১. শিকাগোর ‘সাউথ সাইড’ এলাকায় জন্ম নেওয়া অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে মিশেল রবিনসনের পৃথিবীতে মা ম্যারিয়ান রবিনসন, বাবা ফ্রেশার রবিনসন আর ভাই ক্রেইগ যখন ছিলেন তখনো তিনি ততটা টের পাননি শুধুমাত্র গায়ের রং কালো হওয়ার সুবাদে ঠিক কী কী ধরনের পরিচয়সংকটে তিনি পড়তে পারেন বা চারপাশের পৃথিবীর ঠিক কী কী ধরনের চাপ তাকে মোকাবেলা করতে হবে ভবিষ্যতে। তাকে বড়রা জিজ্ঞেস করত, সবচেয়ে স্টুপিড প্রশ্নটি, ‘তুমি কী হতে চাও বড় হয়ে?’ প্রশ্নটাই এমন যে, তুমি এখন কিছু না। একদিন বড় হয়ে কিছু একটা হবে এবং সেটাই শেষ গন্তব্য!
২. যৌথ পরিবারের নিচতলায় তার খালা রাব্বি পিয়ানো শেখাতেন বাচ্চাদের। ঠিক ওপরতলার রুমটিই মিশেলের হওয়ার সুবাদে সারাক্ষণই সেই একঘেয়ে একই সুর, তাল, খালার চেঁচামেচি ছিল মিশেলের নিত্যসঙ্গী। নিরুপায় মিশেলের সব মুখস্ত হয়ে গিয়েছে অচিরেই। কাজেই খালা যোিদন ওর হাতেখড়ির জন্য ডাকলেন মিশেল খুব দ্রুতই তা ধরে উঠতে পারলেন। এখন সেটাই কাল হলো তার! এখন পিয়ানোতে কোনো ছাত্র-ছাত্রী ভুল করামাত্র তার মেজাজি খালা ছোট্ট মিশেলকে খুঁজতে থাকতেন সেটা বাজিয়ে ছাত্রদের লজ্জা দেওয়ার জন্য!
৩. গত বছরের শেষভাগে নিউইয়র্কের ক্রাউন প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হওয়া ৪১৬ পৃষ্ঠার হইচই ফেলে দেওয়া বই ‘বিকামিং মিশেল ওবামা’ এই প্রশ্নের উত্তরই দিয়েছে যেন! জীবনে নানা পেশায়, নানাভাবে সময় ব্যয় করেছেন তিনি। নিজের পরিচয় দেন এভাবে যে, আমি একজন কালো আইনজীবী, হাসপাতালের ভাইস প্রেসিডেন্ট, উন্নয়নকর্মী, আফ্রিকান-আমেরিকান নারী, প্রেমিকা, স্ত্রী, মা, ফার্স্টলেডি ইত্যাদি ইত্যাদি ছিলাম। তিনি বলেন, জীবনের প্রতিটা মুহূর্তেই মানুষ ‘হয়ে ওঠে’; এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, তিনিও হয়ে উঠেছেন মিশেল ওবামা, এবং এখনো তা চলছে। গোটা বইয়ে মিশেল ওবামা নামের যে মানুষটিকে দেখি, তিনি অতি সাদাসিধে আটপৌঢ়ে একজন মানুষ যার সৎসাহস আছে জীবনে ওবামা আসার আগে তার পূর্ব-প্রেম, যৌনসম্পর্ক নিয়ে, বিবাহ-পরবর্তী দাম্পত্য সংকট, হোয়াইট হাউসের তথাকথিত জাঁকজমক জীবনে শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার মতো অবস্থা নিয়ে খোলাখুলিভাবে লিখবার। নিজের জীবনই তিনি লিখেছেন এ বইয়ে, যতটা সম্ভব খোলাখুলি লেখা যায়, ততটাই। বই প্রকাশ-পরবর্তী অপরা উনফ্রে’র সঙ্গে এই ইন্টারভিউতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ভান-ভণিতা চলে না, এসব বলতে হবে, কারণ পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের খুঁটিয়ে দেখছে।’
৪. বারাক ওবামার সঙ্গে তার পরিচয় যখন হয় তিনি তখন মাত্র একটি ল’ ফার্মে কাজে ঢুকেছেন। বারাক তখন মাত্র হার্ভার্ড ল’ স্কুলের প্রথম বর্ষ শেষ করেছেন। এক্সট্রা-অর্ডিনারি ছাত্র হিসেবে শিক্ষকের তদবিরের চিঠি নিয়ে তিনি সামার জব করার জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন। পরে বারাকের নানারকম কাজের দেখাশোনার ভার মিশেলের ওপর বর্তায়। সে সময় তাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয় এবং সামার জবের শেষদিকে বারাকের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলে, একদিন বারাককে গাড়িতে লিফট দিতে গেলে, গ্রীষ্মের সেই সন্ধ্যায় এক আইসক্রিমের দোকানে আইসক্রিম খাওয়া শেষে বারাক মিশেলকে বলেন, ‘আমি কি তোমাকে চুমু খেতে পারি?’
৫. খুবই সাধারণ পরিবার থেকে আসা কৃষ্ণাঙ্গ এই নারী ২০০৮ সালে ফার্স্টলেডি হয়ে হোয়াইট হাউসে এসে হকচকিয়ে যান! এই প্রথম কোনো কালো-দম্পতি তথাকথিত ‘হোয়াইট হাউসে’ পা রাখলেন যা আমেরিকার ইতিহাসে কল্পনারও অতীত ছিল বলা চলে! মিশেল অত্যন্ত ভীত আর স্ট্রেসড হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি, বলাই বাহুল্য কালো হওয়ার সুবাদে অতিরিক্ত নজরদারিতে থাকবেন! তিনি বারাককে প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়েও যোগ দিতে বারণ করেছিলেন খানিকটা এ সব কারণেই।
তো, হোয়াইট হাউসে প্রতিটা মুহূর্তে বন্দুক-অস্ত্রশস্ত্র হাতে নির্লিপ্ত চেহারার প্রহরীর চোখের ওপর থাকা, প্রতিটি জানালা-দরজা কঠিন-গুলিপ্রুফ কাচ দিয়ে বন্ধ রাখা, প্রতিটা পদক্ষেপ সিকিউরিটিকে জানিয়ে ফেলা, এমনকি বারান্দায় গেলে বা জানালায় দাঁড়ালে সিকিউরিটির অনুমতি নেওয়া...বাচ্চাদের স্কুলের প্রতিটা ইভেন্টে সিকিউরিটির অনুমতি-উপস্থিতি ইত্যাদি ব্যাপারগুলো সাদাসিধে জীবনযাপন-করা মিশেলকে দমবন্ধ অবস্থায় ফেলে!
অঢেল ঐশ্বর্য আর চকমকি জীবন, বারাককে ‘পৃথিবীর ঈশ্বর’-এর অবস্থায় সঁপে দেওয়া তার কাছে মনে হতে থাকে চরকিতে চড়ে বসার মতো! বারাককে তো আগের মতো কাছে পানই না, উপরন্তু বারাককে পৃথিবী শাসনের জন্য সর্বদা প্রস্তুত রাখাও যেন মিশেলের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে! তিনি পরিষ্কার লিখেছেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্টই প্রথম-প্রধান-শেষ গুরুত্বপূর্ণ, তার স্ত্রীর কোনো কোনো ‘রোল’ বলা নেই কোথাও!
তাকে শুধুই অ্যাডজাস্ট করতে হচ্ছে প্রতিটা পদক্ষেপে! যদিও পুরো পৃথিবী তাকে জাজ করছে তার পোশাক, চুল, স্টাইল ইত্যাদি নিয়ে। তিনি বলেন, ‘আমাদের গায়ের রং সবসময়ই আমাদের একধরনের দুর্বল করে রাখত।’
তার পরও মাটির কাছাকাছি থাকতে চাওয়া এই নারী নিজের মতো করে পাওয়া সময়টুকুতে মাটির কাছাকাছি থেকে হোয়াইট হাউসে নিজের হাতে বাগান করেছেন, বাচ্চাদের শিক্ষাবিস্তার, গান, ভায়োলেন্স রোধ, মানসিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে নানা সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
৬. সিংহাসন ছাড়ার পর যখন তিনি নিঃশ্বাস ফেলার সময় পান এবং পেছন ফিরে তাকিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করার সুযোগ পান, তখন দেখতে পান মিডিয়া তাকে অভিহিত করছে ‘সবচেয়ে শক্তিমান নারী’ অথবা ‘রাগী কালো নারী’ হিসেবে। তিনি লেখেন, ‘আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে তাদের কাছে কোন অংশটি তাদের গায়ে সবচেয়ে জ্বালা ধরায় ‘রাগী’ না ‘কালো’ নাকি ‘নারী’?
লেখক : কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক