ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধুর কারামুক্তি ।। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
স্বাধীনতার সোপান ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান
মোহাম্মদ হাননান | ২০ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
বিশ শতকের ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া জনবিস্ফোরণ দুনিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান’ বলে পরিচিতি লাভ করে। এ অভ্যুত্থানে সমগ্র পাকিস্তানে দুই অংশের জনগণই অংশগ্রহণ করে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী মানুষের ভূমিকা ও অবদানটি ছিল সর্বগ্রাসী। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জেনারেল আইয়ুব খান এবং তার বিশ্বস্ত অনুচর মোনায়েম খানের মসনদকে তা ভেঙে চুরমার করে দেয়। এই প্রথম পাকিস্তানের কোনো গণ-আন্দোলন একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে বিকাশ লাভ করে, যার রাজনৈতিক তাৎপর্য বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যেও দোলাচল সৃষ্টি করে।
এই গণ-আন্দোলনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তা ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাস থেকে শুরু হয়ে ১৯৬৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত লাগাতার চলেছিল। সমগ্র পাকিস্তানে এর আগে কোনো আন্দোলন এতটা দীর্ঘ সময় ধরে চলেনি, গুনে গুনে ঠিক পাঁচ মাস একটি আন্দোলন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলার অর্থই ছিল সাধারণ প্রান্তিক মানুষের এতে স্বতঃস্ফূর্ত সম্পৃক্ততা। এই সম্পৃক্ততার কারণে ঠিক এর দুবছরের মধ্যেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একটা সশস্ত্র লড়াইয়ে নেমে পড়ে যার একটা মহড়া হয়ে যায় ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এ গণ-অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ শাহাদতবরণ করে এবং এই সংখ্যা ৬০০ জনেরও অধিক ছিল। গণ-অভ্যুত্থান সফল করতে সে দিনগুলোতে লাগাতার হরতাল পালিত হয়। হরতালের বাইরে আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের একটানা কারফিউ জারিও জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়। কিন্তু প্রান্তিক জনগণ খুশি মনেই এ কষ্ট সহ্য করে। সারা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছিল, এর প্রধান শিকার হয় প্রান্তিক জনগণ। কিন্তু তারা বৃহত্তর স্বার্থে এটি মেনে নেয়। প্রান্তিক মানুষের মধ্যে মরণপণ সংগ্রামী চেতনা জেগে উঠেছিল, ফলে অভ্যুত্থান সার্বিকভাবে সফলতা লাভ করে।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মূল চাবিকাঠি ছিল ছাত্রদের হাতে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছাত্ররা এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের প্রধান স্লোগান ছিল ‘৬ দফা-১১ দফা মানতে হবে’। সর্ব শ্রেণির মানুষ ও সব পেশার জনগণ এ সেøাগানের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানায়। এর পেছনে প্রধান কারণগুলো ছিল সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক সমস্যাকে দফাগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১১ দফার ৩ নম্বর দফাটির ‘ক-চ’ পর্যন্ত ছিল আওয়ামী লীগের নিজস্ব ৬ দফার হুবহু ক্রমানুসরণ। এগুলো ছিল জাতীয় দাবি। এত দিনে পূর্ববাংলার মানুষ তা বুদ্ধিজীবী থেকে সাধারণ কৃষি-মজুর পর্যন্ত বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা পূর্ব পাকিস্তানকে ঢালাওভাবে শোষণ করছে। এর প্রতিকারে শেখ মুজিবের ছয় দফা হলো একমাত্র ওষুধ। ১১ দফার বাকি দশটি দাবি ছিল সরাসরি ছাত্র ও সাধারণ জনগণের সমস্যাকেন্দ্রিক। ছাত্রদের জনপ্রিয় দাবিটি ছিল তৃতীয় বিভাগের উত্তীর্ণ ছাত্রদের উচ্চশিক্ষায় ভর্তি বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা বাতিল করা। বস্তুত এর প্রধান শিকার হয়েছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানরা। আর্থিক অবস্থা এবং দেশের গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানরা পরীক্ষার ফলাফল খারাপ করছিল। একমাত্র ১৯৬২-৬৩ সালের শিক্ষাবছরে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মাত্র ২৭ দিন ক্লাস হয়েছিল।১ পাশাপাশি ছাত্রবেতন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। খুব স্বাভাবিক কারণেই প্রান্তিক মানুষের সন্তানরা এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রান্তিক পর্যায়ে বিদ্রোহ গড়ে ওঠার এটিও একটি বড় কারণ ছিল।
একই সঙ্গে খাজনা-ট্যাক্স আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং বকেয়া খাজনা ও ঋণে কৃষকরা জর্জরিত হয়ে পড়ে। আইয়ুব-মোনায়েম সরকার জমিতে যে সার্টিফিকেট প্রথা চালু করেছিল তাতেও কৃষকরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তহসিলদারদের অত্যাচার সুদূর পল্লীর গরিব মজুরদের মধ্যেও হানা দেয়। পাটের মূল্য ষাটের দশকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছিল। আখচাষিদের জন্যও ছিল সমান দুর্গতি। কৃষকদের এ সমস্যাগুলো ১১ দফার ৬ নম্বর দাবিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী নানা কালাকানুন করা হয়েছিল। ধর্মঘটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় এবং ট্রেড ইউনিয়নও করা যাবে না বলে ঘোষণা এসেছিল। শ্রমিকরা বোনাস তো পেতই না, বরং ন্যায্য মজুরি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছিল তারা। ১১ দফার ৭ নম্বর দাবিতে শ্রমিকরা এর প্রতিফলন দেখতে পায়। দফাগুলোতে সমস্যা অন্তর্ভুক্তকরণই যথেষ্ট ছিল না, বরং এ রকম দাবি এর আগেও অনেক রাজনৈতিক দল ও জোট করে আসছিল। কিন্তু ১৯৬৮-৬৯ সালে দাবিগুলো ছাত্ররা প্রান্তজনের কাছে অনেক আবেগের সঙ্গে পৌঁছে দিয়েছিল। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বুঝতে সক্ষম হয় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ মুসলিম হলেও ‘ভাই-ভাই’ নয়। অথবা ছোট ভাই বড় ভাইকে ঠকিয়ে খাচ্ছে। জনসংখ্যায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছিল বেশি, তাই পূব পাকিস্তানিরাই ছিল বড় ভাই। সাধারণ কৃষক-মজুর এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নেয়।
তৎকালীন বাংলার জারি-সারিগানের বয়াতি শিল্পীরাও তৃণমূলপর্যায়ে গেয়ে গেয়ে কৃষক-মজুরদের কাছে এসব ঘটনা ও বৈষম্য তুলে ধরেছিল। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এতে সংগ্রামী চেতনায় আপ্লুত হয়ে পড়ে। আর বয়াতিরা ছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরই একটি অংশ। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস রচনায় বয়াতি শিল্পীদের এ ভূমিকা অনেকটা বিস্মৃত হয়েই আছে। ২
প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ও গভর্নর মোনায়েম খানবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোও একটি জোট করেছিল। এর নাম দেওয়া হয়েছিল গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ (Democratic Action Committee), সংক্ষেপে ‘ডাক’ নামেই তা পরিচিত হয়েছিল। এতে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপ ছয়-দফাপন্থি এবং পিডিএমপন্থি উভয়েই স্বাক্ষর করে। রুশপন্থি বলে পরিচিত ওয়ালী ন্যাপ এর সদস্য হয়। কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীও এতে শরিক ছিল। এ ছাড়া জামায়াতে উলামায়ে ইসলাম ও এবং নেজামে ইসলামও এতে সক্রিয় ছিল। কিন্তু তারা ছাত্রদের ছয় দফা ও এগারো দফা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। চীনপন্থি বলে পরিচিত ভাসানী ন্যাপ এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি জোটে না থাকলেও ছয় দফা ও এগার দফা মানতে অস্বীকৃতি জানায়।
তবে ভাসানী ন্যাপ সমর্থক ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) ছয় দফার ব্যাপারে আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যোগদান করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে বড় সংগঠন ছিল ছাত্রলীগ। ডাকসুতে তখন ছাত্রলীগ ও সরকারি ছাত্র সংগঠন এনএসএফ ক্ষমতায় ছিল। এটা ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি বাড়তি শক্তি। ওয়ালী ন্যাপ সমর্থক ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়াপন্থিরাও এতে যোগদান করেছিল। তবে বিস্ময়কর ঘটনা ছিল আইয়ুব-মোনায়েম খানের ছাত্র সংগঠন এনএসএফ (জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন)-এর একটি অংশের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যোগদান। এনএসএফের এ অংশের নেতা নাজিম কামরান চৌধুরী তখন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রলীগের তোফায়েল আহমেদ ছিলেন ডাকসুর সহসভাপতি। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফায় স্বাক্ষর করে ডাকসু ছাড়া আরও যেসব ছাত্রনেতা তাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রলীগের আবদুর রউফ ও খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপের) সাইফউদ্দিন মানিক ও শামসুদ্দোহা, ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের নূর মোহাম্মদ খান ও নূরুল হাসান।
ছাত্রদের রচিত এগারো দফা তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এগারো দফায় বাংলায় মুক্তির সনদ খুঁজে পায়। ফলে গ্রামের কৃষক এবং মজুর শ্রেণি এতে যোগদান করে। শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরাও উৎসাহ ভরে আইয়ুব-মোনায়েমের ক্ষমতাচ্যুতির এ আন্দোলনকে বেগবান করে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের শহীদের তালিকা দেখলেও শ্রমজীবী ও প্রান্তিক মানুষের এ আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার গভীরতাটি উপলব্ধি করা সম্ভব হয়।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে তিনটি মৃত্যু সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিল। এর মধ্যে প্রথম ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানের মৃত্যু (২০ জানুয়ারি ১৯৬৯), দ্বিতীয় নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র কিশোর মতিয়ুর রহমান (২৪ জানুয়ারি ১৯৬৯) এবং তৃতীয় মৃত্যুটি ছিল একজন কিশোরী মাতার, আনোয়ারা বেগম (২৫ জানুয়ারি ১৯৬৯), শিশুসন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো অবস্থায় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায় মারা যান। শহীদ আনোয়ারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন খেটে খাওয়া ঘরের গৃহবধূ ছিলেন। জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতি বছরই আন্দোলন-সংগ্রামে কেউ না কেউ নিহত হয়েছে। শত শত মানুষ আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। ১৯৬০ সালে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে আটজন নিহত হয়েছিল। ১৯৬১ সালে নিহত হয় দুজন। ১৯৬২ সালে ৬ জন। ১৯৬৩ সালে ৯ জন। ১৯৬৫ সালে ২০ জন। ১৯৬৬ সালে ১২ জন। ১৯৬৭ সালে ২ জন। ১৯৬৮ সালে ১৫ জন। ১৯৬৯ সালে নিহত হয় ৬১ জন। এ পরিসংখ্যান সংবাদপত্রের সংবাদের ভিত্তিতে, অন্তত যে কয়টি মৃত্যু সংবাদপত্র পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিল।৩ একটি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছিল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে মৃত্যুর সংখ্যা ৬০০-এর অধিক।৪
গণ-অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিল ছাত্ররা। প্রায় ২১ জন ছাত্র এ আন্দোলনে আত্মাহুতি দিয়েছিল। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিকের রক্তদানের সংখ্যা আরও বড়, প্রায় ৩৪ জন। এর মধ্যে ২৯ জন শ্রমিক, ৩ জন কৃষক, একজন মজুর পরিবারের গৃহবধূ এবং একজন সাধারণ নিরণ্ন মানুষ, যার কোনো পরিচয়ই পাওয়া যায়নি। শ্রমিকদের মধ্যে হোটেলের বয় একজন, আইসক্রিম বিক্রেতা একজন, দরজি দোকানের কর্মচারী একজন, নৌকার মাঝি একজন, দোকানের সেলসম্যান একজন, সাইকেল মিস্ত্রি একজন, প্রেসকর্মী একজন, কাঠমিস্ত্রি একজন, ওয়াপদার কর্মচারী একজন, সাধারণ শ্রমিক ২০ জন। পরিসংখ্যানটি প্রান্তিক জনগণের আত্মাহুতির একটি বিরল চিত্র। দুনিয়ার রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এমন আত্মদানের ঘটনা তুলনা রহিত। তাদের আত্মদান ও রক্তের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল স্বৈরাচার আর এর মাধ্যমে নতুন এক সম্ভাবনা স্বাধীনতার সূর্যকেই অবলোকন করতে পায় তৎকালীন পূর্ববাংলার জনগণ। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এভাবেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবদানে গৌরবান্বিত হয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
এই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের উত্তালপর্বে আওয়ামী লীগের ৬-দফা আর ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে বের করে আনতে স্লোগান ওঠে‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কারামুক্তির পর শেখ মুজিব ছাত্রদের ১১ দফায় পরিপূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেন। ৬-দফা আর ১১-দফার ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন জোয়ার সৃষ্টি হয় এবং সত্তরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।
তথ্যসূচি
১. মুহাম্মদ আইয়ুব খান : প্রভু নয় বন্ধু, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচি-ঢাকা, ১৯৬৮, পৃষ্ঠা : ১৩০।
২. ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও কবিয়াল, বয়াতি এবং অন্য লোকশিল্পীরা যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে লোকগানের আয়োজন করে অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসে তার মূল্যায়ন হয়নি।
৩. দৈনিক পূর্বদেশ ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ এবং দৈনিক ইত্তেফাক ২০ জানুয়ারি ১৯৭০।
৪. মোহাম্মদ ফরহাদ : ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা : ১১৯।
লেখক : গবেষক ও লেখক
শেয়ার করুন
মোহাম্মদ হাননান | ২০ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

বিশ শতকের ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া জনবিস্ফোরণ দুনিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান’ বলে পরিচিতি লাভ করে। এ অভ্যুত্থানে সমগ্র পাকিস্তানে দুই অংশের জনগণই অংশগ্রহণ করে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রামী মানুষের ভূমিকা ও অবদানটি ছিল সর্বগ্রাসী। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা জেনারেল আইয়ুব খান এবং তার বিশ্বস্ত অনুচর মোনায়েম খানের মসনদকে তা ভেঙে চুরমার করে দেয়। এই প্রথম পাকিস্তানের কোনো গণ-আন্দোলন একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে বিকাশ লাভ করে, যার রাজনৈতিক তাৎপর্য বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যেও দোলাচল সৃষ্টি করে।
এই গণ-আন্দোলনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তা ১৯৬৮ সালের নভেম্বর মাস থেকে শুরু হয়ে ১৯৬৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত লাগাতার চলেছিল। সমগ্র পাকিস্তানে এর আগে কোনো আন্দোলন এতটা দীর্ঘ সময় ধরে চলেনি, গুনে গুনে ঠিক পাঁচ মাস একটি আন্দোলন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলার অর্থই ছিল সাধারণ প্রান্তিক মানুষের এতে স্বতঃস্ফূর্ত সম্পৃক্ততা। এই সম্পৃক্ততার কারণে ঠিক এর দুবছরের মধ্যেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একটা সশস্ত্র লড়াইয়ে নেমে পড়ে যার একটা মহড়া হয়ে যায় ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এ গণ-অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ শাহাদতবরণ করে এবং এই সংখ্যা ৬০০ জনেরও অধিক ছিল। গণ-অভ্যুত্থান সফল করতে সে দিনগুলোতে লাগাতার হরতাল পালিত হয়। হরতালের বাইরে আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের একটানা কারফিউ জারিও জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়। কিন্তু প্রান্তিক জনগণ খুশি মনেই এ কষ্ট সহ্য করে। সারা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছিল, এর প্রধান শিকার হয় প্রান্তিক জনগণ। কিন্তু তারা বৃহত্তর স্বার্থে এটি মেনে নেয়। প্রান্তিক মানুষের মধ্যে মরণপণ সংগ্রামী চেতনা জেগে উঠেছিল, ফলে অভ্যুত্থান সার্বিকভাবে সফলতা লাভ করে।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মূল চাবিকাঠি ছিল ছাত্রদের হাতে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছাত্ররা এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের প্রধান স্লোগান ছিল ‘৬ দফা-১১ দফা মানতে হবে’। সর্ব শ্রেণির মানুষ ও সব পেশার জনগণ এ সেøাগানের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানায়। এর পেছনে প্রধান কারণগুলো ছিল সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক সমস্যাকে দফাগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১১ দফার ৩ নম্বর দফাটির ‘ক-চ’ পর্যন্ত ছিল আওয়ামী লীগের নিজস্ব ৬ দফার হুবহু ক্রমানুসরণ। এগুলো ছিল জাতীয় দাবি। এত দিনে পূর্ববাংলার মানুষ তা বুদ্ধিজীবী থেকে সাধারণ কৃষি-মজুর পর্যন্ত বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা পূর্ব পাকিস্তানকে ঢালাওভাবে শোষণ করছে। এর প্রতিকারে শেখ মুজিবের ছয় দফা হলো একমাত্র ওষুধ। ১১ দফার বাকি দশটি দাবি ছিল সরাসরি ছাত্র ও সাধারণ জনগণের সমস্যাকেন্দ্রিক। ছাত্রদের জনপ্রিয় দাবিটি ছিল তৃতীয় বিভাগের উত্তীর্ণ ছাত্রদের উচ্চশিক্ষায় ভর্তি বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা বাতিল করা। বস্তুত এর প্রধান শিকার হয়েছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানরা। আর্থিক অবস্থা এবং দেশের গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানরা পরীক্ষার ফলাফল খারাপ করছিল। একমাত্র ১৯৬২-৬৩ সালের শিক্ষাবছরে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মাত্র ২৭ দিন ক্লাস হয়েছিল।১ পাশাপাশি ছাত্রবেতন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। খুব স্বাভাবিক কারণেই প্রান্তিক মানুষের সন্তানরা এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রান্তিক পর্যায়ে বিদ্রোহ গড়ে ওঠার এটিও একটি বড় কারণ ছিল।
একই সঙ্গে খাজনা-ট্যাক্স আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং বকেয়া খাজনা ও ঋণে কৃষকরা জর্জরিত হয়ে পড়ে। আইয়ুব-মোনায়েম সরকার জমিতে যে সার্টিফিকেট প্রথা চালু করেছিল তাতেও কৃষকরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তহসিলদারদের অত্যাচার সুদূর পল্লীর গরিব মজুরদের মধ্যেও হানা দেয়। পাটের মূল্য ষাটের দশকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছিল। আখচাষিদের জন্যও ছিল সমান দুর্গতি। কৃষকদের এ সমস্যাগুলো ১১ দফার ৬ নম্বর দাবিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। শ্রমিকদের স্বার্থবিরোধী নানা কালাকানুন করা হয়েছিল। ধর্মঘটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় এবং ট্রেড ইউনিয়নও করা যাবে না বলে ঘোষণা এসেছিল। শ্রমিকরা বোনাস তো পেতই না, বরং ন্যায্য মজুরি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছিল তারা। ১১ দফার ৭ নম্বর দাবিতে শ্রমিকরা এর প্রতিফলন দেখতে পায়। দফাগুলোতে সমস্যা অন্তর্ভুক্তকরণই যথেষ্ট ছিল না, বরং এ রকম দাবি এর আগেও অনেক রাজনৈতিক দল ও জোট করে আসছিল। কিন্তু ১৯৬৮-৬৯ সালে দাবিগুলো ছাত্ররা প্রান্তজনের কাছে অনেক আবেগের সঙ্গে পৌঁছে দিয়েছিল। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বুঝতে সক্ষম হয় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ মুসলিম হলেও ‘ভাই-ভাই’ নয়। অথবা ছোট ভাই বড় ভাইকে ঠকিয়ে খাচ্ছে। জনসংখ্যায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছিল বেশি, তাই পূব পাকিস্তানিরাই ছিল বড় ভাই। সাধারণ কৃষক-মজুর এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নেয়।
তৎকালীন বাংলার জারি-সারিগানের বয়াতি শিল্পীরাও তৃণমূলপর্যায়ে গেয়ে গেয়ে কৃষক-মজুরদের কাছে এসব ঘটনা ও বৈষম্য তুলে ধরেছিল। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এতে সংগ্রামী চেতনায় আপ্লুত হয়ে পড়ে। আর বয়াতিরা ছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরই একটি অংশ। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস রচনায় বয়াতি শিল্পীদের এ ভূমিকা অনেকটা বিস্মৃত হয়েই আছে। ২
প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ও গভর্নর মোনায়েম খানবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোও একটি জোট করেছিল। এর নাম দেওয়া হয়েছিল গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ (Democratic Action Committee), সংক্ষেপে ‘ডাক’ নামেই তা পরিচিত হয়েছিল। এতে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপ ছয়-দফাপন্থি এবং পিডিএমপন্থি উভয়েই স্বাক্ষর করে। রুশপন্থি বলে পরিচিত ওয়ালী ন্যাপ এর সদস্য হয়। কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীও এতে শরিক ছিল। এ ছাড়া জামায়াতে উলামায়ে ইসলাম ও এবং নেজামে ইসলামও এতে সক্রিয় ছিল। কিন্তু তারা ছাত্রদের ছয় দফা ও এগারো দফা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। চীনপন্থি বলে পরিচিত ভাসানী ন্যাপ এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি জোটে না থাকলেও ছয় দফা ও এগার দফা মানতে অস্বীকৃতি জানায়।
তবে ভাসানী ন্যাপ সমর্থক ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) ছয় দফার ব্যাপারে আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যোগদান করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে বড় সংগঠন ছিল ছাত্রলীগ। ডাকসুতে তখন ছাত্রলীগ ও সরকারি ছাত্র সংগঠন এনএসএফ ক্ষমতায় ছিল। এটা ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি বাড়তি শক্তি। ওয়ালী ন্যাপ সমর্থক ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়াপন্থিরাও এতে যোগদান করেছিল। তবে বিস্ময়কর ঘটনা ছিল আইয়ুব-মোনায়েম খানের ছাত্র সংগঠন এনএসএফ (জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন)-এর একটি অংশের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যোগদান। এনএসএফের এ অংশের নেতা নাজিম কামরান চৌধুরী তখন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রলীগের তোফায়েল আহমেদ ছিলেন ডাকসুর সহসভাপতি। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফায় স্বাক্ষর করে ডাকসু ছাড়া আরও যেসব ছাত্রনেতা তাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রলীগের আবদুর রউফ ও খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপের) সাইফউদ্দিন মানিক ও শামসুদ্দোহা, ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের নূর মোহাম্মদ খান ও নূরুল হাসান।
ছাত্রদের রচিত এগারো দফা তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এগারো দফায় বাংলায় মুক্তির সনদ খুঁজে পায়। ফলে গ্রামের কৃষক এবং মজুর শ্রেণি এতে যোগদান করে। শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরাও উৎসাহ ভরে আইয়ুব-মোনায়েমের ক্ষমতাচ্যুতির এ আন্দোলনকে বেগবান করে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের শহীদের তালিকা দেখলেও শ্রমজীবী ও প্রান্তিক মানুষের এ আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার গভীরতাটি উপলব্ধি করা সম্ভব হয়।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে তিনটি মৃত্যু সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিল। এর মধ্যে প্রথম ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানের মৃত্যু (২০ জানুয়ারি ১৯৬৯), দ্বিতীয় নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র কিশোর মতিয়ুর রহমান (২৪ জানুয়ারি ১৯৬৯) এবং তৃতীয় মৃত্যুটি ছিল একজন কিশোরী মাতার, আনোয়ারা বেগম (২৫ জানুয়ারি ১৯৬৯), শিশুসন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো অবস্থায় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায় মারা যান। শহীদ আনোয়ারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন খেটে খাওয়া ঘরের গৃহবধূ ছিলেন। জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতি বছরই আন্দোলন-সংগ্রামে কেউ না কেউ নিহত হয়েছে। শত শত মানুষ আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। ১৯৬০ সালে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে আটজন নিহত হয়েছিল। ১৯৬১ সালে নিহত হয় দুজন। ১৯৬২ সালে ৬ জন। ১৯৬৩ সালে ৯ জন। ১৯৬৫ সালে ২০ জন। ১৯৬৬ সালে ১২ জন। ১৯৬৭ সালে ২ জন। ১৯৬৮ সালে ১৫ জন। ১৯৬৯ সালে নিহত হয় ৬১ জন। এ পরিসংখ্যান সংবাদপত্রের সংবাদের ভিত্তিতে, অন্তত যে কয়টি মৃত্যু সংবাদপত্র পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিল।৩ একটি রিপোর্টে দাবি করা হয়েছিল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে মৃত্যুর সংখ্যা ৬০০-এর অধিক।৪
গণ-অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিল ছাত্ররা। প্রায় ২১ জন ছাত্র এ আন্দোলনে আত্মাহুতি দিয়েছিল। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিকের রক্তদানের সংখ্যা আরও বড়, প্রায় ৩৪ জন। এর মধ্যে ২৯ জন শ্রমিক, ৩ জন কৃষক, একজন মজুর পরিবারের গৃহবধূ এবং একজন সাধারণ নিরণ্ন মানুষ, যার কোনো পরিচয়ই পাওয়া যায়নি। শ্রমিকদের মধ্যে হোটেলের বয় একজন, আইসক্রিম বিক্রেতা একজন, দরজি দোকানের কর্মচারী একজন, নৌকার মাঝি একজন, দোকানের সেলসম্যান একজন, সাইকেল মিস্ত্রি একজন, প্রেসকর্মী একজন, কাঠমিস্ত্রি একজন, ওয়াপদার কর্মচারী একজন, সাধারণ শ্রমিক ২০ জন। পরিসংখ্যানটি প্রান্তিক জনগণের আত্মাহুতির একটি বিরল চিত্র। দুনিয়ার রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এমন আত্মদানের ঘটনা তুলনা রহিত। তাদের আত্মদান ও রক্তের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল স্বৈরাচার আর এর মাধ্যমে নতুন এক সম্ভাবনা স্বাধীনতার সূর্যকেই অবলোকন করতে পায় তৎকালীন পূর্ববাংলার জনগণ। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এভাবেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবদানে গৌরবান্বিত হয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
এই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের উত্তালপর্বে আওয়ামী লীগের ৬-দফা আর ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে বের করে আনতে স্লোগান ওঠে‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কারামুক্তির পর শেখ মুজিব ছাত্রদের ১১ দফায় পরিপূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেন। ৬-দফা আর ১১-দফার ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নতুন জোয়ার সৃষ্টি হয় এবং সত্তরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।
তথ্যসূচি
১. মুহাম্মদ আইয়ুব খান : প্রভু নয় বন্ধু, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচি-ঢাকা, ১৯৬৮, পৃষ্ঠা : ১৩০।
২. ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও কবিয়াল, বয়াতি এবং অন্য লোকশিল্পীরা যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে লোকগানের আয়োজন করে অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসে তার মূল্যায়ন হয়নি।
৩. দৈনিক পূর্বদেশ ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ এবং দৈনিক ইত্তেফাক ২০ জানুয়ারি ১৯৭০।
৪. মোহাম্মদ ফরহাদ : ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা : ১১৯।
লেখক : গবেষক ও লেখক