দেশের মোট শ্রমশক্তির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। এমন শ্রমিকদের মধ্যে যে অংশটি সারা দেশে পারিবারিক পরিধির মধ্যে শ্রম বিক্রি করেন তাদের এককথায় গৃহকর্মী হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, মানুষের ঘর-সংসারে নিত্যদিন শ্রম দেওয়া এই গৃহকর্মীরা এখনো আমাদের সমাজে খুবই অবহেলিত। গৃহকর্মীরা শ্রমের যথাযথ মূল্য থেকে বঞ্চিত এবং নানারকম নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হলেও তাদের সুরক্ষায় শক্তিশালী কোনো আইনি কাঠামো নেই। আর সাধারণ আইনে যতটুকু সুরক্ষা গৃহকর্মীরা পেতে পারেন সেটাও সমাজের বিদ্যমান বাস্তবতায় তাদের অধরাই থেকে যায়।
রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের শ্রমিকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। চার বছর আগে ৪ জানুয়ারি, ২০১৬ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫’ প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের গ্রামীণ বর্ধিষ্ণু পরিবার থেকে শুরু করে ক্রমপ্রসারমান নগর জীবনের পারিবারিক আবাসস্থল, মেস এবং ক্ষেত্রবিশেষে ডরমিটরি
প্রভৃতি গৃহকর্মীদের কর্মস্থানের প্রধান ক্ষেত্র। নীতিতে বলা হয়েছে : হালকা কাজের জন্য গৃহপরিচারিকাদের ন্যূনতম বয়স ১৪ হতে হবে। কেবল ১৮ বছরের বেশি বয়সের গৃহপরিচারিকারা ভারী কাজের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন। এ ছাড়া ১২ বছর বয়সের কাউকে গৃহকর্মী হিসেবে রাখতে হলে তার আইনানুগ অভিভাবকের সঙ্গে তৃতীয় কোনো পক্ষের উপস্থিতিতে নিয়োগকারীকে আলোচনা করতে হবে। প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ করতে হবে। গৃহকর্মীকে মাতৃত্বকালীন ১৬ সপ্তাহ সবেতন ছুটি দিতে হবে। গৃহকর্মীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হলে ফৌজদারি দণ্ডবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনসহ বিদ্যমান আইনে বিচার হবে। কোনো গৃহকর্মী শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে তিনি সরকারি ব্যয়ে আইনি সহায়তা পাবেন।
কিন্তু রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের শহরাঞ্চলে নিয়োজিত গৃহকর্মীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই যে সরকারের ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি’-তে বর্ণিত সুযোগ-সুবিধা পান না সেটা বলা বাহুল্য। ধনী-দরিদ্র কিংবা শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে বিভিন্ন পরিবারে গৃহকর্মী নির্যাতনের যেসব খবর প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয় সেখান থেকেই গৃহকর্মীদের বিষয়ে নাগরিকদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যাচ্ছে গত বছর ৪৪ জন গৃহকর্মী মারাত্মক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১২ জনের রহস্যজনক মৃত্যুসহ মোট ১৬ জন নিহত হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১২ জন। শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে চরমভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ১২ জন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন আরও ৪ জন। এই পরিসংখ্যান কেবলই পুলিশের কাছে দাখিল হওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে তৈরি।
গৃহকর্মে নিয়োজিতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের কর্মজীবী নারীদের মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিত। এই বিপুল সংখ্যক গৃহকর্মীর প্রাপ্য শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদে সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এটা খালি চোখেই দেখা যায় যে, কোনো লিখিত চুক্তি না থাকায় গৃহকর্মীরা বেতন এবং ছুটির অধিকার থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার চেয়ে বেশি কাজ করতে বাধ্য হন। আর অমানবিক আচরণ এবং নিপীড়ন-নির্যাতনও সইতে হয় তাদের। গৃহকর্মীদের সঙ্গে নাগরিকরা কেমন আচরণ করবেন সেটা বোঝার একটা মানদন্ড হতে পারে, গৃহশ্রমকে নাগরিকরা কীভাবে দেখেন। যে সমাজে পরিবারের নারী সদস্য বা সদস্যদের প্রাত্যহিক গৃহশ্রমই ‘শ্রমের মর্যাদা’ পায় না, সেখানে গৃহকর্মীর শ্রমকে কতটা মূল্যায়ন করা হবে সে প্রশ্ন এড়ানো কঠিন। অন্যদিকে, বলা যেতে পারে, গৃহকর্মীদের পরিচালনার দায়িত্বটা মূলত পরিবারের নারী সদস্যরা করলেও দেখা যায়, নারী বা শিশু গৃহকর্মীর প্রাপ্য যথাযথ মর্যাদাপূর্ণ আচরণের বিষয়ে তারাও সচেতন নন। ফলে এই সংকট সমাধানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বড় ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ও সামাজিক সচেতনা তৈরি করা প্রয়োজন।
গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিতে সার্বিক দিক বাস্তবায়ন ও তদারকির লক্ষ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি মনিটরিং সেল গঠন করার কথা বলা হয়েছে। এই নীতি ভঙ্গ বা কোনো নির্যাতনের শিকার হলে গৃহশ্রমিকরা সরকারের মনিটরিং সেলে মৌখিক বা লিখিত অভিযোগ করতে পারবেন। এখন এই সেলকে সক্রিয় করতে হলে সমাজে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণার পাশাপাশি অভিযোগ দাখিলের প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। পাশাপাশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের গৃহকর্মী সুরক্ষার কাজে যুক্ত করা গেলে স্থানীয় পরিসরে তার সুফল মিলতে পারে। একই সঙ্গে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিকে পূর্ণাঙ্গ আইনে পরিণত করা যায় কি না সে বিবেচনাও জরুরি।