
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা জাতি; শুরু হয় দেশের উল্টো যাত্রা– ষড়যন্ত্রকারী, একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও ঘাতকদের আস্ফালন। হত্যা, নির্যাতন, গুম-খুনের আতঙ্কিত জনপদে শুরু হয় সামরিক শাসন। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছিলেন, ‘সে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি– বঙ্গবন্ধুর সমর্থক, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার-নির্যাতনের খড়গ। শোক প্রকাশের ভাষাকে বন্দুকের নলের নিচে স্তব্ধ করে রাখা হয়েছে! কেউ কথা বলতে পারছে না! বঙ্গবন্ধু তখন দেশে নির্বাসিত নাম– তিনি নিষিদ্ধ– তার নাম উ”চিারণ করা যায় না!’ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে সমকালীন শিল্পসাহিত্য থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিতে চেয়েছিল। ফলে এ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জীবন বাজি রেখে কবিতা লিখেছিলেন বাংলাদেশের কবিরা।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি কবিতা লেখা কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছন ‘বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে কবিতা লিখতে হয়েছে’। ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ শিরোনামে সে কবিতা তিনি ১৯৭৭ সালে একুশের ভোরে বাংলা একাডেমির কবিতা পাঠের আসরে পাঠও করেছেন অসীম সাহস নিয়ে। কবিতাটির সাহসী উচ্চারণ : ‘শহীদ মিনার থেকে খসেপড়া একটি রক্তাক্ত ইট/ গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।/ আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।’ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম প্রকাশ্যে পঠিত কবিতা এটি।
তবে কবি নির্মলেন্দু গুণ নিজেই ১৯৯০ সালের দিকে একটি লেখায় উল্লেখ করেন, “তবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর রচনাকালের দিক থেকে প্রথম কবিতার জনক আমি নই, অন্য কেউ। আমার আগে আরবি শিক্ষক, বঙ্গবন্ধুর বাল্যবন্ধু মৌলভী শেখ আবদুল হালিম আরবি ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা রচনা করেন। আরবি থেকে তিনি নিজে বাংলা করেন এবং আমি সেটি কাগজে লিখে নিই। তিনি বঙ্গবন্ধুর মরদেহ কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে সমাধিস্থ করার পর মনোবেদনা থেকে আরবিতে কবিতাটি লেখেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর এটিই প্রথম কবিতা’’।
‘বঙ্গবন্ধু হত্যার দলিল’-এর বরাত দিয়ে লেখক কবিতাটি উদ্ধৃত করেছেন এভাবে‘হে মহান, যাঁর অস্থি-মজ্জা, চর্বি ও মাংস এই কবরে প্রোথিত।/ যাঁর আলোতে সারা হিন্দুস্থান, বিশেষ করে বাংলাদেশ-আলোকিত হয়েছিল।/ আমি তোমার মধ্যে তিনটি গুণের সমাবেশ দেখেছি ক্ষমা, দয়া ও দানশীলতা।/ নিশ্চয়ই তুমি বিশ্বের উৎপীড়িত এবং নিপীড়িতদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলে।/ সেই হেতু অত্যাচারীরা তোমাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে,/ আমি আমরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের বিচারের প্রার্থনা জানাই,/ যারা তোমাকে বিনা বিচারে হত্যা করেছে।’
এর পরের কবিতাটি লেখেন বাংলাদেশের উর্দুভাষার কবি নওশাদ নূরী। বাংলাদেশের প্রধানতম উর্দু কবিদের একজন তিনি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট তিনি ‘উত্থান-উৎস’ কবিতাটি লেখেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে তাকে নিয়ে লেখা দ্বিতীয় কবিতা এটি। কবিতায় তিনি বলেছেন “... সে আছে, সে আছে-/ সর্বদা হাজির সে যে, অফুরান শক্তি হয়ে/ সে আছে, সে আছে/ সে অমর, মৃত্যুঞ্জয়ী, মৃত্যু নেই তার। [অনুবাদ : আসাদ চৌধুরী]। ৭৫-এর ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর দাফনের পর তিনি লেখেন ‘নজম টুঙ্গিপাড়া’ শীর্ষক কবিতাটি। এ কবিতায় বলেন তোমরা কি জানো? তোমরা কী জানো?/ পথের শুরুটা হয়েছিল এইখানে,/ পথ খোয়া গেল, হায়, সেও এইখানে।/ [অনুবাদ : আসাদ চৌধুরী]
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রকাশিত সরাসরি শোক ও প্রতিবাদী কবিতার সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৭৭ সাল থেকে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন প্রকাশ করত ‘জয়ধ্বনি’ পত্রিকা। সে পত্রিকায় ১৯৭৭ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের) ‘জাতীয়তাময় জন্মমৃত্যু’ নামে কামাল চৌধুরীর কবিতা প্রকাশিত হয়। এই কবিতার লাইন ‘রক্ত দেখে পালিয়ে গেলে/ বক্ষপুরে ভয়, ভাবলে না কার রক্ত এটা/ স্মৃতিগন্ধময়, দেখলে না কার জন্ম-মৃত্যু জাতীয়তাময়’ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের দেয়ালে পোস্টার সাঁটা হয়েছিল তখন। এ কবিতাটিকে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত মাসিক সমকাল পত্রিকার বিজয় দিবস সংখ্যা ১৩৮৫-তে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে প্রথম প্রকাশিত কবিতা বলে উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৭ সালের ২৬ মার্চ আদমজী জুট মিলের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কামাল চৌধুরী প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা পাঠ করেন।
অর্থাৎ, প্রাপ্ত রেকর্ড অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম কবিতাটি রচিত হয় আরবিতে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি উর্দুতে। চতুর্থটি বাংলায়। সেটি লেখেন প্রখ্যাত সাংবাদিক-কবি সন্তোষ গুপ্ত, ১৯৭৫ সালে। রচনার তারিখ নির্দিষ্ট করে জানতে পারিনি। কবিতার নাম ‘রক্তাক্ত প্রচ্ছদের কাহিনী’।
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম লিখেছিলেন, যা তার ‘কাঁদো প্রিয় দেশ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়। তবে অন্নদাশঙ্কর রায় এটিও পরে ১৯৭৮/১৯৭৯ সালের দিকে প্রকাশিত হয়। কাছাকাছি সময়ে ১৯৭৭ সালে সমকাল পত্রিকা ঊনবিংশ বর্ষ প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল মহাদেব সাহার ‘কফিন কাহিনী’। ১৯৭৭ সালের পর ১৯৭৮ সালে বেশ কটি সাহিত্য প্রতিবাদ চোখে পড়ে। এসময় ১৯৭৮ সালে সমকাল পত্রিকায় মোহাম্মদ রফিকের ‘ব্যাঘ্র বিষয়ক’, নির্মলেন্দু গুণের ‘আমি কারো রক্ত চাইতে আসিনি’, ‘রাজদণ্ড’সহ কামাল চৌধুরী, ত্রিদিব দস্তিদার, শাহজাহান চৌধুরীর কয়েকটি প্রতিবাদী কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যতরুণ গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ নামে প্রতিবাদী কবিতা সংকলন প্রকাশ করে। এ সংকলনটি বঙ্গবন্ধু-হত্যার পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত প্রথম প্রকাশিত সংকলন। মোট ৩০ জন কবি ও ছড়াকার এ সাহসী সংকলনে লিখেছেন। তার মধ্যে কয়েকজন গল্পকার ও ঔপন্যাসিকও ছিলেন। এ সংকলনে যারা লিখেছেন তারা হলেন : অন্নদাশঙ্কর রায়, দিলওয়ার, হায়াৎ মামুদ, রাহাত খান, মাশুক চৌধুরী, ফরিদুর রহমান বাবুল, সুকুমার বড়–য়া, মোহাম্মদ মোস্তফা, মাহমুদুল হক, আমিনুল ইসলাম বেদু, নির্মলেন্দু গুণ, তুষার কর, আলতাফ আলী হাসু, মোহাম্মদ রফিক, আবদুল আজীজ, শান্তিময় বিশ্বাস, আখতার হুসেন, ভীষ্মদেব চৌধুরী, জিয়াউদ্দীন আহমদ, জাহিদুল হক, ইউসুফ আলী এটম, সিরাজুল ফরিদ, ফজলুল হক সরকার, লুৎফর রহমান রিটন, নূর-উদ্-দীন শেখ, মহাদেব সাহা, জাফর ওয়াজেদ, ওয়াহিদ রেজা, কামাল চৌধুরী ও খালেক বিন জয়েন উদ্দীন।
১৯৭৮ সালের ১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনসুর আলী মিনার (মিনার মনসুর) ও দিলওয়ার চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় এপিটাফ। এখানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেশ কটি কবিতা প্রকাশিত হয়। যাদের কবিতা এ সংকলনভুক্ত তারা হলেন : ইউসুফ পাশা, তারাপদ রায়, সানাউল হক খান, ময়ুখ চৌধুরী, মুশফিক হোসাইন, নিতাই সেন, মনসুর আলী মিনার, মৃণাল বড়–য়া, নাজিম উদ্দিন নাজু, শাহাবুদ্দীন নাগরী, দিলওয়ার চৌধুরী, ওমর আলী, আসাদ মান্নান।
১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে সাপ্তাহিক মুক্তিবাণী পত্রিকায় বেশ কটি প্রতিবাদী কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৭৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জে ওয়াহিদ রেজা ও হালিম আজাদের নেপথ্য সম্পাদনায় ‘ড্যাফোডিল এফিউসন গ্রুপ’ প্রকাশ করে ‘পৃথিবী কাছে নোটিশ’। এতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকগুলো কবিতা প্রকাশিত হয়। এতে যাদের লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তারা হলেন : অন্নদাশঙ্কর রায়, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, রাহাত খান, ওয়াহিদ রেজা, ইউসুফ পাশা, শিখা চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক, বজলুর রায়হান, বাকী বিল্লাহ, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, নজরুল ইসলাম মিন্টু, মনীন্দ্র ঘটক, হালিম আজাদ, ইউসুফ আলী এটম, আনিসুর রহমান, শামিমা বেগম, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, গৌতম সরকার, রফিউর রাব্বি, মেহেদী ইকবাল, অশোক গুহ, নাহিদ আজাদ, ফজলুল বারী, মো. আসাদুজ্জামান, নিরঞ্জন রায় নিরু, স্বপন দেব।
সে সময় মিজানুর রহমান মিজান সম্পাদিত খবর পত্রিকাও সাহসী ভূমিকা পালন করে। খবর প্রকাশনী আরামবাগ থেকে ১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্ট আবু হাসান শাহরিয়ার ও সৈয়দ আল ফারুকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ নামে সংকলন। যাদের লেখা কবিতা/ ছড়া অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তারা হলেন : দিলওয়ার, অরুণাভ সরকার, আসাদ চৌধুরী, রাহাত খান, জুলফিকার মতিন, মোহাম্মদ রফিক, ফজল-এ-খোদা, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, ফারুক মাহমুদ, মাহমুদুল হক, আবু হাসান শাহরিয়ার, সৈয়দ আল ফারুক, নাসির আহমেদ, লুৎফর রহমান রিটন, আনোয়ারুল কবীর বুলু, খালেক বিন জয়েন উদ্দীন, মনিরা কায়েস, আমীরুল ইসলাম, মাহমুদ উল্লাহ, মাশুক চৌধুরী, শামসুল ইসলাম, সিরাজুল ফরিদ, লতিফ মোহম্মাদ, তুহীন রহমান, মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম, রোকেয়া বেগম কেয়া, আতাউল করিম, সাইফুল্লাহ্ মাহমুদ দুলাল, আসলাম সানী, আনিসুর রহমান আখন্দ, যৌবন চৌধুরী, মনজুরুর রহমান, রিটন রহমান, ফজলুল হক সরকার।
১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্ট এস এম ইউসুফের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংকলন ‘বঙ্গবন্ধু’। এ সংকলনে যাদের কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তারা হলেন : সুফিয়া কামাল, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, মুহম্মদ নুরুল হুদা, ত্রিদিব দস্তিদার, ফিউরি খোন্দকার, কামাল চৌধুরী, এম কোরবান আলী দৈনিক সংবাদ পত্রিকাও তখন সাহসী ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় গ্রন্থাকারে মিনার মনসুর ও দিলওয়ার চৌধুরী সম্পাদিত সংকলন গ্রন্থ ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’। এতে যাদের কবিতা রয়েছে তারা হলেন : অন্নদাশঙ্কর রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, জাহিদুল হক, ওমর আলী, শাহাদাত বুলবুল, ফজলুল হক সরকার, শামসুল আলম সাঈদ, খালিদ আহসান, কামাল চৌধুরী, মিনার মনসুর, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, জাফর ওয়াজেদ, দিলওয়ার চৌধুরী, আলমগীর রেজা চৌধুরী, হারুন রশিদ, নাজিম হাসান, সুজাউদ্দিন কায়সার, বিনতা শাহীন, সনজীব বড়–য়া, রবীন্দ্রনাথ অধিকারী, ইকবাল করিম, স্বপন দত্ত। ১৯৭৯ সালে আসলাম সানী ও ইউসুফ হাসান সম্পাদিত ‘শোক’ প্রকাশিত হয়। মোট ৩টি সংখ্যা প্রকাশিত হয় ‘শোক’ সংকলনে। এতে লিখেছেন : কামাল চৌধুরী, আলমগীর রেজা চৌধুরী, আসলাম সানী, লুৎফর রহমান রিটন, মাশুক চৌধুরী, জাফর ওয়াজেদ, রবীন্দ্রনাথ অধিকারী, ইউসুফ হাসান, মুহম্মদ নুরুল হুদা, সপ্তক ওসমান, ফজলুল হক সরকার, ফারুক মাহমুদ, ত্রিদিব দস্তিদার। কবি শামসুর রাহমান অনূদিত পাবলো নেরুদার কবিতা ‘শোক’ এর ৩য় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এছাড়াও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সংকলন, ‘মুজিব লোকান্তরে, মুজিব বাংলার ঘরে ঘরে (১৯৭৯)’ ইত্যাদিসহ বেশ কটি সংকলন প্রকাশিত হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ভারতের বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা কবি কবিতা লেখেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিত্তোরে সম্ভবত সত্তর দশকের শেষদিকে মনিপুরের অন্যতম শীর্ষ কবি এলাংবম নীলকান্ত ‘শেখ মুজিব মহাপ্রয়াণে’ শীর্ষক একটি কবিতা লেখেন যা তার ‘তীর্থযাত্রা’ (১৯৮৫) গ্রন্থে স্থান পায়। ‘শেখ মুজিব মহাপ্রয়াণে’ কবিতায় লিখেছেন: হে বঙ্গবন্ধু/ নিষ্ঠুর বুলেটের আঘাতে নিহত হয়েছো শুনে/ পেরিয়েছি আমি এক অস্থির সময়/ খোলা জানালা দিয়ে সুদূর আকাশের দিকে/ পলকহীন তাকিয়ে থেকেছি/ উত্তরহীন এক প্রশ্ন নিয়ে/ বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে গড়ে তুলেছিলে স্বদেশ তোমার/ কিন্তু এ কোন প্রতিদান পেলে তুমি? (অনুবাদ : এ. কে. শেরাম) গান্ধীকে নিয়ে কবি অরুণ মিত্র একটি কবিতা লেখেন ‘আজকের দিন যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আছে কাল, একশো গান্ধী যদি মিথ্যে হয় তবুও থাকে সত্য’ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এই পঙ্ক্তিতে গান্ধীর স্থানে মুজিব বসিয়ে শঙ্খ ঘোষ বলেন ‘আজকের দিন যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আছে কাল, একশো মুজিব যদি মিথ্যে হয় তবুও থাকে সত্য।’
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের কবিরা অসংখ্য কবিতা রচনা করেছেন– এ ধরনের কবিতায় শোকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যক্তি চরিত্র, অর্জন ও গৌরবের মহিমা। কোনো কোনো কবিতায় আমরা দেখি তার জীবন-সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ মিলেমিশে একাকার। বিজয়গাথা ও শোকের মিলিত প্রবাহে স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণে কবিতা হয়ে উঠেছে বাঙালির ইতিহাসেরও আকর। বিরুদ্ধ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কবিতাগুলো আমাদের জাতিসত্তার হাজার বছরেরও দীর্ঘ ইতিহাসের অন্তহীন পরিভ্রমণের রূপক যেসব ছিল বলেই পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে আবারও স্বমহিমায় শিল্প সাহিত্যে ও ইতিহাসে পুনরুজ্জীবন দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
তথ্যসূত্র : ১. মুজিবপিডিয়া (প্রধান সম্পাদক কামাল চৌধুরী, সম্পাদক ফরিদ কবির) ২. এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়, ১৯৭৮ ৩. শহীদ বঙ্গবন্ধুর ওপর রচিত প্রথম আরবি কবিতা, মাওলানা এম এ রহমান, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১৭ জুন ২০১১ ৪. রাজু আলাউদ্দিন গৃহীত নির্মলেন্দু গুণের সাক্ষাৎকার, বিডিআর্টস, ১৫ আগস্ট ২০১৫ ৫. নওশাদ নূরী ও তার একটি কবিতা, মফিদুল হক, দৈনিক যুগান্তর, ২৬ জুলাই ২০১৯
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের প্রতিটি দিক বাংলাদেশের লোকায়ত পরিম-লের সাধক কবিরা শ্রদ্ধার সঙ্গে কবিতা, গান, পুঁথি, নাট্যপালা প্রভৃতি আঙ্গিকে রচনা করেছেন। এমনকি এদেশের সাধক কবিরা ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের সঙ্গে শহীদ হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিবাদে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সম্প্রতি সেই ইতিহাস রচিত হয়েছে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি গ্রন্থে।
উল্লেখ্য, এদেশের সাধক কবিরা শুধু জাতির পিতাকে নিয়ে নয়, তার পূর্বপুরুষদের গৌরবময় ইতিহাসও গ্রন্থন করেছেন। এই বিষয়টি জানা যায়, স্বয়ং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শুরুতেই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, শেখ বংশের অতীত ইতিহাসের কথা তিনি দুই ভাবে জেনেছিলেন। প্রথমত বাড়ির মুরব্বিদের কাছ থেকে এবং দ্বিতীয়ত চারণ কবিদের গান থেকে। (শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ২০১২, পৃ. ৩) এমনকি ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে শেখ বংশের পূর্বপুরুষ শেখ কুদরতউল্লাহ কদু শেখের প্রতিবাদের কথাও বঙ্গবন্ধু জেনেছিলেন লোকগানের সূত্রে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘কুদরতউল্লাহ শেখের আধা পয়সা জরিমানা’র দু’একটি গানে ইংরেজ নীলকর কুঠিয়াল মি. রাইনের সাথে আইনি লড়াইয়ের কদু শেখের বিজয়গাথা বর্ণিত হয়েছিল।’ (প্রাগুক্ত, পৃ. ৫) বঙ্গবন্ধুর এই ভাষ্যের প্রমাণ স্বরূপ ইতিমধ্যে ‘কুদরতউল্লাহ শেখের আধা পয়সা জরিমানা’র গান ও পুঁথি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষের সমৃদ্ধ ও সংগ্রামী ইতিহাস নিয়ে বহু আগে থেকেই সাধক কবিরা যে গানের ঐতিহ্যিক চর্চা শুরু করেছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সেই চর্চার প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল। তাই তো তিনি যেখানেই গেছেন ব্যাকুল হয়ে শুনেছেন ভাব সাধকদের গান। অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচার বিভিন্ন অংশে বঙ্গবন্ধু নিজেই তার এই গানপ্রীতির কথা প্রকাশ করেছেন।
এছাড়া, এদেশের সাধক কবিদের গানের ভাষ্যেও বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাধক কবিদের আত্মিক সম্পর্ক এবং তাদের প্রতি অসাধারণ মমত্বের কথা। একটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। সুনামগঞ্জের বিখ্যাত সাধক কবি শাহ আবদুল করিম তার আত্মস্মৃতি শিরোনামের একটি বর্ণনাধর্মী গানের বাণীতে লিখেছেন “পূর্ণচন্দ্রে উজ্জ্বল ধরা/চৌদিকে নক্ষত্রঘেরা/জনগণের নয়নতারা/শেখ মুজিবুর রহমান/জাগরে জাগরে মজুর-
কৃষাণ॥/গণসংগীত পরিবেশন করলাম যখন/একশত টাকা উপহার দিলেন তখন॥/শেখ মুজি বলেছিলেন সৎ-আনন্দমনে/‘আমরা আছি করিম ভাই আছেন যেখানে॥” (শুভেন্দু ইমাম, শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র, ২০০৯, পৃ. ৫৩১)। এই গানের বাণীর ভেতর দিয়ে একই সঙ্গে সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। অন্যদিকে সাধক কবিদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম শ্রদ্ধার প্রকাশ দেখা যায়।
সাধক কবিদের গানে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার মতো প্রধানতম রাজনৈতিক-অভিজ্ঞা ভিন্নভাবে গৃহীত হয়েছে। সাধক কবি মোসলেম উদ্দিন বয়াতি লিখেছেন “শেখ মুজিবের ছয় দফা দিব্যজ্ঞানে বুঝতে হয়/কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্যের ভাবাশ্রয়।” (সাইমন জাকারিয়া, সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি, ২০২০, পৃ. ১৮২) এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার রাজনৈতিক-অভিজ্ঞা আত্মিক-আধ্যাত্মিক ও দেহ-সাধনার ঐতিহ্যিক ভাবাদর্শের সঙ্গে তুলনীয় করেছেন। এর কারণও রয়েছে, সাধক কবিদের চোখে বঙ্গবন্ধু কোনো সাধারণ মানুষ ছিলেন না, ছিলেন স্বয়ং স্রষ্টার আশীর্বাদপুষ্ট মহামানব বা পয়গম্বর। তাই তো সাধক কবির বর্ণনায় বঙ্গবন্ধুর
নামের মূল অংশ অন্বেষণ করেছেন পবিত্র কোরআন থেকে। পাবনার সুফি সাধক কবি ফকির আবুল হাশেম লিখেছেন “মুজিব একটি আরবি শব্দ কোরানে প্রচার/সুরা হুদের পঞ্চম রুকু শেষ আয়াতের মাঝার/ইহার অর্থ উত্তরদাতা সংগ্রাম প্রতিবাদ/সত্যকে সে প্রশ্রয় দিয়ে মিথ্যার কাটে খাদ।” (প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪) বঙ্গবন্ধুর নাম থেকে শুরু করে তার আগমনের বিষয়কে সাধক কবিরা তাদের নিজের দর্শন, সাধনা ও পর্যবেক্ষণের আলোকে প্রকাশ করেছেন। যেমন, মানিকগঞ্জের সুফি সাধক কবি সাইদুর রহমান বয়াতি বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বস্রষ্টার ত্রিযুগের মহিমার ভেতর ভিন্নভাবে আবিষ্কার করে ত্রিরতœনামা পুঁথি লিখেছেন। পুঁথির মধ্যে তিনি লিখেছেন “পাক কোরানে আলিফ লাম মি তিনটি অক্ষর আছে/আজ অবধি তিনের মূল ভেদ গোপন রয়েছে।/আল্লাহ আলম আর মোহাম্মদ হকিকতির মূল/ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এ ব্রহ্মান্ডের ফুল॥/এক হইতে তিনের সৃজন তিনে একেশ্বর/তিনটি মিলে চলছে জগতের কারবার॥/...মানবকুলে যে তিন বস্তু থাকা প্রয়োজন/রবীন্দ্র, নজরুল, শেখ মুজিবর মিলেছে তিনজন॥... হায়! রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্ম অংশ মানব অবতার/মানুষের মঙ্গল কামনায় জীবন কাটে তার।/নজরুল ইসলাম কাজী বংশ বিদ্রোহী খেতাব/স্বাধীনতার অগ্নিশিখায় অনুতাপ।/মুজিবুর রহমান তাহার চিন্তা ছিল মুক্তি/দেশের নাম তাই বদল করেছে পেয়ে জনশক্তি।” (প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৮-২৭৯) প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাধক কবিদের গানে বঙ্গবন্ধুর ভিন্নতর প্রতিকৃতি অঙ্কিত হয়েছে। যে প্রতিকৃতিতে তিনি তার জীবনব্যাপী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় শুধু জাতির পিতা নন, একজন অবতার বা পয়গম্বরে পরিণত হয়েছেন। এতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সাধক কবিদের সীমাহীন ভক্তি, প্রেম ও বিশ্বাসের সম্পর্ক রয়েছে।
সাধক কবিদের রচনায় বিচিত্র আঙ্গিকে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ গ্রন্থিত হয়েছে। যথা১. বর্ণনাধর্মী পুঁথি-গান বা পুঁথিকাব্যে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি প্রসঙ্গ, ২. জারিগানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মাহাত্ম্য ও ১৫ই আগস্টে সপরিবারের শহীদ হবার ঘটনার বর্ণনা এবং ৩. লোকগানের অন্যান্য আঙ্গিকে বঙ্গবন্ধু বন্দনা।
পুঁথিকাব্যে মূলত ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সংগ্রামের ইতিহাস ও দূরদর্শিতার কথা বর্ণিত হতে দেখা যায়। এই ধারা ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শহীদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধক কবিদের অনেকের পুঁথি সাহিত্য রচনা, প্রকাশ ও পরিবেশনের তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রচিত ও প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক দুটি উল্লেখযোগ্য পুঁথিকাব্য হলো কিশোরগঞ্জের বাউল কবি মো. তাহেরউদ্দিন খানের বাংলাদেশ কবিতা ও সংগ্রামী কবি আবদুল খালেকের জয় বাংলার পুঁথি। প্রথম দিকের এসব পুঁথিকাব্যে বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ এসেছিল বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে সমন্বিতভাবে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় মূলত মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় ও জাতীয় ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী ও অগ্রণী রাজনৈতিক ভূমিকার কথা বর্ণিত হয়েছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ঠিক পর পর ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সাফল্যগাথা বর্ণনা করে পুঁথিকাব্য রচনা, প্রকাশনা ও পরিবেশনের ধারা সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে বঙ্গ-বিষাদ নামে উল্লেখযোগ্য একটি পুঁথি রচনা, প্রকাশনা ও পরিবেশনের মাধ্যমে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন নরসিংদীর পুঁথিকার দারোগ আলী (১৩৩৪-১৪২৪ বঙ্গাব্দ)। তিনি তার বঙ্গ-বিষাদ পুঁথিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতিটি কালপর্ব ও ঘটনায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও সাফল্যের কথা বর্ণনা করেন। এছাড়া, এই কালপর্বে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়ে যেসব পুঁথিকাব্য রচিত ও প্রকাশিত হয়েছিল তার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকায়ত গীতিকবি ও পুঁথিকার যামিনী কুমার দেবনাথ ওরফে যামিনী সাধুর জয় বাংলার হত্যাকা-, গাজীপুর জেলার পুঁথিকার ইদ্রিস আলী মিঞা’র স্বাধীন বাংলার কবিতা ও রাজাকারের ডায়েরি, ঢাকা জেলার সাহাবদ্দিনের এহিয়ার হত্যাকা-, নরসিংদীর পুঁথিকার গিয়াসুদ্দিনের সোনার বাংলা করিলে শ্মশান, টাঙ্গাইল জেলার পুঁথিকার আমীর আলীর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের কবিতা, নরসিংদীর পুঁথিকার আজিজুল হকের বাংলা স্বাধীনতার কবিতা, নরসিংদীর পুঁথিকার মফিজউদ্দিনের ২১ দফার কবিতা ও (চাষির দুঃখবর্ণনা), দর্জালের সিংহাসন অবশেষে পলায়ন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। (মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান, বাংলাদেশের লোকসাহিত্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধ, ২০২০, পৃ. ১৭-১৭৫)
তৃতীয় পর্যায়ে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ঘাতক কর্তৃক সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর শহীদ হওয়ার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পুঁথিকাব্য রচনা, প্রকাশনা ও পরিবেশনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন পাবনার ফকির আবুল হাশেম। তিনি ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্টের প্রায় তিন বছর পর সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর বংশপরিচয় ও তার কর্মময় জীবনের কাহিনি শীর্ষক রচনা ও প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে এই পুঁথিটি তিনি পাবনা জেলার হাটে-বাজারে পাঠ করে বিক্রি করতেন। এছাড়া, ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনার পর বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনৈতিক জীবনসংগ্রাম নিয়ে পুঁথি রচনা ও পরিবেশন করেন মানিকগঞ্জের সাইদুর রহমান বয়াতি, নেত্রকোনার আবদুল হেলিম বয়াতী, কিশোরগঞ্জের লাল মাহমুদ প্রমুখ। সাম্প্রতিককালে রচিত বঙ্গবন্ধু বিষয়ক পুঁথির মধ্যে কক্সবাজারের মাস্টার শাহ আলমের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাহিনী ও পুঁথিকাব্যে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বা পুঁথিকাব্যে বঙ্গবন্ধু, গোপালগঞ্জের মনোরঞ্জন বালার বঙ্গবন্ধু গীতিকাব্য, গোপালগঞ্জের শেখ মিজানুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ ও শোক দিবস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
উল্লেখ্য, কারবালার প্রান্তরে মর্মান্তিকভাবে সপরিবারের ইমাম হোসেনের নিহত হওয়ার ঘটনাকে অবলম্বন করে যেমন জঙ্গনামা, জারি জঙ্গনামা, শহিদে কারবালা, হোসেন শহিদ প্রভৃতি নামে ছন্দভাবে অসংখ্য পুঁথিকাব্য রচিত হয়েছিল। যা পরবর্তীকালে জারি-মর্সিয়া গানে রূপান্তরিত হয়েছিল। তেমনি ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্টে নিজগৃহে মর্মান্তিকভাবে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার ঘটনাকে অবলম্বন করেও অসংখ্য পুঁথিকাব্য রচনার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জারি-মর্সিয়া গানের ধারা প্রবর্তিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত পুঁথিকাব্যে প্রাসঙ্গিকভাবে কারবালার ট্রাজেডির সঙ্গে তার হত্যাকা-ের ঘটনাকে তুলনা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যকারীদের এজিদ ও সীমারের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মানিকগঞ্জের সাইদুর রহমান বয়াতির বঙ্গবন্ধু মুজিবনামা বা মুজিব শহিদ, রাজশাহীর মোহাম্মদ আব্দুল আলিম ফকিরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের জন্ম ও পরিবার বিষয়ে জারিগান, হবিগঞ্জের বাউল আব্দুর রহমানের বঙ্গবন্ধু বিষয়ক জারিগান, গোপালগঞ্জের শেখ মিজানুর রহমানের শোক দিবসের জারি, কক্সবাজারের মাস্টার শাহ আলমের মুজিব শোকের জারিগান প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের সাধক কবিদের অনেকে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষদর্শী। অনেকে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে তাকে নিয়ে রচিত গান পরিবেশন করেছিলেন। অনেকে আবার বঙ্গবন্ধুর ডাকে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কয়েকজন স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে শব্দসৈনিকের ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া, কিছুসংখ্যক সাধক কবি প্রত্যক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য না পেলেও বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও আদর্শকে ধারণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান রচনায় তাদের সংগীত জীবনকে সার্থক করেছেন। বাংলাদেশের সীমান্তের বাইরের তথা বাংলাদেশের সীমান্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের সাধক কবিদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান রচনা ও পরিবেশন করেছিলেন। সাধক কবিদের বিচিত্র ধরনের গানে অনেক বিস্তৃত ও ব্যাপকভাবে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতির নানা দিক রূপায়িত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। যেসব সাধক কবিদের গানে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তারা হলেন নেত্রকোনার আবদুল মজিদ তালুকদার, সুনামগঞ্জের শাহ আবদুল করিম, কামাল পাশা, দুর্বিন শাহ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, মছরু পাগলা, মানিকগঞ্জের নূর মেহেদী, আবদুর রহমান, শরিয়তপুরের ইউসুফ মিয়া, চট্টগ্রামের ফণী বড়–য়া, সুনামগঞ্জের চট্টগ্রামের আবদুল গফুর হালী, ঢাকার ভবা পাগলা, নড়াইলের মোসলেম উদ্দিন বয়াতি, বিজয় সরকার, বাগেরহাটের রসিকলাল সরকার, ঢাকা-ফরিদপুরের আবদুল হালিম বয়াতি, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের হযরত আলী বয়াতি, পাবনার ফকির আবুল হাশেম, শরিয়তপুরের ইউসুফ মিয়া, যশোরের তোরাব আলী শাহ, কুষ্টিয়ার মকছেদ আলী সাঁই, মানিকগঞ্জের মহিন শাহ, ফরিদপুরের আয়নাল বয়াতি, ঢাকার মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান, বরিশালের শাহ আলম দেওয়ান, হবিগঞ্জের বাউল আব্দুর রহমান, ঢাকার নীল রতন সরকার, কুমিল্লার বাউল তাহমিনা, চুয়াডাঙ্গার খোদাবক্স সাঁই, আব্দুল লতিফ শাহ, ফরিদপুর আরিফ বাউল, মানিকগঞ্জের বাউল অন্তর সরকার, সিরাজগঞ্জের গুঞ্জের আলী জীবন, কুষ্টিয়ার রেজাউল হক সলক, শরিফুল শেখ প্রমুখ। আগেই বলা হয়েছে যে, সাধক কবিদের গানে কোথাও কোথাও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সাধক কবিরা তাকে এমন একটি উচ্চতা ও মাহাত্ম্য প্রদান করেছেন যে, তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালির জীবনের ত্রাণকর্তা বা অবতার।
অনেকেই আমাকে বঙ্গবন্ধুর সহচর বলে কথা বলতে আসেন। প্রকৃতপক্ষে আমি উনার সাহচর্যে এসেছি, ওনার সঙ্গে রাজনীতি করেছি। এখন আমার বয়স ৮৫ বছর। ওই সময়ের বেশিরভাগ মানুষই এখন আর নেই। এ কথা মিথ্যে নয় যে এই মহান নেতার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি...। আর সব স্মৃতি গিয়ে ঠেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোক কমে এলেও ভার কমেনি আজও। অনেক কথাই মনে পড়ে।
১৯৭৫ সালের আগস্টে আমি ঢাকায় ছিলাম। বাংলাদেশ-রাশিয়া মৈত্রী সমিতির গোপালগঞ্জ শাখার আমি প্রেসিডেন্ট ছিলাম। আমাদের ১৮ তারিখে রাশিয়া যাওয়ার কথা ছিল। ঢাকায় গিয়ে পাসপোর্ট রেডি করলাম। কথা ছিল, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিজে আমাদের তিনজনের হাতে ভিসা তুলে দেবেন। ভোরবেলা ঘুম ভাঙল আমার বড় শ্যালকের ডাক শুনে, ভাই শিগগিরই ওঠেন, সারা দেশে মার্শাল ল’ জারি হয়েছে। আমি লাফ দিয়ে উঠলাম। রেডিওতে আমার শ্বশুর শুনলেন মেজর ডালিম বলছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। সব শেষ হয়ে গেল। জীবনটাই স্থবির হয়ে গেল যেন। কারফিউ জারি হলো, কেউ আর বাসা থেকে বের হয় না।
আমি ১৮ দিন পর গোপালগঞ্জ ফিরেছিলাম। সব সুনসান, কোথাও কিচ্ছু নেই। মানুষ আসছে যাচ্ছে, সব চুপচাপ। কেউ মুখের দিকে তাকাচ্ছে না...। অথচ মনে পড়ে, ৭১ সালে যুদ্ধের পর আমি যখন গোপালগঞ্জে ফিরি, তখন পাড়ার মুরব্বিরাও আমাকে এসে সালাম দিয়ে গেছে, কথা বলেছে। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর পর আর মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীনের পর গোপালগঞ্জে ফিরে আসার এই স্মৃতি দুটি আমার প্রায়ই মনে পড়ে। দেশটা যেন সেদিন থেকে বদলে গেল!
ছোটবেলা থেকেই আমি বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে এসেছি, আমাকে উনি খুবই স্নেহের চোখে দেখতেন। তাকে প্রথম দেখি ১৯৪৮ সালে, আমি তখন খুলনা জেলা স্কুলে পড়ি। আর বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজ থেকে পাস করে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ল’তে ভর্তি হয়েছেন। সোহরাওয়ার্দী তখন কলকাতায় থাকতেন। বঙ্গবন্ধু উনার কাছ থেকে পরামর্শ নিতে যেতেন। তো আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। তখন তো বেশি রাত জাগতাম না, অল্প একটু পড়াশোনা করে, তারপর শুয়ে পড়েছি। খুলনাতে আগ্রাবাদে, তখন তার নাম ছিল শ্রীশ নগর, আমাদের ওই বাসাটায় দোতলায় দুটি ঘর। একটা ঘরে আমার চাচা, আর একটা ঘরে আমি থাকতাম। তো রাতে আমি শুয়ে পড়ি, আর খুব ভোরে ঘুম ভেঙে দেখি আমার খাটে সাদা চাদর দিয়ে আগামাথা মুড়ি দেওয়া একটা লম্বা লোক শুয়ে আছে। আর আমি পাশের ছোট খাটে শোওয়া। আমি বুঝতে পারছিলাম না ছোট খাটে আমি এলাম কখন, কীভাবে। এর মধ্যেই আমার চাচা এসে তখন উনাকে ডাকছেন, ভাইজান ওঠেন, ভাইজান ওঠেন। উনি উঠে বললেন কী হয়েছে হাবিব! চাচা তখন বললেন স্টিমারের তো টাইম হয়ে যাবে। তখন খুলনা থেকে মাদারীপুর যাওয়ার স্টিমার ছাড়ত সকালবেলা। সেই স্টিমারে উনি যাবেন। আগের দিন রাত সাড়ে ১০টায় খুলনায় নেমেছেন। খুলনায় এসে উনি সাধারণত আমাদের বাড়িতেই উঠতেন। আমার সেই চাচা হলো বঙ্গবন্ধুর শিষ্য, উনার এখানেই উঠতেন। খুব ভালোবাসতেন। তো সকালে উঠে উনাকে পরটা গোশত ভুনা নাশতা দেওয়া হলো। উনি সেটা দেখে আমাদের কাজের মহিলাকে ডেকে বললেন, ‘এসব না দিয়ে যদি লাল চালের ভাত দিয়ে পান্তাভাত আর কই মাছ ভাজা দিতা, তাইলে খাইয়া আরাম পাতাম।’ খাবার টেবিলে বসে তিনি আমার চাচাকে বললেন, ছাত্রলীগ গঠনের কথা। তখন তো অত বুঝি না, কিন্তু এটুকু আমার মনে আছে, উনি বললেন, ছাত্রলীগ গঠন করতে হবে। সেই প্রথম দেখা।
এরপর ১৯৪৯ সালে আমার বাবা গোপালগঞ্জের ব্যাংক পাড়ায় চলে আসেন। আমি সেভেনে এস এন স্কুলে ভর্তি হলাম। এখানে আসার পর আরও ভালোভাবে বঙ্গবন্ধুকে দেখা। তখন তো উনি প্রায়ই রাজনীতির জন্য জেলে যেতেন। আর প্রতিবারই জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় দল বেঁধে তাকে রিসিভ করা হতো। এটা ছিল নিয়মিত ঘটনা। একবার উনি জেল থেকে বের হবেন, আমরা সবাই মালাটালা বানিয়ে উনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। উনাকে জেলগেট থেকে মালা দিয়ে বরণ করে আনলাম। উনার একটা হোল্ডার ছিল সঙ্গে, স্যুটকেস ছিল, সেগুলো বাড়িতে দিয়ে এলাম। গোপালগঞ্জের বাসায়, উনি সেখানে বড় ঘরে উঠতেন। তো উনি জেল থেকে বের হয়ে মসজিদের সামনে বক্তৃতা করছেন, ২০ মিনিটও হয়নি, আবার পুলিশ এসে আরেক মামলায় তাকে ধরে নিয়ে গেল। আমরা সবাই মনঃক্ষুণ্ন হয়ে ফিরে গেলাম।
এমন অনেক স্মৃতি আমাকে তাড়া করে ফেরে। সবাই মুজিব ভাই বললেও আমি তাকে চাচা বলে ডাকতাম। একদিন স্কুল থেকে ফিরছি, বসার ঘরের সামনে উনি একটা ফোল্ডিং চেয়ারে বসা। উনি আমাকে হাত ইশারা করে ডাকলেন। গিয়ে দেখি উনার কাছে একটা ফটো অ্যালবাম। নিজের একটা ছবি বের করে বললেন, এটা পছন্দ হয়? দেখি গোঁফ উঁচানো উনার একটা সুন্দর ছবি। আমাকে নিজের নাম সই করে ছবিটা দিয়ে দিলেন তিনি। ছবিটা আমার কাছে ছিল বহুকাল। উনার কন্যা শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে পার্টি প্রেসিডেন্ট হলেন, তখন তার পিএস একবার আমার কাছে ছবিটা দেখে বলেন, এই ছবি আপনি কোথায় পেলেন? আমি বললাম, এটা আমাকে বঙ্গবন্ধু নিজে দিয়েছিলেন। ওই ছবি দিয়েই, উনি চীনে যাওয়ার পাসপোর্ট করেছিলেন। তো উনি বললেন আমাকে এটা দেন, আমি কপি করে আবার আপনাকে দিয়ে দেব। ওই ছবিটা আমাকে আর ফেরত দেয়নি কোনোদিন। সেই ছবির কপি দেখি এখন অনেক জায়গায়। ছবিটা ছিল আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহ!
ওই সময় তো আন্দোলনের সময়। প্রত্যেকদিন স্কুল থেকে সব ছেলেদের নিয়ে বের হয়ে আমরা মিছিল করতাম। উনি তখন স্কুলের সামনে আমগাছের নিচে নিয়মিত বক্তৃতা করতেন। সে সময় থেকেই আমি ছাত্রলীগ করি। এরপর যখন স্কুল পাস করে বিএল কলেজে ভর্তি হই, তখন আবার পাই বঙ্গবন্ধুকে। একবার খুলনায় মিটিং করতে গিয়ে উনি সবুর মিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে একটা বক্তৃতা দেন। তার কয়েকদিন পর ছাত্রলীগের কনফারেন্স ওখানে। তো উনি এলেন সেই কনফারেন্স করতে। থানার সামনে ডেরা হোটেলে। মুসলিম লীগের গুণ্ডারা আর সেইসঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের কিছু ছেলেপিলে সেই হোটেলে দরজা আটকিয়ে আমাদের সে কি মার। আমরা কোনোরকমে পেছন দিয়ে পালিয়ে যাই। এরপর যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ল’ পড়ি, তখন উনি জিন্নাহ অ্যাভিনিউয়ে, এখন যেটা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, সেখানে চাকরি করতেন। তখন উনার কাছে মাঝে মাঝেই যেতাম।
আমাদের নেতা ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে আমার যে কত স্মৃতি! উনি প্রতিটা কাজ করতেন আগে থেকে পরিকল্পনা করে। আমরা হয়তো তখন সেটা বুঝিনি, এখন হিসাব মিলিয়ে দেখি উনি কোনো কাজই পরিকল্পনা ছাড়া করেননি। বেসিক ডেমোক্রেসির ইলেকশনের সময়, ফাতেমা জিন্নাহ যে ইলেকশন করেছিলেন, সেই সময়ের কথা মনে পড়ে। এখন যেখানে জেলা আওয়ামী লীগের অফিস, সেখানে শামিয়ানা টাঙিয়ে নিচে চাটাই বিছিয়ে সব চেয়ারম্যানদের, যারা ভোট দেবে, উনি রাতভর বসে থাকলেন তাদের নিয়ে। আমরাও ছিলাম সারা রাত। পরের দিন ইলেকশন শুরু, উনি বসে আছেন ভোটকেন্দ্রের বাইরে। সাড়ে ৩টার দিকে দেখি উনি পাইপ টানতে টানতে সেখান থেকে চলে আসছেন। আমরা দেখে দৌড়ে গেলাম। রেডিওতে খবর শুনছি ইলেকশনের, মুসলিম লীগের চেয়ে ফাতেমা জিন্নাহ বেশি ভোট পাচ্ছে। উনি বললেন, “এসব কিছু না, ঠকে যাবা। যাদের সঙ্গে সারা রাত বসে থাকলাম, ভোট দিয়ে আমার চোখের দিকে তারা আর তাকাতে পারে না। মুজিবুর রহমান কোনো সময় ভুল করে না। ওরা একটাও ভোট দেবে না। আমরা অনেক ভোটে হেরে যাব। তোমরা দেখো এরপর ঠকার খবর আসবে” ঠিক তাই হলো। এতটাই দূরদর্শী ছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে স্মৃতি আমাকে সবসময় আপ্লুত করে, চোখে পানি আনে সেটা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পরের ঘটনা। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো টুঙ্গিপাড়ায়। যখন অসহযোগ আন্দোলন চলে। সারা দেশ থেকে তখন লোক শুধু আসছে তার সঙ্গে দেখা করতে। বরিশাল, ভোলা, ঢাকা আরও দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার লোক আসছে লঞ্চে, নৌকায় করে। টুঙ্গিপাড়ার মতো অজ পাড়াগাঁয়ে এত লোক ওই সময়... কল্পনাই করা যায় না। পায়ের ধুলা নিচ্ছে কেউ কেউ, কান্নাকাটি করছে, উনি সবার সঙ্গে কথা বলছেন। সেই সময় ওই বাড়িতে আমি গেছি, ওই মামলায় উনার তখন ফাঁসির হুকুম হয়ে যাবে বলে ভাবত সবাই। আমি তখন গ্রামেগঞ্জে চাঁদা তুলে উনার মামলার খরচ জোগাতে সাহায্য করেছি। শুধু আমরা না, সব জায়গা থেকে আসত। সেই আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলা থেকে উনি যে বেঁচে ফিরে আসতে পারবেন কখনো, আমাদের ধারণাই ছিল না। কিন্তু তিনি ফিরে এসেছেন, আর এতদিন পরে উনাকে এভাবে দেখে, এসব দেখে সহ্য করতে পারছিলাম না, আমার কান্না এসে পড়ে। উনি আমাকে দেখে বললেন কে? আমি বললাম, আমি হাবিব শিকদারের ভাইয়ের ব্যাটা, আপনি আমাকে ভুলে গেছেন? উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন ওরে বাবা, তুই এখন কী করিস? একজন বলল, ওই তো আমাদের অফিস সেক্রেটারি, আর প্রচার সম্পাদক আওয়ামী লীগের। উনি বললেন ভালো করেছিস। খাওয়াতে চাইলেন আমাকে। খান সাহেব উনার চাচা, উনার মেজ মেয়ের জামাই হলো আমার মামা। সেই খান সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন। উনার স্ত্রী টেবিলে খাবার সাজিয়েছেন। এত খাবার! আমি তো অল্প খাই!
৭০ সালের ইলেকশন হলো। ইলেকশনের সময় উনি একদিনে ২০টা ৩০টা মিটিং করেছেন। মানুষ আর মানুষ, অসংখ্য মানুষ আসছে। উনি এক জায়গায় বক্তৃতা করেন, আবার আরেক জায়গায় যান। সেদিন ২১টা মিটিং করার পর উনি রাত সাড়ে ১১টায় মুকসুদপুর হয়ে গোপালগঞ্জে এলেন, নজির মিয়া মোক্তার সাহেবের বাসায়। সব নেতারা রয়েছেন। আমি উনার বাম পাশে, আমি তখন সবসময় উনার বাম পাশে বসতাম। উনাকে বললাম, চাচা, আমি মানুষকে ঘরে ঘরে গিয়ে ৬ দফা বুঝিয়েছি, প্রতিদিন মিটিং করেছি। আমাদের একটা ভোটও মার যাবে না। উনি দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার লোক আমি পেয়ে গেছি, কাশিয়ানী মুকসুদপুরের লোক আমি পেয়ে গেছি। এই দৃশ্য দেখে অনেকেরই মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। পরে অবশ্য আমি নিজেই রাজনীতি থেকে সরে আসি।
মানুষকে মোহিত করার যে কী অসীম ক্ষমতা তার ছিল। গোপালগঞ্জের রাস্তায় তিনি হাঁটলেই পেছনে লোক জড় হয়ে যেত। আমরা দোকানে বসে আড্ডা দিতাম। দেখি সবাই হৈ হৈ করে বলছে মুজিব ভাই আসছে। উনি এসে আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে বললেন, কী রে কেমন আছিস। আমি বললাম ওই দেখেন লতিফ ভাই আসছে, উনি কিন্তু এখন নিজামে ইসলাম করেন।
লতিফ ভাই, যার নামে এখন ইউনিয়ন হয়েছে। উনি তখন নিজামে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তো লতিফ ভাই বঙ্গবন্ধু আসবেন শুনে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাস্তায়।
আমার কথা শুনে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কী! নিজামে ইসলাম করে! চল দেখি!’ লতিফ ভাইকে উনি বললেন, ‘কি তুমি নাকি নিজামে ইসলাম করো!’ লতিফ ভাই বললেন, ‘কে বলেছে আপনাকে?’ উনি তখন লতিফ ভাইকে বললেন, আসো আমার সঙ্গে। এই বলে লতিফ ভাইকে বুকে টেনে নিলেন। সেই যে উনি এলেন আমৃত্যু আর লীগ ছেড়ে যেতে পারলেন না। আল্লাহ এমনই ক্ষমতা দিয়েছিলেন আমাদের নেতাকে।
তারপর দেশ স্বাধীন হলো। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে ফিরলাম। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট হলেন। পরে হলেন প্রাইম মিনিস্টার। তখন একবার গোপালগঞ্জে এসেছিলেন। আমরা মিটিং করলাম কলেজ মাঠে। মিটিং শেষে ডায়াসের ওপর আমি বঙ্গবন্ধুর বাম পাশে বসে আছি। আমি সবসময় তার বাম পাশেই বসতাম। কারণ উনার ডান হাতে থাকত একটা পাইপ। আমি সারা জীবন একটা সিগারেটে টান দিয়ে দেখিনি। আমার এই জিনিসটা ভালো লাগত না, তাই আমি উনার বাম পাশে থাকতাম। আমি উনাকে সিগারেট খেতেও দেখেছি। সেই যে ভোরবেলা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে খুলনার বাসায় প্রথম দেখা, তখনো তিনি সিগারেট খেতেন। যতদূর মনে পড়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পর ওনাকে পাইপ খেতে দেখেছি। মিটিং শেষে আমরা ছবি টবি তুললাম উনার সঙ্গে। যাওয়ার সময় উনি একটা কথা বললেন, “এই গোপালগঞ্জে আমার জন্ম, এইখানে আমি বড় হয়েছি, লেখাপড়া শিখেছি, এই নদীতে আমি সাঁতার কেটেছি। আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, যখন রিটায়ার করব, তখন এই জায়গায় এসে থাকব। এই জায়গাটা আমার খুব হোমলি লাগে, আমি এখানেই থাকব।” এটা উনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছিলেন। আর এখন সত্যিই তিনি এই গোপালগঞ্জের মাটিতেই শুয়ে আছেন।
আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ে প্রায়ই। বিএনপির প্রয়াত নেতা খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদের পিতা খন্দকার শামস্ উদ্দিন আহমেদকে নিয়ে। তিনি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির এমএলএ ছিলেন। ঘটনাটি ৭০ এর ইলেকশনের পরে। বঙ্গবন্ধু এসেছেন, সঙ্গে শেখ কামালও আছেন। খন্দকার সাহেব আমার সিনিয়র, উনি বললেন আমাকে মুজিবুরের সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও। আমি বুড়ো হয়ে গেছি, আমারে একটু দেখা করিয়ে দাও। আমি বললাম চলেন এখনই। উনাকে নিয়ে রিকশায় করে বঙ্গবন্ধুর বাসার সামনে নামলাম। এদিকে তখন বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তায় ইট বিছানো। ওরই মধ্যে উনাকে ধরে ধরে আনলাম। বঙ্গবন্ধু তখন খেতে বসেছেন। উনি আর কামাল। ঠিক সেইসময় আমি গেছি। আমাদের দেখেই উনি খাবারে আর হাত না দিয়ে উঠে এসে বললেন, ‘মামা আপনি এসেছেন কেন? আমাকে খবর দিলে আমিই আপনাকে দেখে আসতাম। আমি তো সময় পাই না।’ শামস উদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘তরে দেখতে ইচ্ছা করল।’ বঙ্গবন্ধু তখন কামালকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই আমার বড় ছেলে, আমাদের একটু দোয়া করেন।’ উনি মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন। এই ঘটনাটা আমার খুব মনে পড়ে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একবার উনার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম আমরা ৯ জন। এখানকার যারা নেতা সব, সঙ্গে আমিও গেছি। পার্টি অফিসে উনার সঙ্গে আমরা সবাই বসেছি, আর কেউ সেখানে ছিল না। তোফায়েল সাহেবকে উনি বলে দিলেন যেন আর কেউ না আসে সেখানে। বললেন, তোমরা এসেছ কেন বলো? তখন সালাম মোক্তার বলল আমাদের টেকেরহাট দিয়ে একটা রাস্তা করতে হবে, নাহলে আমরা তো কেউ এখানে আসতে পারি না। ৭ ঘণ্টা লাগে শুধু টেকেরহাট পার হতে। উনি বললেন, রাস্তা কোন জায়গা দিয়ে করতে হবে সেটা আমার জানা আছে, আমি রাস্তা করছি, আমার মাথায় আছে সেটা। আমি জানুয়ারি মাসে গোপালগঞ্জ যাব সেই রাস্তা দিয়ে। আমি অর্ডার দিয়ে দিয়েছি অলরেডি। আমি তখন সরকারি উকিল, আমি ওই ম্যাপ দেখলাম। এরপর বঙ্গবন্ধু বাকশাল করলেন, আমাকে করলেন থার্ড যুগ্ম সম্পাদক। বাকশাল সিস্টেমে জেলার সম্পাদক ছিলেন নজির সাহেব। যুগ্ম সম্পাদক যথাক্রমে কাজী আব্দুর রশিদ, বিরেণ বিশ্বাস এর পর আমি। তার পরে কামরুল ইসলাম রইস এবং শেখ আব্দুল্লাহ। আমি উনাকে বলিওনি কোনোদিন, উনি নিজেই আমাকে থার্ড যুগ্ম সম্পাদক করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর যখন ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি হলো, কে রাজাকার আর কারা খুনখারাবি করেছে এইগুলোর একটা জরিপ করার জন্য। গেজেট করে তার চেয়ারম্যান বানিয়েছিলেন আমাকে। আরেকটা কমিটির আমাকে চেয়ারম্যান করা হলো, সেটা হলো পুনর্বাসন কমিটি। একাত্তরে যারা বাড়িঘর ফেলে চলে গিয়েছিল, যাদের ঘরবাড়ি লুটপাট হয়েছিল তাদের সেগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য কমিটি। আমি জানি না কেন উনি আমাকে এত দায়িত্ব দিয়েছিলেন, কার কথায় করেছিলেন না নিজেই করেছিলেন জানি না। আমার বারবার মনে পড়ে, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আল্লাহ যদি দিন দেয় রে, গরিব মানুষের কোনো খাজনা দিতে হবে না। বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্ব না হলে এটা সম্ভব হতো না। আজ অনেকে তাকে ছোট করে দেখাতে চায়, যেটা তাদের দীনতা। ভাসানী, সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতাদের সান্নিধ্যে বঙ্গবন্ধু যখন গিয়েছেন, তখন তিনি ছিলেন তাদের ছাত্র। রাজনীতি শিখেছেন তাদের থেকে। কিন্তু শেষ বিচারে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে অবিসংবাদিত হয়ে উঠেছেন। তিনি যেখানেই গেছেন, যে মানুষের সঙ্গেই কথা বলেছেন সব জায়গায়, সবার মধ্যে এই প্রভাব তৈরি করতে পেরেছেন। সব শেষে বঙ্গবন্ধুর স্থান গান্ধী, জিন্নাহ, নেহরুর কাতারে।
অনুলিখন
বাংলাদেশে ফৌজদারি অপরাধে আইনের যে ধারায় শাস্তি দেওয়ার হয়, দণ্ডবিধি বা পেনাল কোড নামে আইনটি ১৬৩ বছরের পুরনো। বিচারের দিক-নির্দেশক হিসেবে ফৌজদারি কার্যবিধি (দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর বা সিআরপিসি) নামে পদ্ধতিগত আইনটিও ১২৫ বছর আগের তৈরি। এ ছাড়া ১৫১ বছরের বেশি পুরনো (১৮৭২ সাল থেকে প্রচলিত) সাক্ষ্য আইন (অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট)। ব্রিটিশ আমলে তখনকার প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতিতে তৈরি এ আইনগুলোর কাঠামো নিয়ে আপত্তি না থাকলেও আইন ও বিচারসংশ্লিষ্ট বেশিরভাগ মানুষের প্রশ্ন আছে সময়, পরিস্থিতি ও প্রয়োজনে আইনগুলোর সংস্কার এবং যুগোপযোগী না করা নিয়ে। বাংলাদেশসহ এ উপমহাদেশে ৭৬ বছর আগে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। আইনের সংস্কার নিয়ে বছরের পর বছর দাবি উঠেছে জোরেশোরে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসব আইনের আলোকে, অনেক বিশেষ আইন হয়েছে। সেগুলোর অনেক ধারাতেও অসংগতি ও অস্পষ্টতার বিষয়টি নানা সময়ে আলোচনায় এসেছে। কিন্তু সংস্কারের বিষয়টি এখনো উপেক্ষিত।
১৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত দণ্ডবিধিতে ৫১১ ধারার ৪৫৯টি শাস্তিসংক্রান্ত। এর মধ্যে আটটি ধারায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। ১৮৯৮ সালে তৈরি হওয়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬৫ ধারার বেশিরভাগই বিচারের লক্ষ্যে দিকনির্দেশনা সংক্রান্ত। এ ছাড়া ১৫১ বছরের বেশি পুরনো (১৮৭২ সাল থেকে প্রচলিত) ও ১৬৬টি ধারা সংবলিত সাক্ষ্য আইনে (অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট) ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য অবমাননাকর একটি ধারা গত বছর নভেম্বরে বাতিলসহ এ আইনে ডিজিটাল তথ্য-প্রমাণ আমলে নেওয়ার সুযোগ রাখা হয় সংশোধনীতে। আইন কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, সাক্ষ্য আইনটিকে আরও যুগোপযোগী ও সংস্কারের অংশ হিসেবে চলতি বছরেই তারা সুপারিশসংক্রান্ত প্রতিবেদন দেবেন।
আইনের সংস্কার প্রশ্নে পাঁচজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত নিয়েছে দেশ রূপান্তর। প্রায় অভিন্ন সুরে তারা বলেন, আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতিবাক্য হলো ‘দশজন অপরাধী খালাস পেলেও একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যেন সাজা না পান’। ফলে বিচারে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং আইনের ভাষা হতে হয় সহজ ও অযান্ত্রিক। একই সঙ্গে বিচারপ্রত্যাশীর ভোগান্তি লাঘবে দ্রুত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হয়। তাদের মতে, প্রায় ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক সময়ে মানুষকে প্রজা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এর প্রভাব পড়েছে ওই সময়ে তৈরি আইনগুলোতে। যেখানে শুধু শাস্তিকেই লক্ষ্য করা হয়েছে। অন্যদিকে একশ, দেড়শ বছরে অপরাধের ধরন, ভিন্নতা, অপরাধে প্রযুক্তিগত ব্যবহারসহ বদলেছে অনেক কিছু। বিপরীতে আইনগুলোতে নগণ্য কিছু সংশোধনী ছাড়া সংস্কার হয়নি।
পুরনো আইনের সংস্কার না হওয়াকে মামলাজটের কারণ উল্লেখ করে আইনজীবীরা আরও বলেন, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি, আদালতের সময়সহ বিচারপ্রত্যাশীর অর্থ ও সময় সাশ্রয়, অপরাধীর পুনর্বাসন, সংশোধন ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তেমন কিছুই নেই আইনগুলোতে। অন্যদিকে আইনের অপপ্রয়োগ কিংবা দুর্বলতায় প্রায়ই নির্দোষ ব্যক্তিকে নির্যাতন, জেলে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) ট্রাস্টি অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষের জন্য আইন। কিন্তু ব্রিটিশরা কর্তৃত্ব ও নিপীড়নমূলক অনেক আইন করেছে মানুষকে শোষণ, শাসন ও লুণ্ঠন করতে। তখন তো আর নাগরিক ও মানবাধিকার নিয়ে এত কথা হতো না। তাদের লক্ষ্যই ছিল কথায় কথায় স্বাধীনতাকামীদের বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়া। তিনি বলেন, ‘এখন তো আমরা ব্রিটিশদের উপনিবেশে নেই। কিন্তু ৫৪ (বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার) ১৬৭ ধারার (রিমান্ড) মতো নিপীড়নমূলক আইনগুলোসহ আরও অনেক কিছু রয়ে গেছে। ১৯৭২ সালে মাত্র কয়েক দিনে একটি ভালো সংবিধান হলে এখন মানুষের জন্য যুগোপযোগী আইন কেন হবে না?’
সম্প্রতি ২৪তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নিয়োগ পাওয়ার পরদিন গত ১৩ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি মামলাজটকে তার প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন। এ লক্ষ্যে আইনের সংস্কার বড় বিষয় উল্লেখ করে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘মানুষের দুর্গতি ও কষ্ট লাঘবে সরকার নিশ্চয়ই এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করবে।’ নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা।
আইন সাময়িকী ডিএলআরের সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. খুরশীদ আলম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি যথার্থই বলেছেন। আমরাও আইনের সংস্কার চাই। শুধু ফৌজদারি কিংবা দণ্ডবিধি নয়, এসব আইনের আলোকে আর্থিক অপরাধ, মানি লন্ডারিংসহ এমন কিছু আইন আছে যেগুলোর অনেক কিছুর সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।’
কিছুদিন আগে ভারত সরকার ব্রিটিশদের তৈরি ফৌজদারি আইন ব্যাপক সংস্কারে উদ্যোগ নিয়েছে।
সংস্কারের রূপরেখা আলোর মুখ দেখেনি : পুরনো ফৌজদারি আইনের সংস্কার নিয়ে ২০১১ সালে একটি রূপরেখা তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে প্রতিবেদন দিয়েছিল আইন কমিশন। এতে আইনের প্রতিষ্ঠিত নীতিবাক্যটিকে একটু ভিন্নভাবে উপস্থান করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘একজন নির্দোষ ব্যক্তি যাতে সাজা না পায় এবং একজন অপরাধীও যাতে খালাস না পায়।’ আইনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে প্রশ্নের অবতারণা করে সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানে ৩৩টি সুপারিশ করে কমিশন। এর মধ্যে তদন্ত ও বিচারের ত্রুটি কাটাতে ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত করতে স্থায়ী, পেশাদার ও দক্ষ পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য শুধু হাতেকলমে না লিখে টেপ রেকর্ডার, ভিডিওতে রাখা, ১৬৪ ধারায় আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির সঙ্গে সাক্ষীর বক্তব্য রেকর্ড করা, মিথ্যা ও তুচ্ছ অভিযোগকারীকে জরিমানা, ক্ষতিপূরণ বা কারাদণ্ড দিতে ম্যাজিস্ট্রেটের পাশাপাশি দায়রা জজকেও ক্ষমতা দেওয়া, বিচারকাজের দীর্ঘসূত্রতা কমাতে মুলতবির সময় সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া, মামলার কার্যক্রম স্থগিতের সময়সীমা ৩০ দিনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনের তাগিদ দেয় কমিশন। এ ছাড়া কারাগারের চাপ কমানো এবং আসামিকে সংশোধনের লক্ষ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও অভিযোগ গঠনের সময় দোষ স্বীকার করলে সাজা রেয়াত দেওয়া, যুক্তিতর্কের কারণে মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়ায় তা লিখিত আকারে জমা দেওয়া, আদালতের সংখ্যা অনুপাতে আপিল আদালত প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে কমিশন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কমিশনের ওই সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি।
কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোর্শেদ ইমতিয়াজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রতিবেদন দেওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে কমিশন অবহিত নয়।
দণ্ডবিধির অনেক ধারার অসংগতি ও অস্পষ্টতা নিয়ে আইন ও বিচার সংশ্লিষ্টরা বলেন, এই আইনে অনেক কিছুই আছে। কিন্তু গণপিটুনিতে মৃত্যু, অর্থনৈতিক অপরাধের মতো আরও কিছু বিষয়ে আইনে কিছু নেই। অন্যদিকে পুরনো এ আইনে এখনো ১০ টাকা, ১০০ টাকা ও ২০০ টাকার মতো অর্থদণ্ডের বিধান রয়ে গেছে। জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার তিনজন (একজন অবসরে) বিচারক এসব আইনে তাদের বিচারিক অভিজ্ঞতার বিষয়টি দেশ রূপান্তরের কাছে তুলে ধরেন। সংগতকারণে তারা তাদের নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানান। একজন বিচারক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আদালত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রসিকিউশনসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সমন্বয়ে একটি ফৌজদারি মামলার বিচার কার্যক্রম হয়। কিন্তু বিচারের দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে শুধু বিচার বিভাগকে শুনতে হয়। পুরনো আইনগুলোতে এমন অনেক কিছু আছে, যা একটু আধুনিক হলে বিচারকাজে আরও গতিশীল হবে।’ অন্য একজন বিচারক বলেন, ‘বিচারকাজের সময় টাইম (আদালত ও বিচারপ্রার্থীর সময়), কস্ট (বিচারপ্রার্থীর খরছ) এবং ভিজিট (বিচারপ্রত্যাশীর আদালতে আসা-যাওয়া) এ তিনটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আইনগুলোতে এসব বিষয়ে স্পষ্ট কিছু দিকনির্দেশনা নেই। সংগতকারণে বিচারপ্রার্থীর প্রতি সিমপ্যাথি (সহানুভূতি) ও ইমপ্যাথি (সহানুভূতির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু করা) থাকা সমীচীন।’
আইন সংস্কারের উদ্যোগ থমকে দুই বছর ধরে : ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফৌজদারি আইন সংস্কার ও আইনটি বাংলা ভাষায় প্রণয়ন করতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হককে নির্দেশ দেন। দুদিন পর ফৌজদারি আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন করে আইনটি যুগোপযোগী, আধুনিক ও বাংলা ভাষায় প্রণয়নের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এতে চেয়ারপারসন করা হয় মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব মো. মইনুল কবিরকে। কমিটিকে অন্যান্য দেশের আইন বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করে সমস্যা চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তবে মন্ত্রণালয়ের ওয়াকিবহাল একটি সূত্রের তথ্য বলছে, দুই বছর পার হলেও এ বিষয়ে কার্যকর কোনো অগ্রগতি নেই।
এ বিষয়ে জানতে সচিব ময়নুল কবিরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল ধরেননি। সার্বিক বিষয়ে জানতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলেও তার সাড়া মেলেনি। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এএম আমিন উদ্দিন মনে করেন, পুরনো আইনগুলোর আমূল পরিবর্তন কিংবা পুরো সংস্কার নয়, যতটুকু করলে বিচারপ্রার্থীর দ্রুত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে সেটি হতে পারে। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘আইনগুলোর প্রসিডিউরে (কার্যপ্রণালি) তেমন ভুল নেই। যেসব ক্ষেত্রে অসংগতি বা অস্পষ্টতা আছে শুধু সেগুলোই আলোচনার মাধ্যমে সংশোধন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে অংশীজন হিসেবে অন্যদের সঙ্গে অবশ্যই আইনজীবীদের সম্পৃক্ত রাখা উচিত।’
ভারতের ভিসা পাওয়া নিয়ে পাকিস্তান দল যে জটিলতার মধ্যে ছিল সেটার অবসান হয়েছে। অবশেষে ভারতের সরকার পাকিস্তান দলের জন্য ভিসা অনুমোদন করেছে।
সোমবার ক্রিকেট বিষয়ক ভারতীয় ওয়েবসাইট ক্রিকবাজ এই খবর জানিয়েছে। ভিসা অনুমোদনের ফলে বাবর আজমের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান দল এখন বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতে ভ্রমণ করতে পারবে। আগামী ৫ অক্টোবর শুরু হতে যাওয়া ১০ দলের আসরে শেষ দল হিসেবে ভিসা পেয়েছে পাকিস্তান।
ওয়ানডে বিশ্বকাপ অংশ নিতে আগামী বুধবার ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার কথা রয়েছে পাকিস্তান দলের। তবে যাত্রার ৪৮ ঘণ্টা আগেও ভিসা না পাওয়াকে 'অস্বাভাবিক দেরি' হিসেবে উল্লেখ করে উদ্বেগ জানায় পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি)। তারা বিষয়টি নিয়ে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির দ্বারস্থও হয়। এর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এসেছে ভিসা অনুমোদনের খবর।
ক্রিকবাজ জানিয়েছে, আইসিসির একটি সূত্র তাদেরকে পাকিস্তান দলের ভারতের ভিসা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ভিসা পেতে দেরি হওয়াকে স্বাভাবিক প্রশাসনিক প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছে ওই সূত্র।
সবশেষ এশিয়া কাপের মূল আয়োজক ছিল পাকিস্তান। তবে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে দেশটিতে যেতে চায়নি ভারত। ওই আসরে ভারতের সবগুলো ম্যাচ হয় শ্রীলঙ্কায়। একটি বাদে সুপার ফোরের বাকি সব ম্যাচ আর ফাইনালও অনুষ্ঠিত হয় দ্বীপ দেশটিতে।
ভারত নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকায় হাইব্রিড মডেলে এশিয়া কাপ আয়োজনের প্রস্তাব আসে পাকিস্তানের কাছ থেকেই। এর আগে ভারত দল পাকিস্তানে না গেলে পাকিস্তানও ভারতে বিশ্বকাপ খেলতে যাবে না বলে হুমকি দিয়েছিল পিসিবি। যদিও নিজেদের সেই সিদ্ধান্ত থেকে পরে সরে আসে তারা।
বিশ্বকাপের আগে আগামী শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অফিসিয়াল প্রস্তুতি ম্যাচে মাঠে নামবে পাকিস্তান। তিনদিন পর তাদের আরেকটি প্রস্তুতি ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপে বাবরদের প্রথম ম্যাচ নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। আগামী ৬ অক্টোবর হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত হবে ম্যাচটি।
ন্যায্য পারিশ্রমিক ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সীমিত করার দাবি নিয়ে পাঁচ মাস আগে হলিউডে শুরু হওয়া হট্টগোলের অবসান হচ্ছে। আন্দোলনকারী লেখকরা প্রযোজকদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর পর ধর্মঘট তুলে নেওয়ার কথা জানান। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানাচ্ছে, পাঁচ মাস আগে লেখক বা চিত্রনাট্যকারদের আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দেন অভিনয়শিল্পীরা। যার কারণে হলিউডে একধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। বন্ধ হয়ে যায় অনেক সিনেমার নির্মাণকাজ। তবে স্থানীয় সময় গত রবিবার হলিউডের লেখক ইউনিয়ন বড় স্টুডিওগুলোর সঙ্গে একটি প্রাথমিক চুক্তিতে পৌঁছেছে।
সিএনএন বলছে, এই চুক্তির ফলে হলিউডের ইতিহাসের বড় দুটি ধর্মঘটের মধ্যে একটি পক্ষ কাজে ফিরতে সম্মত হলো। এই ধর্মঘটের ফলে প্রায় পাঁচ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে বেশিরভাগ ফিল্ম ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানের চিত্রায়ণ। ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতিতে এর প্রভাব বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের। তাই এবার আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে লেখক ও অভিনয়শিল্পীদের কাজে ফেরাতে সচেষ্ট হচ্ছে হলিউডের স্টুডিওগুলো।
লেখকদের সঙ্গে নিষ্পত্তি হলেও এখনই হলিউডের স্টুডিওগুলোর আলো জ্বলছে না। অভিনেতাদের সংগঠন এসএজি-এএফটিআরএ এখনো পারিশ্রমিক ও এআই ইস্যুতে ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দাবির পাশাপাশি লেখকদের পারিশ্রমিক ও লভ্যাংশ ইস্যুতে সংহতি প্রকাশ করে ২ মে থেকে কর্মবিরতি পালন করছেন তারা। এসব বিষয়ে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে বার্তা সংস্থার আহ্বানে সাড়া দেয়নি দ্য অ্যালায়েন্স অব মোশন পিকচার অ্যান্ড টেলিভিশন প্রডিউসারস, ওয়াল্ট ডিজনি, নেটফ্লিক্স, ওয়ার্নার ব্রস ডিসকভারিসহ অন্যান্য প্রতিনিধিত্বকারী বাণিজ্যিক গোষ্ঠী।
চলতি বছরের ২ মে থেকে শুরু হওয়া ধর্মঘটে ১১ হাজারেরও ফিল্ম এবং টিভি লেখক অংশগ্রহণ করেন, যারা স্ট্রিমিং যুগে উচ্চ বেতন এবং আরও ভালো কাজের দাবি করছেন। তারা যুক্তি দিয়েছেন যে স্টুডিওগুলো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরম থেকে যে আয় করেছে, সেই তুলনায় তাদের ক্ষতিপূরণ মিলছে না। লেখকরা নতুন নিয়মও চান, যাতে এসব স্টুডিও টিভি শোগুলোর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক লেখক নিয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে বড় স্টুডিওগুলোর কাছ থেকে বেশি পারিশ্রমিক চেয়ে একটি চুক্তি করতে চেয়েছিল লেখকদের সংগঠন রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকা (ডব্লিউজিএ)। সেই চুক্তির চেষ্টা ব্যর্থ হওয়াতেই মূলত ধর্মঘটের ডাক দেন লেখকেরা। হলিউড আন্দোলনের কারণে অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে টেলিভিশন শো ও হলিউডের নির্মাণাধীন সিনেমাগুলো।
বিশ্বকাপ যত এগিয়ে আসছে, বাংলাদেশে বিশ্বকাপ নিয়ে নাটক ততই জমে উঠেছে। একদিন পর দল বিশ্বকাপ খেলতে দেশ ছাড়বে, অথচ এখনো ঘোষণা হয়নি বিশ্বকাপের দল।
এমন অবস্থায় সোমবার মাঝরাতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের বাসায় বৈঠকে বসেছিলেন ওয়ানডে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান ও কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে।
বিকেলে বিসিবি সভাপতির পেশাগত কার্যালয়, বেক্সিমকোতে নির্বাচক কমিটির সদস্যসহ বিসিবির বেশ কয়েকজন পরিচালকের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন বিসিবি সভাপতি। তারপর সন্ধ্যার দিকে দেশের কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দাবী করা হয় সাকিব ও তামিম ইকবালের ভেতর নতুন দ্বন্দের খবর।
গণমাধ্যমগুলোর দাবী, তামিম ইকবাল জানিয়েছেন বিশ্বকাপে তিনি পাঁচটি ম্যাচে খেলতে পারবেন। অন্যদিকে তামিমের এই দাবী মানলে বিশ্বকাপে না খেলার হুমকি দিয়ে রাখেন সাকিব।
২০১৯ বিশ্বকাপে চোটজর্জর মাশরাফী বিন মর্তুজা দলে থাকায় এবং সবগুলো ম্যাচে খেলায় অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের পরও দলকে বিশ্বকাপে অষ্টম হতে দেখেছেন সাকিব, তাই এই শর্তে তার নেতৃত্বে না থাকার আশংকাই প্রবল। এই দুই জনকে সমঝোতা করার জন্য মাশরাফীকে পাপন দায়িত্ব দিয়েছেন এমন একটা খবরই দাবী করা হয়। যদিও এসবের পক্ষে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
ধোঁয়া থাকলে আগুন থাকবেই। তাই মধ্যরাতে, পৌনে ১২টায় সাকিবের বিসিবি সভাপতির বাসভবনে ছুটে যাওয়া আর সিডনি থেকে বাংলাদেশে পা রাখার ঘণ্টা তিনেকের মাথায় তাকে গুলশানের আইভি লেগেসিতে ছুটে আসতে দেখার মাধ্যমেই বোঝা যায়, চূড়ান্ত দল ঘোষণার আগে শেষ মুহূর্তে কোনো মারপ্যাঁচ লেগেছে।
প্রায় ৩ মাস পর আন্তর্জাতিক ম্যাচে ব্যাট করতে নেমে তামিম খেলেছিলেন ৪৪ রানের ইনিংস। পরের ম্যাচে আবার তিনি বিশ্রামে, যেটা বিসিবির মেডিক্যাল বিভাগেরই সুপারিশে।
তাই বিশ্বকাপে তামিম কতটা ফিট হয়ে খেলতে পারবেন, আদৌ খেলতে পারবেন কি না এসব নিয়েই হয়তো হয়েছে শেষ মুহুর্তে মধ্যরাতের আলোচনা।
অধিনায়ক, কোচ আর বিসিবি প্রধান মিলে মিনিট চল্লিশেক বৈঠক করেছেন। আগে বের হয়েছেন হাথুরুসিংহে, তার মিনিট দশেক পর সাকিব। কেউই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি, গাড়ির কাঁচটাও নামাননি। আর পাপনের বাসায় যখন এসব চলছে, তখন এক বন্ধুর সঙ্গে বাসায় বসে চাউমিন খাচ্ছেন তামিম!
সাকিব-তামিম একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলেন না, এই খবর পুরাতন। শোনা গেছে সম্প্রতি একটি মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপণের কাজে দুজনের ভেতর সম্পর্কে তিক্ততা বেড়েছে। তামিমের খেলা, না খেলা এসব নিয়েও জলঘোলা হওয়ার কারণেই নাকি সাকিবের বিরক্তি বেড়েছে।
তবে দুজনের কারো কাছ থেকেই এসব নিয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তামিম অধিনায়ক থাকা অবস্থায় ইংল্যান্ড সিরিজের আগে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন 'নাথিং এলস ম্যাটার্স'। সাকিবও স্বভাবসুলভ ভাবেই পাশ কাটিয়ে গেছেন এসব প্রসঙ্গ।
দল ঘোষণার আগের দিনে, মাঝরাতে বিসিবি প্রেসিডেন্টের বাসভবনে কোচ ও অধিনায়কের বৈঠক হতে পারে শেষ মুহূর্তের বোঝাপড়া। যেহেতু একদিন বাদেই উড়াল দিতে হবে। অথবা তামিম সংক্রান্ত ব্যপারে চূড়ান্ত ফয়সালা। উত্তরটা পেতে অপেক্ষা মাত্র কয়েক ঘণ্টার।
২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনকেন্দ্রিক সক্রিয় অবস্থানের পর দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের বড় কোনো কর্মসূচি নেই। কর্মসূচি পালন করতে চাইলেও ছাত্রলীগের হামলার মুখে দাঁড়াতেই পারছেন না সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাসের আশপাশে ছোটখাটো ঝটিকা মিছিল করেই সারছে দলীয় কর্মসূচি। তবে বিএনপির এক দফা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আবারও ক্যাম্পাসে সরব হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল।
জানা যায়, ক্যাম্পাসে সক্রিয় হওয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন উপদলে ভাগ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকার বিভিন্ন জায়গায় নিয়মিত আড্ডা এবং কর্মী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের নেতারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা। আগামীতে ঢাবি ছাত্রদলের নেতৃত্বপ্রত্যাশী নেতারা এসব কর্মকা- পরিচালনা করছেন বলে জানা যায়। আড্ডা দিতে গিয়ে শনিবার রাতে ছাত্রলীগের হামলার শিকারও হন কয়েক জন ছাত্রদল নেতা। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বেশ সক্রিয় দেখা যাচ্ছে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের। ‘আমরা দ্রুত ফিরছি, মাত্র কয়দিনের অপেক্ষা’ লিখে স্ট্যাটাস দিতে দেখা যায় তাদের।
এদিকে রবিবার ভোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনের দেয়ালে ‘টেক ব্যাক বাংলাদেশ’ সে্লাগান লিখে আলোচনা তৈরি করে ঢাবি ছাত্রদল। ছাত্রদল নেতা আনিসুর রহমান খন্দকার অনিকের নেতৃত্বে মধুর ক্যানটিন ছাড়াও ডাকসু ক্যাফেটেরিয়া, কলা ভবনসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দেয়ালে ২০টির বেশি দেয়াল লিখন করেছে তারা। এসব দেয়ালে ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’, ‘ঘুরে দাঁড়াও বাংলাদেশ’, ‘তারেক রহমান বীরের বেশে আসবে ফিরে বাংলাদেশে’ সে্লাগান লেখা হয়। যদিও এদিন দুপুরের দিকে মধুর ক্যানটিনের লেখা মুছে দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
ঢাবি ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশব্যাপী বিএনপির লংমার্চ শেষে অক্টোবরে ঢাকাকেন্দ্রিক টানা আন্দোলন চলবে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও পুরোদমে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ছাত্রদল। যত বাধাই আসুক ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক কর্মসূচি ও আন্দোলন করতে চান তারা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত স্যাংশন ও বিএনপির সরকার পতনের এক দফা কর্মসূচি চূড়ান্ত রূপ লাভের অপেক্ষা থাকায় নেতাকর্মীরা বেশ উজ্জীবিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন বলে দাবি ছাত্রদলের নেতাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন। অক্টোবরে তা চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। আপাতত বিভিন্ন ভাগ হয়ে হয়ে আড্ডা, দেয়াল লিখনসহ নানান কর্মসূচি চলছে। নতুন শিক্ষার্থীরাও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। ছাত্রলীগের দখলদারিত্বের বিনাশ করতে আমরা বদ্ধপরিকর। দেশনায়ক তারেক রহমানের চূড়ান্ত নির্দেশের অপেক্ষায় আছি আমরা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গতকালও ছাত্রলীগ আমাদের ওপর হামলা করেছে। আমরা হামলার জবাব হামলা দিয়ে নয়, কাজের মাধ্যমে জবাব দিতে চাই। সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিনাশ করতে চাই। ক্যাম্পাস কারও একার সম্পত্তি নয়, যেকোনো সময় আমরা আসব। শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমরা দেশনায়ক তারেক রহমানের আগমনী বার্তা দিতে চাই।’
ঢাবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যেহেতু সামনে নির্বাচন, নির্বাচনকেন্দ্রিক আমাদের কর্মসূচি চলছে। সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ দিতে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসব। আমরা খুব দ্রুতই আসব। হাইকমান্ডের নির্দেশের অপেক্ষায় আছি। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল প্রস্তুত আছি। ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে, দাবি আদায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে অচিরেই ক্যাম্পাস থেকে আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে আমরা বিজয় নিয়েই ঘরে ফিরব ইনশা আল্লাহ।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ক্যাম্পাস থেকে হারিয়ে যায়নি। হামলা-মামলার শিকার হয়েও আমরা নিয়মিত পদচারণা অব্যাহত রেখেছি। আগামীতেও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এই ক্যাম্পাসে সরব অবস্থানে থাকবে। ছাত্রলীগের দখলদারিত্বের অবসান ঘটবে শিগগিরই। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা পেলে আমরা চূড়ান্ত কর্মসূচিতে যাব। আমরা প্রস্তুত ইনশা আল্লাহ।’
এদিকে ক্যাম্পাস দখল ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট করলে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভোররাতে এসে কেউ যদি দেয়াল লিখন করে, এটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলে আমরা মনে করি না। আদালত কর্তৃক ঘোষিত অপরাধীকে তারা দেশনায়ক বলছে, তাদের কর্মকাণ্ড দ্বারা বোঝা যায় তারা কতটা অথর্ব। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার একটি কেন্দ্র, এখানে দখলদারিত্বের কোনো বিষয় নেই। যেটি ছাত্রদল বলার চেষ্টা করছে দখল করবে, এই চিন্তা-ভাবনা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক যায় না। এসবে আমরা বিশ্বাস করি না। শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য যা যা করার দরকার, আমরা তা করতে রাজি আছি। ক্যাম্পাসকে কেউ অস্থিতিশীল করতে চাইলে তা প্রতিহত করা হবে।’
পুলিশের পদোন্নতির তালিকায় থাকা পদ কাটছাঁট করায় অসন্তোষ কমছে না। এ নিয়ে পুলিশ কর্তারা একাধিক বৈঠক করছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে এলে পদোন্নতি নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। পুলিশের অসন্তোষ ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে পদোন্নতির পদ আরও বাড়াতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠি পেয়ে জনপ্রশাসনও কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, পদোন্নতির সংখ্যাটি প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কাটছাঁট করে পুলিশকে বিব্রত করেছে। অন্য ক্যাডাররা একের পর এক পদোন্নতি পেলেও পুলিশ পিছিয়ে আছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হবে।
এদিকে ক্যাডারদের পাশাপাশি নন-ক্যাডারদেরও পদোন্নতির বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতির উদ্যোগ নিতে পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। পদোন্নতির তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তিন দিন আগে পদোন্নতি পেতে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সময় রাজধানীর ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের পদোন্নতির বিষয়ে আমরা কাজ করছি। যাদের পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা আছে তারা অবশ্যই পদোন্নতি পাবেন। বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পদ বাড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি শিগগির বিষয়টি সুরাহা হবে। নন-ক্যাডারদের কর্তারাও কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের বিষয়টিও সমাধান হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পুলিশের জন্য যা করেছে, অতীতের কোনো সরকারই তা করেনি। পুলিশের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুুলিশের পদোন্নতির তালিকা কাটছাঁটের বিষয়ে গত মঙ্গলবার আইজিপিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওইদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পুলিশের পদোন্নতির বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুর-এ- মাহবুবা জয়া।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রের আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাবাহিনী প্রধানতম বাহিনী, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পেশাদায়িত্ব ও শৃঙ্খলা রক্ষায় তদারকি ও ব্যবস্থাপনা এ বাহিনীর নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদানে পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব পদে পর্যাপ্তসংখ্যক পদ এবং দক্ষ জনবল থাকা বাঞ্ছনীয়। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-৩) ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) তুলনামূলক কম। বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোর আলোকে (বিদ্যমান পদে অতিরিক্ত) অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক এবং উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পদোন্নতি দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানের জন্য পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিদ্যমান পদের অতিরিক্ত সুপারনিউমারারি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজনের প্রস্তাবে পদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) পর্যন্ত ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকাটি সংশোধন করতে ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তর ৫২৯টি পদ চূড়ান্ত করে আরেকটি তালিকা পাঠায়। সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিতে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ১ আগস্ট এ প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় তালিকা কাটছাঁট করেছে। অতিরিক্ত আইজিপি পদে দুজন, ডিআইজি পদে ৫০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন। পুলিশের তালিকায় ছিল অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) ১৫, অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-২) ৩৪, ডিআইজি ১৪০, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৫০ ও এসপি ১৯০ পদে পদোন্নতি দিতে। এ তালিকা কাটছাঁট হওয়ায় পুলিশে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ অসন্তোষ এখনো অব্যাহত আছে। অসন্তোষ ঠেকাতে আবার জনপ্রশাসনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) পদোন্নতিতে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপি পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করতে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। পদোন্নতির বিষয়ে সিগন্যাল আসার পর ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সভা হয়েছিল। সভায় অতিরিক্ত সচিবসহ (পুলিশ ও এনটিএমসি) পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, পুলিশে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত আইজিপির পদ খালি রয়েছে। সুপারনিউমারারি পদে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৮, ২০, ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের প্রায় সবাই ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি ২৭, ২৮ ও ২৯তম ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের এসপি হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নন-ক্যাডাররা পদোন্নতি পাবেন। সাব-ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টর থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সুপারনিউমারারি পদে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতোই নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে। ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কারা পাবেন তার তালিকা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো ছিল পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) ১০ বছর পূর্তিতে ষষ্ঠ গ্রেড দেওয়া। ১০ বছর পূর্তিতে ব্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেড পরিবর্তন করা। ১০ বছরের মধ্যে পদোন্নতি না হলে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া। সাব-ইন্সপেক্টরদের (এসআই) ক্ষেত্রেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে এসআই/সার্জেন্ট পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাদের র্যাংক ব্যাজের নীল বা লাল ফিতা তুলে নেওয়া। কনস্টেবলদের বিভাগীয় পরীক্ষায় একবার পাস করলে সেখান থেকে প্রমোশন লিস্ট করে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে মন্ত্রীর কাছে।’
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত অভিযোগে দেশের কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টা বক্তব্য দিতেও শুরু করেছে। এতে বিরোধীপক্ষেরই ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই সবপক্ষই চাপে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান নিয়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হলেও মূলত নির্বাচনী রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন আসবে। একপক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও সেই পথ থেকে তাদেরও সরতে হবে। আবার সরকারপক্ষ যেনতেন নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে যাবে সেই সুযোগও থাকছে না। যে যাই বলুক নির্বাচনী রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে এ পরিবর্তন আসতেই হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবপক্ষের জন্য। তাদের অবস্থানে বিএনপি উৎফুল্ল হয়ে যাবে, আর আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং এতে এক ধরনের সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ না দিলেও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে এমন আভাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আসছে। তাদের একাধিক প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে সরকার ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে সমর্থনের কথা জানিয়ে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রয়োগের কথা জানানো হলো গত শুক্রবার।
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা ও র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিসানীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অনড় অবস্থানের বিষয়টি আবার জানাল। দেশটির এ অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দেখছে দুভাবে। একটি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়টি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। এর বাইরে অন্য কোনো বিরূপ প্রভাব দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার এত দিন যেটা চেয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সেটাই আশা করছে।
তবে বিএনপি ভিসানীতির জন্য সরকারকে দায়ী করেছে এবং সেটা তাদের নেতাকর্মীদের এক দফা আন্দোলনে আরও উজ্জীবিত করবে, এমন দাবি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কারণে আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে হয়ে যাবে সেটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি সবাইকে নিতে হবে। এর বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা যেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা একপেশে করার চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাইলে, পড়তে হবে ভিসানীতির আওতায়। যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান এখন পর্যন্ত সেটাই ইঙ্গিত করে।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে এক দফা দিয়ে আন্দোলনে আছে বিএনপি। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য এক দফা ঘোষণা করেছে। তারাও শান্তি-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সেটা নিশ্চিত করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এটাও বলে আসছে, তাদের সরকারের চাওয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া একই।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দুভাবে দেখলেও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম কানাঘুষা রয়েছে। ভেতরে-ভেতরে ‘ভেঙে পড়লেও’ ওপরে শক্ত মনোভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নতুন কিছু নয়। দুপক্ষের অবস্থান একই বলেও দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যে অবস্থান তাতে বিএনপিরই ক্ষতি, কারণ তারা ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন হতে দেবে না।’ তিনি বলেন, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় সরকার। সেখানে সব দল নির্বাচনে আসুক সেই আহ্বানও জানানো হয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত এবং সহযোগিতা করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জোরালোভাবে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র তো বিএনপির দাবি সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান সেখানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এসব বলা হয়নি। ফলে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন বেকায়দায় পড়বে? আমরা মনে করি, বিএনপিই তো বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, তাদের দাবি অসাংবিধানিক। আর অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনড় অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের দাবি, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি। তারা তো বিএনপির একটা দাবির কথাও বলে নাই।’ সরকার বা আওয়ামী লীগ ভীত ও শঙ্কিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের উচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানা।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, আমেরিকারও একই রকম চাওয়া।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে এমন কিছু করবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা সিম্পল ব্যাপার আমাদের জন্য।’
ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় বিরোধী দল আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যে বক্তব্য এসেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিবৃতিতে কোন বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে আজকে দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট তার জন্য সরকার এককভাবে দায়ী। তা ছাড়া এর আগে বাইডেন প্রশাসন তাদের দেশে যে গণতন্ত্রের সম্মেলন করেছে তাতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি।’
ভিসানীতি প্রয়োগের জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগ বিগত দুটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন করার পর আবারও আগামী নির্বাচন একতরফা করতে যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। এর দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। আজকে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ আগের ঘোষণার ধারাবাহিকতা। প্রথমদিকে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের ভেতর যে বড় ধাক্কা মনে হয়েছিল, ঘোষণা আসার পর সেটা মনে হয়নি। তবে কোনো একটা সমীকরণ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রভাব কত দূর যাবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনে কী বার্তা যাবে সেটা পরিষ্কার নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা তাদের বৈশি^ক চর্চারই অংশ। মূল কথা হলো, এটা সবার জন্যই চাপ।’
বাংলাদেশের কিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র বলে জানিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আজ শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করার ঘোষণা পর তিনি এ তথ্য জানান। তবে কতজনের ওপর এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা তিনি জানাননি ।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেছেন, ‘আমরা যখন এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছি, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘটনাবলির ওপর গভীর দৃষ্টি রাখছে। সতর্কতার সঙ্গে তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনার পর আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছি।’
মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করবে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এসব ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম আমরা প্রকাশ করব না।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ভিসা রেকর্ড গোপনীয়।
ব্রায়ান শিলার এই কথা বলার ঘণ্টাখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আজ (শুক্রবার) স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ব্যক্তিদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী, ক্ষমতাসীন দল এবং রাজনৈতিক বিরোধী দলের সদস্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় তার সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে প্রমাণিত অতিরিক্ত ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে এই নীতির অধীনে মার্কিন ভিসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। এর মধ্যে বর্তমান এবং প্রাক্তন বাংলাদেশী কর্মকর্তা, বিরোধী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের আজকের পদক্ষেপগুলি শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করার জন্য এবং বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সমর্থন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।’
মে মাসে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে ভিসানীতির ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনি ব্লিংকেন ওই ঘোষণা দেন।
সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসনে রদবদলের সুযোগ নেই সরকারের। তাই এর আগেই নির্বাচনী প্রশাসনে ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রশাসনে চলছে পদোন্নতি ও রদবদল। ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রশাসন সাজাতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে বদলি-পদায়ন হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে বড় পদোন্নতি হয়েছে। নির্বাচনের আগে অবসরে যাওয়া কয়েকজন সচিবেরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের ২৬ জন, ২৫তম ব্যাচের ২০ জন এবং ২৭তম ব্যাচের ১৮ জন ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিসিএসের ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৫ সালে, ২৫তম ব্যাচ ২০০৬ সালে এবং ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৮ সালে।
জানা যায়, নির্বাচনের সময় ডিসিরা জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকেন। তাদের যে কোনো কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ থেকে শুরু করে বাতিলের ক্ষমতাও থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও থাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা তথা ডিসির অধীনে। নির্বাচনের সময় সমন্বয়কারীর ভূমিকায়ও থাকেন ডিসিরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন তাদের দুটি ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে। আর সে সময় বিসিএস নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল। বিসিএসে ছিল নানা ধরনের তদবির। ২৪ ও ২৫তম ব্যাচ দুটি বিএনপির সময়ে নিয়োগ পেলেও ২৭তম ব্যাচ নিয়োগ পেয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। কারণ বিএনপির শেষ সময়ে ২৭তম ব্যাচের নিয়োগে বড় ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকায় তা বাতিল হয়। পরে ফের পরীক্ষা নিয়ে ২০০৮ সালে এ ব্যাচের নিয়োগ দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল ২৪তম ব্যাচের নিয়োগ নিয়ে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২৪তম ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ডিসির পদ থেকে তুলে আনা হতে পারে। নির্বাচনের সময় যারা ডিসির দায়িত্বে থাকবেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তাদের সবার ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে পরিবার ও নিকট আত্মীয়স্বজনদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো যাচাই করা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে ছাত্রজীবনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে আর ডিসির পদে রাখা হবে না।
এ ছাড়া নির্বাচনে অন্যতম ভূমিকা পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। বর্তমানে ৩৩, ৩৪ ও ৩৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা রয়েছেন ইউএনও পদে, যারা আসন্ন নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন। এখন ৩৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ইউএনওর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে; এ ব্যাচে প্রশাসন ক্যাডারের ২৯১ জন কর্মকর্তা রয়েছেন।
জানতে চাইলে সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ইকরাম আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পিএসসির নিয়োগ পরীক্ষা হয় যোগ্যতা, মেধা ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে। সেখানে ছাত্রজীবনে কে কোন পার্টি করেছিলেন, কোন দল ক্ষমতায় আছে তা বিবেচনা করা হয় না। বিসিএস কর্মকর্তাদের যে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং হয়, তাতে তাকে একজন অফিসার হিসেবেই গড়ে তোলা হয়। এরপর এসিআর, সুপিরিয়রের মতামত, সুনাম, দক্ষতা, যোগ্যতার ভিত্তিতেই একজন কর্মকর্তাকে উচ্চতর পদে দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তবে সরকার যে দল পরিচালনা করে তাদের কিছু নীতিমালা ও উদ্দেশ্য থাকে। কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সরকারের নেওয়া বৈধ ও জনকল্যাণে গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা। তিনি প্রলুব্ধ হবেন না, নিরপেক্ষ থেকে তার দায়িত্ব পালন করবেন। যদি কোনো নির্বাচনী দায়িত্বও দেওয়া হয়, সেটাও নিরপেক্ষভাবে তিনি পালন করবেন।’
গত মে মাসে অতিরিক্ত সচিব পদে ১১৪ জনের পদোন্নতি হয়। জুলাই মাসে পাঁচ বিভাগে নতুন বিভাগীয় কমিশনার দেওয়া হয়েছে। গত জুলাই মাসেই বদলি ও নতুন মিলিয়ে ৩০টি জেলায় ডিসি পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। উপসচিব পদমর্যাদার এই ডিসি পদে এবারও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর আটজন পিএসকে পদায়ন দেওয়া হয়েছে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ২২১ কর্মকর্তা। এ পদোন্নতিতে মূল বিবেচনায় এসেছে ২২তম ব্যাচ। বর্তমানে যুগ্ম সচিবের স্থায়ী পদ ৫০২টি। এর বিপরীতে পদোন্নতি পাওয়ার পর যুগ্ম সচিবের সংখ্যা হলো ৯৪৬ জন। এর আগে সর্বশেষ গত বছর ২ নভেম্বর ১৭৫ জন কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। আর গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২৭০ জন সিনিয়র সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
জানা যায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই অন্তত ১০ জন সচিবের স্বাভাবিক অবসরে যাওয়ার কথা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন আগামী ১৩ অক্টোবর অবসরে যেতে পারেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান ১৪ সেপ্টেম্বর, সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আবদুস সালামের ২৬ সেপ্টেম্বর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে আবদুস সালামের চাকরি এক বছর বাড়ানো হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ৯ অক্টোবর, ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দীক ৩০ অক্টোবর, ইআরডি সচিব শরিফা খান ২৪ নভেম্বর, শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এহসানে এলাহী ২৫ নভেম্বর এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের সিনিয়র সচিব কামাল হোসেন ২৯ নভেম্বর অবসরে যাবেন। ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মোছাম্মৎ নাসিমা বেগম এবং ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মো. ফয়জুল ইসলাম। এ ১০ জনের মধ্যে কয়েকজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন।
গত কয়েক বছরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং মুখ্য সচিব পদে যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই স্বাভাবিক অবসরের মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। সর্বশেষ সাবেক চার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মধ্যে একমাত্র কবির বিন আনোয়ার ছাড়া বাকি তিনজনই স্বাভাবিক মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। তারা হলেন মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা, মোহাম্মদ শফিউল আলম ও খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তাই স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনেরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিনের মধ্যে অন্যতম ভিটামিন ডি। অতি প্রয়োজনীয় এই ভিটামিনের প্রধান উৎস সূর্যের আলো। তবে আমাদের ব্যস্ত জীবনে রোদ পোহানের সময় কই। অফিস থেকে বাসা, বাসা থেকে অফিস। এসির ভেতর থাকতে থাকতে শরীরে তৈরি হচ্ছে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি। ফলে কম বয়সে হাড়ক্ষয়, পিঠে-কাঁধে ব্যথা, চুল ঝরে যাওয়া, ঘা শুকোতে দেরি হওয়া, হাড় দুর্বল হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা যায়।
রেগুলার অফিসযাত্রীরা ভিটামিন ডি-এর অভাবে সবচেয়ে বেশি ভোগে। এরা রোদে বসার সময় পান না। যে কারণে এদের মধ্যে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি খুব বেশি দেখা যায়। ৫০ বছরের বেশি বয়সের পর শরীরে অনেক ধরনের ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দেয়, যার মধ্যে ভিটামিন ডিও একটি। এই বয়সে শরীর সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন ডি তৈরি করতে সক্ষম হয় না। যে কারণে এই বয়সের মানুষের শরীরে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি পূরণ করতে হয় অন্যান্য পদ্ধতির মাধ্যমে। এনআইএইচ-এর একটি রিপোর্ট অনুসারে, যাদের বডি মাস ইনডেক্স ৩০-এর বেশি বা তাদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বেশি তারাও ভিটামিন ডি-এর অভাবের সম্মুখীন হতে পারেন।
কীভাবে বাড়াবেন ভিটামিন ডি?
মাশরুম
মাশরুমে ভিটামিন ডি থাকে। মাশরুম ইউভি রশ্মির সংস্পর্শে এলে ভিটামিন ডি তৈরি করে। এটি খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। কম তেলে রান্না করলে ওজন কমাতে সাহায্য করে।
সি ফুড
কিছু মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি থাকে। রিপোর্ট অনুযায়ী, স্যামন, টুনা এবং ম্যাকেরেল মাছে ভিটামিন ডি থাকে। যদি আমিষভোজী হন তবে আপনি তাদের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
দুধ
এছাড়াও দুধে অনেক ধরনের পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এতে ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি বেশি পরিমাণে ভিটামিন ডি রয়েছে। বিশেষ করে গরুর দুধে, এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। এর পাশাপাশি সহজে হজম হয়। দই দইয়ে ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন থাকে। দই হাড় মজবুত করে এবং হার্ট ভাল রাখে।
ভিটামিন ডি পাওয়ার সেরা উপায় কি?
রিপোর্ট অনুযায়ী, ভিটামিন ডি পাওয়ার সবচেয়ে ভালো উৎস হল চর্বিযুক্ত মাছ এবং মাছের তেল। ডিমের কুসুম এবং পনিরে অল্প পরিমাণে পাওয়া যায়। উপরন্তু, কিছু মাশরুমে কিছু ভিটামিন ডি২ থাকে।
ভিটামিন ডি এর জন্য রোদে বসার সঠিক সময় কোনটি?
অনেক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে সকাল ও বিকেল হল রোদে বসার সেরা সময়। দুপুরে ইউভিবি রশ্মি সবচেয়ে শক্তিশালী হয়। এর মানে হল আপনি কম সময়ে বেশি ভিটামিন ডি পাবেন। কমপক্ষে ১০ মিনিট এবং সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট রোদে বসলে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।