আমাদের অনুবাদ ও প্রাসঙ্গিক কথা
জি এইচ হাবীব | ২ মার্চ, ২০২২ ০০:০০
কথাটা নিশ্চয়ই আগেও বলেছেন অনেকে। অনুবাদ হচ্ছে বাতাসের মতো। এর মধ্যেই আমরা বাস করি, কিন্তু দেখি না, যদিও মাঝে মাঝে টের পাই সেটার উপস্থিতি; যখন ভালো বা খারাপ কোনো অনুবাদ আমাদের অভিজ্ঞতার গণ্ডিতে আসে, ভালো অনুবাদ সুবাতাসের মতো আমাদের মন ভরিয়ে দেয়, আমাদের মন-প্রাণ প্রফুল্ল হয়ে ওঠে; আবার বাজে কোনো অনুবাদ আমাদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে অনুবাদ বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল পার করছে বলে মনে হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরে একদিকে যেমন প্রচুর বই বা টেক্সট বাংলায় অনূদিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে আবার বেশ অল্প হলেও বাংলা থেকে ইংরেজিতেও ভাষান্তরিত হচ্ছে কিছু বই, মূলত ফিকশন; চেষ্টা চলছে মূল প্রকাশকের অনুমতি নিয়ে অনুবাদ প্রকাশের, বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে কয়েকটি অনুবাদ পত্রিকা। বছর দুয়েক আগে একটি প্রকাশনা সংস্থা ও একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয়েছিল দু’মাসব্যাপী অনুবাদ কর্মশালা (অংশগ্রহণেচ্ছুদের কাছ থেকে আশাতীত সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। আশা করা গিয়েছিল দ্বিতীয় একটি কর্মশালাও আয়োজন করা সম্ভব হবে। কিন্তু করোনা মহামারী এসে সে সম্ভাবনার বিনাশ ঘটায়)। নিয়মিত বিরতিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দিনব্যাপী সম্পাদনা বিষয়ক কর্মশালা বা অনুষ্ঠান, যেখানে অনুবাদ, অনুবাদ সম্পাদনা নিয়েও পাঠ দান করা হয়।
এসব যেমন আশার কথা, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিত্রটি এখনো বেশ আগের মতোই আছে। যেমন, অনুবাদের উৎস ভাষা বরাবরের মতোই ৯৫ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে ইংরেজিই রয়ে গেছে। অন্য যে তিনটি ভাষা থেকে অল্প-বিস্তর অনুবাদ হচ্ছে তা হলো উর্দু, আরবি ও হিস্পানি। একেবারে আণুবিক্ষীণিক স্তরে আছে রুশ, ফরাসি ও জর্মন। মূলত ইংরেজি বই, অথবা অন্য ভাষায় লেখা বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ থেকেই বাংলা তরজমাগুলো হচ্ছে। অনুবাদ মূল ভাষা থেকেই হওয়া বেহতর, যদিও এ-ব্যাপারে সব সময় নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না যে মূল ভাষা থেকে ভাষান্তর হলেই কাজটি ভালো হবে। তবে, অন্তত দর্শন বা সাহিত্যতত্ত্বের ক্ষেত্রে মূল ভাষা থেকে অনুবাদ হওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। এসব ‘জটিল’ বিষয় হাত ফেরতা হয়ে অনূদিত হলে সে-অনুবাদ দুর্বোধ্য হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। আরেকটি জরুরি বিষয় হচ্ছে এসব অনুবাদের একটি বড় অংশই সেরকম কোনো সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত হচ্ছে। সম্পাদনা খুবই দায়িত্বপূর্ণ, সময়সাপেক্ষ ও জটিল একটি কাজ। এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য দক্ষ লোক পাওয়া এমনতেই কঠিন; যদি বা পাওয়া যায়, ভালো পারিশ্রমিক ছাড়া সেই অঙ্গুলিমেয় যোগ্য লোকজন সাড়া দেবেন না তা ধরেই নেওয়া যায়। একেই তো আমাদের প্রকাশনা জগতে এই সম্পাদনার সংস্কৃতি প্রায় অনুপস্থিত, তার ওপর রয়েছে সম্পাদনার খরচের গুরুভার। ফলে, এ-বালাই থেকে দূরেই থাকতে চান অধিকাংশ প্রকাশক। ফলে অনুবাদের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এবার, অনূদিত বইগুলোর বিষয়বস্তুর দিকে যদি নজর দিই তাহলে দেখব থ্রিলার, রহস্য ও গোয়েন্দা কাহিনী, কল্পবিজ্ঞান তথা জনরা সাহিত্য আর অনুপ্রেরণামূলক বই-পত্তরের সংখ্যাই সেখানে বেশি। জনরা সাহিত্য নিয়ে মোটেই শুচিবাই নেই এই লেখকের; সবাই সব বই পড়বে না, এবং জনরা সাহিত্যের বিপুল এক পাঠকগোষ্ঠী রয়েছে। কথা হচ্ছে, অন্য ধারার যেসব রচনা রয়েছে, লেখার জগতের যে বিভিন্ন ও বিচিত্র শাখা-প্রশাখা রয়েছে যার একটি বড় অংশ নন-ফিকশন নামে পরিচিতি তার অনুবাদ বেশ অবহেলিত; বিশেষ করে বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, সংগীত, পরিবেশ বিজ্ঞান ইত্যাদি। ইতিহাস ও বিজ্ঞানভিত্তিক বইয়ের অনুবাদ যে একবারেই প্রকাশিত হচ্ছে না তা অবশ্যই নয়; কিন্তু আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় তা মোটেই যথেষ্ট নয়। আমাদের জ্ঞানচর্চার জগতে বিশেষ করে বাংলায় জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এই তরজমাগুলো যত বেশি হবে ততই আমরা কূপম-ূকতার হাত থেকে রক্ষা পাব। ইতিহাস ও বিজ্ঞান বিষয়ক বই ছাড়া মূল আরবি থেকে কিছু ধর্মীয় বইও অনুবাদ হচ্ছে।
বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার অনুবাদের ক্ষেত্রে যে কথাটি আবারও বলতেই হয় তা হলো, আমাদের মতো রাষ্ট্রের পক্ষে বড় বড় বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনা করা অর্থাভাবের কারণে প্রায় অসম্ভব। অবশ্য বর্তমান জমানায় এককভাবে আর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা হয় না বললেই চলে। কিন্তু সে কারণে আমরা পিছিয়ে থাকতে পারি না। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যদি আমরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিজ্ঞান বিষয়ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখালেখি, গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হওয়া রিপোর্ট, গবেষণা সন্দর্ভ, প্রভৃতি সংগ্রহ করে বাংলায় অনুবাদের বা ভাবানুবাদের ব্যবস্থা করতে পারি; হতে পারে সেসবের যতদূর সম্ভব সহজ-সরল পরিবেশনা। তাহলে বিজ্ঞান গবেষণার ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ হতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো দেশের রাষ্ট্রীয় বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় দায়িত্ব পালন করা উচিত। সবচেয়ে ভালো হয় এ ধরনের কাজের জন্য যদি আলাদা কোনো অনুবাদ প্রতিষ্ঠান থাকে, যার কাজই হবে এসব রচনা অনুবাদ করা। চীন, জাপান, কোরিয়া, ইরানসহ আরও কিছু দেশে দেখা যায় তারা ইংরেজি বা অন্য ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ বই বের হওয়া মাত্র সেগুলো অল্প কিছুদিনের মধ্যে অনূদিত হয়ে যায়, সেসব বই চলে যায় নানান গ্রন্থাগারে, পুস্তক বিপণীতে। এ-কাজের সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন, কারণ এ ধরনের কাজের জন্য উপযুক্ত অনুবাদক রাতারাতি তৈরি হয় না। দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট আছে, ইংরেজি বিভাগ আছে, সেখানের শিক্ষার্থীরা আছে, তা আমাদের ব্যবহার করতে হবে। অনুবাদের মতো আপাত একঘেয়ে জটিল কাজের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির কাজটি একটু আগেভাগেই শুরু করা যেতে পারে শিক্ষার্থীদের এ-কাজে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে। কিন্তু তার আগে চাই তরজমাপ্রেমী শিক্ষক।
অনূদিত বইগুলোর বিতরণের প্রসঙ্গেই চলে আসে আমাদের গ্রন্থাগারগুলোর দৈন্যদশার কথা। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে আমাদের দেশের গ্রন্থাগারের সংখ্যা ১৫০০-ও হবে না, যা এদেশের প্রায় ২০ কোটি মানুষের জন্য হাস্যকর বললেও কম বলা হয়। কিন্তু এই স্বল্পসংখ্যক গ্রন্থাগারেও যদি নিয়মিতভাবে প্রতি বছর প্রকাশিত দেশের ভালো ভালো বই, ভালো ভালো অনুবাদ কেনার ব্যবস্থা করা যেত, পাঠ সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটিয়ে সেসব বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ জাগানো যেত, তাহলেও একটা কাজের কাজ হতো। কিন্তু এদেশে এসব গ্রন্থাগারে যেসব বই কেনা হয় তার বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রীর শংসামূলক রচনা, বা গ্রন্থক্রয় কমিটির সদস্যদের নিজস্ব বইপত্র। কোথাও কোথাও বইকেনার টাকা খরচ হয়ে গেলেও ভাউচার ছাড়া অন্য কোনো কিছুর দেখা মেলে না। আর, পাঠ সংস্কৃতির যে বেহাল দশা তা যে কোনো সংবেদনশীল মানুষকে হতাশ করবে। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিবারগুলোতে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজনৈতিক দলগুলোতে পাঠ্যবইয়ের বাইরের বইয়ের কথা বলা যেন এক গর্হিত অপরাধের মতো। কেউ পারতপক্ষে সেসবের কথা বলেন না, ছেলেমেয়েদের এসব বই পড়তে উৎসাহ দেন না। সবার একটাই লক্ষ্য : পরীক্ষার ফল ভালো করা।
যাই হোক, আবার অনুবাদ প্রসঙ্গে ফিরি। আমাদের বাংলা রচনার যেসব ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে সেগুলোর সিংহভাগই করছেন বাংলাদেশিরা বা বিদেশি বাঙালিরা বা, প্রবাসী বাঙালিরা, দু’একটি বিরল ঘটনা ছাড়া। আরেকটি বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে যে এসবের মধ্যে কিছু কিছু অনুবাদ হচ্ছে যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে, যার ফলে সেসবের মান নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থেকে যাচ্ছে। এবং এসব অনুবাদে ফিকশনই মুখ্য। কবিতার বই যাও বা দু’চারটে হচ্ছে নন-ফিকশন বলতে গেলে শূন্য। অনূদিত এসব বইয়ের লক্ষ্য পাঠক কারা, তাদের কাছে বিপণন কীভাবে হবে বা হচ্ছে সে-ব্যাপারে আমরা প্রায় অন্ধকারেই আছি। তাছাড়া, মাতৃভাষা ইংরেজি এমন অনুবাদকদের দিয়েও আমাদের রচনাগুলো অনুবাদের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাস যতটা, আমাদের দেশে রচিত উন্নতমানের রচনা শোকেসিং, বিপণন এবং অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার কেজো কোনো পরিকল্পনা গ্রহণে ও তা বাস্তবায়নে আমাদের ততটাই অনীহা। প্রতিবছর মাসব্যাপী আমাদের অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয় সে সময়ে বিদেশি ভালো ভালো প্রকাশনা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের মেলায় আমন্ত্রণ করে আমাদের অনুবাদযোগ্য বইগুলোর সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমরা আমাদের কাজগুলোর অনুবাদ সম্ভাবনা বাড়াতে পারতাম। কিন্তু অন্য ভাষা থেকে বাংলা অনুবাদ যেমন দীর্ঘদিনের অনুবাদ চর্চার পরেও পাঠকের আস্থাভাজন হতে পারেনি, তেমনি বাংলা ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদের দশাও সংখ্যা ও মানের দিক থেকে তেমন কোনো নির্ভরতার জায়গায় যেতে পারেনি।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলন বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুবাদের যে ব্যাপক ভূমিকা আছে তা অনেকেই স্বীকার করবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে এজন্য আমরা কি কী পদক্ষেপ নিচ্ছি। প্রথম কথা হলো কাজটা আমরা করতে চাই কি না। তবে, ইংরেজিতে বলা হয়, ‘দ্য রোড টু হেল ইজ পেইভড উইদ গুড ইন্টেনশন্স।’ সদিচ্ছা থাকলেই কাজ হয় না, দরকার হয় কর্মোদ্যোগ। এ-ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে একটি বড় দায়িত্ব পালন করতে পারে সে-ব্যাপারে বহুবার বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগের শিক্ষকরা যদি তাদের বিষয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট অনুবাদ করতেন এবং সেসব অনুবাদ তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কাজে লাগত, তাহলে আমরা বেশ কিছু ভালো টেক্সটের বাংলা পেয়ে যেতাম। এই প্রসঙ্গে চার্লস বারবারের ‘দি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ইন দ্য এইজ অভ শেক্সপিয়ার’ শিরোনামের প্রবন্ধের কথা নানান জায়গায় বলেছি। সেই প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন শেক্সপিয়রের জন্মের সময় (১৫৬৪ খ্রি.) ইংরেজি ভাষাকে তার প্রাঞ্জলতার অভাবে, তথা ভাষাটির ভাঁড়ারে যথেষ্ট সংখ্যক শব্দ না থাকায় বর্বর বা ‘barbarous’ ভাষা বলা হতো (যে-কারণে মনে করা হতো ইংরেজিতে নানান জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা করা যায় না, দর্শনের কথা আলাপ করা যায় না); সে সময় লাতিন মহাপ্রতাপশালী আন্তর্জাতিক ভাষা হওয়ার কারণে সবাই তখন (নিজের সেরা) রচনাটি লাতিনে লেখার ব্যাপারে উৎসাহী থাকতেন; এবং খোদ ইংল্যান্ডেই ইংরেজি ভাষার সম্মান ছিল বেশ কম; অথচ শেক্সপিয়রের জীবনকালের শেষের দিকে ভাষাটি এই দীন দশা থেকে মুক্তি লাভ করেছিল নানান ভাবে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করে ও ধার নিয়ে, নানান রচনা প্রথমে অনুবাদ, পরে অ্যাডাপ্ট আর শেষে মৌলিকভাবে রচনা করে ইংরেজভাষীরা তাদের ভাষার দুরবস্থা দূর করেছিলেন; সেটাকে যথেষ্ট সম্মানের আসনে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং কাজটি ইংরেজিভাষীরাই করেছিলেন; তাদের হয়ে জর্মন, ফরাসি, জাপানি বা চীনাভাষী কেউ এসে করে দিয়ে যায়নি। বাংলার ব্যাপারেও ইংরেজির মতো বলা হয় যে এ-ভাষার শব্দসম্ভার জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানান বিষয় আলাপের উপযোগী নয়, পরিভাষার দিক থেকে আমরা খুব দুর্বল। অল্প যেসব তৈরি হয়েছে সেসব-ও ব্যবহারের অভাবে তেমন প্রচলিত হতে পারেনি। আমাদের প্রবণতা রেডিমেড ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের দিকেই; এর একটি বড় কারণ সম্ভবত আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা। পরিভাষার ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম অনেক শব্দকেই অপরিচিত, অজানা মনে হয়, পরে সেসসব ব্যবহারে ব্যবহারে সড়গড় হয়ে আসে। একথাটা আমরা কেন যেন ভুলে গিয়ে একটু অপরিচয়ের অস্বস্তি সহ্য করতে চাই না। ফলে সেসব আর ব্যবহৃত হয় না। অথচ সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘আমার ভাণ্ডার আছে ভরে’ লেখাটা যদি আমরা স্মরণ করি, আরেকবার পাঠ করি, তাহলে আমাদের ভাষার যে সম্পদ যে শক্তি আছে তা সম্পর্কে একটু বল-ভরসা পেতাম।
বাংলা অনুবাদের, এবং বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদের একটা ডাটাবেইস, একটা হিসাব আমাদের প্রস্তুত করা খুব দরকার। পিটার ফ্রান্স সম্পাদিত দ্য অক্সফোর্ড গাইড টু লিটারেচার ইন ইংলিশ ট্রানসেøশন বইটির মতো, নামেই যেটার পরিচয় ফুটে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার সময় অনুবাদের ভূমিকা নিয়ে একটা আলাদা অধ্যায় থাকাও দরকার মনে করি, শুধু এ-সম্পর্কে দু-একটা আলটপকা মন্তব্য নয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের খুব কম বইয়েই এমন আলোচনার দেখা মেলে; এমনকি কোনো ইংরেজি সাহিত্যের বইয়েও সে-ভাষা ও সাহিত্যের গঠনে অনুবাদের গুরুত্ব নিয়ে বিশেষ আলোচনা দেখতে পাই না।
এর কারণ বোধহয় এই যে, সাধারণ পাঠকের কাছে বাংলা অনুবাদের যা হোক একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু এদেশের অ্যাকাডেমিয়াতে তার কানাকড়িও নেই। অবশ্য এদেশের অ্যাকাডেমিয়ার মান নিয়ে কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো এখন। বাংলা বিভাগগুলোতে চতুর্থ বর্ষ বা এমএ-তে ১০০ নম্বরের একটি কোর্স থাকে যেখানে বাংলা অনুবাদে বিদেশি সাহিত্য পড়ানো হয়। সেখানে মূলত সেই টেক্সটগুলোর ভালোমন্দ, চরিত্র বিশ্লেষণ, এসব নিয়েই আলোচনা করা হয়। অনুবাদের মান বা বৈশিষ্ট্য বা তত্ত্ব নিয়ে কোনো আলাপ হয় না বলেই জানি। অথচ এরকম আলাপ বা বাংলা সাহিত্যে অনুবাদের ইতিহাস নিয়ে আলাপটি জরুরি ছিল, বিশ্ব প্রেক্ষাপটে।
সব শেষে বলব, অনুবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সেটা উপলব্ধি করে এটার চর্চা ও প্রসারের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কাজগুলো আমরা যত দ্রুত করতে পারব ততই মঙ্গল।
লেখক : শিক্ষক ও অনুবাদক
শেয়ার করুন
জি এইচ হাবীব | ২ মার্চ, ২০২২ ০০:০০

কথাটা নিশ্চয়ই আগেও বলেছেন অনেকে। অনুবাদ হচ্ছে বাতাসের মতো। এর মধ্যেই আমরা বাস করি, কিন্তু দেখি না, যদিও মাঝে মাঝে টের পাই সেটার উপস্থিতি; যখন ভালো বা খারাপ কোনো অনুবাদ আমাদের অভিজ্ঞতার গণ্ডিতে আসে, ভালো অনুবাদ সুবাতাসের মতো আমাদের মন ভরিয়ে দেয়, আমাদের মন-প্রাণ প্রফুল্ল হয়ে ওঠে; আবার বাজে কোনো অনুবাদ আমাদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে অনুবাদ বর্তমানে একটি ক্রান্তিকাল পার করছে বলে মনে হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরে একদিকে যেমন প্রচুর বই বা টেক্সট বাংলায় অনূদিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে আবার বেশ অল্প হলেও বাংলা থেকে ইংরেজিতেও ভাষান্তরিত হচ্ছে কিছু বই, মূলত ফিকশন; চেষ্টা চলছে মূল প্রকাশকের অনুমতি নিয়ে অনুবাদ প্রকাশের, বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে কয়েকটি অনুবাদ পত্রিকা। বছর দুয়েক আগে একটি প্রকাশনা সংস্থা ও একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয়েছিল দু’মাসব্যাপী অনুবাদ কর্মশালা (অংশগ্রহণেচ্ছুদের কাছ থেকে আশাতীত সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। আশা করা গিয়েছিল দ্বিতীয় একটি কর্মশালাও আয়োজন করা সম্ভব হবে। কিন্তু করোনা মহামারী এসে সে সম্ভাবনার বিনাশ ঘটায়)। নিয়মিত বিরতিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দিনব্যাপী সম্পাদনা বিষয়ক কর্মশালা বা অনুষ্ঠান, যেখানে অনুবাদ, অনুবাদ সম্পাদনা নিয়েও পাঠ দান করা হয়।
এসব যেমন আশার কথা, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিত্রটি এখনো বেশ আগের মতোই আছে। যেমন, অনুবাদের উৎস ভাষা বরাবরের মতোই ৯৫ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে ইংরেজিই রয়ে গেছে। অন্য যে তিনটি ভাষা থেকে অল্প-বিস্তর অনুবাদ হচ্ছে তা হলো উর্দু, আরবি ও হিস্পানি। একেবারে আণুবিক্ষীণিক স্তরে আছে রুশ, ফরাসি ও জর্মন। মূলত ইংরেজি বই, অথবা অন্য ভাষায় লেখা বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ থেকেই বাংলা তরজমাগুলো হচ্ছে। অনুবাদ মূল ভাষা থেকেই হওয়া বেহতর, যদিও এ-ব্যাপারে সব সময় নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না যে মূল ভাষা থেকে ভাষান্তর হলেই কাজটি ভালো হবে। তবে, অন্তত দর্শন বা সাহিত্যতত্ত্বের ক্ষেত্রে মূল ভাষা থেকে অনুবাদ হওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। এসব ‘জটিল’ বিষয় হাত ফেরতা হয়ে অনূদিত হলে সে-অনুবাদ দুর্বোধ্য হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। আরেকটি জরুরি বিষয় হচ্ছে এসব অনুবাদের একটি বড় অংশই সেরকম কোনো সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত হচ্ছে। সম্পাদনা খুবই দায়িত্বপূর্ণ, সময়সাপেক্ষ ও জটিল একটি কাজ। এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য দক্ষ লোক পাওয়া এমনতেই কঠিন; যদি বা পাওয়া যায়, ভালো পারিশ্রমিক ছাড়া সেই অঙ্গুলিমেয় যোগ্য লোকজন সাড়া দেবেন না তা ধরেই নেওয়া যায়। একেই তো আমাদের প্রকাশনা জগতে এই সম্পাদনার সংস্কৃতি প্রায় অনুপস্থিত, তার ওপর রয়েছে সম্পাদনার খরচের গুরুভার। ফলে, এ-বালাই থেকে দূরেই থাকতে চান অধিকাংশ প্রকাশক। ফলে অনুবাদের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এবার, অনূদিত বইগুলোর বিষয়বস্তুর দিকে যদি নজর দিই তাহলে দেখব থ্রিলার, রহস্য ও গোয়েন্দা কাহিনী, কল্পবিজ্ঞান তথা জনরা সাহিত্য আর অনুপ্রেরণামূলক বই-পত্তরের সংখ্যাই সেখানে বেশি। জনরা সাহিত্য নিয়ে মোটেই শুচিবাই নেই এই লেখকের; সবাই সব বই পড়বে না, এবং জনরা সাহিত্যের বিপুল এক পাঠকগোষ্ঠী রয়েছে। কথা হচ্ছে, অন্য ধারার যেসব রচনা রয়েছে, লেখার জগতের যে বিভিন্ন ও বিচিত্র শাখা-প্রশাখা রয়েছে যার একটি বড় অংশ নন-ফিকশন নামে পরিচিতি তার অনুবাদ বেশ অবহেলিত; বিশেষ করে বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, সংগীত, পরিবেশ বিজ্ঞান ইত্যাদি। ইতিহাস ও বিজ্ঞানভিত্তিক বইয়ের অনুবাদ যে একবারেই প্রকাশিত হচ্ছে না তা অবশ্যই নয়; কিন্তু আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় তা মোটেই যথেষ্ট নয়। আমাদের জ্ঞানচর্চার জগতে বিশেষ করে বাংলায় জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এই তরজমাগুলো যত বেশি হবে ততই আমরা কূপম-ূকতার হাত থেকে রক্ষা পাব। ইতিহাস ও বিজ্ঞান বিষয়ক বই ছাড়া মূল আরবি থেকে কিছু ধর্মীয় বইও অনুবাদ হচ্ছে।
বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার অনুবাদের ক্ষেত্রে যে কথাটি আবারও বলতেই হয় তা হলো, আমাদের মতো রাষ্ট্রের পক্ষে বড় বড় বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনা করা অর্থাভাবের কারণে প্রায় অসম্ভব। অবশ্য বর্তমান জমানায় এককভাবে আর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা হয় না বললেই চলে। কিন্তু সে কারণে আমরা পিছিয়ে থাকতে পারি না। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যদি আমরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিজ্ঞান বিষয়ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখালেখি, গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হওয়া রিপোর্ট, গবেষণা সন্দর্ভ, প্রভৃতি সংগ্রহ করে বাংলায় অনুবাদের বা ভাবানুবাদের ব্যবস্থা করতে পারি; হতে পারে সেসবের যতদূর সম্ভব সহজ-সরল পরিবেশনা। তাহলে বিজ্ঞান গবেষণার ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ হতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো দেশের রাষ্ট্রীয় বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় দায়িত্ব পালন করা উচিত। সবচেয়ে ভালো হয় এ ধরনের কাজের জন্য যদি আলাদা কোনো অনুবাদ প্রতিষ্ঠান থাকে, যার কাজই হবে এসব রচনা অনুবাদ করা। চীন, জাপান, কোরিয়া, ইরানসহ আরও কিছু দেশে দেখা যায় তারা ইংরেজি বা অন্য ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ বই বের হওয়া মাত্র সেগুলো অল্প কিছুদিনের মধ্যে অনূদিত হয়ে যায়, সেসব বই চলে যায় নানান গ্রন্থাগারে, পুস্তক বিপণীতে। এ-কাজের সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ প্রয়োজন, কারণ এ ধরনের কাজের জন্য উপযুক্ত অনুবাদক রাতারাতি তৈরি হয় না। দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট আছে, ইংরেজি বিভাগ আছে, সেখানের শিক্ষার্থীরা আছে, তা আমাদের ব্যবহার করতে হবে। অনুবাদের মতো আপাত একঘেয়ে জটিল কাজের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির কাজটি একটু আগেভাগেই শুরু করা যেতে পারে শিক্ষার্থীদের এ-কাজে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে। কিন্তু তার আগে চাই তরজমাপ্রেমী শিক্ষক।
অনূদিত বইগুলোর বিতরণের প্রসঙ্গেই চলে আসে আমাদের গ্রন্থাগারগুলোর দৈন্যদশার কথা। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে আমাদের দেশের গ্রন্থাগারের সংখ্যা ১৫০০-ও হবে না, যা এদেশের প্রায় ২০ কোটি মানুষের জন্য হাস্যকর বললেও কম বলা হয়। কিন্তু এই স্বল্পসংখ্যক গ্রন্থাগারেও যদি নিয়মিতভাবে প্রতি বছর প্রকাশিত দেশের ভালো ভালো বই, ভালো ভালো অনুবাদ কেনার ব্যবস্থা করা যেত, পাঠ সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটিয়ে সেসব বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ জাগানো যেত, তাহলেও একটা কাজের কাজ হতো। কিন্তু এদেশে এসব গ্রন্থাগারে যেসব বই কেনা হয় তার বেশিরভাগই ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রীর শংসামূলক রচনা, বা গ্রন্থক্রয় কমিটির সদস্যদের নিজস্ব বইপত্র। কোথাও কোথাও বইকেনার টাকা খরচ হয়ে গেলেও ভাউচার ছাড়া অন্য কোনো কিছুর দেখা মেলে না। আর, পাঠ সংস্কৃতির যে বেহাল দশা তা যে কোনো সংবেদনশীল মানুষকে হতাশ করবে। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিবারগুলোতে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজনৈতিক দলগুলোতে পাঠ্যবইয়ের বাইরের বইয়ের কথা বলা যেন এক গর্হিত অপরাধের মতো। কেউ পারতপক্ষে সেসবের কথা বলেন না, ছেলেমেয়েদের এসব বই পড়তে উৎসাহ দেন না। সবার একটাই লক্ষ্য : পরীক্ষার ফল ভালো করা।
যাই হোক, আবার অনুবাদ প্রসঙ্গে ফিরি। আমাদের বাংলা রচনার যেসব ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে সেগুলোর সিংহভাগই করছেন বাংলাদেশিরা বা বিদেশি বাঙালিরা বা, প্রবাসী বাঙালিরা, দু’একটি বিরল ঘটনা ছাড়া। আরেকটি বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে যে এসবের মধ্যে কিছু কিছু অনুবাদ হচ্ছে যথেষ্ট দ্রুততার সঙ্গে, যার ফলে সেসবের মান নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থেকে যাচ্ছে। এবং এসব অনুবাদে ফিকশনই মুখ্য। কবিতার বই যাও বা দু’চারটে হচ্ছে নন-ফিকশন বলতে গেলে শূন্য। অনূদিত এসব বইয়ের লক্ষ্য পাঠক কারা, তাদের কাছে বিপণন কীভাবে হবে বা হচ্ছে সে-ব্যাপারে আমরা প্রায় অন্ধকারেই আছি। তাছাড়া, মাতৃভাষা ইংরেজি এমন অনুবাদকদের দিয়েও আমাদের রচনাগুলো অনুবাদের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাস যতটা, আমাদের দেশে রচিত উন্নতমানের রচনা শোকেসিং, বিপণন এবং অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার কেজো কোনো পরিকল্পনা গ্রহণে ও তা বাস্তবায়নে আমাদের ততটাই অনীহা। প্রতিবছর মাসব্যাপী আমাদের অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয় সে সময়ে বিদেশি ভালো ভালো প্রকাশনা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের মেলায় আমন্ত্রণ করে আমাদের অনুবাদযোগ্য বইগুলোর সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমরা আমাদের কাজগুলোর অনুবাদ সম্ভাবনা বাড়াতে পারতাম। কিন্তু অন্য ভাষা থেকে বাংলা অনুবাদ যেমন দীর্ঘদিনের অনুবাদ চর্চার পরেও পাঠকের আস্থাভাজন হতে পারেনি, তেমনি বাংলা ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদের দশাও সংখ্যা ও মানের দিক থেকে তেমন কোনো নির্ভরতার জায়গায় যেতে পারেনি।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলন বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুবাদের যে ব্যাপক ভূমিকা আছে তা অনেকেই স্বীকার করবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে এজন্য আমরা কি কী পদক্ষেপ নিচ্ছি। প্রথম কথা হলো কাজটা আমরা করতে চাই কি না। তবে, ইংরেজিতে বলা হয়, ‘দ্য রোড টু হেল ইজ পেইভড উইদ গুড ইন্টেনশন্স।’ সদিচ্ছা থাকলেই কাজ হয় না, দরকার হয় কর্মোদ্যোগ। এ-ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে একটি বড় দায়িত্ব পালন করতে পারে সে-ব্যাপারে বহুবার বলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগের শিক্ষকরা যদি তাদের বিষয়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট অনুবাদ করতেন এবং সেসব অনুবাদ তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কাজে লাগত, তাহলে আমরা বেশ কিছু ভালো টেক্সটের বাংলা পেয়ে যেতাম। এই প্রসঙ্গে চার্লস বারবারের ‘দি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ইন দ্য এইজ অভ শেক্সপিয়ার’ শিরোনামের প্রবন্ধের কথা নানান জায়গায় বলেছি। সেই প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন শেক্সপিয়রের জন্মের সময় (১৫৬৪ খ্রি.) ইংরেজি ভাষাকে তার প্রাঞ্জলতার অভাবে, তথা ভাষাটির ভাঁড়ারে যথেষ্ট সংখ্যক শব্দ না থাকায় বর্বর বা ‘barbarous’ ভাষা বলা হতো (যে-কারণে মনে করা হতো ইংরেজিতে নানান জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা করা যায় না, দর্শনের কথা আলাপ করা যায় না); সে সময় লাতিন মহাপ্রতাপশালী আন্তর্জাতিক ভাষা হওয়ার কারণে সবাই তখন (নিজের সেরা) রচনাটি লাতিনে লেখার ব্যাপারে উৎসাহী থাকতেন; এবং খোদ ইংল্যান্ডেই ইংরেজি ভাষার সম্মান ছিল বেশ কম; অথচ শেক্সপিয়রের জীবনকালের শেষের দিকে ভাষাটি এই দীন দশা থেকে মুক্তি লাভ করেছিল নানান ভাবে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করে ও ধার নিয়ে, নানান রচনা প্রথমে অনুবাদ, পরে অ্যাডাপ্ট আর শেষে মৌলিকভাবে রচনা করে ইংরেজভাষীরা তাদের ভাষার দুরবস্থা দূর করেছিলেন; সেটাকে যথেষ্ট সম্মানের আসনে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং কাজটি ইংরেজিভাষীরাই করেছিলেন; তাদের হয়ে জর্মন, ফরাসি, জাপানি বা চীনাভাষী কেউ এসে করে দিয়ে যায়নি। বাংলার ব্যাপারেও ইংরেজির মতো বলা হয় যে এ-ভাষার শব্দসম্ভার জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানান বিষয় আলাপের উপযোগী নয়, পরিভাষার দিক থেকে আমরা খুব দুর্বল। অল্প যেসব তৈরি হয়েছে সেসব-ও ব্যবহারের অভাবে তেমন প্রচলিত হতে পারেনি। আমাদের প্রবণতা রেডিমেড ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের দিকেই; এর একটি বড় কারণ সম্ভবত আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা। পরিভাষার ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম অনেক শব্দকেই অপরিচিত, অজানা মনে হয়, পরে সেসসব ব্যবহারে ব্যবহারে সড়গড় হয়ে আসে। একথাটা আমরা কেন যেন ভুলে গিয়ে একটু অপরিচয়ের অস্বস্তি সহ্য করতে চাই না। ফলে সেসব আর ব্যবহৃত হয় না। অথচ সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘আমার ভাণ্ডার আছে ভরে’ লেখাটা যদি আমরা স্মরণ করি, আরেকবার পাঠ করি, তাহলে আমাদের ভাষার যে সম্পদ যে শক্তি আছে তা সম্পর্কে একটু বল-ভরসা পেতাম।
বাংলা অনুবাদের, এবং বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদের একটা ডাটাবেইস, একটা হিসাব আমাদের প্রস্তুত করা খুব দরকার। পিটার ফ্রান্স সম্পাদিত দ্য অক্সফোর্ড গাইড টু লিটারেচার ইন ইংলিশ ট্রানসেøশন বইটির মতো, নামেই যেটার পরিচয় ফুটে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার সময় অনুবাদের ভূমিকা নিয়ে একটা আলাদা অধ্যায় থাকাও দরকার মনে করি, শুধু এ-সম্পর্কে দু-একটা আলটপকা মন্তব্য নয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের খুব কম বইয়েই এমন আলোচনার দেখা মেলে; এমনকি কোনো ইংরেজি সাহিত্যের বইয়েও সে-ভাষা ও সাহিত্যের গঠনে অনুবাদের গুরুত্ব নিয়ে বিশেষ আলোচনা দেখতে পাই না।
এর কারণ বোধহয় এই যে, সাধারণ পাঠকের কাছে বাংলা অনুবাদের যা হোক একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু এদেশের অ্যাকাডেমিয়াতে তার কানাকড়িও নেই। অবশ্য এদেশের অ্যাকাডেমিয়ার মান নিয়ে কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো এখন। বাংলা বিভাগগুলোতে চতুর্থ বর্ষ বা এমএ-তে ১০০ নম্বরের একটি কোর্স থাকে যেখানে বাংলা অনুবাদে বিদেশি সাহিত্য পড়ানো হয়। সেখানে মূলত সেই টেক্সটগুলোর ভালোমন্দ, চরিত্র বিশ্লেষণ, এসব নিয়েই আলোচনা করা হয়। অনুবাদের মান বা বৈশিষ্ট্য বা তত্ত্ব নিয়ে কোনো আলাপ হয় না বলেই জানি। অথচ এরকম আলাপ বা বাংলা সাহিত্যে অনুবাদের ইতিহাস নিয়ে আলাপটি জরুরি ছিল, বিশ্ব প্রেক্ষাপটে।
সব শেষে বলব, অনুবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সেটা উপলব্ধি করে এটার চর্চা ও প্রসারের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কাজগুলো আমরা যত দ্রুত করতে পারব ততই মঙ্গল।
লেখক : শিক্ষক ও অনুবাদক