মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা
সত্যেন্দ্রনাথ বসু | ২ মার্চ, ২০২২ ০০:০০
অল্প কয়েক দিন আগে সৌম্যেন্দ্র ঠাকুর এ দেশে বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস শুরু থেকে আজ পর্যন্ত খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। রামমোহন ও অক্ষয়চন্দ্র চেয়েছিলেন যুক্তিতর্কের সাহায্যে দেশের কুসংস্কার দূর করতে, রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছিলেন বিদেশি জাহাজে যে জ্ঞান আমাদের দেশে এসে পৌঁছেছে, দেশি নৌকা ও ডিঙি মারফত সেসব বাংলার গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিতে। হাজার বছরের সাধনার যে বিজ্ঞান আমাদের গরিব দেশেরও কাজে আসে তার জন্য তিনি চেয়েছিলেন মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চা শুরু করতে। যেসব শিল্প-সম্ভার উৎপন্ন করে আগেকার বাঙালি দেশ-বিদেশ থেকে নানা সম্পদ আহরণ করে বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে লক্ষ্মীশ্রী ফুটিয়ে রাখত, তা ক্রূর শাসনে শুকিয়ে গেছে প্রাচুর্যের বদলে সেখানে উঠেছে রোজই দারিদ্র্যের হাহাকার ধ্বনি, তিনি চেয়েছিলেন সত্যিকারের শিক্ষার প্রচলন করে, সেসব কুটিরশিল্পের পুনরুজ্জীবন যাতে কৃষক বোঝে কীভাবে উন্নত প্রথায় চাষ করলে এ মাটিতে আবার সোনা ফলবে; প্রতি গ্রামে পরস্পরকে সাহায্য করলে কীভাবে দুরূহ কাজকে সহজে নিষ্পন্ন করা যাবে এসব। তারপর জগদীশচন্দ্র এলেন নিপুণ হাতে এ দেশের গড়া সূক্ষ্মবস্ত্রে প্রাণের রহস্যের সন্ধান নিতে এবং নানাভাবে প্রমাণ করলেন বিজ্ঞানের এই নতুন রাজত্বে কীভাবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করে জাতির হারানো আত্মসম্মান উদ্ধার করা যায়। ওদিকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র চেয়েছিলেন বাঙালিকে বাণিজ্যে নামাতে, দেশের চাহিদা দেশের তৈরি জিনিস দিয়ে মেটানোর চেষ্টা করতে ও আরও কত কী। দেশের নানা আন্দোলনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের চেষ্টা বাংলা ভাষার বাঙালির বিজ্ঞান শিক্ষার আয়োজনের প্রচেষ্টা আজ চাপা পড়ে গিয়েছে। শান্তিনিকেতনে ও শ্রীনিকেতনে কবির কল্পনাকে রূপ দেওয়ার জন্য চেষ্টা চলেছিল কিছুদিন কিন্তু আজ যে রাজনৈতিক ঝড় উঠেছে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে, তার ভা-ারে আমাদের যা সত্যিকারের শ্রেয় ও প্রেয় হিসেবে কর্তব্য তা অনেকেই ভুলে যেতে বসেছি। যে অল্পসংখ্যক শিক্ষিত আছেন ভেবেছিলাম তারা বুঝবেন যে শুধু তারাই এ জগন্নাথের রথ টেনে নিয়ে যেতে পারবেন না। আজ যার বেশির ভাগ নিরক্ষর ও সামাজিক জাঁতার মধ্যে পড়ে চেপ্টে গিয়েছে, তাদের চাঙা করে সঙ্গে নিতে হবে। কিন্তু এখনো সে বিষয়ে একমত হতে পারিনি।
স্বাধীনতার যুগে আমরা তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে চাই। বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে চাই সংঘবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে। তাই ভাবতে বসি যে এক ভাষার সূত্রে বাংলা ও অবাঙালি সবাইকে না বাঁধলে, আমাদের নিস্তার নেই। আবার মনে করি বিদেশি ইংরাজ যেভাবে শাসন করে এসেছে, সেই বোধহয় নিপুণতার শেষ কথা। তাই ইংরেজ চলে গেলেও ইংরেজি ভাষার মোহ আমাদের কাটেনি। একবার প্রথম গণনির্বাচনের ঠিক আগের বছর বিজ্ঞান কংগ্রেসের মধ্যে আমরা বিচার করেছিলাম কীভাবে দেশের মধ্যে প্রচারকার্য চালানো সহজ হবে। তখন কেউ কেউ এক লিপির কথা পেড়ে বসেছিলেন, হয়তো প্রাদেশিক ভাষার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া দরকার হলেও রোমান লিপির সাহায্য পেলে মুদ্রাযন্ত্রের সাহায্যে লোকের কাছে জ্ঞাতব্য বিষয়গুলো পৌঁছে দেওয়ার কাজ সহজ হবে। অবশ্য শেষ অবধি সে মতে সবার সায় মেলেনি। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন আমেরিকা থেকে প্রায় চল্লিশ বছর বাদে প্রত্যাগত এক ভারতীয় তিনি একটা অদ্ভুত কথা বলে বসলেন, আপনারা কেন ইংরেজিকেই সবার ভাষা বলে চালান না এ তো আমেরিকায় সম্ভব হয়েছে, তবে নানা রকমের বাধার জট কেটে সহজেই আপনারা সহজ রাস্তা পেয়ে যাবেন। অনেকের মনে ধারণা আছে যে, ভারতের ঐক্য এটা আমরা ইংরেজির কল্যাণে বুঝতে শিখেছি। কাজেই ইংরেজি শিক্ষা কায়েম করলেই হয়তো সেই ঐক্যজ্ঞান অটুট থাকবে তারা ভেবে নিয়েছেন, দেশের মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিতের স্তর বিভেদ থাকবেই এবং স্তরে ইংরেজি জানালা দিয়ে যে জ্ঞান ওই জানালা সমীপবর্তীদের উদ্ভাসিত করে তুলবে, তারই কিছু বুদ্ধিমানের মতো নি¤œভাগে পরিবেশন করে নিজেদের স্বার্থবৃত্তি অনুযায়ী রঙিন করে নিয়ে বর্তমানে যে ধরনের স্তরবিন্যাস সমাজে আছে তা চিরন্তনী করে রাখতে পারবেন। তাই এখনো পর্যন্ত দেশের মন্ত্রী, উপাচার্যরা ও আরও অনেকে বলে চলেছেন এভাবে বিদেশি ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার বন্দোবস্ত না রাখলে আমরা দেশের অমঙ্গল টেনে আনব। মাঝে মাঝে শোনা যায় যে, ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষা বোধহয় বিজ্ঞান প্রচারে সহায়তা করবে না। নতুন পরিভাষা দরকার হবে প্রত্যেক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই। অতএব সেই রকম চেষ্টা এখন থেকে শুরু হতে পারে তবে আমার দুর্ভাগ্য যে, সেদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন উৎসবে এক উল্টো সুরে আমি কয়েকটি কথা বলেছিলাম। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষা যেকোনো কাজে অপটু এ আমি স্বীকার করতে নারাজ। জলে না নেমে সাঁতার শেখানোর দুরাশার মতো, ভাষাকে শিক্ষার বাহন করার চেষ্টা না করে শুধু পরিভাষা সৃষ্টির চেষ্টা আমার কাছে হাস্যকর বলে মনে হয়েছে। অবশ্য তারপর থেকে অনেক বাগ্বিত-া চলছে নানা প্রদেশে; এদিকে নিজের দেশে আমি দেখেছি যে, দরকার হলে দেশের শিক্ষিত বিজ্ঞানীরা উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক লিখতে পারেন তার উদাহরণ বিরল নয়। এখানেও বেকার সমস্যার ভয় দেখিয়ে প্রগতির চেষ্টা সব ব্যর্থ করে দিতে চাইছেন অনেকে। হায়দরাবাদে মাতৃভাষার সপক্ষে ওকালতি করার পর এক বন্ধু লিখলেন যে, বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার আয়োজন হলে বাঙালির বেকার সমস্যা আরও সঙিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই আর্থিক অবস্থায় কুলিয়ে গেলে অভিভাবক আমরা ছেলেদের পাঠিয়ে দিচ্ছি সেসব শিক্ষায়তনে যেখানে নি¤œশ্রেণি থেকেই ইংরেজি মাধ্যমে সব শেখানোর বন্দোবস্ত রয়েছে। জাতির ভবিষ্যতের সঙ্গে তার শিক্ষা ও আদর্শের কথা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কাজেই সাহিত্যের আসরে তার উপযুক্ত আলোচনার অবতারণা করা শক্ত। একসময় এ ধরনের বুলি কানে আসত অধীন জাতের আবার রাজনীতিচর্চা কেন? এখন তারই প্রতিধ্বনি শুনছি যে বাঙালি চাকুরের জাত, তার ভাবনা ভাববে তার কর্তারা, সে যেভাবে খুঁটে খেতে পারে সেভাবে চলুক। সাহিত্য রচনা কিংবা ভাষার ভবিষ্যৎ ইত্যাদি বড় বড় কথায় তার কী দরকার।
ভাবের তরঙ্গ আমাদের দেশে একটু পৌঁছায়। অবশ্য আজকের দিনে ভাবনার বালাই জলাঞ্জলি দিয়েছি। আমাদের কাছে বিভিন্ন দেশের প্রচার বিভাগ থেকে যে খবর আসে তাই তর্জমা করে প্রকাশ করেই নিশ্চিন্ত। তাকে যাচাই করে দেখার মতো সামর্থ্য নেই। আমরা ইতিহাস পড়ি, রুশ, জাপান, মিসর ইত্যাদি দেশের নবজাগরণের খবর পড়ি। কিন্তু যদি বলা যায়, এসব দেশে দ্রুত প্রগতি সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞান শিক্ষা মাতৃভাষায় চালু করার ফলে এবং সেভাবে আমাদের দেশে শিক্ষানীতি থেকে পরিবর্তন আনলে, আমরাও তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলতে পারব, তখনই তর্কের ধোঁয়ায় আসল কথা চাপা পড়ে যায়। জাপানের কথা আমি অনেক জায়গায় বলেছি। সেদিন এক জাপানি কলকাতায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, বললেন আমরা বিজ্ঞান বিদেশির কাছে শিখেছি এবং হয়তো এতে সত্যিকারের মৌলিক অবদান আমাদের খুব বেশি নেই তবে যা আমরা শিখেছি সবই জাপানির উপযুক্ত রূপ দিয়ে তাকে আপনার করে নিয়েছি। কাজেই শিল্পবাণিজ্যে আমরা এই প্রচন্ড প্রতিযোগিতার মধ্যেও নিজেদের জাহির করে রেখেছি। বক্তৃতার পর এক বিজ্ঞানী বন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন, স্নাতকোত্তরদের বিজ্ঞান শিক্ষার বন্দোবস্ত তোমাদের কোন ভাষায় হয়? জাপানি যখন উত্তর দিলেন যে, ভাষা মাত্র একটি। সেটি জাপানির মাতৃভাষা ও তারই ব্যবহার চলেছে স্কুল-কলেজে, তখন জিজ্ঞাসু একটু আশ্চর্য হলেন, কথাটা বিশ্বাস করতে তার ইচ্ছা হচ্ছিল না। এরাই বলে আসছেন এ দেশে ইংরেজি মাধ্যম ছাড়া উচ্চবিজ্ঞান শেখানো সম্ভব নয়। তাই এই অবিশ্বাসের সুর। এ মনোভাব আমাদের অনেক দিনের। প্রায় চল্লিশ বছর আগে শিক্ষার্থী হয়ে যখন ফ্রান্স দেশে রয়েছি, তখন ইংল্যান্ড থেকে সে দেশে বেড়াতে এলেন বাঙালি এক ডাক্তার বন্ধু। এক দিন সেখানে আড্ডায় ভারতীয় ও ফরাসি দুই-ই উপস্থিত ছিলেন তার মধ্যে তিনি হাজির। ডাক্তারি শিক্ষার কথা উঠল, বন্ধুটি জিজ্ঞাসা করলেন সে দেশে Anatomy কীভাবে শেখানো হয়। যখন শুনলেন ও দেশে Gray’s Anatomy চলে না তখন তিনি চোখ কপালে তুললেন। এভাবে আমরা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কেউ যদি বলে Shakespeare ক্লাসে বাংলা ভাষায় পড়াচ্ছি, তখনই ব্যঙ্গের হাসি আমাদের মুখে ভেসে ওঠে। যদিও সনাতনী গ্রিক সাহিত্য কিংবা আধুনিক জার্মান সাহিত্য তারা তর্জমায় উপভোগ করেন সেটা স্বীকার করতে তারা দ্বিধা করেন না।
শত শত বছর দাসত্ব করে আমরা যে কিছু নিজেদের মতো করে ভেবে, নিজেদের ভাষায় শিক্ষার বন্দোবস্ত করতে পারি এবং সেই শিক্ষার ফল সুদূরপ্রসারী হয়ে দেশের লোককে উদ্বুদ্ধ ও সঞ্জীবিত করতে পারে, এ ভরসাও হয় না আমাদের।
*১৯৫২ সালে কটক-এ অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে বিজ্ঞান শাখায় সভাপতি রূপে সত্যেন্দ্রনাথের ভাষণ। তপন চক্রবর্তী সম্পাদিত সত্যেন্দ্রনাথ বসু, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৬ গ্রন্থ থেকে ঈষৎ পরিবর্তিত আকারে চয়িত।
শেয়ার করুন
সত্যেন্দ্রনাথ বসু | ২ মার্চ, ২০২২ ০০:০০

অল্প কয়েক দিন আগে সৌম্যেন্দ্র ঠাকুর এ দেশে বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস শুরু থেকে আজ পর্যন্ত খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। রামমোহন ও অক্ষয়চন্দ্র চেয়েছিলেন যুক্তিতর্কের সাহায্যে দেশের কুসংস্কার দূর করতে, রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছিলেন বিদেশি জাহাজে যে জ্ঞান আমাদের দেশে এসে পৌঁছেছে, দেশি নৌকা ও ডিঙি মারফত সেসব বাংলার গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিতে। হাজার বছরের সাধনার যে বিজ্ঞান আমাদের গরিব দেশেরও কাজে আসে তার জন্য তিনি চেয়েছিলেন মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চা শুরু করতে। যেসব শিল্প-সম্ভার উৎপন্ন করে আগেকার বাঙালি দেশ-বিদেশ থেকে নানা সম্পদ আহরণ করে বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে লক্ষ্মীশ্রী ফুটিয়ে রাখত, তা ক্রূর শাসনে শুকিয়ে গেছে প্রাচুর্যের বদলে সেখানে উঠেছে রোজই দারিদ্র্যের হাহাকার ধ্বনি, তিনি চেয়েছিলেন সত্যিকারের শিক্ষার প্রচলন করে, সেসব কুটিরশিল্পের পুনরুজ্জীবন যাতে কৃষক বোঝে কীভাবে উন্নত প্রথায় চাষ করলে এ মাটিতে আবার সোনা ফলবে; প্রতি গ্রামে পরস্পরকে সাহায্য করলে কীভাবে দুরূহ কাজকে সহজে নিষ্পন্ন করা যাবে এসব। তারপর জগদীশচন্দ্র এলেন নিপুণ হাতে এ দেশের গড়া সূক্ষ্মবস্ত্রে প্রাণের রহস্যের সন্ধান নিতে এবং নানাভাবে প্রমাণ করলেন বিজ্ঞানের এই নতুন রাজত্বে কীভাবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করে জাতির হারানো আত্মসম্মান উদ্ধার করা যায়। ওদিকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র চেয়েছিলেন বাঙালিকে বাণিজ্যে নামাতে, দেশের চাহিদা দেশের তৈরি জিনিস দিয়ে মেটানোর চেষ্টা করতে ও আরও কত কী। দেশের নানা আন্দোলনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের চেষ্টা বাংলা ভাষার বাঙালির বিজ্ঞান শিক্ষার আয়োজনের প্রচেষ্টা আজ চাপা পড়ে গিয়েছে। শান্তিনিকেতনে ও শ্রীনিকেতনে কবির কল্পনাকে রূপ দেওয়ার জন্য চেষ্টা চলেছিল কিছুদিন কিন্তু আজ যে রাজনৈতিক ঝড় উঠেছে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে, তার ভা-ারে আমাদের যা সত্যিকারের শ্রেয় ও প্রেয় হিসেবে কর্তব্য তা অনেকেই ভুলে যেতে বসেছি। যে অল্পসংখ্যক শিক্ষিত আছেন ভেবেছিলাম তারা বুঝবেন যে শুধু তারাই এ জগন্নাথের রথ টেনে নিয়ে যেতে পারবেন না। আজ যার বেশির ভাগ নিরক্ষর ও সামাজিক জাঁতার মধ্যে পড়ে চেপ্টে গিয়েছে, তাদের চাঙা করে সঙ্গে নিতে হবে। কিন্তু এখনো সে বিষয়ে একমত হতে পারিনি।
স্বাধীনতার যুগে আমরা তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে চাই। বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে চাই সংঘবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে। তাই ভাবতে বসি যে এক ভাষার সূত্রে বাংলা ও অবাঙালি সবাইকে না বাঁধলে, আমাদের নিস্তার নেই। আবার মনে করি বিদেশি ইংরাজ যেভাবে শাসন করে এসেছে, সেই বোধহয় নিপুণতার শেষ কথা। তাই ইংরেজ চলে গেলেও ইংরেজি ভাষার মোহ আমাদের কাটেনি। একবার প্রথম গণনির্বাচনের ঠিক আগের বছর বিজ্ঞান কংগ্রেসের মধ্যে আমরা বিচার করেছিলাম কীভাবে দেশের মধ্যে প্রচারকার্য চালানো সহজ হবে। তখন কেউ কেউ এক লিপির কথা পেড়ে বসেছিলেন, হয়তো প্রাদেশিক ভাষার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া দরকার হলেও রোমান লিপির সাহায্য পেলে মুদ্রাযন্ত্রের সাহায্যে লোকের কাছে জ্ঞাতব্য বিষয়গুলো পৌঁছে দেওয়ার কাজ সহজ হবে। অবশ্য শেষ অবধি সে মতে সবার সায় মেলেনি। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন আমেরিকা থেকে প্রায় চল্লিশ বছর বাদে প্রত্যাগত এক ভারতীয় তিনি একটা অদ্ভুত কথা বলে বসলেন, আপনারা কেন ইংরেজিকেই সবার ভাষা বলে চালান না এ তো আমেরিকায় সম্ভব হয়েছে, তবে নানা রকমের বাধার জট কেটে সহজেই আপনারা সহজ রাস্তা পেয়ে যাবেন। অনেকের মনে ধারণা আছে যে, ভারতের ঐক্য এটা আমরা ইংরেজির কল্যাণে বুঝতে শিখেছি। কাজেই ইংরেজি শিক্ষা কায়েম করলেই হয়তো সেই ঐক্যজ্ঞান অটুট থাকবে তারা ভেবে নিয়েছেন, দেশের মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিতের স্তর বিভেদ থাকবেই এবং স্তরে ইংরেজি জানালা দিয়ে যে জ্ঞান ওই জানালা সমীপবর্তীদের উদ্ভাসিত করে তুলবে, তারই কিছু বুদ্ধিমানের মতো নি¤œভাগে পরিবেশন করে নিজেদের স্বার্থবৃত্তি অনুযায়ী রঙিন করে নিয়ে বর্তমানে যে ধরনের স্তরবিন্যাস সমাজে আছে তা চিরন্তনী করে রাখতে পারবেন। তাই এখনো পর্যন্ত দেশের মন্ত্রী, উপাচার্যরা ও আরও অনেকে বলে চলেছেন এভাবে বিদেশি ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার বন্দোবস্ত না রাখলে আমরা দেশের অমঙ্গল টেনে আনব। মাঝে মাঝে শোনা যায় যে, ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষা বোধহয় বিজ্ঞান প্রচারে সহায়তা করবে না। নতুন পরিভাষা দরকার হবে প্রত্যেক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই। অতএব সেই রকম চেষ্টা এখন থেকে শুরু হতে পারে তবে আমার দুর্ভাগ্য যে, সেদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন উৎসবে এক উল্টো সুরে আমি কয়েকটি কথা বলেছিলাম। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষা যেকোনো কাজে অপটু এ আমি স্বীকার করতে নারাজ। জলে না নেমে সাঁতার শেখানোর দুরাশার মতো, ভাষাকে শিক্ষার বাহন করার চেষ্টা না করে শুধু পরিভাষা সৃষ্টির চেষ্টা আমার কাছে হাস্যকর বলে মনে হয়েছে। অবশ্য তারপর থেকে অনেক বাগ্বিত-া চলছে নানা প্রদেশে; এদিকে নিজের দেশে আমি দেখেছি যে, দরকার হলে দেশের শিক্ষিত বিজ্ঞানীরা উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক লিখতে পারেন তার উদাহরণ বিরল নয়। এখানেও বেকার সমস্যার ভয় দেখিয়ে প্রগতির চেষ্টা সব ব্যর্থ করে দিতে চাইছেন অনেকে। হায়দরাবাদে মাতৃভাষার সপক্ষে ওকালতি করার পর এক বন্ধু লিখলেন যে, বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার আয়োজন হলে বাঙালির বেকার সমস্যা আরও সঙিন হয়ে দাঁড়াবে। তাই আর্থিক অবস্থায় কুলিয়ে গেলে অভিভাবক আমরা ছেলেদের পাঠিয়ে দিচ্ছি সেসব শিক্ষায়তনে যেখানে নি¤œশ্রেণি থেকেই ইংরেজি মাধ্যমে সব শেখানোর বন্দোবস্ত রয়েছে। জাতির ভবিষ্যতের সঙ্গে তার শিক্ষা ও আদর্শের কথা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কাজেই সাহিত্যের আসরে তার উপযুক্ত আলোচনার অবতারণা করা শক্ত। একসময় এ ধরনের বুলি কানে আসত অধীন জাতের আবার রাজনীতিচর্চা কেন? এখন তারই প্রতিধ্বনি শুনছি যে বাঙালি চাকুরের জাত, তার ভাবনা ভাববে তার কর্তারা, সে যেভাবে খুঁটে খেতে পারে সেভাবে চলুক। সাহিত্য রচনা কিংবা ভাষার ভবিষ্যৎ ইত্যাদি বড় বড় কথায় তার কী দরকার।
ভাবের তরঙ্গ আমাদের দেশে একটু পৌঁছায়। অবশ্য আজকের দিনে ভাবনার বালাই জলাঞ্জলি দিয়েছি। আমাদের কাছে বিভিন্ন দেশের প্রচার বিভাগ থেকে যে খবর আসে তাই তর্জমা করে প্রকাশ করেই নিশ্চিন্ত। তাকে যাচাই করে দেখার মতো সামর্থ্য নেই। আমরা ইতিহাস পড়ি, রুশ, জাপান, মিসর ইত্যাদি দেশের নবজাগরণের খবর পড়ি। কিন্তু যদি বলা যায়, এসব দেশে দ্রুত প্রগতি সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞান শিক্ষা মাতৃভাষায় চালু করার ফলে এবং সেভাবে আমাদের দেশে শিক্ষানীতি থেকে পরিবর্তন আনলে, আমরাও তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলতে পারব, তখনই তর্কের ধোঁয়ায় আসল কথা চাপা পড়ে যায়। জাপানের কথা আমি অনেক জায়গায় বলেছি। সেদিন এক জাপানি কলকাতায় বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, বললেন আমরা বিজ্ঞান বিদেশির কাছে শিখেছি এবং হয়তো এতে সত্যিকারের মৌলিক অবদান আমাদের খুব বেশি নেই তবে যা আমরা শিখেছি সবই জাপানির উপযুক্ত রূপ দিয়ে তাকে আপনার করে নিয়েছি। কাজেই শিল্পবাণিজ্যে আমরা এই প্রচন্ড প্রতিযোগিতার মধ্যেও নিজেদের জাহির করে রেখেছি। বক্তৃতার পর এক বিজ্ঞানী বন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন, স্নাতকোত্তরদের বিজ্ঞান শিক্ষার বন্দোবস্ত তোমাদের কোন ভাষায় হয়? জাপানি যখন উত্তর দিলেন যে, ভাষা মাত্র একটি। সেটি জাপানির মাতৃভাষা ও তারই ব্যবহার চলেছে স্কুল-কলেজে, তখন জিজ্ঞাসু একটু আশ্চর্য হলেন, কথাটা বিশ্বাস করতে তার ইচ্ছা হচ্ছিল না। এরাই বলে আসছেন এ দেশে ইংরেজি মাধ্যম ছাড়া উচ্চবিজ্ঞান শেখানো সম্ভব নয়। তাই এই অবিশ্বাসের সুর। এ মনোভাব আমাদের অনেক দিনের। প্রায় চল্লিশ বছর আগে শিক্ষার্থী হয়ে যখন ফ্রান্স দেশে রয়েছি, তখন ইংল্যান্ড থেকে সে দেশে বেড়াতে এলেন বাঙালি এক ডাক্তার বন্ধু। এক দিন সেখানে আড্ডায় ভারতীয় ও ফরাসি দুই-ই উপস্থিত ছিলেন তার মধ্যে তিনি হাজির। ডাক্তারি শিক্ষার কথা উঠল, বন্ধুটি জিজ্ঞাসা করলেন সে দেশে Anatomy কীভাবে শেখানো হয়। যখন শুনলেন ও দেশে Gray’s Anatomy চলে না তখন তিনি চোখ কপালে তুললেন। এভাবে আমরা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কেউ যদি বলে Shakespeare ক্লাসে বাংলা ভাষায় পড়াচ্ছি, তখনই ব্যঙ্গের হাসি আমাদের মুখে ভেসে ওঠে। যদিও সনাতনী গ্রিক সাহিত্য কিংবা আধুনিক জার্মান সাহিত্য তারা তর্জমায় উপভোগ করেন সেটা স্বীকার করতে তারা দ্বিধা করেন না।
শত শত বছর দাসত্ব করে আমরা যে কিছু নিজেদের মতো করে ভেবে, নিজেদের ভাষায় শিক্ষার বন্দোবস্ত করতে পারি এবং সেই শিক্ষার ফল সুদূরপ্রসারী হয়ে দেশের লোককে উদ্বুদ্ধ ও সঞ্জীবিত করতে পারে, এ ভরসাও হয় না আমাদের।
*১৯৫২ সালে কটক-এ অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে বিজ্ঞান শাখায় সভাপতি রূপে সত্যেন্দ্রনাথের ভাষণ। তপন চক্রবর্তী সম্পাদিত সত্যেন্দ্রনাথ বসু, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৬ গ্রন্থ থেকে ঈষৎ পরিবর্তিত আকারে চয়িত।