
আমাদের শৈশবে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে বেশ মাতামাতি ছিল, প্রতি বছর নজরুলজয়ন্তী হতো তার জন্মদিনে, ১৯৭৬ সালে মৃত্যুর পর মৃত্যু দিবসও পালন করা হতো। স্কুল কলেজে তার কবিতা আবৃত্তি হতো, একক অভিনয় হতো কবিতার, সভা করে সামাজিক জীবনে নজরুলের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হতো। এগুলো হতো শুধু প্রধান শহরে নয়, ছোট ছোট শহরে, উপজেলায়, ইউনিয়নে, গ্রামে সর্বত্র! তখন প্রতিটা শিশু তাকে চিনত, তার কবিতা মুখস্থ করত, কেউ কেউ বড় হয়ে কবি নজরুল হতে চাইত!
তারপর অনেক কিছুর মতো এই চিত্রটা দেশ থেকে হারিয়ে গেল। নজরুল দেশের জাতীয় কবি হয়ে রইলেন, কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকে লুপ্ত হয়ে গেলেন।
গ্রীষ্মের কবি আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম। এই জ্যৈষ্ঠ মাসে তার জন্ম। তার কবিতা-প্রাণ ফলের রসে রঙিন, গান সুরে সুরে মন প্রাণ-খোলা, গদ্য ভোলাভালা রাজনৈতিক। আমাদের নজরুল আমাদের জাতীয় চরিত্রের পরিচায়ক যেন তাকে সামনে রেখেই রচিত হয়েছে আমাদের সব বাঙালিয়ানা।
আবার নজরুল একজন আহত আলফা মন। প্রবল পুরুষের হারিয়ে যাওয়া।
রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের দুই কবি নজরুল ও জীবনানন্দের মধ্যে অনেক মিল ও অমিল। একই সালে জন্ম (১৮৯৯) কিন্তু বিস্তর দুইরকম ফারাক এই দুই কবির। মিল আছে জীবন বৃত্তে একজন অকালে চিরজীবনের জন্য রুগ্ণ হয়ে গেলেন (নজরুল ৪৩ বছর বয়সে) আর জীবনানন্দ অকালে আঘাতে মারা গেলেন (৫৪ বছর বয়সে)। দুজনেরই সক্রিয় জীবনে অকালে সাহিত্যচ্ছেদ হলেও, তাদের বেশিরভাগ বই প্রকাশিত হলো পরে। একজন মানুষের মনকে জাগিয়ে তোলার জন্য লিখলেন, আরেকজন মানুষের বৈদগ্ধকে উন্মোচিত করলেন কবিতায়, গদ্যে।
বাংলা ভাষার নয়নের মণি এই দুই কবির জীবন কতই না বিপরীত। নজরুল অল্প বয়সেই বই করেন, ২৩ বছর বয়সে। আর জীবনানন্দ ২৭ বছর বয়সে, তাও তার প্রথম বইটাকে (‘ঝরাপালক’) অনেকে মনে করেন তাতে নজরুলের কবিতার ছাপ রয়েছে।
নজরুল ছিলেন সুপার সাইক্লোন। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্য জীবনে ঝড়ের গতিতে রচনা করে গেছেন। অনেক কিছু রচনা করলেও তিনি ছিলেন মূলত কবি। কবি, যে কিনা মানুষের সঙ্গে মানুষকে যুক্ত করেন, ধর্মের সঙ্গে ধর্মকে, জাতির সঙ্গে জাতিকে। গদ্যের সঙ্গে সুরকে, ধ্বনির সঙ্গে উপমাকে, রাজনীতির সঙ্গে চিত্রকল্পকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে যুদ্ধ-রেডিও হয়েছিল, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’, সেখান থেকে একটা গান বাজানো হতো, তাতে বাংলাদেশকে বিবৃত করা হতো:
বিশ্বকবির ‘সোনার বাংলা’, নজরুলের ‘বাংলাদেশ’, জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’- রূপের যে তার নেইকো শেষ, বাংলাদেশ!
এই গানটায় বাংলাদেশকে বর্ণনা করতে গিয়ে রঙের তালিকার মধ্যে নজরুলকে পুরো দেশটাই দেওয়া হয়েছে। যেন যেহেতু দেশ স্বাধীন হয়েছে যুদ্ধ করে তাই যুদ্ধটা নজরুলের একান্ত বিষয়। যুদ্ধ নিয়ে আর কেউ লেখেননি।
সারা জীবন অসংখ্য বিদেশি ভাষা ব্যবহার করেছেন। বাংলার বাইরে গেছেন করাচি পর্যন্ত, কিন্ত তার ভাষার ব্যবহারে মনে হয় তিনি অনেক দিন বাস করেছেন আরবি, ফার্সি, তুর্কি, ইংরেজি, পশতু, উর্দু এইসব ভাষার পরিমণ্ডলে। তার কাছে শিখতে হবে বিদেশি ভাষা ব্যবহারের টেকনিক। যৌথ সমাজের ভাষা-সমাজের বিভিন্ন পেশা, গোত্র ও অঞ্চলের ভাষারূপের স্মার্ট ব্যবহার শিখতে হবে নজরুলের কাছ থেকে।
নজরুলের গান নতুন আয়োজনে সমকালীন সুরে গাওয়া যেতে পারে। কে গাইবে তা, তার জন্য অপেক্ষা আমার।
নজরুল লেখেন দেশের মানুষের মনের ভেতরের অনেক না বলা আবেগ, না বলা বেদনা। উন্মোচিত করেছেন সাধারণ মনের কথাগুলোকে, ভাষা দিয়েছেন। এজন্য তার সাহিত্য সাধারণ মানুষের মনের ভেতরে খুব গভীরে কাজ করেছে। প্রজন্ম প্রজন্মান্তরে থেকে গেছে। সবার যৌথমনের ভেতরে কাজ করেছেন নজরুল।
শিশুদের যেভাবে ভালোবেসেছিলেন এমন করে কেউ আর ভালোবাসেনি। কল্পনায়, ছন্দ-দোলায় আর শব্দ মিলে শিশুদের জন্য তিনি রচনা করেছেন এখনকার যুগের শিক্ষা মনস্তত্ত্ববিদ শিশুকে যেভাবে পালন করতে বলেন। তার কবিতা পড়েই একজন শিশু মানুষের জীবনকে ভালোবাসা শিখতে পারবে, এককজন শিশু তার পোষাপ্রাণী বা বাসার পাশের গাছকে ভালোবাসতে পারবে। আমাদের শিশুদের জন্য নজরুলকে খুব দরকার।
নজরুল বিদ্রোহী কবিতায় বলেছেন:
করি শত্রুর সাথে গলাগলি,
ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা
লিখেছেন:
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী
আর হাতে রণ-তূর্য
যখন একে একে খসে পড়ে যাচ্ছে আমাদের সব মূল্যবোধ, মানুষে মানুষে সম্পর্কের বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে তাতে কাজী নজরুল ইসলাম খুব প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছেন এখন। কারণ উনি ছিলেন জাতির জোড়া লাগানো কাজে ওস্তাদ কবি।
এমন এক আধুনিক মন তার, যুদ্ধের বাজনার মধ্যে কবিতা লিখতে গিয়ে লেখেন:
‘দেখচ্ কি দোস্ত অমন করে? হৌ হৌ হৌ
সত্যি তো ভাই!-সন্ধ্যেটা আজ দেখতে যেন সৈনিকেরই বৌ’
(কামাল পাশা)
অথবা
‘ডাবের শীতল জল দিয়ে
মুখ মাজো কি আর প্রিয়ে?’
(ছায়ানট: চৈতী হাওয়া)
তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। প্রায় একশো বছর পরেও দেখি তার কবিতার ভাষা এখনো ঝকঝকে, সপ্রতিভ।
প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় রিকশাওয়ালার সঙ্গে এই ঘটনা ঘটছে। ‘দেখিনু সেদিন রেলে, কুলী বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে! চোখ ফেটে এল জল, এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
সেমিনারে শুনছি গবেষক বলছেন: ‘পুরুষ হৃদয়হীন, মানুষ করিতে নারী দিল তারে আধেক হৃদয় ঋণ।’
টকশোতে শুনছি: ‘অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়, অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!’
এমন অসংখ্য মণি-মুক্তা ছড়ানো রয়েছে তার কবিতায়।
কী করা যায়?
দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক বিভেদ থেকে বের হওয়ার জন্য এই কাজটা করা যায়।
রুচির দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি দিতে নজরুল চর্চাকে নিয়ে নিম্নলিখিত কাজগুলো করা যায় -
নজরুলের গানগুলো নতুন নতুন ভাবে গাওয়া। তার কবিতার বই ‘ছায়ানট’ নামের প্রতিষ্ঠানে নজরুল চর্চা বাড়িয়ে দেওয়া।
নতুন করে নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করা। সারা দেশে স্কুলে-কলেজে আবৃত্তি ছড়িয়ে দেওয়া।
গণমাধ্যম, সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে নজরুলের টেক্সট ব্যবহারে উদ্দীপিত করতে হবে যাতে করে সাধারণ মানুষের মধ্যে নজরুল নিয়ে যথার্থ মনোযোগ তৈরি হয়।
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়কে নজরুল নিবেদিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সমকালে নজরুল উপযোগিতা বাড়ানোর গবেষণা করতে হবে।
জাতীয় কবি হিসেবে নজরুলকে যথাযথ মর্মার্থে সরকার ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে।
ইরান যেমন কবি ফেরদৌসীকে নিয়ে জাতীয় দিবস উদযাপন করে, আমরাও নজরুলকে নিয়ে জাতীয় দিবস পালন করতে পারি। ব্রিটেন যেভাবে শেক্সপিয়ারকে নিয়ে, পশ্চিমবঙ্গ যেভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রতিদিনের জীবনযাপনের অংশ করে রেখেছে সেভাবে নজরুলকে নিয়ে আসতে পারি
নজরুলকে নিয়ে টিকটক, ইউটিউব, ফেসবুক কন্টেন্ট ক্রিয়েট করতে হবে
গ্রামে-গঞ্জে যে সব জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আছে যেমন হিরো আলম-তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এনে নজরুল বিষয়ে গুরুত্ব বোঝাতে হবে। তাদের দিয়ে কন্টেন্ট বানাতে হবে। তাদেরকে নিয়ে পুরস্কার প্রতিযোগিতা করতে হবে
নজরুলকে নিয়ে চর্চা করলে পুরস্কার, না করলে তিরস্কার করতে হবে।
বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জাদুঘর, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র সবার প্রধান কাজ হবে ৫ বছরব্যাপী নজরুলচর্চা। তারপর রিভিউ করে আবার ৫ বছরের পরিকল্পনা।
সারা দেশে নজরুলের ভাস্কর্য চাই। নজরুলের উপমা, চিত্রকল্প আর ছন্দের পথ ধরে ভাষার উৎসবে ভরে দিতে হবে সারা দেশ।
এই কাজগুলো করার জন্য দেশের প্রমাণিত নজরুল গবেষকদের সক্রিয় হতে হবে। তাদের পরামর্শে ও উদ্যোগে কাজ এগিয়ে নিতে হবে। তবে এজন্য অবশ্যই অনেক ধরনের তরুণ গবেষক ও অ্যাকটিভিস্টদের সহায়তা নিতে হবে। দেশ-বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষিত বিশেষজ্ঞদের ছাড়া এ কাজ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে আমাদের লক্ষ্য হবে তরুণ প্রজন্ম, যারা নজরুলকে প্রায় কিছুই জানে না। তারা নজরুলের গান শোনেনি, নজরুলের কবিতা পড়েনি কোনো দিন।
নজরুল জন্মশতবর্ষ আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। এবার তার প্রতিটা জন্মদিন থেকে শুরু করতে পারি নজরুল পুনর্নির্মাণ। তাহলেই হয়তো যে সাংস্কৃতিক রুচির দুর্ভিক্ষ হয়েছে বলা হচ্ছে, তা থেকে মুক্ত হতে পারব।
কবি ও গল্পকার
কত পরিচয় তার। পিতাহারা এতিম বালক, রুটির দোকানের মজদুর, দারোগার বাড়ির ফরমাশ-খাটা চাকর, লেটো গানের দলের সাঙাত, সেনাবাহিনীর হাবিলদার, বিদেশি যুদ্ধফ্রন্টের সৈনিক, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ, কারাভোগী বিপ্লবী। আবার সেই তিনি কবি, গীতিকার, গায়ক, সংগীত শিক্ষক, রাগ-রাগিনীর জনক, অভিনেতা, উপন্যাসিক, গল্পকার, প্রবন্ধকার, নন্দনতাত্ত্বিক ইত্যাদি। তার বিচরণ পুরুলিয়া থেকে করাচি অবধি। এক জীবনে যে বহুজীবনের স্বাদ তিনি পেয়েছেন, বহু ধারায় নিজের জীবনীশক্তি ও প্রতিভাকে বইয়ে দিয়েছেন; তার কি কোনো তুলনা আছে? সম্ভবত নেই।
নামও কি কম তার! দুখু মিয়া, নজর আলি, নাজির আলি। নামগুলো আসলে নামহীন-গোত্রহীন এক যুবকের নিজেকে লাগাতারভাবে ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা বলে। শেষে স্থির হন, ‘নাজিরুল ইসলাম’ ও ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ নামে। টিকে যায় কাজী নজরুল ইসলাম নামটিই। তার মানে তার প্রতিষ্ঠার ভিত তখন পোক্ত ও বিস্তারিত। সহজে উপড়ানো যাবে না। কী মুসলমান কী হিন্দু, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মহল এমন কেতাবি নাম ছাড়া কাউকে সম্মান করত না। নামের বিবর্তন থেকে বোঝা যায়, দিনে দিনে তিনি অনামা থেকে ‘নাম-করা’ সারিতে উঠে আসছেন। কিন্তু দুঃখের দহনে পোড়া ‘দুখু মিয়া’র জীবন আগের মতোই দুঃখের দরিয়াই থেকে গেছে।
অনেক সামাজিক শ্রেণিতে থাকার অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। বহু ভাষায় তিনি সাহিত্যের স্বাদ নিয়েছেন। বেশ বড় ভূগোলে তিনি বিচরণ করেছেন। হিন্দু ও মুসলিম তো তার পরিবারেই জড়ানো। সাহিত্যেও তিনি হিন্দু ও মুসলিম দুই তরফেরই। সত্যিকার বাঙালি সংস্কৃতি যদি কারও জীবনে ফলে গিয়ে থাকে, সেটাও নজরুল। তার আগের যুগের ফকির লালন শাহকে বাদ দিলে এ ব্যাপারে সম্ভবত তিনিই একমাত্র। নজরুল অসাম্প্রদায়িক নন, তিনি সর্ব সম্প্রদায়ের। নজরুলের জীবন তার সাহিত্যের মতোই চমক লাগানো। বাঙালি সংস্কৃতির দুই ধারা কোথাও যদি মেলে, সেটা নজরুলের জীবন, সংস্কৃতি এবং সৃষ্টির মধ্যেই। ধর্মান্তর না করেই দোলন ওরফে প্রমীলা দেবীর সঙ্গে তার বিবাহ, চেতনার মধ্যে হিন্দু-মুসলিমের যুগল ভাব এবং অপরকে আপন করার লালনীয় উদারতা এবং ভারত ও পারস্য দুনিয়ার ভাবকে এক জায়গায় মেলানোর বিশ্বজনীনতা সত্যিই বিরল। তিনি চিন্তাকে আবেগায়িত করেছেন, আবেগকে করেছেন চিন্তাধর। একই কথা খাটে তার রাজনীতির বেলায়ও। রাজনীতিকে আবেগায়িত আর আবেগকে রাজনীতি-জারিত করায় তিনি বেজোড়ই বটে।
এত পরিচয় সত্ত্বেও বাঙালির মনে দুখু মিয়া অতি চেনা কবিয়ালের রূপে স্থায়ী হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন নিচ্ছেন সুফি দরবেশের বেশ। নজরুলকে তখন দেখা যায় বুকের একপাশে চাদর জড়ানো, সুদর্শন গোঁফ ও বাবরি চুলের চেহারায়। বেশভূষার এই যে বাহার, তা বাংলাদেশের কবিয়ালের চিরায়ত ছবিকেই মনে জাগিয়ে তোলে। তার স্বভাবের গীতল উচ্ছ্বাস কবিয়াল ছাড়া আর কার? নিম্নবর্গের ইতিহাস ধারার গুরু রণজিৎ গুহ গান্ধীর পোশাকের মধ্যে গুজরাতি কৃষকের আদল দেখতে পেয়েছিলেন। নজরুলের মধ্যে আমরা দেখি বাংলার লোককবিদের মর্মজ্বালা। একেবারে কৃষক আবহ থেকে উঠে এসে তিনি উচ্চবর্গের মহলে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। বাংলা ভাষার ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় কবিয়াল নজরুল। সর্বজনের সারি থেকে উঠে আসা নজরুলের মনে এক চির দুখু মিয়ার বসবাস।
গরিব চালচুলার ঘর থেকে বেরিয়ে এমন অসাধারণ আলোর ঝলকানির জন্য যে তীব্র আত্মশক্তির প্রয়োজন, তার সময়ে বা পরে আর কারও মধ্যে দেখা যায় কি? এক প্রতিভাধর দুখী কবিয়ালের এ রকম গরীয়ান উত্থান বিশ্বসাহিত্যেই বিরল ঘটনা।
এবং ঘটনা কিছুটা আশ্চর্যেরও। সতেরো শতকের আরেক দুর্দান্ত কবি মহাকবি আলাওল। নজরুলের মধ্যে যেন তারই আধুনিক পুনর্জন্ম। আলাওলের জন্ম ফরিদপুর এলাকায়, আনুমানিক ১৬০৭ সালে। পর্তুগিজ জলদস্যুরা তাকে অপহরণ করে আরাকানে নিয়ে বিক্রি করে দেয়। তিনিও সাধারণ সৈনিক পদ থেকে আরাকান রাজসভার প্রধান কবিতে পরিণত হন। খেয়াল করার বিষয়, মধ্যযুগের সুলতানি আমলের বাংলা আর আরাকানেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ফুলে-ফলে ভরে ওঠে। দুই বেলাতেই মুসলমান কবিরা ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে রোমান্টিক প্রেম মিশিয়ে মানবীয় প্রেমের জাগরণের পথ খুলে দেন। নজরুলও আলাওলের মতোই প্রজ্ঞাবান। দুজনের সাহিত্যেই বুদ্ধি ও আবেগের নিপুণ লীলার স্বাদ পাওয়া যায়। আলাওল মধ্যযুগের বাংলা কবিতা শুধু নয়, ভারতীয় ভাষাগুলোর কবিদের মধ্যে একজন শিরোমণি ছিলেন, নজরুলও গত শতাব্দীর বিরাট কীর্তিমান কবি। আলাওল আরবি, ফারসি, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষার সুপণ্ডিত ছিলেন। ব্রজবুলি ও মঘী ভাষাও তার আয়ত্তে ছিল। তারপরও তিনি বাংলাকেই বেছে নিয়েছিলেন। নজরুলও আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ভাষা ও ছন্দের রসে বাংলা ভাবজগৎকে আরও সুফলা করেছেন। তারপরও মধ্যযুগের পর বাংলা কবিতায় বিবাগী প্রেমভাবকে আবার জাগানোর অবদানের কথা কি আমরা খুব একটা বলি?
বৈষ্ণব গীতিকবিতার প্রেম কখনো অতিকামজ আবার কখনো তা ঈশ্বরপ্রেমেরই ছায়া। রবীন্দ্রনাথের প্রেম অনেক বিমূর্ত এবং সেই প্রেমও ঈশ্বরপ্রেমে উত্তরিত হতে চায়। রূপের তৃষ্ণা আকারের আকাক্সক্ষা সেখানে যেন নিস্তেজিত। মধ্যযুগের পর নজরুলের মানসে আবার জাগল দিওয়ানা হওয়ার জোশ। এই প্রেম কাম ও মিলনের উচ্ছ্বাসে ভরপুর, আবার গজল ও রুবাইয়ের ত্যাগী ভাবরসে টলমল। নীরদ সি চৌধুরী বাঙালি জীবন ও কাব্যে রোমান্টিক প্রণয় ছিল না বলে দাবি করেছেন। নজরুলের জীবন ও সাহিত্যকে আমলে নিলে হয়তো তিনি তার মত শোধরাতে চাইতেন।
কাজী নজরুল বাংলা ভাষার রাজ্যে যা করেছেন, তা করেছেন। কিন্তু তার আবির্ভাব ছাড়া বিশ শতকের গোড়ার মুসলমান বাঙালির সাহিত্যসাধনার আত্মবিশ্বাস অর্জন এবং ভেতর-বাহিরের বাধা দূর করা অনেক পিছিয়ে যেত। কারণ, পলাশীর পরাজয়ের পর ইংরেজরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চলন-বলনটাই শুধু বদলে দেয়নি, তারা সর্বতোভাবে বাংলার মুসলিম বিদ্বজ্জনের জীবন ও সাহিত্যচর্চা কঠিন করে তুলেছিল। পলাশী যুদ্ধের পরের দেড়শ বছর বাঙালি মুসলমানদের দিশাহারা দশার পর নজরুলের উদয় তাই যুগান্তকারী ঘটনা।
গুণের বিচারে নজরুল কেবল বাঙালি মুসলমান বা বাঙালি জাতির জন্যই নয়, ভারতীয় মাপেই মুক্তিকামী চিত্তজাগরণের পথিকৃৎ। আরেকটি দিক থেকেও নজরুল মুক্ত মানবের প্রতিনিধি। আর সব বিদগ্ধ ও কর্মীপুরুষ যেখানে কোনো না কোনোভাবে উপনিবেশবাদী পশ্চিমের বশ্যতা বা মুগ্ধতা লালন করেছেন, জীবনের কোনো পর্যায়েই নজরুল তা মানেননি। মনকে তিনি মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। তিনি ইংরেজের নির্যাতন বরণ করেছেন, স্বধর্মীয়দের গালমন্দ শুনেছেন, পরধর্মী স্বজাতির উপেক্ষা সয়েছেন। কোনোভাবেই তিনি কায়েমি রাজনৈতিক ও সম্পত্তি ব্যবস্থার অংশ ছিলেন না। তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যে তেজস্ক্রিয় মুক্ত ‘আমি’র জয় দেখি, তার কাছাকাছি অচলায়তনভাঙা অষ্মিতা ভারতবর্ষে কেন, বিশ্বসাহিত্যেই বিরল।
নজরুলের জীবন ও সাহিত্যে যে বাঁধনছেঁড়া পুরুষকার দেখি, তা আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী। যার মনে এত তীব্র ভালোবাসা, বিদ্রোহ আর ট্র্যাজিক আত্মচেতনা দপদপ করে, তাকে ধারণ করার সমাজ কই? তাকে তো স্বাভাবিকতার বাইরে বোবা ও অপ্রকৃতিস্থই হতে হবে। বাঙালি ভাবুক ও ভাবালু। নজরুল এ দুটির কোনোটিই নন; কিন্তু সংবেদন আর উচ্ছ্বাস দিয়ে তিনি চিন্তাকে ছাপিয়ে এমন এক সত্যে পৌঁছান; চিন্তায় যা তখনো ধরা যায়নি। নিম্নবর্গের নজরুল, বোহেমিয়ান নজরুল, বিপ্লবী নজরুল, যাত্রার নায়ক নজরুল, গায়ক-অভিনেতা নজরুল, পল্টনের নজরুল, প্রেমিক নজরুল, বৈষ্ণব ও সুফি নজরুল জীবনের যত পথে নিজেকে আবিষ্কার ও নিঃশেষ করেছেন, কোনো সনাতন ব্যক্তিপুরুষের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। রবীন্দ্রনাথ যদি দেখতে পেতেন, তাহলে গোরার মতো কাল্পনিক আদর্শবাদী ইউটোপিয়া তৈরি না করে নজরুলকেই তার উপন্যাসের নায়ক করতেন।
প্রথম কবিতা প্রকাশের পর শতবর্ষ হতে চলল। তবু ফেরারি আজও; ঘরে ফেরা হয়নি দুখু মিয়ার। তাহলে ফেরারি কবিকে কীভাবে ‘জাতীয় কবি’ করা হয়? জবাব হলো, বোবা করে দিয়ে। নজরুল শেষ বয়সে বোবা হয়ে গিয়েছিলেন নিয়তির পরিহাসে, মস্তিষ্ক শুকিয়ে আসার রোগে। কিন্তু নজরুল প্রতিভাকে ফুলমালায় ঢেকে তার বিপ্লবী বাঁধনছেঁড়া চরিত্রকে গোপন করে ফেলা হচ্ছে। শোকের চল্লিশ দিন পর যেমন কথা বলে ওঠে শোকতপ্ত মানুষ; শতবর্ষের নীরবতার পর নজরুলও ঠিক রব করে উঠবেন তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রবল অহমিকা নিয়েই।
একের ভেতরে বহু হয়ে থাকা নজরুলের সেই মুখের সাথে আমাদের পরিচয় হতে এখনো অনেক বাকি। ভালোবাসা বা ভক্তির ঝালর দিয়ে তাকে ঢেকে রেখে আমরা বলতে পারি না কাজী নজরুল আমাদের একজনই জাতীয় কবি। জীবনানন্দ ও বিনয় মজুমদারের সেই সারসের মতো কিংবা রবীন্দ্রনাথের উড্ডীন বলাকার মতো নজরুলের নীড়-হারা পাখিটাও অচিন পাখি হয়েই রয়ে গেলো।
কবি ও লেখক। সমকাল পত্রিকার পরিকল্পনা সম্পাদক।
যে মানুষটি ঘুমিয়ে থাকা স্বদেশবাসীর উপলব্ধির দেয়ালে প্রবল করাঘাত করে তাদের জাগিয়েছিলেন, প্রবল ক্ষোভে লোপাট করতে চেয়েছিলেন ‘শিকল পূজার পাষাণ-বেদী’, সেই মানুষটিই লিখেছিলেনহে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে, আমার বিজয়কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।’ যিনি ‘খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’ বিশ্ব-বিধাত্রীর চির-বিস্ময় হয়ে মহাকাশে উত্থিত হতে চেয়েছিলেন সেই তিনিই পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিকের প্রতিভূ হয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘প্রতি তরুণীর ঠোঁটে! প্রকাশ গোপন/যে কেহ প্রিয়ারে তার চুম্বিয়াছে ঘুম-ভাঙা রাতে/রাত্রি-জাগা তন্দ্রা-ঘুম পাওয়া প্রাতে/সকলের সাথে আমি চুমিয়াছি তোমা’/সকলের ঠোঁটে যেন হে নিখিল-প্রিয়া-প্রিয়তমা!’ তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। এক হাতে বাঁশের বাঁশরী, অন্য হাতে রণতূর্য নিয়ে বাঙালির চেতনার দুয়ারে নিরন্তর দন্ডায়মান এক বিপ্লবী প্রেমিক।
প্রেমিক না বিপ্লবী? দাঁড়িপাল্লায় তুললে কোন দিকটি ভারী হবে? সে বিতর্ক একপাশে রেখে নজরুলের জীবন ও কবিতাকে যদি সাক্ষ্য মানি, তবে ‘বিদ্রোহী’র তুলনায় ‘প্রেমিক’ সত্তাটি এতটুকু ঊন হবে না। বস্তুত নজরুলের বিদ্রোহের মধ্যেও জেগে আছে প্রেম, আর প্রেমের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অভিমানী এক বিদ্রোহী। তার জীবনে প্রেম এসেছে বারবার। যদিও বহুলশ্রুত, তবু নজরুলের জীবনের প্রেমের তিনটি অধ্যায়ে আরেকবার চোখ বুলানো যাক।
১৯২১-এর মার্চ। বন্ধুবর আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লায় বেড়াতে আসেন নজরুল। এই কুমিল্লাই নজরুলের জীবনে যুক্ত করল প্রমীলা ও নার্গিসকে। নার্গিস আলী আকবর খানের ভাগ্নি, অন্যদিকে নজরুল কুমিল্লা শহরে যার বাড়িতে আতিথ্য নিয়েছিলেন সেই ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রমীলা। কাকতালীয়ভাবে, প্রমীলা ও নার্গিস দুজনেরই পিতা প্রয়াত, দুজনেই নিজ নিজ মায়ের আদরে-শাসনে প্রতিপালিত। ভবিতব্য ঠিক করে রেখেছিল, নার্গিস ও প্রমীলা দুজনেই নজরুলের স্ত্রী হবেন। তবে প্রমীলা পাবেন স্ত্রীর পূর্ণ মর্যাদা, হবেন নজরুলের সন্তানের মা, আর নার্গিস পাবেন অবহেলা, অসম্মান এবং দীর্ঘ বিরহের জ্বালা।
আলী আকবর খানের প্রবল আগ্রহ এবং প্রত্যক্ষ উদ্যোগে নার্গিসের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন নজরুল। ইতিহাসখ্যাত সে বিয়ে এক রাতও টেকেনি। দৌলতপুর ছেড়ে স্ত্রী নার্গিসকে কোথাও নেওয়া যাবে না কাবিননামায় এই শর্তের কারণে প্রেমিক নজরুলকে ছাপিয়ে বিদ্রোহী নজরুল প্রবল হয়ে উঠলেন। কনেপক্ষের কাকুতি মিনতি উপেক্ষা করে বিয়ের আসর থেকে উঠে এলেন। কখনোই আর ফিরে আসেননি। সতেরো বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ফের বিয়ে করেন নার্গিস। ১৯৩৭ সালে, নিজের দ্বিতীয় বিয়ের প্রাক্কালে হঠাৎ নজরুলকে আবার চিঠি লিখলেন তিনি। সে চিঠি নজরুল সংরক্ষণ করেননি। তবে উত্তর দিয়েছিলেন। নার্গিসকে লেখা তার প্রথম ও শেষ চিঠি। ১৯৩৭-এর ১ জুলাই কলকাতা থেকে নার্গিসকে লেখা সেই চিঠির শেষে নজরুল বললেন, ‘আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত, কী অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়ছি তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি।’ চিঠির শেষে বলেছেন, ‘...আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষ রশ্মি ধরে ভাঁটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করো না। তোমাকে লেখা এই প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি, বিশ্বাস করো, আমার অক্ষয় আশীর্বাদী কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে। তুমি সুখী হও, শান্তি পাওএই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ!’
কী পরিহাস, নজরুল তথা প্রিয় নুরুদার বিয়েতে মা বিরজাসুন্দরীসহ আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে যোগ দিয়েছিল ত্রয়োদশবর্ষীয়া দুলিও। স্বপ্নেও কি ভেবেছিল, তিন বছর না গড়াতেই নুরুদার সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধতে হবে? প্রমীলা ও নজরুলের দাম্পত্য জীবন দীর্ঘ হয়েছিল; অবসান ঘটেছিল ১৯৬৭ সালে প্রমীলার মৃত্যুতে। এর বহু আগে, ১৯৩৯ সালে পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়েছিলেন তিনি, বছর তিনেক পর নজরুলও বাকহারা হলেন চিরজীবনের জন্য। প্রমীলার অসুস্থাবস্থায় নজরুল এবং নজরুলের অসুস্থাবস্থায় শয্যাশায়ী হয়েও সেবা ও যত্নের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন প্রমীলা। এ থেকে স্পষ্ট, উভয়ের প্রতি উভয়ের শ্রদ্ধাবোধ ছিল গভীর। প্রেম? সে-ও ছিল নিশ্চয়ই; যদিও সংসারের ভারে পরবর্তী জীবনে আবেগের চেয়ে দায়িত্বই বড় হয়ে উঠেছিল বলে প্রতীয়মান হয়। প্রমীলার অসুস্থতার সময় স্ত্রীর জন্য নজরুলের আকুলতা, তার চিকিৎসায় আত্মনিবেদন ইত্যাদি পত্নিপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তন্ত্রমন্ত্র, ঝাঁড়ফুক ইত্যাদি নানা অপচিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমেও তিনি চেষ্টা করেছেন স্ত্রীকে সুস্থ করে তুলতে; যদিও তাতে কোনো কাজ হয়নি। নার্গিস অধ্যায়ের চরম মানসিক বিপর্যয়ের পর শান্ত, স্থির প্রমীলা নজরুলের জীবনে স্থৈর্য এনেছিলেন। ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে অম্লান প্রদীপের মতো জেগে থেকে নজরুলকে দিয়েছিলেন গার্হস্থ্য শান্তি।
তবে পতিভক্ত স্ত্রী কিংবা সংসারের টানকোনোকিছুই প্রেমিক নজরুলকে পুনর্বার প্রেমে পড়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। ১৯২৭ সালে ঢাকার বন্ধুদের আমন্ত্রণে নজরুল আড়াই মাস ঢাকায় ছিলেন। সে সময়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। প্রথম দেখাতেই নজরুল ফজিলাতুন্নেসার প্রতি প্রবল অনুরাগ বোধ করেন। নিজের সবটুকু আকর্ষণী ক্ষমতা দিয়ে ভালোবাসার মানুষটির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সব চেষ্টাই ফজিলাতুন্নেসার নির্বিকারতার দেয়ালে প্রতিহত হয়ে ফিরে এসেছে। নার্গিসের প্রতি যে নির্মম অবহেলা দেখিয়েছিলেন হয়তো প্রকৃতিই সেটি ফজিলাতুন্নেসার মাধ্যমে সুদে-আসলে ফিরিয়ে দিল তাকে। বেদনার্ত নজরুল ফজিলাতুন্নেসাকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, ‘সুন্দর কঠিন তুমি পরশ-পাথর, তোমার পরশ লভি হইনু সুন্দর/তুমি তাহা জানিলে না।’ এ সময় প্রিয় বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা একাধিক চিঠিতে প্রেমিক নজরুলের আহত হৃদয়ের আকুলতা ফুটে উঠেছে। ১৯২৮-এর ৮ মার্চ কলকাতা থেকে কাজী মোতাহার হোসেনকে লেখা এক চিঠিতে দুঃখ করে বলেছেন, ‘যেদিন আমি ঐ দূর তারার দেশে চলে যাবসেদিন তাকে বলো, এই চিঠি দেখিয়েসে যেন দুটি ফোঁটা অশ্রুর তর্পণ দেয় শুধু আমার নামে! হয়তো আমি সেদিন খুশিতে উল্কা ফুল হয়ে তার নোটন খোঁপায় ঝ’রে পড়ব।’ ১৯২৮ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে চলে যান ফজিলাতুন্নেসা। ফিরে এসে নজরুলের সঙ্গে আর যোগাযোগ রক্ষা করেননি। নজরুলের জীবনের আরেক প্রগাঢ় প্রেমকথার এভাবেই বেদনাদায়ক সমাপ্তি ঘটে।
প্রেমিক নজরুলের দিকে যদি তাকাই, অন্য সব বৈশিষ্ট্য ছাড়িয়ে একটি বৈশিষ্ট্যই প্রবল হয়ে ওঠে, তা হলো আবেগের প্রাবল্য। আদর্শ প্রেমিকের কুললক্ষণও কিন্তু তা-ই। প্রতিটি প্রেমই যেন সেই দুখ-জাগানিয়া বাঁশির সুর হয়ে এসেছে নজরুলের জীবনে। কাজী মোতাহার হোসেনের কাছে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, ‘... আজ ডুবেছি, বন্ধু! একেবারে নাগালের অতলতায়। ভাসে যারা, তাদের কূল মেলা বিচিত্র নয়। কিন্তু যে ডোবে, তার আর উঠবার কোনো ভরসা রইল না।’ বোঝা যায়, প্রেম-দরিয়ায় এই অসহায় নিমজ্জন কবিকে ব্যাকুল করে তুলেছিল বটে, তবে সেই ব্যাকুলতার মধ্যেও ছিল এক ধরনের আনন্দযে আনন্দের স্বাদ কেবল প্রকৃত প্রেমিকই জানেন। বস্তুত কেবল প্রেমেই নয়, জীবনভর সব কাজে মস্তিষ্ক ও হৃদয়এ দু’য়ের দ্বন্দ্বে হৃদয়কেই প্রাধান্য দিয়েছেন নজরুল। যতদিন চেতন ছিলেন, আবেগকেই দিবারাত্রির সঙ্গী করে রেখেছেন। জীবনের প্রথম পর্যায়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে যে রোমান্টিক কবির জন্ম হয়েছিল, কালের পরিক্রমায় তিনি ক্রমশ স্থিতপ্রাজ্ঞ এবং গভীরতাসন্ধানী হয়েছেন। প্রেমের সূক্ষাতিসূক্ষ অনুভূতি আর বহুমাত্রিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। যত সময় গেছে, কোনো বিশেষ মানবী নয়, জীবন ও প্রকৃতির বৃহত্তর পরিসরে ক্রমবিস্তৃত হয়েছে কবির আবেগি সত্তা। রোমান্টিক বিষন্নতার এক অনুভূতি তাড়া করেছে তাকে। মানুষ, প্রকৃতি, মহাবিশ্ব সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে দিয়েছেন। জীবনের যত না পাওয়া, পেয়ে হারানোর বেদনা আর প্রতিদানহীন ভালোবাসা কবিকে ক্রমশ বিষন্ন করে তুলেছে। হয়তো সেই অভিমান থেকেই চিরস্তব্ধ হওয়ার কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ‘আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’
যেন এক ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ভর করেছিল নজরুলের ওপর, সেজন্যই এমন নিখুঁতভাবে দেখতে পেয়েছিলেন সামনের দিনগুলোকে। বস্তুত এ-ও ছিল এক অভিমানী প্রেমিকের কণ্ঠস্বর। নজরুলের জীবন, সৃষ্টি ও সত্তার মধ্যে যে কণ্ঠস্বর চিরঞ্জীব অগ্নিশিখার মতো সতত দীপ্যমান।
কথাসাহিত্যিক, গবেষক ও অনুবাদক
সূত্র:
১। নজরুল জীবনে প্রেমের এক অধ্যায়। সৈয়দ আলী আশরাফ (সম্পা.)। বাংলা সাহিত্য বিভাগ, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬৭
২। কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃষ্টি। রফিকুল ইসলাম। কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, কলকাতা। ১৯৯১
৩। নজরুল জীবনী। অরুণকুমার বসু। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা। ২০০০
কাজী নজরুল ইসলাম। আমি তাকে ‘সাহস’-না, ‘দুঃসাহস’ বলেই ডাকি! যদিও দুখু মিঞা, নজর আলি কত নামই-না বইপত্তরে পাওয়া যায়। কিন্তু দুঃসাহসই যেন তার ঠিকঠাক নাম। একটি কবিতায় নজরুল নিজেই অবশ্য বলেছিলেন : দারিদ্র্য তাকে মহান করেছে, খ্রিস্টের মতো করেছে সম্মানিত আর দিয়েছে ‘অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’। তবু যে কেউ বলবেন, ওটা নজরুলের বিনয়াধিক্য : শুধুই দারিদ্র্য তাকে এমনটা করেনি। কিংবা দারিদ্র্যের মোটেই এমন শক্তি নেই, এটা নজরুলের আলঙ্করিক প্রয়োগ। দারিদ্র্যই যদি এমনটি করত তাহলে গুলিস্তান বা ফার্মগেট এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা সাহায্যপ্রার্থী দরিদ্রদের সবাই নজরুল হয়ে যেতেন বা হতেন দুরন্ত সাহসী! কিন্তু তারা তা হননি।
নজরুল কী? এই প্রশ্নটি বুঝতে হলে দারিদ্র্য মাপকাঠি নয়, বোধের বিস্তার চাই আরও অন্যদিকে। এতটা দুঃসাহসী নজরুল হলেন কী করে? তার চরিত্রে বাউণ্ডেলে ভাব ছিল বটে, কিন্তু জেদের বিন্দুমাত্র ভাব ছিল না। নারীপ্রেমে তার চোখে জল এসেছে অনেকবার। একই সঙ্গে একাধিক নারীর প্রেমেও দ্রবীভূত হয়েছে তার হৃদয়। বিবাহিত ও সন্তান-সংসারেও দেখা দিয়েছে অন্য নারীর প্রতি আকর্ষণ। বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনকে লিখেছেন বালিশ চাপা দিয়ে কি বুকের কষ্ট লাঘব হয়! মায়ের জন্য মনে কাতরতা ছিল আর তাই বিরজাসুন্দরী, বাসন্তী দেবী, মিসেস মাসুদা রহমান, গিরিবালা দেবীকে নজরুল মা বলে ডাকতেনই শুধু নয়, তাদের সঙ্গে মাতা-পুত্রের স্নেহময় সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী করেছিলেন। দিনের পর দিন এই নারীদের মাতৃজ্ঞানে সেবা করেছেন নজরুল। আবার প্রেমময় বৈষ্ণবের মতো কাতর হয়ে লিখেছেন : ‘তুমি যদি রাধা হতে শ্যাম... তুমি যে কাঁদনে কাঁদায়েছ মোরে, আমি কাঁদাতাম তেমনি করে’। এই কান্না আর আবেগ স্নেহময়তা যার মধ্যে বিরাজ করে, তিনি এতটা দুঃসাহসী হয় কী করে! নজরুল যখন সাহিত্যচর্চা শুরু করছেন এবং প্রকাশের জন্য লেখাগুলো পাঠাচ্ছেন, সেগুলো মূলত মুসলিম ভাবধারার। যেমন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সম্পাদিত ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ বা মোজাম্মেল হক সম্পাদিত ‘মোসলেম্ ভারত’ পত্রিকায় নজরুল প্রথম দিকে প্রচুর লিখেছেন। দুই বছরের কম সময় বেরিয়েছে ‘মোসলেম্ ভারত’ কিন্তু এরই মধ্যে নজরুলের চল্লিশটি রচনা এখানে স্থান পায়। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস কী বের হয়নি এখানে? চিত্রের নজরুল-প্রদত্ত ক্যাপশন পর্যন্ত ছাপা হয়েছে এখানে। এরপর নজরুলের চেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে যায়। তিনি নির্দিষ্ট ধর্মীয় ঘরানা থেকে বের হন এবং ধীরে ধীরে অমুসলিম সম্পাদিত পত্রিকায় লেখা আরম্ভ করেন। নলিনীকান্ত সরকার সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশ হলে দুবারে পত্রিকাটি প্রায় ঊনত্রিশ হাজার সংখ্যা ছাপতে হয়। এরপর নজরুলের অন্যভাবে প্রকাশ! কিন্তু তার আগ পর্যন্ত নজরুল মূলত লিখেছেন ইসলামি ভাবধারার কবিতা। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’য় যে কবিতাগুলো আছে তার মধ্যে প্রায় অর্ধেক আছে ইসলাম ধর্মসংশ্লিষ্ট। যেমন ‘মোহররম’, ‘কোরবানী’, ‘খেয়া-পারের তরণী’, ‘শাত-ইল আরব’, ‘রণভেরী’ এসব কবিতাতেই ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্য কোনো না কোনোভাবে ব্যঞ্জিত হয়েছে। এমন কি ‘আনোয়ার’ নামের কবিতাও ইসলামের বিজয়কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার প্রয়াসমাত্র। এই কবিতাগুলোর পরে লেখা ‘বিদ্রোহী’, ‘ধুমকেতু’, ‘প্রলয়োল্লাস’ এবং সেগুলো পরেই পত্রিকাতেও বের হয়। কিন্তু লক্ষ করার বিষয়, ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বরে যখন ‘অগ্নিবীণা’ বই আকারে প্রথম বের হলো, যেটি নজরুলের প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই সেই বইয়ে লেখক প্রথমে স্থান দিলেন ‘প্রলয়োল্লাস’ বা ‘বিদ্রোহী’র মতো কবিতা এবং একেবারে শেষে স্থান দিলেন ইসলাম ধর্মসংশ্লিষ্ট কবিতাগুলো। ব্যাপারটি সামান্যতর নয়, দুঃসাহসের! কারণ, ততদিনে নজরুলের চেতনার বেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে। আরও অবাক হওয়ার ব্যাপার : ‘অগ্নিবীণা’ উৎসর্গ করা হলো বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে। যে সময় ক্ষুদিরাম বসু, যতীন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ বিপ্লবী কর্মকাণ্ড করে ব্রিটিশদের রোষানলে পড়েছেন, সে সময়ই নজরুল আর এক বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে উৎসর্গ করেন নিজের লেখা প্রথম কবিতার বই। এই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ বোমা তৈরি ও প্রয়োগের মামলায় প্রথমে প্রাণদণ্ডাদেশ ও পরে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পেয়েছিলেন। তার সঙ্গে উল্লাসকর দত্তকেও একই আদেশ দেওয়া হয়। এমন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি, যিনি প্রথম থেকেই ব্রিটিশবিরোধী কর্মকাণ্ডে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন, তাকে প্রথম গ্রন্থ উৎসর্গ করেও নজরুল বুঝিয়েছিলেন, কোনো জ্ঞাতি বা আত্মীয় নয়, আদর্শের সম্পর্কই বড় আর সেটি আত্মার আত্মীয়ও। নজরুলের এই উৎসর্গ কর্মটি সাধারণ ও স্বাভাবিক ছিল না। শুধু আদর্শের টানে এই কর্মটি তিনি করেছিলেন।
‘তুই’ তুচ্ছার্থ দিয়ে আরম্ভ করলেন কবিতা : ‘তোরা সব জয়ধ্বনি র্ক’! প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতার প্রথম চরণের প্রথম শব্দ তুচ্ছার্থের তুই দিয়ে আরম্ভ হতে আর কোনো বাঙালি কবির কবিতায় দেখিনি। একেবারে ধাক্কা দিয়ে বাংলা কাব্যাঙ্গনে প্রবেশ করলেন নজরুল। এরপর ‘বিদ্রোহী’ পড়ে বাঙালি পাঠক ভাব ও ভাষাতে যে স্পর্ধিত সাহস অনুধাবন করে, তা আর তুলনায় ধরে না। মুসলিম সমাজ চমকে যায় খোদার আসন আরশ ছেদ করার ঘোষণায়, হিন্দুসমাজ হতবিহ্বল হয়ে পড়ে আরেক ভ...গু মুনির আগমন ধ্বনি শুনে। এখনো একই কবিতায় এমন স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয়কে আর কি কেউ ধরতে পেরেছেন? ‘কামাল পাশা’ কবিতায় নজরুল বললেন, কামাল পাশার বীরত্ব দেখে আহ্লাদিত নারীসমাজ পথে নেমে এসেছে এবং তাদের মাথার ঘোমটা খুলে পড়ছে। কী সাংঘাতিক! নারীর এমন বেপর্দা হওয়ার চিত্র কোনো দুঃসাহসী কবি ছাড়া কি উল্লেখ করতে পারেন? প্রকরণেও সাহস ছিন্ন করলেন নজরুল। ‘বিদ্রোহী’তে তিনি যে আঙ্গিক বৈচিত্র্য আনলেন, বাংলা কবিতায় তা অভাবিতপূর্ব।
লেখার দায়ে কাজী নজরুল ইসলামই জেলে গেছেন প্রথম, তেমন নয়। এর আগেও অনেকে গেছেন : এ প্রসঙ্গে ইসমাইল হোসেন শিরাজির নামই করা যায়! কিন্তু নজরুল জেলখানায় যে দৃঢ়তার পরিচয় দেন, তা বিস্ময়কর। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামের কবিতা লিখে তিনি জেলে যান। জেলে আটক রেখে নজরুলের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয় লিখিত কবিতা সম্পর্কে। ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেলে বসে চার পৃষ্ঠার লেখা লেখেন তিনি, এর নাম ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’। তাতে নজরুল স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেন : ‘এই অন্যায় শাসনক্লিষ্ট বন্দি সত্যের পীড়ত ক্রন্দন আমার কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল বলেই আমি রাজদ্রোহী?’ বাঘের সামনে বসে তার গালে চপেটাঘাত করা যেমন, নজরুলের এই জিজ্ঞাসার মধ্যেও আছে তেমন সাহসের তড়িৎ। এরপর বিভিন্ন সময় তার একাধিক কবিতা ও প্রকাশিত পাঁচটি বই ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। এসব ব্যাপারে নজরুলের ভ্রুক্ষেপও ছিল না।
ব্যক্তিজীবনে এতটা দুঃসাহসী তিনি! নার্গিসের সঙ্গে বিয়ে তিনি কীভাবে ছিন্ন করলেন? কুমিল্লার মুরাদনগর থানার দৌলতপুরের মেয়ে নার্গিসের সঙ্গে বিয়ের রাতেই নজরুল অভিমান বা বিয়ের ঘটনা প্রত্যাখ্যান করে চলে যাওয়া যে মিথ, সেটি দুঃসাহসী নয় কি? একটি মেয়েকে বিয়ে করে, সেই বিয়েকে অস্বীকার করে বর একাকী কোন পথে এবং কীভাবে মুরাদনগর থেকে চলে গেলেন? বর চলে যেতে চাইলে, নববধূর পক্ষই-বা তাকে যেতে দিলেন? আজ থেকে একশ বছরেরও আগের মুরাদনগর-কুমিল্লা-কলকাতার রাস্তা ও যোগাযোগব্যবস্থার কথা চিন্তা করে নজরুলের পুরো কাজটি দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চারের মতো লাগে। পরে প্রমীলাকে যে অবস্থায় (!) তিনি বিয়ে করেন এবং বিয়ের সময় প্রমীলার ধর্ম-অস্তিত্ব বজায় রাখার পথ বাতলে দেন, সেটিও এক কথায় অসামান্য। বাংলা ও আরবি শব্দ মিলিয়ে নজরুল ও প্রমীলার সন্তানদের নামকরণ এমন দৃষ্টান্ত কি আগে আছে? আমার জানা নেই। এমন দৃষ্টান্ত আজও অনুসরণ করার লোক বেশ অভাব, এমন কি তার উত্তর-প্রজন্মেও!
কাজী নজরুল ইসলাম তাই তার সময়ের থেকে এগিয়ে; তার কর্ম ও চিন্তাও প্রাগ্রসর সমকালীন ব্যক্তিবর্গ থেকে। নজরুলের আরেক নাম তাই সাহস। না না দুঃসাহস!
লেখক ও গবেষক, উপাচার্য-জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
নিজের বিদায়ী ম্যাচ বলেই কিনা জ্বলে উঠলেন সার্জিও রামোস। শুরুতেই পেয়ে যান গোলের দেখা। কিলিয়ান এমবাপ্পে আছেন তার আগের মতোই। তিনিও ডাবল লিড এনে দেন। তবে বিদায়ী ম্যাচে নিষ্প্রভ রইলেন লিওনেল মেসি। তাতেই কিনা শুরুতেই এগিয়ে যাওয়া ম্যাচটি হার দিয়ে শেষ করেছে পিএসজি।
লিগ ওয়ানের শেষ ম্যাচে ক্লেরমো ফুতের সঙ্গে ৩-২ গোলে হেরে গেছে প্যারিসিয়ানরা। তাতে রাঙানোর বদলে বিষাদভরা বিদায় হলো মেসি-রামোসদের।
আগেই লিগ শিরোপা নিশ্চিত করা পিএসজি মৌসুমে নিজেদের এই শেষ ম্যাচে দুটি পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নেমেছিল। হুগো একিতেকে ও আশরাফ হাকিমিকে ফেরান কোচ ক্রিস্তফ গালতিয়ের।
শুরুতে গুছিয়ে উঠতে সময় লেগেছে পিএসজির। প্রথম ১০ মিনিটের পর ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২১ মিনিটের মধ্যে এগিয়ে গিয়েছিল ২-০ গোলে। রামোস ১৬ মিনিটে হেড থেকে এবং তার ৫ মিনিট পর কিলিয়ান এমবাপ্পে পেনাল্টি থেকে গোল করেন।
২-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে ক্লেরম ফুতের পাল্টা লড়াই শুরু করতে সময় নিয়েছে মাত্র ৩ মিনিট। ২৪ মিনিটে গোল করেন ক্লেরমঁর গাস্তিয়েন। এর প্রায় ১২ মিনিট পরই পেনাল্টি থেকে গোল করার সুযোগ নষ্ট করেন ক্লেরমঁ স্ট্রাইকার কেয়ি। পরে অবশ্য ৬৩ মিনিটে তাঁর গোলেই জিতেছে ক্লেরমঁ। প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে ক্লেরমঁর হয়ে সমতাসূচক গোলটি জেফানের।
বিরতির পর গোলের দারুণ একটি সুযোগ নষ্ট করেন মেসি। ৫৪ মিনিটে বাঁ প্রান্ত দিয়ে এমবাপ্পে ঢুকে পড়েন ক্লেরমঁর বিপদসীমায়। তাঁর ক্রস পেয়ে যান ডান প্রান্ত দিয়ে দৌড় বক্সে ঢোকা মেসি। সামনে গোলকিপার একা, কিন্তু মেসি অবিশ্বাস্যভাবে বলটা পোস্টের ওপর দিয়ে মারেন।
সতীর্থ গোলকিপার সের্হিও রিকোর সুস্থতা কামনা করে বিশেষ জার্সি পরে মাঠে দাঁড়িয়েছিলেন মেসি-এমবাপ্পেরা। ঘোড়ায় চড়তে গিয়ে দূর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন রিকো। ম্যাচে বিশেষ জার্সি পরে খেলেছে পিএসজি। মেসি-রামোসদের জার্সির পেছনে রিকোর নাম লেখা ছিল।
৩৮ ম্যাচে ৮৫ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শীর্ষে থেকে মৌসুম শেষ করল পিএসজি। ৮৪ পয়েন্ট নিয়ে দুইয়ে লেঁস। তৃতীয় মার্শেইয়ের সংগ্রহ ৭৩ পয়েন্ট। ৬৮ পয়েন্ট নিয়ে চারে ইউরোপা লিগ নিশ্চিত করা রেঁনে।
এক যুগের ব্যবধানে ঘটা সহিংসতার দুটি ঘটনায় করা তিন শতাধিক মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার পর তদন্ত করে দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মামলাগুলো ২০০১ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা এবং ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়ের করা হয়েছিল। পাশাপাশি যেসব মামলা বিচারাধীন আছে সেগুলোও দ্রুত নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে পুলিশের সব ইউনিট প্রধানদের কাছে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে।
পুুলিশের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনে আসা ‘ভিআইপি অভিযোগগুলো’ আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে পুলিশ ও দুদক সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, নতুন করে তদন্ত করার সময় অহেতুক নিরপরাধ লোকজন যাতে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়ার জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। মামলায় যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়ে আরও গভীরে গিয়ে তদন্ত করতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ২০০১ ও ২০১৩-২০১৫ সালে সহিংসতা মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করতে বলা হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানান, রাজনৈতিক কারণে মামলা জিইয়ে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। সব সরকারের আমলেই এসব করা হচ্ছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর সারা দেশে তান্ডব চালিয়েছিল এই নিয়ে দেশে বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাসহ অনেকেই আসামি হয়েছেন। ২০১৩-২০১৫ সালে সহিংতার ঘটনা মামলা হয়েছে এসব মামলা দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন ও যেসব মামলা আদালতে বিচারাধীন আছে সেগুলোর দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দিনের পর দিন ওইসব মামলা আদালতে ঝুলছে। এতে ভুক্তভোগীরা বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই যারা এসব অপকর্ম করেছে তাদের তাদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে।
সহিংসতা মামলার পাশাপাশি গত ১০ বছরের ব্যবধানে দুর্নীতি দমন কমিশনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ‘ভিআইপি অভিযোগগুলো’ অনুসন্ধান করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, আন্দোলনের নামে বিএনপি ও জামায়াত ২০১৩-২০১৫ সালে তান্ডবলীলা চালিয়েছে। ২০০১ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক অত্যাচার করা হয়েছিল। ওইসব মামলার বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তাছাড়া আন্দোলনের নামে ঢাকাসহ সারা দেশে তান্ডব চালিয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট। সারা দেশেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব মামলা কী অবস্থায় আছে তাও পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস ও নাশকতা করে যারা দেশকে অস্থিতিশীল করার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল, তাদের বিচার করা হবে। এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তা পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। তবে নিরপরাধ কাউকে আমরা হয়রানি করছি না। ভবিষতেও করব না।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে একটি মহল দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। তাদের দমন করতে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে হবে না। এতে সাধারণ জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। আন্দোলনের নামে তারা জ্বালাও-পোড়াও করে সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। এসব ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি যেসব মামলা আদালতে রয়েছে সেগুলোর বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।
একই কথা বলেছেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, হামলায় পেশিশক্তি যেমন থাকে, রাজনৈতিক শক্তিও থাকে। সাধারণভাবে এমন একটি ধর্মীয় জিগির তোলা হয় তখন অনেক ক্ষেত্রেই সব দল এক হয়ে হামলা চালায়। বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। যারা এসব অপকর্ম করছে তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। পাশাপাশি যেসব মামলার তদন্ত শেষ হয়নি তা সঠিকভাবে তদন্ত করতে হবে। ঢালাওভাবে রাজনৈতিক নেতাদের দোষারোপ করা যাবে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখনো বেশ কিছু মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। তাছাড়া জ্বালাও-পোড়াওয়ের অনেক মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। সবমিলিয়ে অন্তত তিন শতাধিক মামলা হবে। এসব মামলা সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে পুুলিশের সব ইউনিটকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে বিচার না হওয়ায় আবারও একটি মহল দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, স্পর্শকাতর মামলায় দীর্ঘদিনে বিচারকাজ শেষ না হওয়ার কারণে বাদীপক্ষের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আসামিপক্ষ ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে। আর এসব কারণে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঝুলে থাকা মামলাগুলো সক্রিয় করে দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। তবে অহেতুক কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে বলা হয়েছে তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার কারণ উদঘাটন এবং জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে ‘হিউম্যান রাইট ফর পিস’ নামের একটি মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। ২০০৯ সালের ৬ মে এসব নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেয় আদালত। ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মো. সাহাবুদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্যর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন দীর্ঘ সময় তদন্ত করে ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে একটি প্রতিবেদন দেয়। তদন্তকালে কমিশন ৫ হাজার ৫৭১টি অভিযোগ পেয়েছিল। বিএনপি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাসহ অন্তত ১৮ হাজার নেতাকর্মী জড়িত ছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। সহিংসতার পর বরিশাল বিভাগে ২ হাজার ১৮৯টি, ঢাকায় ১৮৪টি, চট্টগ্রামে ৩৫০টি, রাজশাহীতে ১১৭টি এবং খুলনায় ৪০৫টি হামলার ঘটনা ঘটে। তাছাড়া হামলায় খুলনা বিভাগে ৭৩, ঢাকা বিভাগে ৯২, রাজশাহী বিভাগে ৫৩, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৭, বরিশাল বিভাগে ৩৮ এবং সিলেট বিভাগে ২ জন হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। তারমধ্যে ভোলা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, যশোর, নাটোর, রাজবাড়ী, পাবনা, ফেনী, রাজশাহী, ঝিনাইদহ, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, দৌলতখান, চরফ্যাশন, লালমোহন, বোরহানউদ্দিন, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা এবং মৌলভীবাজার জেলায় হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড বেশি ঘটে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ২২১টি। এর মধ্যে ৫৭টি মামলা তদন্তাধীন। বাকিগুলোতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, ২০১৩-১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন কর্মসূচি চলাকালে পেট্রলবোমা হামলায় দেশজুড়ে মারা গেছে শতাধিক নিরীহ মানুষ। তারমধ্যে আগুনেই পুড়ে মারা গেছে ৪০ জনের মতো। এ সময় রেললাইন পর্যন্ত উপড়ে ফেলাসহ সরকারি সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। ওই সময় মামলা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার। বেশির ভাগ মামলার তদন্ত হয়েছে। ৪৫০টি মামলা বিচারধীন। এসব মামলায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা আসামি। তারা কৌশলে বারবার শুনানির তারিখ নেয়, যে কারণে মামলা পিছিয়ে যায়। এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে, কয়েকটি তারিখ দেওয়ার পর মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা হবে।
এছাড়া ৩১২টি মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। তদন্ত শেষ করে দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে নাশকতা মামলার দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বেশিরভাগ মামলার আসামি এলাকায় থাকেন না। তাদের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করে অভিযোগপত্র দেওয়া তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষে খুব কঠিন হয়ে যায়। আর যেসব মামলায় আদালতে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোরও বিচার কার্যক্রম শুরু হচ্ছে না। তাছাড়া পলাতক আসামিদের বিষয়ে কিছু আইনি জটিলতার কারণেই দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পুনরায় নাশকতা ঘটানো হতে পারে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা। এই নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। তার জানামতে, মামলাগুলো নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা একাধিক সভা করেছেন।
দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, গত দশ বছরে দুদকে ‘অনেক ভিআইপির’ বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। ওইসব অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। অনুসন্ধানের জন্য আলাদা কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চা শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে চা শিল্প সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, বর্তমান সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে দেশে চায়ের উৎপাদন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আজ রবিবার (৪ জুন) জাতীয় চা দিবস উপলক্ষে গতকাল শনিবার দেওয়া এক বাণীতে এ কথা বলেন রাষ্ট্রপ্রধান।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, এক সময় চা ছিল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য। সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে দেশে চায়ের উৎপাদন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চা শিল্পের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ২০১৭ সালে 'উন্নয়নের পথনকশা : বাংলাদেশ চা শিল্প' অনুমোদন দিয়েছে।
মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, চা শিল্পের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন চা শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধিসহ তাদের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বাসস্থান, শৌচাগার ও নলকূপ স্থাপন, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধু মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে ল্যাবরেটরি ও লাইব্রেরি স্থাপনের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রম জোরদারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত চা শিল্প পুনর্গঠনে বাগান মালিকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান ও অবকাঠামো উন্নয়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেন। তিনি ১৯৭৩ সালে শ্রীমঙ্গলের টি রিসার্চ স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা ইনস্টিটিউটে উন্নীত করেন। এটি বর্তমানে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) হিসেবে দেশের চা গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ বছর চা দিবসের প্রতিপাদ্য 'চা দিবসের সংকল্প, শ্রমিকবান্ধব চা শিল্প' অত্যন্ত যথার্থ হয়েছে বলেও মনে করেন রাষ্ট্রপ্রধান।
মো. সাহাবুদ্দিন আশা প্রকাশ করেন, চা শিল্পের সার্বিক উন্নয়নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ চা বোর্ডসহ চা শিল্প সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
রাষ্ট্রপতি 'জাতীয় চা দিবস ২০২৩' উপলক্ষে নেওয়া সব কর্মসূচির সফলতা কামনা করেন।
তুমি জয়ী তুমি বীর
তুমি দুর্ভেদ্য প্রাচীর
তুমি অগ্নি তুমি সেই জ¦লন্ত মশাল
যাতে চিরন্তন প্রজ্বলিত থাকে অগ্নিশিখা
বৈরীর আঘাতে যখন তুমি হও ক্ষতবিক্ষত
অস্ত্র চলে ক্ষিপ্ত বেগে বজ্রশক্তির মতো
সৈনিক তুমি দাউ দাউ করে জ¦লতে থাকা
প্রজ¦লিত অগ্নিশিখা
সেনাবাহিনী তুমি বাংলা মায়ের সার্বভৌমত্ব রক্ষায়
দুই সীমানায় ঘাত-বিঘাতে শহীদ হওয়া হাজার প্রাণ
সেনাবাহিনী মানে সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা কান্না
সেনাবাহিনী মানে বাংলার মানুষের পূর্ণ আস্থা ও ভরসা
সেনাবাহিনী মানে দেশের সেবা অক্ষুন্ন রেখে
দেশবাসীকে বাঁচানোর লক্ষ্যে পথচলা
হয়তো তার মনের অবচেতনে জেগে ওঠে
মা-বাবা আর আপনজন
তব্ওু মনের গভীরে জেগে রয় তার শপথ বাণী
কখনো তোমার সম্মান ক্ষুন্ন হতে দেব না মাগো
তুমি যে আমার বঙ্গমাতা
তুমি যে সব দেশের রানী
দুর্ঘটনা ঘটেছিল শুক্রবার রাতে। তারপর থেকে আসছিল হতাহতের ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। তবে প্রকৃত ভয়াবহতার চিত্র ফুটতে শুরু করে গতকাল শনিবার ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে। সকালে দেখা যায় তিনটি ট্রেনের বেশিরভাগ কামরা পড়ে আছে মাটিতে। কোনো কামরা পুরোপুরি উল্টে গেছে। কোনোটি আবার উঠে গেছে আরেকটির ওপর। আশপাশে, সামনে-পেছনে শুধু মৃতদেহ। কয়েক ঘণ্টা আগেও যারা বেঁচে ছিলেন, যাদের চোখে স্বপ্ন ছিল তারা লাশ হয়ে পড়ে আছেন খোলা আকাশের নিচে। আহত ও স্বজনহারাদের আর্তনাদ-হাহাকার আর অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দে গতকাল সারা দিনই বিভীষিকাময় ছিল ভারতের ওড়িশার বালাশ্বরের কাছের বাহানগায়ের বাতাস। ওড়িশা রাজ্যে ঘোষণা করা হয়েছে এক দিনের শোক।
শুক্রবার রাতে বালাশ্বরে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর উদ্ধার শেষে দেশটির সরকার ২৮৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যাও হাজার ছুঁইছুঁই করছে। উদ্ধারকাজ শেষ হলেও এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও মানুষ আটকে থাকার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। উদ্ধারকাজের নেতৃত্ব দেওয়া ওড়িশা ফায়ার সার্ভিসের ডিরেক্টর জেনারেল সুধাংশু সারাঙ্গি জানান, নিহতের সংখ্যা ২৮৮। অবশ্য উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার পর রেল কর্র্তৃপক্ষ জানিয়েছে নিহতের সংখ্যা ২৬১। ভারতের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াও দাবি করেছে নিহতের সংখ্যা ২৬১। দেশটির আরেক সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিও প্রথমে ২৬১ জনের কথা বললেও গতকাল সন্ধ্যার পরে তারা নিহতের সংখ্যা ২৮৮ বলেই জানায়। একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমটি বলেছে, নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। দেশটির কেন্দ্রীয় রেল মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অমিতাভ শর্মাও তেমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘উদ্ধারকাজ শেষ হয়েছে। এখন আমরা সংযোগ পুনঃ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করব। তবে এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে মানুষ থাকার আশঙ্কা রয়েছে।’
এনডিটিভি জানায়, যাত্রীবাহী ট্রেন করমণ্ডল এক্সপ্রেস কলকাতা থেকে চেন্নাই যাচ্ছিল। বেলা ৩টার দিকে শালিমার স্টেশন থেকে ছাড়ে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ ট্রেনটি পৌঁছায় বালাশ্বরে। কাছেই বাহানগা বাজারের কাছে মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ট্রেনটি। সে সময় তৃতীয় ট্রেন যশবন্তপুর-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসও এই দুর্ঘটনার শিকার হয়।
ওড়িশা রাজ্যের মুখ্যসচিব প্রদীপ জেনা দুর্ঘটনার পরপর জানিয়েছিলেন, দুর্ঘটনাস্থলে অন্তত ২০০টি অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ১০০ জন অতিরিক্ত ডাক্তার সেখানে সেবায় নিয়োজিত করা হয়েছে।
ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার কারণ কী, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। স্থানীয় মানুষ বলছে, মালগাড়ি গিয়ে ধাক্কা দেয় করমণ্ডল এক্সপ্রেসে। সেই ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। উল্টোদিক থেকে আসছিল সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। উল্টে যাওয়া কামরায় ধাক্কা লেগে সেই ট্রেনের অধিকাংশ কামরা উল্টে যায়। গতকাল দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজন ভারতের বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর আমি ১০ থেকে ১৫ জনের নিচে চাপা পড়ি। আমি ওই মানুষের স্তূপে সবার নিচে ছিলাম। আমার হাতে আর ঘাড়ে আঘাত লাগে। আমি যখন ট্রেনের বগি থেকে বের হই, তখন দেখি কেউ হাত হারিয়েছে, কেউ পা হারিয়েছে, কারও আবার মুখ সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে গেছে।’
এদিকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দেবেন রেলওয়ে সেফটি বিভাগের কমিশনার। এ সংস্থাটি বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে।
এখন পর্যন্ত দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও সিগন্যালের সমস্যার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি জানিয়েছেন, এই রুটে ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ প্রতিরোধী ব্যবস্থা ‘কবচ’ ব্যবহার করা হতো না। রেলওয়ের মুখপাত্র অমিতাভ শর্মা জানান, কবচ সিস্টেমটি এই রুটে নেই। বর্তমানে দিল্লি-হাওড়া এবং দিল্লি-বোম্বে রুটে কবচ স্থাপন করা হচ্ছে।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেসের চারটি বগি ও ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়ে পাশের রেললাইনে পড়ে, যে লাইন দিয়ে যশবন্তপুর-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস যাচ্ছিল। দ্বিতীয় ট্রেনটির পেছন দিকের দুটি বগি তখন লাইনচ্যুত হয়।
রেলওয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ১২টি বগি বাহানগার বাজার স্টেশন পার করার সময় লাইনচ্যুত হয় এবং পাশের লাইনের ওপর পড়ে। সে সময় ওই লাইন দিয়ে হাওড়া এক্সপ্রেস ট্রেন যাওয়ার সময় সেগুলোর সঙ্গে ধাক্কা খায় এবং ট্রেনের তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়।
পত্রিকাটির খবর অনুযায়ী, বাহানগা বাজার স্টেশনে চারটি রেললাইন আছে, যার একটিতে দুর্ঘটনার সময় একটি মালবাহী ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল। যাত্রীবাহী ট্রেন দুটি ভিন্ন ভিন্ন লাইনে একে অপরকে বিপরীত দিক দিয়ে পার করার কথা ছিল। কিন্তু একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে পাশের লাইনে পড়ে গেলে বিপরীত দিক থেকে আসা হাওড়া এক্সপ্রেসের সঙ্গে সেটির সংঘর্ষ হয়।
হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা বলছে, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ১৫টি কোচ লাইনচ্যুত হয়ে পাশের লাইনের ওপরে পড়ে এবং পরে হাওড়া এক্সপ্রেসের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে সেই ট্রেনের দুটি বগি লাইনের বাইরে চলে যায়।
অন্য একটি সূত্রের বরাত দিয়ে দ্য হিন্দু পত্রিকা খবর প্রকাশ করেছে যে প্রথমে হাওড়া এক্সপ্রেস ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত হয়। করমণ্ডল এক্সপ্রেস পশ্চিমবঙ্গ থেকে তামিলনাড়ু যাতায়াতের মাধ্যম। দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগে ট্রেনটি শালিমার স্টেশন অতিক্রম করে। পত্রিকাটি বলছে, মূলত তামিলনাড়ুতে কাজের জন্য ও উন্নত চিকিৎসার জন্য যারা গিয়ে থাকেন, তারা এই ট্রেন ব্যবহার করে থাকেন।
এদিকে বিবিসি বলছে, দুর্ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে উপস্থিত সাংবাদিকদের পাঠানো খবর ও ছবি দিয়ে সেখানকার সবশেষ পরিস্থিতির আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। রেললাইনসহ আশপাশের জায়গাগুলোতে ট্রেনে থাকা মানুষের জিনিসপত্র ছড়িয়ে রয়েছে। লাইনের পাশে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা মৃতদেহ সারিতে রাখা ছিল। কিছুক্ষণ পরপর এই মৃতদেহগুলো গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ট্রেনের বগির ভেতরে মানুষের স্যান্ডেল, কাপড় এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। উদ্ধারকাজ চলাকালে কয়েকজনকে পড়ে থাকা কাপড় ও দড়ির সাহায্যে টেনে বের করা হয়।
ওড়িশার মুখ্য সচিব প্রদীপ জেনা জানিয়েছেন, ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত মানুষকে গোপালপুরে একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে কিছু মানুষকে বালাশ্বর মেডিকেল কলেজেও নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের বাইরে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, বালাশ^র হাসপাতালের পোস্টমর্টেম বিভাগের বাইরে শত শত মানুষ ভিড় করেছে। শুক্রবার রাতেই ৫০০ ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রদীপ জেনা। মানুষ নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে এসে রক্তদান করে যাচ্ছে।
ভারতের রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব শুক্রবার দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে ভুক্তভোগীদের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের আশ্বাস দেন। দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, তদন্তের জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কেন দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা শিগগিরই বোঝা যাবে। এই দুর্ঘটনার দায় নিয়ে তিনি পদত্যাগ করবেন কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের চিন্তা মানুষের জীবন বাঁচানো ও উদ্ধারকাজ শেষ করা।’
রেলমন্ত্রী অশি^নী বৈষ্ণব বলেছেন, প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে ১০ লাখ রুপি করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া গুরুতর আহতদের জন্য দুই লাখ রুপি ও অপেক্ষাকৃত কম আহতদের জন্য ৫০ হাজার রুপি ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে শনিবার সন্ধ্যার দিকে ওড়িশায় ট্রেন দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিনি বলেছেন, এই মর্মান্তিক ঘটনায় যারা পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন তাদের পাশে রয়েছে সরকার। এটা বেদনাদায়ক ঘটনা। আহতদের চিকিৎসার জন্য সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। এটা গুরুতর ঘটনা। তিনি বলেন, এই দুর্ঘটনার প্রতিটি দিক বিবেচনায় নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দোষীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
ট্রেন দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের সঙ্গে ঘুরে দেখেন দুর্ঘটনাস্থল। পরিদর্শনকালে মমতা বলেন, এই দুর্ঘটনার পেছনে কিছু আছে। ভালো করে তদন্ত করতে হবে। তিনি অভিযোগ তোলেন, রেলের কাজে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনের অ্যান্টিকলিশন ডিভাইস ছিল না। ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৮১ সালে। সে সময় অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন বিহার রাজ্যে সাইক্লোনের সময় লাইনচ্যুত হয়ে নদীতে পড়ে যায়। ওই দুর্ঘটনায় অন্তত ৮০০ মানুষ মারা গিয়েছিল।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতি জোর করে হারানো হয়েছে।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন তেমনি যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।