জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বিধিতে ‘৫৭ ধারার আছর’
জাবি প্রতিনিধি | ২০ মে, ২০১৯ ১৩:১৪
গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের ব্যাপারে বিধি প্রণয়ন করে ছাত্র-ছাত্রী শৃঙ্খলা বিধিতে নতুন ধারা সংযোজন করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর নতুন সংযোজিত ধারা দুটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন মহলে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
গত ৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় অধ্যাদেশ হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে ধারা দু'টি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিক, অ্যাকটিভিস্ট ও শিক্ষকরা বলছেন, ধারা দু'টির সংযোজনে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চা বাধার সম্মুখীন হবে।
হালনাগাদকৃত অধ্যাদেশের ৫-এর (ঞ) নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনও ছাত্র/ছাত্রী অসত্য এবং তথ্য বিকৃত করে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কোনও সংবাদ বা প্রতিবেদন স্থানীয়/জাতীয়/আন্তর্জাতিক প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমে/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ/প্রচার করা বা উক্ত কাজে সহযোগিতা করতে পারবে না।’
৫-এর (থ) নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনও ছাত্র/ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ছাত্র/ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর উদ্দেশে টেলিফোন, মোবাইল ফোন, ই-মেইল, ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোনও অশ্লীল বার্তা বা অসৌজন্যমূলক বার্তা প্রেরণ অথবা উত্ত্যক্ত করবে না।’
সংশোধিত বিধিতে বলা হয়েছে, ধারা দুটির ব্যত্যয় ঘটলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের চোখে ‘অসদাচরণ’ বলে গণ্য হবে। এ জন্য লঘু শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা, সতর্কীকরণ এবং গুরু শাস্তি হিসেবে আজীবন বহিষ্কার, বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার, সাময়িক বহিষ্কার ও পাঁচ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে যেকোনো পরিমাণ জরিমানার করা হবে।
উদ্বিগ্ন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মীরা ধারা দু'টিকে বহুল আলোচিত বাতিলকৃত তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন।
৫-এর (ঞ) ধারায় উদ্বেগের বিষয় হিসেবে তারা চিহ্নিত করছেন, কোনটি অসত্য কিংবা বিকৃত তথ্য তা কে নির্ধারণ করবে? এটা নির্ধারণ করার ক্ষমতা যেহেতু প্রশাসনের হাতে থাকবে ফলে প্রশাসনের বিরুদ্ধে যায় এমন যে কোন তথ্য বা প্রতিবেদনকেই প্রশাসন অসত্য বলে চিহ্নিত করবে।
৫-এর (থ) ধারা সম্পর্কে তারা বলছেন, অশ্লীল, অসৌজন্যমূলক আচরণের সংজ্ঞা কী হবে এটা যেহেতু বলা নেই, ফলে যেকোনো অপছন্দনীয় আচরণকেই অশ্লীল ও অসৌজন্যতা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে প্রশাসন।
তাছাড়া এ ধারাটা এমন অর্থ তৈরি করে যে, অশ্লীল ও অসৌজন্যমূলক আচরণ কেবল শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। অথচ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকেও তো অশ্লীল ও অসৌজন্যমূলক আচরণ হতে পারে। ফলে এটা শিক্ষার্থীদের জন্য অপমানমূলক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। তাই এর অভ্যন্তরে কি ঘটছে তা জানবার অধিকার জনমানুষের রয়েছে। এ ধরনের আইন প্রণয়ন সেই স্বচ্ছতার পথে পরোক্ষভাবে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। সমাজের অপরাপর প্রতিষ্ঠানের মতো এখানে যখন অন্যায় ঘটে, সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে যদি কোনো ছাত্রছাত্রী প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে খোঁজখবর করতে চান, কিংবা পত্রিকায় কোনো কিছু লেখেন, তাকে এ ধরনের আইনে শাস্তি দেবার, থামিয়ে দেবার আশঙ্কা রয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, 'রাষ্ট্রে ভিন্নমত দমনের যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, এই ধরনের আইন এবং তার প্রণয়ন তারই সম্প্রসারণ বলে মনে করি।'
জাবি সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মাহমুদ উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, ‘সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যে বিধি দুটি যুক্ত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্নীতি, দুর্বৃত্তপনার খবর সাংবাদিকরা যেন প্রকাশ করতে না পারেন সে উদ্দেশ্যেই এ উদ্যোগ। মেগা প্রজেক্টকে সামনে রেখে এমন বিধি প্রণয়ন বিশেষ সন্দেহের উদ্রেক ঘটায়। অবিলম্বে এটি বাতিল করতে হবে।’
সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান বলেন, স্পষ্টত আমরা এখানে কালো আইন ৫৭ ধারার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। অসত্য, বিকৃত, অশ্লীল, অসৌজন্যতা ইত্যাদি কে নির্ধারণ করবে? স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসন নিজের স্বার্থে এগুলো মর্জিমত নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী আইন প্রয়োগ করবে। এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে প্রশাসন তার কর্তৃত্বপরায়ণ চরিত্রের জানান দিচ্ছে। এই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা এমন আইন কখনো মেনে নেবে না।
এদিকে ধারা দু'টি সংযোজনের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদ ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট জাবি শাখা।
উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকায় তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. আমির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ নতুন বর্ষের প্রবেশিকা অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে তাড়াহুড়া করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেখানে সংশোধনের সুযোগ রাখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও পক্ষের আপত্তি থাকলে আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান হতে পারে।’
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
জাবি প্রতিনিধি | ২০ মে, ২০১৯ ১৩:১৪

গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের ব্যাপারে বিধি প্রণয়ন করে ছাত্র-ছাত্রী শৃঙ্খলা বিধিতে নতুন ধারা সংযোজন করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর নতুন সংযোজিত ধারা দুটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন মহলে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
গত ৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় অধ্যাদেশ হিসেবে অনুমোদন পেয়েছে ধারা দু'টি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিক, অ্যাকটিভিস্ট ও শিক্ষকরা বলছেন, ধারা দু'টির সংযোজনে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চা বাধার সম্মুখীন হবে।
হালনাগাদকৃত অধ্যাদেশের ৫-এর (ঞ) নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনও ছাত্র/ছাত্রী অসত্য এবং তথ্য বিকৃত করে বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কোনও সংবাদ বা প্রতিবেদন স্থানীয়/জাতীয়/আন্তর্জাতিক প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমে/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ/প্রচার করা বা উক্ত কাজে সহযোগিতা করতে পারবে না।’
৫-এর (থ) নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনও ছাত্র/ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ছাত্র/ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর উদ্দেশে টেলিফোন, মোবাইল ফোন, ই-মেইল, ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোনও অশ্লীল বার্তা বা অসৌজন্যমূলক বার্তা প্রেরণ অথবা উত্ত্যক্ত করবে না।’
সংশোধিত বিধিতে বলা হয়েছে, ধারা দুটির ব্যত্যয় ঘটলে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের চোখে ‘অসদাচরণ’ বলে গণ্য হবে। এ জন্য লঘু শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা, সতর্কীকরণ এবং গুরু শাস্তি হিসেবে আজীবন বহিষ্কার, বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার, সাময়িক বহিষ্কার ও পাঁচ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে যেকোনো পরিমাণ জরিমানার করা হবে।
উদ্বিগ্ন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মীরা ধারা দু'টিকে বহুল আলোচিত বাতিলকৃত তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন।
৫-এর (ঞ) ধারায় উদ্বেগের বিষয় হিসেবে তারা চিহ্নিত করছেন, কোনটি অসত্য কিংবা বিকৃত তথ্য তা কে নির্ধারণ করবে? এটা নির্ধারণ করার ক্ষমতা যেহেতু প্রশাসনের হাতে থাকবে ফলে প্রশাসনের বিরুদ্ধে যায় এমন যে কোন তথ্য বা প্রতিবেদনকেই প্রশাসন অসত্য বলে চিহ্নিত করবে।
৫-এর (থ) ধারা সম্পর্কে তারা বলছেন, অশ্লীল, অসৌজন্যমূলক আচরণের সংজ্ঞা কী হবে এটা যেহেতু বলা নেই, ফলে যেকোনো অপছন্দনীয় আচরণকেই অশ্লীল ও অসৌজন্যতা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে প্রশাসন।
তাছাড়া এ ধারাটা এমন অর্থ তৈরি করে যে, অশ্লীল ও অসৌজন্যমূলক আচরণ কেবল শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। অথচ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষ থেকেও তো অশ্লীল ও অসৌজন্যমূলক আচরণ হতে পারে। ফলে এটা শিক্ষার্থীদের জন্য অপমানমূলক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় জনগণের অর্থে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। তাই এর অভ্যন্তরে কি ঘটছে তা জানবার অধিকার জনমানুষের রয়েছে। এ ধরনের আইন প্রণয়ন সেই স্বচ্ছতার পথে পরোক্ষভাবে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। সমাজের অপরাপর প্রতিষ্ঠানের মতো এখানে যখন অন্যায় ঘটে, সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে যদি কোনো ছাত্রছাত্রী প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে খোঁজখবর করতে চান, কিংবা পত্রিকায় কোনো কিছু লেখেন, তাকে এ ধরনের আইনে শাস্তি দেবার, থামিয়ে দেবার আশঙ্কা রয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, 'রাষ্ট্রে ভিন্নমত দমনের যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, এই ধরনের আইন এবং তার প্রণয়ন তারই সম্প্রসারণ বলে মনে করি।'
জাবি সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসান আল মাহমুদ উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, ‘সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যে বিধি দুটি যুক্ত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দুর্নীতি, দুর্বৃত্তপনার খবর সাংবাদিকরা যেন প্রকাশ করতে না পারেন সে উদ্দেশ্যেই এ উদ্যোগ। মেগা প্রজেক্টকে সামনে রেখে এমন বিধি প্রণয়ন বিশেষ সন্দেহের উদ্রেক ঘটায়। অবিলম্বে এটি বাতিল করতে হবে।’
সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান বলেন, স্পষ্টত আমরা এখানে কালো আইন ৫৭ ধারার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। অসত্য, বিকৃত, অশ্লীল, অসৌজন্যতা ইত্যাদি কে নির্ধারণ করবে? স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসন নিজের স্বার্থে এগুলো মর্জিমত নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী আইন প্রয়োগ করবে। এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে প্রশাসন তার কর্তৃত্বপরায়ণ চরিত্রের জানান দিচ্ছে। এই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা এমন আইন কখনো মেনে নেবে না।
এদিকে ধারা দু'টি সংযোজনের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদ ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট জাবি শাখা।
উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকায় তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. আমির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ নতুন বর্ষের প্রবেশিকা অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে তাড়াহুড়া করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেখানে সংশোধনের সুযোগ রাখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও পক্ষের আপত্তি থাকলে আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান হতে পারে।’