পূর্ববাংলার নতুন রাজনীতির সূচনায় বঙ্গবন্ধু ।। ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮
বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই
নূরে আলম সিদ্দিকী | ২০ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই অবিভক্ত বাংলার রাজনীতি থেকে পূর্ববাংলার নিজস্ব রাজনীতি নির্মাণে ব্রতী হন মুজিব। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মুজিবের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে অবমুক্তির পরপরই আমার পূর্বপুরুষদের একটি বেদনাদায়ক ও বিশ্বকে অবাক করা একটি নতুন সংগ্রামের পথপরিক্রমণে নামতে হয়। বোধ করি পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো বর্ণ-গোত্রের কোনো ভাষার মানুষকে নিজের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বুকনিঃসৃত তাজা তপ্ত রক্ত ঢালতে হয়নি। সেই রক্তদান এতটাই গৌরবের ও আত্মমর্যাদার ছিল যে, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে অর্জিত পাকিস্তানের ঊষালগ্নেই বাঙালি জাতীয় সত্তার বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সুদৃঢ় বিনির্মাণের উপাত্ত তৈরি করে।
এই পথপরিক্রমায়, ঔপনিবেশিক কাঠামো থেকে পূর্ববাংলার বাঙালিদের নিজস্ব নতুন রাজনীতির নির্মাণের সূচনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির আত্মপরিচয় সগৌরবে তুলে ধরার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’-এর জন্ম হয় তারই দূরদর্শী নেতৃত্বে। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মহান ব্রতে ব্রতী হয়ে যারা এই অসাধ্য সাধন করেন, সেই স্থপতিরা শুধু বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় অধিকারেই তাদের চিন্তাকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের পরও সেইসব উচ্চকিত, উচ্ছ্বসিত, উদ্গত উদ্ধত প্রাণগুলো ভাষা আন্দোলনের অববাহিকায় দেশের প্রথম বিরোধী শক্তির সংগঠন হিসেবেই একটি স্বর্ণোজ্জ্বল সংগঠন ছাত্রলীগের আত্মপ্রকাশ ঘটায়। শুধু আমাদের কেন, সারা বিশ্বকে বিস্ময়াভিভূত করে ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯ সালে আন্দোলনের একেকটি সোপান তৈরি ও তা অতিক্রমণের মধ্য দিয়ে ৭০-এর নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ৭০-এর নির্বাচনকে প্রশান্ত চিত্তে আলিঙ্গন করে। প্রতিটি আন্দোলনের স্রোতধারায় দোল খাইয়ে বাঙালি জাতীয় চেতনাকে তখনকার জনগোষ্ঠীর বিস্তীর্ণ হৃদয়ে এমনভাবে প্রতিস্থাপিত করে যে, বঙ্গবন্ধুকে আন্দোলনের প্রতীক বানিয়ে ছাত্রলীগ আন্দোলনটিকে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় শুধু রূপান্তরিতই করেনি, ছাত্রলীগ তখনকার বাংলার জাগ্রত জনতার চিত্তকে এতটাই শাণিত করে যে, নিরস্ত্র জাতি পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র ও পৈশাচিক সেনাশক্তিকে শুধু মোকাবিলাই করেনি, পর্যুদস্ত করার মাধ্যমে পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনে। একটি নিরস্ত্র জাতির এই ঐতিহাসিক বিজয় ও স্বাধীনতা বিশ্বকে শুধু বিমুগ্ধই করেনি, বিস্ময়াভিভূত ও আশ্চর্যান্বিত করেছিল। এই মহান বিজয়ের পথপরিক্রমণের একজন পথিক হিসেবে আমার মনে হয়, একটি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠীর এমন মহামিলন বোধ করি পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেনি।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ নিরলস ও নিরবচ্ছিন্নভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন ও তাকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে ব্যাপৃত রয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকার তারা অর্জন করেছে নির্বাচনী ম্যান্ডেটকে সম্বল করে। নিরস্ত্র মানুষগুলোকে সশস্ত্র হায়েনার বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে দেখেছি। ৭১-এর বিজয়োত্তর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক বিজয়ের জয়যাত্রা বিশ্ববাসী বিমুগ্ধ চিত্তে অবলোকন করেছে। আবার বাকশাল প্রতিষ্ঠায় বামধারার রাজনীতির ষড়যন্ত্রে গণতন্ত্রকে হোঁচট খেতেও বেদনাহত চিত্তে বাংলাদেশকে দেখতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো শুধু গণতন্ত্রই নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। গণতন্ত্র অবলুপ্ত হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা নিঃশেষিত হয়ে ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির অপশাসন জাতীয় চেতনাকে সমূলে গ্রাস করেছে। তা সত্ত্বেও এই চিরবিজয়ী জাতি আবারও মেরুদ- খাড়া করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তাদের চেতনা ও বিশ্বাসের বিজয় সাধন করেছে। এই বিজয়ের অগ্রদূত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ। তাদেরই অদম্য উৎসাহ, নির্যাতন-নিগ্রহ সহ্য করে পথপরিক্রমণ এবং পথপরিক্রমণের ফলেই হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র এবং বাঙালি জাতীয় চেতনা পুনঃঅর্জিত হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেকগুলো বিজয়ের বিরল দৃষ্টান্ত আমরা স্থাপন করতে পেরেছি। বাঙালি মার খেয়ে খেয়ে মরে যায়নি। বাংলার সূর্যস্নাত আকাশ, আলোয় ভরা মাটি অন্ধকারের গহ্বরে অনন্তকালের জন্য কেউ নিমজ্জিত করতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলতেন, সব বাঙালির এক দেশ হলে বাঙালিরা কী না করতে পারত। তারা তো বিশ্বজয় করতে পারত। অথচ বাঙালিরা বিভক্ত হওয়ার পর শুনছে কেউ বলে পাক-বাংলা, কেউ বলে পূর্ব বাংলা, কেউ বলছে পূর্ব পাকিস্তান। আমার সোজা কথা, পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের নাম হবে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রমুগ্ধ প্রেরণায় এদেশের ছাত্রসমাজ একটার পর একটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনের পথকে প্রশস্ত করে তুলছিল। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে একচ্ছত্র নেতা হয়ে ওঠার আগেই বঙ্গবন্ধু অধিকার অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ছাত্রলীগকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সংগঠিত করেছিলেন। ক্ষমতার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় যুক্তফ্রন্টের ভাঙন, নিজ দলের মধ্যে আত্মকলহ সর্বোপরি ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর মূল চালিকার ভূমিকায় তিনি ছাত্রলীগকেই ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পূর্ব বাংলার নাম পাল্টে পূর্ব পাকিস্তান রাখার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তিনি গর্জে উঠেছিলেন। তখনো শক্তির পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হবেন কি-না সংশয় ছিল। শেখ মুজিব যখন ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের পাল্টা প্রস্তাব উত্থাপন করেন, তখনো দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা একদল অনুচর রহস্যজনক ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন। তারপরও এ প্রশ্নের সুরাহার জন্য তিনি পূর্ব বাংলায় গণভোট দাবি করেছিলেন।
ছাত্রলীগকে তিনি ভবিষ্যৎ নির্মাণে প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শুদ্ধ নাম যদি হয় স্বাধীনতা, তাহলে সেই স্বাধীনতার চারটি স্তম্ভবাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দার্শনিক রূপকার ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধু যদি হন বাংলার আকাশ, তাহলে সেই আকাশের তারা ছাত্রলীগ। পুরো ষাটের দশকের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যাবে, ওই ১০ বছরেই বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতির মূল স্থপতিই ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিও কখনো তার আদর্শ-দর্শন-অনুভূতি থেকে ছাত্রলীগকে বিচ্যুত করতে পারেনি। কখনো কখনো ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে কিছু উগ্র বিপ্লবী সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা আদায়ের পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে বিপথগামী পথে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে টলানো যায়নি। বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে বেড়ে উঠেছেন, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাই তার লক্ষ্য। ছয় দফায় স্বাধিকার আন্দোলনের দাবি করেছেন। যারা এ দাবির কারণে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলেছেন, তারা বুঝতেন আইনানুগ ভাষায় এ দাবিকে অগ্রাহ্য করা যায় না। তিনি উপলব্ধি করতেন, কথা নেই বার্তা নেই হুট করে স্বাধীনতার দাবি করলে বিশ্বজনমত কোথায় যাবে। সাধারণ মানুষও এই ঝুঁকি নেবে কেন? ১৯৪৭ সালে যখন ভারত বিভাগের প্রশ্নে বাংলাকে দুই টুকরো করার সিদ্ধান্ত হয় তখনো তার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। পাকিস্তান অভ্যুদয়ের মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে ভাষার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়েই যার শুরু তার শেষটাও অতি সহজে হতে পারে না, মর্মে মর্মে তিনি তা উপলব্ধি করতেন।
তিনি একটি জাতিরাষ্ট্রের আত্মপ্রতিষ্ঠাকে কায়েম করেন বিশ্বনন্দিত স্বকীয় প্রবল নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে। আর তা একদিনে হয়নি, ২৪ বছরের অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়। নিষ্ঠুর অত্যাচার, জেল-জুলুম, নির্যাতন এমনকি কারান্তরালে ফাঁসির হুকুমের আসামি হিসেবে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়েও খুঁড়ে রাখা কবরের প্রান্তে দাঁড়িয়েও নিয়মতান্ত্রিকতার বাইরে যাননি। বিচ্ছিন্নতাবাদীর খোলস পরানোর শত ষড়যন্ত্রেও শেখ মুজিবকে ধোঁকা দেওয়া যায়নি। তার বেড়ে ওঠার মধ্যে ভীষণভাবে গ্রথিত ছিল একটি শোষণহীন আধুনিক সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। জীবন ছিল অসাধ্য সাধনের রাজনৈতিক ব্রতে নিয়োজিত এক কণ্টকাকীর্ণ পথে বিস্তৃত। ছয় দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবির স্থলে স্বাধীনতা কথাটি জুড়ে দিলেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বিচ্ছিন্নতাবাদী অভিযুক্ত করে শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানো সহজ হতো। বিচক্ষণরা ছয় দফার মন্ত্র যে স্বাধীনতারই মন্ত্র সেটা বুঝতেন না তা নয়। যে জন্য জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রথমে মানছেন বললেও পরে বলেছেনছয় দফা স্বাধিকারের চেয়ে বেশি, প্রায় স্বাধীনতারই নামান্তর। শেখ মুজিব বুঝতেন কোন পথে হাঁটতে হবে। তাই তো তিনি প্রথমে যখন ছয় দফা দলের সভায় উত্থাপন করলেন তখন সাধারণ সম্পাদক দেখলেন প্রবীণরা পাস করার পথে অন্তরায়। ডাকলেন কাউন্সিল অধিবেশন। অধিবেশনেই এলেন না মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে পাস হয়ে গেল ছয় দফা। ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ ক্ষুব্ধ কাউন্সিলররা শেখ মুজিবকেই সভাপতি নির্বাচিত করলেন।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, মানচিত্রের পৃষ্ঠা থেকে বাংলা কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছে ফেলার চক্রান্ত হচ্ছে। একমাত্র বঙ্গোপসাগরের অস্তিত্ব ছাড়া ‘বাংলা’ নামের আর কিছু নেই বলেও সেদিন মন্তব্য করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশপ্রেমের অন্তর্গত প্রবল অনুভূতি দিয়ে ধারাক্রমে একটি রাষ্ট্রের স্রষ্টা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব। বাঙালিদের সুনির্দিষ্ট ঠিকানা খুঁজে দিয়ে স্বাধীন ভূখ-, পতাকা, সংবিধান, সার্বভৌমত্ব সবই দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫৪-এর নির্বাচন, ৫৮-এর সামরিক শাসন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা ও ১১ দফা-ভিত্তিক ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন-পরবর্তী অসহযোগ আন্দোলনের মূল স্রোতধারায় তিনি নিজেকে কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিলেন।
ইতিহাসের অপূর্ব এক যুগসন্ধিতে, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। একাত্তরে আরেক মার্চের ৭ তারিখে তিনি ঘোষণা করলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধিকারের খোলস থেকে বেরিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা সেই মার্চ মাসেই২৬ মার্চ। ছাত্রলীগ তাকে যে জাতির পিতা ঘোষণা করেসেটিও সেই মার্চে ৩ মার্চ। স্বাধীনতা ও ছাত্রলীগের কী অপূর্ব যুগসন্ধি। এই ৩ মার্চেই ছাত্রলীগ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করে। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণায় আমরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠি এবং বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা নিয়ে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে আমরা ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করি।
১ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর হাতে সব ক্ষমতা অর্পিত হওয়ার পেছনে দূরদর্শী, সুবিবেচক, কল্যাণকামী বিশ্বভাবনা তথা ভূ-অঞ্চলভেদে রাজনৈতিক কৃষ্টি ও জীবনবোধ সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান কাজ করেছিল। স্বাধীনতার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অধ্যায় সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত সংবাদপত্র নিউজ উইক লিখেছিলশেখ মুজিব ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’। বাংলার সর্বকালের সর্বযুগের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানই একমাত্র নেতা যিনি রক্তে-বর্ণে-ভাষায়-সংস্কৃতিতে ও জন্মসূত্রে পুরোদস্তুর বাঙালি। তাই তিনি জাতির জনক। অমর অক্ষয়, ধ্রুবতারা।
লেখক : স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম ছাত্রনেতা ও আহ্বায়ক, প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশন
শেয়ার করুন
নূরে আলম সিদ্দিকী | ২০ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে অবমুক্তির পরপরই আমার পূর্বপুরুষদের একটি বেদনাদায়ক ও বিশ্বকে অবাক করা একটি নতুন সংগ্রামের পথপরিক্রমণে নামতে হয়। বোধ করি পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো বর্ণ-গোত্রের কোনো ভাষার মানুষকে নিজের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বুকনিঃসৃত তাজা তপ্ত রক্ত ঢালতে হয়নি। সেই রক্তদান এতটাই গৌরবের ও আত্মমর্যাদার ছিল যে, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে অর্জিত পাকিস্তানের ঊষালগ্নেই বাঙালি জাতীয় সত্তার বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সুদৃঢ় বিনির্মাণের উপাত্ত তৈরি করে।
এই পথপরিক্রমায়, ঔপনিবেশিক কাঠামো থেকে পূর্ববাংলার বাঙালিদের নিজস্ব নতুন রাজনীতির নির্মাণের সূচনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির আত্মপরিচয় সগৌরবে তুলে ধরার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’-এর জন্ম হয় তারই দূরদর্শী নেতৃত্বে। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মহান ব্রতে ব্রতী হয়ে যারা এই অসাধ্য সাধন করেন, সেই স্থপতিরা শুধু বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় অধিকারেই তাদের চিন্তাকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের পরও সেইসব উচ্চকিত, উচ্ছ্বসিত, উদ্গত উদ্ধত প্রাণগুলো ভাষা আন্দোলনের অববাহিকায় দেশের প্রথম বিরোধী শক্তির সংগঠন হিসেবেই একটি স্বর্ণোজ্জ্বল সংগঠন ছাত্রলীগের আত্মপ্রকাশ ঘটায়। শুধু আমাদের কেন, সারা বিশ্বকে বিস্ময়াভিভূত করে ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯ সালে আন্দোলনের একেকটি সোপান তৈরি ও তা অতিক্রমণের মধ্য দিয়ে ৭০-এর নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ৭০-এর নির্বাচনকে প্রশান্ত চিত্তে আলিঙ্গন করে। প্রতিটি আন্দোলনের স্রোতধারায় দোল খাইয়ে বাঙালি জাতীয় চেতনাকে তখনকার জনগোষ্ঠীর বিস্তীর্ণ হৃদয়ে এমনভাবে প্রতিস্থাপিত করে যে, বঙ্গবন্ধুকে আন্দোলনের প্রতীক বানিয়ে ছাত্রলীগ আন্দোলনটিকে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় শুধু রূপান্তরিতই করেনি, ছাত্রলীগ তখনকার বাংলার জাগ্রত জনতার চিত্তকে এতটাই শাণিত করে যে, নিরস্ত্র জাতি পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র ও পৈশাচিক সেনাশক্তিকে শুধু মোকাবিলাই করেনি, পর্যুদস্ত করার মাধ্যমে পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনে। একটি নিরস্ত্র জাতির এই ঐতিহাসিক বিজয় ও স্বাধীনতা বিশ্বকে শুধু বিমুগ্ধই করেনি, বিস্ময়াভিভূত ও আশ্চর্যান্বিত করেছিল। এই মহান বিজয়ের পথপরিক্রমণের একজন পথিক হিসেবে আমার মনে হয়, একটি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠীর এমন মহামিলন বোধ করি পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেনি।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ নিরলস ও নিরবচ্ছিন্নভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন ও তাকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে ব্যাপৃত রয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকার তারা অর্জন করেছে নির্বাচনী ম্যান্ডেটকে সম্বল করে। নিরস্ত্র মানুষগুলোকে সশস্ত্র হায়েনার বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে দেখেছি। ৭১-এর বিজয়োত্তর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক বিজয়ের জয়যাত্রা বিশ্ববাসী বিমুগ্ধ চিত্তে অবলোকন করেছে। আবার বাকশাল প্রতিষ্ঠায় বামধারার রাজনীতির ষড়যন্ত্রে গণতন্ত্রকে হোঁচট খেতেও বেদনাহত চিত্তে বাংলাদেশকে দেখতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো শুধু গণতন্ত্রই নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। গণতন্ত্র অবলুপ্ত হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা নিঃশেষিত হয়ে ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির অপশাসন জাতীয় চেতনাকে সমূলে গ্রাস করেছে। তা সত্ত্বেও এই চিরবিজয়ী জাতি আবারও মেরুদ- খাড়া করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে তাদের চেতনা ও বিশ্বাসের বিজয় সাধন করেছে। এই বিজয়ের অগ্রদূত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ। তাদেরই অদম্য উৎসাহ, নির্যাতন-নিগ্রহ সহ্য করে পথপরিক্রমণ এবং পথপরিক্রমণের ফলেই হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র এবং বাঙালি জাতীয় চেতনা পুনঃঅর্জিত হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেকগুলো বিজয়ের বিরল দৃষ্টান্ত আমরা স্থাপন করতে পেরেছি। বাঙালি মার খেয়ে খেয়ে মরে যায়নি। বাংলার সূর্যস্নাত আকাশ, আলোয় ভরা মাটি অন্ধকারের গহ্বরে অনন্তকালের জন্য কেউ নিমজ্জিত করতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে বলতেন, সব বাঙালির এক দেশ হলে বাঙালিরা কী না করতে পারত। তারা তো বিশ্বজয় করতে পারত। অথচ বাঙালিরা বিভক্ত হওয়ার পর শুনছে কেউ বলে পাক-বাংলা, কেউ বলে পূর্ব বাংলা, কেউ বলছে পূর্ব পাকিস্তান। আমার সোজা কথা, পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের নাম হবে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রমুগ্ধ প্রেরণায় এদেশের ছাত্রসমাজ একটার পর একটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনের পথকে প্রশস্ত করে তুলছিল। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে একচ্ছত্র নেতা হয়ে ওঠার আগেই বঙ্গবন্ধু অধিকার অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ছাত্রলীগকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সংগঠিত করেছিলেন। ক্ষমতার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় যুক্তফ্রন্টের ভাঙন, নিজ দলের মধ্যে আত্মকলহ সর্বোপরি ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর মূল চালিকার ভূমিকায় তিনি ছাত্রলীগকেই ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পূর্ব বাংলার নাম পাল্টে পূর্ব পাকিস্তান রাখার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তিনি গর্জে উঠেছিলেন। তখনো শক্তির পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হবেন কি-না সংশয় ছিল। শেখ মুজিব যখন ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের পাল্টা প্রস্তাব উত্থাপন করেন, তখনো দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা একদল অনুচর রহস্যজনক ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন। তারপরও এ প্রশ্নের সুরাহার জন্য তিনি পূর্ব বাংলায় গণভোট দাবি করেছিলেন।
ছাত্রলীগকে তিনি ভবিষ্যৎ নির্মাণে প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শুদ্ধ নাম যদি হয় স্বাধীনতা, তাহলে সেই স্বাধীনতার চারটি স্তম্ভবাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দার্শনিক রূপকার ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধু যদি হন বাংলার আকাশ, তাহলে সেই আকাশের তারা ছাত্রলীগ। পুরো ষাটের দশকের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যাবে, ওই ১০ বছরেই বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতির মূল স্থপতিই ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিও কখনো তার আদর্শ-দর্শন-অনুভূতি থেকে ছাত্রলীগকে বিচ্যুত করতে পারেনি। কখনো কখনো ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে কিছু উগ্র বিপ্লবী সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা আদায়ের পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে বিপথগামী পথে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে টলানো যায়নি। বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে বেড়ে উঠেছেন, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাই তার লক্ষ্য। ছয় দফায় স্বাধিকার আন্দোলনের দাবি করেছেন। যারা এ দাবির কারণে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলেছেন, তারা বুঝতেন আইনানুগ ভাষায় এ দাবিকে অগ্রাহ্য করা যায় না। তিনি উপলব্ধি করতেন, কথা নেই বার্তা নেই হুট করে স্বাধীনতার দাবি করলে বিশ্বজনমত কোথায় যাবে। সাধারণ মানুষও এই ঝুঁকি নেবে কেন? ১৯৪৭ সালে যখন ভারত বিভাগের প্রশ্নে বাংলাকে দুই টুকরো করার সিদ্ধান্ত হয় তখনো তার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। পাকিস্তান অভ্যুদয়ের মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে ভাষার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়েই যার শুরু তার শেষটাও অতি সহজে হতে পারে না, মর্মে মর্মে তিনি তা উপলব্ধি করতেন।
তিনি একটি জাতিরাষ্ট্রের আত্মপ্রতিষ্ঠাকে কায়েম করেন বিশ্বনন্দিত স্বকীয় প্রবল নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে। আর তা একদিনে হয়নি, ২৪ বছরের অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়। নিষ্ঠুর অত্যাচার, জেল-জুলুম, নির্যাতন এমনকি কারান্তরালে ফাঁসির হুকুমের আসামি হিসেবে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়েও খুঁড়ে রাখা কবরের প্রান্তে দাঁড়িয়েও নিয়মতান্ত্রিকতার বাইরে যাননি। বিচ্ছিন্নতাবাদীর খোলস পরানোর শত ষড়যন্ত্রেও শেখ মুজিবকে ধোঁকা দেওয়া যায়নি। তার বেড়ে ওঠার মধ্যে ভীষণভাবে গ্রথিত ছিল একটি শোষণহীন আধুনিক সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। জীবন ছিল অসাধ্য সাধনের রাজনৈতিক ব্রতে নিয়োজিত এক কণ্টকাকীর্ণ পথে বিস্তৃত। ছয় দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবির স্থলে স্বাধীনতা কথাটি জুড়ে দিলেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বিচ্ছিন্নতাবাদী অভিযুক্ত করে শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানো সহজ হতো। বিচক্ষণরা ছয় দফার মন্ত্র যে স্বাধীনতারই মন্ত্র সেটা বুঝতেন না তা নয়। যে জন্য জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রথমে মানছেন বললেও পরে বলেছেনছয় দফা স্বাধিকারের চেয়ে বেশি, প্রায় স্বাধীনতারই নামান্তর। শেখ মুজিব বুঝতেন কোন পথে হাঁটতে হবে। তাই তো তিনি প্রথমে যখন ছয় দফা দলের সভায় উত্থাপন করলেন তখন সাধারণ সম্পাদক দেখলেন প্রবীণরা পাস করার পথে অন্তরায়। ডাকলেন কাউন্সিল অধিবেশন। অধিবেশনেই এলেন না মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে পাস হয়ে গেল ছয় দফা। ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ ক্ষুব্ধ কাউন্সিলররা শেখ মুজিবকেই সভাপতি নির্বাচিত করলেন।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, মানচিত্রের পৃষ্ঠা থেকে বাংলা কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছে ফেলার চক্রান্ত হচ্ছে। একমাত্র বঙ্গোপসাগরের অস্তিত্ব ছাড়া ‘বাংলা’ নামের আর কিছু নেই বলেও সেদিন মন্তব্য করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশপ্রেমের অন্তর্গত প্রবল অনুভূতি দিয়ে ধারাক্রমে একটি রাষ্ট্রের স্রষ্টা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব। বাঙালিদের সুনির্দিষ্ট ঠিকানা খুঁজে দিয়ে স্বাধীন ভূখ-, পতাকা, সংবিধান, সার্বভৌমত্ব সবই দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫৪-এর নির্বাচন, ৫৮-এর সামরিক শাসন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা ও ১১ দফা-ভিত্তিক ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন-পরবর্তী অসহযোগ আন্দোলনের মূল স্রোতধারায় তিনি নিজেকে কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিলেন।
ইতিহাসের অপূর্ব এক যুগসন্ধিতে, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। একাত্তরে আরেক মার্চের ৭ তারিখে তিনি ঘোষণা করলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধিকারের খোলস থেকে বেরিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা সেই মার্চ মাসেই২৬ মার্চ। ছাত্রলীগ তাকে যে জাতির পিতা ঘোষণা করেসেটিও সেই মার্চে ৩ মার্চ। স্বাধীনতা ও ছাত্রলীগের কী অপূর্ব যুগসন্ধি। এই ৩ মার্চেই ছাত্রলীগ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করে। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণায় আমরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠি এবং বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা নিয়ে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে আমরা ‘স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করি।
১ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর হাতে সব ক্ষমতা অর্পিত হওয়ার পেছনে দূরদর্শী, সুবিবেচক, কল্যাণকামী বিশ্বভাবনা তথা ভূ-অঞ্চলভেদে রাজনৈতিক কৃষ্টি ও জীবনবোধ সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান কাজ করেছিল। স্বাধীনতার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় অধ্যায় সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত সংবাদপত্র নিউজ উইক লিখেছিলশেখ মুজিব ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’। বাংলার সর্বকালের সর্বযুগের ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানই একমাত্র নেতা যিনি রক্তে-বর্ণে-ভাষায়-সংস্কৃতিতে ও জন্মসূত্রে পুরোদস্তুর বাঙালি। তাই তিনি জাতির জনক। অমর অক্ষয়, ধ্রুবতারা।
লেখক : স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম ছাত্রনেতা ও আহ্বায়ক, প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশন