অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘দৃষ্টি ও সৃষ্টি’ প্রবন্ধে নানান জাতের ‘দেখা’র সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বসংসারে কে দেখে, কেমন করে দেখে, কী দেখে, কী দেখতে চায়, কী দেখাতে চায়। তিনি লিখলেন, ‘বিশ্বজগৎ একটা নিত্য উৎসবের মধ্য দিয়ে নতুন-নতুন রসের সরঞ্জাম নিয়ে ভাবুকের কাছে দেখা দেয় এবং সেই দেখা ধরা থাকে ভাবুকের রেখার টানে লেখার ছাঁদে বর্ণে ও বর্ণনে, কাজেই বলা চলে বুদ্ধির নাকে চড়ানো চলতি চশমার ঠিক উল্টো এবং তার চেয়ে ঢের শক্তিমান চশমা হলো মনের সঙ্গে যুক্ত ভাবের চশমাখানি।’ এমনই এক ভাবুকের লেখার ছাঁদের মধ্য দিয়ে বর্ণে ও বর্ণনে দেখা গেল একটা বিশেষ সময়ের বিশেষ মানুষজন বা জনপদকে। ভাবুক বলা জুৎসই এই জন্য যে, তিনি লেখকদের চলতি তালিকায় নিয়মিত নন। লেখাগুলো পড়তে পড়তে বোঝা যায়, বেশ আয়োজন করে, আটঘাট বেঁধেও তিনি লিখতে বসেননি। নিতান্ত ভাবের চাপে পড়েই হয়তো জীবনের খ- খ- সময়কে ফ্রেমবন্দি করতে চেয়েছেন। কিন্তু কেবল সময় কি আদতে বাঁধা পড়ে মানুষের হাতে? আসলে তো বাঁধা পড়ে সেই সময়ের মানুষগুলো, মানুষের নির্মিত ঘটনাগুলো কিংবা প্রকৃতির ঘটানো কোনো বিশেষ ঘটনার মুখে ক্রিয়াশীল মানবিক কর্মকা-গুলো। প্রতিমা ঘোষ এক নামে পরিচিত কোনো লেখক নন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের মেধাবী শিক্ষার্থী। পেশাগত জীবনে শিক্ষক। ব্যক্তিগত জীবনে বাংলা ভাষার একজন শক্তিমান কবির বন্ধু এবং সংসারের সহযাত্রী। কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে অন্য এক ‘ভাবুক’ পরিচয়ে পাঠককে তিনি অনায়াসে পরিয়ে দিতে পারেন তার ‘ভাবের চশমাখানি’।
নিয়মিত লেখক নন এমন নারীদের লেখাগুলো সাধারণত হয়ে ওঠে আত্মজীবনীমূলক। জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা, বিচ্ছেদ-বেদনা, বঞ্চনা-সংগ্রাম, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির দীর্ঘ বয়ান থাকে তাতে। ২০১৬ সালে কলকাতার পাঠক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত প্রতিমা ঘোষের সেইসব কথাও এককথায় আত্মজীবনীমূলক বই। এবার পুনরায় শুরুর প্রসঙ্গে ফেরা যাক, জীবনের কোন খ-চিত্র দেখাতে চাইলেন তিনি? মনে পড়ে, জীবনানন্দ দাশের কবিতা, ‘মানুষেরা ঢের যুগ কাটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে,/ দেয়ালে তাদের ছায়া তবু/ ক্ষতি, মৃত্যু, ভয়,/ বিহ্বলতা ব’লে মনে হয়।’ এই ঢের যুগ কাটানো বিহ্বল মানুষ নিজস্ব দিনযাপনের অজস্র গল্পের ভেতর থেকে ঠিক কোন কোন গল্পগুলো বাছাই করতে পারে? কেমন করে পারে? বয়েস বাড়তে থাকলে জীবনের পান্ডুলিপি গোছানোর আয়োজন শুরু হয় যখন, ‘তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙ ঝিলমিল’ করে ওঠে। যাপিত জীবনের দিকে ‘ভাবের চশমাখানি’ পরে নতুন করে তাকাতে হয়। অবন ঠাকুর যেমন বলছেন, ‘দেখা শোনা পরশ করার চরম হয়ে গেল, তারপর এলো দেখানোর পালা। মানুষ এবারে আর-এক নতুন অদ্ভুত অনিয়ন্ত্রিত অভূতপূর্ব সৃষ্টি সাধন করে গুণী শিল্পী হয়ে বসলো।... যে এতদিন দর্শক ছিল সে হলো প্রদর্শক, দ্রষ্টা হয়ে বসলো দ্বিতীয় স্রষ্টা।’ মহাকালের ঢের যুগের দর্শক ও দ্রষ্টা প্রতিমা ঘোষের প্রদর্শক ও দ্বিতীয় স্রষ্টা হয়ে ওঠার স্মারক হয়ে আছে সেইসব কথা বইটি।
কী সব কথা বলতে চেয়েছেন তিনি? মানুষের কথা? মানুষেরাই বা কারা? ঘটনার কথা? কোন ঘটনা? ভূমিকাতে প্রতিমা ঘোষ লিখেছেন, ‘অল্প কয়েকটি লেখা নিয়ে আবারও একটা বই প্রকাশ করছে পাঠক। কেন, সেটা জানি না।’ আশ্চর্য সরল প্রশ্ন। কী মূল্য আছে এইসব লেখার সে বিষয়ে যেন তিনি নিজেই সন্দিহান! তারপর লিখছেন,‘ এসব কথা নিতান্তই ব্যক্তিগত স্মৃতি। তিনটে আমাদের ছাত্রবয়সের আর তিনটে উত্তরকালের। ব্যক্তিকে সরিয়ে রেখে যদি নিছক কালের চিহ্ন হিসেবে পাঠকরা লেখাগুলিকে দেখেন তো ভালো হয়।’ ‘নিতান্তই’, ‘ব্যক্তিকে সরিয়ে’ আর ‘নিছক কালের চিহ্ন’ শব্দগুলো ব্যবহারের মধ্যেও যেন দারুণ সংকোচ আর নিজেকে অপ্রকাশের বাসনা উচ্চারিত হলো।
ছয়টি লেখার প্রথমটি ‘সেইসব মাস্টারমশাই’। দূর মফস্বল জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. পড়তে আসা এক বিস্ময়-বিমূঢ় ছাত্রীর স্মৃতিচারণ। এত দূর থেকে মেয়েকে কলকাতায় পড়তে পাঠাবার কথা অভিভাবকরা তখন সহজে ভাবতেই পারতেন না। পথঘাট মোটেই সহজ ছিল না তখন। ‘কত-যে ঘুরে আসতে হত! নকশালবাড়ির পাশ দিয়ে, কাটিহার কাটিয়ে, মণিহারী ঘাটে নেমে, দুর্গম বালুপথ পেরিয়ে বড়োসড়ো দোতলা ফেরিতে গঙ্গাপার, তারপর সকরিগলি ঘাটে নেমে আবারও বালি পেরিয়ে তিনপাহাড়ে’র পাশ দিয়ে আসা কলকাতার ট্রেন।’ কিন্তু মনে হতো, ইতিহাসে-পড়া ঘরবাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটাচলা করতে পেরে আর বিখ্যাত সব মানুষের ক্লাসে উপস্থিত থাকার আনন্দে পথের সমস্ত কষ্ট মুছে যেত কলকাতায় পৌঁছে। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, শশীভূষণ দাশগুপ্ত, প্রমথনাথ বিশী, সুকুমার সেন প্রমুখ বিখ্যাত সব শিক্ষকদের ক্লাসে মুগ্ধ হয়ে ভুলে যেতেন একান্নবর্তী বাড়ির হাতছানি। ছাত্রছাত্রীদের ‘আপনি’ করে বলতেন সুকুমার সেন। এই সম্বোধনে যেমন নতুনত্বের স্বাদ ছিল তেমনি পড়া না পারলে এই সম্বোধনটিকেই কেমন নির্দয় লাগত। জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন শশীভূষণ দাশগুপ্ত কেননা তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘চিন্তা’ ছড়িয়ে দিতে পারতেন। বলতেন, ‘তথ্য জানা দরকার। কিন্তু লেখার সময় তথ্যের দাস হয়ে থাকবে না। আমরা দেখতে চাই তথ্যকে তোমার কতটা দাস করতে পেরেছ।’ এই শিক্ষকের ক্লাসেই তিনি আর তার সহপাঠী বন্ধুরা পেয়েছিল ‘স্বাধীনভাবে চিন্তা করার মুক্তি।’ এছাড়া প্রমথনাথ বিশীর ক্লাসে রবীন্দ্র তত্ত্বের সহজ ব্যাখ্যা আর শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৎসম শব্দ প্রীতি, শিক্ষকদের পড়ানোর কৌশল, পঠন-পাঠনের বর্ণনা যে-কোনো সাহিত্যের শিক্ষার্থীকে ঈর্ষাকাতর করে তুলবে। এ লেখাতেই আছে সহপাঠী বন্ধু শঙ্খ ঘোষের দুষ্টুমি আর বিশেষ ছাত্র হিসেবে মাস্টারমশাইদের নজরে পড়ার কথা। আর আছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে থাকা চারপাশের স্মৃতিময় ঐতিহাসিক নগর কলকাতার চিত্র।
‘কলকাতার বন্ধুরা’তে এম.এ. পরীক্ষা শেষে বোম্বাইয়ে দাদার কাছে বেড়াতে যাবার পর বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া চিঠির সূত্র ধরে ১৯৫৪ এর কলকাতাকে পাঠকের সামনে হাজির করেন প্রতিমা ঘোষ। শিক্ষক ধর্মঘটের সমর্থনে তার সাত বন্ধুর অংশগ্রহণ এবং বিস্তারিত চিঠিতে জানানোর মধ্য দিয়ে বন্ধুদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে কেননা, তিনি লিখছেন, ‘আমাদের প্রজন্মের সবাই দেশভাগের প্রত্যক্ষ শিকার।’ গুণী বন্ধু, দলছুট বন্ধু বা অকালে প্রাণ হারানো বন্ধু স্মৃতিতে বন্ধুত্ব নামক সম্পর্কটির নতুনতর একটা মানে তৈরি হয়ে যায়।
এমনিভাবে, ‘সাহিত্য-পাঠের দিকে’ লেখাটিতে লিখেছেন শৈশবে তার বাড়িতে-স্কুলে অবাধ পড়তে পারার স্বাধীনতা আর আনন্দের কথা। ‘জলপাইগুড়ির-জলস্রোতে’ প্রবন্ধে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাছে অবহেলিত জলপাইগুড়িতে বন্যাক্রান্ত দুর্ভোগের বর্ণনা রয়েছে। এ প্রবন্ধে জলপাইগুড়ির বন্যায় বৈরী সম্পর্কের প্রতিবেশী শিলিগুড়ির কাছ থেকেই প্রথম সাহায্য পাওয়ায় কৃতজ্ঞতার কথা যেমন আছে তেমনি আছে আজকের বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী ঔপন্যাসিক দেবেশ রায়ের বিপ্লবী ভূমিকার প্রসঙ্গ। ‘নিত্যই প্রিয় যে-অসীম’ প্রবন্ধটি মূলত একজন ব্যক্তিকে নিয়েই লেখা। সম্পর্কে এই অসীম তার দেবর। অর্থাৎ, শঙ্খ ঘোষের অনুজ। ঠিক বৌদি হিসেবে নয়, তীক্ষ মেধাসম্পন্ন রবীন্দ্রপ্রিয় এই মানুষটির লেখালেখি, ব্যক্তি জীবন, বন্ধুবৃত্তের পরিচয় ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অসীমকে আবিষ্কার করেছেন তিনি এ লেখায়। ‘সাহিত্য-পাঠের দিকে’ প্রবন্ধে প্রতিমা ঘোষের বাবার বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির জীবনচর্যার খানিকটা খোঁজ মেলে। ‘বারে বারে শিমলা-মানালি’ পড়তে পড়তে দু’বারে দেখা শিমলা-মানালির বদলে যাওয়াগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাঠকের চোখেও। প্রকৃতির সৌন্দর্যের বর্ণনা তো আছেই আর আছে মানুষের স্বভাবগত সৌন্দর্যের খোঁজ। পাঠক জেনে যায়, কোন পরিবেশে লেখা হয়েছিল শঙ্খ ঘোষের গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ আর ইকবাল থেকে। আসলে, ছোট এই বইটির ছয়টি প্রবন্ধ পাঠ শেষে নতুন এক ‘দ্রষ্টা’য় নিজেও পরিণত হয় পাঠক।