কৃষির বদল, ভাষার বদল
পাভেল পার্থ | ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
কৃষিসভ্যতা গড়ে ওঠার আগে বাংলাদেশ ভূগোলের মানুষের ভাষা কেমন ছিল তা আমরা ততটা জানি না। তবে কৃষিকাজসহ উৎপাদনের মৌলরীতি ও কারিগরিগুলো আমাদের ভাষিক ময়দানকে বিকশিত করেছে। বরেন্দ্রভূমির প্রাচীন রামাবতী নগরীর কৈবর্তদের ভাষা আর তজিংডং পাহাড়ের জুমচাষি ম্রোদের ভাষা এক ছিল না। জেলে, কুমার, কামার, তাঁতি কিংবা কৃষক সমাজে প্রচলিত মৌখিক ভাষার শব্দভান্ডও একই রকম নয়।
সমতলের কৃষি কী পাহাড়ের জুম আবাদ মাতৃভাষার রূপ ও রূপান্তরে প্রতিনিয়ত ভূমিকা রাখে। এই ভূমিকা বা সম্পর্ক বেশ জটিল এবং বহুপক্ষীয়। দেখা যায়, কৃষি বা জুমের বদল কী পরিবর্তনে বদলে যায় মানুষের ব্যবহারের ভাষা। হারিয়ে যায় অনেক শব্দভান্ড, পরিবর্তিত হয় ভাষার রূপকল্প ও ব্যঞ্জনা। নদী যেমন তার বাঁকে বাঁকে মানুষের মুখের ভাষার বাঁক ও ভঙ্গি বদলে দেয়, তেমনি প্রতিটি বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে মিশে থাকে মাতৃভাষার বহুমাত্রিক সম্পর্ক। পাখি, পতঙ্গ, সরীসৃপ, বৃক্ষগুল্ম কী জন্তু-জানোয়ার সব প্রাণপ্রজাতিই মানুষের মাতৃভাষাকে বিকশিত করে। শব্দভা- সমৃদ্ধ করে। কোনো গ্রামে চল্লিশ রকমের দেশি ধান আবাদের মানে হলো সেই গ্রামের মানুষের শব্দভা-ারে চল্লিশটি ধানের নাম থাকা। কোনো পাহাড়ে পঁচিশ রকমের পাখি আছে মানে সেই পাহাড়বাসীর ভাষায় পঁচিশটি পাখির নাম আছে।
কিন্তু নিদারুণভাবে ভাষা ও প্রাণপ্রজাতির সম্পর্কের এই জটিল ব্যাকরণ বদলে যাচ্ছে। বিশেষ করে কৃষিকাজ ও জুম আবাদের পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে আমাদের মাতৃভাষায়। কৃষির বদল মানে মাতৃভাষার রূপকাঠামো এবং প্রকাশের ব্যঞ্জনাতেও বদল। চলতি আলাপখানি দেশের কৃষিভাষা বদলের ময়দানকে বুঝতে চায়, বিশেষ করে কৃষির বদলের পাশাপাশি কীভাবে আমাদের মাতৃভাষায় এর প্রভাব পড়ছে সেটি আন্দাজ করতে চায়। কৃষি ও মাতৃভাষা উভয়েই এক চলমান জীবন্তসত্তা। প্রকৃতি ও সংস্কৃতির পারস্পরিক মেলবন্ধনের ভেতর দিয়েই উভয়ের বিকশিত হওয়ার বিজ্ঞান জীবন্ত থাকে। কিন্তু যদি এদের কাউকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, ওপর থেকে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয় বা দখল কী লুণ্ঠন করা হয় তবে কৃষিজগৎও বদলায় এবং সেই কৃষিজগতের মানুষের মাতৃভাষার গড়নও পাল্টে যেতে বাধ্য হয়।
মূলত মানুষ ও গবাদি প্রাণীর খাদ্য জোগানের মূল কারিগর কৃষি ও জুম। আর কৃষির ভিত্তি হলো বীজ। আজ দেশে মানুষ ‘না খেয়ে’ নেই সত্য, কিন্তু কৃষির নিয়ন্ত্রণ আজ মানুষের নাগালে নেই। চারধারে বাণিজ্যিকীকরণ আর বিরাষ্ট্রীয়করণের বাহাদুরি। ফলছে ফসল, থালায় আসছে খাবার। কিন্তু কৃষির এই চেহারাটি এক বিশৃঙ্খল চুরমার দৃশ্যমাত্র। এর পেছনে চাপা পড়ে আছে গ্রামের পর গ্রাম বীজ হারানোর এক নির্দয় আখ্যান। ষাটের দশকের তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে দেশীয় কৃষি ভুবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি আসে। সিনথেটিক সার, বিষ, উফশী বীজ আর যন্ত্রের সেচের মাধ্যমে চিরচেনা কৃষি হয়ে ওঠে অচিন। সহস্র বছরের কৃষি ভুবনের দখল ও নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মনস্যান্টো, সিনজেনটা, বায়ার, বিএসএসফ, ডুপন্ট, কারগিলের মতো বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। পরে আসে হাইব্রিড বীজ। প্যাকেটের গায়ে লেখা হয় ‘এই বীজ পরবর্তী বছর বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না’। ধাক্কা লাগে গ্রামীণ নারীর বীজ-মনস্তত্বে। শূন্য হতে থাকে বীজভান্ড। বিটি বেগুনের মাধ্যমে জেনেটিক ফসলের অনুমোদন দানের মাধ্যমে দেশ প্রবেশ করে আরেক ‘জিন বিপ্লবের’ যুগে। কৃষির এই বদল কীভাবে কৃষিজাতের মানুষের ভাষিক ময়দানের বদল ঘটিয়েছে, ঘটাচ্ছে তাই আন্দাজ করছে চলতি আলাপ। আজ মাতৃভাষার সুরক্ষায় আমাদের আপন ভুবনের কৃষিজগৎকেও সুরক্ষিত রাখা জরুরি। কৃষক সমাজের কাস্তে-লাঙল-বীজভান্ডে বিকশিত কৃষিই জীবন্ত রাখবে কৃষিজাতের মাতৃভাষার ভুবন।
উধাও ধান! উধাও শব্দভান্ড!
বাংলাদেশ গভীর পানির ধানের আঁতুড়ঘর। জানা যায়, এককালে এ অঞ্চলে বিশ হাজার জাতের ধান ছিল। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI), যা সংক্ষেপে ‘ব্রি’ নামে পরিচিত, বারো হাজারের অধিক ধানের নাম দিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছিল। ব্রি’র হিসাবে এখন সংরক্ষিত আছে প্রায় আট হাজার ধানের জাত। কিন্তু আমরা সেসবের কতটা জানি? নাটোরের নলডাঙ্গার হইলদাকলসী গ্রামে জন্ম মর্জিনা বেওয়ার। বিয়ে হয় নওগাঁর আত্রাইয়ের বিপ্রবোয়ালিয়াতে। নদীভাঙনে সব হারিয়ে বর্তমানে রাজশাহী রেলের খাসজমিতে বস্তির ঝুপড়ি ঘরে বাস করেন। মেয়ে তানজিরা সারা দিন ভাঙারি কুড়ায়। মর্জিনা বেওয়া শৈশবের কয়েকটি ধানের নাম স্মরণ করতে পারলেন। তার একটি মাইটাগরল। জানালেন, ধানটির রং ভেজা কালো মাটির মতো, খুব ভালো মুড়ি হতো সেই ধানে। কথা বলে জানতে পারি, মর্জিনা দেশি ও উফশী মিলিয়ে দশটি ধানের নাম জানেন। কিন্তু তানজিরা শুধু দুটি ধানের নাম বলতে পারলেন, আটাশ আর উনত্রিশ। বোঝা যায়, ধান বিষয়ে তানজিরার শব্দভান্ড কম। হয়তো বস্তিতে বড় হয়ে ওঠা তার শিশু তানজিদ ভবিষ্যতে কোনো ধানের নামই জানবে না।
মধ্যযুগের কবি রামাইপন্ডিত রচিত ‘শূন্যপুরাণ’ গ্রন্থর ‘অথ চাষ’ অংশে বহু ধানের নাম উল্লেখ আছে। মুক্তাহার, জেঠ, দুগগাভোগ, তুলন, বুড়ামাত্তা, লতামৌ, মৌকলস, খেজুরছড়ি, তিলসাগরী, পর্বতজিরা, গন্ধতুলসী, দলাগুড়ি, বাঁশগজা, উড়াসালী, কুসুমমালী, সীতামালী, রক্তসাল, চন্দনসাল, রাজদল, কালাকাত্তিক, মেগি, খীরকম্বা, কামদ, দুদুরাজ, পিপিড়া, মাধবলতা, বাগনবিচি, কোঙরভোগ, কনকচুর, লালকামিনি, সোলপনা, আন্ধারকুলি, গোপালভোগ, বাসমতী, গন্ধমালতী, ঝিঙ্গাসাল, বাঁকসাল, বাঁকচুর, বাঁসকাটা এ রকম বহু দেশি ধানের নাম আছে শূন্যপুরাণে।
কবি মালিক মুহম্মদ জায়সী পদ্মাবতী-রত্নসেন-আলাউদ্দীন খলজীর কাহিনী নিয়ে ১৫৪০ সালে রচনা করেছিলেন ‘পদ্মাবৎ’, পরে মধ্যযুগের কবি আলাওল লেখেন ‘পদ্মাবতী’। পদ্মাবতী কাব্য রাজভোগ, কাজররানী, ঝিনোয়া, রুদোয়া, দাদখানি, বাসমতী, রতনরী, মধুকর, ঢেলা, ঝিনাসারি ও কজরী ধানের নাম আছে। মঙ্গলকাব্য কী ময়মনসিংহ গীতিকায় যেসব ধানের নাম পাওয়া যায়, এরই মধ্যে গ্রামীণ কৃষি ভুবন থেকে সেসব জাত উধাও হয়েছে। উধাও হয়েছে ভাষিক জগতেও।
১৯৫০ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুরের শালবনে জুম আবাদ নিষিদ্ধ করে বনবিভাগ। স্থানীয় মান্দিদের আচিক ভাষায় জুম মানে হাবাহুয়া। একসময় শালবনের গ্রামে ছিল বহু মি. মান্দি (জুম ধান)। যেমন : সারেংমারংথাম্বেন আর দেমব্রা জাগেদং। নতুন প্রজন্মের আচিক ভাষার শব্দভা-ে এসব শব্দ এখন অপরিচিত। কৃষির উন্নয়নের নামে আমরা যত দেশি ধান হারিয়েছি, তত হারিয়েছি শব্দ ও ভাষার রূপব্যঞ্জনা।
‘আগাছা’ নয়, শাক
মানিকরামের ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে দেশি শস্যফসল ও কুড়িয়ে পাওয়া শাকের বহুবিধ রান্নার উল্লেখ আছে। বর্ণিত হয়েছে... ‘শুসুনির শাক এনে সম্বরিবে তৈলে/শেষে দিবে সর্ষপের বাটনা সিদ্ধ হলে’। ধর্মমঙ্গলকাব্যে বর্ণিত এই শুষণি ঔষধিগুণ সম্পন্ন এক উদ্ভিদ। গ্রামীণ উদ্ভিদ শ্রেণীকরণের ভাগ অনুযায়ী যখনই ‘শাক’ বলা হয়, তখন সেটি মানুষের খাদ্য উপযোগী উদ্ভিদ বোঝায়। শুষণি তেমনি এক কুড়িয়ে পাওয়া শাক। যেমন : বথুয়া, হেলেঞ্চা, থানকুনি, তেলাকুডা, গিমা, ঘৃতকাঞ্চন, কলমি, মালঞ্চ, ঘুম ও সেচি। একটা সময় ধানসহ কিছু ফসলের জমিনে ‘নিড়ানি’ হতো। দেশে নানাস্থানে প্রচলিত ছিল ‘ক্ষেত নিড়ানির গান’। সেখানে মানুষ ও গবাদি প্রাণীদের জন্য প্রয়োজনীয় শাকলতা তুলে নেওয়া হতো। বর্তমানে সেই চল নেই। এখন জমিতে রাসায়নিক বিষের প্রয়োগে বাণিজ্যিক ফসলটি বাদে আর সবকিছু মেরে ফেলা হয়। এই বিষকে বলা হয় ‘আগাছানাশক’। গ্রামের মানুষ বলছে ‘ঘাসমারা’ ওষুধ। যেমন বাংলাদেশে সিনজেনটার রিফিট, মনস্যান্টোর রাউন্ডআপ এ রকমের বিষগুলো বেশি বিক্রি হয়। এসব কোম্পানি বিষের বোতল ও প্যাকেটের লেবেলে শুষণিসহ সব শাকলতা ও ভেষজকে ‘আগাছা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। নতুন প্রজন্মের গ্রামীণ কৃষকের ভাষিক ময়দানে এখন শুষণি ‘শাক’ নয়, ‘আগাছা’। এমনকি গ্রামের কৃষক আজ নিজেদের চিরচেনা খাদ্য ও ঔষধি উদ্ভিদকে ‘ঘাস’ বলতে বাধ্য হয়েছে। এভাবেই এক ‘আগাছানাশকের’ ব্যবহার ও প্রচলনের ভেতর বদল ঘটছে কৃষকের মুখের ভাষা ও শব্দের ব্যবহার।
দাওয়াল, কামলা, কৃষিশ্রমিক
দেশের ছয় ভাগের একভাগ হাওর অঞ্চল। আর এই হাওরে ঐতিহাসিকভাবেই বোরো মৌসুমে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসেন ধান শ্রমিকরা। তারা এক একটি দলে এক একটি গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে বা ধানের খলায় থাকে। ‘কর্মাদি’ নামক এক আনুষ্ঠানিক কৃত্যের মাধ্যমে তাদের বিদায় জানানো হয়। শুধু হাওর নয়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলেও এভাবে ধান কাটার শ্রমিকদের যাতায়াতের ঐতিহাসিকতা আছে। একসময় এই ধান কাটা শ্রমিকরা ‘দাওয়াল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হাওরে কোথাও তারা ভাগালু নামেও পরিচিত ছিলেন। কিন্তু দিনে দিনে এমন পরিচয় পাল্টে যাচ্ছে, এখন তারা ‘কামলা’ বা ‘কৃষিশ্রমিক’ হিসেবেই গণ্য হচ্ছেন। কবি বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মাপুরাণেও’ আছে, ...সোনার কাঁচি দিয়া দাওয়ালে ধান দায়ে/হীরামন মাণিক্য তারা রৌদ্রতে শুখায়ে’। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু দাওয়ালদের নিয়ে লিখেছেন, ‘...ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার লোক খুলনা বরিশালে ধান কাটবার মরশুমে দল বেঁধে দিনমজুর হিসাবে যেত। এরা ধান কেটে ঘরে উঠিয়ে দেয়। এদের ‘দাওয়াল’ বলা হতো। এমনিভাবে কুমিল্লা জেলার দাওয়ালেরা সিলেট জেলায় যেত।’ বর্তমানে বোরো মৌসুমে ধান কাটার আগে গণমাধ্যম আর ‘দাওয়াল’ ব্যবহার করছে না, লিখছে ‘শ্রমিক সংকট’। এভাগেই পইরেত, ভাগচাষি, কিষান, পাইট এই পরিচয়গুলোও বদলে গেছে। নতুন প্রজন্মের কৃষি পরিবারেও দাওয়াল, পাইট, কিষান, পইরেত শব্দগুলোর প্রচলন কমে যাচ্ছে। এভাবে কৃষির বদলে ঘটে চলেছে কৃষি ভাষার বদল।
লোকায়ত কৃষি পরিভাষা
বরেন্দ্র অঞ্চলে মাটির উপযুক্ত আর্দ্রতাকে বলে ‘বাতাল’। মাটির গন্ধ, কোপ দিয়ে এক খ- মাটি হাতের তালুতে নিয়ে অভিজ্ঞ কৃষক বুঝতে পারেন মাটির বাতাল কতখানি। মাটিতে কতটুকু রস ও আর্দ্রতা আছে। উপকূলের কৃষিসমাজে মাটির এই উপযুক্ত আর্দ্রতাকে বলে ‘জো’। বাতাল বা জো মাটির এক প্রাকৃতিক নির্দেশনা, এটি জানান দেয় বীজ বোনার সময়কাল। নতুন প্রজন্মের কৃষকরা আজ এমনতর লোকায়ত কৃষিচর্চা ও কারিগরি থেকে ক্রমেই দূরে সরে আসছেন। যেমন : খনার বচনের বিশ্লেষণ ও বচনগুলো তরুণ কৃষকদের কাছে খুব পরিচিত নয়। মেঘের রং বা বাতাসের ধরন দেখে কৃষিকাজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা বর্তমানের তরুণ কৃষকদের খুব একটা নেই। লোকায়ত কৃষিচর্চাকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র এবং শস্যবৈচিত্র্যের প্রতি মায়াময় সম্পর্ক তৈরি না হয়ে বাড়ছে দূরত্ব। কৃষিকাজ হয়ে পড়ছে কিছু জায়গা ব্যবহার করে বাণিজ্যিক কিছু ফসল উৎপাদনের মাধ্যম। হারিয়ে যাচ্ছে বহু গ্রামীণ কৃষি পরিভাষা, কৃষিজ শব্দভা-। বিস্তীর্ণ হাওর জমিনে কিছুটা উঁচু আইলের মতো স্থানে যেখানে
কৃষক বিশ্রাম নেয়, খাবার খায় তাকে বলা হতো ‘জাঙ্গাল’। এসব জাঙ্গাল একই সঙ্গে বনতুলসী, বনগোলাপ, বিন্যাছুবা, মনকাঁটার মতো বিরল উদ্ভিদের বাসস্থান। আজ হাওরে ‘জাঙ্গাল’ নেই, হাওরের কৃষি পরিভাষাতেও এর মানে বদলাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে জমিনে যাওয়ার আগে বাড়িতে বা কিছুটা কাজ করার পর সকালে ‘লাহারি’ খাওয়ার চল ছিল, সকালের খাবার আজ বরেন্দ্র কৃষিসমাজে ‘সকালের নাস্তা’ হিসেবে পরিচিত।
‘হাল’ ধরবে কে?
লাঙল, জোয়াল, মই, হাল, টুকরি, পাখাল, জাখা, ডোল, মটকা, মিজাম, ছেনি, আঙরা কৃষিজীবনে বহুল ব্যবহৃত এসব আদি উপকরণ ও আমাদের ভাষার এমন আদি শব্দগুলো আজ বিপন্ন তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। নগরায়ণ গিলছে গ্রাম, প্রতিদিন নিশ্চিহ্ন হচ্ছে কৃষিজমি। ‘কৃষিজমির’ ওপর বসছে সাইনবোর্ড। সেই সাইনবোর্ডে লেখা হচ্ছে, ‘এই জায়গা বিক্রি হবে’। হাজার বছরের ‘কৃষিজমি’ আজ এই করপোরেট দুনিয়ায় হয়ে যাচ্ছে ‘জায়গা’। কৃষিপ্রধান দেশের নাগিরক হিসেবে আমাদের কোনো রা নেই। বিস্ময়করভাবে নতুন প্রজন্ম আবার মঞ্চ কাঁপিয়ে গাইছে, ...পরের জায়গা, পরের জমি, ঘর বানাইয়া আমি রই। জায়গা ও জমির ভিন্ন রূপকল্প ও দ্যোতনা কী মনে কোনো দাগ কাটছে না? কৃষি, লোকায়ত কৃষি পরিভাষা ও মাতৃভাষার সুরক্ষায় আসুন মনের ভেতর আমাদের দাগ কাটতে শুরু করি।
লেখক : গবেষক ও লেখক
শেয়ার করুন
পাভেল পার্থ | ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

কৃষিসভ্যতা গড়ে ওঠার আগে বাংলাদেশ ভূগোলের মানুষের ভাষা কেমন ছিল তা আমরা ততটা জানি না। তবে কৃষিকাজসহ উৎপাদনের মৌলরীতি ও কারিগরিগুলো আমাদের ভাষিক ময়দানকে বিকশিত করেছে। বরেন্দ্রভূমির প্রাচীন রামাবতী নগরীর কৈবর্তদের ভাষা আর তজিংডং পাহাড়ের জুমচাষি ম্রোদের ভাষা এক ছিল না। জেলে, কুমার, কামার, তাঁতি কিংবা কৃষক সমাজে প্রচলিত মৌখিক ভাষার শব্দভান্ডও একই রকম নয়।
সমতলের কৃষি কী পাহাড়ের জুম আবাদ মাতৃভাষার রূপ ও রূপান্তরে প্রতিনিয়ত ভূমিকা রাখে। এই ভূমিকা বা সম্পর্ক বেশ জটিল এবং বহুপক্ষীয়। দেখা যায়, কৃষি বা জুমের বদল কী পরিবর্তনে বদলে যায় মানুষের ব্যবহারের ভাষা। হারিয়ে যায় অনেক শব্দভান্ড, পরিবর্তিত হয় ভাষার রূপকল্প ও ব্যঞ্জনা। নদী যেমন তার বাঁকে বাঁকে মানুষের মুখের ভাষার বাঁক ও ভঙ্গি বদলে দেয়, তেমনি প্রতিটি বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে মিশে থাকে মাতৃভাষার বহুমাত্রিক সম্পর্ক। পাখি, পতঙ্গ, সরীসৃপ, বৃক্ষগুল্ম কী জন্তু-জানোয়ার সব প্রাণপ্রজাতিই মানুষের মাতৃভাষাকে বিকশিত করে। শব্দভা- সমৃদ্ধ করে। কোনো গ্রামে চল্লিশ রকমের দেশি ধান আবাদের মানে হলো সেই গ্রামের মানুষের শব্দভা-ারে চল্লিশটি ধানের নাম থাকা। কোনো পাহাড়ে পঁচিশ রকমের পাখি আছে মানে সেই পাহাড়বাসীর ভাষায় পঁচিশটি পাখির নাম আছে।
কিন্তু নিদারুণভাবে ভাষা ও প্রাণপ্রজাতির সম্পর্কের এই জটিল ব্যাকরণ বদলে যাচ্ছে। বিশেষ করে কৃষিকাজ ও জুম আবাদের পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে আমাদের মাতৃভাষায়। কৃষির বদল মানে মাতৃভাষার রূপকাঠামো এবং প্রকাশের ব্যঞ্জনাতেও বদল। চলতি আলাপখানি দেশের কৃষিভাষা বদলের ময়দানকে বুঝতে চায়, বিশেষ করে কৃষির বদলের পাশাপাশি কীভাবে আমাদের মাতৃভাষায় এর প্রভাব পড়ছে সেটি আন্দাজ করতে চায়। কৃষি ও মাতৃভাষা উভয়েই এক চলমান জীবন্তসত্তা। প্রকৃতি ও সংস্কৃতির পারস্পরিক মেলবন্ধনের ভেতর দিয়েই উভয়ের বিকশিত হওয়ার বিজ্ঞান জীবন্ত থাকে। কিন্তু যদি এদের কাউকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, ওপর থেকে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয় বা দখল কী লুণ্ঠন করা হয় তবে কৃষিজগৎও বদলায় এবং সেই কৃষিজগতের মানুষের মাতৃভাষার গড়নও পাল্টে যেতে বাধ্য হয়।
মূলত মানুষ ও গবাদি প্রাণীর খাদ্য জোগানের মূল কারিগর কৃষি ও জুম। আর কৃষির ভিত্তি হলো বীজ। আজ দেশে মানুষ ‘না খেয়ে’ নেই সত্য, কিন্তু কৃষির নিয়ন্ত্রণ আজ মানুষের নাগালে নেই। চারধারে বাণিজ্যিকীকরণ আর বিরাষ্ট্রীয়করণের বাহাদুরি। ফলছে ফসল, থালায় আসছে খাবার। কিন্তু কৃষির এই চেহারাটি এক বিশৃঙ্খল চুরমার দৃশ্যমাত্র। এর পেছনে চাপা পড়ে আছে গ্রামের পর গ্রাম বীজ হারানোর এক নির্দয় আখ্যান। ষাটের দশকের তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে দেশীয় কৃষি ভুবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি আসে। সিনথেটিক সার, বিষ, উফশী বীজ আর যন্ত্রের সেচের মাধ্যমে চিরচেনা কৃষি হয়ে ওঠে অচিন। সহস্র বছরের কৃষি ভুবনের দখল ও নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মনস্যান্টো, সিনজেনটা, বায়ার, বিএসএসফ, ডুপন্ট, কারগিলের মতো বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। পরে আসে হাইব্রিড বীজ। প্যাকেটের গায়ে লেখা হয় ‘এই বীজ পরবর্তী বছর বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না’। ধাক্কা লাগে গ্রামীণ নারীর বীজ-মনস্তত্বে। শূন্য হতে থাকে বীজভান্ড। বিটি বেগুনের মাধ্যমে জেনেটিক ফসলের অনুমোদন দানের মাধ্যমে দেশ প্রবেশ করে আরেক ‘জিন বিপ্লবের’ যুগে। কৃষির এই বদল কীভাবে কৃষিজাতের মানুষের ভাষিক ময়দানের বদল ঘটিয়েছে, ঘটাচ্ছে তাই আন্দাজ করছে চলতি আলাপ। আজ মাতৃভাষার সুরক্ষায় আমাদের আপন ভুবনের কৃষিজগৎকেও সুরক্ষিত রাখা জরুরি। কৃষক সমাজের কাস্তে-লাঙল-বীজভান্ডে বিকশিত কৃষিই জীবন্ত রাখবে কৃষিজাতের মাতৃভাষার ভুবন।
উধাও ধান! উধাও শব্দভান্ড!
বাংলাদেশ গভীর পানির ধানের আঁতুড়ঘর। জানা যায়, এককালে এ অঞ্চলে বিশ হাজার জাতের ধান ছিল। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI), যা সংক্ষেপে ‘ব্রি’ নামে পরিচিত, বারো হাজারের অধিক ধানের নাম দিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছিল। ব্রি’র হিসাবে এখন সংরক্ষিত আছে প্রায় আট হাজার ধানের জাত। কিন্তু আমরা সেসবের কতটা জানি? নাটোরের নলডাঙ্গার হইলদাকলসী গ্রামে জন্ম মর্জিনা বেওয়ার। বিয়ে হয় নওগাঁর আত্রাইয়ের বিপ্রবোয়ালিয়াতে। নদীভাঙনে সব হারিয়ে বর্তমানে রাজশাহী রেলের খাসজমিতে বস্তির ঝুপড়ি ঘরে বাস করেন। মেয়ে তানজিরা সারা দিন ভাঙারি কুড়ায়। মর্জিনা বেওয়া শৈশবের কয়েকটি ধানের নাম স্মরণ করতে পারলেন। তার একটি মাইটাগরল। জানালেন, ধানটির রং ভেজা কালো মাটির মতো, খুব ভালো মুড়ি হতো সেই ধানে। কথা বলে জানতে পারি, মর্জিনা দেশি ও উফশী মিলিয়ে দশটি ধানের নাম জানেন। কিন্তু তানজিরা শুধু দুটি ধানের নাম বলতে পারলেন, আটাশ আর উনত্রিশ। বোঝা যায়, ধান বিষয়ে তানজিরার শব্দভান্ড কম। হয়তো বস্তিতে বড় হয়ে ওঠা তার শিশু তানজিদ ভবিষ্যতে কোনো ধানের নামই জানবে না।
মধ্যযুগের কবি রামাইপন্ডিত রচিত ‘শূন্যপুরাণ’ গ্রন্থর ‘অথ চাষ’ অংশে বহু ধানের নাম উল্লেখ আছে। মুক্তাহার, জেঠ, দুগগাভোগ, তুলন, বুড়ামাত্তা, লতামৌ, মৌকলস, খেজুরছড়ি, তিলসাগরী, পর্বতজিরা, গন্ধতুলসী, দলাগুড়ি, বাঁশগজা, উড়াসালী, কুসুমমালী, সীতামালী, রক্তসাল, চন্দনসাল, রাজদল, কালাকাত্তিক, মেগি, খীরকম্বা, কামদ, দুদুরাজ, পিপিড়া, মাধবলতা, বাগনবিচি, কোঙরভোগ, কনকচুর, লালকামিনি, সোলপনা, আন্ধারকুলি, গোপালভোগ, বাসমতী, গন্ধমালতী, ঝিঙ্গাসাল, বাঁকসাল, বাঁকচুর, বাঁসকাটা এ রকম বহু দেশি ধানের নাম আছে শূন্যপুরাণে।
কবি মালিক মুহম্মদ জায়সী পদ্মাবতী-রত্নসেন-আলাউদ্দীন খলজীর কাহিনী নিয়ে ১৫৪০ সালে রচনা করেছিলেন ‘পদ্মাবৎ’, পরে মধ্যযুগের কবি আলাওল লেখেন ‘পদ্মাবতী’। পদ্মাবতী কাব্য রাজভোগ, কাজররানী, ঝিনোয়া, রুদোয়া, দাদখানি, বাসমতী, রতনরী, মধুকর, ঢেলা, ঝিনাসারি ও কজরী ধানের নাম আছে। মঙ্গলকাব্য কী ময়মনসিংহ গীতিকায় যেসব ধানের নাম পাওয়া যায়, এরই মধ্যে গ্রামীণ কৃষি ভুবন থেকে সেসব জাত উধাও হয়েছে। উধাও হয়েছে ভাষিক জগতেও।
১৯৫০ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুরের শালবনে জুম আবাদ নিষিদ্ধ করে বনবিভাগ। স্থানীয় মান্দিদের আচিক ভাষায় জুম মানে হাবাহুয়া। একসময় শালবনের গ্রামে ছিল বহু মি. মান্দি (জুম ধান)। যেমন : সারেংমারংথাম্বেন আর দেমব্রা জাগেদং। নতুন প্রজন্মের আচিক ভাষার শব্দভা-ে এসব শব্দ এখন অপরিচিত। কৃষির উন্নয়নের নামে আমরা যত দেশি ধান হারিয়েছি, তত হারিয়েছি শব্দ ও ভাষার রূপব্যঞ্জনা।
‘আগাছা’ নয়, শাক
মানিকরামের ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে দেশি শস্যফসল ও কুড়িয়ে পাওয়া শাকের বহুবিধ রান্নার উল্লেখ আছে। বর্ণিত হয়েছে... ‘শুসুনির শাক এনে সম্বরিবে তৈলে/শেষে দিবে সর্ষপের বাটনা সিদ্ধ হলে’। ধর্মমঙ্গলকাব্যে বর্ণিত এই শুষণি ঔষধিগুণ সম্পন্ন এক উদ্ভিদ। গ্রামীণ উদ্ভিদ শ্রেণীকরণের ভাগ অনুযায়ী যখনই ‘শাক’ বলা হয়, তখন সেটি মানুষের খাদ্য উপযোগী উদ্ভিদ বোঝায়। শুষণি তেমনি এক কুড়িয়ে পাওয়া শাক। যেমন : বথুয়া, হেলেঞ্চা, থানকুনি, তেলাকুডা, গিমা, ঘৃতকাঞ্চন, কলমি, মালঞ্চ, ঘুম ও সেচি। একটা সময় ধানসহ কিছু ফসলের জমিনে ‘নিড়ানি’ হতো। দেশে নানাস্থানে প্রচলিত ছিল ‘ক্ষেত নিড়ানির গান’। সেখানে মানুষ ও গবাদি প্রাণীদের জন্য প্রয়োজনীয় শাকলতা তুলে নেওয়া হতো। বর্তমানে সেই চল নেই। এখন জমিতে রাসায়নিক বিষের প্রয়োগে বাণিজ্যিক ফসলটি বাদে আর সবকিছু মেরে ফেলা হয়। এই বিষকে বলা হয় ‘আগাছানাশক’। গ্রামের মানুষ বলছে ‘ঘাসমারা’ ওষুধ। যেমন বাংলাদেশে সিনজেনটার রিফিট, মনস্যান্টোর রাউন্ডআপ এ রকমের বিষগুলো বেশি বিক্রি হয়। এসব কোম্পানি বিষের বোতল ও প্যাকেটের লেবেলে শুষণিসহ সব শাকলতা ও ভেষজকে ‘আগাছা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। নতুন প্রজন্মের গ্রামীণ কৃষকের ভাষিক ময়দানে এখন শুষণি ‘শাক’ নয়, ‘আগাছা’। এমনকি গ্রামের কৃষক আজ নিজেদের চিরচেনা খাদ্য ও ঔষধি উদ্ভিদকে ‘ঘাস’ বলতে বাধ্য হয়েছে। এভাবেই এক ‘আগাছানাশকের’ ব্যবহার ও প্রচলনের ভেতর বদল ঘটছে কৃষকের মুখের ভাষা ও শব্দের ব্যবহার।
দাওয়াল, কামলা, কৃষিশ্রমিক
দেশের ছয় ভাগের একভাগ হাওর অঞ্চল। আর এই হাওরে ঐতিহাসিকভাবেই বোরো মৌসুমে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল থেকে আসেন ধান শ্রমিকরা। তারা এক একটি দলে এক একটি গ্রামের গৃহস্থ বাড়িতে বা ধানের খলায় থাকে। ‘কর্মাদি’ নামক এক আনুষ্ঠানিক কৃত্যের মাধ্যমে তাদের বিদায় জানানো হয়। শুধু হাওর নয়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলেও এভাবে ধান কাটার শ্রমিকদের যাতায়াতের ঐতিহাসিকতা আছে। একসময় এই ধান কাটা শ্রমিকরা ‘দাওয়াল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হাওরে কোথাও তারা ভাগালু নামেও পরিচিত ছিলেন। কিন্তু দিনে দিনে এমন পরিচয় পাল্টে যাচ্ছে, এখন তারা ‘কামলা’ বা ‘কৃষিশ্রমিক’ হিসেবেই গণ্য হচ্ছেন। কবি বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মাপুরাণেও’ আছে, ...সোনার কাঁচি দিয়া দাওয়ালে ধান দায়ে/হীরামন মাণিক্য তারা রৌদ্রতে শুখায়ে’। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু দাওয়ালদের নিয়ে লিখেছেন, ‘...ফরিদপুর ও ঢাকা জেলার লোক খুলনা বরিশালে ধান কাটবার মরশুমে দল বেঁধে দিনমজুর হিসাবে যেত। এরা ধান কেটে ঘরে উঠিয়ে দেয়। এদের ‘দাওয়াল’ বলা হতো। এমনিভাবে কুমিল্লা জেলার দাওয়ালেরা সিলেট জেলায় যেত।’ বর্তমানে বোরো মৌসুমে ধান কাটার আগে গণমাধ্যম আর ‘দাওয়াল’ ব্যবহার করছে না, লিখছে ‘শ্রমিক সংকট’। এভাগেই পইরেত, ভাগচাষি, কিষান, পাইট এই পরিচয়গুলোও বদলে গেছে। নতুন প্রজন্মের কৃষি পরিবারেও দাওয়াল, পাইট, কিষান, পইরেত শব্দগুলোর প্রচলন কমে যাচ্ছে। এভাবে কৃষির বদলে ঘটে চলেছে কৃষি ভাষার বদল।
লোকায়ত কৃষি পরিভাষা
বরেন্দ্র অঞ্চলে মাটির উপযুক্ত আর্দ্রতাকে বলে ‘বাতাল’। মাটির গন্ধ, কোপ দিয়ে এক খ- মাটি হাতের তালুতে নিয়ে অভিজ্ঞ কৃষক বুঝতে পারেন মাটির বাতাল কতখানি। মাটিতে কতটুকু রস ও আর্দ্রতা আছে। উপকূলের কৃষিসমাজে মাটির এই উপযুক্ত আর্দ্রতাকে বলে ‘জো’। বাতাল বা জো মাটির এক প্রাকৃতিক নির্দেশনা, এটি জানান দেয় বীজ বোনার সময়কাল। নতুন প্রজন্মের কৃষকরা আজ এমনতর লোকায়ত কৃষিচর্চা ও কারিগরি থেকে ক্রমেই দূরে সরে আসছেন। যেমন : খনার বচনের বিশ্লেষণ ও বচনগুলো তরুণ কৃষকদের কাছে খুব পরিচিত নয়। মেঘের রং বা বাতাসের ধরন দেখে কৃষিকাজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা বর্তমানের তরুণ কৃষকদের খুব একটা নেই। লোকায়ত কৃষিচর্চাকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র এবং শস্যবৈচিত্র্যের প্রতি মায়াময় সম্পর্ক তৈরি না হয়ে বাড়ছে দূরত্ব। কৃষিকাজ হয়ে পড়ছে কিছু জায়গা ব্যবহার করে বাণিজ্যিক কিছু ফসল উৎপাদনের মাধ্যম। হারিয়ে যাচ্ছে বহু গ্রামীণ কৃষি পরিভাষা, কৃষিজ শব্দভা-। বিস্তীর্ণ হাওর জমিনে কিছুটা উঁচু আইলের মতো স্থানে যেখানে
কৃষক বিশ্রাম নেয়, খাবার খায় তাকে বলা হতো ‘জাঙ্গাল’। এসব জাঙ্গাল একই সঙ্গে বনতুলসী, বনগোলাপ, বিন্যাছুবা, মনকাঁটার মতো বিরল উদ্ভিদের বাসস্থান। আজ হাওরে ‘জাঙ্গাল’ নেই, হাওরের কৃষি পরিভাষাতেও এর মানে বদলাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে জমিনে যাওয়ার আগে বাড়িতে বা কিছুটা কাজ করার পর সকালে ‘লাহারি’ খাওয়ার চল ছিল, সকালের খাবার আজ বরেন্দ্র কৃষিসমাজে ‘সকালের নাস্তা’ হিসেবে পরিচিত।
‘হাল’ ধরবে কে?
লাঙল, জোয়াল, মই, হাল, টুকরি, পাখাল, জাখা, ডোল, মটকা, মিজাম, ছেনি, আঙরা কৃষিজীবনে বহুল ব্যবহৃত এসব আদি উপকরণ ও আমাদের ভাষার এমন আদি শব্দগুলো আজ বিপন্ন তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। নগরায়ণ গিলছে গ্রাম, প্রতিদিন নিশ্চিহ্ন হচ্ছে কৃষিজমি। ‘কৃষিজমির’ ওপর বসছে সাইনবোর্ড। সেই সাইনবোর্ডে লেখা হচ্ছে, ‘এই জায়গা বিক্রি হবে’। হাজার বছরের ‘কৃষিজমি’ আজ এই করপোরেট দুনিয়ায় হয়ে যাচ্ছে ‘জায়গা’। কৃষিপ্রধান দেশের নাগিরক হিসেবে আমাদের কোনো রা নেই। বিস্ময়করভাবে নতুন প্রজন্ম আবার মঞ্চ কাঁপিয়ে গাইছে, ...পরের জায়গা, পরের জমি, ঘর বানাইয়া আমি রই। জায়গা ও জমির ভিন্ন রূপকল্প ও দ্যোতনা কী মনে কোনো দাগ কাটছে না? কৃষি, লোকায়ত কৃষি পরিভাষা ও মাতৃভাষার সুরক্ষায় আসুন মনের ভেতর আমাদের দাগ কাটতে শুরু করি।
লেখক : গবেষক ও লেখক