বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনাল
মহিউদ্দিন তাহের | ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
“যতদূর বাংলা ভাষা, ততদূর এই বাংলাদেশ, ... পৃথিবীর সর্বপ্রান্ত আমার স্বদেশ...।” কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার এই কাব্যকথন মূর্তিমান হয়ে উঠেছিল আমার কাছে চীনের রাজধানী বেইজিং-এ, ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ তারিখে। সেদিন আমি চীন আন্তর্জাতিক বেতার-এর বাংলা বিভাগে কাজ শুরু করেছিলাম বিদেশি বিশেষজ্ঞ হিসেবে। শুরুতেই চমকিত হয়েছিলাম চীনা সহকর্মীদের মুখে অবিমিশ্র বাংলা শুনে। তখন বিভাগীয় প্রধান ছিলেন মাদাম চুং শাওলি। লি ইউয়ানশান ছিলেন বিভাগের সর্বপ্রবীণ। আরও ছিলেন সর্বজনাব শি চিংউ, পাই খাই ইউয়ান, চৌ চিনছাও, চিয়াং চিংছেং, থান ইয়াওখাং, মাদাম ফোং শিওছিয়েন, মিস শিয়াও লিলিন এবং মিস ইউ কুয়াং য়ুএ (বর্তমানে বাংলা বিভাগের পরিচালক ও চায়না মিডিয়া গ্রুপ-এর বাংলাদেশ ব্যুরো প্রধান; তখন তিনি বাংলা বিভাগে শিক্ষানবিশ)।
তখন টাইপ রাইটারে বাংলা টাইপ করতেন চীনা বন্ধুরা। বেতারের কেন্দ্রীয় সম্পাদনা পর্ষদের অনুমোদিত চীনা ভাষার সংবাদ/প্রতিবেদন তারা বাংলায় অনুবাদ করতেন। আমার কাজ ছিল, চীনাদের বাংলাকে বাঙালির বাংলায় রূপান্তর। সেখানে তখন আমি একমাত্র বাংলাদেশি বাঙালি। বাকিরা পেশাগতভাবে বাংলাভাষী চীনা নাগরিক।
বাঙালিদের মতো তারা ইংরেজি শব্দের মিশেল দিয়ে বাংলা বলেন না। একটা উদাহরণ এরকম: লি ইউয়ানশান এবং আমি একবার বেইজিং টেলিভিশন ভবনের পাশের উড়াল সড়ক দিয়ে অফিসের গাড়িতে যাচ্ছিলাম। গাড়ির জানালা দিয়ে নিজের আবাস দেখাতে গিয়ে মি. লি বললেন: ‘ওই যে দেখছেন, তিনটে বহুতল ইমারত, তার তৃতীয়টির আড়ালে লুকিয়ে আছে চতুর্থ ইমারত। সেই ইমারতের ফটকে গিয়ে আমার কথা বললে প্রহরী আপনাকে আমার বাসায় পৌঁছে দেবে।’ সেদিনই ভদ্রলোকের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয়েছিলাম। তিনি চীন ও বাংলাদেশের কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর দোভাষী হিসেবে কাজ করেছেন। তার বাংলা শুনে আমাদের একজন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি তাকে প্রশংসা করে বলেছিলেন: ‘ইয়ু স্পিক ভেরি গুড বেঙ্গলি।’ এরকম বিশুদ্ধ বাংলাভাষীদের মধ্যে রয়েছেন লি সাহেবের স্ত্রী লিও আইহাও। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাবা চীনা এবং মা ভুটানি। ২১ বছর বয়েসে তিনি চীনে ফিরে যান। টেলিফোনে তার কথা শুনলে তাকে কলকাতার কোনো বাঙালি বলেই মনে হয়। বাসায় স্বামী-স্ত্রী বাংলা ভাষাতেই কথা বলেন।
বাংলা সাহিত্যের চীনা ভাষায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে একজনের নাম সর্বাগ্রেই উচ্চারিত হয়। তিনি পাই খাই ইউয়ান। রবীন্দ্র রচনাবলির প্রায় ৬৫ শতাংশ একা অনুবাদ করেছেন তিনি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় নজরুল সাহিত্যের দুই খণ্ডের চীনা অনুবাদগ্রন্থও তার। তা ছাড়াও বাংলার অসংখ্য বই তিনি চীনা ভাষার পাঠকদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
একটা ঘটনার কথা বলি। চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনাল বা সিআরআই ভবনের দেড়তলায় একটি কফি হল আছে। অর্ধচন্দ্রাকার হলটিতে একবার পাই সাহেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’র অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশনা উপলক্ষে আমাকে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। সেখানে দেখা হলো সিআরআই গ্রন্থাগারের প্রধান অন্তর্মঙ্গোলিয়ার মিস না রেনের সঙ্গে। পাই সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মুহূর্তেই বিগলিত না রেন বিস্ময়ের ঘোরে পড়ে গেলেন। বললেন, ‘স্যার, আমি ভীষণ সম্মানিত বোধ করছি আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে। লাইব্রেরিতে বইয়ের রাজ্যে পড়ে থাকি। একদিন আমি ক্লান্ত হাতে মলাট না দেখেই আপনার অনুবাদ করা একখানা পুস্তক পড়তে শুরু করেই এমন টান অনুভব করি যে, শেষ না করে উঠতে পারিনি। পরে মলাট উল্টিয়ে দেখি, ওটি অনুবাদগ্রন্থ এবং আপনার সৃজন।’ পাই সাহেবের চীনা অনুবাদের মান এবং পাঠকপ্রিয়তা সম্পর্কে ওই একটি ঘটনা অনেক কিছুই বলে দেয়। স্বপ্রতিষ্ঠিত বাংলা সাহিত্যের চীনা অনুবাদকদের প্রায় সবাই সিআরআই বাংলা বিভাগের। মি. লি ইউয়ানশান, মি. শি জিংউ, মাদাম চুং শাওলি, মাদাম ফোং শিওছিয়েন, মি. চৌ চিনছাও, মাদাম ইউ কুয়াং য়ুএ, মাদাম ইয়াং ওয়েইমিং (স্বর্ণা) প্রমুখ তাদের অন্যতম।
সিআরআই তাই প্রবাসে এক খণ্ড বিশুদ্ধ বাংলাদেশেরই অপর নাম। সিআরআই অথবা বাংলায় চীন আন্তর্জাতিক বেতার প্রতিদিনের প্রচারঘণ্টা এবং প্রচারিত অনুষ্ঠানমালার ভাষার সংখ্যার হিসেবে পৃথিবীর বৃহত্তম সম্প্রচার মাধ্যম এখন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যভাগে ১৯৪১ সালের ৩ ডিসেম্বর সিআরআই প্রথম বিদেশি ভাষা হিসেবে ১৫ মিনিটের জাপানি ভাষার অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে ইয়ান আন সিনহুয়া বেতার নামে। তখন বেতারের রেকর্ডিং রুম ছিল একটি অতিকাঁচা গুহাঘর, আর প্রেরণ শক্তি ছিল মাত্র ৩০০ ওয়াট। ইয়ান আন সিনহুয়া বেতার পেইচিংয়ের অদূরে অবস্থিত হোপেই প্রদেশের শে জেলায় স্থানান্তরিত হয় ১৯৪৭ সালের প্রথম দিকে। সে বছরই সেপ্টেম্বরে ইংরেজি অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয় ইয়ান আন সিনহুয়া বেতার থেকে। এসময় বেতারের প্রেরণশক্তি ছিল ১০ কিলোওয়াট।
চীন গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালে। পরে ইয়ান আন সিনহুয়া বেতার, পিকিং সিনহুয়া বেতার নামে রাজধানী পিকিংয়ে (বর্তমানে বেইজিং বা পেইচিং) স্থানান্তরিত হয়। বেতারের নাম বদলের ধারায় প্রথমে রেডিও পিকিং, পরে রেডিও বেইজিং (পেইচিং) এবং সবশেষে চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনাল বা সংক্ষেপে সিআরআই। চীন আন্তর্জাতিক বেতার তার বাংলা নাম।
১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর পিকিং সিনহুয়া বেতার সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে সারা বিশ্বের কাছে চীন গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রচার করে। ১৯৫০ সালের ১০ এপ্রিল ‘পিকিং রেডিও’ নাম ধারণের পর সেই মাসেই মাসেই ভিয়েতনামি, থাই, ইন্দোনেশীয় ও বার্মিজ ভাষার অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই বেতার ৪টি আঞ্চলিক ভাষাসহ ৩১টি ভাষায় প্রতিদিন ৯৮ ঘণ্টা অনুষ্ঠান প্রচার করে। গত শতকের ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে চীনের বৈদেশিক সম্প্রচারের ভাষা ৪৩টিতে দাঁড়ায়।
৮ এপ্রিল ১৯৭৮ সাল থেকে রেডিও বেইজিং চীন আন্তর্জাতিক বেতার (CRI) নামে অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে। বর্তমানে সিআরআই প্রতিদিন ৬৫ ভাষায় পুনঃপ্রচারসহ প্রায় ১০০০ ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। তার রয়েছে নিজস্ব টিভি চ্যানেল, অনলাইন সম্প্রচার ও সংবাদপত্র। চীন আন্তর্জাতিক বেতার (CRI), চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন এবং চীনের জাতীয় বেতার মিলে সিএমজি (CMG) একটি কেন্দ্রীয় মিডিয়া গ্রুপ গঠিত হয়েছে ২০১৮ সালের ২১ মার্চ। চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির বহিঃপ্রচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন এই সিএমজি’র বাংলাদেশ ব্যুরো অফিস রয়েছে ঢাকায়। এটির প্রধান ইউ কুয়াং য়ুএ।
সিআরআই বাংলা বিভাগ : চীন আন্তর্জাতিক বেতারে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার হচ্ছে ১৯৬৯ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে। অবশ্য ১৯৬৮ সালের আগস্টে বাংলা অনুষ্ঠান প্রচারের প্রস্তুতি শুরু হয়। তখন এর নেতৃত্বে ছিলেন- হিন্দি বিভাগের তৎকালীন প্রধান লি লিজুন।
বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে একজন বাংলাভাষী চীনাকে নিযুক্ত করবার জন্য লি ইউয়ানশানকে বাংলা শিখতে পাঠানো হয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সেইন্ট পিটার্সবার্গ (লেনিনগ্রাদ) বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারতের সঙ্গে চীনের বিরোধ ছিল বলে তখন পশ্চিমবঙ্গে বাংলা শেখার সুযোগ হয়নি কোনো চীনার। তখনকার উর্দুভাষী পাকিস্তানের পূর্বাংশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান যে বাংলাভাষী সেটিও তখন চীনাদের মাথায় আসেনি। পরে অবশ্য বাংলা একাডেমি এবং আরও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনারা এসে বাংলা শিখেছেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশে সাবেক রাষ্ট্রদূত ছাই শি, প্রথম সচিব ইয়াও বাওলাই, প্রথম সচিব শি চিংউ, সাংস্কৃতিক অ্যাটাশে ছাও ইয়েনহুয়া প্রমুখ বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয় হয়েছিলেন।
লি ইউয়ানশান হলেন সিআরআই বাংলা বিভাগের প্রথম বাংলাভাষী চীনা পরিচালক। তারপর বিভাগের দায়িত্বে আসেন মাদাম চুং শাওলি এবং মাদাম ইয়ু কুয়াং য়ুএ।
২০০৪ সালের ১৪ জুলাই পর্যন্ত ৩০ মিনিটের বাংলা অনুষ্ঠান দু’বার প্রচার করা হতো। এরই মধ্যে সিআরআই বাংলা বিভাগে ঘটেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ২০০৪ সালের ১৫ জুলাই বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টায় উন্নীত হয়। অনুষ্ঠান প্রচার সময় প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা, ৮টা ও সকাল ৮টায়। ১৬ ডিসেম্বর ২০০৫ থেকে রাত ৯টায় আরও একটি অধিবেশন যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে ৩ বার পুনঃপ্রচার-সহ প্রতিদিন মোট ৪ ঘণ্টা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শোনা যায়।
অনুষ্ঠান প্রচারের সময়সীমা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানের বিষয়বৈচিত্র্যও ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। বেতারের জনবলও বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে শ্রোতাপ্রিয়তা। চীনাদের পাশাপাশি বাঙালিরাও কাজ করছেন শুরু থেকেই। তাদের চীনারা বিশেষজ্ঞ নাম দিয়েছেন। তাদের মধ্যে সর্বজনাব ফয়েজ আহমদ, জাহিদী, সাযযাদ কাদির, জাহিদুল হক, ড. জাহানারা বেগম, মহিউদ্দিন তাহের, মাহমুদ হাশিম, আবাম ছালাহ উদ্দিন, অমিত হাবিব, ইলিয়াছ খান, মফিজুর রহমান, শিয়াবুর রহমান শিহাব, শান্তা মারিয়া, আলিমুল হক, মোহাম্মদ তৌহিদ প্রমুখের নাম মনে পড়ছে। আমার সময় পর্যন্ত একজন করে বাঙালি ছিলেন। বাঙালিদের কাজ মূলত চীনাদের বাংলাকে বাঙালির বাংলায় রূপান্তর করা। অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে নানা বৈচিত্র্য : দেশি-বিদেশি সংবাদ, সংবাদ বিশ্লেষণ, বিশেষ প্রতিবেদন, চীনের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, অর্থনীতি, উন্নয়ন, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ক্রীড়া, পর্যটন, কৃষি, কূটনীতি ইত্যাদি নিয়ে আয়োজন।
প্রতিদিন বাংলা ভাষা অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পাশাপাশি, বাংলা ভাষার ওয়েবসাইট (bengali.cri.cn)-এর মাধ্যমে অনলাইন সংবাদপত্রও প্রকাশ করছে সিআরআই বাংলা বিভাগ। বাংলা ভাষার ওয়েবসাইট চালু হয়েছে ২০০৪ সালের ১ নভেম্বর। এটি চীন ও চীনা জনগণের সর্ববিষয়ে জানবার এক জানালাও বটে।
২০১০ সালের ১ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ বেতারের এফএম ব্যান্ডে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে আনুষ্ঠানিকভাবে বিকেল ৫:৩০ থেকে ৭:৩০ পর্যন্ত ১ ঘণ্টা করে দু’বার সিআরআই ইংরেজি ও বাংলা অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করে যথাক্রমে ১০৩.২ ও ১০৫.৪ মেগাহার্জে। এছাড়া সিআরআই ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ‘চায়না ডটকম’ নামে বাংলা ভাষার ওয়েবসাইট চালু করে।
এছাড়া চীনের বাংলা চর্চার আরও কেন্দ্র রয়েছে। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়, ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যায়, চীনের গণযোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়, বেইজিং বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়াংচৌ বিদেশি শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়ুননান মিনযু বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি উচ্চ বিদ্যাপীঠে বাংলা ভাষার স্নাতক কোর্স চালু রয়েছে। তা ছাড়া, একসময় বেইজিং-এ বিদেশি ভাষা প্রকাশনা সংস্থায় বাংলা ভাষার বহুবিধ প্রকাশনা ছাপা হতো। প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ সেখানে কিছুকাল কাজ করেছিলেন।
বেইজিং শব্দটির চীনা উচ্চারণ পেইচিং। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা ও চর্চা যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, ভারত, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, রাশিয়া, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, চেক রিপাবলিক, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে।
সবচেয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে, চীনা ভাষায় রবীন্দ্র রচনাবলির ৩৩ খণ্ডের অনুবাদ থেকে শুরু করে লালনের গান ও দর্শন অনূদিত হয়েছে। সোভিয়েত আমলে রুশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের ব্যাপক অংশের অনুবাদ হয়েছে। সাম্প্রতিক এ ধারা অব্যাহত থাকায় গবেষকরা মনে করছেন ইংরেজি, চীনা ও জাপানি ভাষার পর বাংলা ভাষা নিয়ে বিশ্বের আগ্রহ যেমন বাড়ছে, তেমনি এ ভাষার প্রসার ও চর্চাও বেড়ে চলেছে।
লেখক : উপদেষ্টা, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি এবং সাবেক বিদেশি বিশেষজ্ঞ, চীন আন্তর্জাতিক বেতার
শেয়ার করুন
মহিউদ্দিন তাহের | ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

“যতদূর বাংলা ভাষা, ততদূর এই বাংলাদেশ, ... পৃথিবীর সর্বপ্রান্ত আমার স্বদেশ...।” কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার এই কাব্যকথন মূর্তিমান হয়ে উঠেছিল আমার কাছে চীনের রাজধানী বেইজিং-এ, ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ তারিখে। সেদিন আমি চীন আন্তর্জাতিক বেতার-এর বাংলা বিভাগে কাজ শুরু করেছিলাম বিদেশি বিশেষজ্ঞ হিসেবে। শুরুতেই চমকিত হয়েছিলাম চীনা সহকর্মীদের মুখে অবিমিশ্র বাংলা শুনে। তখন বিভাগীয় প্রধান ছিলেন মাদাম চুং শাওলি। লি ইউয়ানশান ছিলেন বিভাগের সর্বপ্রবীণ। আরও ছিলেন সর্বজনাব শি চিংউ, পাই খাই ইউয়ান, চৌ চিনছাও, চিয়াং চিংছেং, থান ইয়াওখাং, মাদাম ফোং শিওছিয়েন, মিস শিয়াও লিলিন এবং মিস ইউ কুয়াং য়ুএ (বর্তমানে বাংলা বিভাগের পরিচালক ও চায়না মিডিয়া গ্রুপ-এর বাংলাদেশ ব্যুরো প্রধান; তখন তিনি বাংলা বিভাগে শিক্ষানবিশ)।
তখন টাইপ রাইটারে বাংলা টাইপ করতেন চীনা বন্ধুরা। বেতারের কেন্দ্রীয় সম্পাদনা পর্ষদের অনুমোদিত চীনা ভাষার সংবাদ/প্রতিবেদন তারা বাংলায় অনুবাদ করতেন। আমার কাজ ছিল, চীনাদের বাংলাকে বাঙালির বাংলায় রূপান্তর। সেখানে তখন আমি একমাত্র বাংলাদেশি বাঙালি। বাকিরা পেশাগতভাবে বাংলাভাষী চীনা নাগরিক।
বাঙালিদের মতো তারা ইংরেজি শব্দের মিশেল দিয়ে বাংলা বলেন না। একটা উদাহরণ এরকম: লি ইউয়ানশান এবং আমি একবার বেইজিং টেলিভিশন ভবনের পাশের উড়াল সড়ক দিয়ে অফিসের গাড়িতে যাচ্ছিলাম। গাড়ির জানালা দিয়ে নিজের আবাস দেখাতে গিয়ে মি. লি বললেন: ‘ওই যে দেখছেন, তিনটে বহুতল ইমারত, তার তৃতীয়টির আড়ালে লুকিয়ে আছে চতুর্থ ইমারত। সেই ইমারতের ফটকে গিয়ে আমার কথা বললে প্রহরী আপনাকে আমার বাসায় পৌঁছে দেবে।’ সেদিনই ভদ্রলোকের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয়েছিলাম। তিনি চীন ও বাংলাদেশের কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর দোভাষী হিসেবে কাজ করেছেন। তার বাংলা শুনে আমাদের একজন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি তাকে প্রশংসা করে বলেছিলেন: ‘ইয়ু স্পিক ভেরি গুড বেঙ্গলি।’ এরকম বিশুদ্ধ বাংলাভাষীদের মধ্যে রয়েছেন লি সাহেবের স্ত্রী লিও আইহাও। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাবা চীনা এবং মা ভুটানি। ২১ বছর বয়েসে তিনি চীনে ফিরে যান। টেলিফোনে তার কথা শুনলে তাকে কলকাতার কোনো বাঙালি বলেই মনে হয়। বাসায় স্বামী-স্ত্রী বাংলা ভাষাতেই কথা বলেন।
বাংলা সাহিত্যের চীনা ভাষায় রূপান্তরের ক্ষেত্রে একজনের নাম সর্বাগ্রেই উচ্চারিত হয়। তিনি পাই খাই ইউয়ান। রবীন্দ্র রচনাবলির প্রায় ৬৫ শতাংশ একা অনুবাদ করেছেন তিনি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় নজরুল সাহিত্যের দুই খণ্ডের চীনা অনুবাদগ্রন্থও তার। তা ছাড়াও বাংলার অসংখ্য বই তিনি চীনা ভাষার পাঠকদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
একটা ঘটনার কথা বলি। চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনাল বা সিআরআই ভবনের দেড়তলায় একটি কফি হল আছে। অর্ধচন্দ্রাকার হলটিতে একবার পাই সাহেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’র অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশনা উপলক্ষে আমাকে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। সেখানে দেখা হলো সিআরআই গ্রন্থাগারের প্রধান অন্তর্মঙ্গোলিয়ার মিস না রেনের সঙ্গে। পাই সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মুহূর্তেই বিগলিত না রেন বিস্ময়ের ঘোরে পড়ে গেলেন। বললেন, ‘স্যার, আমি ভীষণ সম্মানিত বোধ করছি আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে। লাইব্রেরিতে বইয়ের রাজ্যে পড়ে থাকি। একদিন আমি ক্লান্ত হাতে মলাট না দেখেই আপনার অনুবাদ করা একখানা পুস্তক পড়তে শুরু করেই এমন টান অনুভব করি যে, শেষ না করে উঠতে পারিনি। পরে মলাট উল্টিয়ে দেখি, ওটি অনুবাদগ্রন্থ এবং আপনার সৃজন।’ পাই সাহেবের চীনা অনুবাদের মান এবং পাঠকপ্রিয়তা সম্পর্কে ওই একটি ঘটনা অনেক কিছুই বলে দেয়। স্বপ্রতিষ্ঠিত বাংলা সাহিত্যের চীনা অনুবাদকদের প্রায় সবাই সিআরআই বাংলা বিভাগের। মি. লি ইউয়ানশান, মি. শি জিংউ, মাদাম চুং শাওলি, মাদাম ফোং শিওছিয়েন, মি. চৌ চিনছাও, মাদাম ইউ কুয়াং য়ুএ, মাদাম ইয়াং ওয়েইমিং (স্বর্ণা) প্রমুখ তাদের অন্যতম।
সিআরআই তাই প্রবাসে এক খণ্ড বিশুদ্ধ বাংলাদেশেরই অপর নাম। সিআরআই অথবা বাংলায় চীন আন্তর্জাতিক বেতার প্রতিদিনের প্রচারঘণ্টা এবং প্রচারিত অনুষ্ঠানমালার ভাষার সংখ্যার হিসেবে পৃথিবীর বৃহত্তম সম্প্রচার মাধ্যম এখন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যভাগে ১৯৪১ সালের ৩ ডিসেম্বর সিআরআই প্রথম বিদেশি ভাষা হিসেবে ১৫ মিনিটের জাপানি ভাষার অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে ইয়ান আন সিনহুয়া বেতার নামে। তখন বেতারের রেকর্ডিং রুম ছিল একটি অতিকাঁচা গুহাঘর, আর প্রেরণ শক্তি ছিল মাত্র ৩০০ ওয়াট। ইয়ান আন সিনহুয়া বেতার পেইচিংয়ের অদূরে অবস্থিত হোপেই প্রদেশের শে জেলায় স্থানান্তরিত হয় ১৯৪৭ সালের প্রথম দিকে। সে বছরই সেপ্টেম্বরে ইংরেজি অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয় ইয়ান আন সিনহুয়া বেতার থেকে। এসময় বেতারের প্রেরণশক্তি ছিল ১০ কিলোওয়াট।
চীন গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৯ সালে। পরে ইয়ান আন সিনহুয়া বেতার, পিকিং সিনহুয়া বেতার নামে রাজধানী পিকিংয়ে (বর্তমানে বেইজিং বা পেইচিং) স্থানান্তরিত হয়। বেতারের নাম বদলের ধারায় প্রথমে রেডিও পিকিং, পরে রেডিও বেইজিং (পেইচিং) এবং সবশেষে চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনাল বা সংক্ষেপে সিআরআই। চীন আন্তর্জাতিক বেতার তার বাংলা নাম।
১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর পিকিং সিনহুয়া বেতার সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে সারা বিশ্বের কাছে চীন গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রচার করে। ১৯৫০ সালের ১০ এপ্রিল ‘পিকিং রেডিও’ নাম ধারণের পর সেই মাসেই মাসেই ভিয়েতনামি, থাই, ইন্দোনেশীয় ও বার্মিজ ভাষার অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত এই বেতার ৪টি আঞ্চলিক ভাষাসহ ৩১টি ভাষায় প্রতিদিন ৯৮ ঘণ্টা অনুষ্ঠান প্রচার করে। গত শতকের ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে চীনের বৈদেশিক সম্প্রচারের ভাষা ৪৩টিতে দাঁড়ায়।
৮ এপ্রিল ১৯৭৮ সাল থেকে রেডিও বেইজিং চীন আন্তর্জাতিক বেতার (CRI) নামে অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে। বর্তমানে সিআরআই প্রতিদিন ৬৫ ভাষায় পুনঃপ্রচারসহ প্রায় ১০০০ ঘণ্টা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। তার রয়েছে নিজস্ব টিভি চ্যানেল, অনলাইন সম্প্রচার ও সংবাদপত্র। চীন আন্তর্জাতিক বেতার (CRI), চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন এবং চীনের জাতীয় বেতার মিলে সিএমজি (CMG) একটি কেন্দ্রীয় মিডিয়া গ্রুপ গঠিত হয়েছে ২০১৮ সালের ২১ মার্চ। চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির বহিঃপ্রচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন এই সিএমজি’র বাংলাদেশ ব্যুরো অফিস রয়েছে ঢাকায়। এটির প্রধান ইউ কুয়াং য়ুএ।
সিআরআই বাংলা বিভাগ : চীন আন্তর্জাতিক বেতারে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার হচ্ছে ১৯৬৯ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে। অবশ্য ১৯৬৮ সালের আগস্টে বাংলা অনুষ্ঠান প্রচারের প্রস্তুতি শুরু হয়। তখন এর নেতৃত্বে ছিলেন- হিন্দি বিভাগের তৎকালীন প্রধান লি লিজুন।
বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে একজন বাংলাভাষী চীনাকে নিযুক্ত করবার জন্য লি ইউয়ানশানকে বাংলা শিখতে পাঠানো হয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সেইন্ট পিটার্সবার্গ (লেনিনগ্রাদ) বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারতের সঙ্গে চীনের বিরোধ ছিল বলে তখন পশ্চিমবঙ্গে বাংলা শেখার সুযোগ হয়নি কোনো চীনার। তখনকার উর্দুভাষী পাকিস্তানের পূর্বাংশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান যে বাংলাভাষী সেটিও তখন চীনাদের মাথায় আসেনি। পরে অবশ্য বাংলা একাডেমি এবং আরও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনারা এসে বাংলা শিখেছেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশে সাবেক রাষ্ট্রদূত ছাই শি, প্রথম সচিব ইয়াও বাওলাই, প্রথম সচিব শি চিংউ, সাংস্কৃতিক অ্যাটাশে ছাও ইয়েনহুয়া প্রমুখ বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয় হয়েছিলেন।
লি ইউয়ানশান হলেন সিআরআই বাংলা বিভাগের প্রথম বাংলাভাষী চীনা পরিচালক। তারপর বিভাগের দায়িত্বে আসেন মাদাম চুং শাওলি এবং মাদাম ইয়ু কুয়াং য়ুএ।
২০০৪ সালের ১৪ জুলাই পর্যন্ত ৩০ মিনিটের বাংলা অনুষ্ঠান দু’বার প্রচার করা হতো। এরই মধ্যে সিআরআই বাংলা বিভাগে ঘটেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ২০০৪ সালের ১৫ জুলাই বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টায় উন্নীত হয়। অনুষ্ঠান প্রচার সময় প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা, ৮টা ও সকাল ৮টায়। ১৬ ডিসেম্বর ২০০৫ থেকে রাত ৯টায় আরও একটি অধিবেশন যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে ৩ বার পুনঃপ্রচার-সহ প্রতিদিন মোট ৪ ঘণ্টা চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান শোনা যায়।
অনুষ্ঠান প্রচারের সময়সীমা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানের বিষয়বৈচিত্র্যও ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। বেতারের জনবলও বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে শ্রোতাপ্রিয়তা। চীনাদের পাশাপাশি বাঙালিরাও কাজ করছেন শুরু থেকেই। তাদের চীনারা বিশেষজ্ঞ নাম দিয়েছেন। তাদের মধ্যে সর্বজনাব ফয়েজ আহমদ, জাহিদী, সাযযাদ কাদির, জাহিদুল হক, ড. জাহানারা বেগম, মহিউদ্দিন তাহের, মাহমুদ হাশিম, আবাম ছালাহ উদ্দিন, অমিত হাবিব, ইলিয়াছ খান, মফিজুর রহমান, শিয়াবুর রহমান শিহাব, শান্তা মারিয়া, আলিমুল হক, মোহাম্মদ তৌহিদ প্রমুখের নাম মনে পড়ছে। আমার সময় পর্যন্ত একজন করে বাঙালি ছিলেন। বাঙালিদের কাজ মূলত চীনাদের বাংলাকে বাঙালির বাংলায় রূপান্তর করা। অনুষ্ঠানমালায় রয়েছে নানা বৈচিত্র্য : দেশি-বিদেশি সংবাদ, সংবাদ বিশ্লেষণ, বিশেষ প্রতিবেদন, চীনের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, অর্থনীতি, উন্নয়ন, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ক্রীড়া, পর্যটন, কৃষি, কূটনীতি ইত্যাদি নিয়ে আয়োজন।
প্রতিদিন বাংলা ভাষা অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পাশাপাশি, বাংলা ভাষার ওয়েবসাইট (bengali.cri.cn)-এর মাধ্যমে অনলাইন সংবাদপত্রও প্রকাশ করছে সিআরআই বাংলা বিভাগ। বাংলা ভাষার ওয়েবসাইট চালু হয়েছে ২০০৪ সালের ১ নভেম্বর। এটি চীন ও চীনা জনগণের সর্ববিষয়ে জানবার এক জানালাও বটে।
২০১০ সালের ১ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ বেতারের এফএম ব্যান্ডে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে আনুষ্ঠানিকভাবে বিকেল ৫:৩০ থেকে ৭:৩০ পর্যন্ত ১ ঘণ্টা করে দু’বার সিআরআই ইংরেজি ও বাংলা অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করে যথাক্রমে ১০৩.২ ও ১০৫.৪ মেগাহার্জে। এছাড়া সিআরআই ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ‘চায়না ডটকম’ নামে বাংলা ভাষার ওয়েবসাইট চালু করে।
এছাড়া চীনের বাংলা চর্চার আরও কেন্দ্র রয়েছে। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়, ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যায়, চীনের গণযোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়, বেইজিং বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়াংচৌ বিদেশি শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়ুননান মিনযু বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি উচ্চ বিদ্যাপীঠে বাংলা ভাষার স্নাতক কোর্স চালু রয়েছে। তা ছাড়া, একসময় বেইজিং-এ বিদেশি ভাষা প্রকাশনা সংস্থায় বাংলা ভাষার বহুবিধ প্রকাশনা ছাপা হতো। প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ সেখানে কিছুকাল কাজ করেছিলেন।
বেইজিং শব্দটির চীনা উচ্চারণ পেইচিং। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা ও চর্চা যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, ভারত, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, রাশিয়া, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, চেক রিপাবলিক, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে।
সবচেয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে, চীনা ভাষায় রবীন্দ্র রচনাবলির ৩৩ খণ্ডের অনুবাদ থেকে শুরু করে লালনের গান ও দর্শন অনূদিত হয়েছে। সোভিয়েত আমলে রুশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের ব্যাপক অংশের অনুবাদ হয়েছে। সাম্প্রতিক এ ধারা অব্যাহত থাকায় গবেষকরা মনে করছেন ইংরেজি, চীনা ও জাপানি ভাষার পর বাংলা ভাষা নিয়ে বিশ্বের আগ্রহ যেমন বাড়ছে, তেমনি এ ভাষার প্রসার ও চর্চাও বেড়ে চলেছে।
লেখক : উপদেষ্টা, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি এবং সাবেক বিদেশি বিশেষজ্ঞ, চীন আন্তর্জাতিক বেতার