
সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ চলছে। এর মধ্যে ৬৮টি ইপিজেডের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর মধ্য থেকে ২২টির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আগামী তিন বছর ধরে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চালানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
সম্প্রতি প্রকল্পটির বিভাগীয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) থাকা বেশ কয়েকটি বিষয়কে বাদ দিতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন। এর মধ্যে রয়েছে ইপিজেডের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর। কমিশন বলছে, বিদেশ সফরের বিষয়টি এ ধরনের প্রকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বিধায় এটি বাদ দেওয়া যেতে পারে। প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল তিন বছরের পরিবর্তে দুই বছর নির্ধারণ করতে হবে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন সভায় জানান, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেজা দেশের পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করছে। বেজার গভর্নিং বোর্ড দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৬৮টি সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।
বেজার এক কর্মকর্তা গতকাল নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেকোনো একটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে কয়েক হাজার কোটির বিনিয়োগের পরিকল্পনা থাকে। এ জন্য ইপিজেডগুলো এসব বিনিয়োগের জন্য সক্ষম কি না, তার জন্যই এ সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ৭ থেকে ৮টি জোনে এখন সম্ভাব্যতা যাচাই প্রক্রিয়া হবে। অবশিষ্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর জমি অধিগ্রহণ, পানি সরবরাহের নিশ্চয়তা ও পরিবেশের বিষয়টি ভালোভাবে খতিয়ে দেখা হবে।
কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন ধরনের স্টাডি ও মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের পর কয়েকটি এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য এলাকায় পরিকল্পিত অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই, পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন (ইএসআইএ), পুনর্বাসন কর্মপদ্ধতি (আরএপি), জমি অধিগ্রহণ পরিকল্পনা (এলএপি), মাস্টারপ্ল্যান ও পানির সহজলভ্যতা যাচাই সম্পন্ন করা প্রয়োজন। এ জন্য ৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্ভাব্যতা যাচাই, ৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ইএসআইএ, আরএপি, এলএপি, ৩টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন ও ৩টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের পানির সহজলভ্যতা যাচাই সম্পাদনের জন্য ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি, মাস্টারপ্ল্যান ও ওয়াটার অ্যাভেইল্যাবিলিটি স্টাডি ফর ইকোনমিক জোনস অব বেজা’ নামে একটি সমীক্ষা প্রকল্প গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত সমীক্ষা প্রকল্পের মাধ্যমে ভোলা, গোপালগঞ্জ, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, নওগাঁ, নাটোর ও রাজশাহী অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্ভাব্যতা যাচাই, ইএসআইএ, আরএপি, এলএপি সম্পন্ন করা হবে এবং নবাবগঞ্জ ইপিজেডের শুধু সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে। এ ছাড়া, নবাবগঞ্জ, বগুড়া ও নেত্রকোনায় মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন ও নবাবগঞ্জ, মহেশখালী বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (ধলঘাটা) ও মহেশখালীতে (সোনাদিয়া) পানির সহজলভ্যতা যাচাই করা হবে।
প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল প্রস্তাব করা হয়েছে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এই অর্থের মধ্যে রাজস্ব থেকে সংস্থান করা হবে ৪০ কোটি ২০ লাখ এবং মূলধন থেকে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বেজার নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এটি বাস্তবায়নের জন্য সম্মতি দিয়েছে অর্থ বিভাগ।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিনিধি বলেন, প্রস্তাবিত সমীক্ষা প্রকল্পে আরটিকে-টোটাল স্টেশনের (মূলত এটি একটি জরিপ মেশিন) প্রাক্কলিত মূল্য কোন সূত্র, তা উল্লেখ করার কথা বলা হয়েছে।
সভায় দুটি আরটিকে-টোটাল স্টেশনের পরিবর্তে একটি কেনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ক্রয় পরিকল্পনার হায়ারিং ভেহিকলের ক্রয়পদ্ধতি ও ধরন নন-কনসালটিং সার্ভিস (এনসিএস) দেখানো হয়েছে। পিপিআর-২০০৮ অনুসারে এ ধরনের কোনো ক্রয়পদ্ধতি না থাকায় এটি ওটিএম পদ্ধতিতে সংশোধন করতে হবে। এ ছাড়া পরিকল্পনা বিভাগের জারি করা পরিপত্রে তিন মাস অন্তর পিএসসি ও পিআইসি সভা আয়োজনের সময়কাল উল্লেখ করতে হবে।
এ ছাড়া পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি উইংয়ের প্রতিনিধি বলেন, প্রকল্পের আকার অনুযায়ী বাস্তবায়নকাল তিন বছর অতিরিক্ত। এটিকে যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক-১ বলেন, সমীক্ষা প্রকল্প প্রস্তাবে বিভিন্ন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দাখিলকৃত সমীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনাক্রমে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান ও সমীক্ষা প্রতিবেদনগুলোর গুণগতমান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের বিষয়টি ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
আসন্ন রমজান মাসে নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে ঋণপত্র নিষ্পত্তিতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ডিসিসিআই সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার। ২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে ডিসিসিআইর নবনির্বাচিত পরিচালনা পর্ষদের সৌজন্য সাক্ষাতে পণ্য আমদানিতে বিদেশি মুদ্রার সহায়তা চেয়েছেন।
ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, ঘোষিত মুদ্রানীতিতে উল্লিখিত সহায়ক নীতি এবং নির্দেশিকা দেশের বেসরকারি খাতের পাশাপাশি আর্থিক খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করবে। সেই সঙ্গে কৃষি, সিএমএসএমই এবং আমদানি বিকল্প শিল্পের জন্য ৫০ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন প্রকল্প অব্যাহত রাখার উদ্যোগকেও স্বাগত জানান। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেও মনে করেন তিনি।
সামীর সাত্তার বলেন, দেশের সিএমএসএমই খাতের স্বার্থে ঋণসহায়তা প্রাপ্তিতে এবং ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রদানের প্রক্রিয়া সহজীকরণসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে। এ ছাড়া তরুণ এবং উদ্ভাবনী স্টার্টআপগুলোর জন্য ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়াও সহজ করতে হবে; যাতে তারা সহজে ঋণ পেতে পারে। বর্তমান বৈশি^ক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বেসরকারি খাতের অবদান বাড়াতে এ খাতে ঋণ বাড়ানো প্রয়োজন। এ ছাড়া নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) নিয়ন্ত্রণে সুশাসন নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি অভ্যাসগত খেলাপিদের কথা মাথায় রেখে দ্রুত ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণসহ ব্যাংকিং আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পরামর্শ দেন সামীর।
এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি বর্তমানে তিনটি প্রধান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। সেগুলো হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক কর্তৃক সুদের হার বৃদ্ধি এবং চীনের বর্তমান কভিড পরিস্থিতি। তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আমাদের অর্থনীতি বেশ স্থিতিশীল।’ আগামী দু-এক মাসের মধ্যে এলসির বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।
গভর্নর বলেন, ‘আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি মার্জিন ন্যূনতম করাসহ বেশ কিছু নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু নীতিগত পরিবর্তন এনেছে, যার মধ্যে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমাদানের বিধান শিথিল করা, স্থানীয় ব্যাংক কর্তৃক ফি মওকুফ এবং রেমিট্যান্স আহরণে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসকে (এমএফএস) সম্পৃক্ত করা উল্লেখযোগ্য। ফলে সামনের দিনগুলোতে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বৃদ্ধি পাবে।’
আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের কারণে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রান্তিক মুনাফা কিছুটা কমেছে। কোম্পানিটির অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে নিট মুনাফা প্রায় ১৬ শতাংশ কমেছে। কোম্পানিটির তৃতীয় প্রান্তিকের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এমন তথ্য মিলেছে।
বার্জার পেইন্টসের হিসাব বছর শেষ হয় ৩১ মার্চ। গতকাল কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ তৃতীয় প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) অনিরীক্ষিত প্রতিবেদন অনুমোদন দিয়েছে। প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে কোম্পানির পণ্য বিক্রি থেকে আয় বাড়লেও উৎপাদন ব্যয় বেশি থাকায় নিট মুনাফা কমে গেছে। এ সময় বিক্রি, বাজারজাতকরণ, প্রশাসনিক ও সুদবাবদ ব্যয় কমলেও নিট মুনাফা বাড়াতে পারেনি।
বার্জারের হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে পণ্য বিক্রি থেকে আয় হয়েছে ৬৫৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি। তবে এ সময়ে কোম্পানির পণ্য উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে রঙের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। তবে এ প্রান্তিকে পণ্য মূল্য একই হারে বাড়াতে পারেনি বার্জার। ফলে তৃতীয় প্রান্তিকে কোম্পানির মোট আয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমে গেছে।
এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে প্রায় ২৩ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে টাকার। এতে করে শুধুমাত্র টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি ব্যয় একই হারে বেড়ে গেছে। এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের কাঁচামালের দামও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। ২০২১ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে বাজারের বিক্রি থেকে আয়ের ৬৬ শতাংশ ছিল উৎপাদন ব্যয়, যা ২০২২ সালের একই সময়ে প্রায় ৭৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
এ বিষয়ে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের কোম্পানি সচিব খন্দকার আবু জাফর সাদিক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ডলারের বিনিময় হারে এ সময়টাতে সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা দেখা গেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দামও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কিন্তু অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে সে হারে পণ্য মূল্য সমন্বয় সম্ভব হয়নি। ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সর্বশেষ প্রান্তিকে মুনাফা কিছুটা সংকোচন হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে নয় মাসের মুনাফা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে।
বার্জারের চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে উৎপাদন ব্যয় শেষে মোট আয় দাঁড়িয়েছে ১৭৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২১৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। ২০২১ সালের তুলনায় চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে কোম্পানির মোট আয় কমেছে ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে মুনাফা ধরে রাখতে বিক্রি, বাজারজাতকরণ, প্রশাসনিক ও অন্যান্য ব্যয় প্রায় ৮ শতাংশ কমিয়েছে কোম্পানিটি। চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে কোম্পানির পরিচালন মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৮৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকায়, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ কম।
চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে বার্জারের সুদ আয়ও কিছুটা কমেছে। এ সময় করপূর্ব মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৮১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১১১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে কর পরিশোধের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এ সময় কোম্পানিটি কর পরিশোধ করেছে ১৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩০ কোটি ৩১ লাখ টাকা। কর পরিশোধের পর চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৬৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮১ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
এদিকে তৃতীয় প্রান্তিকে নিট মুনাফা কমলেও সার্বিকভাবে হিসাব বছরের নয় মাসে (এপ্রিল-ডিসেম্বর) বার্জারের নিট মুনাফা সামান্য বেড়েছে। চলতি হিসাব বছরের নয় মাসে কোম্পানির নিট মুনাফা হয়েছে ২০৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।
চলতি হিসাব বছরের নয় মাসে বার্জারের বিক্রি থেকে আয় বেড়েছে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ। এ সময়ে পণ্য বিক্রি থেকে আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। উৎপাদন ব্যয় শেষে মোট আয় দাঁড়িয়েছে ৫৪৮ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫৫০ কোটি টাকা। তবে অন্যান্য ব্যয় ও কম কর পরিশোধের কারণে নিট মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বার্জার।
অ্যাক্সেল ভন ট্রটসেনবার্গ বলেছেন, বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। এই যাত্রায় সার্বক্ষণিক জোরালো সমর্থন ও সহযোগিতায় পাশে থাকবে বিশ্বব্যাংক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থানে বিশে^র বহু দেশের জন্য উদাহরণ হিসেবে থাকবে। বহু উত্থান-পতনের পর বাংলাদেশ এ পর্যায়ে এসেছে। এ সময়ে তারা রেকর্ড পরিমাণ দারিদ্র্য কমিয়েছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় উদাহরণ তৈরি করে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করেছে।
বাংলাদেশে তিন দিনের সফর শেষে গতকাল মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেন বিশ্বব্যাংক এমডি। এ সময় ট্রটসেনবার্গ বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঘূর্ণিঝড়ের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করেন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো শুষ্ক আবহাওয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। একই সময় তিনি কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করেন। ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মানবিক আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশকে তিনি ধন্যবাদ দেন।
গত সোমবার ট্রটসেনবার্গ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন। এ সময় তিনি ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সফল নেতৃত্ব দেওয়ায় শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও বাংলাদেশ বেশ কিছু অভাবনীয় পদক্ষেপ নেওয়ায় সফলতার কারণে বিশে^ নেতৃত্ব দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক উপকূলীয় এলাকায় ৭০০ কিলোমিটার বাঁধ তৈরিতে, ১ হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র একই সঙ্গে সেই আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার এবং ৫৫০ কিলোমিটারের বাঁধসহ তার ওপর রাস্তা নির্মাণে গ্রামাঞ্চলের অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটেছে।
বিশ্বব্যাংকের এমডি বলেন, চলমান বিশ্ব সংকটের ঝুঁকি মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ; বিশেষ করে করোনা মহামারীর ধাক্কা কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে এটি বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আট থেকে দশ লাখ টাকা কমে বাংলাদেশেই মিলবে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি হুন্দাইয়ের ‘ক্রেটা’ মডেলের নতুন গাড়ি। এতে ১ হাজার ৫০০ সিসির এই এসইউভি ধরনের গাড়িটির মোট দাম পড়বে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। গতকাল মঙ্গলবার গাড়িটির উদ্বোধন উপলক্ষে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত হুন্দাই থ্রিএস সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে হুন্দাইয়ের এ দেশীয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফেয়ার টেকনোলজি লিমিটেড। এ সময় গাড়িটির বাজারজাতকরণ ও দাম সম্পর্কে জানান প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) মুতাসসিম দায়ান।
ক্রেটা ব্র্যান্ডের নতুন গাড়িটির দাম ৩৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু হবে। এ ক্ষেত্রে একই ধরনের আমদানি করা গাড়ির তুলনায় প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা কম দামে গাড়িটি কিনতে পারবেন গ্রাহকরা। এ ছাড়া হুন্দাইয়ের ক্রেটা গাড়ির ক্ষেত্রে ৩ বছর বা ৪০ হাজার কিলোমিটার মাইলেজের মধ্যে কেউ তার গাড়িটি বিক্রি করতে চাইলে কেনা দামের ৬০ শতাংশ মূল্যে তিনি সেটি বিক্রি করতে পারবেন।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুচলেকা দিয়ে এ কথা বলেছে তারা। সংগঠনটির নেতারা আরও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অংশও হবেন না তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো সম্পর্কেই জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তে তারা বলেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ যেসব নেতা কারাবন্দি রয়েছেন তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এ মুচলেকা দেয় এবং এসব শর্ত বা দাবি জানায়।
আগে হেফাজত নেতারা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তারপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুচলেকা দেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের মুচলেকা দেওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। সরকারের সহযোগী হিসেবে থাকার অঙ্গীকার করেছে হেফাজত।
১৪ দলের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভা-ারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তারা রাজনীতি করবে না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধও হবে না।
হেফাজতে ইসলাম আরও কিছু শর্ত দিয়েছে, যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক) সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে মামুনুল হক এবং আরও কয়েকজনকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে সরকারি মহল। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামুনুলকে ছাড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কাদিয়ানি সম্প্রদায় বিষয়ে হেফাজতের দাবি আপাতত আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে বিদেশি চাপ আসবে। যে চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না বলে হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে। বেফাক ইস্যুতেও আপাতত কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না সরকার। বেফাককে সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মানাও আপাতত অসম্ভব, জানিয়েছে সরকার। তবে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, অন্য শর্তগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে সরকারের বিরুদ্ধে; এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে তাদের। জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে হেফাজতকে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে তারা কোনো ছাড় দেবে না। জামায়াতকে তারা ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে না।
বলা যায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে। এটা একটা ‘পলিটিক্যাল ডিল অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। জানা গেছে, এ সমঝোতার ভিত্তিতেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ২০৩টি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং নেতারা জামিন পেতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় এখনো তদন্ত হচ্ছে ২০৩টি মামলার। অনেক দিন ধরেই তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থাগুলো। হেফাজত নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারেও আছেন। তবে বেশিরভাগ আসামি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
পুলিশের পাশাপাশি হেফাজত নেতারা মামলাগুলো নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এগুলোর নিষ্পত্তি চান। এ নিয়ে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত এক মাসে অন্তত ১০ জন নেতা জামিন পেয়েছেন। তারা যেকোনো সময় কারামুক্ত হবেন। তবে মামুনুল হক আপাতত মুক্ত হচ্ছেন না।
হেফাজত নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। তারা বলেন, এসবের জন্যই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছি আমরা। তবে সমঝোতার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। হেফাজত নেতারা সরকারের অঙ্গীকার করেছে, তারা রাজনৈতিক কর্মকা- চালাবেন না। শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলবেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ের সমালেচনাও করবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা এসেছে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মামলাগুলোর অনেক আসামি জামিনে আছে, কেউ কেউ জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে সবখানে। এগুলোর দ্রুত সুরাহা চাচ্ছি আমরাও।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে তারা। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। সে সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশসহ সহস্রাধিক হেফাজত নেতাকর্মী আহত হয়। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। এসব ঘটনায় সারা দেশে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলার কোনোটাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছিলেন। বৈঠকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের রাজনীতি করি না। ইসলাম নিয়ে কাজ করি। একটি মহল আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, আমরা রাজনীতি করছি না, আর করবও না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। আমরাও চাচ্ছি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমরা গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠক করেছি। তাতে সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট বৈঠক হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। আমাদের শর্তও তাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতা ছাড়া কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। আমরা চাই না সরকারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক। আমরা কথা বলেছি। সরকারপ্রধান ইতিবাচক হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
নাগরিকত্ব বিষয়ক জটিলতার জেরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে দেশের উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ ও পার্লামেন্টে আসন হারিয়েছেন নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী রবি লামিছানে। শুক্রবারের রায়ে আদালত জানিয়েছে, এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকত্বও নেই তার।
সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র বিমল পৌদেল বার্তা সংস্থা এএফপিকে এ সম্পর্কে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় অনুযায়ী, ২০২২ সালের জাতীয় নির্বাচনে নাগরিকত্ব বিষয়ক আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে রবি লামিছানের বিরুদ্ধে। এ কারণে এখন থেকে আর পার্লামেন্টের সদস্য নন তিনি।’
নেপালের এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব রবি লামিছানে দেশটির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ইনডিপেনডেন্ট পার্টির শীর্ষ নেতা। ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর নেপালের পার্লামেন্ট প্রতিনিধিসভার নির্বাচনে তার দল ২০টি আসনে জয়ী হয়েছে। তারপর গত ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন জোট সরকারে নিজের দলসহ যোগ দিয়ে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন লামিছান।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিত্ব ছিল লামিছানের; কিন্তু নেপালের সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বীকৃত না হওয়ায় ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগ করে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। শুক্রবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, নিয়ম অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর নেপালের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার কথা ছিল লামিছানের; কিন্তু তা করেননি তিনি। ফলে এই মুহূর্তে নেপালের নাগরিকও নন লামিছান। এদিকে, শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর লামিছানের প্রতিক্রিয়া জানতে তার মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে গিয়েছিলেন সাংবাদিকরা; কিন্তু লামিছানে তাদের বলেন, ‘যেহেতু এই মুহূর্তে আমি কোনো দেশেরই নাগরিক নই, তাই আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করা আমার পক্ষে উচিত নয়, সম্ভবও নয়।’