব্যাংকটি লেনদেন করেছে ৯২ কোটি টাকা।
এছাড়া পর্যায়ক্রমে ইস্টার্ন ব্যাংকের এক লাখ ১৮ হাজার কার্ডে লেনদেন ২০৩ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এক লাখ চার হাজারের বেশি কার্ড নিয়ে লেনদেন ৩৩৭ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৮৮ হাজার ৩৩৫টি কার্ডে লেনদেন প্রায় ১০ কোটি, সাউথইস্টের ৮৪ হাজার কার্ডে লেনদেন ৪৩ কোটি এবং ব্যাংক এশিয়ার ৭৬ হাজার ৫০২টি কার্ড দিয়ে লেনদেন হয়েছে ৯৯ কোটি টাকা।
দেশে ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করা প্রায় অধিকাংশ ব্যাংকেরই রয়েছে ভিসা ও মাস্টারকার্ড ব্র্যান্ডের কার্ড সেবা। তবে এর বাইরে কয়েকটি ব্যাংক কার্ড সেবায় নতুনত্ব আনতে অন্য ব্র্যান্ডের কার্ডও নিয়ে এসেছে। যেমন, সিটি ব্যাংক অ্যামেক্স, প্রাইম ব্যাংক জেবিসি, ইস্টার্ন ব্যাংকের ডিনার্স ক্লাব, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক নেক্সাস পে ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ইউনিয়ন পে ইন্টারন্যাশনাল কার্ড সেবা দিচ্ছে।
দেশের ১৬ বছরের ঊর্ধ্বের যেকোনো নাগরিক ক্রেডিট কার্ড সেবা নিতে পারেন। তবে তার নির্দিষ্ট আয়ের ব্যবস্থা থাকতে হয়। পরিবারের অন্য কেউ উপার্জনক্ষম হলেও তার বিপরীতে কার্ড দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। আর এ কার্ডের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নেওয়া যায়। কার্ডের ব্যবহার সহজ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি সংযুক্ত করা হচ্ছে।
বিশ্বের সব উন্নত দেশে ক্রেডিট কার্ড এখন বহুল প্রচলিত একটি আর্থিক পণ্য। নগদ টাকার বিকল্প হয়ে ওঠায় এটাকে প্লাস্টিক মানিও বলা হয়ে থাকে। প্রতি দেড় মাস পর নির্দিষ্ট দিনে খরচের টাকা পরিশোধ করলে কোনো সুদ দিতে হয় না। সেজন্য পৃথিবীজুড়ে দিন দিন ক্রেডিট কার্ড বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় নগদ টাকার লেনদেন কমে আসছে। কমছে টাকা বহনের ঝুঁকিও।
বিশ্বের ১২১টি দেশের জনসংখ্যা ও ক্রেডিট কার্ডের তথ্য পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে র্যাংকিং তৈরি করেছে বৈশ্বিক অর্থনীতির তথ্য-উপাত্ত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘স্ট্যাটিস্টা’। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের দিক থেকে সবার শীর্ষে কানাডা। দেশটির প্রাপ্তবয়স্কদের ৮২ দশমিক ৭৪ শতাংশের ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। এ তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকা অন্য দেশগুলোর মধ্যে জাপানের ৬৯ দশমিক ৬৬, সুইজারল্যান্ডের ৬৯ দশমিক ২১, দক্ষিণ কোরিয়ার ৬৮ দশমিক ৪৪, যুক্তরাষ্ট্রের ৬৬ দশমিক ৭ ও যুক্তরাজ্যের ৬৬ দশমিক ১১ শতাংশ মানুষ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে। ১২১টি দেশের মধ্যে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৫তম। বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মাত্র শূন্য দশমিক ৬২ শতাংশের ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও প্রাপ্তবয়স্কদের ৪ দশমিক ৬২ শতাংশের ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। এমনকি নেপালেরও এক দশমিক ৮৭ শতাংশ মানুষ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে নেপালের অবস্থান ১০৩তম।
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন সুলতান মাহমুদ। ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে ধানমন্ডি এলাকায় ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন এ শিক্ষক। এখনো সেই ফ্ল্যাটের ঋণ পুরোপুরি পরিশোধ হয়নি। সুলতানের ব্যবহৃত ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা দুটি। একটি বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংক আর অন্যটি প্রাইম ব্যাংকের।
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধা জানতে চাইলেন তিনি জানান, ফ্ল্যাটের কিস্তি পরিশোধ, সন্তানদের বেতন আর ফ্যামিলি খরচ পরিশোধ সব মিলিয়ে প্রায় প্রতি মাসের শেষেই আর্থিক সংকট তৈরি হয়। এ সংকট থেকে বাঁচতেই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। তবে মাসের শুরুতে বেতন পেয়েই পরিশোধ করে দিচ্ছেন ক্রেডিট কার্ডের বিল। এতে অতিরিক্ত সুদও গুনতে হচ্ছে না তাকে।
সুলতান মাহমুদ বলেন, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার না করলে হয়তো প্রতি মাসেই আমার বিভিন্নজনের কাছ থেকে ধার করে চলতে হতো। এতে সম্মানহানিরও ঝুঁকি থাকে। কিন্তু এখন ব্যাংক থেকে স্বল্প সময়ের জন্য ধার নিয়ে তা আবার ফেরত দিচ্ছি। এতে কারও কাছে হাত পাততে হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, একসময় মানুষ ক্রেডিট কার্ডের প্রতি কম আগ্রহী হলেও বর্তমানে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে দেশের ৩৯টি ব্যাংক কার্ড সেবা দিচ্ছে। গত মার্চ শেষে এসব ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ লাখ ৭৮ হাজারটি। ঠিক চার বছর আগে ২০১৯ সালে মার্চ শেষে এ কার্ডের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৪৯ হাজারটি। অর্থাৎ মাত্র চার বছরের ক্রেডিট কার্ড বেড়েছে ৮ লাখ ২৮ হাজার বা ৬১ দশমিক ৪২ শতাংশ। এই একই সময়ে লেনদেনের পরিমাণও বেড়েছে। গত মার্চে ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের মার্চে এ লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ চার বছরের ব্যবধানে লেনদেন বেড়েছে ১৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
শুধু সুলতানই নন, ব্যবসায়ী আমিরুল, সাংবাদিক আক্তার আর চাকরিজীবী তারিকুলও একই কারণে ব্যবহার করছেন দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ক্রেডিট কার্ড। তাদের মতে, ক্রেডিট কার্ডের কারণে সহজ হয়েছে তাদের জীবনযাত্রা। তবে উল্টো চিত্রও আছে। করোনা মহামারীর সময় চাকরি হারানো আজাদুল ইসলাম ক্রেডিট কার্ডে ধার নিয়ে এখন বিপাকে রয়েছেন। তিনি বলেন, করোনার সময় প্রথম দিকে আমাদের বেতন কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়। সে সময় সংসারের খরচ বহন করতে ক্রেডিট কার্ডের সহায়তা নিয়েছেন। যে ঋণ এখন পর্যন্ত টানতে হচ্ছে তাকে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ হবে বলে আশাবাদী এ গ্রাহক।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক্রেডিট কার্ড জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে এর ‘ধার’ নেওয়ার পদ্ধতির জন্য। পাশাপাশি পণ্যের দামে ডিসকাউন্টের পাশাপাশি কিস্তিতে পরিশোধের পদ্ধতিও এ ব্যাপ্তি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে। যেটি গ্রাহককে এককালীন বেশি দামের পণ্য কিনতে সহায়তা করে। এবার জেনে নেওয়া যাক ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা-অসুবিধাগুলো।
পণ্য কিনতে কিস্তি সুবিধা : ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কিস্তিতে পণ্য কিনতে একসঙ্গে সব টাকা পরিশোধ করতে হবে না। বিনা সুদে বা নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদে গ্রাহক কয়েক মাসের সমান কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করতে পারবেন। যদিও গ্রাহক তার ক্রেডিট লিমিটের চেয়ে বেশি দামি পণ্য কিনতে পারবেন না। আর কিস্তির টাকাও পরিশোধ করতে হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। এতে কারও কাছে টাকা ধার করার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তবে পরিশোধের ক্ষেত্রে সময়সীমা পার হয়ে গেলে জরিমানা গুনতে হতে পারে।
ঋণের সুবিধা : কিছু ক্রেডিট কার্ড, বিশেষ করে বিদেশে শূন্য শতাংশ সুদে ঋণ দেয়। এসব ক্ষেত্রে মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য পরিশোধ করতে হয়, যা বেশ সুবিধাজনক। আবার কোনো কোনো কার্ডে ঋণে সুদের হার অনেক থাকে। এ ক্ষেত্রেও একটা সুবিধা আছে। বোঝা এড়াতে দ্রুত ঋণ পরিশোধ করা হয়। নিজস্ব ঋণ থাকে না।
পরিবর্তনযোগ্য : এসব ক্ষেত্রে সঠিক কার্ডটি বেছে নিতে পারা জরুরি। একটি ভুল কার্ড দিনের পর দিন ব্যবহার করলে ঋণের বোঝা শুধু বাড়তেই থাকবে। তবে এটা বুঝতে ব্যাংকের পুরো শর্তাবলি মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। যদিও কার্ডের ধরন পরিবর্তন করা যায় খুব সহজে। কারণ প্রতিটি ব্যাংকে বিভিন্ন প্রকারের ক্রেডিট থাকে। আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী কার্ড যেমন নিতে পারবেন তেমনি পরবর্তী সময়ে সেটির ধরন পরিবর্তনও করতে পারবেন। আবার নির্দিষ্ট পরিমাণ লেনদেন করলে বাৎসরিক ফি এড়ানো যায়। যেমন অনেক ব্যাংকের কার্ডে অন্তত ১৮ বার কেনাকাটা করলে বাৎসরিক ফি দিতে হয় না। ব্যাংকভেদে এ নিয়মের ভিন্নতা রয়েছে। দেশের বাইরেও ব্যবহার করা যায় : ক্রেডিট কার্ড ইন্টারন্যাশনাল হলে সেটি ব্যবহার করা যাবে বিশ্বের অনেক দেশেই। টাকার পাশাপাশি ডলারও ধার করে ব্যবহার করা যায়। হোটেল বুকিং, বিমানভাড়া, রেস্টুরেন্ট ও কেনাকাটায় মেলে নানা ছাড় ও পয়েন্ট জেতার সুযোগ। বিদেশে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে যা খরচ করবেন, মাস শেষে আপনার সেই পরিমাণ বিল হিসেবে ইস্যু করবে ব্যাংক। তারপর সুদ বা জরিমানা এড়াতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেই বিল পরিশোধ করতে হবে।
অফারের ছড়াছড়ি
বিভিন্ন সময়ে ক্রেডিট কার্ডে বিভিন্ন অফার দেওয়া হয়। যেমন ‘ক্যাশ ব্যাক অফার’, ‘স্পেশাল ডিসকাউন্ট’। দেশের বাইরে বেড়াতে গেলে, হোটেলে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারে অনেক সময়ই মূল্যছাড় দেওয়া হয়। প্লেনের টিকিট কাটতেও অনেক সময় পাওয়া যায় বিশেষ মূল্যছাড়। আর অনলাইন কেনাকাটার জন্যও এখন ক্রেডিট কার্ড বেশ জনপ্রিয়। বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, নামিদামি হোটেল ও রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়ায় ছাড় এবং অফার দিয়ে থাকে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আবাসিক হোটেলগুলোও ক্রেডিট কার্ডে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে। একটি কিনলে একটি ফ্রি (বাই ওয়ান গেট ওয়ান) অফারও দেওয়া হয়। এ ছাড়া রয়েছে মূল্যছাড়সহ নানা অফার। অনেকেই পরিবার নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে ঘুরতে যান। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও হোটেলের নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হোটেল বুক করা যায়। এ ক্ষেত্রেও আপনি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন। তবে বিদেশে হোটেল বুকিংয়ের টাকা পরিশোধের ক্ষেত্রে ডুয়েল কারেন্সি ক্রেডিট কার্ড প্রয়োজন হবে।
অসুবিধা
ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি অসুবিধাও কম নয়। এজন্য বেশ সতর্ক হতে হবে গ্রাহককে। একটু বেখেয়ালি হলেই পড়তে পারেন ঋণের ফাঁদে।
ঋণের ফাঁদ
ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার সবসময়ই একটি ঋণ নেওয়ার মাধ্যম। মনে রাখতে হবে অর্থ খরচের ৪৫ দিনের মধ্যে সেটি পরিশোধ করতেই হবে। অন্যথায় ঋণের ওপর সুদ শুরু হবে। যা ঋণের পরিমাণ প্রতিদিন বাড়িয়ে দেবে। তাই কিছুটা ঝুঁকি থেকেই যায়।
লুক্কায়িত ব্যয়
সুদের হার পরিশোধই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের একমাত্র ব্যয় নয়। সময়মতো মাসিক বিল পরিশোধ না করলে গ্রাহককে জরিমানা গুনতে হতে পারে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে নগদ অর্থ তুলতে এর জন্য নির্দিষ্ট হারে ফি দিতে হতে পারে। সরাসরি বুথ থেকে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে নগদ অর্থ উত্তোলন করতে গেলে বাড়তি ফি এবং ওইদিন থেকেই (এ ক্ষেত্রে ৪৫ দিন সময় দেওয়া হয় না) সুদ গণনা শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে চেক দিয়ে টাকা সঞ্চয় হিসেবে স্থানান্তর করে তারপর সেটি নগদায়ন করলে ৪৫ দিন সময় পাওয়া যাবে।
বর্তমান সময়টা তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। দেশের আর্থিক লেনদেন বর্তমানে প্রযুক্তিকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকের সেলফিন অ্যাপে ঘরে বসেই ব্যাংকিং লেনদেন সম্পন্ন করা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চালু করা এনপিএসবি বা আরটিজিএস গেটওয়ের কথাই ধরেন। কোটি কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ব্যাংকে চলে যাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে। ইসলামী ব্যাংকের কার্ড দিয়ে অন্য ব্যাংকের এটিএম থেকে টাকা তোলা যাচ্ছে মুহূর্তেই। সামনে ট্যাপ অ্যান্ড গো আসবে, হাতে পরার ঘড়ির মধ্যে ভার্চুয়াল কার্ড আসবে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রাহকরা অতি সহজেই ব্যাংকিং কার্যাবলি সম্পন্ন করতে পারছেন। ক্যাশলেস সোসাইটি বাস্তবায়নে আধুনিক ব্যাংকব্যবস্থার বিকল্প নেই। আগে ব্যাংকসেবা গ্রহণ করতে হলে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা নিত হতো। কিন্তু বর্তমানে ডিজিটাল ব্যাংকব্যবস্থা চালু হওয়ায় ঘরে বসেই ব্যাংকসেবা গ্রহণ করা যায়। ইসলামী ব্যাংক ২০১৪ সালে খিদমাহ নামে শরিয়াহভিত্তিক ক্রেডিট কার্ড চালু করে। বর্তমানে বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংক ক্রেডিট কার্ডসেবা অফার করছে। ক্রেডিট কার্ডে দেশে প্রতি মাসে ২৫-২৭ বিলিয়ন টাকা লেনদেন হচ্ছে। আমাদের দেশে টিআইএন রয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। অন্যদিকে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যার বিচারে কার্ড সংখ্যা ঠিকই আছে। ক্রেডিট কার্ড পুরোপুরি জামানতবিহীন ঋণ হলেও ঋণশোধের হার বেশ ভালো। তবে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারকারী বিভাগীয় শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে ক্রেডিট কার্ড জনপ্রিয় না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো পর্যাপ্ত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সেবা ও সুযোগের অনুপস্থিতি। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকব্যবস্থা এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিসমৃদ্ধ টেকসই ব্যাংকব্যবস্থায় ক্রেডিট কার্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সেবার গ্রাহক দিন দিন আরও বৃদ্ধি পাবে।
ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার যোগ্যতা সম্পর্কে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনিরুল মওলা বলেন, চাইলেই যে কেউ ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড নিতে পারবেন না। আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ার প্রমাণ দেখালে তবেই ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড দেবে। এ ক্ষেত্রেও আবার পেশাগত দিক বিবেচনায় নানা মানদণ্ড রয়েছে। যেমন ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বয়স হতে হবে অন্তত এক বছর, যাতে অন্তত ১০ লাখ টাকার লেনদেন হতে হবে। এর পাশাপাশি প্রয়োজন হবে টিআইএন সার্টিফিকেট, ক্ষেত্রবিশেষে ট্রেড লাইসেন্স ও রেফারেন্স এবং চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে ছয় মাসের ব্যাংক হিসাব দেখাতে হবে। মাসিক বেতন হতে হবে ২০ হাজার টাকার বেশি। চাকরির বয়সও ছয় মাসের কম হওয়া চলবে না। অন্য পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে যে পেশায় আছেন, সেখানকার আইডি কার্ড বা এমন কোনো প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। আপনি সব দিক থেকে যোগ্য হলে ব্যাংক উদ্যোগী হয়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
এখন ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড নিতে গেলে শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন সনদ দেখালে হয় না। টিআইএনের বিপরীতে আপনি নিয়মিত রিটার্ন জমা দিচ্ছেন কি না তারও প্রমাণপত্র দেখাতে হয়। নতুন এ বিধান চালুর ফলে ক্রেডিট কার্ড নেওয়া একটু কঠিন হয়েছে। তবে যারা ক্রেডিট কার্ড নিতে ইচ্ছুক তারা পরিপূর্ণ নিয়মাচার মেনে কার্ডের জন্য আবেদন করছে। আয়কর বিবরণী বাধ্যতামূলক করায় আগের তুলনায় ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকের সংখ্যা কিছু কমেছে।
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর নানান সুবিধা রয়েছে। যত খরচ করছেন তার ওপর পয়েন্ট বা ক্যাশব্যাক পাওয়া যায়। সর্বোচ্চ ৪৫ দিন পর্যন্ত দিন চার্জমুক্ত ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। সেবা বা পণ্য কেনার জন্য একসঙ্গে পুরোটা খরচ করতে হয় না। কয়েক মাস ধরে ধাপে ধাপে অর্থ পরিশোধ করা যায়। হোটেলের ভাড়া বা বিমানের টিকিট ক্রেডিট কার্ডে পরিশোধ করলে অনেক সময় ছাড় পাওয়া যায়। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি বা চুরি করে অর্থ তোলা বেশ কঠিন। ডেবিট কার্ডের চেয়ে এর নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো। নগদ টাকার সুবিধা গ্রহণ করলেও একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মুনাফা হার থাকে শূন্য শতাংশ। নির্ধারিত সময় পার হলে মুনাফা কেটে নেওয়া হয়। অবশ্য কোনো কোনো ব্যাংকের নিয়ম-কানুনের জটিলতা ও লুকায়িত চার্জের কারণে গ্রাহকদের মনে এক ধরনের ভীতিও কাজ করে। ফলে অনেকে ক্রেডিট কার্ড নিতে আগ্রহী হন না।
সারা দেশে ক্রেডিট কার্ড ছড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না কেন, এমন প্রশ্নে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংকের এই এমডি বলেন, বাংলাদেশের গ্রামীণ ও জেলা সদর এলাকাগুলোতে এখনো ক্যাশ লেনদেনের প্রাধান্য বেশি। ইসলামী ব্যাংকের দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা শাখাসমূহ থেকে গ্রাহকদের ক্যাশলেস লেনদেনের বিষয়ে আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে। নগদ লেনদেনের নেতিবাচক দিক ও ডিজিটাল লেনদেনের সুবিধার বিষয়ে গ্রাহকদের সচেতন করা হচ্ছে। সাধারণত শহরের জনগোষ্ঠী গ্রামের মানুষের তুলনায় প্রযুক্তি ও পরিষেবাবিষয়ক জ্ঞানে এগিয়ে থাকে। শহরের বড় শপিং মলগুলোতে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করা যায়। যার কারণে শহরে বসবাস করা গ্রাহকরা ক্রেডিট কার্ডের যথাযথ ব্যবহারের সুযোগ পান। ডিজিটাল ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে গ্রাম থেকে শহরে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। আশা করা যাচ্ছে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার সামনের দিনগুলোতে আরও বৃদ্ধি পাবে।
গ্রাহকের জীবন সহজীকরণে ক্রেডিট কার্ডের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, একসময় ক্রেডিট কার্ড আভিজাত্যের প্রতীক হলেও বর্তমানে এটি জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। চলে এসেছে সাধারণের নাগালের মধ্যে। মানুষের মধ্যে কার্ডকে জনপ্রিয় করতে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও ছাড় দিয়ে যাচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে চাকরিজীবী ও পেশাজীবীরা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। হঠাৎ জরুরি টাকার প্রয়োজনে ক্রেডিট কার্ড বড় সমাধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া ইলেকট্রনিক, আসবাবপত্র, পোশাক, গাড়ি, ভোগ্যপণ্যসহ অনেক কিছু বর্তমানে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কেনা যাচ্ছে। দামি পণ্যের ক্ষেত্রে কিস্তির সুবিধাও রয়েছে। হাসপাতালের বিলও দেওয়া যাচ্ছে ক্রেডিট কার্ডে। পকেটে টাকা না থাকলেও সমস্যা নেই, একটি ক্রেডিট কার্ড থাকলেই খাওয়া-দাওয়া কিংবা বাস-ট্রেন-বিমানের টিকিট কেনাও সহজ হয়ে গেছে। প্রতিটি কার্ড ব্যবহারের জন্য বার্ষিক একটা ফি দিতে হয় গ্রাহকদের। তবে কার্ড থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ খরচ করলে সেই ফি থেকে মুক্তি মিলে। ইসলামী ব্যাংক কার্ডের ব্যবহার বাড়াতে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। ব্র্যান্ডের পোশাক, ইলেকট্রনিক, জুতা, হোটেল-রিসোর্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য বা সেবা কিনলে ছাড় মিলছে। প্রতি মাসে কার্ডের বিল জমা দেওয়াটা অনেকের কাছেই ঝামেলা পূর্ণ মনে হয়। অর্থ জমা দেওয়ার শেষের দিনগুলোতে ব্যাংকে প্রচুর ভিড় থাকে। তবে সময়ের ব্যবধানে ইসলামী ব্যাংকে এ কাজও সহজ হয়েছে। ব্যাংকের কার্ডের বিল বর্তমানে ডিজিটাল সেবা ও মোবাইল আর্থিক সেবা বা এমএফএসের মাধ্যমে ঘরে বসেই জমা দেওয়া যাচ্ছে। আবার অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও কার্ডের বিল দেওয়া যায়। সুতরাং অকপটে বলা যায়, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে মানুষের জীবনে গতিময়তা এসেছে।
ক্রেডিট কার্ডে খেলাপির হারও কম। ২০২২ সালের জুনে এ হার ছিল ৪ শতাংশ, যেখানে ব্যাংকব্যবস্থায় খেলাপি প্রায় দ্বিগুণ।
ক্রেডিট কার্ডে বার্ষিক ফি ও মুনাফা হার নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে মনিরুল মওলা বলেন, ইসলামী ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের নিয়মকানুন গ্রাহকদের জন্য অনেক সহজ করা হয়েছে। আমাদের কার্ডে কোনো লুকায়িত চার্জ নেই। এ ক্ষেত্রে সার্বিক বিবেচনায় আমাদের মুনাফার যৌক্তিক পর্যায়ে রয়েছে। সাধারণ মানুষের কার্ডের প্রতি এক ধরনের ভীতি কাজ করে। ব্যাংকিং চ্যানেলের নানা ডকুমেন্টশন, নানান চার্জের চাপ এ সেবা সর্বজনীন করার পথে মূল অন্তরায়। এ ভীতি কাটিয়ে সাধারণ গ্রাহকদের কার্ডের প্রতি আকৃষ্ট করাই ক্রেডিট কার্ডের বাজারে বড় প্রতিবন্ধকতা। এ ছাড়া এর খরচ সর্বসাধারণের নাগালের মধ্যে রাখাটাও এ সেক্টরে বড় চ্যালেঞ্জ বটে। ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকের মধ্যে ক্রেডিট কার্ডের জনপ্রিয়তা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে।
ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার কম থাকলে গ্রাহক এটি ব্যবহারে আগ্রহী হবে। আর যদি সুদের হার বেশি থাকে তাহলে মানুষ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার থেকে দূরে সরে যাবে। এ জন্য ক্রেডিট কার্ডের বিস্তারে সুদের হার সহনীয় পর্যায়ে থাকা আবশ্যক বলে মনে করেন বেসরকারি খাতের ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এমরানুল হক। একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন অভিজ্ঞ এই ব্যাংকার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দেশ রূপান্তরের নিজস্ব প্রতিবেদক এ জেড ভূঁইয়া আনাস।
দেশ রূপান্তর : করোনার সময় দেশের ব্যাংক খাতে প্রযুক্তির বিস্তার ঘটেছে। প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিংয়ে আপনারা কী পরিমাণ এগিয়েছেন?
এমরানুল হক : করোনার সময় আমরা ডিজিটাল নির্ভর হয়ে পড়েছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় ডিজিটালের বিস্তার ঘটেছে। করোনা পুরো পৃথিবীকে ঘরে বসেই অফিস (ওয়ার্ক ফর হোম) করার বিষয়টি শিখিয়েছে। এ বিষয়টি আগে কেউ জানত না। শুধু ব্যাংকিং খাত নয়, অন্যান্য খাতেও সে সময় বাসায় বসে অফিস করতে হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের কোথাও কোথাও এটা এখনো চলমান রয়েছে। ওয়ার্ক ফর হোম আমাদের পরিচালন খরচ কমিয়ে দিয়েছে। আগে আমরা সবগুলো সভাই সশরীরে উপস্থিত থেকে করতাম। এখন অনলাইনে করার কারণে যেভাবে আমাদের পরিচালন খরচ কমে যাচ্ছে ঠিক একই ভাবে আমাদের সময়ও বেঁচে যাচ্ছে। সভায় উপস্থিত হওয়ার যানজটের ভোগান্তি নেই, যাতায়াত খরচও নেই।
এ ছাড়া আমরা গ্রাহকের সুবিধা এবং কর্মীদের সুবিধার জন্য সে সময় অনেকগুলো ডিজিটাল প্রোগ্রাম নিয়ে এসেছি। আগে অ্যাকাউন্ট খুলতে সব গ্রাহককে ব্যাংকে আসতে হতো। এখন ঢাকা ব্যাংকের ‘ইজি ব্যাংক’ অ্যাপ ব্যবহার করে গ্রাহক ঘরে বসেই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন। ঢাকা ব্যাংক নামে আমাদের আরেকটা অ্যাপস আছে, যার মাধ্যমে আমরা অন্যান্য সার্ভিসও দিচ্ছি। এই অ্যাপসের মাধ্যমে ক্রেডিট কার্ডের আবেদন, ঋণের আবেদনসহ অন্য কাজগুলো করা হয়। এ ছাড়া ট্রেড বিজনেস বা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য আমরা একটি অ্যাপস নিয়ে এসেছি। যাতে গ্রাহক ব্যাংকে না এসেই তার অফিস বা বাসা থেকে এর কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। এ ছাড়া ন্যারো সেভিংস ও ই-ঋণ নামে আমাদের আরও দুটি অ্যাপ রয়েছে। ই-ঋণের মাধ্যমে গ্রাহক ব্যাংকে না এসেই ঋণ নিতে পারছে। তবে এই অ্যাপে আমরা ৩ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়ে থাকি। এই ঋণ পরিশোধ করতে হয় ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে। এতে আমাদের কোনো কর্মীকে ব্যবহারও করতে হচ্ছে না। সম্পূর্ণ ডিজিটাল মাধ্যমেই এসব কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। এতে ঋণখেলাপি হওয়ার আশঙ্কাও কম। করোনা কমে গেলেও গ্রাহকরা এসব অ্যাপের সুবিধা নিচ্ছেন। এতে গ্রাহককে যেভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করতে হচ্ছে না, ঠিক একই ভাবে আমাদেরও পরিচালন খরচ কমে আসছে। এ জন্য ঢাকা ব্যাংক সব সময় প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করে থাকে।
দেশ রূপান্তর : কার্ডভিত্তিক লেনদেনে আপনাদের অবস্থান কেমন?
এমরানুল হক : আমাদের কার্ডভিত্তিক লেনদেন বাড়ছে। গত চার বছরে আমাদের কার্ডের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ২০০৫-০৬ সালের দিকে আমরা কার্ড বিক্রি শুরু করেছিলাম। সে সময় থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমরা যে পরিমাণ কার্ড বিক্রি করেছি, ২০১৯-২২ সাল পর্যন্ত সমপরিমাণ কার্ড বিক্রি করেছি। আমাদের প্রচারণা ও পরিশ্রম পাশাপাশি গ্রাহকরা কার্ডের ব্যবহারের ভালো দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন হচ্ছেন। এটা ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
দেশ রূপান্তর : বর্তমানে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন বাড়ছে। গত মার্চে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে ক্রেডিট কার্ডে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় ক্রেডিট কার্ডের ভবিষ্যৎ কেমন?
এমরানুল হক : বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ডের ভবিষ্যৎ খুবই ভালো। পুরো বিশ^ই এখন ক্যাশলেস হয়ে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ এখন ক্যাশ গ্রহণ করতে চায় না। মার্কেটে কেনাকাটায় বা ট্যাক্সির ভাড়া কোনো ক্ষেত্রেই ক্যাশ গ্রহণ করতে চায় না। আমারাও ধীরে ধীরে সেদিকে যাচ্ছি। আগে অনেকেই মনে করত ক্রেডিট কার্ড নিলে খরচ বেড়ে যাবে বা ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার বেশি। এখন মানুষ ধীরে ধীরে ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। ক্রেডিট কার্ড থাকলে মানুষকে ক্যাশ নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে না। পাশাপাশি টাকা না থাকলে গ্রাহক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে পারছেন। এই বিল পরিশোধে গ্রাহক ২০ থেকে ২২ দিন সময়ও পাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে কোনো সুদও দিতে হয় না। অনেকেই এই সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করে দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে আমার মনে হয় পৃথিবী যেদিকে যাচ্ছে, আমরাও সেদিকেই যাচ্ছি। ক্রেডিট কার্ডের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে। ধীরে ধীরে এর ব্যবহার এবং সংখ্যা দুটোই বাড়বে।
দেশ রূপান্তর : কারা ক্রেডিট কার্ড বেশি ব্যবহার করছে বলে আপনার মনে হয়?
এমরানুল হক : এখন সব শ্রেণির লোকজনই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন; বিশেষ করে যারা বেতনভোগী ও ব্যবসায়ী তারা ক্রেডিট কার্ড বেশি ব্যবহার করেন। এমনকি বর্তমানে শিক্ষার্থীদের জন্যও আমরা ক্রেডিট কার্ড দিচ্ছি। কারও ১৮ বছর পার হলে তার আয় অথবা তার ফ্যামিলির অবস্থান দেখে আমরা তাদেরও ক্রেডিট কার্ড দিচ্ছি।
দেশ রূপান্তর : ক্রেডিট কার্ড মানুষকে ঋণগ্রস্ত করে তোলে বলে অভিযোগ আছে। আপনি কী মনে করেন?
এমরানুল হক : এটা নির্ভর করবে গ্রাহকের মাইন্ড সেটের ওপর। কোনো গ্রাহক যদি মনে করেন তারা এটি ঋণ নেওয়ার জন্য ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন, তাহলে এটি ভুল হবে। আমি মনে করি, সবার মাথায় রাখা উচিত ক্রেডিট কার্ড মানুষের জীবনকে সচ্ছল নয়, সহজ করে। যদি কেউ এটিকে সচ্ছলতার জন্য ব্যবহার করেন, তাহলে এটি তার জন্য ঋণগ্রস্ত করে তোলার ঝুঁকি তৈরি করে দিতে পারে। ক্রেডিট কার্ড গ্রাহককে অবশ্যই নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। তিনি এমন পরিমাণ টাকা নেবেন, যাতে পরিশোধ করতে পারেন। পাশাপাশি কোন সময়ের মধ্যে পরিশোধ করবেন, এটাও তার প্ল্যানিংয়ে থাকতে হবে। এই প্ল্যানিং যদি থাকে তাহলে ক্রেডিট কার্ড তার জীবনকে সহজ করে তুলবে। ক্রেডিট কার্ড বিতরণের পর রেজাল্ট যদি ভালো আসে তাহলে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। যদি রেজাল্ট খারাপ দেখা যায় তাহলে ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রে সাবধানতা বেশি অবলম্বন করবে।
দেশ রূপান্তর : সুদের হার ক্রেডিট কার্ডের বিস্তারে বাধা কি না?
এমরানুল হক : এখন ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার ১২ শতাংশের ওপরে নেওয়া যায় না। একসময় অনেক ব্যাংক এসব সুদের হার ২০, ২২ এমনকি ২৫ শতাংশ পর্যন্ত নিয়েছে। এটা আমি মনে করি ঠিক নয়। যেহেতু এতে ঝুঁকি বেশি, দ্রুত প্রভিশনিং হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে অন্যান্য ঋণের তুলনায় সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ শতাংশ বেশি সুদ ধরা যেতে পারে। এমন কিছু করা উচিত নয় যেন গ্রাহক এটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন; অর্থাৎ অন্যান্য ঋণের তুলনায় ক্রেডিট কার্ডের সুদ কোনোভাবেই দ্বিগুণ হওয়া উচিত নয়। ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার যদি ভালো হয় বা কম হয়, তাহলে গ্রাহকরা ক্রেডিট কার্ডের প্রতি আগ্রহী হবেন। যদি সুদের হার আকাশছোঁয়া হয় বা বেশি হয় তাহলে এর থেকে মানুষ দূরে সরে যাবে। এ জন্য এটি সহনীয় পর্যায়ে রাখা উচিত। তাহলে অনেকেই আগ্রহী হবেন ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করার ক্ষেত্রে।
দেশ রূপান্তর : বিভিন্ন অফারের কারণে আপনাদের ক্রেডিট কার্ডের বিস্তার ঘটছে কি না?
এমরানুল হক : আমরা সাধারণত ফেস্টিভ্যালের সময় অফার দিয়ে থাকি; অর্থাৎ রোজা, ঈদ, বৈশাখ বা অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এসব অফার দিয়ে থাকি। তখন ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। অনুষ্ঠান বা ঈদের সময় মানুষ এমনিতেই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বেশি করে। পাশাপাশি যদি অফার দেওয়া হয় তাহলে তার আরও বেশি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হয়। একটা সাধারণ মাসে ক্রেডিট কার্ডের যে পরিমাণ ব্যবহার হয়, যখন অফার দেওয়া হয় তখন সাধারণ সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ, আড়াই গুণ বা কোনো কোনো সময় তিন গুণ হয়ে যায়।
একটা সময় পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ড শুধু উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। লংকাবাংলাই সর্বপ্রথম মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য ক্রেডিট কার্ড নিয়ে আসে। গত কয়েক বছরে এটি নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেও ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন আমরা গ্রামপর্যায়ে ক্রেডিট কার্ড পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। দেশ রূপান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের এসইভিপি ও হেড অব রিটেইল বিজনেস খোরশেদ আলম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দেশ রূপান্তরের নিজস্ব প্রতিবেদক এ জেড ভূঁইয়া আনাস
খোরশেদ আলম বলছিলেন, আমাদের আর্থিক ব্যবস্থা ডিজিটাল হচ্ছে। আমরা বহুদূর এগিয়েছি। এটি বাড়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ডিজিটাল লেনদেন দুভাবে ভাগ করা যায়। একটি পেমেন্ট সিস্টেম, অন্যটি ফান্ড ট্রান্সফার। এর মধ্যে ফান্ড ট্রান্সফার ভালোই হচ্ছে। গার্মেন্টস সেক্টর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলেও এ লেনদেন শুরু হয়েছে ব্যাপকহারে। মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন দ্রুতই বাড়ছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে লেনদেনের ৮০ শতাংশ হবে ডিজিটাল। কয়েক দিন আগে আমরা গ্রাহককে চেকের মাধ্যমে পেমেন্ট করতাম। বর্তমানে সেটি ডিএফটিএম মাধ্যমে পরিশোধ করছি। ডিজিটাল লেনদেনে আমরা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি এগিয়েছি। এখনো আমাদের কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, আমাদের মার্চেন্ট লেভেল যেভাবে আধুনিক হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হয়নি।
অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ ক্রেডিট কার্ডে পিছিয়ে আছে। যদিও এখন তা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। দেশে এ ধরনের কার্ডের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খোরশেদ আলম বলেন, জনসংখ্যার বিচারে অনুযায়ী কার্ডের সংখ্যা কম। আগামীতে এটিকে বাড়িয়ে অন্তত চার কোটিতে নিয়ে যেতে হবে। ক্রেডিট কার্ড কম হওয়ার পেছনে যারা ইস্যু করছেন, তাদের গাফিলতি রয়েছে। যদিও এর পেছনে ব্যাংকগুলো ঝুঁকি বিবেচনা করছে। ক্রেডিট কার্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো পুরাতন গ্রাহক ও যাদের হ্যান্ডসাম স্যালারি আছে তাদের বেছে নিচ্ছেন। এজন্য যে গ্রাহককে ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নিয়ে ঋণ দিতে চায় না আমরা তাদেরই টার্গেট করেছি। বিশেষ করে সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা আমাদের ক্রেডিট কার্ড হোল্ডার। আমাদের দেখে অনেক ব্যাংক এখন শিক্ষকদের টার্গেট করে কাজ করছে।
ইন্টার্ন ডাক্তারদের আমরা কার্ড দিয়েছি। দশম থেকে দ্বাদশতম গ্রেডের সরকারি চাকরিজীবীদেরও আমরা কার্ড দিয়েছি। এমনকি যাদের মাসিক আয় ২০ হাজার টাকা তারাও আমাদের কার্ড পেয়েছেন। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষক, সরকারি চাকরিজীবী, ব্যাংকাররাই মূলত ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক। তাদের লক্ষ্য করে যদি আমরা কাজ করতে পারি তাহলে ক্রেডিট কার্ডের বাজার আরও বড় হবে। ক্রেডিট কার্ড যদি আপনি যথাযথভাবে ব্যবহার করেন, সময়মতো বিল পরিশোধ করেন তাহলে আপনি কখনই বিপদে পড়বেন না। কিন্তু যদি ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা নিয়ে আপনি জমি কেনেন কিংবা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে লোকসান করেন, তাহলে আপনি কার্ডের বিল দিতে সমস্যায় পড়বেন এবং এটি আপনার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
আগে একটা ধারণা ছিল যে, এলিট শ্রেণির মানুষজনই শুধু কার্ড ব্যবহার করবেন। কিন্তু সেটি এখন পরিবর্তন হয়েছে। এখন পর্যায়ক্রমে গ্রামাঞ্চলেও ক্রেডিট কার্ড পৌঁছে দেওয়া সম্ভব বলে মনে করছি।
ক্রেডিট কার্ডে সুবিধা প্রসঙ্গে খোরশেদ আলম বলেন, ভোগ্যপণ্যের সব প্রোডাক্ট আপনি ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কিনতে পারবেন। মাছ, মাংস, ওষুধ, ঘরের আসবাবপত্র, এমনকি পার্লারে বিল পরিশোধও করা যায়। বিয়ের সময় অনেকেই অর্থসংকটে পড়েন। সে ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ডের সহায়তা নিতে পারছেন। আমাদের শিখা কার্ড রয়েছে। কাস্টমারদের ন্যানো লোন দেওয়ার জন্য কাজ করছি। কারও পরিবারের কোনো সদস্য অসুস্থ হলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে তার ডাক্তারের খরচ মেটানো, অপারেশন করাতে হলে আমরা সেই সুবিধাও দিয়ে থাকি। আমরা বিভিন্ন সেক্টরের লোকজনের সঙ্গে এগ্রিমেন্ট করেছি। যদি কেউ আমাদের কার্ড দিয়ে তাদের সঙ্গে কোনো লেনদেন করে তাহলে সে ক্ষেত্রে আমরা তাদের পার্সেন্টেজ হারে ডিসকাউন্ট সুবিধা দিয়ে থাকি, শূন্য শতাংশ সুদে। ক্রেডিট কার্ড এমন একটি প্রোডাক্ট, আপনি চাইলে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই ব্যবহার করতে পারবেন।
অনেক সময় আমরা বিভিন্ন অফার বা বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকি। লেনদেনের টাকা প্রতি মাসে বেতন থেকেও অল্প অল্প করে কেটে নেওয়ার সুবিধা রেখেছি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সে পুরো টাকাটা পরিশোধ করে দিলে কোনো সুদ থাকবে না। কোনো কার্ডহোল্ডার যদি রেগুলার তারিখে পরিশোধ করে দেন তাহলে তিনি ঋণগ্রস্ত হবেন না। তারাই শুধু ঋণগ্রস্ত হন যারা টাকা খরচ করছেন আবার সময়মতো ঋণ পরিশোধ করছেন না।
ক্রেডিট কার্ডে খেলাপি প্রসঙ্গে লংকাবাংলার এ কর্মকর্তা বলেন, বরাবরই আমাদের কার্ডে খেলাপির হার ৮ শতাংশের মধ্যে ছিল। কিন্তু কভিডের মধ্যে এটি বেড়ে যায়। অনেক কার্ডধারী রয়েছেন যারা করোনার কারণে চাকরি হারিয়েছেন। তারা চাকরি হারানোর আগে প্রত্যেক মাসে কার্ড থেকে টাকা উত্তোলন করেছেন এবং সেটি স্যালারি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধ করতে পেরেছেন। তাদের অনেকের চাকরি হারিয়ে বেতন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। আবার কেউ কেউ খেলাপি হয়ে গেছেন। কেউ হয়তো করোনায় মারা গেছেন কিংবা কারও হয়তো বেতন কমে যাওয়ার কারণে খেলাপি হয়ে পড়েছেন। অবশ্য এ বছরের জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসেই খেলাপির পরিমাণ কমছে।
কার্ডের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে খোরশেদ আলম বলেন, ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে সার্ভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আমরা যে সফটওয়্যারটি ব্যবহার করি সেটার নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য আমাদের একটি দক্ষ তথ্যপ্রযুক্তি ইউনিট আছে। তারা প্রতিনিয়ত গবেষণার মাধ্যমে ঝুঁকি প্রশমনের কাজ করছে। এখন পর্যন্ত আমাদের ক্রেডিট কার্ডে কোনো ধরনের সাইবার হামলা কিংবা এ ধরনের কোনো কিছু হয়নি। তবে ছোটখাটো জালিয়াতির কিছু ঘটনা ঘটেছে। এজন্য আমরা প্রতিনিয়ত গ্রাহকদের সচেতন করছি কার্ডের পিন কারও সঙ্গে যাতে শেয়ার করা না হয়। এমনকি লংকাবাংলা থেকে ফোন দেওয়া হলেও দেবেন না। লংকাবাংলা কখনই গ্রাহকের কাছে পিন চাইবে না। তবে কেউ কেউ লংকাবাংলার কাস্টমার কেয়ারের নাম ভাঙিয়ে গ্রাহকদের ফোন করে পিন নম্বর চায়। এজন্যই আমরা গ্রাহকদের সতর্ক করছি যে কাউকে পিন নম্বর না দেওয়ার জন্য। সম্প্রতি আমরা কার্ডের বিল জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে কার্ড নম্বরের পরিবর্তে একটি অ্যাকাউন্ট নম্বর তৈরি করেছি। এতে গ্রাহক সেই অ্যাকাউন্ট নম্বর ব্যবহার করে টাকা জমা দেবেন। এতে অন্য কেউ গ্রাহকের কার্ড নম্বর জানতে পারবে না।
দেশ রূপান্তরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী জাফর আলম।
দেশ রূপান্তর : দেশের আর্থিক লেনদেন কতটা ডিজিটাল হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
জাফর আলম : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশে ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে, যেখানে দৈনিক মোট লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ৪৮ লাখ মানুষ ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে যুক্ত আছে। যদিও এ সংখ্যা খুবই কম। তবে ইন্টারনেট ব্যাংকিং ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। গত মার্চেই ৪ লাখ নতুন গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এই হিসাবে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ নতুন গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে যুক্ত হচ্ছেন। দেশে প্রায় ৩ কোটি ডেবিট কার্ড ও ২২ লাখ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী আছেন। এসবের সঙ্গে এটিএম, পস, সিআরএম, সিডিএম, আরটিজিএস, ইএফটিএন ইত্যাদির ব্যবহার ডিজিটাল লেনদেনকে উৎসাহিত করছে বলে আমি মনে করি। আসলে প্রযুক্তিকে আমাদের ধারণ করতে হবে। এ হিসেবে আমরা যথাযথভাবে এগোচ্ছি বলে মনে হয়।
দেশ রূপান্তর : লেনদেনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সম্পন্ন হচ্ছে ক্রেডিট কার্ডে। এই সেবার ভবিষ্যৎ কেমন?
জাফর আলম : বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ক্রেডিট কার্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মানুষজন তাৎক্ষণিক টাকার চাহিদা মেটাচ্ছে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে। এখন কার্ডে ব্যাংকের বুথ থেকে নগদ টাকা তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পণ্যের কেনাকাটা ও সেবার মূল্য পরিশোধ করা যাচ্ছে। আর কোনো মুনাফা বা সুদ ছাড়া টাকা পরিশোধে সর্বনিম্ন ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ দিন পর্যন্ত সময় মিলছে। এসব কারণে দেশে দিনে দিনে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে লেনদেনও।
দেশ রূপান্তর : দেশে ডেবিট কার্ডের তুলনায় ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা অনেক কম। এর কারণ কী?
জাফর আলম : ডেবিট কার্ড দিয়ে নিজের ব্যাংক হিসাবের টাকা খরচ করা হয়। আর বেশির ভাগ ব্যাংক হিসাব খোলার সঙ্গেই গ্রাহকদের ডেবিট কার্ড দিয়ে থাকেন। ক্যাশ টাকা বহনের ঝামেলা মানুষ এখন এড়িয়ে চলতে চায়। আর ক্রেডিট কার্ড দিয়ে গ্রাহকদের ব্যাংকের টাকা খরচ করতে হয়। ক্রেডিট কার্ডের খরচ করা টাকার ওপর মুনাফা বা সুদ গুনতে হয়। তাই দেশে ডেবিট কার্ডের তুলনায় ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা কম।
দেশ রূপান্তর : আয়কর বিবরণী জমা বাধ্যতামূলক করায় ক্রেডিট কার্ড ইস্যুর ওপর কোনো প্রভাব ফেলছে কি না?
জাফর আলম : ক্রেডিট কার্ড ইস্যুর ক্ষেত্রে গ্রাহকদের আয়কর বিবরণী জমা বাধ্যতামূলক করা একটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। এর ফলে কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমার মনে হয় না।
দেশ রূপান্তর : কোন শ্রেণি-পেশার গ্রাহক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন? শহরের মধ্যে ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক সীমাবদ্ধ কেন? পুরো দেশে ক্রেডিট কার্ড ছড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না কেন?
জাফর আলম : চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ আর্থিকভাবে সচ্ছল যেকোনো মানুষ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। শহরের মধ্যে ক্রেডিট কার্ডের চাহিদা বেশি। আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে শহরের বসবাসকারী মানুষই সাধারণত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন। এসআইবিএল সব সময় ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকবান্ধব। গ্রাহকের বিভিন্ন সুবিধার কথা চিন্তা করে আমরা সর্বদা ভালো কিছু করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আমাদের মার্চেন্ট আউটলেটে ডিসকাউন্ট, ইএমআই ও শূন্য শতাংশ আই পে সুবিধা চালু আছে। আরও বেশি সুবিধা দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা স্কুল-কলেজের শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আমাদের কার্ডসেবা প্রদানের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি। মানুষ এখন নগদ টাকা বহন করতে চায় না। গ্রামেও এর চাহিদা তৈরি হবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ক্রেডিট কার্ডের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ইসলামি শরিয়াহসম্মত ও সুদমুক্ত কার্ড হওয়ায় আমাদের কার্ডের বাজার সম্প্রসারণে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আশা করছি, আগামীতে আমাদের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের চাহিদা আরও বাড়বে। সেই টার্গেট নিয়েই আমরা কাজ করছি।
দেশ রূপান্তর : ডিজিটাল লেনদেনে গ্রাহকের নিরাপত্তা কতটা? গ্রাহকের কী ধরনের সচেতনতা প্রয়োজন?
জাফর আলম : এসআইবিএল শরিয়াহভিত্তিক একটি আধুুনিক ব্যাংক। এর ক্রেডিট কার্ডও সম্পূর্ণ শরিয়াহ কমপ্লায়েন্ট। গ্রাহকরা ক্রেডিট কার্ডের সঙ্গে সাপ্লিমেন্টারি কার্ড নিতে পারেন, যা বিনা মূল্যেই দেওয়া হয়। এসআইবিএলের ক্রেডিট কার্ড অত্যন্ত সুরক্ষিত ও ই-কমার্স লেনদেনও টু ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন দ্বারা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। এসআইবিএলের ক্রেডিট কার্ড শরিয়াহসম্মত ও সুদমুক্ত হওয়ায় এর বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে। সমাজে সর্বস্তরের গ্রাহক আমাদের ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। আমরা স্বল্প আয়ের চাকরিজীবীদের জন্য ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করছি।
দেশ রূপান্তর : এসআইবিএলের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের সুবিধা কী?
জাফর আলম : তুলনামূলকভাবে আমাদের ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডে প্রফিট রেট, ফি ও অন্যান্য চার্জ অনেক কম। শরিয়াহসম্মত হওয়ায় আমাদের কার্ডে কোনো হিডেন চার্জ নেই। গ্রাহকরা বাংলাদেশের যেকোনো এটিএম থেকে কম খরচে ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা তুলতে পারেন। সব ধরনের পিওএস (পয়েন্ট অব সেল) মেশিনে আমাদের কার্ড ব্যবহার করা যায়। এসআইবিএলের কার্ডে বিভিন্ন নির্বাচিত মার্চেন্ট আউটলেটে প্রায় সময়ই বিভিন্ন ধরনের ইএমআই সুবিধায় শূন্য শতাংশ আই-পে সুবিধা দেওয়া হয়, যা গ্রাহককে সহজেই আকৃষ্ট করছে। এ ছাড়া এসআইবিএলের ক্রেডিট কার্ডের পেমেন্ট সিস্টেমও অত্যন্ত নমনীয়, অর্থাৎ গ্রাহকরা পেমেন্ট দিতে সর্বোচ্চ ৫০ দিন পর্যন্ত মুনাফা ফ্রি সময় পান। এই সময়ের মধ্যে পেমেন্ট দিলে কোনো ধরনের মুনাফা চার্জ ধার্য করা হয় না। গ্রাহকরা কার্ড দিয়ে ব্যালান্স ট্রান্সফারের সুবিধা ভোগ করতে পারছেন খুব সহজেই। সেই সঙ্গে তারা বিভিন্ন নির্বাচিত আউটলেটে ডিসকাউন্টসহ ইএমআই সুবিধাও পাচ্ছেন। ব্যাংকের প্লাটিনাম কার্ডধারীদের জন্য বিনা মূল্যে প্রায়োরিটি পাস কার্ড দেওয়া হয়, যা দিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বলাকা ভিআইপি লাউঞ্জে ও বিশ্বব্যাপী নির্বাচিত লাউঞ্জে বিনা মূল্যে প্রবেশাধিকার সুবিধা পাওয়া যায়। গ্রাহকরা এসআইবিএলের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দেশে ও বিদেশে এটিএম থেকে নগদ উত্তোলনের সুযোগ পান। বর্তমান সময়ে ক্রেডিট কার্ড হলো বিপদের বন্ধু। কারণ আমাদের কার্ড দিয়ে গ্রাহক প্রয়োজনের মুহূর্তে যখন-তখন যেকোনো সময়ে এটিএম থেকে টাকা তুলতে পারছেন। বিভিন্ন পিওএস মেশিনে ব্যবহার করতে পারছেন, দেশে ও দেশের বাইরে ই-কমার্স লেনদেন করতে পারছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডিসকাউন্ট, ইএমআই ও শূন্য শতাংশ আই-পে সুবিধা পাচ্ছেন, ব্যালান্স ট্রান্সফারের মাধ্যমে কার্ড থেকে টাকা ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে নিয়ে নগদ ব্যবহার করতে পারছেন। কাজেই এসআইবিএলের ক্রেডিট কার্ড আসলেই মানুষের বিপদের বন্ধু, সব সময়ের সঙ্গী।
দেশ রূপান্তর : বিভিন্ন উৎসবে গ্রাহকদের নানা অফার দিচ্ছেন। এতে ব্যবসা কতটা বাড়ে?
জাফর আলম : আসলে ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে এসব অফারের সম্পর্ক নেই। গ্রাহকদের সুবিধার্থে এ ধরনের অফার দেওয়া হয়ে থাকে। আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে আমরা বিভিন্ন শপিং মল, ইলেকট্রনিক ও ফার্নিচার শোরুম, হোটেল ও রেস্তোরাঁর সঙ্গে চুক্তি করছি। গ্রাহকরা তাদের কেনাকাটায় আরও বেশি ডিসকাউন্ট, ইএমআই ও শূন্য শতাংশ আই-পে সুবিধা পেতে পারেন, সে ব্যাপারে কাজ করছে এসআইবিএল। এসআইবিএলের গ্রাহক তাদের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা এবং প্রয়োজন মেটাতে পারছেন।
দেশ রূপান্তর : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
জাফর আলম : আপনাদেরও ধন্যবাদ।
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ আগস্ট ৯ বছরের শিশু আরাফাতের মৃত্যু হয়। সপ্তাহ না যেতেই ২৫ আগস্ট মারা যায় আরাফাতের ছোট বোন ৬ বছরের রাইদা। রাজধানীর মধ্যপাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ের একটি বাসায় দুই সন্তান আরাফাত ও রাইদাকে নিয়ে থাকতেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি। সন্তানদের মৃত্যুর পর জীবনটাই বদলে গেছে তাদের। তছনছ হয়ে গেছে সাজানো সংসার। ইব্রাহিম ও রাবেয়া দম্পতির মতো বহু পরিবার এবার সর্বস্বান্ত হয়েছে ডেঙ্গুজ¦রের থাবায়। সন্তান হারানো এমন বাবা-মায়েরা পাগলপ্রায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সী ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৮৬ এবং নারী ৯১ জন। এবার শুধু শহর নয়, গ্রামেও ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। সেখানেও মারা গেছে অনেক শিশু। এ বছর ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে। এই রোগে এত শিশুর মৃত্যু আগে কখনো হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছর শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ৬৩ হাজার ৯১৯ জন; যা মোট আক্রান্তের ৩২ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ২৩ হাজার ৬১৭ এবং পুরুষ ৪০ হাজার ৩০২ জন। ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে শিশুদের আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া শিশুদের যারা সুস্থ হয়ে উঠছে, তাদের মধ্যে ভবিষ্যতে শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডেঙ্গুর বর্তমান সংক্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি শিশুদের নতুন বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার বিরূপ প্রভাব শিশুদের মধ্যে ভবিষ্যতে দেখা যেতে পারে। মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর প্রভাব থাকতে পারে। এতে তাদের মেধাবিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাদের যদি কিডনি কিংবা লিভারের মতো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেই ভার সারা জীবন বহন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শিশুদের মৃত্যু নিয়ে ভালোভাবে অ্যানালাইসিস করতে পারছি না। এসব মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে অটোপসি করতে পারলে ভালো হতো। বিভিন্ন দেশে মৃত্যু নিয়ে ডেথ রিভিউ বা অটোপসি করা হয়। এটি করতে পারলে বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’
এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। কোনো শিশুর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হলে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, ১ মাস থেকে ১২ বছর বয়সী মুমূর্ষু শিশু রোগীদের পৃথক পিআইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। তবে দেশে পিআইসিইউ সংকট রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পিআইসিইউর জন্য স্বজনদের হাহাকার করতে দেখা গেছে। হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ শিশুকে সেবা দিতে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বেশি, সেখানে শিশু রোগীও উল্লেখযোগ্য। এই দুটি হাসপাতালে একেকটি শয্যায় একাধিক শিশু রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড খুলেছে কর্তৃপক্ষ। ৭০ থেকে ৮০ জনের সেবা পাওয়ার কথা, কিন্তু সেখানে প্রতিদিন সেবা নিচ্ছে প্রায় ৩০০ শিশু। ঢামেক হাসপাতালের ২৫ শিশুকে একসঙ্গে পিআইসিইউতে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো পিআইসিইউ নেই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখানে শিশুদের ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পিআইসিইউ নেই, তবে এনআইসিইউ (নিউনেটাল আইসিইউ বা নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) আছে।
এদিকে শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের শরীরে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু শনাক্তে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। শিশুদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামীমা ইয়াসমীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিশুদের জ্বর আসার তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে হবে। এবার অনেকের মধ্যে হঠাৎ করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। ফলে তারা দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসছে। দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে যেসব শিশু মারা গেছে, তারা বাড়ি থেকেই জটিলতা নিয়ে এসেছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, শুধু প্লাটিলেট কমা আশঙ্কার নয়, রক্তচাপ কমে যাওয়া প্লাটিলেট কমার চেয়ে ভয়ের। তাই আমাদের শিশুদের রক্তচাপ নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।’
স্যাংশন নিয়ে ভয় না পাওয়ার বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার মেথডিস্ট সেন্ট্রাল হলে নাগরিক সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি পাল্টা স্যাংশন দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন।
সংবিধান অনুযায়ী সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা ইস্যু সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন, সাজাপ্রাপ্ত কাউকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় কোন দেশ?
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, পৃথিবীর কোন দেশের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় বলতে পারেন? কোনো দেশে পাঠায়? তারা এটা দাবি করে। আমাদের কেউ কেউ আঁতেল আছে। তারা বলে, একটু কী সহানুভূতি দেখাতে পারেন না! সে এভারকেয়ার, বাংলাদেশের সবথেকে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আর রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়সতো আশির ওপর। মৃত্যুর সময় তো হয়ে গেছে। তার মধ্যে অসুস্থ। এখানে এত কান্নাকাটি করে লাভ নাই।
স্যাংশনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আপনাদেরও বলব, স্যাংশন নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
বিএনপি চেয়ারপারসন ‘অসুস্থ’ খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে শর্ত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই শর্তের অন্যতম ইস্যু হচ্ছে, বিএনপিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। এমন ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিদেশে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। কিন্তু সরকারের সেই শর্তে রাজি নন খালেদা জিয়া। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো শর্তের বিনিময়ে তিনি মুক্তি চান না। ফলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সরকারের যে চেষ্টা, সেটা এ দফায় সফল হচ্ছে না বলে মনে করছেন আন্দোলনে থাকা নেতারা। তাদের মতে, সরকার ফাঁদ পাতলেও এতে পা না দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে বেগম জিয়ার। বরং আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলতে চান তারা। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। এ লক্ষ্যে প্রায় অর্ধশত দল নিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরে আন্দোলনে রয়েছেন তারা।
শর্তের বিনিময়ে মুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে গত রবিবার রাতে কিশোরগঞ্জে বিএনপির রোডমার্চের সমাপনী সমাবেশে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল তিনি যদি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, তাহলে বিএনপিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি থেকে উত্তর দেওয়ার আগেই অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়া বিদ্রোহ করে বলেছেন, তার জীবনে গণতন্ত্রের জন্য কোনো শর্ত নেই। ভোটের অধিকারের জন্য, এই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো শর্ত নেই। কোনো শর্ত খালেদা জিয়ার নামের সঙ্গে যায় না এবং আমরাও তা মানি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়া ৫৪ দিন ধরে টানা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিতই খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। এ সময় বেশ কয়েকবার শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লে দলের কয়েকজন নেতার মাধ্যমে মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের দেওয়ার বক্তব্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি দলের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সম্পাদক ও সদস্য খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। সূত্রগুলো বলছে, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য কথা প্রসঙ্গে এ ধরনের প্রসঙ্গেও ইঙ্গিত দিলে খালেদা জিয়ার শর্ত দিয়ে মুক্ত হতে চান না বলে পুনর্ব্যক্ত করেন। যদিও এর আগে শর্ত দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসার বিষয়ে দল যাতে সম্মত না হয়, সে কথা নেতাদের আগেই বলে রেখেছিলেন একসময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এ নেত্রী। কোনো অবস্থায় শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না এবং এ ব্যাপারে কোনো ধরনের সমঝোতাও নয়Ñ এ ব্যাপারেও খালেদা জিয়ার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করেন। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে মঞ্চের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের এ আন্দোলনে উনার সমর্থন আছে। আমাদের একজন নেতা (ওই বৈঠকে) বলেছেন, সরকার একটা নির্বাচনের জাল বিছানোর চেষ্টা করছে। উনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, কোনো অবস্থায় এ সরকারের অধীনে নির্বাচনী ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।’
এর আগে ৮ মে রাতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় সাক্ষাৎ শেষে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছিলেন, কেউ কেউ বলছেন আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া তাদের বলেছেন, প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে আমি কোনো অনুমতি দেব না।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি এখন সরকারের বিদায়ের ওপর নির্ভর করছে। আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করতে না পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলবে না। তাই এখন আন্দোলনের মাধ্যমে এ ইস্যুর সমাধান করবে তারা। এজন্য চলমান এক দফার আন্দোলনের সঙ্গে এখন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা ইস্যুটি জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে চান তারা। এতে সরকারবিরোধী আন্দোলন বড় ধরনের মোড় নিতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস।
গতকাল সোমবার স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে সভায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ৫ অক্টোবর বিএনপি ঘোষিত রোডমার্চ কর্মসূচি শেষ হবে। এর আগেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বলেন, ‘দাবার ঘুঁটি হিসেবে খালেদা জিয়াকে ব্যবহারের চিন্তা তারা কীভাবে করে সেটাই বোধগম্য নয়। সরকারের এ ধরনের চিন্তা বা পরিকল্পনা কোনো কাজে আসবে না।’
উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে বিএনপিপ্রধানের পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের ওপর গত রবিবার আইন মন্ত্রণালয় মতামত দিয়ে বলেছে, সাজা স্থগিত থাকাবস্থায় তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর সুযোগ নেই। যদি যেতে হয়, তাহলে সাজা স্থগিতের আদেশ বাতিল করতে হবে। কিন্তু সেটা করে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি।
আবার গতকাল নিজ কার্যালয়ে সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি কিংবা আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন। তবে তার আগে তাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। রাষ্ট্রপতি বা আপিল বিভাগের খালেদা জিয়ার পরিবার আবেদন করবে না বলে দলীয় আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই বলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। যে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেখানে বলা হয়েছে, তাকে “দেশে চিকিৎসা নিতে হবে”, তার বদলে “দেশে বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন” বলাই যথেষ্ট। এর বাইরে দলের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেই।’
এদিকে চিকিৎসক সূত্র জানা গেছে, বর্তমানে খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। গতকাল তার আলট্রাসনোগ্রাম ও ইকো করা হয়েছে।
তিনি জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রণীত আইনের অধীনে ধানমন্ডিতে যে বাড়ি পেয়েছিলেন শেখ রেহানা, বিএনপি ক্ষমতায় এসে সে বাড়ি উচ্ছেদ করে। সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি করছে আর ‘লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে’ সেই পুলিশ ফাঁড়ি উদ্বোধন করেছে খালেদা জিয়া। ছেলে কোকোর মৃত্যুর পর তাকে (শেখ হাসিনা) খালেদা জিয়ার বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কীভাবে খালেদা জিয়ার জন্য আমার কাছ থেকে আরও সহানুভূতি আশা করে।’
লন্ডনের মেথোডিস্ট সেন্ট্রাল হল ওয়েস্টমিনস্টারে তার সম্মানে আয়োজিত একটি কমিউনিটি সংবর্ধনায় তিনি এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলা বিএনপির পক্ষে শোভা পায় না কারণ তারা জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ধোকাবাজি খেলেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন করে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার দেড় মাসের মধ্যেই দেশের জনগণ তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। তিনি বলেন, দেশের জনগণ কখনই ভোট কারচুপিকারীদের ক্ষমতায় বসতে দেয় না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রধান হিসেবে তার ওপর ন্যস্ত নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে এতিমদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড স্থগিত করার পর খালেদা জিয়াকে তিনি বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আইন অনুযায়ী যা করতে পারেন তাই করেছেন। অনেকেই এখন যুক্তি দিচ্ছেন, ‘আইন নিজের গতিতে চললেও খালেদা জিয়ার প্রতি আমি বেশি সহানুভূতি দেখাতে পারি’।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজেদুর রহমান ফারুক।
উত্তর-পূর্ব পাকিস্তানে একটি অঙ্গ পাচারকারী চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পুলিশ বলছে। চক্রটির নেতা ফাওয়াদ মুখতারের বিরুদ্ধে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষের কিডনি চুরি করে বের করে ধনী গ্রাহকদের মধ্যে প্রতিস্থাপন করার অভিযোগ রয়েছে।
মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা বিবিসি নিউজ।
বিবিসি জানায়, অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর দেহ থেকে কিডনি সরিয়ে ফেলা এবং ধনী গ্রাহকদের কাছে বিক্রির অভিযোগে ফাওয়াদ মুখতার নামের এক চিকিৎসক ও তার দলের আট সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে পাকিস্তান পুলিশ। ফাওয়াদ এ পর্যন্ত তিন শতাধিক রোগীর কিডনি চুরি করেছেন।
এমনকি অস্ত্রোপচারকালে কিডনি চুরির সময় তার হাতে অন্তত তিনজন রোগী মারা গেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ফাওয়াদ এর আগে পাঁচবার অসদাচরণের জন্য গ্রেপ্তার হলেও প্রতিবারই জামিন নিয়ে মুক্তি পেয়ে যান। রোববার (১ অক্টোবর) পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় পাকিস্তান পুলিশ। চক্রটি পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশের পাশাপাশি পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে কাজ করছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মহসিন নকভি রবিবার একটি সংবাদ সম্মেলনে জানান, “কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টগুলি বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনকে ক্লিনিক আকারে সাজিয়ে সেখানে রোগীদের অস্ত্রোপচার করার সময় রোগীদের অজান্তেই কিডনি সরিয়ে নেয়া হত।“
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফাওয়াদ মুখতার জানিয়েছেন, তার নেতৃত্বাধীন চক্র এখন পর্যন্ত মোট ৩২৮ রোগীর দেহ থেকে কিডনি চুরি করেছে। প্রতিটি কিডনি বিক্রি হয়েছে ১ কোটি রুপি করে।
২০১০ সালে মানবদেহের প্রত্যঙ্গ ব্যবসা নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান। এ অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মোটা অঙ্কের জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।