বই রিভিউ
প্রজন্মের দায় মোচনের পথে ইজাজ মিলন
অধ্যাপক অসীম বিভাকর | ১৫ নভেম্বর, ২০২০ ১৪:৩১
প্রচ্ছদে রূপ ‘১৯৭১ বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং’
‘আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি। তোমার ভয় নেই মা, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি। মা গো ভাবনা কেন? ’
প্রায়-ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি দুঃশাসনের সমাধি রচনার মধ্য দিয়ে মাকে দেওয়া এই প্রতিশ্রুতি সন্তানেরা সেদিন রক্ষা করেছিলেন। যারা জীবন দিয়ে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা দিয়েছিলেন, যাদের মৃত্যুর বিনিময়ে নিশ্চিত হয়েছিল আমাদের বেঁচে থাকা— আমরা সেই মানুষগুলোকে মনে রেখেছি কতটুকু?
এই দেশের জন্য ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। লুণ্ঠিত হয়েছে দুই লাখের বেশি মা-বোনের সম্ভ্রম। এই পরিসংখ্যান আমাদের প্রত্যেকেরই জানা। ত্রিশ লাখ নয়, ত্রিশ হাজার নয়, তিন শত নয়, এখন যদি ত্রিশজন শহীদের পরিচয় জানতে চাই শতকরা কিংবা হাজারে কতজন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি এমন এক বিপ্রতীপ বাস্তবতায় যেখানে সর্বজনীন স্বার্থের কোনো স্থান নেই; যেখানে পরের কারণে স্বার্থ বিসর্জন বিষয় হিসেবে উপহাসযোগ্য; আত্মকেন্দ্রিকতার চর্চা করতে করতে অগোচরেই যেখানে প্রান্তর থেকে আলো হারিয়ে যায়।
এমন এক বৈরী সময়ে বাস করেও ইজাজ আহমেদ মিলনের মননে জেগে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতার বোধ। এ যেন অকৃতজ্ঞ প্রজন্মের অবশ্যপালনীয় কর্তব্যের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া। আমরা যারা দায়িত্বপালনে অপারগতার পরিচয় দিয়েছি কিংবা আত্মপরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছি, তাদের পক্ষ থেকে ইজাজকে অভিনন্দন জানাই।
গবেষণামূলক প্রতিবেদনটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ভালোবাসার যে প্রকাশ দেখিয়েছে দৈনিক মুক্ত সংবাদ, তার জন্য পত্রিকাসংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।
একজন গবেষক একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতকে কেন্দ্র করে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আবিষ্কার করেন খণ্ড থেকে অখণ্ডের অনুভব। ১৯৭১ এ সারা বাংলাদেশই পরিণত হয়েছিল মৃত্যু উপত্যকায়। পাকিস্তানি ঘাতকবাহিনীর সর্বগ্রাসী আক্রমণে গোটা বাংলাদেশই হয়ে উঠেছিল বধ্যভূমি। অগণিত বধ্যভূমির অবিরাম কান্নার এক স্রোত স্থির হয়ে আছে গাজীপুর জেলার সদর থানার অন্তর্গত বাড়িয়া ইউনিয়নের বাড়িয়া গ্রামে। সত্যসন্ধানী সাংবাদিক ইজাজ আহমেদ মিলন বাড়িয়ায় সংঘটিত গণহত্যার বিস্মৃতপ্রায় কাহিনিকে তুলে এনেছেন তার সংবেদনশীল প্রতিবেদনে।
যে বাংলাদেশের পরিচয়ে আমার পরিচয় মহিমান্বিত হয়, যে বাংলাদেশ ভালোবাসার ঘুড়ি উড়াবার জন্য আমাকে একটি মুক্ত আকাশ দিয়েছে, যে বাংলাদেশ আমাকে দিয়েছে দিনের শেষে ক্লান্তি নিবারণের পরম আশ্রয়— সেই বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে যেমন বাঙালির স্বজন হারাবার বেদনামথিত ইতিহাস, পাকিস্তানি বর্বরতার অবর্ণনীয় উপাখ্যান; তেমনি আছে অনতিক্রম্য প্রাচীর ডিঙিয়ে সবুজকে স্পর্শ করা সাহস জাগানিয়া বীরত্বগাথা।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চেয়েছিল পৃথিবীর বুক থেকে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব চিরদিনের জন্য মুছে দিতে। সেই জন্য তারা গ্রহণ করেছিল ‘পোড়ামাটি নীতি’। তারা যখন গণহত্যা সংঘটনের নীলনকশা প্রণয়ন করেছে, ভাবতে অসুবিধা হয় না, সেই স্থানটিকে তারা সমগ্র বাংলাদেশ হিসেবেই কল্পনা করে নিয়েছে। ১৯৭১ সালে পাক হানাদারবাহিনী যে কেবল মানবিকতাকেই অপমান করেছে তা নয়, ছাড়িয়ে গিয়েছিল পশুবৃত্তিকেও। ইজাজ আহমেদ মিলনের আঠারোটি ভিন্ন শিরোনামে বিন্যস্ত প্রতিবেদনের সংকলিত রূপ ‘১৯৭১ বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং’ গ্রন্থে যার প্রমাণ সুপরিস্ফুট। মিলনের শিরোনামই জানিয়ে দেয় অন্তর্গত প্রেক্ষাপটের বেদনাবিধুর ভয়াবহতার কথা।
অতর্কিত হামলায় নিরীহ মানুষকে হত্যা করা কোনো নীতির আলোকেই সমর্থনযোগ্য নয়। ১৯৭১ সালের ১৪ মে শুক্রবার বাড়িয়ার মানুষ শিকার হয়েছিল এমনই এক অনৈতিক আক্রমণের। পাক হানাদারবাহিনী এদিন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান নির্বিশেষে হত্যা করেছিল। বাড়িয়া গ্রামকে পরম মমতায় আলিঙ্গন করে আছে যে বেলাই বিল, সেই বিলের জল সেদিন রক্তে রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল।
প্রতিদিনের মতোই সুচিস্নিগ্ধ বাতাসের স্পর্শে সকাল শুরু হয়েছিল বানু শীলের। সূর্যের মুখে ছিল না কোনো অমঙ্গলের আভাস। তবু সেই দিনই সপরিবার বানু শীলের প্রাণ কেড়ে নেয় পাক হানাদারবাহিনী। মৃত্যু হয় কিন্তু সৎকার হয় না। মায়ের পরম স্নেহে বেড়ে ওঠা শরীরটা পরিণত হয় শিয়াল কুকুরের খাদ্যে। কেবল বানুচন্দ্র শীল নয়, বুলু রাণী দে আর ফুলু রাণী দের মৃতদেহও হয়ে ওঠে শিয়াল কুকুরের উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ।
মিলনের অনুসন্ধানে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আল শামসদের অভাবনীয় বীভৎসতা যেমন চিত্রায়িত হয়েছে, তেমনি সন্তানবাৎসল্যের মর্ম বিদারী উপাখ্যান আমাদের অনুভূতিকে অসাড় করে দেয়। বাড়িয়া ডাকঘরের রানার ছিলেন সত্যরঞ্জন। সেদিনও সেরে নিচ্ছিলেন সংসারের টুকিটাকি কাজ। আকস্মিক আর্তচিৎকার আর গুলির শব্দে তিনি বিমূঢ় হয়ে পড়েন। গ্রামে মিলিটারি প্রবেশ করেছে। আত্মরক্ষার জন্য নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সময় পথেই গুলিবিদ্ধ হন তিনি। শিশুকন্যাকে তখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাসমৃদ্ধ ইজাজ আহমেদ মিলনের বই কালো অক্ষরের সমষ্টিমাত্র নয়। এই বই আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় একাত্তরের রক্তভেজা দিনে, স্বজনহারা বিরান প্রান্তরে। কালো অক্ষরের আয়নায় আমরা দেখি মুক্তিকামী মানুষের অবিরাম অভিযাত্রার ছায়াচিত্র। আমাদের চোখে ভেসে ওঠে নয় মাসের রক্তাক্ত শিশু বাকেরের মুখ। মৃত-মায়ের স্তন থেকে দুধপানের চেষ্টা করতে করতে সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মৃত মায়ের বুকেই। আমরা দেখি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া হামিদা খাতুনকে চার বছরের বোন মমতাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। বর্বরদের গুলিতে নিহত মা এবং তিন ভাইয়ের শোকে তার বেদনাকাতর মুখ। যে বোনকে বুকে জড়িয়ে খানিকটা হলেও জীবনের প্রতি হামিদার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই বোনটাও যখন ঘাতকের বুলেটে নিথর হয়ে পড়ে, আমরা তখন তার কষ্টকে অনুভব করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলি।
ইজাজ আহমেদ মিলনের সংবেদনশীল পরিভ্রমণ এগোতে থাকে। পাক হানাদারবাহিনীর বর্বরতার স্বাক্ষর প্রত্যক্ষ করে আমরা বিস্মিত হতে থাকি। লোভ, জিঘাংসা, প্রতিহিংসা কতটা প্রবল হলে এভাবে হত্যালীলা চালিয়ে যাওয়া যায়, আমরা তার সীমা খুঁজে পাই না। অগণিত ঘটনার একটিমাত্র চিত্র থেকেই নৃশংসতার ভয়াবহ রূপ উপলব্ধি করা যাবে।
‘এরপর গুলিবিদ্ধ হন বিনোদা রাণী দাস ও তার কন্যা কাজলী। একপর্যায়ে বিনোদার কোল থেকে ছিটকে জলে পড়ে যায় গুলিবিদ্ধ কাজলী। তারপর ঠান্ডা মাথায় সুন্দরী ও নারায়ণকে গুলি করে তারা। এরই ফাঁকে বৃদ্ধা অন্নদা রানী দাস গুলিবিদ্ধ হয়ে নৌকার মধ্যেই লুটিয়ে পড়েন। নৌকার নিচের অংশ ভরে যায় রক্তে। ছটফট করতে করতে নৌকায় থাকা লোকজন মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন।” না, একজনও বাঁচেনি। নরঘাতকের দল বাঁচতে দেয়নি একজনকেও। অন্ধকারের সেই শক্তি শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, জ্বালিয়ে দিয়েছে বসতভিটাও। সেই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় ভরতচন্দ্র দাসের চলৎশক্তিরহিত মা যামিনী বালা।
জুমার নামাজ আদায় শেষে তখনই বাড়ি ফিরছিল আছমত উল্লাহ সরকার। বাড়িয়ার কামারিয়া এলাকার বাসিন্দা হেদায়েত উল্লাহ সরকারের ছেলে। লুটেরাদের দাবিকৃত টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হয় না তার পক্ষে। তিনিও শিকার হন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের।
সেদিন হত্যার যে তাণ্ডব শুরু হয়েছিল, তা কেবল বাড়িয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেই রক্তে ঢেকে গিয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশের শরীর। সেই রক্তের স্রোতে স্বপ্নের অভিন্ন ধারায় মিশে প্রগাঢ় করে তুলেছিল স্বজনহারা মানুষের অব্যক্ত বেদনার রং।
ইজাজের চোখ হয়ে ওঠে আমাদের সকলের চোখ। সকলের দায় কাঁধে নিয়ে তিনি এই প্রজন্মের পরিব্রাজক হিসেবে স্মৃতির গভীর থেকে তুলে আনেন গণহত্যার শিকার শহীদ স্বজনদের পরিচয়। যে পথ আগাছার বিপুল বৃদ্ধিতে বিস্মৃতির কুয়াশায় প্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, তিনি সাহস ও ভালোবাসা দিয়ে উদ্ধার করেন সেই পথের চৌহদ্দির পরিচয়।
যাদের রক্তে অবগাহন করে পরিশুদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ, যাদের আত্মদানের বিনিময়ে মোচন হয়েছে পরাধীনতার গ্লানি, তারা কি হারিয়ে যাবেন? ইজাজ কিন্তু দেখিয়েছেন সময় ফুরিয়ে যায়নি। এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন মুক্তিযুদ্ধের অনেক প্রত্যক্ষদর্শী। কোন এলাকায় কতজন মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, কারা শহীদ হয়েছেন, এলাকাভিত্তিক জরিপ চালালে সেই নামগুলো জানা সম্ভব হতে পারে।
এ গবেষণা একটা পথ খুলে দিয়েছে। জন্ম দিয়েছে আত্মজিজ্ঞাসার। অবহেলা অথবা অসচেতনতার কারণে অবশ্যপালনীয় যে কর্তব্য আজও পালন করা হয়নি, কালবিলম্ব না করে সেই কাজটি শুরু করা দরকার। সিটি করপোরেশন এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে, উপজেলা সদরে অনার বোর্ড স্থাপন করে শহীদ-জীবিত নির্বিশেষে সকল মুক্তিযোদ্ধার নাম লিখতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আমাদের যে ঋণ তা পরিশোধযোগ্য নয়। কৃতজ্ঞতাবোধসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলার স্বার্থেই দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া মানুষগুলোর নাম উদ্ধার করতে হবে। ইজাজ আহমেদ মিলনের ‘১৯৭১ বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং’ এখানে প্রেরণা হিসেবে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, গাজীপুর
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
অধ্যাপক অসীম বিভাকর | ১৫ নভেম্বর, ২০২০ ১৪:৩১
‘আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি। তোমার ভয় নেই মা, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি। মা গো ভাবনা কেন? ’
প্রায়-ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি দুঃশাসনের সমাধি রচনার মধ্য দিয়ে মাকে দেওয়া এই প্রতিশ্রুতি সন্তানেরা সেদিন রক্ষা করেছিলেন। যারা জীবন দিয়ে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা দিয়েছিলেন, যাদের মৃত্যুর বিনিময়ে নিশ্চিত হয়েছিল আমাদের বেঁচে থাকা— আমরা সেই মানুষগুলোকে মনে রেখেছি কতটুকু?
এই দেশের জন্য ত্রিশ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। লুণ্ঠিত হয়েছে দুই লাখের বেশি মা-বোনের সম্ভ্রম। এই পরিসংখ্যান আমাদের প্রত্যেকেরই জানা। ত্রিশ লাখ নয়, ত্রিশ হাজার নয়, তিন শত নয়, এখন যদি ত্রিশজন শহীদের পরিচয় জানতে চাই শতকরা কিংবা হাজারে কতজন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি এমন এক বিপ্রতীপ বাস্তবতায় যেখানে সর্বজনীন স্বার্থের কোনো স্থান নেই; যেখানে পরের কারণে স্বার্থ বিসর্জন বিষয় হিসেবে উপহাসযোগ্য; আত্মকেন্দ্রিকতার চর্চা করতে করতে অগোচরেই যেখানে প্রান্তর থেকে আলো হারিয়ে যায়।
এমন এক বৈরী সময়ে বাস করেও ইজাজ আহমেদ মিলনের মননে জেগে ওঠে মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতার বোধ। এ যেন অকৃতজ্ঞ প্রজন্মের অবশ্যপালনীয় কর্তব্যের ভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া। আমরা যারা দায়িত্বপালনে অপারগতার পরিচয় দিয়েছি কিংবা আত্মপরিচয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছি, তাদের পক্ষ থেকে ইজাজকে অভিনন্দন জানাই।
গবেষণামূলক প্রতিবেদনটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ভালোবাসার যে প্রকাশ দেখিয়েছে দৈনিক মুক্ত সংবাদ, তার জন্য পত্রিকাসংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।
একজন গবেষক একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষিতকে কেন্দ্র করে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আবিষ্কার করেন খণ্ড থেকে অখণ্ডের অনুভব। ১৯৭১ এ সারা বাংলাদেশই পরিণত হয়েছিল মৃত্যু উপত্যকায়। পাকিস্তানি ঘাতকবাহিনীর সর্বগ্রাসী আক্রমণে গোটা বাংলাদেশই হয়ে উঠেছিল বধ্যভূমি। অগণিত বধ্যভূমির অবিরাম কান্নার এক স্রোত স্থির হয়ে আছে গাজীপুর জেলার সদর থানার অন্তর্গত বাড়িয়া ইউনিয়নের বাড়িয়া গ্রামে। সত্যসন্ধানী সাংবাদিক ইজাজ আহমেদ মিলন বাড়িয়ায় সংঘটিত গণহত্যার বিস্মৃতপ্রায় কাহিনিকে তুলে এনেছেন তার সংবেদনশীল প্রতিবেদনে।
যে বাংলাদেশের পরিচয়ে আমার পরিচয় মহিমান্বিত হয়, যে বাংলাদেশ ভালোবাসার ঘুড়ি উড়াবার জন্য আমাকে একটি মুক্ত আকাশ দিয়েছে, যে বাংলাদেশ আমাকে দিয়েছে দিনের শেষে ক্লান্তি নিবারণের পরম আশ্রয়— সেই বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে যেমন বাঙালির স্বজন হারাবার বেদনামথিত ইতিহাস, পাকিস্তানি বর্বরতার অবর্ণনীয় উপাখ্যান; তেমনি আছে অনতিক্রম্য প্রাচীর ডিঙিয়ে সবুজকে স্পর্শ করা সাহস জাগানিয়া বীরত্বগাথা।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী চেয়েছিল পৃথিবীর বুক থেকে বাঙালি জাতির অস্তিত্ব চিরদিনের জন্য মুছে দিতে। সেই জন্য তারা গ্রহণ করেছিল ‘পোড়ামাটি নীতি’। তারা যখন গণহত্যা সংঘটনের নীলনকশা প্রণয়ন করেছে, ভাবতে অসুবিধা হয় না, সেই স্থানটিকে তারা সমগ্র বাংলাদেশ হিসেবেই কল্পনা করে নিয়েছে। ১৯৭১ সালে পাক হানাদারবাহিনী যে কেবল মানবিকতাকেই অপমান করেছে তা নয়, ছাড়িয়ে গিয়েছিল পশুবৃত্তিকেও। ইজাজ আহমেদ মিলনের আঠারোটি ভিন্ন শিরোনামে বিন্যস্ত প্রতিবেদনের সংকলিত রূপ ‘১৯৭১ বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং’ গ্রন্থে যার প্রমাণ সুপরিস্ফুট। মিলনের শিরোনামই জানিয়ে দেয় অন্তর্গত প্রেক্ষাপটের বেদনাবিধুর ভয়াবহতার কথা।
অতর্কিত হামলায় নিরীহ মানুষকে হত্যা করা কোনো নীতির আলোকেই সমর্থনযোগ্য নয়। ১৯৭১ সালের ১৪ মে শুক্রবার বাড়িয়ার মানুষ শিকার হয়েছিল এমনই এক অনৈতিক আক্রমণের। পাক হানাদারবাহিনী এদিন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান নির্বিশেষে হত্যা করেছিল। বাড়িয়া গ্রামকে পরম মমতায় আলিঙ্গন করে আছে যে বেলাই বিল, সেই বিলের জল সেদিন রক্তে রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল।
প্রতিদিনের মতোই সুচিস্নিগ্ধ বাতাসের স্পর্শে সকাল শুরু হয়েছিল বানু শীলের। সূর্যের মুখে ছিল না কোনো অমঙ্গলের আভাস। তবু সেই দিনই সপরিবার বানু শীলের প্রাণ কেড়ে নেয় পাক হানাদারবাহিনী। মৃত্যু হয় কিন্তু সৎকার হয় না। মায়ের পরম স্নেহে বেড়ে ওঠা শরীরটা পরিণত হয় শিয়াল কুকুরের খাদ্যে। কেবল বানুচন্দ্র শীল নয়, বুলু রাণী দে আর ফুলু রাণী দের মৃতদেহও হয়ে ওঠে শিয়াল কুকুরের উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ।
মিলনের অনুসন্ধানে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আল শামসদের অভাবনীয় বীভৎসতা যেমন চিত্রায়িত হয়েছে, তেমনি সন্তানবাৎসল্যের মর্ম বিদারী উপাখ্যান আমাদের অনুভূতিকে অসাড় করে দেয়। বাড়িয়া ডাকঘরের রানার ছিলেন সত্যরঞ্জন। সেদিনও সেরে নিচ্ছিলেন সংসারের টুকিটাকি কাজ। আকস্মিক আর্তচিৎকার আর গুলির শব্দে তিনি বিমূঢ় হয়ে পড়েন। গ্রামে মিলিটারি প্রবেশ করেছে। আত্মরক্ষার জন্য নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সময় পথেই গুলিবিদ্ধ হন তিনি। শিশুকন্যাকে তখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাসমৃদ্ধ ইজাজ আহমেদ মিলনের বই কালো অক্ষরের সমষ্টিমাত্র নয়। এই বই আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় একাত্তরের রক্তভেজা দিনে, স্বজনহারা বিরান প্রান্তরে। কালো অক্ষরের আয়নায় আমরা দেখি মুক্তিকামী মানুষের অবিরাম অভিযাত্রার ছায়াচিত্র। আমাদের চোখে ভেসে ওঠে নয় মাসের রক্তাক্ত শিশু বাকেরের মুখ। মৃত-মায়ের স্তন থেকে দুধপানের চেষ্টা করতে করতে সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মৃত মায়ের বুকেই। আমরা দেখি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া হামিদা খাতুনকে চার বছরের বোন মমতাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। বর্বরদের গুলিতে নিহত মা এবং তিন ভাইয়ের শোকে তার বেদনাকাতর মুখ। যে বোনকে বুকে জড়িয়ে খানিকটা হলেও জীবনের প্রতি হামিদার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল, সেই বোনটাও যখন ঘাতকের বুলেটে নিথর হয়ে পড়ে, আমরা তখন তার কষ্টকে অনুভব করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলি।
ইজাজ আহমেদ মিলনের সংবেদনশীল পরিভ্রমণ এগোতে থাকে। পাক হানাদারবাহিনীর বর্বরতার স্বাক্ষর প্রত্যক্ষ করে আমরা বিস্মিত হতে থাকি। লোভ, জিঘাংসা, প্রতিহিংসা কতটা প্রবল হলে এভাবে হত্যালীলা চালিয়ে যাওয়া যায়, আমরা তার সীমা খুঁজে পাই না। অগণিত ঘটনার একটিমাত্র চিত্র থেকেই নৃশংসতার ভয়াবহ রূপ উপলব্ধি করা যাবে।
‘এরপর গুলিবিদ্ধ হন বিনোদা রাণী দাস ও তার কন্যা কাজলী। একপর্যায়ে বিনোদার কোল থেকে ছিটকে জলে পড়ে যায় গুলিবিদ্ধ কাজলী। তারপর ঠান্ডা মাথায় সুন্দরী ও নারায়ণকে গুলি করে তারা। এরই ফাঁকে বৃদ্ধা অন্নদা রানী দাস গুলিবিদ্ধ হয়ে নৌকার মধ্যেই লুটিয়ে পড়েন। নৌকার নিচের অংশ ভরে যায় রক্তে। ছটফট করতে করতে নৌকায় থাকা লোকজন মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন।” না, একজনও বাঁচেনি। নরঘাতকের দল বাঁচতে দেয়নি একজনকেও। অন্ধকারের সেই শক্তি শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, জ্বালিয়ে দিয়েছে বসতভিটাও। সেই আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় ভরতচন্দ্র দাসের চলৎশক্তিরহিত মা যামিনী বালা।
জুমার নামাজ আদায় শেষে তখনই বাড়ি ফিরছিল আছমত উল্লাহ সরকার। বাড়িয়ার কামারিয়া এলাকার বাসিন্দা হেদায়েত উল্লাহ সরকারের ছেলে। লুটেরাদের দাবিকৃত টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হয় না তার পক্ষে। তিনিও শিকার হন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের।
সেদিন হত্যার যে তাণ্ডব শুরু হয়েছিল, তা কেবল বাড়িয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেই রক্তে ঢেকে গিয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশের শরীর। সেই রক্তের স্রোতে স্বপ্নের অভিন্ন ধারায় মিশে প্রগাঢ় করে তুলেছিল স্বজনহারা মানুষের অব্যক্ত বেদনার রং।
ইজাজের চোখ হয়ে ওঠে আমাদের সকলের চোখ। সকলের দায় কাঁধে নিয়ে তিনি এই প্রজন্মের পরিব্রাজক হিসেবে স্মৃতির গভীর থেকে তুলে আনেন গণহত্যার শিকার শহীদ স্বজনদের পরিচয়। যে পথ আগাছার বিপুল বৃদ্ধিতে বিস্মৃতির কুয়াশায় প্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, তিনি সাহস ও ভালোবাসা দিয়ে উদ্ধার করেন সেই পথের চৌহদ্দির পরিচয়।
যাদের রক্তে অবগাহন করে পরিশুদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ, যাদের আত্মদানের বিনিময়ে মোচন হয়েছে পরাধীনতার গ্লানি, তারা কি হারিয়ে যাবেন? ইজাজ কিন্তু দেখিয়েছেন সময় ফুরিয়ে যায়নি। এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন। বেঁচে আছেন মুক্তিযুদ্ধের অনেক প্রত্যক্ষদর্শী। কোন এলাকায় কতজন মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, কারা শহীদ হয়েছেন, এলাকাভিত্তিক জরিপ চালালে সেই নামগুলো জানা সম্ভব হতে পারে।
এ গবেষণা একটা পথ খুলে দিয়েছে। জন্ম দিয়েছে আত্মজিজ্ঞাসার। অবহেলা অথবা অসচেতনতার কারণে অবশ্যপালনীয় যে কর্তব্য আজও পালন করা হয়নি, কালবিলম্ব না করে সেই কাজটি শুরু করা দরকার। সিটি করপোরেশন এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে, উপজেলা সদরে অনার বোর্ড স্থাপন করে শহীদ-জীবিত নির্বিশেষে সকল মুক্তিযোদ্ধার নাম লিখতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আমাদের যে ঋণ তা পরিশোধযোগ্য নয়। কৃতজ্ঞতাবোধসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলার স্বার্থেই দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া মানুষগুলোর নাম উদ্ধার করতে হবে। ইজাজ আহমেদ মিলনের ‘১৯৭১ বিধ্বস্ত বাড়িয়ায় শুধুই লাশ এবং’ এখানে প্রেরণা হিসেবে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, গাজীপুর