আজকের পত্রিকা

আড় নেই অন্দরে কি অন্তরে

  • প্রশান্ত মৃধা   

বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রথম পর্বের প্রধান লেখকদের একজন মীর মশাররফ হোসেন। যদিও তার এই কৃতি অনুমোদনের প্রশ্নে বঙ্কিমচন্দ্রের সার্টিফিকেটমূলক বাণী আজ বেশ হাসির, আর একই সঙ্গে বাংলায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অন্তঃস্রোতে বহে চলা ‘আমরা’ ও ‘ওরা’-কেও ধ্বনিত করে। সে সুর বেদনার। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, এই লেখকের লেখা পড়ে মনে হয় না এটা কোনো মুসলমানের রচনা, এ ‘তাদের’ মতন কোনো বর্ণহিন্দুরই লেখা। এখানে হিন্দুর রচনা কথাটা লিখলে আমাদের জন্যে বোঝাবুঝি খানিকটা সহজই হতো। কিন্তু হচ্ছে না যে তার কারণ, বরদায় বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের বাংলার শিক্ষক ছিলেন দীনেন্দ্রকুমার রায়। তিনি নিম্নবর্ণের হিন্দু। এই ভদ্রলোক কিংবা ছোটলোক ভালো বাংলা জানতেন। লিখেছেন, তার লেখা পড়ে কলকাতার ভদ্র তথা বর্ণহিন্দু সমাজের পয়লা উপলব্ধি ঘটেছিল, এটা কোনো বর্ণহিন্দুরই রচনা। রায় তো ব্রাহ্মণেরও পদবি।

তা হতে পারে বইকি! কিন্তু লেখা পড়ে এমন ধারণার পেছনে আছে সেই কথা, ব্রাহ্মণ-কায়স্থ ছাড়া আর কারও এত ভালো বাংলা লেখা বা গদ্য লেখা সম্ভব নয়। চিন্তার কী দীনতা! বঙ্কিমচন্দ্র থেকেই এর শুরু নাকি ভবানীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে? কে জানে। অথচ মধ্যযুগে মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দু কবির আনাগোনা বেশ। তারা বৈষ্ণব পদ, বড় বড় কাব্য অনেকই রচনা করেছেন। রামী ধোপানি, মীননাথ ধীবর। বাংলা ভাষার পক্ষে এখনো পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ পদযুগলের রচয়িতা আবদুল হাকিম যে মুসলমান সে কথা লেখাই বাহুল্য। মহাভারতের রচয়িতা বেদব্যাস? কিংবা জ্ঞানী বিদুর? বাকিদের কথা থাক। কারণ অনেক সাহিত্য-ঐতিহাসিক আর ইরাবতী কাব্যে ও প্রতিভা বসু তো একেবারে নির্দিষ্ট করেই দিয়েছেন, মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আসলে আর্য-অনার্যের লড়াই। এখানে পা-বরা অনার্য। কৃষ্ণ কালো। গোপ। অর্জুনও তাই। অভিমন্যু কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা আর অর্জুনের সন্তান। যুদ্ধান্তে একসময়ে অভিমন্যুপুত্র পরীক্ষিৎ ভারতরাজ! আর আধুনিক কাহিনীগদ্যে অদ্বৈত মল্লবর্মণ জেলেজীবন নিয়ে একটি অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন, যেন সেটি তার লেখারই কথা; কিন্তু যে অনন্য সাধারণ নদীবাহিত গদ্য তিনি সেই উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন, এমন উদাহরণ বাংলা ভাষায় বিরল।

প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া কাজের কথা নয়। মীর মশাররফ হোসেনের প্রধান পরিচয় এখন ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা। কারবালার পুঁথির কাহিনী রূপ। যদিও তিনি ঔপন্যাসিকের কল্পনার যথেষ্ট ব্যবহার করেছেন। এটি বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রধান বইগুলোরও একটি। হয়তো এই একখানি বইয়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী খ্যাতি তার অন্যান্য সাহিত্যকৃতিকে পেছনে সরিয়ে রেখেছে। পাঠক হিসেবে তা একদিক থেকে দীনতারও প্রকাশ। অন্তত, আজও পর্যন্ত বাংলা ভাষায় রচিত আত্মজীবনীগুলোর ভেতরে তার ‘উদাসী পথিকের মনের কথা’, ‘আমার জীবন’ ও ‘আমার জীবনীর জীবনী কুলসুম-জীবন’ অসাধারণ। বাঙালি জাতি হিসেবে কপট। আত্মজীবনী রচনার ক্ষেত্রে তো বটেই। বাঙালির আত্মজীবনী মাত্রই স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী নয়। আত্মজীবনী অন্য জিনিস। সেখানে গদ্যে ঔপন্যাসিকের কলমের জড়তাহীনতার পাশে লাগে নিজেকে অনর্গল খুলে তুলে ধরা। যেমন উত্তমপুরুষের রচিত উপন্যাস। কিন্তু বাঙালির রচিত বেশির ভাগ আত্মজীবনী ভালো কথার সমাহার, দেবতার আত্মচরিত প্রায়, সেখানে খোল যেমন থাকে না নলচেও না, বরং খোল আর নলচে কী করে এক জায়গায় হয়েছে সেই স্মৃতির কাহনেই পূর্ণ। ব্যতিক্রম যে একেবারে নেই তা নয়, তবে তা সংখ্যায় খুবই কম। মীর মশাররফ তার আত্মজীবনীতে নিজেকে মেলে ধরেছেন অর্গল খুলে, জমিদারনন্দনের কোনো ঢালই সেখানে নেই। উত্তরপুরুষকে ঢাল দেওয়াই প্রচলিত আত্মজীবনীর কাজ, মীর মশাররফ সেই কালে তো বটেই যে কোনো কালের বিবেচনায় ব্যতিক্রমেরও ব্যতিক্রম। হয়তো কলকাতার বাবু কালচার আর গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত মানসিকতার থেকে অনেক দূরে কুমারখালির লাহাড়িপাড়ায় অবস্থানও একটি কারণ। কিন্তু সৎ সাহস তো শুধু দূরবর্তিতার বিষয় নয়, সেটি যে কোনো লেখকের অন্তর্গত চৈতন্যে প্রবহমান না থাকলে, অমন গলগল করে বেরিয়ে আসে না।

আর একটি দিক। মীর মশাররফের নাটক রচনা। দীনবন্দু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে নানান কারণে মাইলফলক। এই নাটকটি এক রাতে ইন্ডিগো প্লান্টিং মিরর নামে অনুবাদ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, এমন ধারণা প্রচলিত। যদিও মাইকেল মধুসূদন কিংবা দীনবন্ধু মিত্র কারোর জীবনীকাররা এ তথ্যের পক্ষে খুব সহায়ক মতামত পেশ করেননি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘সেই সময়ে’ সে কথা লিখেছেন ঔপন্যাসিকের বর্ণনায়। এক রাতে এই নাটকটি অনুবাদ করেছেন মধুসূদন। পরদিন সকালে পাওয়া যায় ঘরময় ছড়ানো নাটকের পা-ুলিপি আর গোটা কতক রামের বোতল। তবে এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, এই ‘নীল দর্পণ’-এর ইংরেজি অনুবাদের কারণে ব্রিটিশরাজ নাটক রদ আইন করে, যার ফলে কোনো নাটক মঞ্চায়নের আগে জেলা প্রশাসক বা তার প্রতিনিধির কাছ থেকে অনুমতি নিতে হতো। অর্থাৎ নাটক লিখবেন নাট্যকার, কিন্তু সেটি মঞ্চায়ন করা যাবে কি না তার অনুমতি দেবেন জেলা প্রশাসক। যার একটি সংলাপ লেখারও যোগ্যতা নেই, তিনি অনুমতিদাতা! জিভ নেই যার, সে জানাবে স্বাদ। সেন্সর বোর্ড সম্পর্কে এ কথা বলেছেন সত্যজিৎ রায়। স্বাধীন বাংলাদেশেও বহুদিন নাটক রদ আইন বহাল ছিল।

ইংরেজ সরকার আইনটি করেছিল তার প্রয়োজনে। যে কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি তখত রক্ষায় এমন কত আইন করে। শোষিত ওপরে তা মানতে বাধ্য, ভেতরে মানে না। জেলখানায় রচিত ‘কবর’ সেই কারণে মঞ্চস্থ হয় নিচু আলোয়। যাক, নীল দর্পণের যে ভূমিকা, এর পাশাপাশি রেখে পড়লে মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’-এর ভূমিকাকে বিন্দুমাত্র খাটো করে দেখবার সুযোগ নেই। বরং, একটি দিক থেকে তা বেশি। সেখানে শাসক ইংরেজের একনিষ্ঠ সেবক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমস্ত সুফলভোগী জমিদারের যে রূপ মীর মশাররফ প্রকাশ করেছেন, তা সেই সময়কার বাংলাদেশের এতটাই দগদগে চিত্র যে, সেখান থেকে আড়চোখে তাকানোর সুযোগ নেই। বরং, কৃষিভিত্তিক এই সমাজে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর কারণে বাংলার কৃষকের যে দশা হয়েছিল, আবু মোল্লার তার প্রতিনিধি। সে শোষিত জমিদারের হাতে। মীর মশাররফ সে পক্ষের। সহায়ক ইংরেজ সরকার, তার পুলিশ ও বিচারক। আবু মোল্লার স্ত্রীর সঙ্গে যে আচরণ করেছে জমিদার, সে কাজ মীর মশাররফের পরিবার থেকেই হয়তো সংগঠিত হয়েছে। শারীরিক লাঞ্ছনার জন্যে নুরুন্নাহার আত্মঘাতী হয়। তার সেই লাঞ্ছনার সহায়ক কতজন। সবই জমিদারের তাঁবেদার। ওই শ্রেণির তখন কি এখন কোনো সময়েই তো তাঁবেদারের অভাব ছিল না। অন্যায়কারী জমিদারেরও ইংরেজ তোষণের সব কায়দা জানা। তারা পরস্পরের পরিপূরক। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূত্রে তারা সে বন্ধনে আবদ্ধ। আর রায়ত বা প্রজা বা কৃষককে সেই চিরকালীন শোষণের কায়দা ও এর বদৌলতে উপঢৌকন প্রদানও তারা নিজেদের ব্যবস্থায় রাখেন।

‘জমিদার দর্পণ’ তো আর শুধু জমিদারকে দেখার আয়না নয়, বরং জমিদারের কৃতকর্মের হিস্যা, যা মীর মশাররফ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সূত্রেই অর্জন করেছেন। কিন্তু সে অর্জন তো সবাইকে একেবারে আগাপাশতলা দেখানোর মতন করে লিখবার সাহস জোগায় না, সে সাহস সবার থাকেও না। মীর মশাররফের ছিল। বাংলা গদ্যের ভিত্তিভূমিতে, ‘মুসলমান পরিবারের’ সন্তান হয়েও তিনি যেমন বর্ণহিন্দুর চোখ কচলে ধাঁধা ধরানো মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। একই সাহস তিনি দেখিয়েছেন ‘বিষাদ সিন্ধু’ রচনায় ঔপন্যাসিকের স্বাধীনতা নিয়ে, আত্মজীবনীতে ব্যক্তিজীবন উন্মোচন করে, আর ‘জমিদার দর্পণ’-এর মতন অসাধারণ নাটকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এক দগদগে ক্ষতকে সামনে এনে। প্রতিভাবান লেখকমাত্রই শিল্পের শর্ত রক্ষা করে যে কাজটি করেন।

তবু পশ্চিমবাংলায় তো অবশ্যই, বাংলাদেশেও, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ এই যাত্রায় মাঝখানে মীর মশাররফের নামটা অনেক গদ্যলেখকের হিসেবে থাকে না। সাহিত্যের ইতিহাসকার রাখেন কালের ধারাবাহিকতায়, যেখানে অনেক গৌণ নামও থাকে। তা স্বাভাবিক। কারণ, সাহিত্যের ইতিহাস সব সময়েই গৌণ লেখকদের অংশগ্রহণেই বহমান। মীর মশাররফ সেখানে ব্যতিক্রম। আজ যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের হিড়িক, যা আনন্দবাজার গোষ্ঠীর সহযোগী ‘দেশ’-পত্রিকা উৎসারিত, তারও তো প্রথম দিককার সফল কারিগর মীর মশাররফ। আর আত্মজীবনী রচনায় তার যে অকপট কলম, সে কলমকে সবসময়েই কুর্নিশ জানাতে হয়।

০৪ ফাল্গুন ১৪২৭ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১। সিলেট

লেখক কথাসাহিত্যিক

prasantamridha@gmail.com

এই পাতার আরো খবর