১৯৫২-২০২২
সাত দশকে বাংলাদেশের সাহিত্যিক ভাষা
মোহাম্মদ আজম | ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
প্রথমেই দুটি সতর্কতা দাগিয়ে দেওয়া ভালো। প্রথমত, বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন বিশুদ্ধ ভাষাকেন্দ্রিক আন্দোলন নয়। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-আর্থিক নানা দিক এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। এক বিরাট জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক জীবন-বাস্তবতার বিচিত্র উৎসারণ ভাষার দাবিকে সামনে রেখে ঘটনা-পরম্পরায় মুক্তি পেয়েছিল। বদরুদ্দীন উমর পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইয়ের তিন খন্ডে এই সামগ্রিক বাস্তবতার মোটামুটি নির্ভরযোগ্য ছবি এঁকেছেন। কাজেই একুশের ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমরা যখন শুধু ভাষা নিয়ে আলাপ করি, তখন ওই বৃহত্তর পটভূমির সাপেক্ষেই তা করা ভালো বিচ্ছিন্ন করে নয়। দ্বিতীয়ত, সাহিত্যিক ভাষা ভাষার খুব ছোট্ট একাংশ মাত্র। গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নেই। কিন্তু ভাষার বিচিত্র অস্তিত্ব ও কেজো দিকের খন্ডাংশের এ আলাপ কিছুতেই পুরো ভাষার আলাপ নয়। এ লেখায় গত সত্তর বছরের বাংলাদেশের সাহিত্যিক ভাষা নিয়ে কয়েকটি মন্তব্য করার ক্ষেত্রে আমরা এ দুটি দিক মনে রাখব।
একুশে ফেব্রুয়ারির সবচেয়ে বড় যে দিকটি আমাদের সামগ্রিক আলোচনা-পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, তাকে বলতে পারি জাতীয়তাবাদী দিক। জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক দিকগুলোর অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ভাষা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার আগে বিকশিত জাতীয়তাবাদী চেতনার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ও বাঙালি পরিচয় এককভাবে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিল। আমাদের সাহিত্যিক চর্চা ও সাহিত্যের মূল্যায়নেও সেদিকের সুস্পষ্ট প্রাধান্য আছে। সেকালের ভাষা-পরিস্থিতির নিরিখেই তখন সাহিত্যিক-সমাজ ও সংস্কৃতিসেবীরা পরিচালিত হয়েছিলেন। খুব স্বাভাবিক কারণেই চল্লিশের দশকে পাকিস্তান-আন্দোলনের সঙ্গী হয়ে বিকশিত সাহিত্যিক ভাষা-রূপের সঙ্গে এই দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র বিরোধ ছিল। চল্লিশের সাহিত্যিক সমাজের একটা বড় অংশ কলকাতার প্রমিতের বিপরীতে পূর্ব বাংলার এবং বিশেষত মুসলমান-সমাজের আলাদা প্রমিত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। তাতে সাফল্য এসেছিল। কিন্তু আলাদা প্রমিতের নামে অতিরিক্ত ফারসি-আরবি শব্দের ব্যবহার, এবং সংস্কৃত এমনকি প্রচলিত সংস্কৃত শব্দের প্রতিও বিতৃষ্ণা দেখা গিয়েছিল। তার ফলে অনেকের লেখায় বাংলা গদ্য কিংবা কাব্যভাষা বেশ অচলিত একটা রূপ পাচ্ছিল। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন খুব প্রত্যক্ষভাবে এ ধারার সাহিত্যিক ভাষাকে নিরুৎসাহিত করেছিল। তার নগদ প্রমাণ পাওয়া যায় পঞ্চাশের সাহিত্যিক ভাষায়। দেখা যাচ্ছে, পঞ্চাশের দশকেই আগের দশকের কবিভাষা অথবা গদ্যভাষা বেশ কোণঠাসা হয়ে উঠেছে; আর আমাদের তরুণ সাহিত্যিকরা কলকাতায় বিকশিত প্রমিত বাংলায় ফিরে যাচ্ছেন। হুমায়ুন আজাদ একে বলেছেন বাংলা ভাষার ‘পরিস্রুত’ হয়ে ওঠা। অন্য বেশির ভাগ বিশ্লেষকও এ রকম মনে করেন। আমরা যদি এ ক্ষেত্রে ‘পরিস্রুত’ কথাটা ব্যবহার নাও করতে চাই, সাহিত্যিক ভাষার-যে খুব দৃষ্টিগ্রাহ্য বদল হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ করা চলে না।
অনুমান করা যায়, ঢাকার একটি মানভাষা নিয়ে তখন প্রকাশিত-অপ্রকাশিত নানা উদ্যোগ-আয়োজন চলছিল। অনেকেই কলকাতার প্রমিতের তুলনায় ঢাকার ভাষার নানামাত্রিক ভিন্নতা বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু এ সমস্যা সমাধানে ঠিক কী করা যায়, তা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। এ দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে খুব সহজ করে দিয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অনুসারীদের বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক বিভিন্ন উদ্যোগ। রাষ্ট্রের চাওয়া-অনুযায়ী ভাষা-সংস্কারের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল বলেই খুব সহজে অনেক পন্ডিত এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পেরেছিলেন। কারণ, তখন ভাষা-সংস্কার এবং রাজনীতি একাকার হয়ে গিয়েছিল। কে রাষ্ট্রীয় ভাষা-সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছিল, আর কে এর বিরুদ্ধে কাজ করছিল, সে সমীকরণ খুব সহজেই রাজনৈতিক অবস্থানের পরিচয় হয়ে উঠেছিল।
মুহম্মদ আবদুল হাই এবং মুনীর চৌধুরীর কথাই ধরা যাক। আবদুল হাই নিজে ব্যাপক ভাষা-সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এ ধরনের সংস্কারের আয়োজন চলে, এবং তার পক্ষে নানান ধরনের সংস্কার-প্রস্তাব করা হয়, তখন আবদুল হাই তার বিরোধিতা করেন। রাষ্ট্রের চাওয়া-অনুযায়ী ভাষা-সংস্কার হতে পারে না এটাই ছিল তার অবস্থান। অন্যদিকে মুনীর চৌধুরীও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ভাষা-সংস্কার-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরে তার বাংলা গদ্যরীতি বইতে পূর্ব বাংলার সাহিত্যিক গদ্য বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন, জীবনযাপনের বাস্তবতা প্রকাশের স্বার্থেই লেখকরা পূর্ব বাংলায় প্রচলিত ভাষার নানা উপাদান সহজাত ভঙ্গিতে ব্যবহার করছেন। কাজেই এ নিয়ে আলাদা কোনো আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা করা অর্থহীন।
প্রমিত বাংলা এবং সাহিত্যিক বাংলা নিয়ে এসব তর্কবিতর্ককে আমরা ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত করতে পারি। এর গভীরতর প্রভাব পড়েছে, দেখতে পাই, ষাটের দশকে নতুন বিকশিত সাহিত্যিকদের চর্চায়। ষাটের প্রথম দশকে ‘সাহিত্যিক আধুনিকতা’র তীব্র প্রকাশ লক্ষ করি সাহিত্যচর্চার প্রায় সর্বত্র; আর ভাষার বিবেচনায় এ আধুনিকতা অনেকাংশে সংস্কৃতায়নের পথ ধরেছিল। ষাটের প্রথমার্ধের সাহিত্যিকরা সংস্কৃতায়িত ভাষা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিলেন। দ্বিতীয়ার্ধে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের চাপেই হয়তো, আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়, আর সংস্কৃতায়িত ভাষার জটিলতাও অনেকাংশে কমে আসে। আমাদের সত্তরের দশকের সাহিত্যিক ভাষাকে গদ্য-পদ্য মিলিয়ে ষাটের দশকের দ্বিতীয়াংশে বিকশিত এ ভাষাদৃষ্টির অনুসারী বলতে পারি। কবিতার এলানো এবং তুলনামূলক সরল ভাষাভঙ্গি আর গদ্যে জনপ্রিয় ধারার ব্যাপক উত্থানের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক দেখানো সম্ভব।
কিন্তু ষাটের দশকের ভাষা-নন্দনতত্ত্বের আরও একটা প্রবল দিক ছিল। পাকিস্তানবাদী সাহিত্যাদর্শের প্রবলতার বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবেই হয়তো, আমাদের গদ্য-লেখকরা শুধু কলকাত্তাই প্রমিতের ইমানদারই হয়ে উঠলেন না, জটিলতা আর দুর্বোধ্যতাকেও ব্যাপকভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বিখ্যাত কণ্ঠস্বর-গোষ্ঠীর গদ্যচর্চায় তার প্রায় সর্বব্যাপী পরিচয় মেলে। বুদ্ধদেব বসু নয়, সুধীন্দ্রনাথ দত্তই হয়ে উঠেছিলেন ওই গদ্য-লিখিয়েদের পরম আশ্রয়। সাহিত্যিক অর্থে বেশ বর্ণাঢ্য এ গদ্যচর্চার স্মারক হয়ে আছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত সাম্প্রতিক ধারার প্রবন্ধ গ্রন্থটি।
ষাটের দশকের এ সংস্কৃতায়ন-প্রবণতাই প্রবল বিক্রমে বাংলাদেশের সাহিত্যিক ভাষায় ফিরে এলো আশির দশকে। এ সময়ের সাহিত্যকর্মে কলকাতার কবিতা ও কথাসাহিত্যের প্রবল প্রভাব দেখা যায়। জনবোধ্য ভাষার বিপরীতে গিয়ে সাহিত্যিক-সমাজের একটা বড় ও প্রভাবশালী অংশ দুর্বোধ্যতার চর্চা করেছেন এ সময়। এর পেছনে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাও প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে হয়। এ বিষয়ে কোনো গবেষণা না হওয়ায় নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। তবে ভাষিক-নন্দনতাত্ত্বিক ঝোঁক এবং সাহিত্যকর্মে তার প্রতিফলন প্রমাণ করে, বাংলাদেশের প্রভাবশালী সাহিত্যিক ভাষায় একটা বড় বদল ঘটেছিল ওই দশকে। নব্বইয়ের দশকে ওই ধারা অংশত অব্যাহত ছিল। এর সঙ্গে অধিক হারে মিশেছিল সাহিত্যিক আধুনিকতার কতগুলো ধারণা, যেমন বিমূর্ততা, নাস্তি, ফর্মের দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রাধান্য, অচলিত শব্দ ব্যবহারের ঝোঁক ইত্যাদি।
তবে নব্বইয়ের দশকেই ঢাকার সাহিত্যকর্মে আরও অন্তত দুটি প্রবণতা প্রবলভাবে দেখা দিয়েছিল। একটিকে বলতে পারি এক ধরনের উত্তরাধুনিক চর্চা। পশ্চিমা উত্তরাধুনিকতার বিপরীতে গিয়ে, আসলে বলা উচিত আধুনিকতাবাদের বিপরীতে গিয়ে, বেশসংখ্যক সাহিত্যিক এ সময় এক ধরনের স্থানীয় ‘উত্তরাধুনিকতা’র চর্চা করেছিলেন। সাহিত্যকর্মে স্থানীয় নানা উপাদান ও ভাবকে রূপায়িত করাই ছিল এর মূল লক্ষণ। স্বভাবতই ‘প্রমিত বাংলা’র আওতায় ইতিপূর্বে বাদ পড়া বহু উপাদান এ সময় সাহিত্যচর্চায় গুরুত্বের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়েছিল। ওই নব্বইয়ের দশকেই আরেকটি প্রবণতা প্রবলভাবে আমাদের সামগ্রিক চর্চায় শুরু হয়েছিল। একে বলতে পারি, ভাষা ও ভাবের অপ্রমিতায়ন। যাকে প্রমিত ভাষা বলা যায়, তার সঙ্গে স্বভাবতই নানা প্রমিত ভাবও যুক্ত। এ ভাষা ও ভাব জনগোষ্ঠীর যাপনগত বহুরৈখিক বাস্তবতাকে একরৈখিক আদবে সীমিত করতে চায়। আর চায় বিপুল ভাষা ও ভাবকে অপরায়ণ করতে। নব্বইয়ের দশকেই প্রথমবারের মতো শক্তিশালী কোনো কোনো সাহিত্যিকের ভাব-ভাষায় এ দৃষ্টিভঙ্গিকে কেবল আঘাতই করা হয়নি, ব্যঙ্গপ্রবণ তির্যক ভাব-ভাষার আঘাতে পর্যুদস্তও করা হয়েছে। বাংলাদেশের পরবর্তী সাহিত্যিক যাত্রায় এ ধারার প্রবল প্রতিষ্ঠা ঘটেছে।
এখানে মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি, ওপরে খুব সংক্ষিপ্ত ও মন্তব্যধর্মী কেতায় সাহিত্যিক ভাষার যে বর্ণনা আমরা দিলাম, তা মোটেই পুরো সাহিত্য-ভাষার খতিয়ান নয়। বরং একটা বিশেষ সময়ে যেসব প্রবণতাকে নতুন, প্রধান ও প্রভাবশালী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, তার কয়েকটিই এখানে উল্লিখিত হয়েছে। এর বাইরে চর্চার বিপুল অংশ যেমন রয়ে গেছে, ঠিক তেমনি একটা নির্দিষ্ট সময়ে বিচিত্র ধরনের চর্চাও চোখে পড়ে। যেমন : আশির দশকে কলকাতার সাহিত্যিক ভাষা ও সংস্কৃতায়িত সাহিত্যিক ভাষার পাশাপাশি বহু সাহিত্যিক পাওয়া যাবে, যাদের সাহিত্যিক ভাষাকে এসব ডাকনামে চেনা সম্ভব নয়। ঠিক তেমনি নব্বইয়ের দশকে এক সার্বিক ‘অপ্রমিতায়ন’ প্রবণতা হিসেবে আমরা সাহিত্যভাষার যেসব প্রবণতাকে চিহ্নিত করেছি, তার বাইরে যথারীতি ‘আধুনিকতাবাদী’ কিংবা ‘প্রমিত’ নামে চেনা যায়, এমন বিপুল সাহিত্যকর্মও রচিত হয়েছে। তবে সাহিত্যধারায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে ধরনের চর্চা ও ভাষা, তা অন্যরকম গুরুত্বের দাবিদার। যেমন : নব্বইয়ের দশকে শুরু হওয়া ‘অপ্রমিতায়ন’ একুশ শতকের বাংলাদেশের সাহিত্যিক ভাষায় বিশেষভাবে গুরুতর হয়ে ওঠায় এ চর্চাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই।
একুশ শতকের দুই দশকে বাংলাদেশের সাহিত্যভাষার প্রধান প্রবণতাকে বলতে পারি প্রমিতসহ নন্দনতাত্ত্বিক নানা বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার সৃষ্টিশীল সাধনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন প্রকাশনার ব্যাপকতা এ চর্চায় বিরাট আনুকূল্য জুগিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভাষার পুলিশির মতো বিষয়গত ও ভাবনাগত পুলিশিও অনলাইন মাধ্যমগুলোতে এক প্রকার অসম্ভব হয়ে উঠেছে। কাজেই জীবন-বাস্তবতাই আমাদের ভাবতে উৎসাহিত করছে, ভাষা ও ভাবের সংকীর্ণ ‘প্রমিত’ বেড়াজাল আরও প্রসারিত করাই কর্তব্য। বাংলাদেশের সৃষ্টিশীল ও মননশীল সাহিত্যিক ভাষায় এ বোধের সফল উৎসারণ এখন প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে। আগের দশকগুলোর চর্চায় কোনো বিতৃষ্ণা না দেখিয়েই নিশ্চিন্তে বলা যায়, বাংলাদেশের সাহিত্যিক ভাষার বিকাশ ও মুক্তির জন্য এ অবস্থা অনেক বেশি অনুকূল।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের উপাদান ও আবেগের বিষয় হিসেবে দেখার প্রবণতা আমাদের মধ্যে অতি প্রবল। জাতীয় ইতিহাসের কোনো একটি ক্ষণকে সমকালীন তাৎপর্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা একটা বিরাট সীমাবদ্ধতা। মনে রাখা দরকার, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে যেমন সামগ্রিক জীবনযাপনগত বাস্তবতার প্রকাশ ঘটেছিল, ঠিক তেমনি সত্তর বছর পরে ওই ঘটনার কোনো প্রকৃত তাৎপর্য যদি থেকেই থাকে, তবে তা থাকবে বর্তমান জীবনযাপনের সামগ্রিকতায় তাকে অনুবাদের সাফল্যের মধ্যে। আমাদের বর্তমান আলোচনার প্রসঙ্গে বলা যায়, গত দু-তিন দশকে বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যিক ভাষার মুক্তির সম্ভাবনা শুধু তখনি ফলপ্রসূ হবে, যখন জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক জীবনযাপনের সঙ্গে তাকে নানামাত্রায় সম্পর্কিত করে বিচার করা যাবে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ভাষার ব্যবহার ও প্রকাশকে ওই বড় আঙ্গিকে ও পরিসরে দেখা শুধু সম্ভবই নয়, জরুরিও বটে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন
মোহাম্মদ আজম | ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

প্রথমেই দুটি সতর্কতা দাগিয়ে দেওয়া ভালো। প্রথমত, বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন বিশুদ্ধ ভাষাকেন্দ্রিক আন্দোলন নয়। রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-আর্থিক নানা দিক এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। এক বিরাট জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক জীবন-বাস্তবতার বিচিত্র উৎসারণ ভাষার দাবিকে সামনে রেখে ঘটনা-পরম্পরায় মুক্তি পেয়েছিল। বদরুদ্দীন উমর পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বইয়ের তিন খন্ডে এই সামগ্রিক বাস্তবতার মোটামুটি নির্ভরযোগ্য ছবি এঁকেছেন। কাজেই একুশের ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমরা যখন শুধু ভাষা নিয়ে আলাপ করি, তখন ওই বৃহত্তর পটভূমির সাপেক্ষেই তা করা ভালো বিচ্ছিন্ন করে নয়। দ্বিতীয়ত, সাহিত্যিক ভাষা ভাষার খুব ছোট্ট একাংশ মাত্র। গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নেই। কিন্তু ভাষার বিচিত্র অস্তিত্ব ও কেজো দিকের খন্ডাংশের এ আলাপ কিছুতেই পুরো ভাষার আলাপ নয়। এ লেখায় গত সত্তর বছরের বাংলাদেশের সাহিত্যিক ভাষা নিয়ে কয়েকটি মন্তব্য করার ক্ষেত্রে আমরা এ দুটি দিক মনে রাখব।
একুশে ফেব্রুয়ারির সবচেয়ে বড় যে দিকটি আমাদের সামগ্রিক আলোচনা-পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, তাকে বলতে পারি জাতীয়তাবাদী দিক। জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক দিকগুলোর অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ভাষা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার আগে বিকশিত জাতীয়তাবাদী চেতনার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ও বাঙালি পরিচয় এককভাবে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিল। আমাদের সাহিত্যিক চর্চা ও সাহিত্যের মূল্যায়নেও সেদিকের সুস্পষ্ট প্রাধান্য আছে। সেকালের ভাষা-পরিস্থিতির নিরিখেই তখন সাহিত্যিক-সমাজ ও সংস্কৃতিসেবীরা পরিচালিত হয়েছিলেন। খুব স্বাভাবিক কারণেই চল্লিশের দশকে পাকিস্তান-আন্দোলনের সঙ্গী হয়ে বিকশিত সাহিত্যিক ভাষা-রূপের সঙ্গে এই দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র বিরোধ ছিল। চল্লিশের সাহিত্যিক সমাজের একটা বড় অংশ কলকাতার প্রমিতের বিপরীতে পূর্ব বাংলার এবং বিশেষত মুসলমান-সমাজের আলাদা প্রমিত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। তাতে সাফল্য এসেছিল। কিন্তু আলাদা প্রমিতের নামে অতিরিক্ত ফারসি-আরবি শব্দের ব্যবহার, এবং সংস্কৃত এমনকি প্রচলিত সংস্কৃত শব্দের প্রতিও বিতৃষ্ণা দেখা গিয়েছিল। তার ফলে অনেকের লেখায় বাংলা গদ্য কিংবা কাব্যভাষা বেশ অচলিত একটা রূপ পাচ্ছিল। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন খুব প্রত্যক্ষভাবে এ ধারার সাহিত্যিক ভাষাকে নিরুৎসাহিত করেছিল। তার নগদ প্রমাণ পাওয়া যায় পঞ্চাশের সাহিত্যিক ভাষায়। দেখা যাচ্ছে, পঞ্চাশের দশকেই আগের দশকের কবিভাষা অথবা গদ্যভাষা বেশ কোণঠাসা হয়ে উঠেছে; আর আমাদের তরুণ সাহিত্যিকরা কলকাতায় বিকশিত প্রমিত বাংলায় ফিরে যাচ্ছেন। হুমায়ুন আজাদ একে বলেছেন বাংলা ভাষার ‘পরিস্রুত’ হয়ে ওঠা। অন্য বেশির ভাগ বিশ্লেষকও এ রকম মনে করেন। আমরা যদি এ ক্ষেত্রে ‘পরিস্রুত’ কথাটা ব্যবহার নাও করতে চাই, সাহিত্যিক ভাষার-যে খুব দৃষ্টিগ্রাহ্য বদল হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ করা চলে না।
অনুমান করা যায়, ঢাকার একটি মানভাষা নিয়ে তখন প্রকাশিত-অপ্রকাশিত নানা উদ্যোগ-আয়োজন চলছিল। অনেকেই কলকাতার প্রমিতের তুলনায় ঢাকার ভাষার নানামাত্রিক ভিন্নতা বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু এ সমস্যা সমাধানে ঠিক কী করা যায়, তা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। এ দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে খুব সহজ করে দিয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অনুসারীদের বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক বিভিন্ন উদ্যোগ। রাষ্ট্রের চাওয়া-অনুযায়ী ভাষা-সংস্কারের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল বলেই খুব সহজে অনেক পন্ডিত এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পেরেছিলেন। কারণ, তখন ভাষা-সংস্কার এবং রাজনীতি একাকার হয়ে গিয়েছিল। কে রাষ্ট্রীয় ভাষা-সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছিল, আর কে এর বিরুদ্ধে কাজ করছিল, সে সমীকরণ খুব সহজেই রাজনৈতিক অবস্থানের পরিচয় হয়ে উঠেছিল।
মুহম্মদ আবদুল হাই এবং মুনীর চৌধুরীর কথাই ধরা যাক। আবদুল হাই নিজে ব্যাপক ভাষা-সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এ ধরনের সংস্কারের আয়োজন চলে, এবং তার পক্ষে নানান ধরনের সংস্কার-প্রস্তাব করা হয়, তখন আবদুল হাই তার বিরোধিতা করেন। রাষ্ট্রের চাওয়া-অনুযায়ী ভাষা-সংস্কার হতে পারে না এটাই ছিল তার অবস্থান। অন্যদিকে মুনীর চৌধুরীও বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ভাষা-সংস্কার-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরে তার বাংলা গদ্যরীতি বইতে পূর্ব বাংলার সাহিত্যিক গদ্য বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন, জীবনযাপনের বাস্তবতা প্রকাশের স্বার্থেই লেখকরা পূর্ব বাংলায় প্রচলিত ভাষার নানা উপাদান সহজাত ভঙ্গিতে ব্যবহার করছেন। কাজেই এ নিয়ে আলাদা কোনো আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা করা অর্থহীন।
প্রমিত বাংলা এবং সাহিত্যিক বাংলা নিয়ে এসব তর্কবিতর্ককে আমরা ভাষা-আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত করতে পারি। এর গভীরতর প্রভাব পড়েছে, দেখতে পাই, ষাটের দশকে নতুন বিকশিত সাহিত্যিকদের চর্চায়। ষাটের প্রথম দশকে ‘সাহিত্যিক আধুনিকতা’র তীব্র প্রকাশ লক্ষ করি সাহিত্যচর্চার প্রায় সর্বত্র; আর ভাষার বিবেচনায় এ আধুনিকতা অনেকাংশে সংস্কৃতায়নের পথ ধরেছিল। ষাটের প্রথমার্ধের সাহিত্যিকরা সংস্কৃতায়িত ভাষা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিলেন। দ্বিতীয়ার্ধে, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের চাপেই হয়তো, আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়, আর সংস্কৃতায়িত ভাষার জটিলতাও অনেকাংশে কমে আসে। আমাদের সত্তরের দশকের সাহিত্যিক ভাষাকে গদ্য-পদ্য মিলিয়ে ষাটের দশকের দ্বিতীয়াংশে বিকশিত এ ভাষাদৃষ্টির অনুসারী বলতে পারি। কবিতার এলানো এবং তুলনামূলক সরল ভাষাভঙ্গি আর গদ্যে জনপ্রিয় ধারার ব্যাপক উত্থানের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক দেখানো সম্ভব।
কিন্তু ষাটের দশকের ভাষা-নন্দনতত্ত্বের আরও একটা প্রবল দিক ছিল। পাকিস্তানবাদী সাহিত্যাদর্শের প্রবলতার বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবেই হয়তো, আমাদের গদ্য-লেখকরা শুধু কলকাত্তাই প্রমিতের ইমানদারই হয়ে উঠলেন না, জটিলতা আর দুর্বোধ্যতাকেও ব্যাপকভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বিখ্যাত কণ্ঠস্বর-গোষ্ঠীর গদ্যচর্চায় তার প্রায় সর্বব্যাপী পরিচয় মেলে। বুদ্ধদেব বসু নয়, সুধীন্দ্রনাথ দত্তই হয়ে উঠেছিলেন ওই গদ্য-লিখিয়েদের পরম আশ্রয়। সাহিত্যিক অর্থে বেশ বর্ণাঢ্য এ গদ্যচর্চার স্মারক হয়ে আছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত সাম্প্রতিক ধারার প্রবন্ধ গ্রন্থটি।
ষাটের দশকের এ সংস্কৃতায়ন-প্রবণতাই প্রবল বিক্রমে বাংলাদেশের সাহিত্যিক ভাষায় ফিরে এলো আশির দশকে। এ সময়ের সাহিত্যকর্মে কলকাতার কবিতা ও কথাসাহিত্যের প্রবল প্রভাব দেখা যায়। জনবোধ্য ভাষার বিপরীতে গিয়ে সাহিত্যিক-সমাজের একটা বড় ও প্রভাবশালী অংশ দুর্বোধ্যতার চর্চা করেছেন এ সময়। এর পেছনে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাও প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে হয়। এ বিষয়ে কোনো গবেষণা না হওয়ায় নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। তবে ভাষিক-নন্দনতাত্ত্বিক ঝোঁক এবং সাহিত্যকর্মে তার প্রতিফলন প্রমাণ করে, বাংলাদেশের প্রভাবশালী সাহিত্যিক ভাষায় একটা বড় বদল ঘটেছিল ওই দশকে। নব্বইয়ের দশকে ওই ধারা অংশত অব্যাহত ছিল। এর সঙ্গে অধিক হারে মিশেছিল সাহিত্যিক আধুনিকতার কতগুলো ধারণা, যেমন বিমূর্ততা, নাস্তি, ফর্মের দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রাধান্য, অচলিত শব্দ ব্যবহারের ঝোঁক ইত্যাদি।
তবে নব্বইয়ের দশকেই ঢাকার সাহিত্যকর্মে আরও অন্তত দুটি প্রবণতা প্রবলভাবে দেখা দিয়েছিল। একটিকে বলতে পারি এক ধরনের উত্তরাধুনিক চর্চা। পশ্চিমা উত্তরাধুনিকতার বিপরীতে গিয়ে, আসলে বলা উচিত আধুনিকতাবাদের বিপরীতে গিয়ে, বেশসংখ্যক সাহিত্যিক এ সময় এক ধরনের স্থানীয় ‘উত্তরাধুনিকতা’র চর্চা করেছিলেন। সাহিত্যকর্মে স্থানীয় নানা উপাদান ও ভাবকে রূপায়িত করাই ছিল এর মূল লক্ষণ। স্বভাবতই ‘প্রমিত বাংলা’র আওতায় ইতিপূর্বে বাদ পড়া বহু উপাদান এ সময় সাহিত্যচর্চায় গুরুত্বের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়েছিল। ওই নব্বইয়ের দশকেই আরেকটি প্রবণতা প্রবলভাবে আমাদের সামগ্রিক চর্চায় শুরু হয়েছিল। একে বলতে পারি, ভাষা ও ভাবের অপ্রমিতায়ন। যাকে প্রমিত ভাষা বলা যায়, তার সঙ্গে স্বভাবতই নানা প্রমিত ভাবও যুক্ত। এ ভাষা ও ভাব জনগোষ্ঠীর যাপনগত বহুরৈখিক বাস্তবতাকে একরৈখিক আদবে সীমিত করতে চায়। আর চায় বিপুল ভাষা ও ভাবকে অপরায়ণ করতে। নব্বইয়ের দশকেই প্রথমবারের মতো শক্তিশালী কোনো কোনো সাহিত্যিকের ভাব-ভাষায় এ দৃষ্টিভঙ্গিকে কেবল আঘাতই করা হয়নি, ব্যঙ্গপ্রবণ তির্যক ভাব-ভাষার আঘাতে পর্যুদস্তও করা হয়েছে। বাংলাদেশের পরবর্তী সাহিত্যিক যাত্রায় এ ধারার প্রবল প্রতিষ্ঠা ঘটেছে।
এখানে মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি, ওপরে খুব সংক্ষিপ্ত ও মন্তব্যধর্মী কেতায় সাহিত্যিক ভাষার যে বর্ণনা আমরা দিলাম, তা মোটেই পুরো সাহিত্য-ভাষার খতিয়ান নয়। বরং একটা বিশেষ সময়ে যেসব প্রবণতাকে নতুন, প্রধান ও প্রভাবশালী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, তার কয়েকটিই এখানে উল্লিখিত হয়েছে। এর বাইরে চর্চার বিপুল অংশ যেমন রয়ে গেছে, ঠিক তেমনি একটা নির্দিষ্ট সময়ে বিচিত্র ধরনের চর্চাও চোখে পড়ে। যেমন : আশির দশকে কলকাতার সাহিত্যিক ভাষা ও সংস্কৃতায়িত সাহিত্যিক ভাষার পাশাপাশি বহু সাহিত্যিক পাওয়া যাবে, যাদের সাহিত্যিক ভাষাকে এসব ডাকনামে চেনা সম্ভব নয়। ঠিক তেমনি নব্বইয়ের দশকে এক সার্বিক ‘অপ্রমিতায়ন’ প্রবণতা হিসেবে আমরা সাহিত্যভাষার যেসব প্রবণতাকে চিহ্নিত করেছি, তার বাইরে যথারীতি ‘আধুনিকতাবাদী’ কিংবা ‘প্রমিত’ নামে চেনা যায়, এমন বিপুল সাহিত্যকর্মও রচিত হয়েছে। তবে সাহিত্যধারায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে ধরনের চর্চা ও ভাষা, তা অন্যরকম গুরুত্বের দাবিদার। যেমন : নব্বইয়ের দশকে শুরু হওয়া ‘অপ্রমিতায়ন’ একুশ শতকের বাংলাদেশের সাহিত্যিক ভাষায় বিশেষভাবে গুরুতর হয়ে ওঠায় এ চর্চাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই।
একুশ শতকের দুই দশকে বাংলাদেশের সাহিত্যভাষার প্রধান প্রবণতাকে বলতে পারি প্রমিতসহ নন্দনতাত্ত্বিক নানা বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার সৃষ্টিশীল সাধনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন প্রকাশনার ব্যাপকতা এ চর্চায় বিরাট আনুকূল্য জুগিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভাষার পুলিশির মতো বিষয়গত ও ভাবনাগত পুলিশিও অনলাইন মাধ্যমগুলোতে এক প্রকার অসম্ভব হয়ে উঠেছে। কাজেই জীবন-বাস্তবতাই আমাদের ভাবতে উৎসাহিত করছে, ভাষা ও ভাবের সংকীর্ণ ‘প্রমিত’ বেড়াজাল আরও প্রসারিত করাই কর্তব্য। বাংলাদেশের সৃষ্টিশীল ও মননশীল সাহিত্যিক ভাষায় এ বোধের সফল উৎসারণ এখন প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে। আগের দশকগুলোর চর্চায় কোনো বিতৃষ্ণা না দেখিয়েই নিশ্চিন্তে বলা যায়, বাংলাদেশের সাহিত্যিক ভাষার বিকাশ ও মুক্তির জন্য এ অবস্থা অনেক বেশি অনুকূল।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের উপাদান ও আবেগের বিষয় হিসেবে দেখার প্রবণতা আমাদের মধ্যে অতি প্রবল। জাতীয় ইতিহাসের কোনো একটি ক্ষণকে সমকালীন তাৎপর্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা একটা বিরাট সীমাবদ্ধতা। মনে রাখা দরকার, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে যেমন সামগ্রিক জীবনযাপনগত বাস্তবতার প্রকাশ ঘটেছিল, ঠিক তেমনি সত্তর বছর পরে ওই ঘটনার কোনো প্রকৃত তাৎপর্য যদি থেকেই থাকে, তবে তা থাকবে বর্তমান জীবনযাপনের সামগ্রিকতায় তাকে অনুবাদের সাফল্যের মধ্যে। আমাদের বর্তমান আলোচনার প্রসঙ্গে বলা যায়, গত দু-তিন দশকে বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যিক ভাষার মুক্তির সম্ভাবনা শুধু তখনি ফলপ্রসূ হবে, যখন জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক জীবনযাপনের সঙ্গে তাকে নানামাত্রায় সম্পর্কিত করে বিচার করা যাবে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ভাষার ব্যবহার ও প্রকাশকে ওই বড় আঙ্গিকে ও পরিসরে দেখা শুধু সম্ভবই নয়, জরুরিও বটে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়